ধারাবাহিক
উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(২)
অনঙ্গর বাবার বাবারা আঠেরো শতকের গোড়ার
দিকে যশোরের জমিদার ছিল। সেই জমি নিয়েই বংশের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে বিবাদবিসম্বাদের
জেরে রঘুনন্দনের বড়দা প্রতাপনন্দন খুন হন। প্রতাপনন্দন জমিজিরেত দেখে ফেরার সময় খবর
পান যে তাঁকে মারবার জন্য সাতসাতটা নৌকা বোঝাই করে লোকজন নিয়ে শরিকরা তাঁকে ঘিরে ফেলেছে আর তাঁর মাথার
দাম ধার্য করেছে সেই তাখনকার দিনে একশো দশ
টাকা। ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রতাপনন্দন তাঁর বাহন একেবারে ধবধবে সাদা টাট্টু ঘোড়াটাকে
কানে কানে পরিস্থিতির কথাটা জানিয়ে সেই মত নির্দেশ দেন। ঘোড়াটা একেবারে সঙ্গে সঙ্গে,
শোনা যায়, হুঙ্কার দিয়ে উঠে সোজা সেই অদৃশ্য
শত্রুবেস্টনী ভেদ করে খালের জল থেকে এমন এক লাফ দেয় যে তারা জল থেকে তীর বেগে সোজা সাতক্ষীরার মাটিতে গিয়ে পড়ে। ওখানে পৌঁছেই
প্রতাপনন্দন তাঁর কাকাকে সব খুলে জানান এবং
ছোটভাই রঘুনন্দনকে তাঁর আশ্রয়ে রেখে কাকার সমস্ত বারণ অগ্রাহ্য করে শত্রুদের মুখোমুখি হন। একশো কুড়ি জনকে মারার পর তিনি
নিজে ওদের হাতে খুন হয়ে যান। ততদিনে শিশু রঘুনন্দনও খানিকটা বড় হয়েছে। সে দাদার মৃত্যুর
প্রতিশোধ নেবার জন্য বিরাট এক লাঠিয়াল বাহিনী তৈরী করে। তাদের সাহায্যে শত্রুপক্ষের
লোকদের ধরে ধরে নিয়ে এসে যশোরের একেকটা গ্রামে লাঠিয়ালদের দিয়ে মেরে ফেলে সমস্ত জমি পুরস্কার হিসেবে
লাঠিয়ালদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে সাতক্ষীরায় কাকার কাছে এসে অল্প খানিকটা জমি
চেয়ে নিয়ে সেখানে ছোটখাটো আটচালার একটা বাড়ি বানায় আর সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে।
সেইসময় সরকার চাকরি দিচ্ছিল। রঘুনন্দন সেইরকমই একটা চাকরিতে যোগ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ
করতে শুরু করে, কাকার নির্দেশে প্রসন্নময়ীকে বিয়ে করে। রঘুনন্দনের কাকার ঠাকুরদা ছিলেন
প্রসন্নমোহন। সেই প্রসন্নমোহনের মুখেই কাকা
অন্নদাচরণ শুনেছিলেন তাঁর শৈশবের বন্ধু ক্ষীরোদাপ্রসাদ ষোড়শ শতকের কাছাকাছি কোন এক
সময় যশোর থেকে এখানকার সুতানু্টি অঞ্চলে পড়াশোনার অভিপ্রায়ে এলেও পরবর্তী কালে অন্য কোন গ্রামের দিকে বেশ কয়েকশো একর জমি তার উপার্জন
হিসেবে কোন এক রাজার কাছ থেকে অর্জন করে এবং
তারপর সেখানে তার জমিদারী স্থাপন করেন। প্রতাপনন্দনের ওই নিখুঁত সাদা টগবগে ঘোড়ার মতনই
ক্ষীরোদাপ্রসাদও তাঁর অদ্ভুত অলৌকিক জ্ঞানে লাফিয়ে লাফিয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়েছিলেন
তাঁর ভূসম্পত্তি। তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি একটা
সত্য আবিষ্কার করেছিলেন, রাতে যখন তিনি তাঁর
স্ত্রী সঙ্গে সহবাস করতে যান, সেই সহবাস কালটা আরও অনেক বেশি মধুর হয়ে উঠতে পারে, যদি
তাঁর প্রিয়তমা একটু ছলাকলা পটীয়সী হয়ে ওঠে।
ঠিক সেই জন্যেই বিভাবরী দেবীকে কিঞ্চিত অঘটনঘটনপটীয়সী করে তোলার জন্যেই ইংরেজ মেমদের
রেখে তাঁর বাড়িতেই একটা ছোটখাটো স্কুল বসিয়েছিলেন এবং সে কাজে তিনি যতদিন গেছে ততই
অনেক আনেক অর্থ ব্যয় করেছিলেন। রঘুনন্দনের
কাকামশাই তাই তাঁর ছেলেদের বলে রেখেছিলেন যদি এদিকে কখনও তারা আসে তাহলে ওদের যেন একটু খোঁজ করেন। রঘুনন্দন সরকারী
চাকরি থেকে অবসর নেবার পর যখন এখানে আসেন , তিনি খোঁজ খবর করে দেখেন, বৃদ্ধ মোহিতেশ্বর ও জোয়ান উদয়প্রসাদ
সেই বাতিস্তম্ভ স্বমহিমায় বুক চিতিয়ে তখনও ধরে রেখেছেনই শুধু নয়, তাঁদের বাচ্চা ছেলেটাকেও রীতিমত তালিম দিয়েছেন, কীভাবে এসব আরও
আরও বাড়াতে হবে। সেখানে ততদিনে বড়সড় স্কুলবিল্ডিং ও ছাত্রছাত্রীদের জমায়েতও স্বাধীনতা
দিবস উপলক্ষে তিনি নিজে চোখে দেখে এসেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের ছেলেরা মুখ পুড়িয়েছে।
তাই আলাপ পর্বটা বাকি রেখেই তিনি ওখান থেকে অন্য পথে গমন করেন। যদিও পরে অজান্তেই বিভাবরীদেবীর
নাতনি মানময়ীর সঙ্গেই যুবক অনঙ্গের বিয়েটা ঘটে যাবে স্রেফ একটা নতুন ইতিহাস পৃথিবীর
পেটের ভেতর থেকে রচনা হবার জন্য নিছকই একটা ভ্রুণ হিসেবে বেরিয়ে আশার ফলস্বরূপ, রঘুনন্দন
সেকথা না জেনেই এ পৃথবী ছেড়ে চিরবিদায় নেবেন, দিবাঙ্গের কাছে নিজের শেষ বয়সের শেষ সম্বল
সর্বস্ব খুইয়ে, আধপেটা খেয়ে, এমনকি অনঙ্গের উপার্জনের জমানো প্রায় পুরো টাকা সমেত হাতব্যাগটাও
খুইয়ে। কেননা অনঙ্গ চিরকালই তার মাইনের খামটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিত, সংসার আর গাড়ি
খরচা বাদ দিয়ে বাকী সবটাই মোটা অঙ্ক হয়ে রঘুনন্দনের হাতব্যাগে জমত, দিবাঙ্গের লোভাতুর
চকচকে চোখের ছোবল থেকে অশীতিপর রঘুনন্দন সেটুকুও বাঁচাতে পারেননি। মানময়ী বউ হয়ে এ
বাড়িতে ঢুকতেই সকলের চোখ ছানাবড়া। সেই ছানাবড়া
টপাটপ মুখে পড়তেই সকলেরই এমন বেদম বদহজম হয় যে সেই বদহজমের ঠেলায় মুখ দিয়ে অনর্গল রামায়ণ
মহাভারতের এমন প্রাকৃত প্রবচন নিঃসৃত হয়ে গিয়ে যে প্লাবন তৈরী হয়, তা এই ব্রম্ভান্ডকে
সাতবার অতলে পাঠাবার পক্ষেও বেশি।
মেয়েদের চোদ্দহাত কাপড়ে কাছা আঁটার ব্যাপারটা
কিন্তু শ্যামাঙ্গী কিছুতেই ভোলে না। ও ভীষণ উদ্যম নিয়ে শুরু করে এক আপ্রাণ চেষ্টা
যাতে করে কেউ না কেউ অকে এর মানেটা ঠিকঠাক
বুঝিয়ে বলতে পারে। তারপর কোন একদিন কোন দিকে কোনরকমই সুবিধে করতে না পেরে মানময়ীর বারহাত
একটা কাপড় পরে সেটাকেই ধুতির মত করে পেছনে টেনে নিয়ে কোঁচাটা গুঁজে দিয়ে সে সকলের সামনে
এসে সে সদর্পে ঘোষণা করে, ‘এই দেখ, আমি বারহাত কাপড়েই একা একা কাছা এঁটেছি। তারপর সোজা
সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গোটা গাঁয়ের সবাইকে
ঘুরে ঘুরে সেটা দেখিয়ে বলে আসে তার নিজের বক্তব্য।
জগা এসে ওকে যেই পাল্টা বোঝাবার চেষ্টা এর আসল মানেটা, মানময়ী খুন্তিটা উঁচিয়ে ধরে
বলে, ‘খবরদার ঠাকুরপো!’ জগা লেজ গুট্টিয়ে পালায়। তার বদলে অনঙ্গ মানময়ীকে বলে, মেয়ে তো ঢের বড় হল! এবার
ওর বিয়ের ব্যবস্থাটা পাকা করে ফেলতে হবে’। মানময়ীর চোখ দুটো থেকে যেন লাল গনগনে আগুনের গোলা বেরিয়ে এসে মনে হল অনঙ্গকে জীবন্তই
ভস্ম করে ফেলবে। উপমা এসে তক্ষুনিই সব সমস্যার সমাধান করে দিল। সে তখন সবে মাত্র দু
চার পা হেঁটে টলমল করতে করতে মানময়ীর সামনে মুখ থুবড়ে পড়েই এমন ভ্যা করে কান্না জুড়ে দিল যে তাকে তাড়াতাড়ি করে
কোলে তুলে নিয়ে মানময়ী আদর করে কান্না ভোলাবার
জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
অনঙ্গ রাস্তার ধারে ফুরফুরে হাওয়ায় বাড়ি
করেছে শুনে নীলাঙ্গের বউ একদিন ওদের বাড়ি আসে। বড় জাকে মানময়ী সাধ্যমত খাইয়ে পড়িয়ে
দান ধ্যান করাতে অনঙ্গ রেগে এমন আগুন হয়ে যায়
যে পর পর কয়েকদিন ওদের নিজেদের এবং গাঁয়ের অন্য সব বাড়িতে উনুন জ্বলে না। সকলেই এসে
ভীড় করে ওদের বাড়ি। মানময়ী কিন্তু অটল থাকে। সে দিব্যি জানিয়ে দেয় যে সে যা করেছে সেটা
আদৌ কোন অন্যায় নয় এবং এরকম কাজ সে প্রয়োজন হলে আবারও করবে শুধু নয়, করতেই থাকবে, যতদিন
সে বেঁচে থাকবে। অনঙ্গ হাঁ করে ওকে দেখতে দেখতে
সারাদিন পার করে দেয়। ঠিক সেই রকম একটা মুহূর্তে ওর মুখ দিয়ে একটা মাছি ঢুকে ওর পেটে
বুড়বুড়ি কাটতে শুরু করে দেয়। ও ওর পেটে হাত বোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে একজন
প্রতিবেশী মহিলা সকলের জন্য চারটি চাল নিয়ে অনঙ্গর মাথার ওপর বসিয়ে দেয়। বেচারা অনঙ্গ তা টেরও পায় না। আড়াই দিনের মাথায় সকলে সার দিয়ে
কলাপাতা নিয়ে বসে সেই রান্না করা ভাত খেতে আর সাড়ে তিন দিনের মাথায় সকলের খাওয়াদাওয়ার
পর্ব চুকলে একথালা ভাত নিয়ে অনঙ্গর সামনে মেলে ধরে স্বয়ং মানময়ী। বাধ্য শিশুর মত অনঙ্গ
সেটা নেয়। সকলে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। এরপর বড়জা তার সবচেয়ে ছোটছেলে আর তার চেয়েও বেশ ক’বছরের ছোট
মেয়েটাকে নিয়ে আসে একদিন। নতুন দাদাদিদিকে
পেয়ে উপমা, শ্যামাঙ্গী, সম্রাট, সুদাম খুব খুশি। সেদিন ওরা কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেও
এরপর থেকে ওদের যাতায়াত বাড়ে। ছেলেটিকে ওরা
নাম দেয় বাদুড় আর মেয়েটাকে ডাকে ভাঁটি বলে। যত দিন যায় ছেলেমেয়েরা হাতে পায়ে বেড়ে ওঠে।
আর শ্যামাঙ্গী নজরে নজরে প্রচুর নজরানা পেতে শুরু করে যেটা তা নিজের কিন্তু খুব তেঁতো
লাগতে শুরু করে। ইতিমধ্যে একদিন সেজজা সুলক্ষী
তার বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে আসে। শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে ওর দিব্যি ভাব জমে ওঠে। ওর নাম দেয়
ওরা লগ্নলতা। লগ্নলতা উপমার চেয়ে বড় বলে ওকে
কোলে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না । শেষপর্যন্ত ওরা দুজনে মিলে গিয়ে সোজা অনঙ্গর
ঘাড়ে পড়ে। অনঙ্গ গলা চড়িয়ে বলে ওঠে, ‘এসব কী হচ্ছেটা কী?’ ভয়ে উপমা আর লগ্নলতা কেঁদে
ফেলে। ঠিক সেই সময় মানময়ী অনঙ্গর মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে উত্তরটা ছুঁড়ে দেয়, ‘এখানে ঠিক সেই ব্যাপারটাই হচ্ছে যেটা তুমি
তোমার চর্মচক্ষে দেখতে পাচ্ছ। অবশ্য তুমি যদি নিজে চোখে দেখতে না পাও তাহলে আমাকেই
চোখটা সারিয়ে তোলার জন্য এখন একটা ডাক্তার ডাকতে বেরোতে হবে’। এরপর আর কেউ কোন কথা
বলে না।
বিমার সূত্রে মানময়ীর একটা বড় অঙ্কের
টাকা জমেছে। তাই সে স্থির করে বাড়িটাকে সে
আরও খানিকটা বাড়াবে আর সাজাবে। আয়তনে খুব বেশি বাড়ানো তো আর সম্ভব নয়। তাই আয়তনে খুব
সামান্যই বাড়ানো হল। সামনে পেছনের বাগান অক্ষত
থাকল। তবে সামনে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া , দোপাটি হাস্নুহানা আর বেশ কিছু পাতাবাহার
এবং ক্যাকটাস জাতীয় গাছ লাগান হল। ঈশান, অগ্নি, নৈঋত, বায়ুতে তিনটি করে মোট বারটি দেবদারু
লাগান হল। তুলসির বেদিতে দুদিক থেকে বট আর অশত্থ, শুধু এইদুটো গাছ এমন ভাবে বসালো যেন
চাঁদোয়ার মত ছাউনি তৈরী করেছে একটা। তারপরে বাড়িটাকে ওপরের দিকে বাড়ানো হল। সব ঘরের
মেঝেতেই বসানো হল ধবধবে সাদা পাথর। ঘরগুলোও বড়। তাতে দরজা জানলার মাপও যথেষ্ট বড়, যেমনটা
সচরাচর দেখা যায় না। জানলা দরজা সব মেহগনি কাঠের। অন্যান্য আসবাবও সব মেহগনি কাঠের।
দেশ বিদেশের নানা প্রতিভাবান শিল্পীদের ছবির প্রতিলিপি দিয়ে দেওয়াল সাজান হল। আর বিখ্যাত
সব চিত্রকলা ফ্রেম বন্দী করে নানা ঘরে রাখা হল। সম্রাট, উপমা আর লগ্নলতাকে নিয়ে মানময়ী
সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের পরিচয় আর কাজকর্ম
সম্পর্কে যা যা বলে সেগুলো সুদাম আর শ্যামাঙ্গীও জানে না। ফলে তারাও পেছন পেছন চলল
আর শুনতে থাকল এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে। মানময়ী তার গুরুজী রসিদুল্লা খাঁ আর গুরুমা নূরজাহান
খাতুনকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাল। বাড়িতে ওঁদের পা পড়তেই ছেলেমেয়েরা যেন মন্ত্রের
মত বদলে গেল। মানময়ী ওঁদের ওপরের দিকে দক্ষিণ খোলা শান্ত নিরুদ্বিগ্ন ঘরে থাকার ব্যাবস্থা করল।
শিশুরা সবাই ভোরবেলা উঠে ছাদে গিয়ে গুরুজী-গুরুমার তত্ত্বাবধানে সঙ্গীতের সাধনা করতে
বসে। গোটা বাড়ি যেন সুরের বন্যায় ভেসে যেতে
শুরু করল। প্রতিদিন সকালে একটা সুইচ টিপে বাড়ির সব জানলাগুলো খোলা হয় আর রাত দশটার
সময় ওটা দিয়েই সেগুলো বন্ধ করা হয়।
শ্যামাঙ্গী মূলত ক্লাসিকাল গানটাই ভালো
গায়। উপমা শুধু ছোটদের পক্ষে সহজ এমন কিছু গানই গাইতে পারে। লগ্নলতা ভজন গাইতে ভাল
শেখে। সুদামই শুধু একমাত্র যে নিজে গান লিখে নিজে সুর দিয়ে গান গাইতে পছন্দ করে। সপ্তসুরের
সাতটা ধ্বনি পুব দিক বাদ দিয়ে বাকি সাতটা দিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বাড়ির সমস্ত সদস্য ছাড়াও
যারা এই বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করে তাদের সকলের জন্যই প্রায় একটা করে ঘর বরাদ্দ করা
হয়। প্রত্যেকের খাট বিছানা আলমারি বাদ্যযন্ত্রও
যার যার আলাদা। এত বৈভবে অনঙ্গর চোখে ধাঁধা লেগে যায়।
যত দিন যাচ্ছে কস্তুরী মৃগের মত শ্যামাঙ্গীর
গা থেকে কিরকম একটা অচেনা গন্ধ বেরাতে শুরু করেছে। মানময়ী একদিন ওকে ওর ঘরে খুঁজে দেখে
বিবস্ত্র, ঘুমন্ত এক অচেনা মানবী রূপে। দেখা মাত্রই মানময়ী চমকে ওঠে। তারপরেই সঙ্গে
সঙ্গে ডেকে তুলে সব জানিয়ে এর কারণ জানতে চায়। শ্যামাঙ্গী খানিকটা থতমত খেয়ে ও লজ্জা
পেয়ে সত্যি আর মিথ্যে মেশানো এক কৌশলী উত্তর দেয় এবং সেই থেকে সে সারা জীবনের মত একেবারে সতর্ক হয়ে
যায়। কিন্তু নিজের সব কিছুকে ধীর স্থির অদ্ভুত
এক লয়ে বেঁধে ফেলার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সে আত্মরতিটাকেই এক চূড়ান্ত বিবেচনাসম্পন্ন
ব্যাপার হিসেবে গণ্য করে। সেই সঙ্গে সতর্কও
থাকে কাকপক্ষীও যেন আর কোনদিনও কখনও তার এ ব্যাপারটা টের না পায়। ফলে যতদিন যায় ততই
তার শারীরিক গড়ন খুব নিটোল হয়ে ওঠে ওর বয়সের অন্যদের তুলনায় এবং সেই সঙ্গে মেধাও খুব
তীব্র এবং প্রখর হয়ে ওঠে। আত্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিত্বের
গড়ন এমন হয়ে দাঁড়ায় যে ব্যাপারটা প্রায় সকলের কাছেই একই সঙ্গে প্রশংসনীয় ও ঈর্ষণীয়
হয়ে ওঠে। নানাজনে নানা কথা বলতে শুরু করে। শ্যামাঙ্গী কিন্তু নিষ্পাপ। মানময়ী যতই ওকে
বোঝায় যে বিয়ের আগে ও যেন আর কখনও এরকম না
করে এবং ওর শরীরের সব অধিকার ওর স্বামীর, ও যেন ততই আকাশ থেকে পড়ে। মুখে কিছু না বললেও,
ভেতরে ভেতরে ও একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠে যেন। আর খুব আশ্চর্যভাবে এইসব নিয়ে কথা বলতে গেলেই ও ভয়ঙ্কর ভাবে রেগে ওঠে। মানময়ী
কী করবে কিছু বুঝতে পারে না। শ্যামাঙ্গী ভাবে তার নিজের শরীরের ওপরে সকলের আগে তার
নিজের হক। তাই কোন পাপবোধ তাকে স্পর্শও করতে
পারে না। কোন কিছুকে সে পরোয়া করে চলে না। নির্মল চিত্তে অবলীলায় সব জায়গায়
সব কাজ করে বেড়ায় আর সবক্ষেত্রেই দুর্দান্ত সব ফলাফল হাতে পায়।
জগৎ সংসারের সকলেরই শ্যামাঙ্গীকে নিয়ে
নানা সন্দেহের মাঝে শুধু সুদামের মেজাজটা চটকে এমন ভাবে তালগোল পাকিয়ে যায় যে ঈশানের
দেবদারু তলায় বসে সে বেচারা একা একা বিড়ি ফুঁকে যায় একমনে আর তার ধোঁয়া বাড়ি ঘরে এমন বন্যার মত বয়ে যায় যে মানময়ী চেল্লামিল্লি করতে
শুরু করে দেয়। ধোঁয়াটা তাতেও না থেমে আস্তে আস্তে আশেপাশের বাড়িগুলোকেও গ্রাস করে ফেলে।
তারপর একসময় সেই ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে শ্যামাঙ্গী বড় বড় পা ফেলে দুহাতের মুঠোয় শিউলি ফুল নিয়ে এসে গোটা
চত্ত্বরটায় ছড়িয়ে দেয়। সেদিন রাত আটটা থেকে
বৃষ্টি শুরু হল। আর খুব আশ্চর্যজনকভাবে বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে অজস্র বেল, জুই, টগর ও
আরও নানারকমের সাদা ফুল পড়তে থাকে। জলে রাস্তাঘাট মাত্র এক ঘন্টাতেই ভেসে যায়, ছেলেমেয়েরা
রাস্তায় বেরিয়ে ফুল কুড়োতে শুরু করে। অনঙ্গ
মাথা নেড়ে জানায়, ব্যাপারটা তার সুবিধের ঠেকছে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কিছু একটা আছে।
কিন্তু কী, সেটা সে নিজেও বলে উঠতে পারে না। বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি দেখে তার শৈশবের বন্যার
স্মৃতিকাতরতায় গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সেই
কোন ছোটবেলায় একবার বন্যা হয়েছিল। তিন দিনের লাগাতার তুফানে গাছপালা, বাড়িঘরদোর, গরু,
ছাগল, হাস, মুরগি সব ভেসে যায়। ঘাড় অব্দি জলে শুধু কয়েকটা সাপ সাঁতার কাটতে কাটতে যাচ্ছে
আর ওরা কলার ভেলায় করে যেমনি এগোতে যাবে মানময়ী চিৎকার করে অনঙ্গকে ডাকল। অনঙ্গ অমনি
উত্তর দিল, ‘না। আমি এখন কলার ভেলায় চড়ে ভেসে যাচ্ছি জগত সংসারের সব কটা জ্যান্ত আর
মরা মানুষকে উদ্ধার করতে’। মানময়ী হতভম্ব হয়ে যায়, গভীর বিপদ অনুভব করে। তারপর সোজা
ঘরের ভেতর ঢুকে যায়।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন