কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

কালিমাটি অনলাইন / ২০



সম্পাদকীয়



'কালিমাটি অনলাইন' ব্লগজিনের গত ১৯তম সংখ্যা থেকে একটি নতুন বিভাগ শুরু করা হয়েছে -- 'প্রতিবেশী সাহিত্য'। বলা বাহুল্য, এটা কোনো নতুন ব্যাপার আদৌ নয়। দীর্ঘকাল ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় রচিত সাহিত্য অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। হবেও। কিন্তু এখানে যে কথাটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি, আমরা যদি এই বিশাল ও ব্যাপক অনূদিত সাহিত্য সম্ভারের ভাঁড়ার ঘরে উঁকি মারি, তাহলে দেখব, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত মূলত প্রধান প্রধান ভাষায় রচিত সাহিত্যেরই অনুবাদকর্ম হয়েছে। তাও বিশ্বের অধিকাংশ অন্যান্য প্রধান প্রধান ভাষাতেও নয়, কিছু কিছু ভাষায়। আর যে সব অপ্রধান ও আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে সারা বিশ্বে, তা অনুবাদের হাত ধরে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার পাঠক-পাঠিকাদের কাছে এখনও পৌঁছতে পারেনি। আমরা জানি না, সেইসব সৃষ্টির মধ্যে হয়তো কত মহান সৃষ্টি আছে, যা এখনও পর্যন্ত অসূর্যস্পর্শা থেকে গেছে। আর তাই আমরা একান্ত আগ্রহী, সেইসব আঞ্চলিক ও প্রায় উপেক্ষিত ভাষায় রচিত সাহিত্য অনূদিত হয়ে  বিশ্বের উদগ্রীব পাঠক-পাঠিকাদের দরবারে হাজির হোক। আমরা সেই সাহিত্য পাঠ করে তার রসস্বাদন করব, আরও শিক্ষিত হব, ঋদ্ধ হব।

'কালিমাটি অনলাইন'এর গত ১৯তম সংখ্যায় এবং সাম্প্রতিক ২০তম সংখ্যায় 'প্রতিবেশী সাহিত্য' বিভাগে দুজন কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ছবি ও তাঁদের মূল কবিতা সহ অনূদিত কবিতা প্রকাশ করেছি। এই দুজন কবিই স্প্যানিশ ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন। আমরা জানি যে, স্প্যানিশ ভাষা এই বিশ্বের একটি অন্যতম প্রাচীন, প্রধান ও সমৃদ্ধ ভাষা। এই ভাষায় অনেক মহান সাহিত্যকর্ম সৃষ্ট হয়েছে। এই প্রাসঙ্গিকতায় শ্রীমতি জয়া চৌধুরীকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তিনি স্প্যানিশ ভাষার চর্চা দীর্ঘদিন করছেন এবং এই ভাষার শিক্ষকতাও করেন। সেইসঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা থাকার দরুন অনুবাদকর্মেও রীতিমতো পটু। বস্তুত তাঁরই আগ্রহে আমাদের 'প্রতিবেশী সাহিত্য' বিভাগের কাজ ত্বরাণ্বিত হয়েছে।

আমাদের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারাও অনুবাদের কাজে আপনাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই আপনারা বসবাস করুন না কেন, নিজের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য যে সব ভাষাতে দক্ষতা অর্জন  করেছেন, সেইসব ভাষায় রচিত সাহিত্য বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে পাঠিয়ে দিনএবং শুধুমাত্র কবিতা নয়, ছোটগল্প-প্রবন্ধ-নিবন্ধ-আলোচনা-সমালোচনা-রম্যরচনা,  সবই পাঠাতে পারেন। লেখার সঙ্গে অতি অবশ্য লেখকের ছবি ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠাবেন। এবং সম্ভব হলে মূল লেখাটির প্রতিলিপি। আমরা আরও উল্লসিত হব, যদি বিশ্বের তাবড় তাবড় ভাষায় রচিত সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি সেইসব স্থানে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ পাঠাতে পারেন।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি, সাহিত্যের আঙিনায় আমরা দেশ ও বিদেশ বলে কথিত কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডকে গুরুত্ব দিই না। সাহিত্যে আমাদের কাছে কোনো বিদেশ নেই, সবটাই স্বদেশ। আর তাই আমাদের কাছে স্বদেশী ভাষা বা বিদেশী ভাষা বলেও কিছু নেই। আমরা একদিকে যেমন নিজের মাতৃভাষাকে প্রচন্ড ভালোবাসি ও শ্রদ্ধা করি, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বে প্রচলিত সব ভাষাকেই ভালোবাসি, সম্মান করি এবং প্রতিবেশী ভাষার মর্যাদা দিই।

আপনাদের কাছে সেইসঙ্গে নম্র নিবেদন, 'কালিমাটি অনলাইন'এর যে কোনো বিভাগের জন্য লেখা পাঠাতে পারেন। কিন্তু লেখা অতি অবশ্যই শুধুমাত্র বাংলা ফন্ট অভ্রতে কম্পোজ করে ওয়ার্ড ফাইলে পাঠাবেন। সবাই ভালো থাকবেন।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675                                                          
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Parvati Condominium, Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India
     

<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১) অমিতাভ প্রহরাজ




দেশী বাবু,ইংলিশ মেম


অর্পিতা দাস প্রহরাজের সাথে আমার একটা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা নিয়ে আর্টিকেলের নিচে একটা ইন্টারেস্টিং কথোপকথন হলো।। যেটাকে আলাদা করে তুলে রাখা জরুরী মনে হলো... প্রবন্ধের শুরুতে আমি বলেছিলাম, বাংলা ভাষায় যতটা বিস্তার ও বহুমাত্রায় প্রকাশ করা যায়, তা ইংলিশে সম্ভব নয়। এর কারণ লেখকের নয়, দুই ভাষার চরিত্রগত পার্থক্য। ইংলিশ লোগোসেন্ট্রিক ল্যাংগুয়েজ এবং বাংলা ভার্বসেন্ট্রিক বা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা, যে কোনো ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় শব্দ অর্থের পরিসীমা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে যেটা লোগোসেন্ট্রিক ল্যাংগুয়েজে সম্ভবপর নয়। অর্পিতা ইংলিশের খুবই মগ্ন ছাত্রী, তাই প্রবন্ধের শুরুতে ইংরেজি ভাষা নিয়ে আমার বলা কথাগুলো তার কাছে ভালো না লাগার জন্ম দিয়েছে... আমি সেজন্য দুঃখিত... হয়তো কোনো ভাষা সম্পর্কে এতটা কর্কশভাবে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা ঠিক নয়। তাই আমি একটা কথা অর্পিতার কাছে এবং অন্য পাঠকদের কাছেও স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমি কখনই কোনো ভাষার বিরোধী নয়। কোনো ভাষাকেই ছোট চোখে দেখা যায় না, জুলু বা সোয়াহিলিও নয়। সেখানে অর্ধেক পৃথিবী কথা বলে যে ভাষায়, সাধারণ আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে যে ভাষা স্বীকৃত, তাকে আমি কোন্‌ সুমহান জলহস্তী এসে উপস্থিত হলাম যে, ঘটি ডোবে না বিদ্যের লচক মচক দিয়ে তাকে এক্কেবারে নস্যাৎ করে দেব! আমি কি আন্তর্জাতিক মানের পাগল, না ফ্রেঞ্চকাট রামছাগল? তার ওপর যে ভাষায় আমার গুরুদেব (ব্যাপ্টাইজড-এর মতো সাহিত্যজীবনের শুরুতেই যিনি আমাকে একলব্যাইজড করে রেখেছেন আজীবনের মতো) জেমস আগস্টাইন আলোসিয়াস জয়েস মহাশয় কলমকারি করেছেন, সেই ভাষাকে আমি কি করে এক কথায় ঘ্যাচাং করে দিতে পারি?! যে ভাষাতে আমার প্রিয়তম দোস্ত ও দুশমন এবং আমার মতে ভাষা দ্বারা ক্রিয়েটেড পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্রিয়েশানটি ইউলিসিস রয়েছে তাকে ছোট দেখানোর কোনো উদ্দেশ্যই নেই। আমি শুধু পার্থক্যগুলো দেখাতে চেয়েছি যা আমাদের মাতৃভাষার আচার আচরণ বুঝতে অনেকটা সাহায্য করবে। পটচিত্র মায়াবী হয়ে ওঠে, তাকে যে প্রেক্ষাপট ধারণ করে আছে, তার জন্য।
লেখাটি কথোপকথনের রূপটিই বজায় রাখা হয়েছে, কারণ এতে একটি সাহিত্যমতভেদ থেকে উদ্ভূত তর্ক কীরকম প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ও নিজস্ব চরিত্র তৈরি করে, তার আভাস পাওয়া যাবে। তো অর্জ করা হলো...

Arpita Das Praharaj boroder majhe ekta chhotto kotha boli... Amitava tui je prothome bolli je English-e 'Noun' er dadagiri chole r Bangla-te 'Verb' er dadagiri...seta kintu thik holo naa... actually, Bangla-te, alike Sanskrit, both Noun & Verb change hoe jae according to grammatical usage...jemon (Bari_house, Bari-te_in the house, Bari-r_of the house). English e eta hoe na...sekhane exta words use korte hoe... (like...'in' 'of' 'by' etc.) etake bole Declension in case of Noun & Conjugation in case of Verb( eg. - korchhi, korlam, korbo, 'kora' verb ta ichchhe moton change hoe jachchhe...English e jeta hoe na)...eta prachin Latin eo same...as Latin & Sanskrit are sister languages...Sanskrit eo achhe na..? Noro, Norong, Norah...(crudely bollam, as ami Sanskrit janina...samanyo Latin jani...tai bollam) English khub simple language...tai language e juktakkhor khub ekta nei...but English is one of those rare languages jatey maximum stock of adjectives achhe...je kono jinish prokash korar exact 'word' English e pawa jae... sob language e pawa jae na... r ekta kotha ekdom amar moner moto bolechhis...Word dekhe tar baba-maa-r porichoy pawa jae...sotyii..je kono word dekhe tar etimology bujhte para jae...eta darun mojar jinish...tar baba, thakurda...thakuma (tini hoyto pasher rajyo theke esechhen...tai ektu alada dialect use koren)...eta darun lagey bujhte... Actualyy language is an 'Audio-visual' medium...ete visual achhe (alphabets /characters)... er ekta sound o achhe (pronunciation)..mojar byapar na?

23 hrs · Like · 4 · Reply

·

জুয়েল মাজহার প্রমিথিউস বাউন্ড

22 hrs · Like · Reply

·

Amitava PraharajArpita Das Praharaj... ইংলিশ লোগোসেন্ট্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ, সেখানে ভার্ব নাউন ছাড়া অচল... খুব সহজ একটা জিনিস দিয়ে বলি। বাংলায় বিশেষ্য ছাড়া, বিশেষণ ছাড়া, অব্যয় ছাড়া (যা ইংরেজি কাউন্টারপার্ট প্রিপোজিশান), শুধুমাত্র ভার্ব এবং একমাত্র ভার্ব দিয়েই একটা এক্সপ্রেসান তৈরি করা যায়। ধর একটা বাক্য "হচ্ছে, হচ্ছে, হচ্ছে, হচ্ছে, হচ্ছে এ এ এ এ, হবেই। হতেই হবে।"... তুমুল এক্সপ্রেসিভ বাক্য... ইংরেজি ভাষার ক্ষমতা নেই এই বাক্য তৈরি করার... শুধুমাত্র ভার্ব এবং ভার্বের টেন্স দিয়ে একটা ফুল ফ্লেজেড এক্সপ্রেসান তৈরি করার ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই ইংরেজি ভাষাতে... সেখানে রান রান বললে একটা লোলা আনতে হয় কমপ্লিট করার জন্য... ইংলিশ সাবজেক্ট প্রেডিকেট ছাড়া এক্সপ্রেসান কমপ্লিট করতে পারে না... এই সাবজেক্ট প্রেডিকেট ডিভিসান একটা ভার্বাওকে লিমিটেড করে দেয়, তার চৌহদ্দি হচ্ছে প্রেডিকেট, আর তার মালিক হচ্ছে সাবজেক্ট... "দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে পেলাম"। এই বাক্যের লিমিটলেসনেস কোনো লোগোসেন্ট্রিক ল্যাংগুয়েজ ক্রিয়েট করতে পারে না। বিজ্ঞানের নিয়মেই পারে না...। আর ল্যাটিন আর সংস্কৃত সিস্টার ল্যাংগুয়েজ, সংস্কৃত থেকে বাংলার উৎপত্তি এগুলো খুব মূর্খের মতো মিথ... জার্মান এয়ারলাইন্সের নাম লুফতহান্সা, আর সংস্কৃত লুপ্তহংস, এই মিল দেখে অনেকে মহা উল্লাসে কনক্লুড করে, জার্মান আর সংস্কৃত এক বাপের ছেলে...। এগুলো অর্ধজানার ফলে তৈরি হওয়া ধারণা... প্রো ইন্দো ইউরোপিয়ান গ্রুপ অফ ল্যাংগুয়েজের ভাগ... ইন্দো ইরানিয়ান, হেলেনিক, ইটালিক, সেল্টিক, বাল্টো স্লাভিক, জার্মানিক... এবার ইন্দো ইরানিয়ানের নাতি হলো বাংলা... প্রথমে ইন্ডিক ত্যারপর সেল্টিক, তারপর তার থেকে বাংলা... এবার কমপ্লিটলি অন্য জঁর, ইটালিক থেকে জন্ম নেয় ল্যাটিন... বেসিক ডিভিসানটা দেখাচ্ছি...




17 hrs · Like · 3 · Reply

·

জুয়েল মাজহার দারুণ অমিতাভ

17 hrs · Unlike · 1 · Reply

·

Amitava PraharajArpita Das Praharaj ইংলিশ লোগোসেন্ট্রিক ল্যাংগুয়েজ বলে বিরাট স্টক অফ এ্যাডজেক্টিভ থাকলেও, বিশেষ্য বা নাউন বা সাবজেক্ট ছাড়া অচল... এবং ল্যাংগুয়েজ খুব রিজিড হয়ে যায়... কিন্তু বাংলায় শুধুমাত্র বিশেষণ ও ভার্ব দিয়ে তুই এক্সপ্রেসান তৈরি করতে পারবি যা ইংলিশে অসম্ভব। "ব্যাপক, দারুণ, তুমুল, ফাটিয়ে বললে"...... এটা ইংলিশে সম্ভব নয়, একটা ইউ বা সেয়িং বা স্পীচ বা ম্যানার আনতে হবেই, বাধ্য... আর বিশেষ্য হলো ইঁট... তাই ইংলিশে নাউনলেস সেনটেন্স এ্যাবসার্ড হয়ে যায়... জয়েস এটাকে ব্যাপক কাজে লাগিয়েছেন ফিনেগান'স ওয়েকে... তুলকালাম... নর নরৌ নরাঃ আর করছি করলাম করবো'র মধ্যে পার্থক্য হলো hoarse ar whores এর মধ্যে পার্থক্যর মতো... একটা ক্রিয়াবিভক্তি আর আরেকটা ধাতুরূপ...। ভালো করে বোঝ, বাংলায় একটা ক্রিয়ার ফর্মেশান করতে গেলে তার সাথে স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্ব নেই, এমন ধ্বনি প্লাগিন ফিট করতে হয়... আর সংস্কৃতে নিউটন'স ল'এর মতো ধাতুরূপ আছে। ষষ্ঠী তৎপুরুষে কী হবে একদম ক্লিয়ার ডিফাইন করা আছে... কোনো কিছু এ্যাটাচ করতে হয় না, জাস্ট সূত্র মনে রাখতে হয়... ডিটো ইংলিশ, প্রেজেন্ট কন্টিনুয়াস হলে আই এন জি যোগ হবে... সোজাসাপটা কথা... কিন্তু বাংলায় ঘটমান বর্তমান এক লক্ষ উপায়ে প্রকাশ করা যায়... তুমি খাচ্ছো, তোমার খাওয়া হচ্ছে, তোমার খাদ্যগ্রহণ চলছে, তুমি একটা খাদ্যগ্রহণ করছো......। আরো কত কি!

17 hrs · Like · 1 · Reply

·

Amitava Praharaj থাংকু জুয়েলদা

17 hrs · Like · 1 · Reply

·

Amitava Praharaj বোঝ, বাংলায় ভার্ব আর নাউন কখনোই চেঞ্জ হয় না সংস্কৃতের মতো... বাংলায় যা হয় তা হচ্ছে নাউনের ভার্বাইজেশান হয় আর ভার্বের নাউনাইজেশান হয়... সেটা কোনো উপসর্গ, বিভক্তি, যোগ করে হয় না। যে উদাহরণ তুই দিয়েছিস, বাড়িতে, বাড়ির, বাড়িকে... এগুলো তো বিভক্তি ব্যবহারের উদাহরণ মাত্র... কিশলয়, সহজ পাঠের ব্যাপার... বাংলা ভাষা আমাকে এতটাই ইনফিনিটি দেয় নাউন ও ভার্বের ইন্টারট্রান্সফর্মেশানে যে আমি অনায়াসে বলতে পারি... "বহুদিন বাইরে বাইরে বেড়ানো হলো, এবার মন বড্ড বাড়িপনা করতে চাইছে / এবার একটু বিশুদ্ধ বাড়িবাজি হোক"...... অথবা "কতদিন থেকে সকালবেলা জগিং করছি একা একা, আমার নানান জগেরা একটা দৌড়োনোর মতো দ্রুত ও ঘামায়িত জীবনের মতো নড়তে চায়।" এগুলো শিফট নয়, মিউটেশান... শুঁয়োপোকা থেকে রাতারাতি প্রজাপতি... ইংরেজিতে মিউটেশান হয় না, এ্যাডাপটেশান বা অভিযোজন করে ইভোলিউওশান বা বিবর্তনের পারমিশান পাওয়া যায়...

অনেক ব্যাপারেই disagree করছি... ইংলিশে তুই একটা শব্দ দিয়ে intensely express করতে পারিস না বলে, একটা শব্দ দিয়ে এক্সপ্রেস করা যায় না, এটা ভুল। Recently আলোচ্য Hamlet এর ‘Words, words, words…’ পড়িসনি? এটা নিয়ে কিছু লোক সারা জীবন ধরে রিসার্চ করে... depth of expression আছে বলে নিশ্চয়ই! নেক্সট টাইম ওপেন ফোরামে কাউকে ‘মূর্খ’ বা ‘অর্ধ জানা’ বলার আগে একটু পড়াশোনা করে নিবি, ও কে? According to the chart u have urself provided here, Sanskrit and Latin are clearly showing as Sister languages. মাদার যদি এক হয়, তাহলে তো এরা সিসটার হবেই! আর language er sisterhood determined hoy according to its structure. তুই নিশ্চয়ই জন্মের বংশ লতিকা দেখার মতো এটাকে দেখছিস না! বাংলায় যেভাবে Declension and Congujation হয়, সেটা সংস্কৃত আকা ল্যাটিন-এর সাথে হুবহু মেলে। ‘Verbisation’ and ‘Nounisation’ are Wrong words. এটা তুই কবিতায় ব্যবহার করতে পারিস... এখানে কাজে লাগবে না। যে কোনো ভাষায় বহু নাউন ভার্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বহু ভার্ব নাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়... seta ‘verbisation’ ba ‘nounisation’ na. বাড়িপনা বা বাড়িবাজি... এগুলো colloquial usage. তোর বোধহয় America ba London, বা যে কোনো ইংলিশ স্পিকিং লোকের সাথে আলাপ নেই, না? এরকম কারোর সাথে কথা হলে দেখবি... ওরাও এরকম স্মার্ট ল্যাঙ্গোয়েজে কথা বলে... হ্যাভ ইউ ‘বোঝাফাইড’ দিস? আর তুই তো স্কুল, কলেজে ডিবেটে খুব ভালো ছিলি বলে জানতাম, তাহলে ডিবেট করার সময় এত ফালতু, useless, verbose শব্দ use করিস কেন? এরকম ডিবেট করলে তো ফার্স্ট রাউন্ডেই স্টেজ থেকে নামিয়ে দেওয়ার কথা! একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি সবসময় একটা আলোচনার সেরা পয়েন্টসগুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। আমি আমার পোস্টে বলেছিলাম language is an audio-visual medium… কী দারুণ thought এটা। আসলে তুই যে ভাষার intrinsic depth নিয়ে বলছিলি, সেটারই সূত্র ধরে আমি বলছিলাম। যে কোনো জায়গায়, মানুষ কীভাবে কথা বলে, কি খায়, কি কি করে, ওখানকার ক্লাইমেট কেমন... এই সব রিফ্লেক্ট করে একটা ভাষায়। Language actually reflects the ‘Ethos’ of a particular region. এটা নিয়ে যত পড়াশোনা করা যায়, তত সুন্দর বোঝা যায়... খুব মজার এটা। And next time you post a comment, please be a little more ‘professional’ and ‘specific’… …okay?

রাগিনী সাজেশানস-

বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড খচে গেছিস। এবং সেইরকম রাগ যা ভালো না লাগার বাতাবরণ তৈরি করে। যাতে রাগটা আরো খুঁচিয়ে না খারাপ হয়ে ওঠে সেইজন্যই সকালবেলা ইচ্ছে করেই উত্তরটা দিইনি। অন্তত একটু শান্ত হোক। মানুষকে আনপ্লেজান্ট অনুভূতি সরবরাহ করে কোনোদিনই কোনোরকম ক্রিয়েটিভ এ্যাকটিভিটি সম্পন্ন হতে পারে না। লেখা তো ঘটতেই পারে না। কারণ যে কোনো লেখাই একটা ইমেন্স পজিটিভ ফোর্স। একবিন্দুও নেগেটিভিটি থাকলে লেখা দাঁড়ায় না। তোকে কিছু সাজেশান দিতে চাই, একটু ঠান্ডা মাথায় শোন। একজন সিনিয়র লেখক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। প্রথমতঃ মতান্তর বা মতবিরোধ কখনোই একটা খারাপ ব্যাপার বলে দেখিস না। আমি যেমন তর্ক বা মতবিরোধ হলে ব্যাপক খুশি হই, কারণ আমি জানি, তার মানে ওর থেকে আমার একটা লেখা তৈরি হবে। আর তোর মতের সাথে কেউ ভিন্নমত হলে রাগ কেন হবে, কৌতূহল হওয়া উচিত। রাগ কোনোভাবেই একটা ক্রিয়েটিভ ইমোশান নয়। আর রাগ হলেও তাকে কোলে বসিয়ে লিখতে নেই কখনো। যতক্ষণ না যুক্তিবোধ ফিরে আসছে, কলম ছুঁতেই নেই। কারণ সাইকো লিংগুইস্টিক্স অনুযায়ী কোন্নো ইমোশানের সোমাটিক নেচার তার থেকে ক্রিয়েটেড ল্যাংগুয়েজে প্রচ্ছন্ন থাকে। কেউ যদি রেগে গিয়ে জিনিসপত্র ছোঁড়ার অভ্যেস থাকে, তাহলে দেখা যাবে তার লেখার বাক্যগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া, শব্দগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারা। দ্যাখ রাগ তোকে দিয়ে কী লিখিয়েছে “হ্যাভ ইউ ‘বোঝাফাইড’ দিস? আর তুই তো স্কুল, কলেজে ডিবেটে খুব ভালো ছিলি বলে জানতাম, তাহলে ডিবেট করার সময় এত ফালতু, useless, verbose শব্দ use করিস কেন? এরকম ডিবেট করলে তো ফার্স্ট রাউন্ডেই স্টেজ থেকে নামিয়ে দেওয়ার কথা!” এটা তো তোর মতো একজন ট্যালেন্টেড লেখকের কাছে মোটেও অভিপ্রেত নয়! এটা তোর অস্ত্র কেন হবে? সেন্স অফ হিউমার, উইট, শ্লেষ, ব্যাঙ্গ, পৃথিবীতে এই জিনিসগুলো থাকতে থাকতে! আরো দেখ, রাগের ফলে তুই এ্যাকচুয়াল কনটেক্সট থেকে ছিটকে চলে গেছিস এবং এতটাই বেকন্ট্রোল হয়ে গেছে লেখা যে, তুই লিখছিস আমি আমার পোস্টে বলেছিলাম language is an audio-visual medium… কী দারুণ thought এটা। মানে তুই নিজেই নিজের লেখাকে ভালো বলছিস!!! খেয়ালই করিস নি! এগুলো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে একজন ট্যালেন্টেড লেখককে সাজেশান দিলাম, আশাকরি তার মন খারাপ হবে না। তবে এই বারে তুই যা যা বলেছিস, প্রত্যেকটিই ভুল ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া। এত কনফিডেন্টলি কী করে বলছি, পুরো লেখাটা পড়লে বুঝতে পারবি।



কন্ট্রা নামক ডিকশান-

এবং যে কোনো মতবিরোধের বেস্ট পার্ট হচ্ছে, মতবিরোধ আরো একটু পড়াশুনো করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। প্রথম প্রত্যুত্তরের থেকে দ্বিতীয় প্রত্যুত্তর যদি কন্সেপচুয়ালি এবং ইনফর্মেশান অনুযায়ী বেটার না হয় এবং আরো নতুন না হয়, তার মানে তর্ক কোনো নতুন সিদ্ধান্তের দিকে জার্নি করছে না, হচ্ছে তর্ক ফর দ্য সেক অফ তর্ক বা ইগো ইনজ্যুরিতে ভলিনি লাগানোর জন্য চলছে... গতকালের আপত্তিপুঞ্জের পরে নব আপত্তিতে জাগা আজকের মন্তব্য থেকে টেক এ্যাওয়ে কিছু পেলাম না। বরং কয়েকটা অতি হাস্যকর ভুল ধারণা প্রকট হলো। এই মন্তব্য থেকে যে যে পয়েন্টগুলো পাওয়া গেল--



শব্দ এক্সপ্রেস / শব্দ লোক্যাল-

a) ইংলিশে তুই একটা শব্দ দিয়ে intensely express করতে পারিস না বলে, একটা শব্দ দিয়ে এক্সপ্রেস করা যায় না, এটা ভুল। Recently আলোচ্য Hamlet এর ‘Words, words, words…' (নাঃ, একটা শব্দ দিয়ে এক্সপ্রেস আমি বলিনি। একটা কেয়ারফুলি পড়লে দেখতে পেতিস আমি বলেছি শুধুমাত্র ভার্ব বা ক্রিয়াপদ দিয়ে বাক্য। এটা ইংরেজির বাবার ক্ষমতা নেই করার। আর সিংগল ওয়ার্ড এক্সপ্রেসান বলতে বলেছি, একটা শব্দ একবার। এই ক্যাম্পাসে ইংরেজির ক্যারদানি ও floccinaucinihilipilification অবধি। তাও যার অর্থের মধ্যে এক্সপ্রেশান নেই, ডেফিনেশান আছে কোনো কিছুর। আর বাংলার ভাঁড়ার ঘরে আছে “দ্বিধাথরোথরোআঁখি”... এনাকে ভাষান্তর করতে গেলেই ইংলিশবাবু প্রায় প্যারাগ্রাফ নিয়ে ফেলবেন। একটা শব্দ বার বার বলে গেলে তো এক্সপ্রেসান হবেই। তার জন্য বেচারা সেক্সপিয়ারেকে ডাকার কি দরকার ছিল??? এ তো রামপেয়ারেও জানে যে আমি যদি তোকে “গাধা” “গাধা” “গাধা” “গাধা” গাধা” “গাধা” একটানা বলে যাই (অবশ্যই ইংলিশে) তাহলে তুইও “তোর গাধায় ফুটো” বলে এক্সপ্রেস করে ফেলবি (এটাও ইংলিশে)।


মা-বোন তোলার পরে-

b) “According to the chart u have urself provided here, Sanskrit and Latin are clearly showing as Sister languages. মাদার যদি এক হয়, তাহলে তো এরা সিস্টার হবেই” –

এটা একটু ডিটেলে বলি--

এই প্রসঙ্গে একটু মাদার ল্যাংগুয়েজ আর সিস্টার ল্যাংগুয়েজ-এর কেসটা বুঝিয়ে বলি... প্রোটো- ইন্দো-ইউরোপীয়ান নামক একটি বিটকেল ভাষা (তখনো ফুল ভাষায় ফর্ম হয়নি, ডাক আর ভাষা মিক্সড) ৩০০০ বি সি তে ব্ল্যাক সীর উত্তরে একজন কেভম্যানের হাতে তলপেটে ঘুঁষি খেয়ে চার টুকরো হয়ে গেছিল... একটা টুকরোর নাম ছিল এ্যানাটোলিয়ান। এ্যানাটোলিয়ান ছিল এক রহস্যময় ভাষা, এখন তুর্কের সামান্য ছিটেফোঁটা ছাড়া বাকি সমস্তটাই অবলুপ্ত হয়ে গেছে। যার মধ্যে তুমুল মিস্টিরিয়াস Hittie আর Phrygian (পরে কখনো এই ভাষা দুটো নিয়ে আলোচনা করবো। কীভাবে রাতারাতি লোপাট হয়ে গেল দুটি ভাষা)। এবার আরেক টুকরো যেটা প্রাচ্যের দিকে হাঁটছিলো তারা নিজেদের তিনভাগে ভাগ করে নিল। ইন্দো-ইরানিয়ান, তোচারিয়ান এবং আর্মেনিয়ান। একটা ছোট্ট খন্ড ইউরোপের দিকে ছিটকে পড়েছিল। যেখান থেকে গ্রীক, বাল্টিক আর রাশিয়ান তৈরি হলো। ইউরোপের পশ্চিম দিকে যে টুকরোটা গেছিল সেটা ভাগ হলো না, বরং চেঞ্জ হয়ে গেল জার্মানিকে। ওখানে ইটালিক বলে যে টুকরোটা ছিল তার অনেকগুলো মেয়ে হয়েছিল, যার মধ্যে ল্যাটিন একটা... এই ল্যাটিনের বাকি যত বোন ছিল, সবাই মরে গেছে। ল্যাটিনের মেয়ে হলো French, Spanish, Italian -- যারা তিনবোন। আবার এদিকে বৈদিকের সংস্কৃতের মেয়ে ক্লাসিকাল সংস্কৃত, যার মেয়ে হলো হিন্দি উর্দ্দু, গুজরাটি, সিংহলি অর্থাৎ এইসব বোনেরা। (অবশ্য একটা ফর্মূলায় তুই প্রমাণ করতে পারিস সংস্কৃত ল্যাটিনের বোন, কারণ ল্যাটিনের সব বোন মারা গেছে আর সংস্কৃতও মারা গেছে। মরে যাওয়া মরে যাওয়া কাটাকুটি করে দিলে। ল্যাটিন সংস্কৃতের বোন)। ওই যে আদিম প্রোটো ইন্দো ইউরোপীয়ান ছিল, ওকে বলা হয় কমন মাদার। এবার মন দিয়ে শোন, এই প্রোটো ল্যাংগুয়েজের বেশ কিছু শব্দ যেসব ভাষাগুলো চেঞ্জ সবচেয়ে অল্প হয়েছে, তাতে ধ্বংসাবশেষ হিসেবে জমে থেকে গেছে। ফলে সংস্কৃত, ল্যাটিন, জার্মানে আমরা কমন কিছু শব্দ দেখতে পাই, আর এর থেকে কিছু উদগাণ্ডু ধারণা জন্মায়। যেমন ১) যে সংস্কৃত থেকে ল্যাটিন শব্দ ধার নিয়েছে এবং ভাইসি ভার্সা ২) আসলে সংস্কৃত ল্যাটিন আর জার্মান একটাই ভাষা শুধু জিওগ্রাফির জন্য বদলে গেছে ৩) আর্যরা ইউরোপ থেকে এসেছিল এদিকে, আসার সময় ব্যাগে কিছু ল্যাটিন কিছু জার্মান ঢুকিয়ে নিয়ে এসেছে। ৪) গ্রীক দেবতারা আসলে হিন্দু দেবদেবীদেরই মডিফায়েড রূপ। একে সাপোর্ট করার জন্য কিছু মজার গল্পো আছে। যেমন বলা হয় হেরাক্লিস বা Herakles আসলে কৃষ্ণের আরেক নাম। হেরাক্লিস এর সন্তান ছিল না, বেশি বয়সে এক মেয়ে হয়। হেরাক্লিস নিজের মেয়েকেই বিয়ে করে আবার। যার সন্তানদের নাম Pandia. যেটাকে পাণ্ডবের অপভ্রংশ বলে বলা হয়। শালা, না জানা অনেক স্বাস্থ্যকর, কিন্তু মানুষের মধ্যে যে কল্প-বিশেষজ্ঞ থাকে, যারা কল্প-থিওরিতে ভরিয়ে দেয়, তারাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আপদ... প্রসঙ্গতঃ বলি এই গ্রীক দেবতা Herakles তিনবার ভারত আক্রমণ করেন এবং Aornos নামে সিন্ধু নদীর ধারে একটি বিশাল পাথর আছে, এখনো, সেখান থেকে চুনকালি মেখে ফিরে যান তিনবারই। তো দেবতাবাবাজীর এই কাণ্ড লুকোনো থাকেনি, কারণ স্বয়ং মেগাস্থিনিস তাঁর ইন্ডিকাতে লিখে গেছেন।



এইসব ফেক ফান্ডা আমাদের ভাষাবিজ্ঞানের সঠিক এ্যানালিসিস ঘেঁটে দেয়। ডাক থেকে ভাষা হওয়ার প্রসেসটা দারুণ ইন্ট্রেস্টিং... বলা হয় যে, ওই আদিম মাদার বা কমন মাদার প্রোটো ইন্দো ইউরোপীয়ান শুনতে কেমন ছিল তা জানতে গেলে র‍্যান্ডম সংস্কৃত জার্মান ও ল্যাটিন বলে গেলে যে সাউন্ডটা হবে, তা প্রোটো ল্যাংগুয়েজের সাউন্ডের কাছাকাছি... এছাড়া বিন্দুমাত্র আত্মীয়তা নেই এদের মধ্যে। বরং সংস্কৃতের অনেক কাছের জ্ঞাতি বোন হচ্ছে লিথুয়ানিয়া লাটভিয়ার ভাষা। জোর করে সম্পর্ক করতে গেলে ল্যাটিন সংস্কৃতের মাসতুতো দিদির পিসতুতো বোন টাইপের হতে পারে।

3) বাংলায় যেভাবে Declension and Congujation হয়, সেটা সংস্কৃত আকা ল্যাটিন-এর সাথে হুবহু মেলে।

এটা হচ্ছে ফেক ফান্ডার অসাধারণ উদাহরণ। ডিক্লেনসান আর ইনফ্লেকশান বা কনজুগেশান জিনিসটা কী, পাঠকদের একটু শর্টে বলে দি... বিভিন্ন গ্রামাটিক্যাল ক্যাটাগরি (tense, mood, voice, aspect, person number gender and case) বোঝানোর জন্য একটা শব্দকে যেমন মর্ফ করা হয়, তাকে বলে ইনফ্লেকসান। এই মর্ফিং হয় নানা ভাবে, শব্দ বেঁকিয়ে চুরিয়ে, প্রিফিক্স, সাফিক্স দিয়ে ইত্যাদি শব্দের নানা অবতার দিয়ে... আর এই একই জিনিস নাউন আর প্রোনাউন এর ক্ষেত্রে হলে বলে ডিক্লেনশান। মানে ভার্বের ক্ষেত্রে ইনফ্লেকশান আর নাউনের ক্ষেত্রে ডিফ্লেকশান। সহজ ভাবে বললে I am doing, I did and I am done. অথবা chair এবং chairs. ডিফ্লেকসানের প্রসঙ্গ তুলে তুই বাংলা আর ইংরেজির মধ্যে কমপ্যারেটিভ স্টাডি করার একটা অপূর্ব জায়গা দিয়ে দিয়েছিস। এই জায়গা থেকে ভাষাকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। এটা খুব ইন্টারেস্টিং এবং এতেই ইংলিশ আর বাংলার নেচার স্পষ্ট হয়।


১) High Synthetic Language- সংস্কৃত, জার্মান (এখানে সামান্য পান থেকে চুন খসলেই ক্রিয়া বা ভার্ব বদলে যায়... সংস্কৃতে ধাতুরূপ নিশ্চয়ই মনে আছে... সমস্ত ফর্ম একেবারে সূত্রের মধ্যে ষষ্ঠী তৎপুরুষ ইত্যাদি... জার্মানে কম্বাইন্ড ওয়ার্ড মানে খানিকটা সংস্কৃতের মতো একটা গাবদা ওয়ার্ড এ্যাসোসিয়েসান দিয়েই জলজ্যান্ত সেনটেন্স এক্সপ্রেস করা যায়।

২) Weak Synthetic language- English… যে ভাষায় ইনফ্লেকশান খুবই কম এবং যাতে variant থাকে... মানে এমন শব্দ যা টেন্স বা ভয়েস বা কোনো কিছুতেই চেঞ্জ হয় না... যেমন must.

3) Polysynthetic language- যে ভাষায় ইনফ্লেকশান অতি হাই... মানে ভয়েস বা টেন্স চেঞ্জ হলে গোটা বাক্যের ওপর এফেক্ট ফেলে, এবং প্রায়ই গোটা শব্দকে আমূল বদলে দেয়। এর উদাহরণ কি? না Anglicised Indian Language. অর্পিতা দেবী ডিফ্লেকসান না জানার জন্য আওয়াজ মেরে যে শব্দটি ফর্ম করেছিলেন 'বোঝাফায়েড' এটি একটি পলিসিন্থেটিক ভাষার ডিক্লেনশানের উদাহরণ। আমেরিকান ইংলিশ এবং ইন্ডিয়ান মর্ফড ইংলিশ হচ্ছে আরেক উদাহরণ। আমি যে ব্যবহার করেছিলাম nounisation, verbisation -- এগুলো হলো ইনফ্লেকশানের উদাহরণ (ভার্ব চেঞ্জ ডি, নন ভার্ব চেঞ্জ ই)।

4) Agglutinative language- যেখানে একটাই ইনফ্লেকশান বা ডিক্লেনশান একাধিক গ্রামারের ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ? সরি অর্পিতা... ল্যাটিন।

5) Fusional- যেখানে কোনো চেঞ্জই হয় না, ম্যান্ডারিন চাইনীজ।


এবার অর্পিতা, এই জায়গাটা ভালো করে শোন, অনেক কিছু ক্লিয়ার হবে...

প্রথমতঃ বাংলার ডিক্লেনশান আর কঞ্জুগেশান, ইংলিশের ডিক্লেনসান আর কনজুগেশান আর সংস্কৃতের ডিক্লেনসান আর কঞ্জুগেশান তিনটে ভিন্ন মেরুর। এবং তার সাইড এফেক্টও আছে।

সংস্কৃতে ডিক্লেনশান আর কনজুগেশান প্রচণ্ড রিজিড এবং নিয়মাবদ্ধ। ষষ্ঠী তৎপুরুষ কী হবে লতা শব্দের যা নারীবাচক বা গম বা কৃ ধাতুর, যা ভার্ব, সমস্ত রূপবদ্ধ করা আছে... কল্পনার কোনো জায়গা নেই, কোনো ফ্রী স্পেস নেই। ফলে ভাষাটিতে বাইরের ভাষার শব্দ ঢুকলেও উপসর্গ বা অনুসর্গ ঢোকার পারমিশান পায়নি। ফলে ভাষাটি আস্তে আস্তে মরে গেছে।


ইংলিশে ডিক্লেনশান বা ইনফ্লেকশান খুব উইক বলে এই ভাষাটির একটি অসাধারণ গুণ আছে যা অন্য ভাষার নেই... সেটা হলো, এই ভাষাটি আয়ত্ত করা সবচেয়ে সহজ। এবং এই সহজপাচ্যতাই ইংলিশকে বিশ্বভাষা করে তুলেছে। আরেকটা গুণ হচ্ছে ডিক্লেনশান বা কনজুগেশান খুব উইক, এবং অতি কম কনকর্ড (concord) [concord মানে যেখানে ইনফ্লেকশানের নিয়ম অনুযায়ী একটা গোটা বাক্যের প্রতিটি পার্ট কমপ্যাটিবল হয়। যেমন the battalion is moving বা the choir sings… এখানে ব্যাটালিয়ন প্লুরাল বা কয়ার প্লুরাল হলেও সিংগুলার হিসেবে আসছে তাই ইনফ্লেকশান sings হচ্ছে]... এইটির ফলে ইংলিশের মধ্যে প্রচুর বিদেশী ঢুকলেও তা ভাষায় খাদ মেশায় না বা বেসিক স্ট্রাকচার চেঞ্জ করে না। ফলে বেংলিশ আপনি শুনতে পেলেও 'ইংলা' কোনোদিন শুনতে পাবেন না, তা সম্ভব নয়। আরেকটা পয়েন্ট আছে... সেটা হলো ইনফ্লেকশান শব্দের সাথে যেটা জোড়ে তাকে বলে bound morpheme, বাকি যেটা থাকে তাকে বলে morpheme. এবার ইংলিশে Bound morpheme এর কোনো অর্থ থাকে না, মূল অর্থ morpheme ক্যারি করে। sing হলো morpheme, 's' হলো 'bound morpheme'. ইংলিশে ডিক্লেনশান অতীব রেয়ার, একমাত্র সিংগুলার প্লুরালের ক্ষেত্র ছাড়া। voice বা tenseএ কখনো noun পরিবর্ত্তন হয় না। এই প্রতিটি জিনিস ঘটে ইংলিশ লোগোসেন্ট্রিক ল্যাংগুয়েজ বলে।



এবার আসি বাংলায়। এক লক্ষবার বলেছি বাংলা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা। ফলে ইংলিশে যা যা হয় না তা বাংলায় হয় এবং ইংলিশে যা যা হয় তা বাংলায় হয় না। অর্পিতা দুম করে বলে দিলি সংস্কৃত ইংলিশ বাংলার ডিক্লেনশান, কনজুগেশান একইরকম। এইসব জারগন কনসেপচুয়ালি না বুঝে ব্যবহার করলে এমনই চরম অপদস্থ হতে হয়। বাংলার ডিক্লেনশান আর ইনফ্লেকশান প্রচণ্ড ফেক্সিবল। প্রথমতঃ সিঙ্গুলার প্লুরালে ক্রিয়াপদে কনজুগেশান বাংলায় হয় না।

বাংলায় যে কোনো প্রিপোজিশান বা অব্যয় হলো ভ্যারিয়েন্ট। বাংলায় আরেকটা কারণে প্রচুর প্রচুর ইনফ্লেকশান আর ডিফ্লেকশান ঘটে যা অন্য কোনো ভাষায় (জার্মান ছাড়া) এত পরিমান ঘটে না। সেটা হলো পার্টস অফ স্পীচগুলোর মধ্যে ইন্টারচেঞ্জ। ক্রিয়ার বিশেষ্যীকরণ (এবার তোর ভালো লাগবে, নাউনাইজেশান বলিনি), নামধাতু, জোড়শব্দ ইত্যাদি। যেহেতু বাংলা এখন এ্যাংলিসাইজড বাংলা, তাই এ্যাংলিফিকেশানও ডিফ্লেকশান আর কনজুগেশান আনে। ইংরেজি লোগোসেন্ট্রিক বলে যে কোনো ক্রিয়াপদের একটি চেঞ্জে, ধরা যাক টেন্স চেঞ্জে, এক ধরনেরই ইনফ্লেকশান ঘটে, gone, done। বাংলায় মজাটা দেখা যাক... রাম বেরোলো, রাম সেই বিকেল পাঁচটায় বেরোলো (চেঞ্জ হলো না)। এবার বাচ্য বা ভয়েস, রামের খাওয়া হলো, রামের খাদ্যগ্রহণ হলো, রাম খেয়েই চলেছে শেষ হলো। কত রকম ভ্যারাইটি। এটাই বাংলার সম্পদ।



3) ‘Verbisation' and ‘Nounisation’ are Wrong words. এটা তুই কবিতায় ব্যবহার করতে পারিস... এখানে কাজে লাগবে না। যে কোনো ভাষায় বহু নাউন ভার্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বহু ভার্ব নাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়... seta ‘verbisation’ বা ‘nounisation’ না। বাড়িপনা বা বাড়িবাজি... এগুলো colloquial usage।

এটার সাপেক্ষে কিছু বলার নেই... এটা বস্তুতঃ একটা ইম্পর্ট্যান্ট পয়েন্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়... আমি আগে বহুবার বলেছি আমাদের বাংলাশিক্ষার মডেলটা এত ত্রুটিপূর্ণ যে বেশির ভাগ মানুষকে সাহিত্য-অশিক্ষিততে পরিণত করে। আমাদের পড়ানো হয় একটা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার ব্যাকরণ, কিন্তু মডেলটা লোগোসেন্ট্রিক ভাষার। ইংরেজি ব্যাকরণের কাঠামোতে আমাদের বাংলা ব্যাকরণ শেখানো হয় বলে অর্পিতা বিনা হিচকিচাহটে “রঙ ওয়ার্ডস, কবিতায় ব্যবহার করতে পারিস, এখানে নয়” জাতীয় হাফ বেকড ধারণাসঞ্জাত মন্তব্য করে যায়। আমাদের মনে আসে না মাইকেল বা নামধাতুর কথা, “উত্তরিলা বিভীষণ...”। তাই ভার্বাইজেশান বললে ভুল, ভুল চিৎকার করে ওঠে। মাথায় আসে না ক্রিয়ার বিশ্যেষীকরণ... আর সবচেয়ে মারাত্মক হলো “এসব কবিতায় চলতে পারে এখানে নয়”... কী চূড়ান্ত মিসকনসেপশান কবিতা সম্পর্কে আমাদের আকাদেমীগুলি মাথায় ঢুকিয়ে যাচ্ছে, ভাবা যায় না!!!!! বা ওই ব্যবহার, এগুলো 'colloquial usage'… আমাদের বলাও হয় না বাংলায় colloquial বলে কিছু হয় কি হয় না??? বাংলায় ফর্মাল ইনফর্মাল-এর ডিভিসান চলিত আর সাধু। কলোকিয়াল-এর কনসেপ্ট আসে জিওগ্রাফিক্যাল এফেক্ট থেকে, ভাষার ওপরে। বাংলায় জিওগ্রাফিক্যাল এফেক্টের ফলে তৈরি হয় ডায়ালেক্ট। সেই অর্থে বাংলার কলোকিয়াল হচ্ছে খাইসে!!

বাংলা আর ইংরেজির মর্ফোলজি যে কতটা আলাদা সিনট্যাক্সিং সহ, একটা সাধারণ বাক্য বললেই বোঝা যাবে। “রহিম হত্যা করেছিল করিমকে”। “করিমকে রহিম হত্যা করেছিল”। এখানে সাবজেক্ট চেঞ্জ হয়ে গেলেও দুটি বাক্য একই তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু ইংলিশে “Rahim killed Karim” আর “Karim killed Rahim.” দুটি বেজায় আলাদা বাক্য। দ্বিতীয়টায় রহিম বেচারা খুন টুন করে এসে ফের খুন হয়ে যাচ্ছে। এই একটা সাধারণ উদাহরণ বোঝায় প্রথম ভাষাটি ক্রিয়া ডিপেনডেন্ট, তাই নাউনের বাড়ি কোথায় তা নিয়ে কিচ্ছু এসে যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় ভাষাটি নাউন নির্ভর। তাই নাউন সামান্য সরলেই অর্থ বদলে যাচ্ছে।

আরেকটা উদাহরণ-

আঁকা- verbal noun (‘act of drawing’)
আঁকতে - verbal infinitive (‘to draw’)
আঁকতে আঁকতে - progressive participle (‘while drawing’)
আঁকলে - conditional participle (‘if X draws’)
এঁকে - perfect participle (‘having drawn’)
এঁকে এঁকে - iterative participle (‘having drawn many times’)

ইংরেজিতে এই নানান সিচুয়েশানে ভার্বকে কব্জা করতে বেশ প্যাঁচ খেলতে হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় শুধুমাত্র আঁকা ধাতুটিকে যত রকম ভাবে বাঁকাবো তত রকম সিচুয়েশান তৈরি হবে। একটায় সিচুয়েশান অনুযায়ী ক্রিয়েট করতে হচ্ছে আর আরেকটায় যতভাবে কল্পনা করতে পারি একটা ক্রিয়ার ফর্ম, তত রকম সিচুয়েশান আমার হাতে। যে কোনো ক্রিয়েটিভিটির পক্ষে এর থেকে অপূর্ব আর কী হতে পারে??? কিন্তু যেহেতু আমাদের ব্যাকরণটি ওই ডানদিকের মডেলে পড়ানো হয়, আমরা বুঝতেই পারি না বাংলা ভাষায় সামান্য একটা ক্রিয়াপদ আমাকে বিধাতার সমান ক্ষমতা দেয়।

সোজা কথায় বলতে ইংরেজিতে SVO হচ্ছে word order মানে Subject Verb Object. আর বাংলায় হচ্ছে SOV বা Subject Object Verb. এই ছোট্ট ফারাকটি গভীর দর্শনের কথা বলে। ইংরেজিতে প্রথমে আসে মালিক, মালিকের অঙ্গুলি হেলনে ঘটনাটা সচল হয় বা প্রাণ পায়, কিন্তু তার প্রাণময়তা শেষ হয় বস্তুতে বা অবজেক্টে। একদিক থেকে মালিক আর অন্যদিক থেকে বস্তুর আকাঙ্ক্ষার জন্য আমার সচল অস্তিত্ব। একদম সোজাসাপটা পুঁজিবাদী বস্তুতান্ত্রিক কাঠামো।

বাংলায় দেখতে পাই মালিকের সাথে সম্পর্ক বস্তুর। মানে বস্তুর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে মালিক আর সব মিলিয়ে অস্তিত্ব সচল হয় বা প্রাণ পায় এক্কেবারে শেষে। তাই প্রাণময়তার কোনো গন্ডি থাকে না। অসীম হতে পারে। এবং ঠিক তাই, বাংলা ভাষাকে এই ক্রিয়াভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বা দর্শন দেখলে দেখতে পাই, এতে সৃষ্টির অসীম সম্ভাবনা। অসংখ্য রূপে সামনে আসতে পারে একটি ঘটনা। পাখিটি গাছে বসেছিল, উড়ে গেল। এটি পাখিটি গাছ থেকে বাতাসে ঢুকে গেল। পাখিটির অবাধ্য ডানাগুলি ওঠাবসার শাস্তি পেয়েছে। পাখিটি গাছের বাইরে একটি ওড়া পরে নিল। এরকম অপরিসীম কল্পনাকে ধারণ করতে পারে বাংলা, যা সত্যিই ইংলিশের দ্বারা সম্ভব নয়।

০২) রমিত দে


সুফী ও শূন্য

এই বেলা তোর মনের মানুষ চিনে সাধন কর / মানুষ পলাইবে দেহ ছেড়ে পড়ে রবে শুধু ঘর / ঘরের মধ্যে তোর তিন তের আর / কোন দরজা করেছ সার / ঘরের মধ্যে বাস্ত খুঁটি / সেইটা কর গে মূলাধার / ডুবে থাক গে রূপসাগরে / বসত কর গে জুতোর ঘরে / লালন বলে, মনের মানুষ; / চিনা হলো ভার”- এখন এই মনের মানুষটি কে? এ কি কেবল ঈশ্বর বা আল্লা নামের চিদচিৎকার? নাকি ক্রমাগত পরিধির দিকে যেতে যেতে একটা ফেরাকে ভালোবাসা দিয়ে পাওয়া! দার্শনিক শূন্যবাদ বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু নয়, সেই বেদ থেকেই শূন্যতার আদি ভাবধারার  একটি ধারণা পাওয়া যায়ঋকবেদেই তো বলছে  
  ....“নাসদাসীন্নো সদাসিত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ
             কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্ময়ংভঃ কিমাসীদগহনং গভীরং..."  
অর্থাৎ আদিতে সৃষ্টির সৎ বা অসৎ রূপ বা অরূপ বলে কোনো পৃথক আধার ছিল না, এমনকি অস্তিত্ববিহীন গভীর অন্ধকারের কোনও আবরণও ছিল না। অর্থাৎ চেতনা  বলতে সেখানে মুহূর্তের এক ধরনের ফাঁকা যার মাঝে অভাবও নেই স্বভাবও  নেই। কেবল পরাবাক এক স্তরের কথা উপনিষদেও বলা হচ্ছে। ইতি ভাবকে অতিক্রম করতে বলা হচ্ছে- প্রেত্য, ন প্রেত্য সংজ্ঞা অস্তিঅর্থাৎ চেতনাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে যে শূন্য যার কোনো সংজ্ঞা নেই। এই শূন্য সেই বিন্দুবোধ যেখানে চৈতন্য ও আনন্দ একই তত্ত্ব, দুই সেখানে নিস্তরঙ্গ আবার তরঙ্গায়িত। শূন্যের মধ্যেই স্বরূপ আর  স্বরূপের মধ্যেই তো সহজের অবস্থান। কেবল বৈদিক সাহিত্য নয়, বৌদ্ধসাহিত্যেও  আমরা দেখতে পাই কীভাবে একের পর এক ধ্যানভূমি ছেড়ে রূপ অরূপ খসিয়ে বুদ্ধ হয়ে উঠছে- নৈব সংজ্ঞা নৈব অসংজ্ঞা আবার বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পরবর্তী যুগের দোঁহাকোষ সাধন ভজন বা চর্যাপদেও আমরা দার্শনিক শূন্যের নিদির্ষ্ট সংজ্ঞা পাই।  কৃষ্ণাচার্যের দোঁহাতে মহাসুখের ভেতর চারটে পদ্ম ও চারটে পত্র আছে, আর ঐ চারটে  পদ্মের মৃণাল শূন্য, অতিশূন্য, মহাশূন্য এবং সর্বশূন্য এই চার রকমের শূন্যতার বাহক। পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সাহিত্য বা নাথসাহিত্যেও শূন্যকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নিজকীয়া সাধনাহাজার হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে এভাবেই মরমীয়াবাদি বা  অতীন্দ্রিয়বাদিদের শূন্যমন্ডলকে ঘিরে এই যে এক তরঙ্গায়িত আনন্দ, মূল প্রকৃতি থেকে বুদ্ধি অহংকার থেকে রূপ রস গন্ধ থেকে মুক্ত হবার জন্য এই যে শূন্যযোগ, তা  আমরা পরবর্তীকালে সুফী তত্ত্বের ভেতরও আস্বাদন করতে পারি। অন্নময় স্থূল শরীরের  বাইরে শূন্যময় স্থিতির সপক্ষে তাদের বলতে শুনি- “শূন্য ভরে একটি কমল আছে কি সুন্দর / নাই তার জলে গোড়া, আকাশ জোড়ে সমানভাবে নিরন্তরসুফীদের মতে অসীম অনন্ত ও অব্যক্ত এক শক্তি হতে অনুলোম গতিতে সূক্ষ্ম হতে স্থূলরূপে সৃষ্টির প্রকাশ, তদ্রুপ আবার বিলোম গতিতে স্থূল হতে সূক্ষ্ম বা শূন্যে পরিতিমুক্তি” -

নিতাই, জালাল চাঁদ, মনসুর, শিতালং শাহ, মোকসেদ আলী সাঁই থেকে শুরু করে পরান ফকির, কাঙাল হরিনাথ, জামাল শাহ, দ্দুদ্দু শাহ, ফুলবাসউদ্দীন, করিম শাহ, খোদা বকশ শাহ কিংবা ভবা পাগলা বাংলার জনপদ এভাবেই সমৃদ্ধ হয়েছে সুফী  মুরশিদ ও মরমীয়া সাহিত্য সংগীতে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সুফী মতবাদে মুসলিম  ভাবধারার সাথে একে একে বৈদিক বৌদ্ধিক গূহ্যতন্ত্র সহজিয়া বা বৈষ্ণব ভাবধারার সংযোগ সাধিত হয়ে তার মাঝে একদিকে দর্শন ও অন্যদিকে মরমীয়াবাদের সৃষ্টি হয়।  দর্শন জানতে চাইল জগতের অনিত্যতা আর স্বরূপের সংজ্ঞা, যেখানে মরমীয়াবাদ সেই সন্ধানী পথটুকুতেই প্রবেশাধিকারের উপায় বাতলাতে সচেষ্ট হলো অথচ বাউল বা  সুফির মতো লোকায়ত দর্শনের কোনো শাস্ত্রগ্রন্থ নেই, কারণ স্বরূপের সন্ধানে  সুফীপন্থীদের স্থির সাধনার কোনো অর্থ নেই, বরং ঈশ্বরের দিকে এক ধরনের পর্যটনই সুফীর তারিকাৎ বা মরমিয়া মার্গ যেন জেন অনুশীলনের সাতোরি প্রাপ্তির মতো, জেনে যেমন কোয়ান বা একাধিক আত্মপলোব্ধির মধ্যে দিয়ে আকস্মিক শূন্যে পৌঁছোনকেই উত্তরণ মনে করা হচ্ছে, তেমনি সুফীমতবাদেও পর্যটনটাই সারাৎসার, পথ চলতে চলতে হঠাৎই পরম বিচ্ছেদে পৌঁছোনো আর এই নির্মেদ শূন্যে পৌঁছতে ঈশ্বর ও মানুষের মাঝে নাকি বিকার ও বোধাবোধের সাত হাজার পর্দা বিছানো; শূন্যকে নিবিড় করতে অনন্তকাল ধরেই জন্ম থেকে মৃত্যু মানুষ যেন এই পর্দা সরিয়ে সরিয়ে আপন প্রতিচ্ছবি বর্জন করতে করতে কখনও আলো থেকে অন্ধকারে তো কখনও অন্ধকার থেকে আলোর দিকে প্রত্যাগমন করছে। আর এই পর্যটনের গূঢ়তত্ত্বে সম্প্রদায়ের সাধন ভজন আচারই সুফীকে তার সাঁইদয়ালের উন্মার্গগামী করে তোলে সুফীতত্ত্বের মূলে যে আল্লাহর প্রতি প্রীতিজাত বৈরাগ্য এবং যে বৈরাগ্যের আটটি গুণ হিসেবে জুনেইদ বলেন- ইব্রাহীমের মতো ত্যাগ, ইসমাইলের মতো আনুগত্য, আয়ুবের মতো ধৈর্য, জ্যাকারিয়ার মতো বাকসংযম, জনের মতো আত্মপীড়ন, সার মতো  ভোগবিমুখতা, মুসার মতো পশমী পরিধেয় গ্রহণ এবং হযরত মহম্মদের মতো দারিদ্র্য বরণ। অর্থাৎ প্রাথমিক স্তর থেকেই সুফীমতে ছিল এক ধরনের প্রবৃত্তির বর্জন এবং জীবাত্মার প্রসুপ্তি ভঙ্গ করে ক্রমাগত শূন্যের রহস্য সাধনা। আজ যখন মনের  মানুষেরসন্ধানে লালনকে আমরা বলতে শুনি, ঈশ্বর অধর মানুষএবং তাকে  আবিষ্কার করতে  হলে কেবল মাত্র যোজন যোজন মহাশূন্যের শ্রুতি, যেখানে দাঁড়িয়ে কেবল বলা যেতে পারে
আমি আর সে অচিন একজন
এ জগতে থাকি দুজন
ফাঁক দেখি লক্ষ যোজন
গেলে ধরিতে”-
তা কিন্তু ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উচ্চারণের উত্তরাধিকারীই বহন করে। কারণ   বাউল মরমীবাদে রসুল  নবী বা আল্লাহের যে উল্লেখ, তা কিছুটা হলেও সুফীপ্রভাবেরই প্রতিফলন। যে খাঁচা ভেঙে অচিন পাখির হদিশে অতীন্দ্রিয় অভ্যেসেকে  তাদের মার্গসাধন করে তুলেছেন বাউলেরা, সেই খাঁচা-ভাঙার পরিভাষা অনেক আগেই  সুফীতে অনূদিত হয়েছে ফানা বা অহংবোধের বিলুপ্তি ঘটানোর মধ্যেইসনাতনী  ইসলামের অনুমোদিত ক্রিয়াবাদের বাইরে সুফীদর্শন নিষ্ক্রিয়াবাদের কথা বলেছে। বলেছে বৈরাগ্যের কথাদেহতত্ত্বের কথা বলতে বলতে বারবার সে উঠে গেছে দেহ ছাড়িয়েতীন্দ্রিয়ের দিকে; শূন্যই হয়ে উঠেছে তার সাধনা; যেমন কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের  লেখায় আমরা পাচ্ছি- “এই মানব জীবন ভাই / এই আছে আর এই নাই /  যেমন পদ্মপাত্রে জল টলে সদাই / তেমনি দেখিতে দেখিতে নাই / আজ গেল আমার / পরে যাবে কেহ / অনিত্য এই মানবদেহ / তবে কেন অহংকারে বল মত্ত সদাই”-শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ থেকে বিষয় থেকে উঠে আসছে এক ধরনের  প্রত্যাখান; বিত্ত অন্তের শেষে এভাবেই সুফী মরমীয়াবাদ খুঁজেছে তার সত্য আশ্রয়, আত্মার চরমোৎকর্ষতা হিসেবে স্বীকার করেছে শূন্যের নিত্যতা। দেহ যে কেবল  দেহসর্বস্ব নয়, তা যে আত্মার সম্পদ, সে কথাই বারবার সুফীপ্রন্থীদের নিত্য দোহার  হয়ে উঠেছে। জড়কে যে প্রথম থেকেই ভিড়ে একলা করে ফেলতে হবে, সুফীর এই   মনস্তত্ত্বের ঠিকানা পেতে গবেষক রমা চৌধুরীর সুফী দর্শন ও বেদান্ত বিষয়ক আলেখ্যের সুফী মনস্তত্ত্বে সরাসরি আমরা প্রবেশ করতে পারি। –“সুফীমতে, মানব জড়দেহন্দ্রিয় ও অজড় আত্মার সমাহার। মানবই সৃষ্টির চরমোৎকর্ষ... মানবই ঈশ্বর স্বরূপের পূর্ণ অভিব্যক্তি, কিন্তু জগত ঈশ্বরের আংশিক অভিব্যক্তি মাত্র। অতএব আংশিক প্রতিচ্ছবি জগৎও পূর্ণ প্রতিচ্ছবি মানবের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ মানবরূপ ক্ষুদ্র জগতে(microcosm) বিশ্বব্রহ্মান্ডরূপ বৃহৎ জগৎ(macrocosm) প্রতিফলিত হইয়া আছে...প্রথমটিকে আজ্ঞাকৃত জগৎ'(আলাম-ই আমর) এবং দ্বিতীয়টিকে 'সৃষ্টিকৃত জগৎ' (আলাম ই খাল্ক) নামে অভিহিত করা হয়, কারণ প্রথমটি  ঈশ্বরের আজ্ঞা  সৃষ্ট হওহইতে এক নিমেষে সম্ভূত, কিন্তু দ্বিতীয়টি পূর্ব্ববর্ত্তী আদিভূত হইতে ক্রমান্বে সৃষ্ট... জড় জগৎ হইতে সে অগ্নি, জল, বায়ু, পৃথিবী এবং জড় আত্মা(নাফস) প্রাপ্ত হইয়াছে। অগ্নি প্রভৃতি চতুর্ভূত তাহার জড়দেহের উপাদান কারণ। জড় দেহ ও জড়  আত্মার সমাহারই মানবের পার্থিব স্বরূপ। অজড় জগৎ হইতে সে হৃদয়( কালব), আত্মা(রুহ), প্রগাঢ় আধ্যাত্মিক জ্ঞানশক্তি(সির), গভীরতর উপলব্ধি শক্তি (খাফী) এবং গভীরতম অনুভূতিশক্তি (আখফা) প্রাপ্ত হইয়াছে। ইহাই মানবের আধ্যাত্মিক স্বরূপ...এই দশবিধ উপাদানে গঠিত মানুষ পৃথিবীর হইয়াও পৃথিবীর উপরে। অতএব পার্থিব স্বরূপকে বশীভূত করিয়া আধ্যাত্মিক স্বরূপের যথাযথ উন্নতিই মানবের প্রধান কর্তব্য"-এই নাফসকে বশীভূত করে নাদ-এ পৌঁছনোই সুফীর স্বরূপমন্ত্র। সেখানে পূর্ব থেকে অপূর্বে গমন, দেহ নির্মাণের উপাদানগুলো থেকেই দেহকে অনির্মাণের কেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত করা।  আর এই বস্তুজগতের বিবিধ থেকে গাঢ়তম ব্রাত্যে যেতে সুফীদের স্বেচ্ছাকৃত বৈরাগ্যই শূন্যের ধারণাতে সত্ত্বাকে ধার্ণ করার পক্ষে জোরদার  সওয়াল করে। সত্ত্বা ও শূন্যের মাঝে ওই যে সাত হাজার পর্দা তা পেরোতে সমাধি, মিলন, আত্মজ্ঞান, বৈরাগ্য বা অতীন্দ্রিয়তার মতো কিছু অভাবের দৃশ্যই হয়ে ওঠে  সুফীপন্থীদের আত্মান্বেষণআত্মাতত্ত্ব সন্ধানে যখন মরমীয়া কবি বলে ওঠেন- “আতমার এ চারি নাম এ চারি প্রকার / রুহু নাথকীবৈসে মনুষ্য শরীরে / রুহু হামিপাইল যথেক জানোয়ার / ‘জির্মিনামে রুহু বকশিয়াছে ধরান্তরে / ‘ছঙ্গনামে রুহু দিয়াছে পাথরেরে / শরীরে আতমা বৈসে ব্যাপিত মন / বধির সহিতে যেন রহিয়াছে কান / দুগ্ধের মধ্যেত যেন ব্যাপিত লনী / শরীর আতমা মধ্যে এতিন বাখানি / ......শরীর বিলাত আত্মা তার রাজা / আর যথ বৈসে জান তারা সব প্রজা”- তখন স্বরূপোলব্ধিতে সুফীদের সাধনমার্গ বা সোপান বা মোকামগুলির স্বাভাবিক পার্থিব থেকে শরীর থেকে শূন্যের দিকে হাতড়ে বেড়ানো আঁচড়গুলোই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 
মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের হারামনির মুখবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন লেখেন- আমার অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে, তেমনি বাউল ভাবগানেও অস্পষ্ট জন্মসূত্রের মতো লেগে রয়েছে সুফীদর্শন    সঞ্জাত একটি সত্তা।  কিন্তু সুফীর মারফতির সাথে বাউলের মরমীয়াতে মানুষ ও ঈশ্বর তত্ত্বের মধ্য দিয়ে শূন্যকে সংজ্ঞায়িত করার যে সাদৃশ্যতা, সেই সাদৃশ্যতা   বহুবিধ উৎস থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে; বাংলাদেশের সুফীরা হিন্দু যোগ, বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া বা বৌদ্ধমরমির পাশাপাশি ইসলামিক অতীন্দ্রিয়বাদ ও নাথপন্থীদের শূন্যদর্শনের সান্নিধ্যে আসে। বুৎপত্তিগত দিক দিয়ে দেখলে অধিকাংশ সুফীর মতেই সুফী শব্দটি আরবী সফাহতে উৎপন্ন। সফাঅর্থে পবিত্রতা  অর্থাৎ যিনি স্বয়ং এবং ঈশ্বরের প্রতি অকপটভাবে শুদ্ধ সাধু ও সত্যের পিয়াসী। পাশাপাশি গ্রীক sophisma বা জ্ঞান শব্দের সাথেও অনেকে সুফীর সংমিশ্র ও সম্বন্বয়ের কথা  বলেন। কিন্তু অধিকাংশ তাত্ত্বিকের মতে আরবী তসাউওফবা মূল বিশেষ্য সুফ শব্দ হতে সুফীর উদ্ভব। সুফ অর্থ পশম আর যে সব সমুদায় লোক ইসলামের  প্রাথমিক যুগে পশমের জামা পরে সংসার হতে একেবারে নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করতেন তাঁহারাই সুফীনামে পরিচিত হতেন। আবদুল করিমও প্রায় একই মত ব্যক্ত করে লেখেন- “তসাউওফ বা সুফী শব্দটি আরবী সুফ শব্দ থেকে উদ্ভুত। সুফ শব্দের অর্থ  হলো উল বা পশম এবং প্রাথমিক যুগের ধর্মতাত্ত্বিকেরা পশমী বস্ত্র পরিধান করে সাধনা করতেন বলে তাঁদেরকে সুফী বলা হতোপন্ডিতরা সুফী শব্দের মূল বের  করতে গিয়ে আরও কয়েকটা শব্দের অবতারনা করেছেন, যেমন কেউ কেউ বলছেন যে, ‘আহল-উস-সুফকা অর্থাৎ হযরত মহম্মদের সময়ে যারা মসজিদের মেঝেতে বসে   সাধনা করতেন, তাঁদের থেকেই সুফী শব্দের উৎপত্তি। আবার কারও মতে সফ-- আউয়ালঅর্থাৎ যারা সামনের সারিতে সালাত আদায় করতেন, তাঁদের থেকেই সুফী শব্দের উৎপত্তি। আবার সুফী শব্দের উদ্ভব সম্পর্কে ভিন্নমত হচ্ছে- মদিনায় ইসলাম  প্রচারের প্রাথমিক যুগে মদিনার মসজিদ সংলগ্ন নির্জন স্থানে অবস্থানরত সংসার নির্লিপ্ত আল্লাহ প্রেমিক একদল লোক আলহুস সাফফানামে পরিচিত হন; এদেরই উপর আরোপিত এই সাফফা শব্দ থেকে সুফি শব্দের উদ্ভব বলে ধরা হয়"-কিন্তু সুফী উদ্ভবের কার হিসেবে যে মতই দর্শানো হোক, সুফী শব্দের মধ্যে এবং সুফীর রূপ  স্বরূপ সৃষ্টি পুষ্টির মাঝেই যেন বিদম্যান এক ধরনের নিস্পৃহতা, উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা এবং জাগতিক বৈরাগ্য। ঈশ্বরের সাথে মানুষের সেখানে বাধাহীন মিলন। ইসলামি সুফীবাদের মোনাজাত বা প্রার্থনায় প্রেমই মূল বিষয়। কিন্তু এই প্রেম কার সাথে! কেবল বাহ্যিক কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টিমাত্র নয় সুফীবাদ; হজরতের সময় থেকেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রেমে আত্মার সংযোগ খুঁজেছিলেন ইসলামী মরমীয়াবাদীরা। তাই ইসলামের সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সুফীবাদে সচেতনভাবে  মনকে প্রাণে লয় করে শূন্যসারে পৌঁছে যাবার মানসঅঞ্চল বিদ্যমান। যেমন আলি রজা ওরফে ওয়াহেদ কানু ফকির যিনি কিনা চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানা এলাকার ওশখাইন গাঁয়ের সাধক তাত্ত্বিক কবি ও পীর হিসবে প্রখ্যাত ছিলেন, তাজ্ঞানসাগর গ্রন্থে লিখেছেন-
সংসারে ফকির শূন্য জপে শূন্য নাম
শূন্য হস্তে ফকিরের সিদ্ধি সর্ব কাম
নাম শূন্য কাম শূন্য শূন্য যার স্থিতি
সে শূন্যের সঙ্গে করে ফকির পিরীতি 
শূন্যেত পরম হংস তথা যোগ ধ্যান
যে জানে হংসের তত্ত্ব সেই সার যোগী
সেই সব শুদ্ধ যোগী হএ শূন্য ভোগী
সিদ্ধা এক শূন্য এক এই সে যুগল
যে সবে এই তত্ত্ব পালে সে তনু নির্ম"-

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আলি রজার এই পদাবলীতে উর্ধ্বস্রোতা হয়ে রয়েছে  বৌদ্ধশূন্যতত্ত্ববৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ে শূন্যতা নিয়ে ভেদ রয়েছে। পুদগল শূন্যতাআর ধর্ম শূন্যতা'- শূন্যতা সেখানে দু' প্রকারের। পুদগলমানে আমিত্ব আমার জীবত্ব, সেখানে আমার ভেতরে সব শূন্যমূলত হীনযানীরা এই পুদগল শূন্যতাবিশ্বাসী ছিলেন এবং যেহেতু আমি শূন্য হলেও আমার ভেতর আমাকে নিয়ে যে জগত যে ইষ্ট সে পূর্ণ, তাই হীনযানীরা সমাহিত হওয়ার কথা বলতেন অর্থাৎ শূন্যের মাঝে একটা  জগৎ ভাসছে এবং যে মুহূর্তে তুমি সমাধিস্থ হচ্ছো সে মুহূর্তে তুমি শূন্যকিন্তু  মহাযানীরা এই নির্মাণাকার শূন্য থেকে বেরিয়ে পরিপূর্ণ শূন্যতার প্রসঙ্গ তোলেন।  সেখানে আমিও নেই জগৎও নেই আমিও শূন্য জগৎও শূন্য বিষয়ও শূন্য বিষয়ীও শূন্যহাযান বৌদ্ধদের ধর্মশাস্ত্রে বারবার যে অবাকশাখবা ঊর্ধ্বমূলবৃক্ষের বর্ণনা এসেছে, তা তো দেহবৃক্ষ আবার তাই বোধিবৃক্ষ। গাছটির মূল তার ওপরের দিকে  আর শাখাপ্রশাখা নিচের দিকে। ওপরের দিকের বিস্তার চৈতন্যের আর নিচের দিকের বিস্তার জড়ের এবং দু'দিকের শাখাপ্রশাখা ও মূলের চিত্রন একে ওপরের প্রতিবিম্ব স্বরূপ  অর্থাৎ চিৎ ও জড়ে কোনো তফাত নেই সেখানে। নিজের ভেতরেও সেখানে ফাঁকা আবার নিজের বাইরেও ফাঁকা - মহাযানের ভাষায় এটা অতিশূন্য, যার ভেতরে তলিয়ে যেতে পারলেই পরম স্থিতি বা নাদরূপতার উন্মেষ ঘটে। পাশাপাশি উপনিষদে রয়েছে অতিমুক্তি যা অতিশূন্যেরই উদ্দীপন, সেখানে ব্যক্তি বদ্ধ, ব্রহ্মা মুক্ত, জগত মুক্ত আর ওই মুক্ততির ভেতরই প্রাণকে আশ্রয় শিখতে হবে। হিন্দুতন্ত্রের উদ্ভব হয়  বৌদ্ধতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে আর হিন্দু আর বৌদ্ধ উভয় তন্ত্রের প্রভাবে গড়ে ওঠে বাঙালী সুফীর বিশ্বাস ও ভাবজগতটি, যার ফলে শূন্যবাদ, অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, দেহতত্ত্ব, বৈরাগ্য, গুরু বা পীরবাদ, মায়াবাদ, ফানাতত্ত্বের মতো একাধিক ধারণা অনুপ্রবেশ ঘটেছে সুফী সাধনায়। শূন্যতার আদি ভাবধারার উদাহর পাই আমরা বেদ  উপনিষদে। কেনোপনিষদে আমরা পাই নৈরাত্ম শক্তি বা শূন্যময়ী প্রকৃতির সাধনা। হিন্দু যোগশাস্ত্র ও শক্তি সাধনাও কিন্তু সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের দেহের মধ্যে এক ধরনের শূন্যের এক ধরনের ভাসমানতার বা সহজতার সাথে ঈথারের সাথে জড়িত আত্মার কথা বলে এসেছে। মানুষের দেহের মধ্যেই রয়েছে একটি ঘুম এবং একটি চির জাগর বা মুক্ত পিপাসা। কুন্ডলিনীর মতো নিদ্রিত হয়ে আছে সুপ্তশক্তি, সে বদ্ধ গতিহীন নিষ্ক্রিয় আর তাকে মূলাধার থেকে স্বাধিষ্ঠানে, স্বাধিষ্ঠান থেকে মণিপুরে, মণিপুর থেকে অনাহত বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র পার হয়ে সহস্রারে প্রবেশের  মাধ্যমেই ঘুমন্ত প্রকৃতির পরম স্থিতি পরম মুক্তি এভাবেই শূন্যকে হাজারো সম্ভাবনা থেকে মুক্ত করার প্রয়াস হয়েছে আদিকাল থেকে। বৌদ্ধতন্ত্রেও আমরা পাই নির্মাণ চক্র' নামের প্রাথমিক শক্তিস্তর পেরিয়ে ক্রমাগত ধর্মচক্র’, ‘সম্ভোগচক্রঅতিক্রম করে  সাধকের উষ্ণীষকমলে' পৌঁছে মহাসুখ বা সহজানন্দরূপ শূন্যতা প্রাপ্তির আকুলতা।   আবার বৈদিকী ও তান্ত্রিকী থেকে যে হিন্দু পৌরাণিক ধর্মের উৎপত্তি, সেখানেও শূন্যতা কিন্তু কেবল নিহিলিজম নামে অভিহিত হয়নি বরং অভাববস্তু ও ভাববস্তু এই দুইয়ের মধ্যে যখন আর কোনো মীমাংসা থাকে না, মত থাকে ন্‌ মায়া থাকে না, তখনই শূন্যের ইঙ্গিত আসছে, অনুসরণ আসছে ভেতরের আরও ভেতরের নিঃশব্দের আরও  নিঃশব্দের। আবার বোধিসত্ত্ব ও দশভূমির আলোচনা করলে আমরা দেখব বুদ্ধও কিন্তু শূন্যতা প্রাপ্তির জন্য সাধককে দশটি ভূমি বা স্তরের মধ্যে দিয়ে উর্ধ্বদিকে প্রসারণের কথা বলেছেন। এই দশ ভূমি হলো- প্রমুদিতা, - বিমলা, - প্রভাকরী, -  অচিস্মিতা, - সুদুর্জয়া, - অভিমুখী, - দূরঙ্গম, -অচলা, -সাধুমতী বা সদিচ্ছা এবং ১০- ধর্মমেঘ। প্রতিটা ভূমি বা স্তরের বিশদ বিবরণে না গিয়েও বলা যেতে পারে, বোধিসত্ত্বের নিগুঢ় তত্ত্বে ছিল চরম স্থিতি বা শূন্যতা অবধি পৌঁছবার   আকুতি। অচলালো সেই ভূমি যেখানে জড়ের আর পতনের ভয় নেই, আর  ধর্মমেঘসেই ভূমি যেখান থেকে সে শূন্যকে শুদ্ধ শক্তিরূপে গ্রহ করে বিলীন হয়ে  চলেছে। বৌদ্ধিক শূন্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা নাগার্জুনীয়  শূন্যবাদেও শূন্যই সারবস্তু অবিনাশী এবং অচ্ছেদ্দ্য হিসাবে অভিহিত হলো এখন  সুফীবাদ এবং তার যোগধর্ম সম্বলিত সংস্কারগুলির কাছে ফিরে এলে আমরা দেখব বৌদ্ধ বেদান্ত জৈন শৈব বৈষ্ণব তন্ত্র লোকায়তের মতো কর্মমার্গ জ্ঞানমার্গ ভক্তিমার্গের  বিবিধ স্তরের মধ্যে দিয়ে মোক্ষলাভের বিষয়টিকে সেখানেও জীবনদর্শনের মূলপন্থা করা  হয়েছে। আউলা বাউলাদের সাঁই যেমন শূন্যের দিকে তুরীয় আনন্দ লাভ করতে  শিখিয়েছেন তেমনি সুফীবাদে মুরশিদ বা পিরই সেই গুরু, যার বাণী বারবার  আত্মবোধকে বিসর্জন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। শরিয়তি ও মারফতি এই দুই পথে পার্থিব প্রেম দেহজ থেকে অপার্থিবে উত্তরিত করে নিজেকে নিজের মধ্যে বিলীন করে নিজেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলাই হয়ে ঠেছে সুফীসাধনার গুপ্তদর্শ
  
আল্লাহর অহি প্রাপক এবং আল্লাহর বাণী প্রচারক ও নবী হজরত মহম্মদ, যিনি ইসলাম ধর্মমতের প্রবক্তা, ৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর কিছু কালের মধ্যেই খারিজি, শিয়া, মুরজিয়া আর কাদেরীয়ার মতো বেশ কিছ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, যারা মহম্মদ  কর্তৃক প্রণোদিত ইসলামের বিধি নিষেধ অনুশাসন ও ধর্মাতাত্ত্বিক কর্মকান্ডে বারংবার  নতুন বিশ্লেষ নিয়ে আসে। এদের মধ্যে প্রভাবশালী ছিল মোতাযিলা সম্প্রদায়, যারা   ইসলামকে যুক্তি ও ধর্মের মিশেল হিসেবে পরিভাষিত করতে চেয়েছিল এরা ছিলেন র‍্যাশানলিস্ট, যুক্তিবাদী। সব তত্ত্বের বিচার যুক্তির সাহায্যে করতে হবে, এমনকি ধর্মেরও, এমনই ছিল তাঁদের মত দয়ালতত্ত্বের ভাবপেক্ষা মানব জীবনে অতি মাত্রায়  গুরুত্ব আরোপ করার জন্য স্বভাবতই জীবনের প্রতি অপেক্ষাকৃত নিরাসক্ত ইসলামিক মরমীয়াদের সাথে মোতাযেলাদের দ্বন্ধ ছিল স্বাভাবিক, আর এই দ্বন্ধ থেকেই ইসলামে  এল সুফীর মতো নতুন ভাবধারা যা মোতাযিলাদের বিজ্ঞান ও দর্শনের থেকে বেরিয়ে  প্রেম ও সত্যের অভিধ্যান চাইল। এই সুফীরা আসলে মুরশিদের সাধনা করেছেন মারফতির গুঢ়তত্ত্ব শেখার জন্য। মারফতি সাধনার সেই স্তর যেখানে খাঁটি সত্যে বিলীন হওয়াই একমাত্র লক্ষ্যআর এই মারফত থেকেই আরও একধাপ বা একস্তর  অতিক্রম করলেই বাকায় পৌঁছে রিপু দমন করে সাধক মরমীয়ারা মহাসত্যের সন্ধান করেনঅর্থাৎ সুফীর প্রাথমিক মননতন্ত্রেই পাওয়া যায় শূন্য হওয়ার বাসনা, আধার ত্যাগ করার আকাঙ্ক্ষা। বৌদ্ধ সহজিয়া বা নাথসাহিত্যে কিন্তু এই শূন্যবাদ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। নাথধর্ম হলো নিরীশ্বরবাদী ধর্ম এবং শূন্য নিরঞ্জনের  উপাসনাই এই ধর্মের নীতি এবং যোগাবলম্বনে সর্বশূন্যতা লাভই ছিল তার কাম্যবস্তু। বৌদ্ধমতে সর্বত্রই শূন্য বিরাজ করছে এবং সংজ্ঞানের স্বরূপ চিনতে গেলে চিনতে হবে ওই অনন্ত প্রসারিত শূন্যের স্বরূপকেচারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত শূন্যপুরা হতে আমরা এই নামরূপহীন শূন্যের সমর্থনে শুনি-  
নহি-রেক নহিরূপ নহি ছিল বন্নচিন
রবিশশী নহি ছিল নহি রাতি দিন
নহি ছিল জল থল নহি ছিল আকাশ
মেরুমন্দার নহি ছিল নহি ছিল কৈলাস
নহি ছিল সৃষ্টি আর না ছিল চলাচল
দেহারা দেউল নহি পরবত সকল
দেবতা দেহার ছিল পুজিবাক দেহ
মহাশূন্যর মধ্যে পরভুর আর আছে কেউ,
শূন্যপুরা ও নাথসাহিত্যে কেবল শূন্যের সংজ্ঞা নয়, সাথে সাথে শূন্যের স্বরূপ স্বত্ব  স্বভাবে পৌঁছতে বাহাত্তর হাজার নাড়ির মধ্যে ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা সুষুন্মা চিত্রা হস্তিনী বারুশী গান্ধারী পূষ্যা সরস্বতী অলম্বুসা যশস্বিনী কুহু তপস্বিনী বিসন্ধরী ও শক্তিনী এই পনেরোটি নাড়ীর উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছ; এই নাড়িচক্রভেদই ছিল  নাথযোগীদের যোগসাধনা ও যোগলব্ধ প্রণালী আশ্চর্যভাবে দেখা যায় পরবর্তীকালে   বাংলা সাহিত্যে প্রচারিত সুফী সাধক গানে মরমীয়াতে নাথপন্থীদের পনেরোটি নাড়ি ও ছয় চক্রের ভিতর দিয়ে শূন্যদেশে সাধনার কথা বারবার উঠে এসেছেইসলামের প্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা সুফীতত্ত্বের ভেতর বহতা নদীর মতো ক্রমাগত ঢুকে পড়েছে  ভারতীয় পৌরাণিক ও বৌদ্ধিক মননতত্ত্ব। ইসলামী আবরণে গড়ে ওঠা সুফীতেও  অচিরেই বৌদ্ধ হিন্দু যোগতান্ত্রিক সাধনার অনুরণন জোরালো হয়ে উঠেছে। আরবী  ফারসী পরিভাষায় সীমিত না থেকে ক্রমাগত সুফীর সর্বেশ্বরবাদ আর বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদও একাকার হয়ে গেছে সুফীপন্থী মুসলমান সাধকের ভাষায়। সুফী সাধক কাজী শেখ মনসুর বিরচিত 'সির্নামায় আমরা ইসলাম ও বাঙলার সুফীমতের সমন্বয় দেখতে পাই, ষোলো সতেরো বা আঠারো শতকেঙ্কীভাবে সুফী মতবাদে মিশে গেছে  হিন্দুয়ানী অধ্যাত্মসাধন, তা সির্নামারপীরতত্ত্বেই উল্লেখিত। নাথসাহিত্যের কুন্ডলিনী জাগরণ সেখানেও হয়ে উঠেছে সুফী সাধনার মূল বিষয়, শূন্যত্ব প্রাপ্তির একমাত্র পথ-
শরীরের রগ সব তিনশত ষাইট
শোণিতে ভরিয়া আছে সমুদ্রের মত
তার মাঝে দশ নাড়ী আছএ প্রধান
যেখানে যে আছে কহি লও পরিমাণ
ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা দুই সুষুন্মা আর
গান্ধারী, কুহু, হস্তিজিহ্বা, পুষা নাম তার
পক্ষিনী শঙ্খিনী মুষা কুন্ডলিকা দশ
ধক দশ ব্রহ্মনাড়ী হএ একাদশ
যে যে নাড়ী যেইস্থানে, রহিয়াছে নিত
সে সব কহিব আমি শুন দিয়া চিত
ব্রহ্ম নাড়ী মেরুদন্ড ভেদিছে নিশ্চিত
ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা দুই মেরু দুই ভিত
তালু মুলে হস্তীজিহ্বা মুখে বৈসে মুষা
শিরেত পক্ষিনী লিঙ্গে কুন্ডলিকা বাসা
.........

নদ নদী খাল যেন পৃথিম্বিত
নাড়ী সব শরীরেত শোণিত পূরিত
যেহেন দরিয়া সব পৃথিম্বী মাঝার
শরীরের মধ্যে আছে তেমত আকার
.........
লবনী ক্ষীরোদ হএ আর জলা নদী
শরীরেত এই সিন্ধু রহে নিরবধি...

শরীরের ওই সিন্ধু আসলে শূন্যের। পূর্ণকে ধরে রাখে সে শূন্যযোগতান্ত্রিক যৌগিক  প্রক্রিয়াগুলি এবং বৌদ্ধ হিন্দু সাধনার রীতিগুলি বাঙালী সুফিরা এভাবেই বারংবার আত্মস্থ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে চোদ্দোশো বা পনেরোশো শতাব্দীতে সিদ্ধা ও মুসলমান ফকির থেকে উদ্ভূত বাউল সম্প্রদায়ের দর্শনেও বৌদ্ধসহজিয়া থেকে সুফীদের  গৃহীত সাধনের এমত পদ্ধতিগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে লালনও কিন্তু  সহস্রারে এসেই তাঁর 'আয়নামহল'এ যাওযার কথা বলেছেনএবং বাউলের দেহতত্ত্বেও  প্রবেশ করেছে সুফীর গোপন সাধন জগত, সেখানে স্বরূপ স্বরূপকে সন্ধ্যাভাষায় আক্রমণ করেছে হেঁয়ালিচ্ছলে আর সাথে সাথে চেতনা কেন্দ্রের দিকে বাড়তে বাড়তে শূন্যদর্শনের সাক্ষাৎ দিয়েছে। মনসুরউদ্দিন মুহম্মদ তাঁর গ্রন্থ হারামনিতে একটি গান উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন সৃষ্টিতত্ত্বে কীভাবে হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের সুর গান  অবধি পৌঁছেছিল। -“মাবুদ আল্লার খবর না জানি / আছেন নির্জ্জনে সাঁইনিরঞ্জন মনি, / সেথা নাই দিবা রজনী / অন্ধকারে হিমান্ত বায় ছিলে আপনি / সেই বাতাসে গৈবী আওয়াজ হল তখনি / ডিম্ব ভেঙে আসমান জমিন গড়লেন রব্বানি / ডিম্ব রক্ষে আলে, ডিম্বের খেলা আদমে খেলে / অধীন আলেক বলে না ডুবিলে কি রতন মিলে? / ডুবিলে হবে ধনী"-সাঁই নিরঞ্জন কিম্বা আল্লা যেমন কোনো মত  নয়, কেবল এক একটা সাধনা, শরিয়ত কিংবা শাস্ত্র সেখানে শূন্যের দিকে  ক্রমপ্রসারিত হওয়ারও এক একটি পথ মাত্র। বাউলের উদ্ভবই হয়েছিল মুসলমান ফকির ও সিদ্ধা থেকে, তাই আধুনিক সুফীতে যেমন তার মিশেল তেমনি ভারতীয়  যোগ ও বেদান্তদর্শনের স্পষ্ট প্রভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যায় সুফীর বিভিন্ন মোকাম ও মঞ্জিলে। নাথদর্শনের বা ভারতীয় বেদান্ত দর্শনে যেমন শূন্য অবধি পৌঁছতে চক্রে চক্রে ভাগ করা হয়েছে দেহকে এবং মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা পেরিয়ে সহ্রসার অবধি জাগরণই যেমন ভারতীয় তন্ত্রসাধনার চৈতন্যরস হয়ে উঠেছে,  তেমনি ইরা বা আরবী সুফীরাও উত্তর ভারতে বিস্তৃতি লাভের সাথে সাথে এসব   তন্ত্রসাধনা ও বৌদ্ধসহজিয়া যোগ দ্বারা বিশেষভাবে আকর্ষিত হয়। মূলাধার থেকে সহ্রসারের মতোই সুফী সাধকেরাও মানুষকে বা সংসারকে শূন্যের সম্যক দর্শ বা ইন্ট্রিগাল ভিউ দেখাবার জন্য ভারতীয় যোগের আলোকেই দেহকে, সৃষ্টির আধারকে কয়েকটি মোকাম বা মঞ্জিলে ভাগ করেন।
-নাসুত বা দেহলোক,
-মলকুত বা বৌদ্ধলোক,
-জবরুত বা শক্তিলোক,
-লাহুত বা ফানা বা আত্মবিলোপের জগত এবং
-হাহুত বা অদ্বয় অবস্থা
এই ফানা ফিল্লাহ বা আত্যোৎসর্গ বা আত্মার বিনাশের মধ্যে দিয়ে সুফীরা স্রষ্টার নৈকট্য লাভের পথ প্রশস্ত করার কথা বলেছে বারবার; ফানার অর্থ ব্যক্তির মানবীয় সত্তা এবং গুণাবলীর বিলয় সাধন করিয়া নিগূঢ় অনুভূতিতে আত্মবিস্মৃত  হওয়ার অবস্থাএই জায়গায় এসে বিষয় ও বিষয়ী উভয়ের ব্যক্তিগত বোধ তিরোহিত হয় 'বাংলার বাউল-সুফি সাধনা ও সংগীতগ্রন্থে আবদুল ওয়াহাব  লেছেন- “সুফিতত্ত্বের সাধক, পির দরবেশের সাথে নাথ গুরুদের ধর্মসাধন পন্থার  খানিকটা ঐক্য আবিষ্কার করা দুরূহ নয় এবং সুফিতত্ত্বের দর্শনে ভারতবর্ষের নিজস্ব দর্শ সাংখ্য যোগের একটি গভীর মিল আছে। কায়াসাধনার যে রীতি পদ্ধতি  সুফিবাদে প্রত্যক্ষ করা যায় তার সঙ্গেও সিদ্ধাচার্যদের কায়া সাধনার মিল আছে" কেবল নাথপন্থীদের সাথে বা বৌদ্ধসহজিয়াদের সাথেই নয়, সুফীবাদের চেতনার মূলের  যে জগৎ অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্মসূক্ষ্ম থেকে শূন্য অর্থাৎ স্থূলদেহের ভাবনাকে  অতিক্রম করে যে নিরাকার অধর মহাবিদেহের খোঁজ, সে আসলে হাজার হাজার  বছরের ভারতীয় জীবন দর্শনেরই ফসল। বাংলার সুফীরা উত্তর ভারতীয় সুফীদের তুলনায় অধিকতর উদার বলে মনে করেন আবদুল ওয়াহাব এবং তার জন্য বাংলার সংবেদনশীল উদারনৈতিক মানবাতাবাদী সমাজদর্শনের কথা বলেন তিনি। একাধিক ধর্ম  একাধিক বাদ একাধিক দর্শনের যোগে সুফী সংস্কৃতিতে এক ধরনের সমন্বিত জীবনবোধের জন্ম নেয় যা ঈশ্বরকে আল্লাহকে জানার জন্য যেমন তৃষ্ণার্ত, তেমনি সে শূন্যেরও দ্বারস্থ। মন মনীষা আর হৃদয়ের বহুশ্রুতি দিয়ে এ শূন্য সুফী সাধকের যুগ যুগান্তের সেই খোঁজ, যেখানে দাঁড়িয়ে সে আদি অনন্ত ব্রহ্মকেই খোঁজে, স্থূল থেকে যেতে  চায় মূলে, স্বরূপ থেকে যেতে চায় শূন্যেএখানে দাঁড়িয়েই অস্তি থেকে জগত থেকে সুফীসাধকের শূন্যলিপ্সু উচ্চারণ বারবার খোঁজে শব্দহীন বস্তুহীন সন্ধিৎসারের সুগন্ধীটুক; না-থাকা কোনোখানে থাকে এ যেন তার আবহমান উচ্চারণ-

নূর অংশ মোর এই দেহেতে
কোন খানে আছে
শুনি নূরেতে নূর মিশাইয়া
দেশের সকল অঙ্গ আমার
আপন আপন নামে প্রচার
নূর নামে কোন বস্তু গো তার
কোথায় মিশেছে!...”


*********************

(বেদান্ত  দর্শনে ঋণ স্বীকারঃ  শ্রীঅনির্বাণ, রমা চৌধুরী)