কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১০৫

 

সম্প্রতি কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটের ইন্ডিয়ান কফিহাউসের তিনতলায় ‘বই-চিত্র’ সভাঘরে একটি আলোচনাসভা আয়োজিত হয়েছিল। সভার আয়োজন করেছিল  ‘আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি সমিতি’। এই সংস্থার কেন্দ্রীয় অফিস দিল্লিতে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় শাখা অফিস আছে। বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের পাশাপাশি বর্তমানে এই সংস্থা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করে চলেছে। আমরা বাংলাভাষী রূপে সাধারণভাবে জানি যে, আমাদের ভাষা বাংলা একটি নতুনতর ভাষা, যার জন্ম হয়েছে হাজার বছর আগে। এবং এই ভাষায় রচিত প্রথম সাহিত্য নিদর্শন রূপে পাই ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাপদাবলী’। যাঁরা ভাষাতত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা জানেন, কীভাবে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বিবর্তিত হয়ে নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় রূপান্তরিত হয়ে বাংলা, ওড়িয়া, ভোজপুরি, মৈথিলী, মগহী, অসমীয়া ইত্যাদি আধুনিক বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এইসব আধুনিক ভাষা মোটামুটি প্রায় একই সময়ে সৃষ্ট হয়েছে, এবং প্রত্যেক ভাষারই বর্তমান বয়স কম-বেশি হাজার বছর। বিশেষত ‘চর্যাপদাবলী’কে এই সব ভাষাই তাদের প্রথম সাহিত্য-নিদর্শন হিসেবেই দাবি করে থাকে। কিন্তু সেদিনের সেই আলোচনাসভার বিষয় ছিল একটু আলাদা বা ভিন্ন। ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে প্রচলিত অসংখ্য ভাষা ও উপভাষার মধ্যে এর আগে মাত্র পাঁচটি ভাষায়  রচিত সাহিত্যকে ধ্রুপদী ভাষার সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছিল। এই ভাষাগুলি হলো সংস্কৃত, তামিল, তেলগু, কানাড়ী ও মালয়ালাম। এই মর্যাদার পেছনে যে শর্তগুলির উল্লেখ করা হয়েছিল, তা হচ্ছে, সেই ভাষাকে প্রাচীন হতে হবে, অন্তত ১৫০০ থেকে ২০০০ বছরের পুরনো ভাষা হতে হবে, সেই প্রাচীন কাল থেকে তার সাহিত্যের বহমান ধারা থাকতে হবে, এবং সেই ভাষার সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ হতে হবে। আর এই শর্তগুলি পূরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রাচীনত্বের ঐতিহাসিক নিদর্শন, লিপি, মুদ্রা, পুঁথি ও পুস্তকাদির তথ্য সম্বলিত যাবতীয় কিছু ভারত সরকারের সংস্কৃতি দফতরে পেশ করতে হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যে পাঁচটি ভাষাকে এর আগে ধ্রুপদী মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তাদের  প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আদৌ কোনো তর্ক-বিতর্কের অবকাশ নেই। বিশেষত যাঁরা ভাষাতত্ব চর্চা করেন, তাঁরা জানেন, এই ভাষাগুলি যথেষ্ট প্রাচীন, কয়েক হাজার বছরের পুরনো অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা। এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিন আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যখন ষষ্ঠ ধ্রুপদী ভাষার সাহিত্য  হিসেবে ওড়িয়াকে মর্যাদা দান করে, তখনই বাংলাভাষী হিসেবে আমরা আলোড়িত হই। কেননা, এতদিন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, নব্য ভারতীয়  আর্যভাষা থেকে উদ্ভূত আধুনিক সব ভাষাই সমবয়সী। কম-বেশি হাজার বছর বয়স। কিন্তু ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্যের তাত্ত্বিক গবেষকরা গভীর গবেষণায়  আবিষ্কার করেছেন, ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্য আরও প্রাচীনকালে সৃষ্ট। এবং যথেষ্ট সমৃদ্ধও। সুতরাং ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদালাভের অধিকারী।  

সেদিনের সেই আলোচনাসভায় আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল, এতদিনের প্রচলিত  ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে ওড়িয়া ভাষা-সাহিত্য যদি তার প্রাচীনত্বের দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন আরও নিবিড় গবেষণা, প্রাচীন শিলালেখ, পুঁথিপত্র ইত্যাদির সন্ধান এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের খোঁজখবর। যেসব বাংলাভাষী মানুষজন তাঁদের মাতৃভাষাকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, তাঁদের সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে, শ্রমদান করতে হবে, সময়দান করতে হবে। এমনিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধুমাত্র যদি তার আরও প্রাচীনত্ব প্রমাণ করা যায়, তাহলে সপ্তম ধ্রুপদী ভাষার সাহিত্য হিসেবে বাংলা ভাষাও মর্যাদালাভ করবে।

সবার সুস্থতা কামনা করি।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব 

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২২   




 

আজ হলিউডের প্রিয় অভিনেত্রীদের নিয়ে কলম ধরার পালা। অকপটে বলি, হলিউডের সুন্দরী ছিপছিপে হাস্যময়ী নায়িকাদের অনেককেই আমার ভাল লাগে, সে নাতালি পোর্টম্যান হোক বা চার্লিজ থেরন কিম্বা অ্যানি হ্যাথওয়ে বা জেসিকা অ্যালবা বা কিরা নাইটলি (অবশ্য ভাববেন না যে শুধুমাত্র এদের সৌন্দর্যই দর্শককে স্ক্রিনের সামনে আটকে রাখে, এদের অভিনয়ও যথেষ্ট ভাল)।

কিন্তু অভিনয়ের জন্য যদি আমাকে নায়িকাদের চালুনির নিচে ফেলে ঝাড়াই-বাছাই করতে বলা হয়, তাহলে তালিকা ছোট হয়ে আসবে। তখন কিন্তু এই মুহূর্তের তরুণী অভিনেত্রীদের নাম নয়, বর্ষীয়ানদের নাম আগে আসবে যারা বহু  বছর ধরে বিভিন্ন চরিত্রে নিজেদের প্রমাণিত করেছেন (যেটা আগের পর্বেও  বলেছি)। সেই লিস্টে আমার প্রথম পছন্দঃ মেরিল স্ট্রিপ, দ্বিতীয় ফ্রান্সিস ম্যাকডরম্যান্ড। তৃতীয় পছন্দ হিসেবে রাখতে চাই এমন একজনকে যিনি হিরোইন থেকে যে কোন সিরিয়াস চরিত্র বা ভ্যাম্প, সব চরিত্রেই সাবলীল। সেই হিসেবে যাকে পেনের ডগায় আনব, তার নাম কেট ব্ল্যাঞ্চেট। আর, যাকে অভিনয় দক্ষতার বিচারে খুব অল্পের জন্য এই তিনজনের মধ্যে রাখতে পারলাম না, তার নাম কেট উইন্সলেট। ‘টাইটানিক’ খ্যাত সুন্দরী এই ব্রিটিশ অভিনেত্রীর  ভাইরাস সংক্রান্ত একটা সিনেমা নিয়ে কিন্তু একদম প্রথম পর্বে আলোচনা করেছিলাম, মনে আছে তো? কেটের আরেকটা ছবি না দেখলে আপনি ওর অভিনয় মুন্সিয়ানা বুঝতে পারবেন না – ‘দ্য রিডার’ (২০০৮)। 

তাহলে মেরিল স্ট্রিপ-কে দিয়ে শুরু করা যাক। বয়স ৭৩, জন্মসূত্রে আমেরিকান এবং ওনাকে ওনার প্রজন্মের সেরা নায়িকা আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। ওনার যেসব ছবির কথা উল্লেখ করতেই হয়, সেগুলো হল - দ্য ডিয়ার হান্টার (১৯৭৮), ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার (১৯৭৯), দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্ট’স ওয়াইফ  (১৯৮১), সোফি’জ চয়েস (১৯৮২), আউট অব আফ্রিকা (১৯৮৫), এ ক্রাই ইন  দ্য ডার্ক (১৯৮৮), পোস্টকার্ডস ফ্রম দ্য এজ (১৯৯০), ব্রিজেস অব ম্যাডিসন কাউন্টি (১৯৯৫), অ্যাডাপ্টেশন (২০০২), অ্যাঞ্জেলস্‌ ইন আমেরিকা (২০০৩), দ্য ডেভিল অয়্যারস প্রাডা (২০০৬), জুলি অ্যান্ড জুলিয়া (২০০৯), দ্য আয়রন লেডি (২০১১) এবং ইনটু দ্য উডস্‌ (২০১৪)। অভিনয়ের জন্য সারা জীবনে ১৭৫টি পুরষ্কার জিতেছেন যার ভেতর ২১বার অস্কার নমিনেশন, ৩বার বিজয়ী, ৩২বার গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশন, ৮বার জয়, এবং ১৫বার বাফটা নমিনেশন ও ২বারের বিজয়। 

আগের পর্বে ডাস্টিন হফম্যানকে আলোচনার সময় ‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ নিয়ে লিখেছিলাম, যেখানে স্ট্রিপ ছিলেন নায়িকা। সুতরাং এই পর্বে স্ট্রিপের শুধুমাত্র ‘সোফি’জ চয়েস’ নিয়ে আলোচনা করব। আড়াই ঘন্টার এই সিনেমা  নিউ ইয়র্কের পটভূমিকায় ১৯৪৭ সালের কিছু গল্প নিয়ে, যার প্রধান চরিত্রে তিনজন – সোফির নামভূমিকায় মেরিল স্ট্রিপ, সোফির প্রেমিক এক পাগলাটে যুবক নাথান এবং এক হবু ঔপন্যাসিক স্টিঙ্গো। সোফি এক পোলিশ উদ্বাস্তু, তার এক কালো অতীত আছে। তার দু’সন্তান জার্মান কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে মৃত। সে  কোনমতে আমেরিকা পালিয়ে বেঁচেছে। নাথান পাগলাটে, এক ল্যাবে কাজ করে এবং মনে করে সে কিছুদিন পরেই পোলিওর যুগান্তকারী ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলবে। কিন্তু রোজ সে সোফি-কে সন্দেহ করে। এবং সদ্যযুবক স্টিঙ্গো সদ্য আমেরিকায় এসেছে, এদের দুজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে, কিন্তু মনে মনে সে নিজের লেখক হবার ইচ্ছেকেই বেশি ভালবাসে এবং ভালবাসে মিষ্টি মুখের অধিকারী সোফি-কে। ছবি এগিয়ে চলে, একসময় সোফি ও স্টিঙ্গো মিলিত হয়, এবং শেষ মুহূর্তে গিয়ে সোফি ও নাথান আত্মহত্যা করে। কিন্তু যেটা এই গোটা সিনেমা জুড়ে রয়ে যায়, তা হল সোফি হিসেবে স্ট্রিপের দুর্দান্ত অভিনয়। পোলিশ-আমেরিকান উচ্চারণ এবং ছবির ফ্ল্যাশব্যাকে পোলিশ-জার্মান উচ্চারণ। এগুলো স্ট্রিপ-কে বহুদিন ধরে শিখতে হয়েছিল। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সিনে অভিনয়ের জন্য নিজেকে রোগা ও বিবর্ণ করতে হয়েছে। এই স্ট্রিপ ক্র্যামার বা  ডিয়ার হান্টারের স্ট্রিপের থেকে অনেক আলাদা। সেখানেই এই ছবির মজা।

ফ্রান্সিস ম্যাকডরম্যান্ড জন্মসূত্রে আমেরিকান, বয়স ৬৫ এবং অভিনয়ের বিবিধ শিরোপা তার মাথাতেও (৩বার অস্কার, ২বার বাফটা, ১বার গোল্ডেন গ্লোব)। তার যে যে সিনেমার কথা বলতেই হয় - মিসিসিপি বার্নিং (১৯৮৮), হিডন্‌ অ্যাজেন্ডা (১৯৯০), ফারগো (১৯৯৬), অলমোস্ট ফেমাস (২০০০), দ্য ম্যান হু ওয়াজন্ট দেয়ার (২০০১), নর্থ কান্ট্রি (২০০৫), বার্ন আফটার রিডিং (২০০৮), প্রমিস্‌ড ল্যান্ড (২০১২), থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি (২০১৭) এবং নোম্যাডল্যান্ড (২০২০)। এখানে ম্যাকডরম্যান্ডের ‘ফারগো’ নিয়ে আলোচনা করব।

এক অপরাধমূলক ব্ল্যাক কমেডি সিনেমা হল ‘ফারগো’। পরিচালক জোয়েল  কোয়েনের ৯৮ মিনিটের ছবি। ম্যাকডরম্যান্ড এখানে মিনেসোটা শহরের গর্ভবতী পুলিশ চিফের ভূমিকায়। সেই শহরের এক গাড়ি বিক্রেতা নিজের শ্বশুরের থেকে মোটা টাকা আদায়ের জন্য নিজের বউকে দুজন ডাকসাইটে অপরাধীকে দিয়ে অপহরণ করানোর প্ল্যান করে। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় যে পরপর বেশ কয়েকটা খুন হয়। ম্যাকডরম্যান্ড অনুসন্ধান করতে নামেন। তারপর অনেক সত্যি সামনে আসে। এই সিনেমায় ম্যাকডরম্যান্ডের অভিনয় তারিফের যোগ্য। ওনার আরো এক ছবি ‘থ্রি বিলবোর্ডস...’ শুধুমাত্র ওনার অভিনয়ের জন্যই দুর্দান্ত।  

জন্মসূত্রে অস্ট্রেলিয়ান ক্যাথরিন এলিস ব্ল্যাঞ্চেট (কেট ব্ল্যাঞ্চেট) এখনো সমানভাবে ছবিতে ও মঞ্চে অভিনয় করে চলেছেন। বয়স ৫৩। তার মনে রাখার মত সিনেমাগুলো হল - এলিজাবেথ (১৯৯৮), দ্য অ্যাভিয়েটর (২০০৪), নোটস্‌ অন আ স্ক্যান্ডাল (২০০৬), আয়াম নট দেয়ার (২০০৭), এলিজাবেথঃ দ্য গোল্ডেন এজ (২০০৭), দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাট্‌ন (২০০৮), ব্লু জাসমিন (২০১৩), ক্যারল (২০১৫), সিন্ডারেলা (২০১৫), নাইটমেয়ার অ্যালি (২০২১) ইত্যাদি। অভিনয়ের জন্য ২বার অস্কার, ৩বার গোল্ডেন গ্লোব, ৩বার বাফটা পেয়েছেন। এখানে ওনার ‘ব্লু জাসমিন’ নিয়ে আলোচনাই সঙ্গত হবে।

উডি অ্যালেনের ১ ঘন্টা ৪০ মিনিটের কমেডি-ড্রামা ব্লু জাসমিন ছবির নামভূমিকায় ব্ল্যাঞ্চেট। টাকা তছরূপকারী স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর জাসমিন মানসিক উৎকন্ঠায় ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করে এবং নিজের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তার প্রচুর ধারদেনা হয়ে যায়। অবশেষে সে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে নিজের বোনের কাছে সান ফ্রান্সিসকো চলে আসে। সেখানে বোনের প্রেমিকের বিষয়ে সে নাক গলাতে শুরু করে এবং সেই নিয়ে তার বোনের দু’বার ব্রেক-আপ হয়।  এরপর জমাটি নাটক, শেষেও বেশ ড্রামা। ব্ল্যাঞ্চেটের মেধাবি অভিনয় এই সিনেমাকে ‘এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’ ছবির সঙ্গে একাসনে বসিয়ে দেয়।  এমনকি ছবির শেষ সিনেও অনবদ্য স্বগতোক্তি।

হলিউড বিদূষীদের নিয়ে কথা শেষ করার আগে আরো কয়েক লাইন। ‘দ্য মমি’ (১৯৯৯) সিনেমার অভিনেত্রীকে মেনস্ট্রিম নায়িকার ছাপ মেরে অস্কার কমিটি বারবার উপেক্ষা করে গেছে, শুধু একবার সেরা সহ-অভিনেত্রীর পুরষ্কার দেওয়া ছাড়া (‘কনস্টান্ট গার্ডনার’, ২০০৫)। এই নায়িকার নাম র‍্যাচেল ভাইশ। বয়স  ৫২। কিন্তু বিভিন্ন সিনেমায় তার বেশ কিছু ভাল অভিনয় ছড়িয়ে আছে যেগুলোর সিরিয়াস মূল্যায়ন হওয়া দরকার ছিল। এর আগের ১২ নম্বর পর্বে আর্ট হাউজ মুভি নিয়ে র‍্যাচেলের ‘দ্য ফাউন্টেন’ সিনেমার কয়েক লাইন উল্লেখ করেছিলাম।  আরো দুটোর নাম বলছি, দেখবেন। ‘মাই কাজিন র‍্যাচেল’ (২০১৭) এবং ‘দ্য ডিপ ব্লু সি’ (২০১১)। আরেক নায়িকার কথা উল্লেখ করতে চাই যার বয়স এখন  মাত্র ৩৭, কিন্তু এই বয়সেই সে বেশ কিছু ভাল অভিনয় দেখিয়েছে এবং বিভিন্ন রকমের চরিত্রে। কিরা নাইটলি। ওর ভবিষ্যত উজ্জ্বল। কিরার তিন রকম অভিনয় বোঝার জন্য আমি পাঠককে তিনটে সিনেমা দেখতে বলব – অ্যাটোনমেন্ট (২০০৭), দ্য ডাচেস (২০০৮), এ ডেঞ্জারাস মেথড (২০১১)। 

এবার হলিউডের সমান্তরালে পৃথিবীর যে চারজন বর্ষীয়ান অভিনেত্রীকে আমরা তাদের দক্ষতার জন্য বেছে নিতে পারি, তারা হলেন ইউরোপ থেকে লিভ উলমান (নরওয়ে), ক্যাথরিন ডেনেভ (ফ্রান্স) এবং এশিয়া থেকে ইয়ুন জিওং-হি (দক্ষিন কোরিয়া) ও গং লি (চিন)। 

নরওয়ের জীবিত কিংবদন্তী অভিনেত্রী লিভ উলমান (বয়স ৮৩) তার বাবার চাকরিসূত্রে জাপানে জন্মেছিলেন। কিন্তু খুব ছোট বয়সে তার বাবা মারা যাবার পর তার পরিবার আবার নরওয়েতে ফিরে আসে। ইংমার বার্গম্যানের বেশিরভাগ যৌন মনস্তাত্বিক ছবির প্রধান মুখ ছিলেন তিনিই। তার সময়ের সেরা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অভিনেত্রী বলতে উলমান-কেই বোঝায়। দুর্ভাগ্য, সারাজীবনে একবারো অস্কার পাননি, কিন্তু ২০২২-এ তাকে অনারারী অস্কার দেওয়ার সময় কমিটি স্বীকার করে নেয় যে তার সিনেমার প্রধান গুণ হল ‘bravery and emotional transparency that has gifted audiences with deeply affecting screen portrayals’। তার প্রধান ছবিগুলো হল - পারসোনা (১৯৬৬), শেম (১৯৬৮), দ্য প্যাশন অব আনা (১৯৬৯), দ্য এমিগ্রান্টস (১৯৭১), ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস (১৯৭২), সিন্‌স ফ্রম আ ম্যারেজ (১৯৭৩), ফেস টু ফেস (১৯৭৬), অটাম সোনাটা (১৯৭৮), ফেইথলেস (২০০০), সারাবান্ড (২০০৩)। এখানে আমরা তার ‘পারসোনা’ নিয়ে কিছু কথা বলব।

এই সিনেমায় লিভ উলমান একজন বিখ্যাত স্টেজ অভিনেত্রী, এলিজাবেথ। একদিন অভিনয় করতে গিয়ে এলিজাবেথ চোখে অন্ধকার দ্যাখে। পরের দিন কথা বলতে বলতে বোবা হয়ে যায়। ডাক্তারের পরামর্শে কিছুদিনের জন্য সে বাল্টিক সমুদ্রের ধারে হাওয়া বদল করতে যায়। সঙ্গে থাকে এক নার্স। কিন্তু যত সময় যায়, এলিজাবেথ সেরে ওঠার বদলে এই দুজন একে অন্যের চরিত্রে আস্তে আস্তে ঢুকে যেতে থাকে। তাদের আর আলাদা করা যায় না। বার্গম্যানের ৮৪ মিনিটের অনবদ্য রহস্যে ঢাকা বিভ্রান্তিকর মনস্তাত্তিক ভয়ার্ত ছবি। এবং সেই রহস্য প্রায় প্রতি সিনে ফুটিয়ে তুলেছেন উলমান। পিটার কাউয়ি এই ছবি নিয়ে বলেছিলেন – ‘everything one says about Persona may be contradicted; the opposite will also be true’।

ফ্রেঞ্চ অভিনেত্রী ক্যাথরিন ডেনেভ আরেক জীবিত কিংবদন্তী। বয়স ৭৮। বেশ কয়েক দশক জুড়ে ছিলেন সেরা ফ্রেঞ্চ অভিনেত্রী। তার অভিনীত যে যে ছবি দেখতেই হয়, সেগুলো - দ্য আমব্রেলাজ অব চেরবার্গ (১৯৬৪), রিপালসন (১৯৬৫), বেল দে জুর (১৯৬৭), দ্য ইয়ং গার্লস অব রোশফোর্ট (১৯৬৭), মিসিসিপি মারমেড (১৯৬৯), ত্রিস্তানা (১৯৭০), আন ফ্লিক (১৯৭২), অ্যানিমা পেরসা (১৯৭৭), দ্য লাস্ট মেট্রো (১৯৮০), দ্য হাঙ্গার (১৯৮৩), ডান্সার ইন দ্য ডার্ক (২০০০)। আজ আমরা ‘বেল দে জুর’ নিয়ে আলোচনা করব কারণ  ডেনেভ-কে বুঝতে গেলে এই সিনেমা দেখতেই হবে।

‘বেল দে জুর’ বা ‘বিউটি অব ডে-লাইট’ লুই বুনুয়েলের এক অন্যতম সফল ছবি  যা ক্যাথরিন ডেনেভ-কে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ডেনেভ এখানে এক সুন্দরী গৃহবধূ যে তার স্বামীর সাথে যৌনসুখ উপভোগ করতে পারে না। তার ফ্যান্টাসি লুকিয়ে বিভিন্ন রকম ব্যথাদায়ক যৌনতায়। ফলে সে আস্তে আস্তে এক হাই সোসাইটি বেশ্যালয়ে প্রতি সপ্তায় কয়েকদিন দুপুরে সময় দিতে শুরু করে, যখন তার স্বামী কাজে ব্যস্ত। এবং তার জীবনে আবার যৌনসুখ ফিরে আসে। বিতর্কিত সিনেমা, বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের মত সময়ে। কিন্তু সাহসী। মেয়েরাও যে নিজের ইচ্ছেমত যৌনতা প্রকাশ করতে পারে, এই ছবি তার সিম্বল। ডেনেভ সেইসব মেয়েদের প্রতিভূ। প্রতি সিন মনে রাখার মত। এইরকম সিনেমা দেখলে বোদলেয়ারের কবিতা মনে পড়ে – ‘O fleeting beauty / By whose glance I was suddenly reborn / Shall I see you again only in eternity?’ স্বদেশ সেনের কবিতাও যেন এর কাছাকাছি।

কোরিয়ান অভিনেত্রী ইয়ুন জিওং-হি বয়সে ডেনেভের সমসাময়িক। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে সিনেমায় চুটিয়ে অভিনয় করছেন। কিন্তু প্রায় শেষ জীবনে এসে ‘পোয়েট্রি’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরষ্কার পেলেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজ- গুলোর মধ্যে রয়েছে মিস্ট (১৯৬৭), দ্য ফার্স্ট নাইট (১৯৬৭), স্নো-স্টর্ম (১৯৬৮), ইউনাক (১৯৬৮), বান-রাইজ স্টোরি (১৯৭১), নাইট জার্নি (১৯৭৭), স্প্লেন্ডিড আউটিং (১৯৭৮), ভিলেজ অব হেজ (১৯৮৩), দ্য আইল অব শিরো (১৯৮৮), ফ্লাওয়ার ইন স্নো (১৯৯২) এবং পোয়েট্রি (২০১০)। যদিও ‘পোয়েট্রি’ নিয়ে আমি কোরিয়ান সিনেমার দিন আলোচনা করেছিলাম, এখানে  আরো কিছু বলা দরকার। বিশেষত জিওং-হি-র অভিনয় নিয়ে। একজন ৬৬ বছর বয়স্ক ঠাকুমা যে কোন ছবিতে নায়িকা হতে পারেন, তা এই ছবিতে জিওং-হি করে দেখিয়ে দিয়েছেন। বিবর্ণ হয়ে আসা স্মৃতি, টাকার জন্য এই বয়সেও  অনৈতিক কাজ করার সাহস, তার মাঝে কুরে কুরে খাওয়া অপরাধবোধ, আর সবার ওপরে কবিতা বা পোয়েট্রি বা শি – জিওং-হি যেভাবে এক মাটির কাছাকাছি থাকা ঠাকুমার চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আর কেউ পারত কিনা সন্দেহ আছে।

গং লি চিনের সিনেমার এক প্রধান মুখ। বয়স ৫৬, এবং আজ অব্ধি চিনের যে চারটে সিনেমা অস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়েছিল, তার তিনখানাতেই অভিনয় করেছেন গং লি। তার বাছাই কয়েকটা হবি হল - রেড সোরঘাম (১৯৮৭), এ সিটি অব স্যাডনেস (১৯৮৯), জু দো (১৯৯০), রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন (১৯৯১), ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন (১৯৯৩), টু লিভ (১৯৯৪), ২০৪৬ (২০০৪), সাংহাই (২০১০), গুই লাই (২০১৪) ও লিপ (২০২০)। চিনের ছবি নিয়ে যেদিন লিখেছিলাম, গং লি-র এক মাস্টারমিস ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ আরেক ক্লাসিক ‘রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন’ নিয়ে কয়েক কথা। ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে চিনদেশের ধনী  শ্রেণী এবং তাদের একাধিক মিস্ট্রেস রাখার গল্প নিয়ে এই ছবি। মিস্ট্রেসদের নিজেদের ভেতর ঈর্ষা ও রেষারেষি নিয়ে টানটান সিন। গং লি এই ছবির চার নম্বর মিস্ট্রেস। লো টোন অভিনয়, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এবং অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করার চরিত্র ফুটিয়েছেন গং লি। অবশ্য তার সঙ্গে এই ছবি অপেরার ঢংয়ে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছেন তারই আরেক সহ অভিনেত্রী হি সাইফাই।

ওপরের সবার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এক ব্রিটিশ নায়িকা – জুডি ডেঞ্চ, এক স্প্যানিশ নায়িকা – পেনেলোপি ক্রুজ এবং এক ফ্রেঞ্চ নায়িকা – মারিয়ন কোটিলার্ড, এদের উল্লেখ করতে ভুলে গেছি। এদের ছবি দেখতে ভুলবেন না।   

 

(ক্রমশ)

 


জে. হোবেরম্যান

 

আন্দ্রেই রুবলেভ : এক দিব্য ভাব-বিগ্রহের উদয়

 

(অনুবাদ : অদিতি ফাল্গুনী) 




আন্দ্রেই তারকোভস্কির নিষ্করুণ অন্ধকার ও চমকপ্রদ সিনেমা ‘আন্দ্রেই রুবলেভ‘ যখন প্রথম ১৯৬০-এর শেষ দশক নাগাদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র আয়োজনে প্রদর্শিত হলো (১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে এই ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হয়, তবে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য ছবিটির আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনী বন্ধ রাখে), তখন আপাত:দৃষ্টে ছবিটিকে মনে হয়েছে যেন এক মূর্তিমান অসঙ্গতি - পুনরুত্থিত স্লাভিক অতীন্দ্রিয়বাদে অভিযুক্ত এক প্রাক-সোভিয়েত নিষ্ঠুরতার মঞ্চ। আজ, তারকোভস্কির নির্মিত এই দ্বিতীয় কাহিনীচিত্র যেন সোভিয়েত ইউনিয়নে নব্বইয়ের দশকে আসন্ন সেই ঝড়েরই পূর্বাভাস জানিয়েছিল বলে মনে হয়।

সত্যি বলতে সের্গেই আইজেনস্টেইনের ‘ইভান দ্য টেরিবলে‘র বিশটি বছর পর তারকোভস্কি নির্মিত ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’ ছিল ঐতিহাসিক বিচারে সবচেয়ে  দু:সাহসী সিনেমা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের মহত্ত্বের নিরিখে এর উচ্চতা দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাশিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম আইকন বা গির্জার প্রতিমূর্তি আঁকিয়ে আন্দ্রেই রুবলেভের (১৩৬০-১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দ) জীবনী নিয়ে তারকোভস্কির এই মহাকাব্যিক সিনেমায় রুবলেভের জীবন নানা জায়গায় পরিচালক নিজেও যেন  অনেকটাই ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’ সৃষ্টি করেছেন। ‘আন্দ্রেই রুবলেভ‘ সিনেমার নির্মাণ বিচারে যতটাই সেরা, ভাবাদর্শগত দিক থেকে ততটাই যেন ‘ক্ষ্যাপাটে’। একটি সোভিয়েত সিনেমা হিসেবে সহিংস এবং এমনকি রক্তাক্ত এই ছবি ‘আন্দ্রেই রুবলে’‘ মধ্যযুগে রাশিয়ায় তাতার আক্রমণের নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত এবং গোটা সিনেমাটিই কালানুক্রমিকভাবে এক গ্রন্থনাহীন নাট্যাভিনয়ের  দৃশ্যাবলীই যেন দর্শকের সামনে মেলে ধরে। এই সিনেমার নায়ক যেন এক অপার্থিব বা দৈবী সত্ত্বার মত পরিত্যক্ত ঐশ্বর্যের এক ভূ-খন্ডে ঘুরে বেড়ান - তিনি দেখছেন যন্ত্রণা ভোগা কৃষকের দল, পবিত্র গ্রন্থরাজি তাঁর চোখের সামনে অধ্যাসের মত দেখা দিচ্ছে, তিনি কাজ করছেন নিষ্ঠুর অভিজাতদের জন্য যতদিন না ভ্লাদিমিরের শহর আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হওয়ার সময় এক নারীকে  আক্রমণে উদ্যত এক তস্করকে হত্যা করার পর রুবলেভ নীরবতার শপথ নেন এবং ছবি আঁকা ছেড়ে দেন।




একইসাথে বিনয়ী এবং মহাজাগতিক এই ছবি ‘রুবলেভ’-কে পরিচালক   তারকোভস্কি নিজেই বর্ণনা করেছেন ‘পৃথিবীর ছবি’ হিসেবে। ওয়াইড স্ক্রিনে শ্যুট করা এবং তীক্ষ সাদা-কালোয় বিন্যস্ত, সংজ্ঞায়িত এই ছবি চূড়ান্তভাবে স্পর্শকাতর - এই সিনেমায় প্রদর্শিত চারটি ধ্রুপদী উপকরণ হলো: কুয়াশা, কাদা, নিভে যেতে থাকা মোমবাতি এবং তুষার। একটি আদিম আস্তাবলকে ঘিরে ক্যামেরার ৩৬০-ডিগ্রি আবর্তন মূলত: মানব অস্তিত্বের বিস্ময়কেই প্রকাশ করে।   ক্যামেরার এই যত দীর্ঘ ও আঁকাবাঁকা টেকগুলো যেন কোন এক্সপ্রেশনিস্ট বা অভিব্যক্তিবাদী শিল্পীর হাতের ব্রাশস্ট্রোক - তুলির কাজ। এক গাঢ়, অশান্ত নদীর উপরিভাগে একটি ঘোড়ার ক্ষুরের দাগের অভিঘাতকে ক্লোজ-আপে শটে ফুটিয়ে তোলা থেকে তারকোভস্কির ক্যামেরা আবার ছুটে যায় এক বন্ধ্যা পাহাড়ের পাশ দিয়ে তাতার ঘোড়সওয়ারদের পথের ধূলো উড়িয়ে ছুটে চলার দিকে। অন্য সময়গুলোতে পরিচালকের ক্যামেরা ঠিক যেন দেবদূতের মত এক যন্ত্রণার্ত ভূ-খন্ডের বাতাসে ভাসতে থাকে। সিনেমাটির মেধাবী ও অব্যখ্যাত সূচনায় এক মধ্যযুগীয় ইকারুসকে দেখায় যে কিনা এক ক্রুদ্ধ জনতাকে স্বর্গরাজ্যে ঝড়ো  আক্রমণের জন্য সাহস যোগাচ্ছে। একটি চার্চের মিনারে আরোহণ করে এই ইকারুস একটি আদিম গরম-বাষ্পীয় বেলুনে চড়ে ওড়ার সময় - নিচে পৃথিবীর অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখানো হতে থাকে - যতক্ষণ না বেলুনে করে ওড়া ইকারুস ভূ-পৃষ্ঠে পড়ে পিষ্ট হয়ে যান।

তারকোভস্কি ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’-এর কাজ শুরু করেন।  এটি ছিল তাঁর প্রথম কাহিনীচিত্র ‘ইভানস চাইল্ডহুড’ ভেনিসে স্বর্ণ সিংহ পাবার দু‘বছর পর এবং নিকিতা ক্রুশ্চেভের ক্ষমতাচ্যূতির একমাস আগের ঘটনা। ১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে বিরূপ আবহাওয়ায় ছবিটির ফটোগ্রাফির মূল কাজ বন্ধ হয়ে যেতে না যেতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কৃতি বিষয়ক কর্তাব্যক্তিরাও তারকোভস্কির প্রতি বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬৬ সালের জুলাইয়ে রুবলেভ যখন শেষমেশ সমাপ্ত হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় ফিল্ম এজেন্সি সিনেমাটির নানা দৃশ্যের ব্যপক কাট-ছাঁট দাবি করেন। রুশ বিপ্লবের পঞ্চাশতম পূর্তির ঠিক প্রাক্কালে এই ছবিটি ছিল যেন বড় বেশি নেতিবাচক, বড় বেশি নিষ্ঠুর, বড় বেশি পরীক্ষামূলক, বড় বেশি ভীতিকর, বড় বেশি নগ্নতায় ভরা এবং রাজনৈতিকভাবেও বড্ড বেশি জটিল। মস্কোয় প্রথম একবারের মত স্ক্রিনিং হওয়ার পরে (রাশিয়ার ডম কিনো প্রেক্ষাগৃহটি এইদিন চারপাশ থেকে পুলিশে ঘেরাও ছিল), ‘দ্য প্যাশন এ্যাকোর্ডিং টু আন্দ্রেই’ শিরোনামের এই সিনেমাটি তাকবন্দী করে ফেলা হয়। সিনেমাটি থেকে প্রায় পঁচিশ মিনিটের দৃশ্যাবলী কেটে বাদ দেয়ার পর (যা অবশ্য তারকোভস্কি নিজেই পরে অনুমোদন করবেন) ১৯৬৭ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি তালিকাভুক্ত করা হয় শুধুমাত্র শেষ মুহূর্তে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাতিল  হবার জন্য। দুই বছর পরে, ফরাসী কম্যুনিস্ট পার্টিকে তাদের আন্দোলনের জন্য অংশত: ধন্যবাদ দিতেই হয়, রুবলেভ শেষপর্যন্ত কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় - তবে ছবিটি বলতে গেলে প্রতিযোগিতার বাইরে ছিল। ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনে ভোর চারটায় স্ক্রিনিং সত্ত্বেও ছবিটি ‘আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরষ্কার’ অর্জন করে। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে; লিওনিদ  ব্রেজনভে ছবিটি তাকে আলাদাভাবে একান্তে দেখানোর দাবি তোলেন বলেও পরে জানা যায় এবং সিনেমাটির মধ্য পর্যায়েই তিনি হল থেকে বের হয়ে আসেন।

ফ্রান্সে সোভিয়েত দূতাবাসের কঠোর বিরোধিতা এবং ছবিটির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরও প্যারিসে ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’  উন্মুক্ত হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালে সোভিয়েত সাংস্কৃতিক আমলাতন্ত্র খানিকটা নমনীয় হন এবং ১৯৭১ সাল নাগাদ ছবিটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে প্রদর্শিত হবার ছাড়পত্র পায়। দু’বছর পর নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘রুবলেভ’ দেখানো হয়, তবে ছবিটির মার্কিনী পরিবেশক ‘কলম্বিয়া পিকচার্স’ সিনেমাটির আরো কিছু কাট-ছাঁট করে। টাইম ছবিটি ডক্টর জিভাগো-র সাথে তুলনা করে। নিউইয়র্কের অন্য চলচ্চিত্র আলোচকেরা যারা সিনেমাটির নোট নিয়েছেন, তারা ‘রুবলেভ’-এর আপাত: ছেঁটে ফেলা অংশের কথা উল্লেখ করে ছবিটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছিলেন।

যাহোক, বিশেষ কি আর বলার আছে? শিল্পী রুবলেভকে সিনেমার শুরুতেই তাঁর দুই সন্ন্যাসী ভাইয়ের সাথে পরিচয় করানো হয় যারা ঝড়ের ভেতর একটি আস্তাবলে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে কিছু গ্রাম্য চাষী অশালীন কৌতুকাভিনয়ে  বিনোদিত হচ্ছে। পরবর্তী দৃশ্যক্রমে, দু‘জন সন্ন্যাসী পরস্পর মিলে নন্দনতত্ত্ব আলোচনা করছে যখন কিনা চার্চের বাইরে একজন কারাবন্দীকে একটি তাকের উপর রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। অবশেষে, ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে, এই দুই সন্ন্যাসীর একজন মঠ ছেড়ে বাইরে বের হবে এবং এই বলে অভিসম্পাত দিতে থাকবে যে শিল্পের প্রতি নিবেদনই তাঁর ভাইদের নষ্ট করেছে। পরবর্তী সময়ে রুবলে ‘শেষ বিচার’-এর একটি দৃশ্য এঁকে বিশ্ববাসীদের ভীত করতে অস্বীকৃতি  জানান। রুবলেভের এই নীতি তাঁর কর্মজীবনকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল; তবে নিয়তির পরিহাস হলো যে গির্জা অলঙ্করণের এই শিল্পীর মৃত্যুর এক শতাব্দী পরে রুশ অর্থোডক্স চার্চ তাঁরই নির্মিত বিগ্রহগুলোকে সর্বোচ্চ বৈধতা প্রদান করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্যও রুবলেভের কাজগুলোকে ‘চিরায়ত কাল ধরে শিল্পের প্রমিত মান হিসেবে অনুসরণ করতে হবে’ বলে নির্দেশ দেয়।  

তারকোভস্কির এই ছবিটিই বোধ করি সোভিয়েত শাসনামলে নির্মিত প্রথম এবং একমাত্র ছবি যেখানে শিল্পীকে একজন বিশ্বঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে দেখানো  হয়েছে এবং খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতিদ্বন্দী ধর্ম বা রাশিয়ার আদি প্যাগান বা পৌত্তলিক  ধর্মকে সেদেশের ঐতিহাসিক সত্ত্বার সর্বজনবিদিত শেকড় হিসেবে দেখানোও হয়েছে। মোটের উপর আন্দ্র্ইে রুবলেভ সিনেমাটি ইতিহাসের এক বিশৃঙ্খল যুগ বা সময়ে প্রোথিত যে যুগ ঐ বিশৃঙ্খলার ভেতরেই জাতীয় পুনর্জাগরণও ঘটাবে এবং রুবলেভের চিত্রকলা হবে সেই যুগের সাংস্কৃতিক প্রতীক। বরঞ্চ রুশ গির্জা অলঙ্করণে আইকন বা বিগ্রহের প্রতি শিল্পীদের ভক্তি বা নিবেদন এত বেশি  থাকত যে এটাই পরে রুশ চিত্ররীতিকে পশ্চিমা চিত্ররীতি থেকে আলাদা করে। পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ যতই তার চূড়ান্ত মাত্রা লাভ করতে থাকে, ততই খ্রিষ্ট ধর্মের পবিত্র বিগ্রহসমূহ আরো বেশি করেই যেন একধরনের ইহজাগতিক বা পার্থিব ও ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা লাভ করতে থাকে; অন্যদিকে  রুশ চিত্রকলা তবু পৃথিবীর বাস্তব প্রতিনিধিত্বের বদলে চৈতন্যের প্রতিভূ হয়ে ওঠে।

একদিক থেকে দেখলে, রুবলেভ যেন শুচিতা-সংযম ও কৃচ্ছ্রতায় কঠোর খ্রিষ্ট ধর্ম ও ইন্দ্রিয় বিলাসী পৌত্তলিকতার ভেতরে এক দ্বন্দের উপর প্রতিষ্ঠিত - সেই পৌত্তলিকেরা স্লাভ হোক আর তাতারই হোক। অন্য দিক থেকে দেখলে, এই সিনেমাটি আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও দমনের প্রেক্ষিতে শিল্পীর অবস্থানও দেখায়। সন্ত জনের পর্বের সাথে জড়িত রুশ লোকজীবনে তখনো অনবলুপ্ত পৌত্তলিকতার রহস্যময়তায় রুবলেভ নিজেও যেন হোঁচট খান - সন্ত জনের এই পর্ব এক অজানা আচার পালিত হয়, যেমনি কোমল তেমনি বিস্ময় জাগানিয়া, যেখানে নগ্ন কৃষকেরা কুয়াশার ভেতর থেকে মশাল বহন করে নিয়ে যায় - সন্ন্যাসী রুবলেভ নিজেই বন্দী হন এবং একটি ক্রশের সাথে তাঁকে বেঁধে ফেলা হয়। এখানে শিল্পী তারকোভস্কির এক অতি সূক্ষ্ম কাজের নমুনা:  অসাবধানতাবশত: আন্দ্রেই রুবলেভ নিজেই একটি ধিকি ধিকি করে জ্বলা  অগ্নিশিখায় পা দিয়ে ফেলায় তাঁর পোশাকে আগুন ধরে যায়, ক্ষণিকের জন্য তাঁর পোশাকে অগ্নিশিখা জ্বলতে দেখা যায়।



উপরোল্লিখিত এসব বিবরণ ব্যতীতও, সিনেমাটি নিজেই যেন একটি গোটা ভুবনকে মেলে দেখায়, অথবা, আমাদের সেই ভুবনের ঘ্রাণ নিতে সাহায্য করে,  যেমনটি আন্দ্রে বাঁজা তাঁর প্রবন্ধ ‘দ্য মিথ অফ টোটাল সিনেমা’-য় বলেছেন, পৃথিবী নিজেই এখানে স্ক্রিনের ভেতর তার পথ খুঁজে পেতে জোর খাটাচ্ছে। পরিচালনা করা যায় না এমন নানা প্রাণী তারকোভস্কির সিনেমার কম্পোজিশনকে জীবন্ত করে তোলে - শবদেহে একাকার একটি গির্জায় আবদ্ধ একটি বিড়াল, একটি বিধ্বস্ত শহরে বুনো হংসীরা ডানা ঝটপট করে। জল সাপ এবং সার বেয়ে বেঁধে চলা পিঁপড়েয় বার্চ গাছগুলোকে জীবন্ত দেখায়, অরণ্যের জমিন থেকে একটি পচতে থাকা রাজহংসী পাওয়া যায়। এই সিনেমার সাউন্ডট্র্যাক পাখির ডাক এবং শব্দহীন গান দিয়ে ভরা; আবহে প্রায়ই আগুন চিড়বিড় করে ফাটার শব্দ বা গির্জার ঘন্টাধ্বনি।

আন্দ্রেই রুবলেভ নিজেই যেন যতটা না সিনেমা, তার চেয়েও বেশি একটি ভাববিগ্রহ যা এক ভাববিগ্রহ শিল্পীর জীবন নিয়ে নির্মিত। এই সিনেমাটিকে আমরা ‘চলমান ভাববিগ্রহ’ হিসেবেও দেখতে পারি ঠিক যে অর্থে ল্যুমিয়ের  ভ্রাতৃদ্বয় ‘চলমান ছবি’ বানিয়েছিলেন। এই সিনেমা এমন এক শিল্পীর প্রতিকৃতি রচনা করেছে যেখানে কেউ একবারও হাতে তুলি তোলে না। কেননা গির্জা অলঙ্করণের বিন্যাস তো ঈশ্বরের কাছ থেকেই আসে, সেটি রুবলেভের তুলির ছিটকে  যাওয়া রঙ পুকুরের জলের আবর্তে ঘোরার ক্লোজ-আপ শটেই দেখা যাক  অথবা ময়লা ও মাটির যে চাঁই রুবলেভ একটি সাদা চুনকাম করা দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দেন, সেই দৃশ্যের চিত্রায়ণেই বোঝা যাক না কেন! তবে আর কোন সিনেমাই শিল্পীর ভূমিকার উপর এত বেশি গুরুত্বারোপ করেনি। যেন বা রুবলেভের উপস্থিতিই সৃষ্টিকে বৈধতা দান করে। 


চিত্তরঞ্জন হীরা

 

কবিতা পাঠের অভিব্যক্তি : উচ্ছ্বাস না নীরবতা!




 

পথ চলেছে পথের দিকেই বেঁকে। এই অসীমের খোঁজ কখনও ফুরোয় না। তবু রোজ কেন সে গন্তব্য হারায়! প্রশ্নটা এখানেই। জীবন একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে বাঁধা। প্রতিটি সকাল এক বৃত্তের ভোর। দিনের চলাটাও শুরু সেই ভোর থেকেই। আমরা তাকে নতুন দেখি। একটা নতুন সকাল। মাঝে মাঝে ভাবি, শুরুরও কি শুরু থাকতে পারে! প্রতিটি শুরুর আগে সে কি আরম্ভ! মুহূর্ত ভেঙে পল সেই আরম্ভের দিকে। ভেতরের অস্থিরতা হয়তো এভাবেই ভাঙে। টানাপোড়েনের ফাঁকে কিছু রঙ এসে ঢলে পড়ে। যেন সূর্যের সাতরঙ ভেঙে এই রঙবাহার। তারপর মিলে মিশে একাকার। শুধু সাদা। তবে অনুভূতির বাহ্যত কোনও রঙ হয় না। যেমন জল। তাই জলরঙে ভেতরে ভেতরে কণা কণা তাদের মিলনের রাগ অভিব্যক্তিতে এসে মিলছে। আবার কখনও উপলব্ধির দিকে বেঁকে যাচ্ছে। এই পাগলপ্রলাপের মতো তার ঘূর্ণন। কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কারণ ব্যক্তির সমস্ত অনুভূতিই একান্ত ব্যক্তিগত। একই বস্তু বা ঘটনা থেকে প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান। এটা নির্ভর করে দেখার চোখ ও গ্রহণের ক্ষমতা থেকে। এভাবে একই বস্তু একই সময়ে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন।

এ থেকে আমরা অন্তত এখানে এসে পৌঁছতে পারলাম যে, সমস্ত জ্ঞানই ইন্দ্রিয়লব্ধ। এ যদি হয় সত্য হয় তবে তা থেকে আমাদের সামনে এখন শুধু শূন্যের এক খোলামাঠ। এসে দাঁড়ালাম। এই শূন্যের অব্যক্ততায় কিছু আলো এসে পড়লো। কিছু ঘ্রাণ বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। তাকে ধরার জন্যে দুহাত বাড়ালাম। কিন্তু তাকে কি হাতে পাওয়া যায়! অতল নীলিমায় নীল এক অফুরন্ত আকাশ মাঝে মাঝে  কাশের ডানা মেলে উড়ছে আর নিঃশব্দের হাসিতে জাগিয়ে তুলছে কয়েকটি যুবতী নক্ষত্র। এই যে দেখা তা অনির্ভর অথচ যিনি দেখলেন তার কাছে তো বাস্তব! এই বাস্তব-অবাস্তবের মাঝখানে একটা জগৎ। কবিতার জগৎ। তাকে মায়া বলা যায়। এভাবেই কিছু কিছু মায়া বিভ্রমের আলো-অন্ধকার নিয়ে, রঙ-বেরঙ নিয়ে কবির মনোজগতে দোলা দিতে থাকে। যেন ছোট ছোট পা ফেলে শূন্যের দিকে হেঁটে চলেছে। তাহলে কি এ জীবন ততটা দীর্ঘ নয়! এও এক আত্মজিজ্ঞাসা হতে পারেএই দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ নিয়েও নানা প্রলাপ জেগে উঠতে পারে। আসলে কবির জগৎ প্রলাপ ছাড়া আর কি!

এক অন্ধ ভিখারি পথে অতুলপ্রসাদী ধরেছেন। এই গান এক প্রসঙ্গ। কারণ এর মধ্যে এক জীবন দেখা রয়েছে। এই দেখার মধ্যেই নিত্য তাঁর গানের মহড়া। নতুন নয় তবে ফিরে ফিরে নতুন হয়ে ওঠে। ওই বোধ। মনের ভেতরে এক গভীর বোধের নড়াচড়া। সুরের ভুবন তো হাওয়ায় হাওয়ায় ফিরছে। যখন হাওয়া ফেরে তখন মনে হয় এই সুর হাওয়ারও। খণ্ড বিখণ্ডের অনুভূতি জুড়ে জুড়ে একক সুর দীর্ঘ হয়ে মধুর মূর্ছনায় ধরা দেয়। গান তো আমরা শুনি, আবার দেখিও। দেখি গাইতে গাইতে গায়ক অনেক বেশি থামেন। এই থামাটাই মনে হলো সুরের ব্যঞ্জনা। যেন মূল গানটা পড়ে আছে ওই নীরবতার মধ্যেই। যেমন কবিতা। তার বেলাতেও আমরা যেমন অনুভব করি দুই পংক্তির ফাঁকে যে সাদা অংশগুলো, কবিতা থাকে সেখানেই তাহলে এভাবেও বলা যায় – যা দীর্ঘ নীরবতার অনুভব সে এক দীর্ঘ কবিতা। এই দীর্ঘতা একটি মাত্র শব্দের মধ্যেও থাকতে পারে আবার পাতার পর পাতা জুড়ে তার বিস্তৃত পরিসর। কবিও জীবনকে ভেঙ্গেচুরে নিজের মতো করে দেখতে বেরিয়েছেন। বলছেন –

দিনান্তে সব আসে একা একা

কথা শোনায় সৌভাগ্য গাঙের এবং বিড়ালের।

কুঁজো হয়ে বসে শোনে খদ্দের

শূন্য-বয়ামগুলি থেকে বাকি-রাখার বাণী যায় উড়ে

(নারায়ণ মুখোপাধ্যায়)

শূন্য থেকে শূন্যে, আরও শূন্যে দিনান্তের চালাঘর জুড়ে রসিকের কেনাবেচা। জীবন চলে তারই ছন্দে। এই যে গাঙের হাওয়া, তার মধ্যে এক প্রবাহ বিড়াল এক প্রতীক, সঙ্গী থাকে জীবনের। শূন্যপাত্র এই জীবনসম্ভার, তা নিয়ে কতটুকু আর বলা যায়! অথচ পড়ে থাকে এ জন্মের হাজার হাজার রজনীঘোর কথার ফের কবিতার পাঠ এভাবে নিজের মধ্যে কথার জন্ম দেয়। আমরা মাঝে মাঝেই নিজের সঙ্গে কথা বলি। নীরব কথা। নীরবতার সঙ্গে কথা। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এক নীরব নিঃসঙ্গতা বাস করে, কিন্তু সে আমাদের নিঃসঙ্গ করে না। তার সঙ্গতায় এক অপরূপ আনন্দের জাগরণ ঘটে। এই যে গায়কের কথা এলো তিনি কিন্তু পোশাকি বাউল নন। অথচ বোঝা যায় ওই মানুষটির দেহ এক, আর আত্মার মধ্যে আরেকজন। এক বাউলের বাস। যার কোনও পোশাক হয় না। তার সঙ্গেই কথা হয়। কথার পৃষ্ঠে কথা জুড়ে জুড়ে ভাব, সুর আর প্রেম। আবার এই তিনে মিলে কখন যে নিরাসক্তি আসে! বৈরাগ্যের সাধ। সে এক আশ্চর্য গোলমেলে ব্যাপার। এই জগৎ, এ বিশ্ব চরাচর যে পথের ইশারা দেয় সে পথ ভাবনার। বিশ্ব হলো মন। মনের বাইরে যাপনের অনেক শ্রম, অনেক রক্তঝরা। কিন্তু নিজের কাছে এসে দাঁড়ালে বাইরে আর কোনও চেনা নেই, জানা নেই। শুধু একার মধ্যে একা হারিয়ে যাওয়া।

চরাচরে কবি ও পাগল তাই একই রসের নাগর। প্রেমের ভাব ও অভাব। প্রেমকেই মজিয়ে তোলে। একটা পথ বেঁকে চলে যায় ভেতর থেকে আরও ভেতরের দিকে। অন্তর্নিহিতের ডাক ওঠে বারবার। ছিল প্রেম, হলো ভাব এবার তাকে মজালে রসে। জীবনে চলার পথ তো অনেক, যেতে হবে একই গন্তব্যের দিকে। কিন্তু তাকে আমরা অনন্ত বলতে পারি না। চির নির্ধারিত গন্তব্যের কথাই রসিক বলতে চান। বলছেন – নাচো। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে খানিক নাচো। তবেই তো প্রেমের ভাব বুঝবে। ভাবের রসে মজে ওঠো। তবেই জীবন বুঝবে। তার কতটুকু বুঝি আমরা! জীবন বোঝা কি অতই সহজ। বুঝতে বুঝতে এই নদী কোথায় যে হারায়! বললাম – সাধক যে সব ছেড়ে, এই সংসারের বাঁধন কাটিয়ে একলা পথের পথিক হয়ে ওঠার কথা বলেন। তার বেলা!

উনি বলছেন – এই ভবের সত্যি-মিথ্যার আমি কি জানি ঠাকুর, আমি সামান্য ভিখিরি মানুষ পথের ধুলো গায়ে মেখে পথে পথে ফিরি দিনান্তে মাধুকরির দুমুঠো অন্ন। সংসারের ভার বইতে বইতে ভেতরে অন্ধ, বাইরেও। বলতে বলতে তিনি একটু থামেন। উদাস হন। তারপর আপন মনে আবার গান ধরেন। মাঝখানে পড়ে রইলো শুধু টুকরো টুকরো তার নীরবতা। সুর ঘুরে ঘুরে বাজে। শব্দ আর নৈঃশব্দ্য মিলে সেই সুরের নেমে যাওয়া। কখনও কাছে আসে, আবার দূরে দূরে। এভাবে কোনও এক সময় মিলিয়েও যায়। কিন্তু এই অব্যক্তের ব্যক্ততা যাঁকে আক্রান্ত করে, ভেতরে ভেতরে তিনিও নীরব যাত্রী হয়ে ওঠেন। উদাসীন লগ্নতা তাকেও জড়িয়ে ধরতে বাধ্য।

মীর্জা গালিব বলছেন –

আমি রয়েছি সেইখানে যেখান থেকে

আমার কাছে আমারই খবর আসে না

ওই যে পথের গায়কের কথা বলছিলাম – তিনি দূরের উদাসীনতায় হারিয়ে যেতে যেতে এবার গেয়ে উঠলেন – "আশার আশা ভবে আসা, আসা মাত্র হলো" অতুলপ্রসাদ থেকে রামপ্রসাদে পৌঁছতে এই যে সাঁকো তার উপর মনের চলাচল চরণ তো শূন্যে থাকে। শূন্যের পা শূন্যেই ফেলে ফেলে আমরা কেমন দ্বিধা দ্বন্দ্বে ব্যাকুল হতে থাকি। কোথায় যেন মিলে যায় দুটি সুর। দ্বিধা হলো 'আসা' আর 'আশা' নিয়ে। চলে তো যেতেই হবে একদিন। তাই কোনও প্রত্যাশা নেই আর। করাও হলো না কিছু। কাজের কাজ পড়ে রইলো সবই। নিজের কাছে নিজেও যেন শুধু হারিয়ে যাওয়া। সত্যের এই এক মরমী যন্ত্রণা। কিন্তু যন্ত্রণার ভেতর সেই নীরবতার সুর দীর্ঘকবিতার মতো স্মৃতি নিয়ে সত্তা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে ঘোরে আর ফেরে। এখানেই বেজে উঠলো যেন অনন্ত।

তো নিজের ভেতর যখন দুটি সত্তা একই সঙ্গে ক্রিয়া করতে থাকে, তখনই কি নিজেকে হারিয়ে ফেলার চরম মুহূর্তটি আসে! অস্তিত্বের এই আজব খেলায় ভেতরে যতটা আলোড়ন, সেখানে উচ্ছ্বাসের ক্রিয়া নেই, ধর্ম নেই, নিশিপালন নেই। শুধু নৈঃশব্দ্য দিয়ে বুঝে নিতে হয় একটি হলো বিষাদ, অন্যটি নিরাসক্তের প্রণোদনা। এই গান, সে এক মোহ। তার প্রবাহের টানে দুকূল ছাপিয়ে অশ্রু আসে। বিষাদকে সে নিজের জলে স্নান করিয়ে দেয়। নিরাসক্ত আসে স্নানের পর গা মুছিয়ে দিতে। তারপর আরেক পরত নৈঃশব্দ্যের চাদর জড়িয়ে বাইরের অস্তিত্বে একটু হাওয়া খাওয়া। ঝিরিঝিরি দোলা লাগে হাওয়ার। যেন বসন্ত এলো এই শ্রাবণের দ্বারে। দ্বার থেকে বাহির পর্যন্ত অপূর্ব আর অভূতপূর্বের ঘ্রাণ-গন্ধের আলপনাটা বৃষ্টিই আঁকছে

কবি মাসুম রাজা বলছেন –

কোনো অতিথিই আসত না যখন হৃদয় ছিল সমুজ্জ্বল

উজাড় হয়েছে যেই, হৃদয় এখন যাতায়াতের পথ

এ পথেই এক অতীন্দ্রিয় এসে নাড়া দেয়। হৃদয়ের মধ্যে অব্যক্তের নদীপ্রবাহ। উছল কিন্তু ছলাৎছল আওয়াজ ওঠে না। সব ভেতরেই বাজে। তার উপর একটা সাঁকো। নদী বইছে। সাঁকো দুলছে। কিন্তু পড়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অতীন্দ্রিয়কে নিয়ে খেলছে মন। জগতের সব সীমা ছাড়িয়ে, সব আবদ্ধতা ছাড়িয়ে দেশকালের ঊর্ধ্বে। এ হলো নিস্তব্ধতার বিস্তার। দীর্ঘ পরিসর রচনার আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া।

প্রসঙ্গত, কবি রাহী মাসুম রাজা বা রেজার কথা উঠলো। অনেকে নিশ্চয়ই জানেন, তিনি ছিলেন উর্দু ও হিন্দী ভাষার বিখ্যাত কবি। তিনি কর্মজীবনে জড়িয়ে ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে। বহু জনপ্রিয় হিন্দী গানের গীতিকার তিনি। বিখ্যাত অনেক সিনেমার চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনাও করেছেন একেবারে নিজস্ব ঘরানায়। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ গাজীপুর এবং মৃত্যু ১৫ মার্চ ১৯৯২ মুম্বাই।

যাহোক আমরা ফিরে আসি আমাদের একান্ত মায়া আর ভাবনার সংসারে। কবিতার একটি শব্দ ভেতরে বেজে ওঠার আগে কত কত আলোড়ন যে সৃষ্টি হয় তা বোঝানো যায় না। কিন্তু ক্রিয়াটি চলতে থাকে। প্রথমে তার আবহ সৃষ্টি হয়। কবিতা তো একই সঙ্গে সৃষ্টি ও নির্মাণ। সৃষ্টি যখন নির্মাণের হাত ধরে, প্রথমে আলোড়িত করে শব্দকে। তখন তার পথে যে সম্ভাবনাগুলো, যাদের কুড়িয়ে কবি আমাদের সামনে অক্ষরের রঙ, রূপ, রসে সাজিয়ে দিতে চাইছেন, তার মধ্যে কিছুটা বিভ্রম, কিছুটা মায়া তো কাজ করেই। ভাবনা তাদের ছাড়া বাঁচে না। ধরা যাক একটা দৃশ্য, বাস্তবে সেটা নেই, কিন্তু কবির ভেতর ভেসে উঠলো। যেমন গান আসে, কান্না আসে। কান্নার আবার অনেক রঙ। তাতে ভেসে যাওয়া। অরূপ আধার এক। এই অমূল্য ভাণ্ডার গড়িয়ে শ্মশানের আভাস আসে, চিতা আসে, অগ্নি আসে। কখনও এমন হয় চোখের সামনে নিরন্তর সেই চিতাটি জ্বলছে। চিতার উপর শুয়ে আছে একটা দেহ। সে মৃত না জীবিত বোঝা যায় না। কখনও মনে হয় – এতো আমারই শব। এই অনুভূতি যখন জাগে, তা থেকে যে শব্দপুঞ্জের ঘনঘটা শুরু হয়, তা একজন পাঠকের মধ্যেও যখন চারিয়ে যায় তখন পাঠক সবার আগে অবাক হন। অর্থাৎ বাক্যরহিত হন, নৈঃশব্দ্যতাড়িত হন। অভিব্যক্তির উচ্ছ্বাস প্রকাশের তখন আর কোনও পথ নেই। ওই যে 'আমার কাছে আমারই খবর আসে না' তাই নিজের মধ্যে নিজেকে তখন শুধু খুঁজে ফেরা। নিজের মধ্যে নিজের আরেক সত্তা, আরেক রূপ, প্রতিবিম্বের আলোছায়ায় খুঁজে ফেরা

এখানে আমরা দুটি অণুকবিতার কথা উত্থাপন করলাম। কিন্তু ভাবনার বিশ্বে তার বিস্তৃতি অণু নয়। দীর্ঘ পরিসর জুড়ে জীবনের এক আশ্চর্য অনুভব জাগালো। বোধের চিত্রায়ন ঘটলো। গোটা ক্যানভাস জুড়ে যে রঙ, সুর, তার কি কোনও ব্যাখ্যা হয়! এই রঙের বিশ্বটিও অব্যক্ত। এই অব্যক্ততার মধ্যেও যেটুকু বলা যায় তা হলো পরিসর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কবির অভিপ্রায়ই প্রধান। তিনি তাঁর ভাবনাকে কীভাবে প্রকাশ করতে চান সেটাই লক্ষ্যণীয়।

ঠিক এভাবেই আমরা পরিসরে দীর্ঘ এমন কবিতাকে সামনে রেখেও কিছু কথা বলতে পারি। বলার কথা হলো, চর্যাপদের পর থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা কাব্য বলতে যা বুঝেছি তা আসলে গান। কারণ কবিতাকে গান করেই শোনানো হতো। অবশ্য আমরা পাঠযোগ্য কবিতায় এসে পৌঁছেছি সেই মহাকাব্যের হাত ধরেই। যা ছিল আখ্যায়িত কাব্য। যেখানে চরিত্র, ঘটনা, জীবনের অভিঘাত নিয়ে এক একটা পরিসর সময় ও কাল জুড়ে তার বিস্তার। সেখানে নানা রসের সংমিশ্রণ রয়েছে। ফলে তার অভিব্যক্তিও নানারকম। হাসি, কান্না, ক্রোধ, উল্লাস, প্রতিশোধস্পৃহা সবই হয়তো রয়েছে। পরবর্তীতে গদ্যসাহিত্যের যখন উদ্ভব হলো, তার কাহিনি, চরিত্র বিন্যাস থেকে যে অভিঘাত, তার প্রতি মানসিক অবস্থান হয়তো একরকমই

আখ্যানকাব্যে কবির প্রধান অভিপ্রায় ছিল দেবতার মাহাত্ম্য প্রচার এবং ধর্মবিশ্বাস। সাহিত্যের বিবর্তনে সেখান থেকে দুটি শাখার উদ্ভব ঘটেছিল। গদ্যসাহিত্যে কাহিনি, চরিত্র, ঘটনার সংঘাত সব মিলিয়ে কিছুটা জীবনের কথা বলা শুরু হলো। তখন অভিব্যক্তিও পাল্টে গিয়ে জীবনকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে লাগলো। মহাকাব্যের একটি শাখা এভাবে বেঁকে গেলো উপন্যাসের দিকে। পরবর্তীতে উপন্যাস ছোট হতে হতে জন্ম নিলো ছোটগল্প। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেলো কাব্যের প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো আর গদ্যে থাকছে না। যেমন কাব্যময়তা, যেমন রূপকচিত্র, রহস্যব্যঞ্জনা, তার ব্যবহার, প্রতীক, দৃশ্যকল্প ইত্যাদি। একেবারে যে থাকছে না তেমন নয়। সে প্রসঙ্গ অন্য।

আমরা উপন্যাসের কথা বললাম। সাহিত্যে গদ্যের পাশাপাশি বিশেষত মহাকাব্যের প্রভাব ও প্রচারের গুণে আরেকটি শাখার জন্ম হয়েছিল। বলা যায় প্রতিকাব্য। সময়ের আধারে মহাকাব্যের বর্ণময় চরিত্র, সংঘাতময় ঘটনার অভিঘাত থেকে জন্ম নেওয়া নতুন কবিতা। দীর্ঘ রূপে। এছাড়া সংলাপ কাব্য, কাব্যনাটক ইত্যাদি। রবীন্দ্র-উত্তর কালে দেখা গেলো দীর্ঘকবিতাও ক্রমশ নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠছে। আর এই নৈর্ব্যক্তিকতাই আমাদের টেনে নিয়ে যায় গূঢ় নৈঃশব্দ্যের দিকে। এই নৈঃশব্দ্যই পাঠক মনের বিশেষ অভিঘাত।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সবই বদলায়। যেমন এখানে দেবতার অনুগ্রহ কমে কবিতার ধারা নেমে এলো মাটির মানুষের কাছাকাছি। চরিত্র এবং ঘটনার মধ্যে নতুন ভাষায় নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেতে শুরু করলো সমকালীন সমাজভাবনা, জীবনদর্শন, মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না, প্রেম, বিরহ ইত্যাদি। এখন সময় আরও বদলে গেছে। দ্রুতগামী হয়েছে। তাই পাঠকের মানদণ্ডে সময় ছুটছে। শিল্প প্রকাশিত হতে চাইছে তার তালে তাল মিলিয়ে। কম পরিসরে বৃহতের ভাবনা। কম শব্দে সহস্রের মূর্ছনা। ছোটগল্প তাই ছোট হতে হতে আরও ছোট। অণুগল্প বা ঝুরোগল্প। তেমনি মহাকবিতা থেকে অণুকবিতার দিকে যাত্রা। যদিও আমরা উর্দু শের, জাপানি হাইকু ইত্যাদি বহু আগেই পেয়েছি। যা অণু হলেও প্রসারতায় অনেক অনেক দীর্ঘ নীরবতার কথাই বলে।

এই নীরবতাই আমাদের একটি কবিতার দুই পংক্তির মধ্যবর্তী সাদা অংশে বা এক স্তবক থেকে আরেক স্তবকে যাওয়ার পথে নৈঃশব্দ্যের কাছে এনে দাঁড় করায়। যখন কবি বলছেন

সন্ধ্যাপাতা ঝরে পড়ে রাত্রিগাছ থেকে। একাগাছ।

হিম রাত। পান্থশালা। পাশে নদী। একা নদী।

কারা যেন আগুন জ্বেলেছে। আঁকে আবছা তারাদের মুখ।

ছায়াকঙ্কালের মত ট্রেন গেল দিগন্ত কাঁপিয়ে

(অশ্বমেধ / মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)

এখানে শুধু পংক্তি নয়, স্তবক নয়, প্রতিটি শব্দের ফাঁকে ফাঁকে ভাবনার বীজ দীর্ঘ দীর্ঘ নৈঃশব্দ্যের ওম জাগে। একটু একটু করে আমাদের আলোড়িত করতে চায়। পাঠককে ডাকে। বলছে – দেখো। মননের দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াও। দেখো টুপ শব্দে ঝরে পড়লো যে পাতাটি তার শরীর জুড়ে সন্ধ্যা। যে গাছ থেকে সে পড়লো, সেটি রাত্রিগাছ। বোধকে প্রসারিত করো। একাকী নিঃশব্দের মধ্যে বাহিত আত্মার প্রবাহ। কবিতা এখানে।

সচেতন অভিপ্রায় বোধ ও মননকে ভিন্ন রূপে জাগায়। শব্দে তার প্রকাশ ঘটে। চেতনা যত প্রসারিত হবে পথ তত দীর্ঘ হবে। এখানে বলার হলো, মহাকাব্যের যুগ ছেড়ে যেমন একটি পথ বেঁকে গিয়েছিল গদ্যসাহিত্যের দিকে, আরেকটি পথ গেলো দীর্ঘকবিতার দিকে। জীবনানন্দ যাকে বললেন মহাকবিতা। আমরা প্রসঙ্গক্রমে বলতে চেয়েছিলাম গদ্যসাহিত্যে কাব্যের প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো বর্জিত হতে থাকে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যে আমরা মাঝে মাঝেই কবিতা ফুটে উঠতে দেখেছি। মহৎ সাহিত্যের এটা একটা দিক। আবার রবীন্দ্রনাথ যখন 'শেষের কবিতা' লিখছেন তখন সমগ্র উপন্যাসের মধ্যে যে পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব, যে স্বপ্ন-ব্যর্থতা, যে ক্ল্যাইমেক্স, তা তো দীর্ঘ কবিতার আরেক রূপ। বুদ্ধদেব বসু এই উপন্যাসকে বলেছেন 'কাব্যোন্মাদ কাহিনী'। এরকম আরও অনেক কাহিনি আমরা বাংলা সাহিত্যে পেয়েছি, যার পরতে পরতে সেই নৈঃশব্দ্যের মধুর মূর্ছনা। কবিতার আবহ নিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চায় আরও গভীর কোনও অনুভূতিদেশে। বিস্তীর্ণ সেই চরাচরে এসে বসে অবাক আঁচল পেতে।

কবির সৃষ্টিতে আত্মজৈবনিক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে এই পরিসর রচনা। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই স্মরণীয় যে কবিতার জগৎ সবসময় রহস্যের জগৎ। কবি বলছেন, "যে জগতে প্রবেশ করার চাবি পাঠককেই নিজের চেষ্টায় আপন অনুভূতি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে। কবিতা কিছু বলবে না তা নয়, বরং অনেক অনেক কিছু বলবে, স্তরে স্তরে তার অন্তহীন অর্থ ছড়ানো থাকবে। কিন্তু বলবে পরোক্ষভাবে, আকারে-ইঙ্গিতে, নানা সংকেতের মধ্যবর্তিতায়, শব্দকে তার সাধারণগ্রাহ্য অর্থের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে" ( রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিকতা / অরুণকুমার সরকার)

এই সত্যের নিহিতে পাঠকের চারণভূমি। কবি চলেছেন তার সৃষ্টির বীজ আপন খেয়ালে বিশ্বে ছড়িয়ে ছড়িয়ে। পাঠককে নেমে পড়তে হবে সমস্ত বাঁধন খুলে। মনের বাঁধন, চিত্তের বাঁধন, সংস্কারের বাঁধন খুলে। তা না হলে শব্দকে অর্থের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করা সম্ভব কীভাবে! অভিজ্ঞতায় প্রসারিত বোধই কবির অভিপ্রায়কে ভাষা ও আঙ্গিকের খেলায় মাতিয়ে তোলে। আবার জাগতিক সমস্ত সংকট থেকেও মূর্ত-বিমূর্তের খেলা তীব্র হতে পারে‌। এর সব কিছু নিয়েই কবির জগৎ। এক উপলব্ধিময় বিশ্ব। আমাদের নেমে যেতে হয় তার অতলে।

ধরা যাক একটা দৃশ্য এলো। জ্যোৎস্না খেলছে জাগতিক অস্থিরতার মধ্যে এক অবাক স্থির জলস্থলির উপর। মন ঠায় দাঁড়িয়ে সেখানে। মুহূর্তে জল ভরে উঠছে ফুল, পাতা, রজনীচন্দনের ধূপগন্ধ নিয়ে। যেন রচিত হলো একটি মনবাসর। ঘর বলতে সেই শূন্যের চরাচর। হঠাৎ বৃষ্টি এলো। যেন পায়ে নূপুর তার। অবিশ্রান্ত টাপুরের মধ্যে টুপুর টুপুর ধ্বনি। বৃষ্টি কীভাবে এক নারীর আদল পায় কেউ জানে না। কবি তাকেই দেখেন। তার হাঁটার তালে, নৃত্যের ভঙ্গিমায় যেন মহাকালের মুহূর্তগুলোও ধ্বনিময় মাধুর্য হয়ে বেজে ওঠে। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় আমাদের। কবি দেখেন কখনও বৃষ্টি, কখনও নূপুরের ধ্বনি, কখনও বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রভূমি জুড়ে পাকাধানের শীষ দুলে উঠছে। বেজে উঠছে বাঁশির সুর। ভাঙা ভাঙা ধ্বনিগুলো কবি নিঃশব্দ দিয়ে জুড়তে বসেন সেই বাসরঘরের এককোণে।

এই দেখার মধ্যে যে বাস্তব, পাঠককে সেখানেই পৌঁছতে হয়। ওই যে অপার রহস্যের জগৎ, সেখানে প্রবেশের চাবিটি। সমস্ত কি খুলে বলা যায়! যা অনুভব থেকে পাওয়া তাকে অনুভূতির তারেই বাজাতে হবে। সৃষ্টিরহস্যের বাকল খুলে দৃশ্যের আড়ালে যে দৃশ্য তাকে উন্মুক্ত করতে হবে। যে স্রোত ভেতরে বইছে, সেখান থেকেই দৃশ্যের উদ্ভব, তারপর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে পৌঁছে যাওয়া। বাস্তব থেকে পরাবাস্তব হয়ে অতিবাস্তবের পথকে প্রসারিত করা। যে নারীটি বৃষ্টি থেকে আদল পেলো তার ছায়াও ধারাপাতের বিন্দু থেকে নির্মিত। আবার দৃশ্যের পট যখন বদলায়, হয়তো এই আলোকিত বাসর, এই ভরা শষ্যক্ষেত্র সব নিভিয়ে শ্মশাননিস্তব্ধতায় ভরে উঠলো। বাসরের সাজ হয়ে উঠলো চিতাসাজ। শুধু আতর আর ধুনোর গন্ধ। সুদূরপ্রসারী রাত্রি এসে বাজিয়ে চলেছে পারাপারের গান। কোনও গানই স্পষ্ট নয়। অশ্রুনদীটি খেয়া বাইছে চাঁদের ঘাট বরাবর। তো এই হলো জীবন থেকে মৃত্যুর পথে শৈশব পেরিয়ে একবার বাসরের সাজ, ক্রমে ধূধূ মাঠ, জলাধার, শ্মশান, অগ্নি সব মিলিয়ে চক্রটি যখন পূর্ণ হয়, পড়ে থাকে বিষাদের দুঃখ ছুঁয়ে আনন্দের মিশ্ররাগ। দুঃখ এবং আনন্দ তখন পাশাপাশি হাঁটে।

আমরা আগেই বলতে চেয়েছিলাম চেতনার আলো আর বোধের বিস্ময়েরর কথা। একজন কবি যেমন পূর্বাপর শব্দের খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে সময়কে অতিক্রম করেন তেমনি পাঠককেও তার চেতনার সঙ্গী হতে হয়। সময় পাল্টে দিচ্ছে সৃষ্টির প্রবণতাগুলো। ফলে বদলে যাচ্ছে অনেক লক্ষণ। পরিবর্তনশীল সভ্যতার নতুন নতুন লক্ষণ ফুটে ওঠে কবিতার শরীরে। যা হয়ে ওঠে নতুন দর্শন। কিন্তু পাঠবিশ্বে তার অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয় সেই নীরবতার মধ্যে দিয়েই। এর বেশি আর বলার কী থাকতে পারে, শুধু পাঠক হয়ে ওঠা ছাড়া!