কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৮৫

 

বিগত শতাব্দীর প্রথমার্ধে এবং তারও আগে যাঁরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৯২০ সালে সারা বিশ্ব জুড়ে অতিমারির ভয়ংকর তান্ডব। আমরা যারা বর্তমানে জীবিত আছি, ১৯২০ সালের সেই তান্ডব দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি ঠিকই, কিন্তু ঠিক একশ বছর পরে ২০২০ সালে সম্ভবত তার থেকেও ভয়ংকর তান্ডবের মুখোমুখি হয়েছি। বিশ্বের এত এত মানুষের অকাল মৃত্যুর ভয়াবহতা এবং ঘনিষ্ঠ স্বজন হারানোর বেদনা থেকে এখনও পর্যন্ত মুক্ত হতে পারিনি। সেইসঙ্গে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে বিশাল সংখ্যক মানুষের কর্মহীনতা এবং তারই প্রেক্ষাপটে অনাহারে অপুষ্টিতে জীবন বিপর্যয়ের এক অসহনীয় চিত্রনাট্য। বিষাক্ত ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সবাইকে নিজের নিজের ঘরে থাকতে বলা হয়ছিল। একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল অধিকাংশ বড় মাঝারি ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান, যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, পরিবহন ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছিল। এবং এর দরুণ প্রায় সব দেশেরই অর্থনৈতিক কাঠামো বেহাল হয়েছিল। কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে, যাঁরা পুঁজির ব্যাপারী, তাঁদের মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন কারণে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। মুনাফার ঘাটতি হয়। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল হলে তারা আবার হারানো জমি ফিরে পায়। নতুন নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভের কড়ি ঘরে তুলে আনে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যারা কর্মচ্যূত হয়, তারা কিন্তু সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের বিপদ উভয়মুখী, কর্মক্ষেত্রে থাকলে ভাইরাসের মার, আর ঘরে থাকলে নিতান্তই অনাহার। বস্তুত পক্ষে, মেহনতী মানুষের কাছে লকডাউন ব্যাপারটাই একটা নির্মম প্রহসন। বরং যাদের ঘরে খাবারের অভাব কখনও অনুভূত হয় না এবং সঞ্চিত যথেষ্ঠ অর্থ, তাদের ক্ষেত্রে লকডাউন একটা মানসিক উৎপাত বলে মনে হলেও, অন্তত অনাহারে মরার কোনো আশঙ্কা থাকে না। যত অনিশ্চয়তা, অসহায়তা ও অপরাগতা দিন আনি দিন খাই মানুষের।

 

এভাবেই একে একে অতিক্রান্ত হয়েছে ২০২০র দিনগুলি। আর কয়েকটা দিন পরেই সূচনা হবে ২০২১এর। এবছর ৩১শে ডিসেম্বরের রাতে যখন ঘড়ির কাঁটা স্পর্শ করবে ১২ নম্বর অঙ্ক, তখন কি বিশ্বের মানুষ আগের মতোই উচ্ছ্বসিত উল্লসিত হয়ে পরস্পরকে অভিবাদন ও অভিনন্দন জানাবে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করে? কৃত্রিম আলোর রোশনাইতে আলোকিত হবে আকাশ? শব্দবাজির বিকট আর্তনাদে গাছে গাছে নিদ্রিত পাখিদের ঘুম যাবে ভেঙে? আর যাঁরা স্বজন হারানোর বেদনায় মুহ্যমান হয়ে আছেন, তাঁদের ক্ষততে কি একটুও স্নিগ্ধ প্রলেপ বুলিয়ে দিতে পারবে নতুন বছরের ১লা জানুয়ারী? বাস্তব বড় নির্মম। সে কোনো হাস্যরস ও কোমল রসের ধার ধারে না। কারও বেদনায় ব্যথিত হয় না। তীব্র নিদাঘ এবং তীক্ষ্ণ শৈত্যের মতোই আমাদের সামগ্রীক জীবনযাপনে তার অনুপ্রবেশ ঘটে। এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

 

সবাই সুস্থ থাকুন। সুস্থ থাকার জন্য যে বিধি নিষেধ মেনে চলা প্রয়োজন, তা কখনই অবহেলা করবেন না।   

 

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

                                                                                                   

দূরভাষ যোগাযোগ :           

08789040217 / 09835544675 

                                        

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৪  

 


আমাদের দেশে ও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। আমরা আজ তার ভেতর মাত্র কয়েকটা হলিউড ক্লাসিক বেছে নেব, যার গ্রহযোগ্যতা প্রশ্নাতীত এবং সেগুলো থেকে আমরা কী কী শিখলাম সেই নিয়ে  আলোচনা করব। আমি ইচ্ছে করেই ১৯৩০-এর পরের সিনেমাগুলো বেছেছি যাতে ছায়া-ছবি-শব্দ সব কিছুই থাকে, অর্থাৎ এগুলো সাইলেন্ট মুভি নয় (শুধু আংশিকভাবে ‘মডার্ন টাইমস্‌’ বাদে যেটা পরে বলব)প্রথম ছবি, ফ্রাঙ্ক কাপরার ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’ (১৯৩৪), দ্বিতীয় চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস্‌’ (১৯৩৬), তৃতীয় ভিক্টর ফ্লেমিংয়ের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯), চতুর্থ ছায়াছবি আলফ্রেড হিচককের ‘রেবেকা’ (১৯৪০) ও পঞ্চম মুভি অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১)

একটা সিনেমা বানানো বেশ জটিল কাজ। সিনেমা-হলে ছবিটা দেখে আসার পর আমরা যেরকম ভাবি, কী দারুন ডায়লগ, সিনারি, অভিনয়, নাচ-গান-মিউজিক –  সিনেমা বানানো কিন্তু এর থেকে বহুগুণ শক্ত। কিছু গলা-কাঁপানো ডায়লগ দিয়ে, নাচ-গান দিয়ে আর প্রকৃতির মাঝে ক্যামেরা ঘুরিয়ে সিনেমা হয় না। স্ক্রিন-প্লে যদ্দূর সম্ভব নিখুঁত তৈরি করে ক্যামেরার পেছনে একজন পরিচালককে শিকারী চিলের মত বসে থাকতে হয়, কখন একেকটা শট্‌ পারফেক্ট হবে, ওমনি সেটাকে ক্যামেরায়  বন্দী করতে হবে। এরজন্য ক্যামেরাটা কোথায় থাকবে, কোন্‌ অ্যাঙ্গেলে থাকবে, শট্‌টা ক্লোজ শট্‌ হবে নাকি দূরের শট্‌, ফোকাস কোথায় হবে, কতক্ষণের শট্‌ হলে  সেটা বেশি কার্যকর হবে, কোন্‌ জায়গাটায় আলো থাকবে আর কোথায় আবছায়া,  সেটে রঙের ব্যবহার কীরকম হবে, এইসব হাজারো হাবিজাবি মাথায় রাখতে হয়।  তারসঙ্গে অভিনয়, ডায়লগ, মেক-আপ, মিউজিকের ব্যবহার ইত্যাদি। অর্থাৎ পুরো সেটের ডিজাইন, প্রত্যেক শটের জন্য। আর এইসব হবার পর আবার শব্দের একপ্রস্থ ডাবিং আর যথাযথ এডিটিং। কাঁচি একবার যদি ভুল কাটে, তাহলে সব পরিশ্রম জলে। আর এইসবের পেছনে থাকে পরিচালকের ধৈর্য্য। তবেই দাঁড়ায় একটা সিনেমা। ফলে আমরা যখন কোন ছবির কড়া সমালোচনা করি, সেটা হয়ত পরিচালকের ভবিষ্যতের জন্য ভাল হয়, কিন্তু সে খুব দুঃখ পায়, তার ঘামঝরা  সৃষ্টির বদনাম হল বলে। সেইজন্য সব পরিচালককেই পরিচালনা করার আগে গোটা পৃথিবীর সবথেকে ভাল ছায়াছবিগুলো থেকে শিখতে হয়। ছবির প্রতি অংশের বিশ্লেষণ বুঝতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাধার কিছু ছবিও দেখতে হয়, যাতে বোঝা যায়  সেই ছবির ভুলগুলো কোন্‌ যায়গায়। তো, আজ আমরা হলিউডের শুরুর দিকের কিছু অসাধার ছবি নিয়ে এইসব আলোচনাই করব। সিনেমাগুলো কোন্‌ অংশে  শিখিয়েছে, কী কী শিখিয়েছে। ছবির প্লট নিয়ে একগুচ্ছ সময় ও স্পেস নষ্ট করব না।




১৯৩৩ সালের এক ছোটগল্প ‘নাইট বাস’ অবলম্বনে তৈরি ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’ (১৯৩৪) হলিউডের প্রথম ছবি যা পাঁচটা সেরা অস্কার (বিগ ফাইভ) পেয়েছিল – সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা স্ক্রিপ্ট, সেরা নায়ক ও সেরা নায়িকা। এক বড়লোকের মেয়ে নিজের বাবার শাসন থেকে বাঁচতে পালিয়ে যায়। রাস্তা দেখা হয় এক রিপোর্টারের সঙ্গে, সে যার প্রেমে পড়ে। তারপর ছবি জুড়ে উপভোগ্য নাটকীয়তা। আমার মতে, এই সিনেমার আসল সাফল্য একদিকে প্রকৃতির মায়া ফুটিয়ে তোলা ও অন্যদিকে গ্রাম্য আমেরিকার দারিদ্র ক্যামেরার সামনে আনা। এই সিনেমা ‘প্রি-কোড’ হলিউডের ব্লকবাস্টার রোমান্টিক কমেডি হিসেবে ধরা যায়, যখন ‘মোশন পিকচার প্রোডাকশন কোড’ চালু হয় নি (এই কোড ছিল সিনেমায় কী দেখান যাবে আর কী দেখান যাবে না, তার গাইডলাইন) এই ছবি নিয়ে অনেক  গল্প আছে। এর নায়িকা ক্লদেত কোলবার কিছুতেই এই সিনেমা করতে চাননি কার কাপরার পরিচালনায় ওনার কেরিয়ারের প্রথম ছবি ফ্লপ করেছিল। তারপর  পারিশ্রমিক ডবল করার শর্তে (সেই সময়ে ৫০ হাজার ডলার, ভাবতে পারছেন!)  নায়িকা এই ছবি করেন। শুটিং চলাকালীন পরিচালক বারবার এর স্ক্রিপ্ট বদল করেন ও এই ছবিকে দ্রুতগতির সিনেমা করে তোলেন। একজন পরিচালককে সেরা হতে গেলে ও সেরা ছবি বানাতে গেলে উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে কী কী করতে  হতে পারে, তা এই সিনেমার ইতিহাস থেকে ভালভাবে শেখা যায়। সাদা কালো ছবি হিসেবেও কীভাবে জলে আলোর ঝিকমিকের সাথে মায়াবি মুহূর্ত বা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের  ক্লোজ-শটে মুখের প্রতিক্রিয়া ফুটিয়ে তুলতে হয়, তা এই ছবি পৃথিবীকে শিখিয়েছে। আরো শিখিয়েছে নায়িকার বিরক্তি সত্বেও পরিচালক কীভাবে তার অভিব্যক্তির  সেরা অংশ ক্যামেরায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন। এই সিনেমা একদম আদিলগ্নের রোমান্টিক কমেডি হিসেবে এতই জনপ্রিয় ছিল যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রচুর ভাষায় এর গন্ডা গন্ডা রিমেক হয়েছে। ভারতেও হয়েছে। হিন্দি, তামিল, কন্নড়, এমনকি বাংলাতেও... উত্তম-সুচিত্রার চাওয়া-পাওয়া (১৯৫৯) ইত্যাদি




‘মডার্ন টাইমস্‌’ (১৯৩৬) নিঃসন্দেহে চার্লি চ্যাপলিনের সেরা ছবি। লিটল ট্রাম্পের ভূমিকায় চ্যাপলিনের শেষ সিনেমা। যে ট্রাম্প এর আগে বিভিন্ন রোলে ধরা দিয়েছে, সে এই সিনেমায় আধুনিক শিল্পায়নের আগ্রাসনের যুগে মানিয়ে নিতে পারছে না। চ্যাপলিন এই ছবির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপের আর্থিক মন্দা দেখে ও গান্ধীর সঙ্গে কথা বলার পর। আমার মতে এই ছবি নিতান্ত কমেডি ছবি নয়। থিম হিসেবে আমি এই সিনেমাকে অন্য সব ছবির তুলনায় এগিয়ে রাখব,  কার এখানে যা দেখানো হয়েছে, তা আজকের যুগেও উল্লেখযোগ্যভাবে মানানসই।  জনসংখ্যা বেড়ে চলা, আগ্রাসী শিল্পায়ন, সেজন্য মানুষকে রোবটে পরিত করা,  ক্লান্তি-অবসাদ, মানসিক হাসপাতাল, কমুনিস্ট ধর্মঘট, বেকারত্ব, মানুষের দুর্দশা, বেড়ে চলা অসামাজিক কাজ, এর ভেতরেই ভালবাসা, বাঁচার স্বপ্ন, আবার উচ্চশ্রেণীর মানুষের ভেতর শপিং মল আর ক্যাবারে কালচার – আধুনিক সমাজের খুব জটিল কিছু বিষয় এখানে একসঙ্গে সহজভাবে দেখানো হয়েছে। নিজের সময়ের থেকে এই ছবি অনেক এগিয়ে। সঠিকভাবে বললে, এ হল দুঃখ সত্বেও মানুষের ভালভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নের ছবি। ‘ইটস্‌ এ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ থেকে শুরু করে ‘দ্য শ্যশঙ্ক রিডেম্পশন’ অব্ধি সবার পূর্বসুরী।

এই সিনেমাকে সাদা-কালো সাইলেন্ট মুভি বলা হলেও আসলে এটা নির্বাক, সবাক, শব্দ, মিউজিক, স্ক্রিনে লেখা ও সংলাপের এক অপূর্ব মিশ্র। এমনকি  চ্যাপলিনের মুখেও গিবারিশ ভাষায় গান আছে। সঙ্গে তাঁর অনবদ্য অভিনয়,  শারীরিক সক্ষমতা আর স্ল্যাপস্টিক কমেডি। সবাক সিনেমার যুগেও শব্দ-নির্বাক মিশ্র এই সিনেমার সবথেকে বড় পাওয়া। একটা সিন আছে যেখানে চ্যাপলিনের  পেটে গুড়গুড় করছে। সেই শব্দ চ্যাপলিন নিজে তৈরি করেছিলেন – জলের ভেতর প্লাস্টিক বুদবুদ ফাটিয়ে। আরেকটা কথা। এই সিনেমা শুট করা হয়েছিল প্রতি সেকেন্ডে ১৮-টা ফ্রেমে। নির্বাক ছবির এটাই মোটামুটি স্পিড। এবং সেটাকে প্রোজেক্ট করা হয়েছিল প্রতি সেকেন্ডে ২৪-টা ফ্রেমে। সবাক স্পিডে। ফলে স্ল্যাপস্টিক মুহূর্তগুলো দারু ফুটে উঠেছে। সবশেষে বলতেই হয় এই মুভির সেট   পরিকল্পনা। ধরুন, শুরুর ফ্যাক্টরির সিন। যন্ত্রাংশের মিনিয়েচার দিয়ে পুরো সেটটা নিখুঁতভাবে তৈরি করা। যা আজকের পরিচালককে জানতেই হবে। একে সর্বকালীন ক্লাসিকের তালিকায় না রাখলে ইতিহাস রাগান্বিত হবে।




১৯৩৬ সালে মার্গারেট মিচেলের বিখ্যাত উপন্যাসের ছাঁচে ফেলে তৈরি ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) প্রায় চারঘন্টার ছবি, দেখতে গেলে বেশ ধৈর্য্য দরকার। তবুও দু’বার দেখেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি, এই সফল রসায়নের পেছনে ঠিক কী  লুকিয়ে। এবং বারবার আলো আর রঙের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। প্রায় ৮২ বছর আগের ছবি, অথচ রঙের ব্যবহারে কী সাবলীল! এই সিনেমার শুরুর দিকের  আউটডোর সিন আর শেষের মিউজিক দৃশ্য যতবার দেখি, মনে হয় স্বদেশ সেনের কবিতা –- ‘নীল রবারের থাবা পড়ে গেছে এইসব আকাশের গায়ে/ কি ভাবে যে খেলে গেছে শরতের যত ভালো/ যত কিছু আলো’।

এবার আসি ছবির টেকনিকাল কথায়। আমেরিকান সিভিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণের জর্জিয়া ও আটলান্টার তুলোচাষিদের জীবন ও তার নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে এই ছবি। ইতিহাসের সঙ্গে ইমোশনে ভরা। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ফ্লেমিংয়ের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ ৮২ বছর আগের সেই প্রথম ছবি যা দশ’খানা অস্কার পেয়েছিল। আরো বড় কথা, এই ছবি সিনেমার ইতিহাসে সাদা কালো ছবির ভীড়ে প্রথমদিকের কয়েকটা রঙিন ছবির ভেতর একটা। আরেকটু এগোই, এই ছবি সেই প্রথম ছবি যা রঙের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দর্শকের মুড ভাল করার জন্য অনারারি অস্কার পেয়েছিলসঙ্গে অনবদ্য কস্টিউম ডিজাইন যার জন্য আর্ট ডিরেকশনেও অস্কার। আর ভিভিয়েন লেই ও ক্লার্ক গ্যাবলের মনকাড়া অভিনয় তো রয়েইছে হ্যাঁ, এই সিনেমা নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক আছে। যেমন, সিনেমার দ্বিতীয় ভাগ অনাবশ্যক ভাবেই দীর্ঘ। দাসপ্রথাকে এখানে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। ছবির নাটকীয়তায় বুদ্ধিদীপ্ত অংশ নেই বললেই চলে, শুধুই আবেগে ভরা। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে কথাটা মনে রাখতেই হবে, তা হল এই ছবি সেই সময়কার সর্বোচ্চ সফল ছবি এবং বেশ কিছু বিভাগে এই ছবি এমন কিছু ব্যাপার শিখিয়ে গেছে যা আজকের দিনেও হবু পরিচালকদের কাছে খুব প্রাসঙ্গিক। স্কারলেট ও’হারা-র ভূমিকায় ভিভিয়েন লেই সেই সময়কার প্রোটোটাইপ নারী চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসা এক ব্যতিক্রম। বারবার জীবনের ওঠাপড়া। অবসেশন। ধূসর হয়ে আসা স্বপ্ন। এতগুলো মোটিফ বা কনট্রাস্ট একই সিনেমায় সহজে দেখা যায় না। সঙ্গে দুরন্ত রঙিন ক্যামেরার কাজ। সেজন্যই এই সিনেমা হলিউডি ক্লাসিকের একদম ওপরের সারিতে।     



এরপর হিচককের ‘রেবেকা’ (১৯৪০) দাফনি দু’মরিয়ে–র ১৯৩৮-এর বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে। হিচককের একমাত্র সিনেমা যা সেরা ছবি হিসেবে অস্কার পেয়েছিল। জানি, অনেকেই হয়ত বলবেন, হিচককের ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) বা ‘সাইকো’ (১৯৬০) ছেড়ে আমি হঠাৎ ‘রেবেকা’ নিয়ে পড়লাম কেন? কার বেশিরভাগ দর্শক মনে করেন, পরিচালক হিসেবে হিচককের সেরা ছবি ভার্টিগো বা সাইকো। কিন্তু আমি আমার পছন্দের পেছনে দুটো কার দেখাব (অস্কার পাওয়া অবশ্যই কোন কার নয়)প্রথমত, ‘রেবেকা’ অন্য দুটো সিনেমার তুলনায়  বহু আগের ছবি। হিচককের পাকাপাকিভাবে হলিউড আসার পর প্রথম ছবি। দ্বিতীয়ত, ‘রেবেকা’র পর সাইকোলজিকাল থ্রিলার এক অন্য মাত্রা পায় এবং অন্যান্য পরিচালকরা এই ধরনের ছবির প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে, রেবেকা আমার কাছে ট্রেন্ড-সেটার। আর আজ তো আমরা জীবনের ওঠাপড়ার সাথে ট্রেন্ড-সেটার মুভি নিয়েই আলোচনা করছি। একটা গোটা ছবি জুড়ে গথিক আধাভৌতিক পরিবেশে মৃত এক চরিত্র (রেবেকা) না থেকেও অদৃশ্যভাবে প্রতি সিনে রয়ে গেল আর তার বিশ্বস্ত পরিচারিকা মিসেস ডেনভার্স (জুডিথ অ্যান্ডারসন) আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে নায়িকার (জোন ফন্টেন) মনে সেই ভয় বজায় রেখে তার ঘাড়ে  নিঃশ্বাস ফেলে গেল, এই কম্বিনেশন ৮২ বছর আগে ভাবা যেত না। এমনকি, মিসেস ডেনভার্স যখন মৃত রেবেকার অন্তর্বাস কোথায় থাকে বা সে যখন পার্টি থেকে মাঝরাতে ফিরে এসে আনড্রেস করত, সেই স্মৃতিচারণায় আভিজাত্যের  মাঝেও সাহসী হাল্কা লেসবিয়ান ছোঁয়া টেনে আনছে – তখন এই ছবিকে সম্ভ্রম করতেই হয়। অস্কার কমিটির ভুল, এইরকম অসাধার অভিনয়ের পরেও জুডিথ  অ্যান্ডারসনকে সেরা সহ-অভিনেত্রীর জন্য অস্কার না দেওয়া। এবং এটাও ভুললে চলবে না, এই সিনেমায় জোন ফন্টেনের ভেতর হলিউড সেই হবু সুপারস্টার পেয়ে গেছিল যে পরের বছর হিচককের ‘সাসপিশন’ (১৯৪১) ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার পেয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় এই ছবি আরো অনেক কিছু শেখাতে পারে। ক্যামেরা অ্যাঙ্গল আর কথোপকথনের সময় দুজন চরিত্রের মাঝের দূরত্ব (স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স) কী রকম হওয়া উচিৎ, সেটা সত্যিই তারিফ করার মত।  এই সিনেমার একটা স্টিল ছবি দিলাম, ভাল করে দেখলে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। হবু পরিচালকরা আরো ভাল বুঝবে। এরপর রয়েছে সাদা আলোর সাহায্যে কালো আবছায়া ফুটিয়ে তোলা আর কস্টিউমের মাধ্যমে গথিক সেই মেজাজ ধরে আনা। এবং এডিটিং। আর সবার ওপরে, ক্যামেরার অ্যাকশন যখন হচ্ছে, তখন সাউন্ড-ট্র্যাক কী রকম হলে সেই অ্যাকশন দর্শকের মনে শিহরণ জাগায়। মিউজিক  দিয়ে রোমান্স অথবা থ্রিলার ফুটিয়ে তোলা। সিনেমাটা মনোযোগ সহকারে দেখলে আমার কথাগুলো ধরতে পারবেন।  



অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১) কোন উপন্যাস বা বই থেকে নেওয়া নয়। সরাসরি লেখা চিত্রনাট্য যা সিনেমায় দেখানো হয়েছে। চিত্রনাট্য এতই ব্যতিক্রমী যার জন্য এই ছবি বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিন-প্লে হিসেবে অস্কার পেয়েছিল। অবশ্য প্রকৃত অর্থে এই সিনেমার একক স্টার অরসন ওয়েলেস। উনি এই ছবির পরিচালক, প্রোডিউসার, নায়ক ও স্ক্রিন-প্লে লেখক (যৌথ)। দু’ঘন্টার ছবি শুরু  হচ্ছে খুব ধনী ব্যক্তি অরসন ওয়েলেসের (ছবিতে চার্লস ফস্টার কেন) মৃত্যু আর তার বলা শেষ শব্দ ‘রোজবাড’ নিয়ে। সেই নিয়ে খবরের কাগজগুলো তদন্ত শুরু করে। তারপর পর্দায় কেনের জীবন উঠে আসে। অবশ্য নন-লিনিয়ার ন্যারেশনের মাধ্যমে। সিনেমার টেকনিকাল জায়গায় যাবার আগে যেটা বলে রাখতে চাই, তা হল ওয়েলেসকে হলিউড আমেরিকায় ডেকে এনেছিল তার মার্কারী থিয়েটারের সাফল্য দেখে। এবং তার হাতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল নিজের মত করে মুভি বানানোর। যে কারণে ওয়েলেস এই সিনেমা একগুচ্ছ নতুন মুখকে নিয়ে বানাতে  পেরেছিলেন। এবং বলাই বাহুল্য, এই ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।

ঐ যে ‘রেবেকা’য় ক্যামেরার মুভমেন্ট আর ক্যামেরা অ্যাঙ্গলের কথা বলছিলাম তখন, সেগুলো দারুনভাবে শিখিয়েছে ‘সিটিজেন কেন’এমন একেকটা অ্যাঙ্গলে ক্যামেরা বসিয়ে শুট করা হয়েছে যা দেখলে অবাক লাগবে। সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার শিখিয়েছে -- ডিপ ফোকাসকী রকম? ধরুন আপনি একজন ফটোগ্রাফার। একটা  গোলাপ ফুলের ফটো তুলবেন। ফোকাল লেন্থ গোলাপ অব্ধি ফিক্স করলে দেখবেন পেছনের সমস্ত অবজেক্ট ঝাপসা হয়ে গেছে। এবার দূরের পাহাড়ের দিকে ক্যামেরা তাক করুন। ফোকাল লেন্থ ইনফিনিটি। সামনে কাউকে দাঁড় করিয়ে দেখুন, এবার সেই ব্যক্তি ঝাপসা হয়ে গেছেন। SLR ক্যামেরায় এটাই ফোকাসের স্বাভাবিক নিয়ম। এবার ক্যামেরায় একটা ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স লাগান। অ্যাপার্চার ছোট করে দিন। ফটো তুললে দেখবেন, সামনের পেছনের সব অবজেক্ট স্পষ্ট আসছে। এটাই ডিপ ফোকাস। কিন্তু সিনেমায় ডিপ ফোকাস ব্যবহার করতে গেলে মুন্সিয়ানা লাগে। সিটিজেন কেন-এর একটা সিন বলি। কেন-এর মা-বাবা একজন ব্যাঙ্কারের সঙ্গে কেনের ভবিষ্যত নিয়ে ঘরের ভেতর আলোচনায় ব্যস্ত আর বালক কেন জানলার বাইরে বরফ নিয়ে খেলছে। সাধার একজন পরিচালক হলে সে প্রথমে জানলার  ওপর ক্যামেরা রেখে বালক কেন-কে একটু দেখিয়ে ক্যামেরার মুখ ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর ক্লোজ শটের জন্য নিয়ে চলে আসত। কিন্তু ওয়েলেস সেই পথে যান নি। উনি ডিপ ফোকাস করে বাকি চরিত্রগুলোর সঙ্গে সারাক্ষণ বালক কেন-কে দেখিয়ে গেলেন যাতে কথোপকথনের সময় আমাদের দৃষ্টি সেই বালকের ওপর পড়তে বাধ্য হয়। এটা কিন্তু ৮০ বছর আগে বেশ শক্ত এক টেকনিক ছিল। ঠিক যেমন ছিল লং শট বা বহুক্ষণ ধরে তোলা একটা শট। কারণ তখনকার দিনে ক্যামেরা স্থিরভাবে রাখার যন্ত্রপাতি বিশেষ ছিল না। অথচ ‘সিটিজেন কেন’ সেটাও করে দেখিয়েছে। হিচককের ‘রেবেকা’র মত এখানেও আবছায়া ব্যবহার করা হয়েছে রহস্য জিইয়ে রাখার জন্য। শার্প কনট্রাস্ট রয়েছে। এছাড়াও এখানে বেশ অদ্ভুতভাবে এসেছে মন্তাজের ব্যবহার। ওভারল্যাপের মাধ্যমে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়া। সব মিলিয়ে, এই সিনেমা সর্বকালের সেরা হবার দৌড়ে সবসময় এগিয়ে থাকবে। ‘আই ডোন্ট থিঙ্ক এনি ওয়ার্ড ক্যান এক্সপ্লেন এ ম্যান’স লাইফ’ – এই সিনেমার এক বিখ্যাত উক্তি। একটু ঘুরিয়ে বলতে পারি, এই দুর্দান্ত সিনেমাকে সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য আমার কাছেও শব্দ নেই। 

সবশেষে বলি, আজ হলিউড ক্লাসিক নিয়ে আলোচনা করলাম মানে এরপর অবশ্যই একদিন গোটা পৃথিবীর ক্লাসিক কিছু মুভি নিয়ে বলতেই হবে। নাহলে আমার পেটে একটা সুড়সুড়ি থেকে যাবে যে আপনারা হয়ত আজ আলোচনা করা এইসব সিনেমাগুলোকেই সর্বোচ্চ ধরে নিলেন। তবে তার আগে কয়েকটা দেশ একটু ঘুরে আসব। ওঠানামার পাশাপাশি জীবনের একটা অদ্ভুত রহস্যময়তাও আছে। আমি সেই রকম রহস্য খুঁজে পাই বেশ কিছু কোরিয়ান সিনেমায়। সামনের বার সেই রহস্য নিয়ে আপনাদের মুখোমুখি হব।     


ফারহানা রহমান

 

কাজিও ইশিগুরো : মানবমনের গভীরতম উপলব্ধির নায়ক




‘উপন্যাসের দিন ফুরিয়ে গেছে’ বলে যেসব গুঁজব সৃষ্টিকারীরা গত কয়েকবছর ধরে যে হাঁকডাক করে বেড়াচ্ছিল, তাদের অবাস্তব উক্তিগুলোর মুখে চুনকালি মাখিয়ে জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ উপন্যাসিক, গল্পকার এবং বিজ্ঞানলেখক  কাজুও  ইশিগুরো তাঁর অসাধারণ আবেগীয় উপন্যাসসমূহের জন্য সাহিত্যের  সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল পুরস্কারটি তাঁর ঝুলিতে ভরে নিয়েছেন। তাঁর নোবেল  পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে সুইডিশ একাডেমির প্রেস রিলিজে বলা হয় যে , কাজুও ইশিগুরো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পিছনে রয়েছে তাঁর এমন একটি  ক্ষমতা যা দিয়ে তিনি মানব মনের গভীরতম উপলব্ধিকে অবলোকন করতে পারেন। তিনি তাঁর আবেগীয় শক্তিতে ভরপুর উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে আমাদের  বাস্তবজগতের সাথে অলীক জগতের সম্পর্কের অন্তরালের নিমজ্জিত হতাশাগুলোকে উন্মোচন করেছেন।  

কাজুও ইশিগুরোকে বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবহিত হতে হবে, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমরা এমন  একটি সময়ের খুব কাছে পৌঁছে যাচ্ছি, যখন আমরা কিছু মানুষ অন্য মানুষদের থেকে উন্নততর মানুষ বানাতে সক্ষম হব। নবকারিগরি দক্ষতা আমাদের মৌলিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে দেবে যদি না আমরা বিজ্ঞানের সাথে এখনই  সংযুক্ত হতে পারি। আমরা আসলে এমন একটি দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমাজের কথা কল্পনা করতে পারি, যেখানে অভিজাত নাগরিকরা জৈবপ্রকৌশল প্রযুক্তির কারণে অধিকতর চৌকস স্বাস্থ্যবান এবং দীর্ঘজীবী হবে। আর নিন্মস্তরের মানুষেরা হবে গড়পড়তা সাধারণ ও দুর্বল। এটি শুনে মনে হতে পারে যে, আমি কোন ভীতিকর উপন্যাসের কথা বলছি। কিন্তু  ব্রিটেনের জনপ্রিয়তম লেখকের মতে এই বিশ্ব আসলে এমনই একটি দৃশ্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। কাজুও ইশিগুরো যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘ক্রিস্পর (Crispr) প্রযুক্তি দ্বারা জীন বা প্রাণ-কোষ সম্পাদনার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থায় অনিবার্য যে পরিবর্তন আসবে, তা প্রতিষ্ঠিত মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিতে পারে।   

তিনি বলেন, “আমরা এমন এক স্থানে যাচ্ছি যেখানে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে  নির্মিত আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থা সহসা অকার্যকর হয়ে পড়বে। যদিও উদারনৈতিক গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি, মৌলিকভাবে সব মানুষ সমান। কিন্তু আমরা এমন একটি স্তরে পৌঁছে যাচ্ছি যেখানে বস্তুতঃ আমরা এক ধরনের উন্নততর মানুষ সৃষ্টি করতে পারবো বলে মনে করি।   

ব্রিটিশ উপন্যাসিক, গল্পকার এবং বিজ্ঞানলেখক কাজুও ইশিগুরো, ১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর জাপানের নাগাসাকিতে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। সমুদ্রবিজ্ঞানী বাবা সিজুও  ইশিগুরো ১৯৬০ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের সারেতে অবস্থিত বড়শহর গিল্ডফোর্ডে the National Institute of Oceanography তে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে রিসার্চ করার জন্য আসেন এবং সেখানেই স্ত্রী, পুত্র ইশিগুরো ও দুই কন্যা নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।    

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি তাঁর বাবা সিজুও ইশিগুরো সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “আমি যখন অতীতের দিকে তাকাই আমি দেখতে পাই যে বাবা  তাঁর নিজের কাজের প্রতি পুরোপুরি সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরে রেখেছিলেন, ঠিক  যেমন ছিল একজন লেখক হিসেবে আমার কাজের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি। বাবা আমার জীবনের মডেল কারণ তিনি তাঁর কাজকে কখনই শুধুমাত্র তাঁর পেশা হিসেবে দেখেননি। বরং তিনি তীব্রভাবে সবসময় কাজটিকে উপলব্ধি করতেন।    

ইশিগুরো সারেতে স্টটটন প্রাথমিক স্কুলে এবং তারপর উইকিং কাউন্টি গ্রামার স্কুলে পড়ালেখা শেষ করেন। স্কুল শেষ করার পর তিনি প্রায় একবছর প্রচলিত পড়ালেখা বন্ধ রেখে ইউএসএ ও ক্যানাডাতে ঘুরে বেড়ান। এরপর যুক্তরাজ্যের  কেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৮ সালে ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রী নেন এবং  ইস্ট এঞ্জলিয়া থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর উপর ১৯৮০ সালে  মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পান। এবং এরপর থেকে তিনি ব্রিটেনেই বসবাস করতে থাকেন। জাপান থেকে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে আসার পর প্রথম তিনি ৩৮ বছর বয়সে একটি সাহিত্যসভায় যোগ দেওয়ার জন্য জাপান সফরে যান।  

ইশিগুরোকে সমকালীন ইংরেজিভাষী বিশ্বের সবচেয়ে  জনপ্রিয় কল্পকাহিনী লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।  তিনি এ পর্যন্ত চার চারবার ম্যানবুকার প্রাইজ উইনিং-এ মনোনয়ন পেয়েছেন এবং ১৯৮৯ সালে অবশেষে তিনি তাঁর  উপন্যাস ‘দ্য  রিমেইন্স  অফ দ্য ডে’এর জন্য পুরস্কৃত হন। তাঁর ৭টি উপন্যাস  প্রায় ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ২০০৮ সালে ‘দি  টাইম’ ম্যাগাজিনের জরীপে ১৯৪৫ পরবর্তী ৫০জন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখকদের মধ্যে তাঁর স্থান হচ্ছে ৩২তম। ২০০৫এ লেখা তাঁর ‘নেভার লেট মি গো’ উপন্যাসটি বছরের সেরা উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলো। ৬২ বছর বয়সী এই লেখকের বিখ্যাত  দুটি উপন্যাস  'দ্য রিমেইনস অব দ্য ডে' ও 'নেভার লেট মি গো' অবলম্বনে বিখ্যাত দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।   

নোবেল প্রাপ্তির পর তিনি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন যে, “এটি আমার জন্য একটি বিরল সম্মাননার, কারণ যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত লেখকদের  মধ্যে আমি আমার পদচিহ্ন রাখতে পেরেছি, যা ভূয়সী প্রশংসার দাবী রাখে।  পৃথিবীটা এখন খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে আর আমি আশা করি যে এই মুহূর্তে পৃথিবীর জন্য সমস্ত নোবেল পুরস্কারই ইতিবাচক শক্তি হিসেবে ভুমিকা রাখতে পার। আমি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হবো যদি এবছর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমি ইতিবাচক কোন অবদান রাখতে পারি”।  

সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মতামত হচ্ছে, “উপন্যাসিকরা আসলে তাদের আবিষ্কৃত  জগতকে সম্পূর্ণ তাদের আয়ত্তের মধ্যে রেখেছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রায়শই তারা যা করতে চায় তার জন্য তাদেরকে আশ্চর্যজনকভাবে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। কথাসাহিত্য প্রকৃতপক্ষে অতটা সহজসরল কোন ব্যাপার নয় যা আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখি”।      

তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন আরও বেশি বহুবিধ সাংস্কৃতিক এবং অনেক   বেশি বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছি, কিন্তু শরণার্থী  সংকটের ব্যাপাটিকে একেবারেই ভিন্ন মতামত বলে মনে করি। যেভাবে আমি ব্রিটেনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হই তা থেকে সেটা একেবারেই ভিন্ন।" 

কাজুও ইশিগুরো অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন যে, তিনি যখন একটি  শীতের উজ্জ্বল বিকেলে তাঁর কটসউডের কুটিরটিতে বসে থাকেন, তখন তিনি  তাঁর উপন্যাসের একজন মানুষ এবং তাঁর ঘোড়াকে দেখতে চান। অবশেষে তিনি  তাঁর সপ্তম উপন্যাস ‘দ্য বারিড জায়ান্ট’-এর প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর গন্তব্যপথ খুঁজে পেলেন। তিনি মজা করে বলেন যে, “সেই একাকী পথিকই আমার জন্য সবসময় কাজ করে গেছে”।     

১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অ্যা পেইল ভিউ অফ হিলস’ প্রকাশিত হয়। এক মধ্যবয়সী জাপানি নারীর ভিন্ন দেশের মাটিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রামের কাহিনী এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর তিনি তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘এন আর্টিস্ট অফ দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’ লেখেন। এই সময়টিতে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে তিনি তাঁর সমাজসেবী স্ত্রী লরনা ম্যাকডুগালের সাথে পরিচিত হন এবং  পরবর্তীতে প্রেমাসক্ত হয়ে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। নাওমি নামে এ যুগলের একটি কন্যা সন্তান  আছে।

তাঁর সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে লেখা সবচেয়ে স্মরণীয় উপন্যাসগুলির মধ্যে  একটি হচ্ছে, ‘নেভার লেট মি গো’। গল্পটিতে একটি কল্পিত সমসাময়িক  ইংল্যান্ডের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও নেতিবাচক বোর্ডিং-এ বড় হয়ে ওঠা ছাত্রদের মধ্যকার প্রেম, বন্ধুত্ব ও বেদনাময় স্মৃতির জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর অন্য একটি বিখ্যাত উপন্যাসটি হচ্ছে ‘দি রিমেইন্স অফ দ্য ডে’। তিনি এটি ১৯৮৯ সালে লেখেন যা তাঁকে এনে দিয়েছিল বুকার প্রাইজের মতো সম্মাননা। তিনি এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের পটভূমিতে এক ইংরেজ লর্ডের সেবায় নিয়োজিত এই বাটলারের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ‘দ্য আনকন্সল্ড’ এবং ২০০০ সালে তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘হোয়েন উই ওয়ের অরফেন্স’ লেখেন। 

তাঁর সর্বশেষ উপন্যাসটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়, যেটির নাম, ‘দ্য বারিড জায়েন্ট’। এখানে দেখানো হয় যে একটি বয়স্ক দম্পতি তাঁদের হারিয়ে যাওয়া   ছেলেকে খুঁজতে একজন নাইটের কাছে আসেন।  উপন্যাসটিতে আমরা দেখি যে একজন তৃতীয় ব্যক্তি সম্পূর্ণ গল্পটি বর্ণনা করছেন। আধুনিক পাঠকদের কাছে তিনি গল্পের সময়কার রাস্তাঘাট এবং ঘরবাড়ির বর্ণনা  দেন। উপন্যাসটির পটভূমি রাজা আরথার যুগের সময়কার ব্রিটেন। এখানে আরথারিয়ান ব্রিটেনের পরপরই স্যাক্সনেসদের ব্রিটন্স-এর বর্ণনা করা হয়। শুরু থেকে এখানে অগারস  নামক ফ্যান্টাসি চরিত্রদের দেখান হয়। স্যাক্সনদের গ্রামে থাকা অবস্থায় ভ্রমণের প্রথম রাতেই দম্পত্তিটি দুটি অগারস বন্ধু দ্বারা আক্রমণিত হয় এবং এডউইন  নামের ছেলেটি অপহৃত হয়। পূর্ব ফিনল্যান্ডের স্যাক্সন যোদ্ধা ইউস্ট্যান এডউইনকে উদ্ধার করে আক্রমণকারীদের মেরে ফেলেন। যদিও অগারসদের দ্বারা এডউইন ক্ষত হয়। এখানে ইশিগুরো সায়েন্স ফিকশন, জাদুবাস্তবতা আর ফ্যান্টাসির একটি পরাবাস্তব জগত তৈরি করে পাঠকদের অভিভূত করতে সমর্থন হন। 

ইশিগুরো গীটার বাজিয়ে গান গাওয়া ছাড়াও অনেক ছোটগল্প এবং গান রচনা করেন। সেইসাথে তিনি লিখেছেন নানা চিত্রনাট্যও।

ইশিগুরোর উপন্যাসগুলি প্রায়শই কোন নির্দিষ্ট সমাধান ছাড়াই শেষ হয়। তার উপন্যাসের চরিত্রদের সমস্যাগুলো অতীতে সমাধিস্থ হয় এবং অমীমাংসিত রয়ে যায়। এভাবেই ইশিগুরো তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসগুলোকেই মর্মস্পর্শীভাবে শেষ করেন। তাঁর গল্পের এই উপলব্ধিটি সান্ত্বনা এবং মানসিক যন্ত্রণার মাধ্যমে শেষ হয়।   

সাধারণত মনে করা হয় যে তাঁর লেখায় জাপানি সাহিত্যের প্রভাব আছে, যেখানে সান্ত্বনা এবং মানসিক যন্ত্রণা যুগপৎ বৈশিষ্টের মাধ্যমে লেখাটি এগিয়ে  যায়। ইশিগুরো মনে করেন তিনি তাঁর লেখার ব্যাপারে ফ্রয়েড, দস্তোয়েভস্কি এবং  মার্সেল প্রুস্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। 



যদিও সারা বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমিদের কাছে কাজুও ইশিগুরো একটি সমূহ বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তথাপি একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে,  একজন যোগ্য কথাসাহিত্যিকই আসলে নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন।

 

 

 

 

 

 


পৃথা কুণ্ডু

 

অর্বাচীনের রবিযাপন  

   


      

(পর্ব ২) 


দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি দিব্যি তো লিখে বসে আছেন আচ্ছা, কে আপনাকে বলল বলুন তো, খাঁচাটা সবসময় সোনারই হবে? অবশ্য খাঁচা তো খাঁচাই, সে সোনার হোক বা লোহার আপনার তোতাকাহিনির বেচারা পাখি তো সোনার খাঁচার মধ্যেই মরল। তার চেয়ে বোধহয় অর্বাচীনের কপাল ভাল, সোনার ঝলকানি চোখে লাগে নি বলেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর জন্য তার অমন উথলে ওঠা মায়া জাগে না মরীচিকার মত।

আসলে দিনগুলো বোধহয় হারিয়ে যায়নি, লোহার খাঁচার এককোণে পড়েই আছে। আপনিই হারাতে দেন নি, ইচ্ছে করে। আর একটু কড়া করে বলি, ষড়যন্ত্র করে। আর আপনার ষড়যন্ত্রের সঙ্গীর কথা না বলাই ভাল বেশি। লোকে আবার পাঁচ কথা বলবে।

খুব হাসি পাচ্ছে, না? ছবির আড়ালে মুখ টিপে হাসছেন আর ভাবছেন, ওরে অর্বাচীন, লোকে আর পাঁচ কথা বলেনি কবে, যে আজ সেই নিয়ে ভাবতে বসলি! পারলে আর এক বার শুনে নে, “কাটল বেলা হাটের দিনে/ লোকের কথার বোঝা কিনে...”  

থাক, এ গানটা শোনার কথা বলবেন না এখন। সব ভুল হয়ে যাবে, অর্বাচীনের না-বলা সব কথা ভাসিয়ে দিতে খুব মজা লাগে বুঝি? এমনিতেই তো অর্বাচীনের কথা বলা চলে না, ভাবা চলে না, ভুল করে কিছু একটা ভেবে, বলে ফেললে শুনতে হয়, ও ভাবনা অন্য কারো থেকে চুরি!  তার খাতায় বড় বড় করে লিখে দেওয়া হয়, “হুবহু বই থেকে টুকে দেবে না। মৌলিক রচনা জমা দেবে।” কিন্তু ওই কথাগুলো তো বইয়ের পাতায় ছিল না কোনদিনই! মনের মধ্যে একটু একটু করে ফুটে ওঠা একটা ছবি যদি কথা হয়ে বেরোয়, তাহলে কি সেটাকে চুরি বলে? হয়ত বলে। ভাবচুরি। সে কথা তো আপনিই বলে গেছেন, “নিন্দুকেরা জানতে পারে নি, অনেক পরে ভাবচুরিতে হাত পাকিয়েছি।”

কেউ যদি বলেন, ছবিটা এল কোত্থেকে? তারও তো একটা ‘সোর্স’ আছে, সেটাকে ‘সাইট’ করতে হয়, এটা ‘স্কলার’-এর দায়, এটা রিসার্চ এথিক্স অত ভারি ভারি কথা মাথার ওপর দিয়ে যায়, আর অর্বাচীন কেন ‘স্কলার’ হবে বলুন তো? হতে পারবেও না, চাইবেও না। দায় যদি থাকে, সেও আপনার গানের। আরও বিশেষ করে বলতে গেলে, আপনার ‘গানের গান’-এর।

‘গানের গান’- শব্দদুটো নিয়ে যে এত চর্চা হয়েছে, সেসব তো অর্বাচীন জেনেছে অনেক পরে। কিন্তু গানগুলো যখন তার কাছে আসে, তখন তো তার মধ্যে শব্দ, সুর আর ধ্বনি ছাড়া আর অন্য কিছু ছিল না। প্রথম যেদিন এসেছিল... অর্বাচীন তখন নেহাতই ছোট,  আপনার সঙ্গে ‘জানাশোনা’ অবশ্য তারও আগে। মানে আপনি কবে জন্মেছেন, কি কি লিখেছেন, আপনার সামনে ২৫শে বৈশাখ একটু নাচ-গান করতে হয়, এইসব জানা আর কি। অবশ্য এটাকে যদি জানা বলা যায়, তবেই।

সেবছর ‘কপিরাইট’ ওঠা নিয়ে অনেক কথাবার্তা চলছিল চারদিকে।  সেসবের মানে বোঝার ক্ষমতা ছিল না। যাই হোক, ইস্কুলে কোন একটা অনুষ্ঠানের জন্য কোরাসে একটা গান তোলার কথা ছিল। একটা ক্যাসেটের সেট দেওয়া হয়েছিল, প্র্যাকটিসের জন্যই হাতে পাওয়া। যেদিন পুরোটা শুনবে বলে চালাল কচি-অর্বাচীন, সেদিন কী কারণে যেন তার খুব মন খারাপ। খুব ভালবাসার কোন বন্ধু, যাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের ঘাড়ে দোষ নেওয়া যায়, সে কষ্ট দিয়েছিল? নাকি সামান্য কারণে বা অকারণে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মত শাস্তি পেয়েছিল, কেউ মিথ্যে বলেছিল তার নামে? নাকি বাড়িতে বড়দের অন্য কোন জটিল সমস্যার আঁচ এসে পড়েছিল তার গায়ে? কে জানে, এতদিন পরে আর মনেও নেই, আর ছোটদের মনের কথা অত মনে রাখতে আছে নাকি! শুধু মনে আছে, খুব কষ্ট হচ্ছিল, তবু চোখের জলে নাকের জলে হয়ে কোনরকমে হোমওয়ার্ক সেরে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ক্যাসেটটা নিয়ে বসা।  বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া  গানের সংকলন। প্রথম গানটা কী ছিল তাও মনে নেই। দ্বিতীয় গান, ‘ধ্বনিল আহবান মধুর গম্ভীর...’ একটা বদ্ধ ঘর, রোজকার যত মলিনতা দেওয়াল জুড়ে... তুচ্ছাতিতুচ্ছ একটা অস্তিত্বের মাঝে এমন করে এ কার ডাক ভেসে এল! ক্লান্ত, ধুঁকতে থাকা সন্ধ্যেটা এক মুহূর্তে উবে গিয়ে এক সকাল আলো, খোলা মাঠ, বিশাল আকাশ- “দিকে দিগন্তরে ভুবনমন্দিরে শান্তিসঙ্গীত বাজে... ধ্বনিল রে-এ-এ ধ্বনিল রে-এ-এ”

একটা স্বর থেকে আর একটা স্বরের মধ্যে ফাঁক নেই। ধ্বনির অনুরণনসঙ্গীত’ শব্দটাকে এক পর্দায়, অচঞ্চল সুরে আর ধ্বনিতে ভর করে শোনা। ‘মধুর’ আর ‘গম্ভীর’ শব্দদুটো ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে’ ঢুকে গেঁথে যাওয়া। এই গেঁথে যাওয়ায় রক্ত ঝরা নেই, ক্ষতে প্রলেপ পড়ার অনুভূতি আছে। সেই প্রথম। গানের গান শোনা, শোনার মত করে— যদিও গীতবিতান বলে, এ গানের উপ-পর্যায় ‘উৎসব’।  হলই বা, গানেরও যে গান হতে পারে, ধ্বনির গান, স্বরের... তার আগে কে আর বুঝিয়েছিল! আবছা আবছা বোঝা, অনেকটাই না বোঝা, কিন্তু ভেসে যাওয়া। কলুষ-কল্মষ বিরোধ বিদ্বেষ যত কিছু... একটা একটা শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নির্মল, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।

তারপর সময়ে অসময়ে অনেক গান শোনা।  কিন্তু বিশেষ করে ‘গানের গান’ গুলো খুঁজে বেড়াবার সেই গোপন অভিযান। ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে।’ এ গান গীতবিতান খুলে এমনি পড়ে গেলে মনে হয়, শুধুই আনন্দের, মিলনের গান- আর তেমন কোন ‘আইডিয়া’র ভার নেই এতে। আপনি কিন্তু বলেই দিয়েছেন এক চিঠিতে— “কিন্তু এগুলো গান সে কথা মনে রেখো-- সুর না থাকলে এ যেন নেবানো প্রদীপের মত...” এত কৈফিয়ত দেবার কী দায় পড়েছিল, শুনি? গানটা তো বেঁধেছেন শুরুর দিকে বেশ খোলামেলা সুরের চলনেসা দিয়ে শুরু করে মধ্যসপ্তকের মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত হয়ে কোমল নি পর্যন্ত বিস্তার ফুরফুরে একটা ভাব, সুরের বাঁধন তো আটকে রাখার নয়, মুক্তি দেবার—তাই ‘বাঁধনে’ বলেও চড়ায় গলা ছেড়ে দেওয়া- তার সপ্তকের সা-তে বকুলগন্ধ, কবির ছন্দ... বাঃ, কীসব মিষ্টি মিষ্টি কথা। মনে হবে জগতে যেন কোথাও কোন সমস্যা দুঃখ কিছু নেই, থাকলেও আপনি তার ধার ধারেন না।

এদিকে আপনি তো মোচড়টা আসার অপেক্ষায়, ‘দাঁড়া, এইবার কি করি দ্যাখ!’ ‘রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে’র পর আবার ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি’ যখন এল, সুরটা কেমন বদলে গেল, ‘সঙ্গে’ আর ‘বেঁধেছি’তে যেন ধাক্কা লাগল একটা, তারসপ্তকের রে আর কোমল গা লাগিয়ে। বাঁধতে চাইলেই কি আর বাঁধা যায় এত সহজে? আমি যে তোমায় বাঁধতে চাইছি, তুমিই তো জানো না। বুকের কাছে টান পড়ল একটা, অসহ্য সুখের বেদনা নিজেকে জানান দিয়ে হারিয়ে গেল সোনার আভায় কেঁপে কেঁপে ওঠা গানের তানের উন্মাদনায়, অথচ তুমি জানলে না। এই কাঁপন, এই উন্মাদনা কি আমি একা বইতে পারি? গানটা শেষ হল এক অসম্পূর্ণতায়, আমি ভাবলাম বেঁধে ফেলেছি, অথচ তোমার দিক থেকে কি কোন স্বীকৃতি এল সে বাঁধন স্বীকারের? 

এই অসম্পূর্ণতা থেকেই আবার চলা। ‘আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে।’ এও বিরহের গান, কিন্তু ‘গানের গান’ হয়ে উঠতে বাধা কোথায়? (আ)স্থায়ী আর অন্তরা জুড়ে বেজে চলা একটা অস্থির, প্রায়-মরিয়া হয়ে ওঠা ব্যথার আর্তি যেন আশ্বাস পায় সঞ্চারীতে,  ‘আমার ব্যথা যখন বাজায় আমায় বাজি সুরে’- মন্দ্র থেকে মধ্য সপ্তকে ওঠে এক বিশ্বাসের জোরে, ‘সেই গানের টানে পারো না আর রইতে দূরে।’  আভোগের সুর অন্তরার মতই, কিন্তু বদলে যায় অভিব্যক্তি, ঝড়ের রাতে পাখির মত দিশেহারা ছটফটানি এসে যখন লুটিয়ে পড়ে গান হয়ে, তখন তো অন্ধকারে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই হবে তোমায়। সমর্পণের চেয়ে বড় জিতে যাওয়া আর কিছু আছে কি? 

এমন করে জিতে যাওয়ার কল্যাণেই তো মুখোমুখি হওয়া।  তুমি আর আমি। কখনও তুমি বলবে আমায়, ‘তোমায় গান শোনাবো তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো’, আবার কখনও বলবে, ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান।’ অনেকে ভাবতেই পারেন, এ-গানের ‘আমি’ মানে ‘আমি’ই।  হতেই পারে। যিনি যা ভাবেন, তাঁর কাছে তা-ই সত্যি হয়ে থাক— সে জায়গা তো চিরকালের জন্য খুলেই রেখেছে ‘গানের গান’। অর্বাচীনের কিন্তু মনে হয়, এ গানের ‘আমি’ আসলে ‘তুমি’—যে ‘তুমি’ কোনদিনই কিছু চাওনি আমার কাছে। কেবল দিয়েছ, শুনিয়েছ । আর চাওনি বলেই, অবাক হয়ে কেবল শুনতে শুনতে আমারও সাধ জাগে, ‘মনে করি অমনি সুরে গাই/ কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই।’ এ গান একেবারেই যেন ‘আমার’ হয়ে ওঠে ‘কইতে কি চাই কইতে কথা বাধে’তে এসে। কথায় বুঝি, হার মেনে পরাণ কাঁদার কথা। কিন্তু সুরে? এমন তরঙ্গের মত উচ্ছ্বাস, ফাঁদে পড়ার খুশি, চারপাশে সুরের জাল বুনে তাতে নিজেকে ছড়িয়ে দেবার সুখ! যে হার মেনে এত আনন্দ, সে হার হাজারবার, লাখোবার মানব! বাউলাঙ্গের মাতন-টানে ‘আমার বেলা যে যায়’ গানেও সেই একই কথা, ‘তোমার কাছে বারে বারে/হার মেনেছি এই খেলাতে... বিশ্বহৃদয় পারাবারে রাগ রাগিণীর জাল ফেলাতে।’                                          

একেবারে অন্য মেজাজের আর একটা গান, ‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’। গীতবিতানের উপ-পর্যায় বিভাগ মানলে এ গান ‘বিরহ’-উপ পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু ভাবের দিক দিয়ে এও কি ‘গানের গান’ নয়?    প্রথম যখন শোনা, কিছু না বুঝেও কেমন করে যেন মনে হওয়া, পুরো গানটাই দাঁড়িয়ে আছে ‘কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে’- এই কথাগুলোর ওপর। আরও অনেক পরে মনে হওয়া, শুধু গানটা কেন, জীবনের এক মানেও কি দাঁড়িয়ে নেই? পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যে চির বিরহ, তার মাঝে সুরে সুরে সেতু বাঁধার চেষ্টা অবিরাম... কিন্তু কতই আর সম্ভব? একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই বেসুরো সবকিছু। তাই বুঝি ‘কত আর’ থেকে ‘সেতু বাঁধি’তে যেতে অমন দীর্ঘশ্বাসের ভাব ফুটে উঠেও মিলিয়ে যায় গলায়?

আবার,  দীর্ঘশ্বাসেই তো শেষ নয়।  শেষ হয় ‘সুরে সুরে তালে তালে’ ফিরে। ‘তালে তালে’ এমনভাবে বলা, যেন মনে হয়, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’। গানের গান তো এমনই হয়। আবর্তনেও বুঝি শেষ নেই, সা-তে শুরু হয়ে পা-তে থেমে যাওয়ার ভান। ‘তালে তালে’ সুর বেঁধে রাখার চেষ্টা ওই পঞ্চমেই-- যতদিন শ্বাস থাকে।                        

 আর যখন শ্বাস ফুরিয়ে যায়, যখন শুকিয়ে যায় জীবন, হারিয়ে যায় সামান্য অবলম্বনটুকুও, মনে হয় এই ‘একমাত্র’কে হারিয়ে কেমন করে বেঁচে থাকব, ক্ষোভে অভিমানে যন্ত্রণায় মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে হয় জীবন থেকে, তখনও তো জীবনে ফেরায় এমনই এক ‘গানের গান’। ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে/ বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে।’  যে ‘আমি’ এত তুচ্ছ, অর্বাচীন— তাকেও কেমন অনন্তের সাথে হাত ধরাধরির সীমানায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয় এ গান। এইটুকু হৃদয়ে জায়গা নেয় বিজন আকাশ, সে আকাশ বিজন কেন? এমন অনেক ছোট ছোট ‘আমি’ তাদের সব দুঃখ, শোক, হারানোর ব্যথা নিয়ে মিশে আছে সে আকাশে, তাই বুঝি আলাদা করে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না? ‘নেই’কে আর ‘নেই’ বলে মনে হয় না, ‘ভুবন মিলে যায় সুরের রণনে/গানের বেদনায় যাই যে হারায়ে।’

আজ বলতে বাধা নেই, এত যে প্রলাপ বকে চলেছে অর্বাচীন, সেসব কোথায় থাকত, যদি এমনই এক ডিসেম্বরের রাতে এ গান না শোনাতে!

আচ্ছা, কার সঙ্গে কথা হল এতক্ষণ? যিনি গান বেঁধেছেন, তাঁর সাথে, যিনি গান শোনালেন তাঁর সাথে, নাকি... যাকগে, অত আর ভেবে কাজ নেই। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এল যে কখন, তাও তো খেয়াল নেই! ও ঠিক আছে, অর্বাচীনের সাত খুন মাপ।