কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৯৯  


প্রকাশিত হলো ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ৯৯তম সংখ্যা। এই সংখাটি একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা, কেননা এই সংখ্যার সঙ্গেই আমাদের অনলাইন জার্নির ৯ বছর পূর্ণ হলো। অর্থাৎ ৯৯টি সংখ্যা প্রকাশ করতে আমাদের সময় অতিবাহিত হলো ৯ বছর। বিশেষত এই ৯৯ সংখ্যাটির একটি আলাদা তাৎপর্যও আছে। কেননা ৯৯ অতিক্রম করা মানেই ১০০ বা সেঞ্চুরির অমোঘ আকর্ষণ ও হাতছানি। এবং একইসঙ্গে আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। যাঁরা ক্রিকেট খেলার অনুরাগী, খেলেন এবং দেখেন, তাঁরা বোঝেন, যখন কোনো ব্যাটসম্যান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যাটিং করতে করতে ব্যক্তিগত রানের স্কোর ৯৯তে পৌঁছে যান, তখন তাঁরা কতটা উদ্বেগ ও উত্তেজনার মুখোমুখি হন। কেননা বিশ্বের যেসব দেশে ক্রিকেট প্রচলিত আছে, সেইসব দেশের অসংখ্য ক্রিকেটার অসংখ্যবার সেঞ্চুরি যেমন করেছেন, তেমনি অনেক ক্রিকেটার ৯৯তে পৌঁছে আউট হয়ে গেছেন। ৯৯এর গাঁট পেরোতে পারেননি। আর এই না পেরোনোর দুঃখ, যন্ত্রণা, হতাশা তাঁদের তাড়া করে ফিরেছে বাকী সারাটা জীবন।

কিন্তু এটা নিতান্তই ক্রিকেট খেলার মাঠের ব্যাপার। অন্যান্য ক্ষেত্রে যে এই ৯৯এর গাঁট কাউকে বিড়ম্বিত করেছে, অন্তত সাহিত্যক্ষেত্রে, তা বলা যায় না। যাঁরা পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে দীর্ঘদিন নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারেন, তাঁরা অনেকেই তাঁদের পত্রিকার শততম সংখ্যা সম্পাদনা ও প্রকাশের গৌরব অর্জন করেন। আবার যাঁরা শততম সংখ্যা প্রকাশের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেন না, তাঁদের কৃতিত্বও কম নয়। আসলে কোনো পত্রিকার কতগুলি সংখ্যা প্রকাশিত হলো, তার একটা বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও, আসল গুরুত্বটা নির্ভর করে সেই পত্রিকার চরিত্র ও মানের ওপর। যদি পত্রিকার মান যথেষ্ট উন্নত হয় এবং পত্রিকার একটি নির্দিষ্ট চরিত্র উন্মোচিত হয়, তবে সেই পত্রিকার হাতেগোণা মাত্র কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেলেও তা গৌরবের অধিকারী।

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘কালিমাটি অনলাইনে’র আগামী সংখ্যা, অর্থাৎ শততম সংখ্যা আমরা আগামী মার্চ মাসে প্রকাশ করব একটি বিশেষ সংখ্যা রূপে। ‘সাহিত্যিক অশোক তাঁতী স্মরণসংখ্যা’। অকালে প্রয়াত অশোক ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকা এবং ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের নিয়মিত লেখক ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, গল্পকার এবং প্রবন্ধিক। অনেক পত্র পত্রিকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। অত্যন্ত মার্জিত ও সজ্জন এই সাহিত্যিক তাঁর স্বভাবগুণে অনেকেরই অত্যন্ত প্রিয় ও কাছেরজন ছিলেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ তাঁকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে বিগত বছরে। যাঁরা অশোকের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবনের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের কাছে ‘কালিমাটি অনলাইন’এর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, তাঁকে নিয়ে এবং তাঁর সম্পর্কে কলম ধরার জন্য। তাঁদের কাছে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা, তাঁরা আমাদের অনুরোধে ‘সাহিত্যিক অশোক তাঁতী স্মরণসংখ্যা’র জন্য লেখা পাঠিয়ে সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রসঙ্গত আরও একটি কথা উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরি, এই সংখ্যাটির সংকলন ও সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সাহিত্যিক ঝুমা চট্টোপাধ্যায়কে। অশোক ও ঝুমা দুজনেই দুর্গাপুরের। তাঁরা সেখানকার সাহিত্যসভায় নিয়মিত যোগদান করতেন এবং সাহিত্যভাবনা বিনিময় করতেন। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, ঝুমা খুবই যত্ন ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। আগামী মার্চ মাসে ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের শততম সংখ্যা ঝুমা চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হবে প্রয়াত সাহিত্যিক অশোক তাঁতীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৭ 




সেটা ১৯৯৭ সাল। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভাল তখন নিতান্তই শিশু। আমিও তখন যাদবপুরে সদ্য মাস্টার্স করতে গেছি। সেই সময় ফিল্ম ফেস্টিভালে গোর্কি সদনে তিনটে রাশিয়ান ছবি দেখেছিলামঃ ব্যাটলশিপ পোটেমকিন, ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ১ এবং ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ২। যেহেতু তখন প্রধান ভিড় হত  নন্দনে এবং গোর্কি সদনে খুব কম লোকেই উপস্থিত হত (একমাত্র সিনেমা প্রেমীরাই যেত), তাই সেই পঁচিশ বছর আগের বাতানুকূল ফাঁকা নিশ্চুপ গোর্কি সদনে এই তিনটে রাশিয়ান ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখার পর আমি রাশিয়ান ছবির ভক্ত হয়ে যাই। এটা ঠিক যে এই তিনটে সিনেমাতেই মুগ্ধ করে দেবার মত কিছুই নেই, বরং ইভান দ্য টেরিবল্‌ ছবিতে বীভৎসতা দেখান হয়েছে, কিন্তু রাশিয়ান ছবির ইতিহাস প্রাধান্যতা দর্শককে সিটে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করে। পরবর্তীকালে যখন তারকোভস্কির সিনেমা দেখেছি, তখন রাশিয়ান ছবির অন্য মাত্রা চোখে পড়েছে।   

এই পর্বে সেজন্য জার্মানির পর আমাদের গন্তব্য রাশিয়ান সিনেমা। তবে হ্যাঁ, প্রথমেই একটা ছোট ব্যাপার খোলসা করে নিই। আমি কিন্তু ১৯২২ থেকে ১৯৯১ অব্দি সোভিয়েত ইউনিয়ন আর তারপর ভেঙে গিয়ে রাশিয়া, ইতিহাসের এইসব  কচকচানিতে যাব না। রাশিয়া হিসেবেই পুরোটা উপস্থাপন করব। তবে সিনেমার পাশে ব্র্যাকেটের ভেতর তার সাল দেখে উৎসাহী পাঠক যদি সেই ভাঙা হিসেব করে নিতে চান, আমার কোন আপত্তি নেই।

তাহলে প্রথমেই রাশিয়ান সিনেমার একগুচ্ছ ডালি সাজিয়ে বসি। সেই দেশের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পরিচায়ক হিসেবে।   

ভার্তভের ‘ম্যান উইথ এ মুভি ক্যামেরা’ (১৯২৯), আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫), ‘ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ১’ (১৯৪৪) এবং ‘ইভান দ্য টেরিবল্‌ পার্ট ২’ (১৯৫৮), কালাটোজোভের ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’ (১৯৫৭), গ্রেগোরি চাকরে-র ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’ (১৯৫৯), তারকোভস্কির ‘আন্দ্রেই রুবলভ’ (১৯৬৬), ‘সোলারিস’ (১৯৭২), ‘দ্য মিরর’ (১৯৭৪) ও ‘স্টকার’  (১৯৭৯), পারাজানভের ‘শ্যাডোজ অব ফরগটেন অ্যানসেস্টার্স’ (১৯৬৫) ও ‘দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্‌স’ (১৯৬৮), বন্দারচাকের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ (১৯৬৬-৬৭), গেইদাই-এর ‘দ্য ডায়মন্ড আর্ম’ (১৯৬৯), আবুলাদজের ‘দ্য উইশিং ট্রি’  (১৯৭৭), ভ্লাদিমির মেনশোভের ‘মস্কো ডাজন্ড বিলিভ ইন টিয়ার্স’ (১৯৮০), এলেম ক্লিমভের ‘কাম অ্যান্ড সি’ (১৯৮৫), মিখাকভের ‘দ্য বারবার অব সাইবেরিয়া’ (১৯৯৮), সোকুরোভের ‘রাশিয়ান আর্ক’ (২০০৩) এবং আন্দ্রে জিয়াগিনশেভের ‘লেভায়াথন’ (২০১৪)।   

এই লেখার ১১ নম্বর পর্বে আইজেনস্টাইন ও ১২ নম্বর পর্বে পারাজানভকে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ফলে আর তাদের সিনেমা আলোচনায় আনব না। আজ জোর দেব তারকোভস্কির ওপর। মোট পাঁচটা সিনেমা নিয়ে আজ বিশদে আলোচনা হবেঃ ব্যালাড অব এ সোলজার, দ্য মিরর, স্টকার, কাম অ্যান্ড সি এবং লেভিয়াথন। এবং যদিও আলোচনা করব না, তবুও বলি যে এই লিস্টে সোকুরোভের ‘রাশিয়ান আর্ক’ (২০০৩) রেখেছি শুধুমাত্র একটা কারণে। ৯৬ মিনিটের একটাই লং শটে এক সিনেমা বানানো, মাত্র একটা টেকে – অদ্ভুত ও অবিস্মরণীয়। সিনেমার ইতিহাস শুধুমাত্র এই কারণেই এই সিনেমা কোনদিন ভুলতে পারবে না।

গ্রেগোরি চাকরে-র ‘ব্যালাড অব এ সোলজার নিয়ে লিখতে গিয়ে একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। রবার্ট বার্নসের ‘এ রেড, রেড রোজ – ‘Till all the seas gang dry, my dear/ And the rocks melt with the sun, / I will love thee still, my dear/ While the sands of life shall run.’। এই সিনেমা যেন ভালবাসার কবিতা। সেলুলয়েড বন্দী দেড় ঘন্টার এক কবিতা। এক যুবক-যুবতীর রোমান্টিক আখ্যান, এক বিবাহিত দম্পতির নিঃশব্দ ভালবাসার গল্প, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসার টান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯ বছরের এক রাশিয়ান সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য এক মেডেল পায়। কিন্তু সেই মেডেলের বদলে সে কয়েকদিনের জন্য তার বাড়ি ফিরতে চায়, যাতে সে তার মা-কে দেখতে পায় ও বাড়ির ছাদ মেরামত করতে পারে। ফেরার সময় সে তার সাথে আরেক সৈনিককে নিয়ে ফেরে যার একটা পা যুদ্ধক্ষেত্রে কাটা গেছে। যদিও সে আর বাড়ি ফিরতে উৎসাহিত নয় কারণ তার মনে হয় তার স্ত্রী হয়ত আর তাকে মেনে নেবে না, কিন্তু বাড়ি ফেরার  পর দেখা যায় তার স্ত্রী তাকে আগের মতই ভালবাসে। ১৯ বছরের সেই সৈনিক এরপর এক অফিসারকে ঘুষ দিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা দেওয়া এক মালবাহী ট্রেনে উঠে পড়ে। সেই ট্রেনে সে এক রিফিউজি যুবতীর সান্নিধ্য লাভ করে এবং তাদের মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই যুবতী তার গন্তব্য স্টেশনে নেমে যাবার পর ট্রেনে এক বিস্ফোরণ হয়। সেই সৈনিক কোনমতে  অবশেষে তার বাড়ি অব্দি পৌঁছয়, তার মাকে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে পায়, আবার বেরিয়ে পড়ে, কারণ ছুটি শেষ। তার মা তাকে বিদায় দিয়ে আবার অপেক্ষা শুরু করে ছেলে এরপর কবে ফিরবে সেই আশায়।

যুদ্ধের আবহে বেদনাদায়ক ভালবাসার ছবি। যা কবিতার মত বয়ে চলে। প্রতি ফ্রেম অনবদ্য। বেশ ভাল লাগে ট্রেনের সেই অল্পবয়স্ক যুবতীর ভূমিকায় যানা প্রোখোরেঙ্কোর সহজ সরল আপনভোলা অভিনয়। এবং এক ১৯ বছরের সৈনিকের চোয়ালচাপা দেশভক্তি কিন্তু যুবতীর স্পর্শ পাবার জন্য তার স্বাভাবিক আকর্ষণ ও যৌন আকাঙ্ক্ষা। এই সিনেমাকে সেই সময়ের ‘socialist realism  with a human face’ বলা হত। ক্যামেরার কাজও বেশ ভাল। ডিপ ফোকাস সিনগুলো দেখার মত।

বার্গম্যান ও কিউব্রিকের পর এক্সপেরিমেন্টাল থিম নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজের তালিকায় যার নাম আসবে, সেই পরিচালক হলেন তারকোভস্কি। তাঁর  পরিচালনা করা ছবির লিস্টে ধর্মীয়, কল্পবিজ্ঞান, আধাভৌতিক, সব রকম থিম রয়েছে। তাঁর বৈশিষ্ট্য হল ক্যামেরার স্লো মোশন, লং টেক এবং বিভিন্ন ফ্রেমে  স্বপ্নের মত চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলা। মোট ২৪ বছরের ফিল্ম কেরিয়ারে তিনি মাত্র সাতটা ছবি তৈরি করেছিলেন এবং তার শেষ দুটো রাশিয়া থেকে স্বেচ্ছা  নির্বাসিত অবস্থায়। বোঝাই যায় কী রকম মানসিক চাপ নিয়ে তিনি ৫৪ বছরের ছোট জীবন কাটিয়েছেন। এখানে তাঁর দুটো সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব যাতে  পাঠকের কাছে তারকোভস্কির কাজ ঠিক করে ফুটিয়ে তোলা যায়।

মনে করে দেখুন, আমি কিন্তু এই লেখার ১১ নম্বর পর্বে পৃথিবীর সেরা ১২ ক্লাসিক মাস্টারপিস সিনেমার লিস্টে তারকোভস্কির ‘মিরর’ রেখেছিলাম। আজ  সেই সিনেমা নিয়েই আমাদের পরবর্তী আলোচনা। এর আগেও বলেছিলাম যে কীভাবে একটা সিনেমা গ্রেট হয়ে ওঠে। নিজস্বতা, অনন্যতা ও স্বতন্ত্রতা, এগুলোই গ্রেটনেসের পরিচয়। দর্শক যদি সিনেমা থেকে নতুন কিছু না পায়, সে সেই মুভি গ্রেট হিসেবে মেনে নেবে না। সেদিক দিয়েই বরং মিরর-কে কাটাছেঁড়া করা যাক।

১০৬ মিনিটের ছায়াছবি। মৃত্যুশয্যায় থাকা এক কবির মানসচেতনে একে একে ফুটে উঠছে তার ছেলেবেলা, তার মা, তার গ্রাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি এবং সেইসব সময়ের কথা যা তার সুখ দুঃখের সাথী। তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে রোজকার সংলাপ ফুটে উঠছে, কখনো মাথায় আসছে তার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের বেদনা। অবশ্য এই পুরো ন্যারেশন নন-লিনিয়ার, এরসঙ্গে মিশে আছে স্বপ্ন, ফ্ল্যাশব্যাক, কবিতা। সিনেমা বারবার ঘোরাফেরা করেছে যুদ্ধের আগে, যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধের পরের ঘটনায়। প্রধান চরিত্রের স্মৃতির পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছেন আরেক চরিত্রের স্মৃতি। অবজেক্টিভ। সব মিলিয়ে আধুনিক স্ট্রিম অব কনসাসনেস ভরা ফ্রেম। এক কথায় অদ্ভুত ও অনবদ্য।

এই সিনেমার প্রধান কাজ হচ্ছে ক্যামেরার কাজ। কালার, সাদা-কালো ও সেপিয়া, এই তিন ধরনের রং নিয়ে পরিচালক ফ্রেম থেকে ফ্রেমে খেলা করেছেন। আবার একই ব্যক্তিকে দিয়ে বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়েছেন। ফলে তাঁর কাজ যারা আগে দেখেন নি, তাঁরা বিভ্রান্তিতে পড়বেন। দর্শক বুঝতেই পারবেন না,   এই সিনেমার চরিত্র আসলে পরিচালকেরই আরেক ছায়া। সময়কে নিয়ে ফ্রেম থেকে ফ্রেমে খেলা করেছেন যা অন্য কোন শিল্পকর্মে এভাবে সম্ভব নয়। তারকোভস্কির নিজের কথায় – ‘no other art can compare with cinema in the force, precision and starkness with which it conveys awareness of facts and aesthetic structures existing and changing with time’। এবং এই টাইমফ্রেমের বদলে যাওয়াই মিরর-কে স্বতন্ত্র করে তোলে। পরিশেষে, এই ছবির প্রেক্ষিতে আবার বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অস্কার কমিটি বাঁধা রাস্তা ছেড়ে অচেনা রাস্তায় নামতে শেখেনি।

এরপর ‘স্টকার’। ১৯৭২ সালের বিখ্যাত উপন্যাস ‘রোডসাইড পিকনিক’  অবলম্বনে তৈরি ২ ঘন্টা ৪০ মিনিটের ছবি। কী নেই এই সিনেমায়? কল্পবিজ্ঞান,  দর্শন, মনস্তত্ব, রূপক ও জটিলতাকে কী করে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়, তার পরীক্ষাগত উদাহরণ স্টকার। আমি এই সিনেমাকে আমার লেখার ১২ নম্বর  পর্বে ৭০ দশকের সেরা দুটো এক্সপেরিমেন্টাল বা আর্ট-হাউজ সিনেমার মধ্যে রেখেছিলাম। যদিও আলোচনার পরিসর হয়নি।

কোন এক অজানা দেশে ও সময়ে এক সংরক্ষিত এলাকা আছে যা সবার কাছে ‘জোন’ হিসেব পরিচিত। সেখানে নাকি অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটে। এক চোরাগাইড সেখানে দুজনকে নিয়ে যায় – এক বেদনামুখর সাহিত্যিক ও এক প্রফেসর যিনি আবিষ্কার করতে ভালবাসেন। সেই ‘জোন’এ নাকি দীর্ঘ টানেল পেরিয়ে এমন একটা ঘর আছে যা মানুষের ভেতরে চাপা কামনা-বাসনাকে সাকার করে। এরপর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলে। শেষ দৃশ্যে সেই গাইডের বাড়ির সামনে দিয়ে ট্রেন চলে যায়, গোটা বাড়ি কাঁপতে থাকে।

এই সিনেমার ‘জোন’ পরবর্তীকালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ‘চেরনোবিল এক্সক্লুশন জোন’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছিল যেহেতু এই সিনেমায় পাওয়ার প্লান্ট  গোছের কিছু একটা পেছনে দেখান হয়েছিল। যাইহোক, এই সিনেমায় প্রথমেই বলি মিউজিকের কথা। তারকোভস্কি মনে করতেন সঙ্গীত হচ্ছে প্রতি সিনের চিত্রকল্পের সমান্তরাল এক বিকল্প যা পালটে দিয়ে একটা গোটা চিত্রকল্পের মানে বদলে দেওয়া যায়। তিনি এটাও বলতেন যে যেখানে প্রতি সিনে পারস্পরিক  লেনদেন আছে, সেখানে আবার মিউজিকের বদলে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা যায়। এই দর্শনের সদব্যবহার হয়েছে স্টকার সিনেমায়। যেমন, জোনের দিকে তিনজন যত এগোচ্ছে, তত জলের শব্দ বাড়ছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে জোন আসলে এক ভেজা জায়গা। এরপর ফটোগ্রাফি। মানুষের মাথা যে ফটোগ্রাফির সাবজেক্ট হতে পারে, সেটা এই ছবি দেখে পাঠক নিশ্চয় বুঝেছেন। এমনকি ডায়লগ ও নৈঃশব্দ, দুটোই লক্ষ্য করার। আসলে এই ছবি ছিল এক রূপক,  তৎকালীন শিল্পের ওপর রাজনৈতিক চাপ ও সেই চাপমুক্তির সুপ্ত ইচ্ছে। এই ছবি খুব ভালভাবে দেখলে বোঝা যায়, তারকোভস্কি সামাজিক বুর্জোয়াদের বাঁধন আর সহ্য করতে পারছিলেন না, তাঁর মনের সুপ্ত বাসনা ছিল রাশিয়া ছেড়ে চলে যাবার।   

এলেম ক্লিমভের ‘কাম অ্যান্ড সি’ ১৪২ মিনিটের এক যুদ্ধবিরোধী সিনেমা।  ১৯৭৮ সালের উপন্যাস ‘আয়াম ফ্রম এ ফিয়ারি ভিলেজ’ অবলম্বনে। গোটা ছবি  জুড়ে শুধু নাৎসি বাহিনীর তান্ডব ও অত্যাচার। জার্মান নাৎসি বাহিনী যখন বেলারুশ দখল করে রেখেছিল, তখন এক কিশোর ফ্লোরিয়া একদিন তাদের গ্রামের পরিত্যক্ত ট্রেঞ্চে এক রাইফেল পায়। তারপর তার মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেলারুশ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। এবং তারা গ্রামে ফিরে আসে। এসে দ্যাখে সেই গ্রামের ৬২৮ জন গ্রামবাসীকে একসঙ্গে পুড়িয়ে মারার বীভৎসতা, একইসঙ্গে হিটলারের ফটো ভেসে ওঠার বৈপরিত্য। ফ্লোরিয়ার কাছে যুদ্ধ দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে। হতাশ হয়ে সে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যায়।

যেটা বলে শুরু করতে চাই, তা হল, এই সিনেমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বেশ শক্তিশালী আর উপস্থাপনা মনে রাখার মত। এটা এমন এক সিনেমা যেখানে বেঁচে থাকাই কষ্টের। সিনেমায় বাস্তব, পরাবাস্তব আর জাদুবাস্তব একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সাথে মনস্তাত্তিক আর রাজনৈতিক মোড়। এই সিনেমার আরেক বৈশিষ্ট্য এর বৈপরিত্য। ক্লিমভ বেশ নিপুণ হাতে একদিকে যুদ্ধের দৈত্যাকার চেহারা আর মাঝে মাঝেই অন্যদিকে রূপকথার মত কিছু ছবি স্ক্রিনে তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি যদি যুদ্ধবিরোধী ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ আর ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ রাখা হয় (দুটো সিনেমাই এর অনেক পরে তৈরি হয়েছে), তাহলে দেখব  যুদ্ধের বর্বরতা দেখানোর জন্য এই ছবি কিন্তু বেশি মারাত্মক। তেমনি সুন্দর এর ক্যামেরার কাজ। অন্ধকার মাঠে হঠাৎ কমলা দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠা বা সকালের ঘন কুয়াশা ভেদ করে আচমকা জার্মান বাহিনীর একদম সামনে চলে আসা, এগুলো মনে রাখার মত।

রাশিয়ান সেন্সরশিপের কাঁচি বাঁচানোর জন্য এবং এই সাহসী সিনেমা যাতে পাঠকের কাছে পুরোটা তুলে দেওয়া যায়, তার জন্য ক্লিমভকে পাক্কা আট বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরপর উনি আর কোন সিনেমা করেননি। জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন – ‘I lost interest in making films… everything that was possible I felt I had already done’। বোঝা যায়, রাজনীতির চোরাগোপ্তা মারপ্যাঁচে স্পষ্টতই হতাশ হয়েছিলেন। তাহলে পারাজানভ থেকে শুরু করে তারকোভস্কি হয়ে ক্লিমভ অব্দি, বুঝতে পারছেন, রাশিয়ান রাজনীতি সে দেশের শিল্প ও সাহিত্যেকে কতটা চেপে রাখার চেষ্টা করেছে?   

আজকের শেষ আলোচনা ‘লেভায়াথন’। ইহুদি রূপকথায় ‘লেভায়াথন’ মানে এক  প্রকান্ড ও শক্তিশালী সামুদ্রিক দৈত্য। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এর মানে শক্তিশালী রাজনৈতিক বুর্জোয়াতন্ত্র। আন্দ্রে জিয়াগিনশেভের ‘লেভায়াথন’ সেই রকম এক বুর্জোয়া রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে এক সাধারণ মানুষের যুদ্ধ দেখাতে  চেয়েছে। রাশিয়ার এক ছোট্ট বন্দরশহরের এক জেলে-কাম-মেকানিক সেখানকার দুর্নীতিবাজ মেয়রের বিরুদ্ধে কোর্টে গিয়ে লড়াই করতে বাধ্য হয়। কারণ সেই মেয়র সেই জেলের বাড়ি, জমি আর গ্যারাজ আত্মসাৎ করে নিয়ে  সেখানে একটা মোবাইলের টাওয়ার বসাতে চায়। সাহায্যের জন্য জেলেটি মস্কো থেকে তার পুরনো দিনের এক বন্ধুকে ডেকে পাঠায়, যে মস্কোর বড় একজন উকিল। দুজন মিলে মেয়রের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে এবং ঠিক করে মেয়রের দুর্নীতি ফাঁস করবে। কিন্তু কোর্টে কেস শুরু হবার পর সেই মেকানিককে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য অ্যারেস্ট করা হয়। কোর্টে মেয়রের জিত হয়। এরপর সেই জেলের পরিবারে একে একে অশান্তি শুরু হয়। তার স্ত্রী সুইসাইড করে। ছবির শেষে দেখা যায় সেই জেলের বাড়ি ভেঙে সেখানে এক চার্চ তৈরি হচ্ছে।

যদিও এই ছবির স্ক্রিন-প্লে দারুন, কিন্তু আমি এই ছবিকে আগের সিনেমাগুলোর মত প্রচুর নম্বর দেব না। এর বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি আছে। কিন্তু যে জায়গায় লেভায়াথনকে সাবাস বলতেই হবে, তা হল, বেশিরভাগ রাশিয়ান ছবির যুদ্ধ ঘেঁষা প্লট ছেড়ে বেরিয়ে এই সিনেমা সাধারণ রাশিয়ান মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে  এক সাদামাটা গল্প বলেছে, যা মাটির কাছাকাছি। রাজনীতির ধূর্ত মারপ্যাঁচগুলো দেখিয়েছে। এবং রাশিয়ান সরকারের সাংস্কৃতিক বিভাগ এই ছবি প্রকাশের পর বিরুদ্ধতা করেছিল। (ভাগ্যিস নিষিদ্ধ করেনি!)

১৪১ মিনিটের এই সিনেমার স্ক্রিন-প্লে কাটাছেঁড়া করলে আমরা আরেকটা ডাইমেনশন খুঁজে পাব। এর সিনগুলো খুব ভালভাবে উলের মত ঘন বুননে বাঁধা। এর প্রতি সিনের গড়ে ওঠা ড্রামা কিন্তু কখনোই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয় না, অন্তত জিয়াগিনশেভ সেভাবে দেখান না। যেটা উনি প্রতিবার করতে থাকেন, তা হল, ড্রামা শুরু হয়, পাক খেতে থাকে এবং হারিয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা যেমন ঘুরেই চলে। আস্তে, নিয়ম মেনে। পরিচালক পর্দা না ফেলা অব্ধি দর্শক সেই মেথডিকাল ড্রামা দেখতে থাকে। এবং এই সিনেমার স্ক্রিন-প্লে’কে আমি সমালোচক হিসেবেও বাহবা দেব কারণ এখানেই প্রথম জিয়াগিনশেভ তার  সিনেমাগুরু তারকোভস্কির প্রভাব ছেড়ে সচেতনভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন।  

ব্যাস, আজ এই অব্ধিই। একটা সিনেমা ইচ্ছে থাকলেও এই লিস্টে রাখলাম নাঃ আকিরা কুরোসাওয়ার ‘দারসু উজালা’ (১৯৭৫)। এই বিখ্যাত জাপানি  পরিচালকের একমাত্র রাশিয়ান ছবি। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে অনবদ্য সিনেমা। সময় পেলে দেখে নিতে অনুরোধ করব।

রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আপাতত ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করলাম। এরপর  আমরা এশিয়ার কয়েকটা দেশের ছবি আর লাতিন আমেরিকার ছবি নিয়ে আলোচনা করব। তারপরের কয়েকটা পর্বে আমরা নতুন করে জেনে নেব আমাদের প্রিয় কিছু নায়ক নায়িকাদের অনবদ্য সব ছবির কথা। সেটা শেষ করে আবার বিশ্বভ্রমণে বেরোব। তখন সময় হলে আবার ইউরোপের সিনেমায় ফিরব।

(ক্রমশ)

 

 


মৌ চক্রবর্তী

 

মিথ অভিনেত্রী শাঁওলী মিত্র




সে বা তিনি শিশুশিল্পী। সে ডাকঘর-এর অমল। অমল চরিত্রটি বালক হলেও, শিশুদের ক্ষেত্রে অভিনয়ে এরকম হয়েই থাকে মঞ্চ ও সিনেমার অভিনয়ের জন্যে। শিশুশিল্পী হিসেবে তাঁর অভিনয় বহুরূপী দলের নাট্য প্রযোজনায়। এটি বিশেষ এক সূচনা হিসেবে ধরা গেল। তারপর মেয়েটি বেড়ে উঠল নাটকের পরিবেশে। কারণ, বাবা শম্ভু মিত্র এবং মা তৃপ্তি মিত্র। নাটকের সংসারে নাটকের পরিবেশে বেড়ে উঠতে থাকল সে বা শিশুকন্যেটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর নামকরণ হয় শাঁওলী। এর অর্থ বাঙালি মাত্রেই জানেন, শ্যামলা মেয়ে। কখন খাওয়ার টেবিলে ঘুমিয়ে যাওয়া খেতে খেতে। কখনও সাজঘরে বসে স্কুলের পড়া করে নেওয়া। এত মনোযোগী ছাত্রী শাঁওলীকে দেখে বাবা শম্ভু মিত্র অবাক। কেন, এত পড়া, পরীক্ষার কম্পিটিশনে যাওয়া! আরে  বাবা, যে মেয়ে নাটুকে পরিবারে জন্মেছে, সে তো নাটকই করবে! আর মেয়ের তখন  নাটকে হাতেখড়ি হলেও, মনের ভেতরে দানা বাঁধেনি নাটকের প্রতি ভালবাসা। তবে, রাতদিন বাড়িতেই রিহার্সাল দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার প্রভাব থেকেই যায়। প্রতিদিন সংলাপ শুনতে শুনতে কিন্তু গেঁথে যায় শিশু মস্তিষ্কে। আওড়ে ফেলে যেখানে সেখানে। কিছু মজা রয়ে যায় শিশুর অভ্যন্তরে। এও তাই, কলকাতা দূরদর্শনের সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কী প্রাণবন্ত! টাটকা কথা, তাজা অভিনেত্রী বা শিল্পী বা  মানুষটা এখন আর নেই। সেই সুধাকণ্ঠী বাচিক শিল্পী আর নেই। এ যা লিখলাম তা সৌজন্য আন্তর্জালিক মাধ্যমে পাওয়া, শোনা ও দেখা যাবে। এহেন সংরক্ষিত ও বহমান থাকবে তাঁর গুণমানসম্পন্ন অভিনেয় কর্ম। এখানেই লেখা শেষ হলে, আরেকটি শিল্পীর কথা না-জানা থেকে যায়। সদ্য প্রয়াত হওয়ার সূত্রে তাঁকে ঘিরে কিছু প্রবন্ধ এবং লেখা ভাসছে গণ-মাধ্যমে। সেই লেখা পড়তে গিয়ে মনে হল আরেকটি চেনা শিল্পীর অজানার লেখা হতে পারে। জানা মধ্যেই তো এক অজানা শিল্পী মানুষটির দেখা মেলে। সেই দেখাই ২০২২-এ লিখতে থাকলাম।

শাঁওলী মিত্র-কে নিয়ে পড়েছি পরে। জেনেছি আর দেখেছিলাম আগেই। তখন কলকাতার গিরিশ মঞ্চে নাট্য অ্যাকাডেমি আয়োজিত অভিনয় নাট্য কর্মশালা চলছিল।

সাল ২০০৬, ২৬ জুন থেকে ২ জুলাই ছিল এর সময়। এরই একটি দিনে তিনি এসেছিলেন সেই প্রশিক্ষণ শিবিরে শেখাতে। কালো শাড়ি। গোল টিপ। 'নাথবতী অনাথবৎ' –এর আংশিক পাঠ ও অভিনেয় পরিবেশনা করে দেখাবেন তিনি। আলো নিভতেই মুহূর্তে হলেন দ্রৌপদী। আশ্চর্যের যে, এততুকু না বুঝেও যেন দাগ কেটে গেল স্বর, কথা, ধ্বনি। সুর শুধু গানে থাকে না। থাকে কণ্ঠেও। তাই যেন আবৃত করে দিল। কর্মশালা জুড়ে নাট্যকর্মীদের মরমে পশিল যেন। অভিনয় করার ব্যাকরণ বুঝিনি তখনও। তাঁর কণ্ঠের ওঠানামা অনুভূতি, আবেগ এসবও যেন বুজিয়ে দিল গলা। সাধারণত, শিল্পীদের নিরপেক্ষ হতে হয়। কিন্তু শ্রোতা হলে? সেই দায় থাকে না। অমনি তাঁকে বলেছিলাম, বা বলতে পেরেছিলাম, পারি না দিদি, আমি কিচ্ছুটি পারি না।

তিনি যেন জানতেন আমি কী বলব, টেকনিক্যাল নাটকের সংলাপের রিহার্সাল ছাড়াই  চার সেকেন্ড পজ। তারপর উত্তর দিলেন, আমিও জানি কতটুকু শিখছি এখনও। এই যেভাবে তুমি বললে, জানি না দিদি। জানি না। আমার কথা ওঁর গলায় সুরে খেলে গেল। বললাম, দিদি, আমি পারব না। বললেন, সেই না, পারাটাই তো জানা নিজেকে। এই যা তুমি জান, তুমি পারো আর পারো না কতটা। এইটাই তো তোমার অভিনয়  করতে জানার প্রথম শর্ত। সেখানে জুড়ে দিলেন নিজের ছোটবেলার কিছু কথা। কথা মানে, গল্প। জানা গল্প। অজানা সময়ের। একটি নক্ষত্রের অবয়ব যেন মিশে গেছে উইংস থেকে আড়াল করাটা জানতাম। শিখেছি এটুকুই যে, উইংয়ের কোথায় দাঁড়ালে আর দেখা যায় না অভিনেতাকে। আর শাঁওলীদি, ঘিরে বসে সব্বাই। মনে হচ্ছে উনি পদ্মাবতী। মনে হচ্ছে উনি সরস্বতী। আর আমরা ওঁর পাশে ছড়িয়ে থাকা শালুক বা পদ্মপাতা। সেই পাতার এক বিন্দু জলকণা যেন না পড়ে হারিয়ে যায়। সেই চেষ্টায় রইলাম। অভিনয় বুঝি না ভেবে এদ্দিনে শান্তি পেলাম। এভাবেই ওঁর সামনে ছোট  থাকা গেল, থেকে যাওয়া গেল। কিন্তু অভিনয় করতেই হল। কী যে বিস্ময়ে জেগেছিল  সেই তাঁর দুচোখ। অনুজ অচেনা অপারদর্শী আমার ভেতর তিনি খুঁজতে চেষ্টা করছিলেন – সন্ধান, যা গবেষণার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। একমাত্র নিরুপায় আমিটাকে অভিনয় নামক কঠিন কাজের মধ্যে ফেলে পালিয়ে আসতে পারিনি। হয়নি সেটা। পালা করে সবাইকেই টুকরো কিছু অভিনয় করতে হচ্ছিল। তবে এটুক বোঝা গেল, ওঁর কাছে সবটাই শিল্প, নাটক বা গুরুত্বের। আমরা অভিনয় করছি বলে উনি কিন্তু মনোসংযোগ হারাননি। এই শ্রদ্ধায় অবনত হই আজও। কারণ, প্রকৃত শিল্পী তিনিই যিনি শিল্পের সাধনায় রত নবিশদেরও সম্মান করেন। তিনি কাজ শেষে চলে গেলেও আমরা প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিলাম। 'সেখানে ছিলাম আমি...' জীবনানন্দ কবির এটুকু নাড়া দিচ্ছিল। রাতের মঞ্চে বসে ছিলাম। আলো নেভা এক দৃশ্যে তিনি ফের এসেছিলেন যেন। না শেষ হওয়া কথাগুলো বলতে, 'বাবুমশাইরা...'। নরম আবহে রয়ে গেল দিদি। অভিনেত্রী শাঁওলী মিত্র। এভাবেই লক্ষ কোটি অনুজদের মধ্যে বেশ হারিয়ে থাকলাম।

আড়ালে আবডালে দেখতাম তাঁকে। সবার দিদি। কিন্তু আমার কাছে ওই এক চরিত্র।  তারপর অনেক অনেকবার তাঁর অভিনয়ের ব্যাকরণ বুঝে তারিফ করেছি আয়নার  সামনে। আর ভয় পেয়েছি অভিনয় কত সহজে করেছেন ভেবে, কত কঠিন যা। কাচ সাধারণত সব দেখায়। দেখতে দেয় ওপাশে এপাশে। আমিও তাই ছিলাম। নক্ষত্র সমাবেশে দেখা হলে, তাঁরা হতেন আলোচক। আমি মুগ্ধ এক ক্ষুদে অপটু ভক্ত  তাঁর। সবসময় বাছতাম আড়াল। ওই আড়াল শিশির মঞ্চের পেছনের বাড়িটার সৌন্দর্যরক্ষা করে ছায়া নেমে এলে। সেখানের দোতলা ঘরে কখনও একতলায় নাট্যপাঠের আসর বসত। পাঠ করতে আসতেন নাট্যকারঅভিনেতা মনোজ মিত্র। নাট্যকার-নির্দেশক  চন্দন সেন। এবং একদিন এই ক্রমে তিনি ফের এলেন। আগেই জানতাম। নাট্য একাডেমী থেকে অজন্তাদি (অজন্তা ঘোষ) খবর দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন গণনাট্য  সংঘের অনেক বরিষ্ঠ সদস্য এবং গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা, নাট্যকর্মী প্রমুখ। আর ছিলাম নগণ্য আমি। সঙ্গে আমার লজ্জা, না পারার লজ্জা। না জানার লজ্জাবোধ। দূরেই ছিলাম তাই। রক্ষা তবুও হল না। বাঙালি নারী, কৃষ্ণবর্ণা কৃষ্ণা আমার কাছে এসে, বেঁকে চলে গেলেন পাঠ শুরুর আগে মঞ্চে বসলেন। সবাই মুগ্ধ। অপূর্ব এক সন্ধ্যা। তিনি যেতেন ওই দূরের দিকে। কাচ। দেওয়াল। তারপর আমি। দাঁড়িয়ে বুঝতাম কতটা  দূরে তিনি। মনে পড়ত সংলাপ, ওই নারী, যিনি কথক থেকে চলে যাচ্ছেন চরিত্রে।  আর স্পর্শ  করেছেন আগামীকে, আলোচকদের। আমাদের বুঝিয়ে তুলেছেন  নারীজাতির সংজ্ঞা। মাতৃসত্তা থেকে নয়। যে কথক কথার চেয়েও বেশি স্পর্শ করছেন ব্যথা দিয়ে। সেই আরেকবার দেখা তাঁর পারফরমেন্স। শিল্পী হিসেবে দেখা। চেয়ার  টেবিলে বসে তিনি। শুধু কথা দিয়ে অভিনয়। সেও নাটকের সংলাপ। নড়বড় করে উঠল আমার চেয়ারের হাতলটা। পড়ে না যাই, তাই ধরে থাকলাম। অন্ধকারে  পিনপতন শব্দে মোচড় দিল আলো। কক্ষের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় শুধু মঞ্চের আলো জ্বলে নাটক পাঠের সময়। আরও অনেকেই ছিলেন। আমিও ছিলাম। অদৃশ্য সেদিন আমি বসে পড়েছিলাম মঞ্চের একপাশে। সম্বিৎ ফিরতেই সবাই কথা বলছেন শুনলাম।  নাটক-জগতের  মহীরুহদের সমাবেশ থেকে একজন শাড়ি, বেণী, চুলের ফুলে এসে দাঁড়ালেন। গাছের ডালে কলকাতার রাত-আকাশের চাঁদ। সেদিন পূর্ণিমা হবে বা। সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতে হয়।

সেদিন চাঁদ ছিল গোলপানা পূর্ণিমা হবে। জোছনার রঙ। ওঁর চুলে ধরেছে সেই রঙ। অকৃত্রিম রঙ, স্নিগ্ধ। কেশবিন্যাসে ওঁর প্রাকৃতিক রঙ, কৃত্রিম ছোঁয়াচ নেই। মুগ্ধ দিদি, অসাধারণ, আপনি তো পাঞ্চালীকে দেখালেন কীভাবে ধারণ করতে হয় সত্তা। পাঠ  শেষেও রয়ে গেছে। বললেন, তাও কিছু খামতি রয়ে গেছে। যেমন... ঐ যে ওখানটায়, একটু যেন বৃন্তছিন্ন হয়ে যাওয়া ফুলের মতন সুর কাটল। সকলেই বললেন যে, না তো বুঝতে পারিনি আমরা। উনি হাসলেন, বললেন, আমি বুঝেছি কেটেছি। এরপর গ্রুপ থিয়েটার পত্রিকার দেবাশিসদা বললেন, শুনলে, এই হল শিল্পী। পারফেক্ট শিল্পী। ততক্ষণে ভেসে গেছি আমি। চাঁদের আলো পড়ে মরা সায়রের জলে। যেন স্নেহ। আমাকে ডাক দিতেই ফিরে এলাম দলে। আলোচনা শেষে তিনি যাবেন ফিরে বাসগৃহে। বলতে চাইলাম, দিদি আপনি তো মিথ অভিনেত্রী। দিদি আপনি তো শম্ভু মিত্রের কন্যে। তৃপ্তি মিত্রের যোগ্য দুহিতা। উত্তরসূরি। বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের এক সংজ্ঞা ও নির্ণয় সূত্র। তাঁকে এরচেয়ে আর কী বলি, বলতে গিয়ে সেই একই কথাগুলো বললাম,  অসাধারণ পাঠ করেছেন দিদি। শেখাবেন? হ্যাঁ, নিশ্চয়। গ্রীষ্মের রাত। যেন আঁচলে করে তুলে ছুঁইয়ে দিলেন নরম স্নেহ থুতনিতে। এস!

মনে পড়ছে। তন্ময় আমাকে কতবার যেতে হয়েছে ওঁর কাছে গুনতে পারিনি। সশরীরে না গেলেও বারবার গিয়েছি ওঁর ঘর বারান্দা আর সাজকক্ষে। আর অশরীরী তিনিও  দেখা দিয়েছেন বারবার। সাজঘরে, একাডেমীর বারান্দায়, অলিন্দে, সভাকক্ষে এবং লেখার এই সঞ্চারিত মুহূর্তে। কাঁপতে থাকা হাতটা ধরে আরও কেউ কতকিছু বলেছেন। তবে, রিহার্সাল না-থাকা সংলাপ এখনও ঐ চাতালে দাঁড়ালে শুনি, এস...! যা এখনও শাঁওলি মিথ, ঘিরে থাকে আমার ভুবন। 


অদিতি ফাল্গুনী

 

পশ্চিমে গ্রিক পুরাণের ‘নিষ্ক্রিয়‘ ইউরিদিসের নতুন নারীবাদী বিশ্লেষণ




যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও নারীবাদী, তবু পশ্চিমে সম্প্রতি বিখ্যাত গ্রিক ট্র্যাজেডির দুই চরিত্র অর্ফিয়ূস ও ইউরিদিসকে নিয়ে যে নতুন নারীবাদী ব্যাখ্যা  বা বিশ্লেষণ হচ্ছে, সেটা শুরুতে আমাকে একটু আহতই করেছে। অর্ফিয়ূসের মত অমন একশোভাগ নিবেদিত এক মানুষকে নিয়েও কিনা নারীবাদী বিশ্লেষণ? যে অর্ফিয়ূসকে নিয়ে সনেট লিখেছেন স্বয়ং শেক্সপীয়র অথবা ধ্রুপদী যুগের ভার্জ্জিল থেকে রাইনার মারিয়া রিলকে হয়ে এই কিছুদিন আগের পোলিশ কবি শেজওয়া মিউয়াশ পর্যন্ত যে অর্ফিয়ূসের বন্দনা না করে পারেননি, সেই অর্ফিয়ূসকেও কিনা নারীবাদের আতশ কাচে ফেলে পরখ করতে হবে? শুরুতে খানিকটা কুঁকড়েই গেছিলাম। তবে অস্বীকার করা যাবে না গ্রিক এই বেদনাবিদ্ধ পুরাণের নতুন কিছু বিশ্লেষণ পড়ার পর থেকে চমকে গেছি পশ্চিমের নারীবাদী চিন্তকদের চিন্তা করার মৌলিকত্ব এবং সম্পূর্ণ প্রথাবিরোধী সব প্রশ্ন তোলার সাহসী ক্ষমতায়। পশ্চিমের নারীবাদী চিন্তকরা এই পুরাণের নতুন সব বিনির্মাণের কাজটি করছেন মূলত: নাটকের ক্ষেত্রে।

২০১৪ সালে স্যার আন্তোনিও পাপ্পানোর পরিচালনায় ‘অর্কেস্ট্রা দেল এ্যাকাদেমিয়া ন্যাজিওনেল দি সান্টা সিসিলিয়া‘-এর আয়োজনে এবং নামী অপেরা গায়িকা বারবারা হ্যান্নিগানের অনবদ্য সঙ্গীত পরিবেশনায় ‘লা ন্যুয়োভা ইউরিদিস সেকেন্ডো রিলকে‘ নামে যে অপেরা মঞ্চস্থ হয়, সেখানে যে ‘নতুন‘ ইউরিদিসকে দেখা যায়, তা ইউরিদিস বিষয়ক আমাদের অতীতের সব ভাবনা থেকে একদমই অন্যরকম। এই অপেরায় নির্মিত এই ‘নতুন ইউরিদিসে‘র চরিত্রটি মূলত: কবি রাইনার মারিয়া রিলকের অর্ফিয়ূস, ইউরিদিস, হার্মেস এবং টু মিউজিক নামে দু‘টো বিখ্যাত কবিতার সংশ্লেষণে সৃষ্ট। কে এই নতুন ইউরিদিস? সে কি একজন নারীবাদী?

প্রাচীন গ্রিক পুরাণের সেই অনন্য গল্পটিতে কেন ইউরিদিস চরিত্রটি এত নীরব ও নিশ্চুপ? গোটা ট্র্যাজেডিতে সাপের কামড়ে মরে যাওয়ার পর মৃত্যুভূমি পাতালরাজ্যে চলে যাওয়া ছাড়া ইউরিদিসের কোন উল্লেখই নেই। অর্ফিয়ূসই আছে সমগ্র কাব্য জুড়ে। সেই নরকের রাজ্যে ছোটা, তিন মুখো ভয়াল কুকুর সার্বেরেসকে বিষাদগীতি শুনিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে চুপ করিয়ে দেয়া, অর্ফিয়ূস পরে কিনা গেলেন খোদ যমরাজ হেদস বা প্লুতো ও তাঁর স্ত্রী পৃথিবী বা দেমিতার কন্যা পার্সিফোনের সামনেই! অর্ফিয়ূসের বিষাদে বিশেষভাবে দু:খিত হলেন  পার্সিফোনে। নিজে পৃথিবীর মেয়ে হয়েও যাকে হেদসের হাতে অপহৃত হয়ে আসতে হয়েছে নরকে বা পাতালপুরীতে। শেষপর্যন্ত যমরাজ হেদসও গলে গেলেন। ইউরিদিস নবজীবন পাবে ঠিকই। তবে পাতাল থেকে পৃথিবীতে যাবার অন্ধকার সেই সুড়ঙ্গপথে অর্ফিয়ূসের পিছু পিছু সে যখন যাবে, আর পৃথিবীতে পা রাখার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছুতেই পিছু ফিরে তাকাতে পারবে না অর্ফিয়ূস।  তাকালেই ইউরিদিস চিরতরে হারিয়ে যাবে। আবার সে হারিয়ে যাবে পাতালপুরীতে। আর এখানেই নারীবাদীদের খটকা। অর্ফিয়ূস কি কখনোই ইউরিদিসের উপর ভরসা রাখতে পারে না? যমরাজ প্লুটোর শর্ত জেনে এবং মেনেও শেষমুহূর্তে কেন তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হলো আর এতদিনের সব পরিশ্রম ও ভালবাসায় অর্জিত সবটাই পুনরায় ‘অনর্জিত‘ হয়ে গেল? এটাই কি ‘টক্সিক ম্যাসক্যুলিনিটি‘র সেই ভয়ানক উপাদান যা ভালবাসার আত্যন্তিকতা থেকেই বারবার ভালবাসার পাত্রীকে হারিয়ে ফেলে? ইউরিদিসকে কি বড্ড বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় অর্ফিয়ূস? এক মুহূর্তের জন্য তার উপর আস্থা নেই? অর্ফিয়ূসের কি সারাক্ষণই ভয় যে হয়তো ইউরিদিস তার পিছু পিছু আসছে না? ইউরিদিস হয়তো তাকে যথেষ্ট ভালবাসছে না? আর ‘বজ্র আঁটুনী ফস্কা গেরো‘র মতই বারবারই এই অত্যধিক নিয়ন্ত্রণকামীতার কারণে ভালবাসার পাত্রীই তাই বারবার হাতছাড়া হয়ে যায়? কারণ প্রেম যে কিছু পরিসর বা ‘ব্রিদিং স্পেস‘-ও দাবি করে যেমনটা কহলীল জিব্রান বলেছেন তাঁর কবিতায়।

পশ্চিমের নারীবাদীরা তাই আজ খোদ রিলকের কবিতার চরণ বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন যে কোথাও কি ইউরিদিনের ভেতরেও ছিল অর্ফিয়ূসের এমন ‘পুতুলের মত নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া‘র বিরুদ্ধে কোন সুপ্ত বিদ্রোহ? নয়তো দেখুন রিলকের কবিতায় ইউরিদিস নি:শব্দ এবং তাঁর পদচারণা হচ্ছে ‘অনিশ্চিত, শান্ত এবং কোন তাড়া-হুড়ো নেই’। অর্ফিয়ূস কিনা যখন বড় বড় পা ফেলে সামনে  এগোচ্ছেন, তখন ইউরিদিসের পদক্ষেপ বড় বেশি অবিচলিত ও শান্ত। আর এতেই যেন ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটে অর্ফিয়ূসের। কেন এত নি:শব্দে বা অনিশ্চিত পায়ে তার পিছু পিছু আসছে ইউরিদিস? ইউরিদিস কি তবে আসবে না? তখনি সে অস্থির হয়ে পিছন ফিরে তাকায় এবং নিয়তি দ্বিতীয়বার তার খেলা খেলে।

কিন্তু রিলকের কবিতায় ইউরিদিস কেন এত নির্লিপ্ত? পশ্চিমের নারীবাদীরা  বলছেন যে রিলকের কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে যখন ইউরোপে দেখা দিচ্ছে ‘নতুন নারী’। নারীবাদের প্রথম তরঙ্গের সময়ের সেই নারীরা চুল ছোট করে ছাঁটছে, পুরুষের মতই ট্রাউজার পরা শুরু করেছে, বাইকে উঠছে এবং নিজস্ব কর্মজীবনের লক্ষ্যে বিয়ে করতে দেরি করছে বা করছেই না কেউ কেউ। ‘লা ন্যুয়োভা ইউরিদিস সেকেন্ডো রিলকে‘ নামের অপেরায় যে নতুন ইউরিদিসকে দেখা যাচ্ছে, সে একনিষ্ঠ ভাবে অর্ফিয়ূসের পদক্ষেপ অনুসরণের বদলে বিংশ শতকের নতুন নারীর নতুন জীবন সংজ্ঞা নির্মাণে ব্যস্ত। বিয়ের বিষয়ে তার ভাবনা না শীতল না  তপ্ত। তার আছে উচ্চশিক্ষা বা কর্মজীবন সহ হাজারটা নতুন স্বপ্ন। এই ‘ইউরিদিস‘ আর অর্ফিয়ূসের হাতে উদ্ধার খোঁজা মেয়েটি নয়।

শুধু উপরোল্লিখিত অপেরা নয়, এ্যামিলিয়া আর্ল রচিত ‘মর্ডার্ণ ফেমিনিজম ইন রিরাইটস অফ দ্য অর্ফিয়ূস এ্যান্ড ইউরিদিস মিথ‘ প্রবন্ধেও দেখা যায় মার্গারেট এ্যাটউড এবং সারাহ রুহলও ‘ইউরিদিস’-এর চরিত্রটিকে নারীবাদের আতশকাচে ফেলে পরখ করেছেন। এ্যাটউড তাঁর ১৯৭৮ সালে রচিত প্রবন্ধ ‘দ্য অর্ফিয়ূস এ্যান্ড ইউরিদিস সাইকল’-এ এক নতুন ইউরিদিস চরিত্রকে দেখান যে সবটা সময়ই অর্ফিয়ূসের হাতে প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত। অর্ফিয়ূসের প্রতি গোপন বিরক্তি থেকেই কি পাতাল থেকে পৃথিবীতে ওঠার সময় অমন নিস্পৃহভাবে পিছু  হাঁটে? পশ্চিমে কোন কোন থিয়েটার গ্রুপ আবার দেখাতে চাইছেন যে পাতালরাজা হেদস যেন আসলে মোটেই কোন নিষ্ঠুর পাতাল নৃপতি নন। তিনি যেন ইউরিদিসের পিতৃপ্রতিম কোন চরিত্র। আর এদিকে অর্ফিয়ূস এসেছে দাম্পত্য জীবনের অধিকারের বার্তা নিয়ে। কিন্তু ইউরিদিস যেন বিচলিত।  পিতৃগৃহের সুখী কুমারী গৃহকোণ নাকি নতুন দাম্পত্য জীবন - কোনটি সে বেছে নেবে? তাই এই পাতালপুরী থেকে সে আসছে বটে পিছু পিছু। হেদস যেন সেই পিতা যে মেয়েকে নতুন জীবনে পাঠাতে বাধা ত’ দিতে পারে না। তবে শর্ত জুড়ে দেন। আর ইউরিদিস ত’ নিজেই নিজের কাছে পরিষ্কার নয় যে এই সুখী কুমারীর গৃহকোণ ভাল নাকি নতুন, বিবাহিত জীবন। তাই তার পদক্ষেপ এত মৃদু যা বিচলিত করে অর্ফিয়ূসকে। তাই সে পেছন ফেরে।

আবার ‘দ্য হোয়াইট লেবেল কালেক্টিভ’ নামে আর একটি নাট্যগোষ্ঠির নাটকে  শুধু হেদসের পাতালরাজ্য নয়, খোদ অর্ফিয়ূসের থ্রেস রাজ্যটিও যেন এক নিপীড়ক পুলিশী রাষ্ট্রের প্রতিভূ। সর্পাঘাতে মৃত ইউরিদিসের দেহটি যেন ‘নিষ্ক্রিয় নারীদেহ’কে নিয়ে পুরুষের পৌরুষগর্ব, জাতি-রাষ্ট্রের পৌরুষ আষ্ফালন এবং মেয়েটির এই নিয়ন্ত্রণকামীতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে ‘দ্য হোয়াইট লেবেল কালেক্টিভ’-এর নাট্যনির্মিতিতে। এই নাটকে ইউরিদিসের চোখে বিয়ের  পর প্রথম মুহূর্ত থেকেই থ্রেস যেন এক নিপীড়ক, পুলিশী রাষ্ট্র যেখানে দম  নিতেও কষ্ট হয়। তাই পালাতে চায় ইউরিদিস। এই নাট্যগোষ্ঠির নাটকে যমরাজ হেদসকে বরং এক হাসি-খুশি, মনোহর চরিত্রে দেখা যায়। পাতালপুরী আদৌ ইউরিদিসের জন্য কোন অভিশপ্ত জায়গা নয়। সেটা তার পলায়নের স্থান।

তবে এক কথায় পুরাণকে কোন নির্দিষ্ট মতবাদের আতশকাচে ফেলাটাও যে সবসময় সঠিক তা নয়। সাইকো-এ্যানালিটিক বা মনো-বিশ্লেষকরা আবার অর্ফিয়ূসের শেষ মুহূর্তে পিছে ফিরে দেখাটাকে মানব চরিত্রের এক  অসংশোধনযোগ্য মৌল চারিত্র্য বলে মনে করেন। যত আমরা নিজেকে প্রবোধ দিই যে ‘আর পিছু ফিরে দেখা’ নয়, ততই আমরা যেন আরো বেশি বেশি পিছু ফিরে দেখি। এবিষয়ক কোন নিবন্ধ না হয় আবার পরে কখনো লেখা হবে।

স্বপ্না রায়

 

স্নেহের পরশ



আর সবার মতো সৌমিত্র চ্যাটার্জি আমারও খুব প্রিয় শিল্পী! তাঁর অভিনয়, তাঁর আবৃত্তি, লেখা, বিশেষ করে তাঁর কবিতার আমি গুণগ্রাহী! সাক্ষাৎ কখনো আমার পরিচয় হয়নি ২০০১ সালের আগে! তবে তাঁর কথা ও তখনকার সিনেমার  অনেক বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীদের কথা ও আসা যাওয়া ছিল আমাদের বাড়িতে এবং সেটা আমার কাকার সৌজন্যে! আমার কাকা, পরিমল সরকার, সিনেমার প্রোডিউসার ছিলেন! সেই সূত্রেই উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী, কানন দেবী, ছবি বিশ্বাস ইত্যাদি স্বনামধন্য মানুষেরা এসেছেন আমাদের বাড়িতে! সৌমিত্র চ্যাটার্জি আসেননি, কিন্তু আমার কাকা তাঁকে সাম্মানিক দিচ্ছেন সে ছবি (তপন সিনহাও রয়েছেন) আমার বাড়িতে সাজানো আছে!

এবার আমার সঙ্গে চাক্ষুস আলাপের কথা! ২০০১ সালে বস্টনে যখন বঙ্গ সম্মেলন হয় তখন আমরা (আমি ও আমার বর রাহুল) এখানের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলাম! আমার ওপর ভার পড়েছিল বিশেষ অতিথিদের দেখাশোনা করার! এই কাজটা আমি সবসময়ই করি! দেশ থেকে কোনো শিল্পী আসলেই আমরা আমাদের বাড়িতে অতিথি রাখতে চাই! তাঁদের সংখ্যা ২ থেকে ১৮ জনও হয়!

সে বছর ঠিক হল দেশ থেকে যতজন শিল্পী আসবেন তাঁদের দেখাশোনা করার জন্যে, তাঁরা যে হোটেলে থাকবেন আমাদেরও সেখানেই থাকতে হবে! বিশেষ  করে সৌমিত্রদা ও উষা উত্থুপের যাতে কোনো অসুবিধে না হয়! সৌমিত্রদা ১৯ জনের দল নিয়ে এসেছিলেন! হোটেল থেকে বাড়ির দূরত্ব অনেক তাই সব গুছিয়ে নিয়েই হোটেলে গেছিলাম! মনে আছে প্রচুর কচুরি আর ল্যাংচা করে  নিয়ে গেছিলাম! কারণ আমার অভিজ্ঞতা আছে, দেশ থেকে যাঁরা আসেন তাঁদের মাঝে মাঝে দেশের খাবার হলে ভালো লাগে! ভাগ্যিস করে নিয়ে গেছিলাম! উষা  উত্থুপ নিরামিষাশী! উনি যে তিনদিন ছিলেন শুধু ওই কচুরিই খেলেন আমের আচার দিয়ে!

সৌমিত্রদা আসার আগেই নাটকের জন্যে কী কী লাগবে তার একটা লিস্ট  পাঠিয়েছিলেন! অনেক বড় লিস্ট, তার মধ্যে দোতলা বাড়ির স্টেজ আর দাবা  খেলার বোর্ড দেওয়া একটা টেবিল, এই দুটোর তলায় দাগ দেওয়া (মানে চাইই-চাই)!

প্রথমদিন যখন আলাপ হলো হোটেলে তিনি বললেন যে আমি এসব  মাইক্রোওভেন বা অন্য গ্যাজেট ব্যবহার করতে জানি না, আপনি এসে আমাকে একটু খাবার গরম করে দেবেন! বলেই ফেললাম, আমাকে তুমিই বলবেন, আপনি আমার কাকার খুব পরিচিত! আমি পরিমলদার ভাইঝি বলে তাঁর একটু সোয়াস্তিও হল! বললেন, তাহলে কিছু লাগলে তোমাকেই বলবো!

ঠিক পরেরদিনই আমি সকালে ডাইনিং রুম থেকে তাঁর ঘরে ব্রেকফাস্ট নিয়ে গেছি! তিনি জানালেন যে একটা খুব ঝামেলা হয়ে গ্যাছে! তাঁর সহশিল্পীদের একজনদের (২-৩ জন করে একটা স্যুইটে ছিলেন) রুম ফ্লাডেড! তাড়াতাড়ি গেলাম তাঁর সঙ্গে, গিয়ে আমরা দুজনেই অবাক! কার্পেট ভিজে জব জব করছে! ডিস্ ওয়াসারে কাপ-ডিসের সঙ্গে ঝাড়নটাও পরিষ্কার হবার জন্যে কেউ দিয়েছিলেন, আর সেটা পাইপে আটকে গিয়েই এই কান্ড! যাহোক মেন্টেনেন্সের লোক ডেকে সব ঠিক করা হল! ঘরও চেঞ্জ করে দেওয়া হলো! আমাকে  বললেন, "দেখো দেশে তো ডিস্ ওয়াসার নেই তাই ওদের ভুল হওয়াটা খুব দোষের নয়! তবে তোমায় দেখতে ছোটোখাটো হলেও দেখছি তুমি বেশ কাজের মেয়ে তো!"

নাটকের দিন সে এক কান্ড! আমি খুব বকুনি খেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে! কী কী লাগবে তার লিস্ট আগেই দিয়েছিলেন! আমি সাধ্যমত তা জোগাড় করেছিলাম! শুধু দাবার ছকের টেবিল কোথাও পাইনি! দোতলা বাড়ি চেয়েছিলেন, সেটাও করা হয়েছে! আমি খুব খুশিতেই ছিলাম, সবার সামনে বেশ গর্বই হচ্ছিল, এমন একজন বড়মানুষ আমাকে ডেকে এটা ওটা চাইছেন!

হঠাৎ শুনলাম তিনি গ্রিনরুম থেকে স্টেজে এসে খুব জোরে জোরে আমার নাম  ধরে ডাকছেন! কাছে গিয়ে দেখি মুখ গম্ভীর, রেগে বললেন, "চারটে বড় ফুলদানী চেয়েছিলাম, এই ফুলদানী তে কী হবে? এ তো খেলার জিনিস মনে হচ্ছে!"  (আসলে স্টেজ এতো বড় যে ওখানে সবকিছুই ছোটো মনে হবে)! তারপর আরো গলা চড়িয়ে বললেন, আমার দাবা খেলার টেবিল কই? ওটা চাইই!

আমার একটুতেই চোখে জল আসে। চুপ করে ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে আছি, চোখ ঝাপসা! শেষে উষা উত্থুপ এসে আমাকে বাঁচালেন! আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে একেবারে সৌমিত্রদার সামনে!

"আপনি মেয়েটাকে এভাবে বকতে পারলেন? ও সারাক্ষণ আমাদের জন্যে ছুটে বেড়াচ্ছে আর আপনি ওকে বকতে পারছেন? ঠিক আছে আমি আপনার বড় ফুলদানী এনে দিচ্ছি!"

এই বলে আমার হাত ধরে টানতে টানতে একেবারে সেকেন্ড ফ্লোরে যেখানে কেনাবেচার সব দোকান ছিল, প্রদর্শনী হচ্ছিল! আমাকে বললেন, খুঁজে দেখ কোন দোকানে বা কোথায় বড় ফুলদানী আছে! পেলে আমায় দেখাও, আমি ওদের কাছ থেকে দু ঘন্টার জন্যে চেয়ে নেব!" সত্যিই পাওয়া গেল! দেশের শিল্পী বলাই কর্মকার এসেছিলেন, তাঁর স্টল থেকে চারটে ফুলদানী চেয়ে নিলেন! সেই ফুলদানী এনে স্টেজে সাজিয়ে দিয়ে আমি ভয়ে আর তাঁর সামনে যাইনি! এরপর টেবিলের ঝামেলা তিনি কীভাবে মিটিয়ে ছিলেন তাও জানি না!

আমার মন খারাপ লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু একটা জিনিষ শুধু সেদিন দেখে অবাক হয়েছিলাম যে, এত মানুষজন তাঁর সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও প্রতিটা ছোটো খাটো জিনিসের ওপর তাঁর কত সূক্ষ্মদৃষ্টি!

সন্মেলনের পর আরও কয়েকদিন হোটেলে তাঁরা ছিলেন। আমরা বাড়ি চলে এসেছিলাম! ফেরার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম! খুব অবাক হলেন,  "তুমি চলে যাচ্ছ? আমাদের এখানে কে দেখাশোনা করবে? "

আমি বললাম, "অনেক বঙ্গ সম্মেলন হল, এবার ল্যাবে ফিরতে হবে"! তিনি অবাক হলেন, "তুমি কাজও করো?"

আমরা তখন বাড়ি ফিরে এসেছি! একদিন অফিস থেকে ফিরে রান্না করে সেই খাবার হোটেলে পৌঁছে দিয়েছি। খুব ইচ্ছে ছিল বাড়িতে নিয়ে আসার, কিন্তু তাঁরা ১৯ জন! আমাদের ছোটো গাড়িতে ধরবে না!

ফিরে যাবার আগে যে সংস্থার আমন্ত্রণে তিনি নাটক নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সাথে কোন কারণে সৌমিত্রদার কিছুটা মনোমালিন্য হয়। আমিও ছিলাম সেখানে, যেহেতু আমিও একজন সদস্য! বেশ রাগারাগী হচ্ছিল, যা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না! আস্তে আস্তে সবার চোখ এড়িয়ে বাইরে গাড়িতে চলে আসি। সৌমিত্রদা ঠিক লক্ষ করেছিলেন! আমার খোঁজ করে গাড়িতে এসে আমায় অবাক করে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন! বারবার বললেন, "তোমাকে আমি কিছু বলিনি, তুমি মনে কষ্ট পেয়ো না!" তাঁর মতো মানুষ এভাবে বলছেন, সেটাও আমার বড় খারাপ লাগছিল! তারপর আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের 'ছোটোবড়ো' কবিতা "এখনো তো বড়ো হইনি আমি, ছোটো আছি ছেলেমানুষ বলে---" আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন! এ আমার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি!

 

 

 

প্রদোষ ভট্টাচার্য্য


 নামোপাখ্যান -১




রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্প ‘গিন্নী’তে ব’লেছেন যে, যার নাম ভূতনাথ তাকে  নলিনীকান্ত বললে সে দুঃখিত হয়।

টেনিদার বলা ‘পেশোয়ার কী আমীর’ গল্পে গোবর্ধনবাবু ভেবেছিলেন যে ন’ ছেলেকে নিয়ে নবরত্ন সভা বসাবেন বাড়িতে। তাই তিন ছেলের নাম রাখেন বরাহ, ক্ষপণক,  আর ঘটকর্পর। কিন্তু এরপর আর ছেলে হয় না, খালি মেয়ের পর মেয়ে! রেগে গোবর্ধন বাবু তাদের নাম রাখতে লাগলেন ‘জ্বালামুখী’, ‘মুণ্ডমালিনী’, এইসব। এমনকি ‘খনা’ অবধি নাম রাখেননি কারুর!

বাস্তব জীবন খুব বেশী পিছিয়ে নেই!

ঘোরতর পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, কন্যাসন্তানের কথা ভাবতেই তার সদস্যরা মূর্চ্ছা যান। কিন্তু তাঁদের বিধি বাম, এলো মেয়ে। ক্ষুব্ধ ‘সাহারায়’ পরিবার অভাগীর নাম রাখলেন ‘মরীচিকা’!

এক সহকর্মীর পাড়ায় কোন প্রতিবেশীর যমজ পুত্রসন্তান হওয়াতে তিনি সেই সহকর্মীর কাছে আবেদন করলেন, “আপনি অধ্যাপক মানুষ, দুই ছেলের নামকরণ আপনিই করুন।”

এরপরের ঘটনা সহকর্মীর ভাষায়ঃ “বেশ নাম বেছেছিলাম হে, তাতে ভদ্রলোক ক্ষেপে গিয়ে আমাকে যা-নয়-তাই বলে – ‘বুদ্ধিজীবি বলে কি এরকম যাচ্ছেতাই ফাজলামি করবেন আমাদের মতো সাধারণ লোকেদের সঙ্গে!’ – নিজেই দুই ছেলের নাম রাখলেন ‘আহ্লাদ’ আর ‘প্রহ্লাদ’। তা আমি কি তার চেয়ে খারাপ কিছু বলেছিলাম?”

কি নাম ঠিক করেছিলে তুমি?

“আরে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সর্বধর্ম-সমন্বয়, এইসবের কথা ভেবে ভদ্রলোককে বলেছিলাম, ‘দুই ছেলেকে ডাকুন “ইদের চাঁদ” আর “ন’দের চাঁদ” ব’লে!

সেই একই সহকর্মীর কাছে বীমা-সংক্রান্ত কাজকর্মের জন্যে আসতেন এক তরুণী। একদিন মহিলা সোৎসাহে সহকর্মীকে জানালেন, “স্যার, আগামী মাসে বিয়ে করছি!”

“বাঃ, বাঃ, খুব ভালো খবর!”

“আমি কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্যার।”

“কি সিদ্ধান্ত?”

“স্যার, বিয়ের পর পৈতৃক পদবী ছাড়ছি না। ওটাও থাকবে, তারপর ওরটা জুড়ে দেব। যেমন বৌদিরা অনেকেই করেন।”

আবার সহকর্মীর নিজের কথায়ঃ “চরম আতঙ্কের সঙ্গে প্রায় হাতজোড় ক’রে ব’লে উঠলাম, ‘মা, নিজের ক্ষেত্রে এটা নাই বা করলে!’ সে মেয়ে তো ক্ষেপে কাঁই! ‘কেন, কেন? আপনাদের মতো উচ্চবর্গের নই ব’লে এইটুকু স্ত্রী-স্বাধীনতাও আমাদের থাকবে না? ওসব কি আপনাদের একচেটিয়া? যা ঠিক করেছি, তাইই করব, এই ব’লে দিলুম, হ্যাঁ!’”

তা তুমিই বা আপত্তি করতে গেলে কেন? সত্যিই তো, কত মেয়েই তো এমন করে!

“আরে, দূর! করে ঠিকই, কিন্তু তাই ব’লে পদবীগুলো নিয়ে একটু ভাববে না! জুড়ে দিলেই হ’লো! মেয়েটির নাম যে ‘কল্পনা পোত’!”

আর তার হবু বরের পদবী?

“ঘোরাই!”

এতো গেল শোনা ঘটনা। এবার নিজের অভিজ্ঞতার কথায় আসি।

এম-এ পড়তে-পড়তেই এক স্নেহভাজন ছাত্রী জানালেন যে তিনি জীবনসাথী নির্বাচন ক’রে ফেলেছেন।

বেশ কথা। ছেলেটির নাম?

“স্যার ‘পথিকৃৎ পণ্ডিত’!”

বটে! তা এবার থেকে তোমার পদবীর ব্যাসবাক্য যে পাল্টে গেল!

“কি রকম স্যার?”

‘সান্যাল’ হইবে যে ‘পণ্ডিত’!

বিয়ের ঠিক পরেই শ্রীমতীর বাপের বাড়ি গেছি, তার আমন্ত্রণে। সে কি গোলকধাঁধা!  ছাত্রী গর্বের সঙ্গে একটু দূরে আঙুল দেখিয়ে ব’লে, “জানেন, ওইখানেই সত্যজিৎ রায় ‘সমাপ্তি’র শুটিং ক’রেছিলেন! আর ঠিক ওখানটায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চটিটা কাদায় ডুবে গিয়েছিল!”

বাপরে! যাক, এবার এখান থেকে বাড়ি ফিরবো কি ক’রে ব’লে দাও! নইলে ঘুরে ঘুরে হারিয়ে যাব!

“সে আর এমন কি কথা? পথিকৃতই তো কতবার এখানে আসতে গিয়ে হারিয়ে গেছে!”

তাহ’লে সে হয় ‘পথভোলা পথিকৃৎ’ নয় তো ‘পথভ্রষ্ট পণ্ডিত’!

পরে উক্ত ছাত্রীর এক সহপাঠিনীর এক উক্তিঃ “আপনাকে স্রেফ গুলি ক’রে মারা উচিৎ! মেয়েটা যে শেষ অবধি বিয়েটা ক’রতে পার’লো আপনার এইসব বদ-রসিকতা সত্ত্বেও, তাতে ওর সাহসই প্রকাশ পায়! আমি হ’লে আপনার কাছ থেকে  অনেক দূরে পালিয়ে বিয়ে করতাম! সম্ভবত ব্রিটেনের গ্রেটনা গ্রীনে!”

 

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ৫




কুটুমবাড়ি পৌঁছতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা বাজল। সক্কলে বসার ঘরে অপেক্ষা করছিল। আমি যেতেই আদর আপ্যায়ন, এটা খাও ওটা খাও। ওদের বাড়িতে সরস্বতীর প্রভাব স্পষ্ট।

বিক্রম আর শীলার দুটি মেয়ে শ্রদ্ধা আর সমীক্ষা। খুব যত্ন করে মানুষ করেছে মেয়ে দুটিকে। হাইস্কুলে পড়াকালীন দুজনেই ন্যাশনালসাইন্স ওলিম্পিয়াডের গোল্ড মেডালিস্ট, চমৎকার ভারতনাট্যম নাচে আর সবচেয়ে বড় কথা, বিদ্যাজনিত অহমিকা নেই। দুজনেই MIT থেকে কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ওই যেটা বলছিলাম... দুজনেরই বিদ্যাদম্ভ থাকার যথেষ্ট উপাদান ছিল, তবে আধারটি উৎকৃষ্ট, তাই ঔদ্ধত্য দাঁত ফোটাতে পারেনি। কর্ণাটকের গ্রামের বাড়িতে ওরা কেমন ওদের আত্মীয় পরিজন, নারকেলবাগান, পুকুরঘাট, মাটি, বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় তা আমি দেখেছি... আর দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

সমীক্ষা শুধোল, 'You must be very tired. Would you like some tea?  Some dessert perhaps?' মিষ্টির কথা শুনে মনটা একটু উদাস উদাস হলেও ঠিক সময়ে সামলে নিলাম। 'Just a glass of water will be fine. May I go to my room for a bit?'

'Oh certainly. Let me take your things to your room.'

মার ঘরে যাবার তাড়া দেখে ওরা বোধহয় ভাবল প্রকৃতির ডাক। তা নয়! আসলে সেদিন ছিল বিক্রমের জন্মদিন। তাই চটপট ঘরে গিয়ে ওদের জন্য যে সব উপহার এনেছিলাম সেগুলি নিয়ে এলাম। আসার আগে বিক্রমের জন্য শার্ট, শীলা আর সমীক্ষার জন্য শাড়ি, শ্রদ্ধার জন্য সুগন্ধ আর ঋজু আর মোহিতের জন্য জামা সুটকেসে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। মোহিত আর  শ্রদ্ধার বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এখানে আসার আগে জানতে পেয়েছিলাম যে মোহিত আর শ্রদ্ধাও এই সময় সিরাকিউসে থাকবে। সোনায় সোহাগা যাকে বলে আর কী!

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো সর্ষে ফোড়ন দেওয়া টাটকা নারকোলের চাটনির গন্ধে। শীলা অসাধারণ দোসা বানায়। ও জানে যে ওর হাতের দোসা খেতে আমি খুব ভালোবাসি। তাই সকাল সকাল রান্নাঘরে খুটখাট আর মনমাতানো সুবাস। সারাটা দিন কাটলো ছেলেপুলেদের সঙ্গে। আমার মতো বিক্রম আর শীলাও ওদের সান্নিধ্য উপভোগ করছিলো রসিয়ে রসিয়ে। আমরা নানারকম বোর্ডগেম খেললাম, হারা-জেতা নিয়ে প্রচণ্ড তর্ক করলাম, সকলে মিলে আসে পাশের  সবুজপ্রান্তর হেঁটে বেড়ালাম, রংবেরঙের  পাখি দেখলাম, দেখে এলাম গ্রীনলেকের সবুজ পান্নার মতো জলের রঙ।

দুটো দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো কে জানে। শীলা বানালো ডাল, মাছ, মুরগি, তরকারি... তাতে কর্ণাটকের রান্নার আদল। আমি রাঁধলাম সজনে ডাঁটা দিয়ে পাঁচমিশালি তরকারি আর আলু দিয়ে ডিমের ডালনা। ছেলেমেয়েরা স্যালাড, ফল কাটা, টেবিল সাজানো, পরিষ্কার করা এইসব কাজে নিযুক্ত ছিল।  শীলা বিক্রমের একজামাই পাঞ্জাবী আর একজামাই বাঙালী। রান্নাঘরে বেশ একটা সমন্বয়ের ভাব।

‘পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ

বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছল জলধিতরঙ্গ’

এর মধ্যে মোহিত জানিয়েছে  যে আমার শিকাগোতে হোটেলে থাকা একেবারেই চলবে না। ওখানে ওর বাবা  মা থাকেন। আমি যেন ওদের সঙ্গে একদিন থেকে তবেই যাত্রা শুরু করি।

'But Mohit, they do not know me at all. I have not yet met them. How can I just land there?'

'You are Ayushman's mom and that is introduction enough. You are going on this very long trip alone and that is intriguing enough. Please, you must stay the night with them. My parents are looking forward to your visit.'

এরপর আর কথা সরে না। ওই যে পামেলাকে বলেছিলাম, 'আমার সঙ্গে থাকেন ছত্রধর। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দেন।' একটা অচেনা শহরে, একটা অচেনা পথের শুরুতে দুজন অচেনা মানুষের সন্ধান পাওয়া গেল, যারা আমাকে এমন করে ডাক পাঠালেন।

'তুমি ডাক দিয়েছ কোন্‌ সকালে কেউ তা জানে না,

আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে কেউ তা মানে না।।

ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,

তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না।।

বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,

বাহির হতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।

আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা,

এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না’।

লেক-শোর লিমিটেডে সিরাকিউস থেকে ছাড়বে রাত ৯:৫০এ। সেদিন জুলাই ৩... আমার চলে যাবার দিন। সকলকে জড়িয়ে ধরে বললাম, 'Take care. We will meet soon.'

'Yes we will.'

সকলের চোখ বলল, 'Please be careful. We are worried about you.'

ঋজু  আর বিক্রম আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে স্টেশনে এলো। প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছি আমরা তিনজন। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সন্ধ্যে থেকেই চারিদিকে বাজি ফাটছে। আকাশে আলোর রোশনাই। দূরে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আলো দেখা যাচ্ছে। ঋজুর মুখে চিন্তার ছাপ। বিক্রমও তথৈবচ। ওরা  আমার ছত্রধরকে চেনে না,  তাই স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত। আমি অকুতোভয়। বিক্রমকে বিদায় জানালাম। ঋজুকে আদর করে মাথার চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বললাম, 'আসি রে... চিন্তা করিস না।'

তারপরে ট্রেন, তারপরে ঢিপ করে প্ল্যাটফর্মে পেন্নাম। তারপরে সব ঝাপসা।

रथारूढो गच्छन् पथि मिलित भूदेव पटलैः

स्तुति प्रादुर्भावम् प्रतिपदमुपाकर्ण्य सदयः

दया सिन्धुर्बन्धुः सकल जगतां सिन्धु सुतया

जगन्नाथः स्वामी नयन पथ गामी भवतु मे

যার রথ পথের ধূলায় এসে মানুষের সাথে মিলিত হয়, যার পায়ে স্তুতিগান করে সকল ভক্তবৃন্দ, করুণার সিন্ধু যে ঈশ্বর আমাদের করুণার সন্ধান দেন... সেই মহাপ্রভু জগন্নাথ যেন চিরদিন আমার নয়নে বিরাজ করেন...