কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / অষ্টম সংখ্যা / ১৩৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / অষ্টম সংখ্যা / ১৩৫

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


 

কালিমাটি অনলাইন / ১৩৫ / ত্রয়োদশ বর্ষ : অষ্টম সংখ্যা

 


ভাবনাটা মাঝেমধ্যেই মাথায় আসে, এই যে সারা বিশ্বে এত অসংখ্য ভাষা প্রচলিত আছে, কিছু হয়তো কথ্যভাষা, বাকি ভাষার নিজস্ব লিপি আছে, যে ভাষার নেই সে ভাষা অন্য কোনো লিপির ওপর নির্ভরশীল, সেইসব ভাষাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে চলেছে। ভেবে অবাক হই, এই বিপুল সৃষ্ট সাহিত্য কারা পড়ে, পড়ে কতটা সমৃদ্ধ হয়, কতটুকু মনে রাখে, এবং তা কোথায় সংরক্ষিত হয়? লিপি আবিষ্কারের অব্যবহিত পরে সেই সেই ভাষার সাহিত্য লিখিত হতো বিভিন্ন গাছের বাকলে, তালপত্রে, ভুর্জপত্রে। কাগজ আবিষ্কৃত হবার পরে কাগজে। জানা যায়, সেই যুগে সংরক্ষণের কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা ছিল না। কিছু পুঁথি সংরক্ষিত হতো প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে, রাজ দরবারে, বিভিন্ন মঠ এবং উপাসনালয়ে, বাকিটা পুঁথিকারের ব্যক্তিগত সংগ্রহে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই অবহিত আছেন, এইসব সংরক্ষণ পুঁথিগুলির স্থায়িত্ব কতটা দীর্ঘায়িত করতে পারত। তবে এখনও যে বিপুল পরিমাণে প্রাচীন পুঁথি উল্লেখিত স্থানে আছে, তা অস্বীকার করা যায় না। সেইসঙ্গে এটাও উল্লেখ করতে হয়, প্রযুক্তির উন্নতির কল্যাণে যখন কাগজ এবং মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, তখন জ্ঞানের ভান্ডার ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। আর আজকে আমরা যে নতুনতর যুগে প্রবেশ করেছি, সাইবার যুগ, তাতে সারা বিশ্ব ব্রম্ভান্ড এসে গেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। কেউ আগ্রহী হলে সে জ্ঞানভান্ডারের উত্তুঙ্গ শিখরে পৌঁছে যেতে পারে।

তবে আমার ভাবনাটা ঠিক এই পর্যায়ে নয়, বরং আমি ভাবি, সারা বিশ্ব জুড়ে যে অসংখ্য বিদ্বান, ভাবুক, চিন্তক, শাস্ত্রপ্রণেতা, কবি, দার্শনিক, রাজনীতিক, সমাজবিদরা তাঁদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তা আমাদের সাধারণ জনসাধারণের কাছে কতটুকু এসে পৌঁছেছে, যেটুকু এসেছে তার কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, মানুষের জীবন ও যাপনে তার প্রভাব কতটা এসে পড়েছে? যদি সেইসব প্রভাব যথাযথভাবে এসে পড়ত, তাহলে আজকের সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপ অন্য হতো, প্রকৃত মানবিকতার আলোকে আলোকিত হত। বিশ্বের কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা সমাজের কথা এখানে বলছি না, বরং বিশ্বের সব দেশে এবং সমাজে আজকের এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অচিন্ত্যপূর্ব জয়যাত্রার যুগে মানুষের মধ্যে, তাদের স্বভাবে ও আচরণে, তাদের রাজনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক জাতি তথা ধর্মীয় ভাবনায় যে অমানবিকতা নিরন্তর প্রকট হয়ে উঠছে, লোভ হিংসা দ্বেষ যেভাবে একে অপরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছে, পাশবিক প্রবৃত্তি কী পরিমাণে উৎকট হয়ে উঠেছে, তা কোনো সভ্য দেশ বা সমাজের পরিচায়ক  নয়। আর সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, আমরা সবাই বসবাস করছি, বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছি সেইসব অসভ্য দেশে অসভ্য সমাজে, যা আমাদের কখনই কাম্য হতে পারে না। আরও কষ্ট লাগে, সারা বিশ্বব্যাপী জ্ঞান, সততা ও মানবিকতার বিপুল চর্চা হলেও আমরা তা আত্মস্থ করতে পারিনি, জীবিন ও যাপনে প্রয়োগ করতে পারনি। তথাকথিত সভ্যতার বহিরঙ্গের আড়ম্বরে নিজেদের নিমগ্ন করেছি শুধু, সভ্যতার অন্তরঙ্গ আলোকে স্পর্শ করতে পারিনি।

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

রোমেনা আফরোজ

 

বাঙালি নারীর সাংস্কৃতিক জন্ম

 


মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৮০ শতাংশ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আবহমানকাল ধরে  বাঙালি নারী এই ধরনের  অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেও সংসার টিকিয়ে  রাখছে, এই দায়টা মূলত কার? কেন একজন নারী অসম্মানজনক জীবনকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। এটা কি শুধুই সাংস্কৃতিক আধিপত্য, নাকি আর্থিক অক্ষমতা বা তৃতীয় কোনো শক্তি কাজ করছে এর পেছনে?

বর্তমান সময়ে গণতন্ত্র বহুল চর্চিত বিষয় হলেও তা যেন রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারে বিষয়টিকে শুধুমাত্র নির্বাচনের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলেছি। আমাদের বুঝতে হবে, পরিবারে গণতন্ত্র না থাকলে রাষ্ট্রে কখনোই গণতন্ত্রের যথাযথ বিকাশ সম্ভব নয়। কারণ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র  নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই পারিবারিকভাবে নারীর প্রতি জুলুমের সংস্কৃতি অব্যাহত রাখলে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রাষ্ট্রের দিক থেকেও  সংগঠিত হবে। পরিবারের কাছে নারী যেমন দুর্বল সত্তা, তেমনি রাষ্ট্রের কাছেও সাধারণ মানুষ। তাই দুর্বলতার সুযোগে এক পক্ষ সুবিধা নিলে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রও দুর্বলের ঘাড়ে চেপে বসার সুযোগ পেয়ে যাবে। তাই রাষ্ট্রের কাছ থেকে গণতন্ত্র প্রত্যাশার পূর্বে অবশ্যই পরিবারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র হবে অসম্পূর্ণ এক অধ্যায়।

বাঙালি সমাজে শিশুকাল থেকে বিভেদ এবং বিভাজনের পাঠ শেখানো হয়। এই প্রয়াসেই যেন একটা ছেলে শিশুর হাতে তুলে দেয়া হয় খেলনা বন্দুক, মেয়েরা খেলা করে পুতুল নিয়ে। যদি বন্দুক হয় যুদ্ধের প্রতীক, তবে পুতুল সংসারের। জন্মলগ্ন থেকে ছেলেশিশুকে তার লিঙ্গের জন্য পূজা করা হয়। তারা তুলনামূলকভাবে পড়াশোনা করে বেশি। তারা যখন তখন চৌকাঠ ডিঙাতে পারে। গুরুত্ব দেওয়া হয় তাদের সিদ্ধান্তকে। এই সাংস্কৃতিক জন্ম এবং সুযোগ-সুবিধা বস্তুত পুরুষদের মধ্যে একটা কর্তৃত্বপরায়ণ ভাবের জন্ম দেয়। ওদিকে মাসিক হওয়ার জন্য নারীদের ভাবা হয় পাপী, অচ্ছুৎ এবং নিম্নবর্গের আধা মানুষ। এই মানসিকতার দরুণ তাদের দুর্বল এবং দাস শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত করে গৃহস্থালির মত সহজ কাজকর্মে  নিযুক্ত রাখা হয়। এ ধরনের বৈষম্য দেখতে দেখতে একটা মেয়েশিশু বড় হয়। তার অবচেতন মনে অধস্তন বিষয়টি গভীরভাবে প্রবেশ করে। নিজের অজান্তে সামাজিক অনাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠে মানসিকভাবে।

আমাদের সমাজে একজন মেয়ের পথ চলার জন্য বাবা নামক পুরুষের প্রয়োজন হয়। তারপর দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে ভাই এবং স্বামীর। নারী এতটাই অক্ষম এবং পরাধীন যে, তার গর্ভে জন্ম নেওয়া ছেলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। নারীর মনে যে-সাংস্কৃতিক দীনতা জায়গা দখল করে নেয়, তা দীর্ঘদিনের  পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব। এই দীনতা, যেটা আবার ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স (Inferiority Complex),  তা নারীর চিন্তার পরিসরকে সীমিত করে রাখে। নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া নারীর স্নায়ুতে নতুন কেমিকেল তৈরি হতে পারে না। তাই নতুন ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে নারীরা যে-পিছিয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি সমাজে এখনো বৈবাহিক সম্পর্ক নির্ধারণের  ক্ষেত্রে  প্রধান  ভূমিকা  রাখে পুরুষ সমাজ। শহরের চিত্র কিছুটা ভিন্ন হলেও  টাকা-পয়সা, আসবাব-পত্রের মত নারীকেও পুরুষের সম্পত্তি ভাবা হয়। যৌনতার ক্ষেত্রেও নারীকে কখনো ছাড় দেওয়া হয়নি। আমাদের বাঙালি সমাজে মনে করা হয়, পুরুষ শক্তিশালী তাই সে অধিকার করে, উপরে উঠে ভোগ করে দুর্বলকে।

অনেক সময় সম্পর্ক সহিংসতার পথে গেলেও নারীকে মেনে নিতে হয়। আসলে পরিবারিক সমর্থন না থাকলে একা একা সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন। তাই শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সত্ত্বেও অনেক নারী ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। একজন পুরুষ যখন নারীর অসহায়ত্বের এই  দিকটি অনুধাবন করতে পারেন তখন বেড়ে যায় অত্যাচার। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া নারীর সংখ্যাও কম নয়।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘প্রিভেনটিং সুইসাইড: আ গ্লোবাল ইমপারেটিভ শীর্ষক’  প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে  পুরুষ আত্মহত্যার হার বেশি থাকলেও বাংলাদেশে নারীর আত্মহত্যার হার বেশি। (প্রথম আলো)

সাধারণত মনে করা হয়, বিবাহিত জীবনে নির্যাতন সহ্য করার মূল কারণ হলো আর্থিক অসংগতি। আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেই যে প্রেক্ষাপট পাল্টে যেত তা জোর দিয়ে বলা যায় না।  কারণ আর্থিক  সচ্ছলতা  থাকার পরেও অনেক নারী নির্যাতন মেনে নেন। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮৭ লাখ।  একজন কর্মজীবী নারীকে একই সাথে সংসার এবং চাকরি দুটোই সামলাতে হয়। আদতে শ্রেষ্ঠত্বের জটিলতা (সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স)  থেকে বাঙালি পুরুষ গৃহস্থালি কাজকর্ম থেকে দূরে থাকেন। এই বৈষম্য মেনে নিয়েও বেশিরভাগ নারীরা সংসার করছেন। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মীদের প্রায় ৫৪% নারী অর্থাৎ ৪০ লাখের মধ্যে ২২ লাখ নারী কর্মী আছে।

এটা শুধু চাকরি ক্ষেত্রের হিসাব। শহরের প্রান্তিক নারীরা বাসাবাড়িতে কাজ করে থাকেন। নিম্নবর্গের পুরুষের মধ্যে বহুবিবাহ, দায়িত্বহীনতা, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের  প্রবৃত্তি থাকলেও নারীরা বিষয়টা মেনে নেন। তাই এক বাক্যে আর্থিক অসংগতিকে নির্যাতন সহ্য করার মূল কারণ হিসেবে ধরা যায় না। মূলত ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় মানসিক শক্তির। একবার নিজ শক্তিকে অনুভব  করতে পারলে পারিবারিক অসমর্থন কিংবা আর্থিক অসংগতি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু শিশুকাল থেকে নারীর মধ্যকার এই শক্তিটাকে ধীরেধীরে ধ্বংস করে ফেলা হয়।

তবে কি বিষাক্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য যৌনতা একটা কারণ হতে পারে? যেহেতু বাঙালি সমাজে নারীর বহুবিবাহের বিষয়টা দৃষ্টিকটু, তাই এটা একটা কারণ। তবে দু’একজনের ক্ষেত্রে এমনটা প্রযোজ্য হলেও মূলত নারীরা জৈবিক চাহিদাকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ভাবেন না। কারণ তাদের কাছে সবসময় যৌনতাকে একটা গোপন বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাই যৌনতা নিয়ে ভাবার মানসিকতা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকে।

তবে যৌনতার মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে একটা মজবুত সম্পর্ক গড়ে উঠে। ভারতীয় যোগী সাদ গুরু বলেছেন, যৌনতার  মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে রুনানুবন্ধাহ (Runanubandha) গড়ে উঠে।  প্রথম যখন দুজনের মধ্যে  যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয় তখন নারী শরীর শুক্রাণুকে মনে করে ফরেন বডি বা জীবাণু। তাই এসিড নিক্ষেপ করে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার দৈহিক সম্পর্কের সময় শুক্রাণুকে চিনে রাখে। রুনানুবান্ধার মাধ্যমে  নারী-পুরুষের মধ্যে অসংখ্য তথ্য আদান-প্রদান হয়। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে জন্ম নেয় মায়া। এই ধরনের অনুভূতি দুর্বল মানুষের ক্ষেত্রে খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। তাই নারীর ক্ষেত্রে সম্পর্ক থেকে বের হওয়া কিছুটা কঠিন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, বাঙালি নারীরা যদি রুনানুবান্ধার বেড়াজালে আটকা পড়ে থাকেন, তাহলে পাশ্চাত্যের নারীরা কীভাবে বন্ধনটা এড়িয়ে যান? এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, পুঁজিবাদের জন্মভূমি হলো পাশ্চাত্য। এর হাত ধরে এসেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ।  এই রাজনৈতিক দর্শন নারীকে সাংস্কৃতিক মুক্তি দিয়েছে। এখানে মুক্তি শব্দটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সামগ্রিক অর্থে এর নেতিবাচক প্রভাব আছে, যা নিয়ে পরে কোথাও আলোচনা করা হবে। আবার পাশ্চাত্যের নারীরা আর্থিকভাবে সক্ষম এবং  পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও তাদেরকে সর্বোচ্চ সমর্থন দেয়। তাই বহুপূর্বেই রুনানুবান্ধার মতো সম্পর্ক পুঁজিবাদী মনস্তত্ত্ব এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সেই পরিবর্তন দীর্ঘসময় চর্চা করতে করতে প্রবেশ করেছে রক্তের মধ্যে। সমাজের বেশিরভাব ব্যক্তি যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, ভোগবাদ যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে তখন তাদের কাছে রুনানুবান্ধার মত বিষয়গুলো একেবারে ঠুনকো হয়ে উঠেছে। তাদের কাছে ব্যক্তি মানে ঈশ্বর। ঈশ্বর মানে ব্যক্তি। কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক জন্মের ইতিহাস সহ্য করার, মেনে নেওয়ার। বাঙালি সমাজে একজন মেয়ে পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচার দেখতে দেখতে বড় হয়। বড় হতে হতে বৃত্তের বাইরে কল্পনা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে।

মূলত  সাংস্কৃতিক জন্ম, আর্থিক অসংগতি, পারিবারিক পিছুটান এবং অশিক্ষা বাঙালি নারীর সহ্য করার মূল কারণ। পুঁজিবাদের হাত ধরে একসময় বাংলাদেশেও পাশ্চাত্যের  মত পরিবর্তন আসবে। সম্প্রতিককালের ডিভোর্সের হার বৃদ্ধি সেই পরিবর্তনের দিকে ঈঙ্গিতও দেয়। তবে হাওয়া-বদল থেকে সামগ্রিক অর্থে কল্যাণ পেতে হলে অবশ্যই পুঁজিবাদকে জানতে হবে। অন্যথায় পুঁজিবাদী আগ্রাসনে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

 

 

 

 


শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

'শঙ্খচিল': শিকড়হীন মানুষের অস্তিত্বের সন্ধান

 


"নিজেদেরই দেশে থাকি না, পালাই দূরে

কে আর শূন্য ভাঁড়ার দু-হাতে খুঁড়ে

দেখবে রয়েছে স্মৃতি জুড়ে মৌমাছি!

সাহস গিয়েছে, সব কিছু গেছে দূরে

কে রাখবে বলো চিরকাল বুকে জুড়ে-

দুই বাংলাই রইলো না কাছাকাছি!"

"ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসে ও বাঙালির জাতীয় জীবনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বড় বিপর্যয়ের ঘটনা দেশভাগ”। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট, শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক কারণে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হয় ভারতবর্ষ। জন্ম নেয় দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র-ভারত ও পাকিস্তান। এই পচা-গলা কলুষিত স্বাধীনতাস্বরূপ দুই দেশ পেল লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষকে। মানচিত্রের একটা রেখার টানে সমগ্র জাতির ভাগ্য আমূল বদলে যায়।

বছরের পর বছর নিরাশ্রয় জীবনকে সঙ্গী করে স্রোতের শ্যাওলার মত বাস্তুচ্যুত মানুষজন ভিড় জমাল প্ল্যাটফর্ম কিংবা উদ্বাস্তু কলোনিতে। "পৃথিবীর ইতিহাসে এমনতর বিভাজন প্রক্রিয়া আগে ঘটেনি। এই একটিমাত্র ঘটনা পাল্টে দিল ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ-সংস্কৃতি, চিরায়ত পরম্পরা, আর্থ-সামাজিক জীবন, সাংস্কৃতিক বোধ-বিশ্বাস। মানুষের বর্হিজীবনে ও অর্ন্তজীবনে তৈরি হল এক গভীর সংকট। এক গভীর শূন্যতা। স্বভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার যন্ত্রণা, সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার বেদনাবোধ, নতুন ঘরবাড়ি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে শিকড়ের সন্ধানে গৃহচ্যুত মানুষের মরিয়া অভিযান”- এই সব মিলিয়ে বিভাগোত্তর বাংলা সাহিত্যে জন্ম নিল দেশভাগ ও উদ্বাস্তু-সমস্যা কেন্দ্রিক এক ভিন্ন ধারার সাহিত্যসম্ভার।

এই পর্বের উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- জ্যোতির্ময়ী দেবীর 'এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা' (১৯৬৬), অতীন বন্দোপাধ্যায়ের 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' (১৯৭১), 'মানুষের ঘরবাড়ি' (১৯৭১), প্রফুল্ল রায়ের নোনা জল মিটে মাটি' (১৯৮৩), 'কেয়াপাতার নৌকা' (২০০৩), 'শতধারা বয়ে যায়' (২০০৮)', শক্তিপদ রাজগুরুর 'মেঘে ডাকা তারা' (১৯৯৫), 'দেশ-কাল-পাত্র (২০০৪), হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' (২০০৮) ইত্যাদি।

সায়ন্তনী পূততুন্ড প্রণীত 'শঙ্খচিল' (ডিসেম্বর, ২০১৬) দেশভাগ বিষয়ক একটি উপন্যাস। ঔপন্যাসিক তাঁর মুন্সীয়ানায় দেশভাগ ও তৎকালীন সমাজ-সমস্যার সঙ্গে বর্তমান সময়ের সূক্ষ সংযোগ স্থাপন করেছেন। স্বাধীনতার পরও উত্তরাধিকার সূত্রে দুই বাংলার মানুষ যেন বহন করে চলেছ বিভাগের সেই গভীর ক্ষত। যার ঘেরাটোপে কখনো মানুষ হারায় তার পরিচয়, কখনো বা প্রিয়জনকে। 'আবার বিভেদের মাঝে মিলন মহান'-এর একটুকরো ছবিও প্রতিফলিত হয়েছে লেখিকার কলমে। ইচ্ছামতীর তীরে দূর্গাপুজোর ভাসান কিংবা পানিত্তারের মেলায় বিভেদভুলে দুই বাংলার একসঙ্গে যোগদান-এই ঘটনার স্বপক্ষে যুক্তি দেয়। উল্টোদিকে ফুটে উঠেছে মানবিক মূল্যবোধের এক কঙ্কালসার রূপ। আলোচ্য ক্ষেত্রে 'পাঠ সমালোচনা'র নিরীখে সমগ্র বিষয়টিকে সাংস্কৃতিক সমালোচনা, সমাজ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ইত্যাদি তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সমগ্র বিষয়টি নিম্নোক্ত শিরোনামের অধীনে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম অংশে, দেশভাগ ও সমকালীন প্রেক্ষিত সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।

ঔপন্যাসিকের বয়ানে বিবৃত কাহিনি অনুসারে আমরা জানতে পারি একটি পারিবারিক গল্পের রূপরেখা। নিবিড় ভালবাসায় ঘেরা পরিবার; মুনতাসির চৌধুরী বাদল, লায়লা ও তাদের মেয়ে রূপসা ওরফে চম্পক ঈশ্বরী। সাংসারিক জনজীবনের পরিসরেও দেশভাগের ক্ষত কীরূপ অক্ষয় হয়ে রয়েছে, তার একটি দৃষ্টান্তও মেলে উপন্যাসে। যদিও এই উপন্যাসটির ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রচেষ্টায় একটি ছায়াছবি ‘শঙ্খচিল’ প্রকাশিত হয়।

উপন্যাসের অন্যতম প্রধান মুখ বাদল। আদতে "বাদল আজন্ম শান্ত, মার্জিত স্বভাবের মানুষ। ছাপোষা গৃহস্থ। শান্তিতে ঘেরা একটা নিরিবিলি সংসারমুখী গৃহস্বামী। পেশায় শিক্ষক। জলছবির মতো এই সুন্দর জীবনে আকস্মিকভাবে ঘনিয়ে আসে দুর্যোগের মেঘ। কনজেনিটাল ভালভ ডিফেক্টসে আক্রান্ত রূপসাকে কেন্দ্র করে বাদল ও লায়লা এক অসহায়তার নাগপাশে ক্রমাগত জড়িয়ে পড়তে থাকে। বাদল অসীম সাহসে অসুস্থ রূপসাকে নিয়ে পাড়ি দেয় ভিনদেশ 'ইন্ডিয়ায়', কিন্তু "একইরকম গাছপালা! একইরকম মানুষ! একইরকম প্রকৃতি!"" সত্ত্বেও "পার্থক্য একটাই, এটা অন্যদেশ! এবং তারা অনুপ্রবেশকারী!”

একই জমি, একই নদী-নালা-খাল-বিল, একই রকম মানুষ, তাদের ভাষাও এক!” কিন্তু মাঝখানের একটা লাইন দ্বিখণ্ডিত করে দেয় সবকিছুকে। বাদলের কথায়, “চেষ্টা করছিলাম বাংলাদেশ আর ভারতবর্ষের মাঝখানে এল ও সি'র দাগটা টানার। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না! কেন বলুন তো? স্যার রেডক্লিফ তো পেরেছিলেন। আমি কেন পারছি না! কিছুতেই হচ্ছে না!..."

কাঁটাতারের বেড়া অগ্রাহ্য করে চলে আসা ঘটনা কেড়ে নেয় বাদলের পরিচয় তথা অস্তিত্ব। "মুনতাসীর চৌধুরী বাদল হয়ে যায় বাদল চৌধুরী। স্ত্রী লীলা চৌধুরী ও কন্যা রূপসা চৌধুরী। কান্ট্রি-ইন্ডিয়া, কাস্ট-হিন্দু ব্রাহ্মণ। কিন্তু যে কাঁটাতারকে সে অগ্রাহ্য করেছিল সেই কাঁটাতারের কাঁটার ক্ষত বুকে নিয়েই শেষ হয় বাদলের সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। এই সব কিছু নিয়েই 'শঙ্খচিল' হয়ে উঠেছে এক মর্মস্পর্শী আখ্যান।

দেশভাগ ও সমকালীন প্রেক্ষিত এই কাহিনির কায়ার সঙ্গে সহাবস্থান করছে। ফলত সেই প্রসঙ্গটি বারংবার ফিরে ফিরে এসেছে কথাসূত্রে।

"তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হল। রিকয়েললেস রাইফেল

আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।

তুমি আসবে বলে ছাই হল গ্রামের পর গ্রাম।

তুমি আসবে বলে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার

ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।

তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা

অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।”

আজ থেকে বহু বছর পূর্বে ভারতবর্ষের মানুষ 'দেশভাগ' এবং 'স্বাধীনতা' নামক দুটি বিপরীতার্থক শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়।"এই দুই শব্দবন্ধ হল তৎকালীন মানুষের বেদনা ও আনন্দের গান। একদিকে খুশির উল্লাস, আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নপূরণ, দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান;- অন্যদিকে জন্ম নিল দুঃখের সমুদ্র, রক্তের শতদ্রু। এই দুটি বিষয় কার্যকারণসূত্রে আবদ্ধ।”

একদিকে দুই বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা অন্যদিকে দেশভাগের মতন আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা প্রচন্ড ভাবে আন্দোলিত করে মানুষের চেতনা, চৈতন্যকে। বদলে দেয় পুরনো জীবনবোধ; "সমগ্র বাঙালি জাতি দুইটি নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ হইয়া গেল। বাঙালি বলিতে আর কেহ রহিল না। রহিল হিন্দু, এবং রহিল মুসলমান।”এই নারকীয় ঘটনা দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মনে তৈরি করল এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। পূর্বে হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায় ছিল পরস্পরের কাছাকাছি। মতান্তর তাদের মধ্যে থাকলেও ছিল না মনান্তর কিংবা তীব্র বিদ্বেষ।

'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' সত্ত্বেও 'বিভেদের মাঝে' মিলনই ছিল অখন্ড ভারতবাসীর জীবন সাধনা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিল যে যুগের মানুষ। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সেই বন্ধনে ধরাল ফাটল। অচিরেই সম্পর্কের মধুরতা ঘৃণায় পরিণত হল। একদিকে কংগ্রেসের স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা, অন্যদিকে মুসলিম লীগের 'পাকিস্তান প্রস্তাবে'র দাবিতে ভারতবর্ষ তখন আলোড়িত। এরই মধ্যে ১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট কলকাতায় দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। ধীরে ধীরে সমগ্র দেশের শিরা- উপশিরায় হিংসার স্রোত প্রবাহিত হল। শেষপর্যন্ত ভঙ্গ হল অখন্ড বঙ্গ; গড়ে উঠল স্বতন্ত্র দেশ। যার সর্বগ্রাসী দাবানলের শিখা গ্রাস করল একটি জাতির আত্মপরিচয়, পরিবেশ-প্রকৃতিকে।

প্রসঙ্গত ঔপন্যাসিক মনোজ বসুর 'রক্ত' (১৯৬০) শীর্ষক উপন্যাসে দেখা যায় পরস্পরবিরোধী দুটি সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমান একে অপরের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে, "রক্তের বদলে রক্ত”। এই উপন্যাসে 'রক্ত' ঝরার ইতিবৃত্ত মূল ঘটনা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে, কোনো চরিত্র মুখ্য হয়ে ওঠেনি।

'শঙ্খচিল' উপন্যাসে বাদলের জবানীতে সায়ন্তনী পূততুন্ড সেই ঘটনারই একটি সূক্ষ চিত্রাঙ্কন করেছেন, "আজ হিন্দুরা দেশবিভাগের জন্য মুসলিমদের দায়ী করে, আর মুসলিমরা হিন্দুদের। দু'দলের দাঙ্গায় জহরলাল বা জিন্না বা আজাদের কিছু হয়নি! মরেছি শুধু আমরা! বিহারে হিন্দুরা মুসলিমদের কাটল, পঞ্জাবে মুসলিমরা শুরু করল, আর উত্তরে খালসা শিখরা নেমে পড়ল তরোয়াল হাতে। কলকাতায় আর বাংলাদেশে আমরা নিজেরাই নিজেদের কাটলাম!” বহু মানুষের আত্মবলিদান ও রক্তের বিনিময়ে যে প্রত্যাশিত স্বাধীনতা এসেছিল, কতিপয় স্বার্থান্ধ মানুষের প্রচেষ্টায় তা  পর্যবসিত হয়েছিল নিদারুণ যন্ত্রণা ও বেদনার ইতিবৃত্তে।

স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে দুই বাংলার লক্ষ মানুষ দেউলিয়া হয়ে যায়। বিশেষত পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুরা চরম নির্যাতনের শিকার হয়। স্বাধীনতার অনুষঙ্গ ধরে তাদের জীবনে নেমে এল এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডি।

আলোচ্য উপন্যাসে আব্দুল গণির জবানীতে, "দাঙ্গা ক্রমাগতই ভয়াল রূপ ধারণ করিতেছে। হিন্দু পরিবারেরা পোড়ার দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে ইন্ডিয়ায়।... দুষ্কৃতীরা খোঁজ না পাইয়া উহাদের বাড়ি দখল করিয়া লইয়াছে। গোস্বামীদের পবিত্র তুলসীমঞ্চে প্রস্রাবাদি করিয়া, মঞ্চ ভাঙিয়া, নৃত্য করিয়াছে। ইহার পর পবিত্র রাধাকৃষ্ণের মূর্তি বাহির করিয়া, উহাদিগের পবিত্র পুঁথি, ধর্মগ্রন্থাদি বাহির করিয়া, প্রস্রাব করিয়া আগুন ধরাইয়া দিয়াছে। অতঃপর উহাদের ঘর দখল করিয়া 'শত্তুরের ব্যাসাত' আখ্যা দিয়াছে। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে পরধর্মের এইরূপ লাঞ্ছনা দেখিয়া যত না ভীত হইয়াছি, লজ্জিত হইয়াছি চতুর্গুণ। এবং বুঝিয়াছি দুষ্কৃতকারীদের কোনও ধর্ম নাই। উহারা 'হিংসা' নামক ধর্মের পূজারি। মাঝেমধ্যে ভাবি, এই ধ্বংসের কি শেষ নাই?...

বঙ্গবিভাগের কথা ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। প্রাণভয়ে কাতারে কাতারে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসে ভারতবর্ষে। হৃতসর্বস্ব, দেহ, মনে লাঞ্ছিত, শ্রান্ত মানুষগুলো নিজেদের পরিচয়, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে পাড়ি দিল অনিশ্চিত জীবনের দিকে। পূর্ব বাংলায় তারা ছিল পরবাসী, 'ইন্ডিয়া'য় তাদের পরিচয় হল 'রিফিউজি' তথা উদ্বাস্তু বা ছিন্নমূল। বিজয়কৃষ্ণ চৌধুরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নিজের দেশ, পরিবেশ, পরিচয় হারিয়ে তিনিও সামিল হন উদ্বাস্তু শিবিরে। ব্যাকুল কন্ঠে সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মন্তব্য করেন, "আজন্ম এই দেশে কাটাইয়া দিলাম। এই মাটিতে খেলা করিয়া, এই দেশের ভাষায় কথা বলিয়া, পদ্মার জলে স্নান করিয়া বড় হইয়াছি! পিতৃ-পিতামহের মাটি আর আমার নাই। আর যে দেশটাকে কখনও চক্ষে দেখি নাই, তাই নাকি অধুনা আমার দেশ হইয়াছে! যে দেশ আপন ছিল, তাহা আজ কেন আমার নেই? আর যে মাটিকে বিভুঁই বলিয়া জানিয়াছি  সে দেশ কেমন করিয়া আমার হয় বলতে পারো?”

গল্প বলা মানুষের সভ্যতার সূচনালগ্নকালীন সময়ের অভ্যাস। সভ্যতার সূচনালগ্নে গুহাবাসী মানুষ আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে যে ঘটনাবলি বিবৃত করতে চেয়েছে, তার মধ্যেও ছিল একটি গল্প বা আখ্যান। তারপর সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে তার গল্প বলার ক্রিয়া-কৌশল।

মানুষের গল্প বলার আদিম অভ্যাসই সৃষ্টি করল সাহিত্যের এমন একটি শাখা যা আজ সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও পরিচিত। আমাদের বিষয় রূপ কাঠামোটির হৃদপিণ্ড যদি দেশভাগ হয়, তাহলে অবয়ব হল উপন্যাস।” আসলে হৃদপিণ্ড যেমন তার সচলতার মধ্য দিয়ে সমগ্র দেহকে সচল রাখে, ঠিক তেমনি দেশভাগ ও তার পরবর্তী জনজীবনের ব্যাপক অবনতি বর্তমান সময়ের সাহিত্যধারাকে প্রভাবিত করে চলেছে। ফলত সমালোচক মহলে ‘দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা’ আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয় হিসাবে সমাদৃত।

আসলে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, দেশভাগের বর্ণনা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যকে মূলত দুটি উপকরণে সমৃদ্ধ করেছে। একদিকে যদি বলি নিজের ঘরদোর ছেড়ে আসার গভীর বেদনা কাহিনি, সে ক্ষেত্রে অপরটিকে আমরা বলতে পারি আকস্মিকভাবে নতুন পরিস্থিতিতে এসে দেশচ্যুত উদ্বাস্তু মানুষের বাঁচার জন্য তুমুল এবং আপোষহীন প্রয়াস। দেশভাগ সম্পর্কিত উপন্যাসের বিচার করার সময় উপন্যাসগুলিকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। একধরনের উপন্যাসে দেখি দেশভাগের ফলে জন্মভূমি থেকে বিচ্ছেদের বেদনা। অপরটিতে মূল লক্ষ্য হয়েছে মানুষের বাঁচার সমস্যা ও বর্ণনার ইতিহাস। তৃতীয় আরও এক ধরনের উপন্যাস আমরা লক্ষ্য করি যে, উপরোক্ত দুটি সমস্যাই যৌথভাবে আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ মাতৃভূমি থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের বেদনার সঙ্গে মিশে গিয়েছে তাদের পুনর্বাসনের অন্তর্নিহিত রাজনীতির, লোভের ও বর্ণনার ইতিহাস। যদিও অধিকাংশ সমালোচকই দেশভাগ সম্পর্কিত উপন্যাসগুলিকে সেভাবে ভাগ করেননি।”

সায়ন্তনী পূততুন্ডের ‘শঙ্খচিল’ উপন্যাসটি প্রথম শ্রেণির অন্তর্গত। এখানে জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। আবার উল্টোদিকে দেখা যায় খণ্ডিত বাংলার অখণ্ডের একটি প্রতিচ্ছবি। প্রতিবছর দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে ইছামতীর তীরে দুই বাংলা, তার মানুষজন একত্র হয়। ভাবের আদান-প্রদানের পাশাপাশি দুই বঙ্গের সংস্কৃতিরও মেলবন্ধন ঘটে এইসময়। এছাড়া বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত পানিত্তার নামক অংশে একটি মেলা আয়োজিত হয়। সেখানে দুই বাংলার জনগণ সমান ভাবে যোগদান করে। ওই একটি দিন মুছে যায় সীমান্তের বিভেদ, কাঁটাতার সবকিছু;…” মেলবন্ধন ঘটে দুই ছিন্ন হৃদয়ের, সংযোগ ঘটে দুইপারের বাসিন্দার।

“...পানিত্তারে বিরাট মেলা বসেছে। কত আলো, কত রোশনাইয়ে ভেসে যাচ্ছে মাঠ, জনপদ। কত তার ধমক, চমক। এই মেলায় ভারত-বাংলাদেশ এক হয়ে যায়। যেমন এক হয়ে যায় দুর্গামূর্তি ভাসানের সময়। দুই বাংলার মিলনমেলাও বলা যায় এই পানিত্তারের মেলাকে।’’

কেবলমাত্র উৎসব নয়, সম্প্রীতির এক অনন্য নজির ‘শঙ্খচিলে’ লক্ষণীয়। হাসান আজিজুল হকের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’(২০০৮) শীর্ষক উপন্যাসে হিন্দু-মুসলমানের মিলনক্ষেত্র হিসাবে সনাদার পরিবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঈশম শেখ বিজাতীয় ধর্মের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন এই পরিবারের একজন অন্যতম সদস্য। কিন্তু অকস্মাৎ দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপর্যস্ত হয়ে সনাবাবুদের উদ্বাস্তু হিসেবে এপার বাংলায় আশ্রয় নেয়। এহেন ঘটনার প্রতিচ্ছবি ‘শঙ্খচিল’ উপন্যাসেও লক্ষ্য করা যায়; সুদীপ্তবাবুর পূর্বপুরুষ কোনও একসময় সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। সুদীপ্তবাবুর বাবা ও মেজ কাকা জেঠু জমিদারিঁর পুঁজিবাদকে ঘৃণা করতেন। তাই তারা পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন না। দু’জন যৌবনেই স্বদেশী আন্দোলনে নাম লিখিয়ে বাড়ি ছেড়ে ছিলেন। তখন থেকে ইছামতীর প্রান্তবর্তী বাদলের গ্রামে থাকতেন সুদীপ্তবাবুর বাবা।...সুদীপ্তবাবুর বাবার বিবাহ, পুত্রসন্তানের জন্ম— সব কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অধুনা বাংলাদেশ! কিন্তু সেই প্রাণের বাংলা যখন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল তখন ঘটনাটা মেনে নিতে পারেননি ভদ্রলোক। তাই বাংলা ভাগ হওয়ার খবর পাওয়া মাত্রই সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।”

শেষে অসীম অত্যাচারের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় সুদীপ্তবাবুদের পরিবার। কিন্তু পরবর্তীকালে রূপসার চিকিৎসার জন্য যখন বাদলের পরিবার বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশ করে, তখন সুদীপ্তবাবুর পরিবারই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। সুদীপ্তবাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নিকট আত্মীয় পরিচয় দিয়ে রূপসার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে কলকাতায়। সম্প্রীতির এই নিটোল প্রতিবিম্বে কাঁটাতারের বিভেদ ভুলে আরও একবার দুই বাংলার মেলবন্ধন ঘটে যায়।

লিঙ্গ রাজনীতির চোনা ছকে সচেতনভাবে নারীত্বের যে অবয়ব গড়ে ওঠে সেখানে সে নিতান্তই ‘মেয়েছেলে’। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় নির্মিত ‘নারী’ এবং তার বিভিন্ন প্রতিশব্দের ব্যুৎপত্তিতে রয়েছে তার ‘পরনির্ভরতা’, তার লতার মত বেষ্টনশীলতা, তার সেবা পরায়ণতা—এককথায় তার অসম্পূর্ণতা। শাস্ত্রীয় অবরোধ ও সামাজিকরণের সিলেমোহর সহযোগে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে পুরুষতন্ত্র আবহমানকাল থেকেই নারীর ‘ভুবন’ নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রসঙ্গত, সিমন দ্য বোভেয়ারের বিখ্যাত মন্তব্য স্মরণযোগ্য—‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, সমাজই তাকে নারী করে তোলে।’ তাইতো সতীত্বের গৌরবে গরিবিনী চিরকালীন নারীর ‘আর্কাইপ’ সীতার নিজের কোনো ঘর হয় না। মেয়েমাত্রই যেন চির উদ্বাস্তু, চির নির্বাসিত।”

কালের প্রবাহমানতায় যুগের পরিবর্তন ঘটেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে উন্নত হয়েছে মানুষের জীবনশৈলী, আমূল বদল ঘটেছে তার আচার-আচরণের, কিন্তু নারী জাতির প্রতি বদলায়নি সমাজের দৃষ্টি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সিদ্ধান্ত তৎকালীন নারীসমাজেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেসময় প্রাণের দায়ে পরিবারের সঙ্গে নারীরাও সামিল হয় অনিশ্চিত জীবনে। ফলস্বরূপ কোথাও “দেশভাগ সুস্থ, স্বাভাবিক, ভদ্র, পরিবারের মেয়েদের পরিণত করেছে প্রায় বেশ্যায়...।” প্রখ্যাত সমালোচক সরোজকুমার রায়চৌধুরীর ‘নীল আগুন’(১৯৬১) উপন্যাসে অঞ্জনা, রঞ্জনা ও খঞ্জনা পৃথক পৃথক পরিবারের এই তিনজন নারী দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হিসাবে শিয়ালদহ প্লাটফর্মে আশ্রয় নেয়। ধীরে ধীরে তারা নারীমাংসলোভী দুঃশ্চরিত্রের শিকার হয়ে দেহবিক্রয়কারিণীতে পরিণত হয়।

শঙ্খচিল’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক দেশভাগ ও তৎকালীন সময়ের নারী নির্যাতনের ঘটনাবলির একটি প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করেছেন। উল্টোদিকে দেশভাগ পরবর্তী হিংসায় সন্তানহারা মায়ের বেদনাকেও তুলে ধরেছেন সায়ন্তনী দেবী। সুদীপ্তবাবুর মেজ জেঠিমা পুত্র মানিককে হারিয়েছিলেন দেশভাগের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসাবে। বরিশালের দাঙ্গার সময় মাকে প্রাণে বাঁচাতে গিয়ে দাঙ্গাবাজদের হাতে নৃশংস ভাবে নিহত হন মানিক ডাক্তার। যার পরিণামে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তার মা। অন্যদিকে লায়লার সন্তান রূপসা দেশভাগের পরোক্ষ কারণে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সায়ন্তনী দেবী কলমের সূক্ষ আঁচড়ে দুই যুগের দুই মায়ের অঅন্তর্বেদনাকে মিলিয়ে দিয়েছেন।

কনজেনিটাল ভালভ ডিফেক্টসে আক্রান্ত রূপসার চিকিৎসার জন্য বাদলের সঙ্গে লায়লা কাঁটাতার অমান্য করে অনুপ্রবেশ করে ‘ইন্ডিয়া’য়। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার ফলে তারা হারিয়ে ফেলে আত্মপরিচয়সহ রীতি-রেওয়াজও। এপার বাংলায় তারা এক নতুন মানুষ; নতুন তাদের পরিচয়; সবকিছুই অন্যরকম। মুনতাসীর বাদল চৌধুরী এখন হিন্দু ব্রাহ্মণ বাদল চৌধুরী স্ত্রী লীলাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসেছে মেয়ে রূপসার চিকিৎসা করাতে। কিন্তু কলকাতায় বাদল-লায়লা এক অবক্ষয়ী নাগরিক মূল্যবোধের সম্মুখীন হয়। একদিকে ‘ইন্ডিয়া’ একটা অন্যদেশ আর অন্যদিকে তারা অনুপ্রবেশকারী।

রূপসার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে পড়ে তারা; “ভারতে চিকিৎসার খরচ সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না। যেটুকু হাতের কাছে পেয়েছে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে এনেছে। কিন্তু সে অর্থও অপ্রতুল!’’ অগত্যা নিজের গয়না বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয় লায়লা। কিন্তু বিনা রসিদে ‘কে ডি এম কে সোনা’ অর্থাৎ বাংলাদেশি সোনা ক্রয়-বিক্রয় আইনত অপরাধ; ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে বেআইনি পথে গয়না বিক্রি করতে রাজি হয় বাদল-লায়লা। চোরাচালানকারীদের কাছে গয়না বিক্রি করতে গিয়ে নারীলোলুপ মানুষের চক্রান্তের শিকার হয় লায়লা। শেষমেশ নিজেদের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে হাসপাতালে ফিরে আসে তারা। একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় রূপসার।

রূপসার মৃত্যুর পরে বাদল-লায়লার জীবনে নেমে আসে আরও এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডি। বিনা অনুমতিতে ‘ইন্ডিয়া’য় প্রবেশ করার ফলে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় তারা। বাদলের অনুরোধে রূপসার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় বাংলাদেশে।তারপর একদিন ছোট একটি কফিন নিয়ে ভারতবর্শের বর্ডার ইছামতীর কুশায়ায় মিশে গেল। তার কিছুক্ষণ পরেই কফিনবন্দী দেহটিকে বাইরে এনে দেহসমেত সমস্ত আশা, স্বপ্ন মিশিয়ে দেওয়া হল মাটির গভীরে।  আকাশ বেয়ে তখন শঙ্খচিল উড়ান দিয়েছে! তাদের মাথার উপরে উন্মুক্ত আকাশ! নিচে উন্মুক্ত জমি। কোনো বাধা বন্ধ নেই। কোনো মানচিত্র নেই ব্যারিকেড নেই, বর্ডার নেই! আলোতে উচ্ছ্বসিত ডানা মেলে দিয়ে তারা উড়ে চলেছে ভারতবর্শের দিকে ! শঙ্খচিলদের পাসপোর্ট লাগে না! ভিসা লাগে না!” একদিকে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা অন্যদিকে কারাবাসের দণ্ড; অবসাদের বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাদের। একবছর পরে দেশে ফিরে লায়লা হাতড়ে বেড়ায় রূপসার স্মৃতিকে। সে বলে ওঠে “মা দেখ, সব বিষ আমি খেয়ে ফেলেছি! তোর ভাগের বিষটাও আমি খেয়েছি।...আর ভয় নেই। এবার বেরিয়ে আয়! আয় মাগো!”

ভাষা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই ভাষার মাধ্যমে স্রষ্টা যেমন তার রচনার ঘটনাবলি বিবৃত করেন। ঠিক তেমনভাবে সাহিত্যিকের সচেতন ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁর চরিত্ররা সজীব হয়ে ওঠে পাঠক মহলে। তবে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে সাহিত্যের ভাষার প্রভেদ রয়েছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজের তাগিদে একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ বিভিন্ন ভাবে ভাষাকে ব্যবহার করে। কিন্তু একজন সাহিত্যিকের ভাষা প্রয়োগের সঙ্গে তার প্রভেদ রয়েছে। কারণ একজন সাহিত্যিকের ভাষা প্রকৌশলে তাঁর শিক্ষিত, মার্জিত জীবনবোধের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। তবে বিভিন্ন সাহিত্যিকের ভাষা প্রকৌশল বিভিন্ন ধরনের হয়; এই ভিন্নতা একজন সাহিত্যিকের নিজস্ব শৈলীর পরিচায়ক। প্রাচীন ভারতীয় কাব্যতত্ত্বে বক্রোক্তিবাদের প্রবক্তা রাজানক কুন্তক প্রথম বলেন, যে কবির স্বভাবভেদে কাব্যের প্রকাশভেদ ঘটে যায়। পরবর্তীকালে পাশ্চাত্য তাত্ত্বিকদের আলোচনায় শৈলী বা ‘Style’ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন সময় শৈলী বিষয়ে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন।

বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম দিকের রচনা যেমন ‘দুর্গেশনন্দিনী’(১৮৬৫)-তে বিদ্যাসাগরীয় রীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আবার ‘বিষবৃক্ষ’(১৮৭২) উপন্যাস থেকে বঙ্কিমী রীতির প্রদর্শন লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে বাংলা কথাসাহিত্যে বিভিন্ন সময় আবির্ভূত সাহিত্যিকগণ তাঁদের রচনারীতির ভিন্নতার মাধ্যমে স্বাতন্ত্র্যের সৃষ্টি করেছেন। একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম কথাসাহিত্যিক সায়ন্তনী পূততুন্ডের রচনায় তাঁর নিজস্ব স্বাক্ষর লক্ষ্য করা যায়। শঙ্খচিল’ উপন্যাসটি মান্যচলিত ভাষায় রচিত। যদিও চরিত্রের প্রয়োজনে সাধুভাষা ব্যবহার করেছেন লেখিকা। ছোট ছোট বাক্যের মাধ্যমে চিত্রকল্প সৃষ্টি তাঁর লেখার অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

উপন্যাসের শুরুতে ভোরের বর্ণনা প্রসঙ্গে এক অনবদ্য চিত্রকল্প রচনা করেছেন ঔপন্যাসিক; ইছামতীর বুকে তখনও রাতের কুয়াশা জমে আছে। ভোরের রক্তিম আলো কুসুম রঙের আভা সদ্য তৈরি করেছে মাত্র! এখনও তেমন আলো ফোটেনি। তবে অন্ধকারও নেই। অনেকটা যেন দুভেদ্য প্রহেলিকার মতো। কিছু দেখা যায়, কিছু দেখা যায় না। খানিক আলো, খানিক অন্ধকার!” তৎসম শব্দবহুল গদ্যের পরিবর্তে বেশ কিছুটা বৈঠকী মেজাজ আলোচ্য উপন্যাসে ক্রিয়াশীল।

উদাহরণস্বরূপ ইছামতীর তীরে কফিন হ্যান্ডেলের ঘটনাবলির কিছু অংশ তুলে ধরা হল-- “ইছামতীর পাড়ে, বাংলাদেশ সীমান্তে বেশ কিছু মানুষ ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা এই কফিনকে সমাধিস্থল অবধি নিয়ে যাবে। অর্থাৎ ‘জনজা’য় ‘কন্ধা’ দেবে। মানুষগুলোকে দেখলে মনে হয় ওরা এখনও অদ্ভুত একটা ঘোরে আছে। অনেকটা বাজ পড়া বটগাছের মতো স্তম্ভিত।” শঙ্খচিল’ উপন্যাসের ঘটনাক্রম দেশভাগ কেন্দ্রিক। সাম্প্রদায়িক কারণে বাংলা বিভক্ত হয়েছিল আজ থেকে বহু বছর আগে। কালের প্রবাহমানতায় এতটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সীমান্তবর্তী বিদ্বেষ বা বিক্ষোভ প্রতিমুহূর্তে সেই ক্ষত আরও একবার স্মরণ করে দেয়। কাঁটাতারের মাধ্যমে ভূমি ভাগ করা যায়। কিন্তু নদীকে বাঁধা যায় না। সে তো চিরপ্রবহমান। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এরকমই একটি নদী ইছামতী, যার দুইপ্রান্ত দুটি ভিন্ন দেশ ও তার রীতি-রেওয়াজকে ধারণ করে আছে।

উল্টোদিকে এই নদী প্রতিমুহূর্তে সাক্ষী থাকে সীমান্তবর্তী সংঘর্ষের। এক অনবদ্য ভঙ্গিতে শ্রীমতী পূততুন্ড বর্ণনা করেছেন সেই কাহিনি, “একটা জীবন অসময়ে শেষ হয়ে গেলেও প্রকৃতির কিছু আসে যায় না। প্রাত্যহিক নিয়ম মেনে একটু পরেই পবিত্র আজানের সুরে ভরে উঠবে এই ছোট্ট সীমান্তবর্তী গ্রাম! সকালে ইছামতীর বুকে ‘নেয়ের’ গান শোনা যাবে। সন্ধ্যেবেলায় বেজে উঠবে শঙ্খ! নিয়মমতোই ভারতীয় আর বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীদের যৌথ ফ্ল্যাগ মার্চও হবে। যত না মৈত্রীর প্রতীক, তার চেয়েও বেশি আতিথেয়তা! ... রাতে মৈত্রী ভুলে গর্জন করে উঠবে হিংস্র বন্দুক! হয়তো বা একরাশ গরুর পালকে ছেড়ে দেওয়া হবে সীমান্তে। গরু পাচারকারী দল গরুর পালের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে রাখবে একটা দুটো অনুপ্রবেশকারীকে! প্রচুর টাকার বিনিময়ে গরুর ভিড়ে লুকিয়ে বাংলাদেশের বা ভারতবর্ষের বর্ডার পার করতে চাইবে কেউ! সীমান্তরক্ষীর রাইফেল গর্জন করে উঠবে। প্রথমটা ব্ল্যাংক ফায়ার। ভয়াত, বিক্ষুব্ধ গরুর দল দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করবে। তার মধ্যেই হয়তো শোনা যাবে সেনাবাহিনীর ভারী বুটের শব্দ।”

সমগ্র উপন্যাসটি মান্যচলিত ভাষায় রচিত হলেও চরিত্রের খাতিরে পূর্ববঙ্গীয় কথ্য ভাষা এবং হিন্দি ভাষার ব্যবহার ‘শঙ্খচিল’ উপন্যাসে লক্ষণীয়। যার ফলে চরিত্রগুলোকে আরও সজীব ও বাস্তবসম্মত হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী অর্জুন সিং ও রূপসার কথোপকথনের একটি অংশ তুলে ধরা যায়--- “ ‘...এই লড়কি! তুমি কে?’ একটা দুষ্টু গলা খিলখিলেয় হেসে উঠল, ‘আমি বাঘ, ভালুক নই গো। আমি মানুষ।’ আবার সেই অদ্ভুত প্রশ্ন ফিরে আসে তার কাছে। ‘আপেন কি মোছলমান?’ আপন মনেই বিড়বিড় করে উত্তর দেয় সে, ‘নহি ম্যাঁয় ইনসান হুঁ।’ রূপসা বাংলাদেশের মেয়ে তাই তার মাতৃভাষা বাংলা। আর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী অর্জুন সিং রাজস্থানের বাসিন্দা। চাকরিসূত্রে অর্জুন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে থাকে। তার মাতৃভাষা হিন্দি। এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক রূপসা এবং অর্জুন সিং চরিত্রটি আরও বাস্তবসম্মত করে তুলতে কথোপকথনের সময় চরিত্রানুযায়ী বাচনভঙ্গী তুলে ধরা হয়েছে।

রূপসা বাংলাদেশের মেয়ে তাই তার মাতৃভাষা বাংলা। আর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী অর্জুন সিং রাজস্থানের বাসিন্দা। চাকরিসূত্রে অর্জুন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে থাকে। তার মাতৃভাষা হিন্দি। এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক রূপসা এবং অর্জুন সিং চরিত্রটি আরো বাস্তবসম্মত করে তুলতে কথোপকথনের সময় চরিত্রানুযায়ী ভাষার প্রয়োগ করেছেন।

"বলে যায়, বলে যায়, বল্লে যেতে যেতে

একটি মানুষ থমকে দাঁড়ায় জীবনে হাত পেতে

দিনভিখারী বাউল বলে ইচ্ছামতন পারি

বদলবন্ধে কাল কাটাতে কিচ্ছু না রাজবাড়ি, এবং ভাঙা ঘরও

শুদু বাঁধন বদলে যাওয়া মূর্তিতে রঙ কর।”

সমালোচকদের মতে দেশভাগের ফলে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়, যার ফলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝখানে অবশিষ্ট রইল একটি বিভাজিত দেশ ভারতবর্ষ। একদিকে এই বিভাজন সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত করল বহুবছর ধরে সযত্নে লালিত সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে। অন্যদিকে সৃষ্টি করল উদ্বাস্তু সমস্যার। আসলে "দেশ মানে শুধুমাত্র একটি ভূমিগত অবস্থান নয়। দেশ হল স্বদেশ, নিজের বাসস্থান। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে সেই দু বিঘা জমি যেখানে একজন তার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের দিনগুলি কাটিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়। দেশ হল সেই জায়গা যেখানে মৃতুর পর মানুষ চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চায়। তাই একজন সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু দেশ মানে ভৌগোলিক অবস্থান নয়।"৩০ অবিভাজ্য ভারতবর্ষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনজাতির দ্বারা শাসিত হয়েছে। ইতিহাসের অন্তরালে লুকিয়ে আছে অতীতের সেই কাহিনি।

১২০৪ বঙ্গাব্দে তুর্কি আক্রমণের পর প্রাণের দায়ে বহু হিন্দু পরিবার মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সেই ধর্মান্তরিত পরিবারবর্গ শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশে থাকার অনুমতি লাভ করে। মুনতাসির চৌধুরী বাদল তাদের একজন প্রতিনিধিমাত্র। তার পূর্বপুরুষ প্রাণের দায়ে তুর্কি-আক্রমণের সময় ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল আর এখন বাদলের পরিবার আইনের চোখে ফাঁকি দিতে আরও একবার ধর্মীয় পরিচয় বদল করতে বাধ্য হল।     বাদলের কথায়, “আজ বাংলায় যত বাঙালি মুসলমান আছে, তার বেশিরভাগই তুর্কি আক্রমণের আগে হিন্দু ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষও হিন্দু ছিলেন। কিন্তু তুর্কি আক্রমণের সময় নিজের ও পরিবারের প্রাণ বাঁচাতে সবাই হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম নিয়েছিলেন! তোমাকে হিন্দু হতে কেউ বলছে না। কিন্তু রূপসার জন্য তুমি কি সিঁদুর পরতে পারবা না! কিন্তু তারপরও শেষরক্ষা হয় না। বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশের ফলে একবছরের সশ্রম কারাদণ্ড দণ্ডিত হয় বাদল-লায়লা। বীতশ্রদ্ধ কণ্ঠে বাদল বলে ওঠে, "আমরা তো লক্ষ্মীছাড়াই। ঠিকই বলেছেন কবিগুরু। আমরা নিজের মাকে বেচে দিয়েছি। তাই সাতশো বেয়াল্লিশ বছরের অধিকারও হেরে যায়। পড়ে থাকে মাত্র সাতষট্টি বছর। যেটা বাপ-পিতেমোর ভিটে ছিল, আজ সেখানেই চুপিচুপি চোরের মত আসতে হয়! আমার দেশে আমিই অনুপ্রবেশকারী! ট্রেসপাসার!"৩২ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও উত্তরাধিকারসূত্রে দুই বাংলার মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে সেই দুঃসহ স্মৃতি। একজন মানুষের একটা কলমের দাগ এভাবেই ক্ষত-বিক্ষত করে দিল একটা জাতিসত্তাকে। "একটা কাঁটাতার দ্বিখন্ডিত করেছে সবকিছু। ওদিকটা ইন্ডিয়া, এদিকটা বাংলাদেশ! 'একই বঙ্গ হল ভঙ্গ, পূরব ও পশ্চিম!' সহোদর হওয়া সত্ত্বেও তাই রাম-রহিমের মিলন অসম্ভব! মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন একটি মানুষ যে কোনওদিন এ মাটির ছিল না, হয়নি কখনও। লোকটা বিদেশি তাই দুই বাংলার মাঝখানে একটা লাল দাগ টেনে দিতে একবারও হাত কাঁপেনি!"

'একই বঙ্গ হল ভঙ্গ, পূরব ও পশ্চিম!' সহোদর হওয়া সত্ত্বেও তাই রাম-রহিমের মিলন অসম্ভব! মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন একটি মানুষ যে কোনওদিন এ মাটির ছিল না, হয়নি কখনও। লোকটা বিদেসি তাই দুই বাংলার মাঝখানে একটা লাল দাগ টেনে দিতে একবারও হাত কাঁপেনি!”৩৪ কিন্তু বাদল বাংলাদেশের জন্মগ্রহণ করলেও উত্তরাধিকার সূত্রে সে অবিভাজ্য ভারতবর্ষের নাগরিক। ভারতবর্ষের মাটি তার জন্মভূমি। তাই তার একটা দাগে পক্ষে জন্মভূমিকে বিভক্ত করা অসম্ভবের নামান্তর

পরিশেষে বলা যায় বঙ্গবিভাজন সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও দুই বঙ্গের মানুষ আজও সেই ক্ষত বহন করে চলেছে। ১৯৪৭ সালে বঙ্গবিভাগের পর প্রচুর মানুষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়ে এপার বাংলায় ভিড় জমায়। দেশভাগ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জীবনের মর্মান্তিক আখ্যান বারে বারে বিভিন্ন সাহিত্যিকের কলমে প্রতিফলিত হয়েছে। সায়ন্তনী পূততুন্ড প্রণীত 'শঙ্খচিল' উপন্যাসটি দেশভাগ কেন্দ্রিক অন্যতম একটি আখ্যান। কিন্তু দেশভাগ কিংবা তার পরবর্তী পরিবর্তিত জনজীবনে এই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু নয়। দেশভাগের কাহিনিক্রম এই উপন্যাসের ঘটনাবলিকে ধারণ করে রয়েছে মাত্র। 'শঙ্খচিল' কাঁটাতারের বাধা অগ্রাহ্য করে ভারতে চলা আসা একটি পরিবারের আখ্যান। যেখানে অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসার জন্য বাদল এবং লায়লা বেআইনিভাবে কলকাতায় চলে আসে। একদিকে আত্মপরিচয় হারানোর বেদনা অন্যদিকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় একমাত্র কন্যার মৃত্যু এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডি সূচনা করে বাদল-লায়লার জীবনে। এখানেই মরীচিকার সমাপতন সমাপ্ত হয় না। বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশ করার জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত হয় পরিবারটি। বাদলের একান্ত অনুরোধে রূপসার শেষকৃত্য বাংলাদেশে সম্পন্ন হয়। কিন্তু 'ট্রেসপাসার বাদল-লায়লা' আইনি জটিলতার কারণে রূপসার শেষযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে অসমর্থ হয়। জীবিত অবস্থায় যে মাটি রূপসাকে 'অনুপ্রবেশকারী' হিসাবে দূরে রেখেছিল, মৃত্যুর পর সেই মাটিই তার একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। কাঁটাতার দিয়ে একটা ভূমিকে দ্বিখন্ডিত করা যায় কিন্তু প্রকৃতিকে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। তেমনিই সম্ভব নয় পাখির কোনো দেশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া।

একঝাঁক শঙ্খচিল দলবেঁধে প্রতিনিয়ত ভারত-বাংলাদেশে উড়ান দেয়, দুই দেশের সীমানা কে অগ্রাহ্য করে। তাদের পাসপোর্ট বা ভিসার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তারা স্বাধীন, স্বতন্ত্র। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে নিয়মটি ভিন্ন। সেক্ষেত্রে চলে আসে অনুমোদিত অনুমতিপত্রের কথা, পাসপোর্ট কিংবা ভিসার প্রসঙ্গ। আইনি জটিলতার ঘেরাটোপে মানবিকতার পরিবর্তে নিয়মতন্ত্র কায়েম করে সবকিছু। যার ফলে কখনো মানুষ হারায় তার আত্মপরিচয়, কখনো বা প্রিয়জনকে। সায়ন্তনী পূততুন্ডর কলমে আরো একবার উঠে আসে সেই পটচিত্র। মান্য চলিত ভাষায় রচিত সমগ্র উপন্যাসে চরিত্রের প্রয়োজনে ঔপন্যাসিক বেশকিছু ভারতীয় ভাষা (হিন্দি)-র প্রয়োগ করেছেন। এছাড়া বেশ কিছু বাংলা কবিতার সংযোজিত হয়েছে 'শঙ্খচিল' উপন্যাসে। নিটোল বয়ানে, সুসংহত ভাবে কাহিনিক্রম বর্ণিত হয়েছে। এই কাহিনিবর্ণনের ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক একটি কৌশল অবলম্বন করেছেন।

নাটকের ক্ষেত্রে যেমন একটি দৃশ্যের মধ্যে সমান্তরালভাবে দুটি ঘটনা অভিনীত হয়, ঠিক তেমন ভাবেই ঔপন্যাসিক সমান্তরালভাবে দুটি ঘটনা বিবৃত করেছেন অনেকটা সিনেমাটোগ্রাফির ধাঁচে। যেমন-উপন্যাসের সূচনাংশে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীর হাতে রূপসার কফিনবন্দি দেহ হস্তান্তরের পর ভারতীয় সেনাজওয়ান অর্জুন সিং রূপসার শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করে। হেনকালে অর্জুন ডুব দেয় স্মৃতির রোমন্থনে। ঠিক সেময় বিপরীত দিকে ভারতবর্ষের সীমানায় বসে বাদল-লায়লা রূপসার স্মৃতিচারণায় নিমগ্ন হয়। দুই বাংলার মানুষ আজও উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে বঙ্গভঙ্গের বির্দীণ ক্ষত। বাদল-লায়লার জীবনের ইতিবৃত্ত যেন সেই ঘটনারই প্রতিনিধিত্ব করেছে 'শঙ্খচিল' উপন্যাসে। কিন্তু এই সমস্যার নেই কোনো সমাধান। কেবলমাত্র স্মৃতি বহন করা ছাড়া। কারণ মানুষ তো "সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল...।" আর তাই হয়ত বাদলের জবানীতে প্রতিধ্বনিত হয় দেশভাগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষের প্রতিবাদ- " দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে। অবশেষে যথাক্রমে খাব: গাছপালা, নদী-নালা, গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত, চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী, উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি--- আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলা যায় না আজ। ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব।”

দেশভাগের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঙ্গে এভাবেই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় মানুষের বেদনাদীর্ণ ইতিকথা। দেশবিভাজন নিয়ে অনেক সময়ের প্রবাহে বহু গল্প-কবিতা-উপন্যাস রচিত হয়েছে। 'শঙ্খচিল'ও তার ব্যতিক্রমী নয়। দেশভাগের যন্ত্রণা উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। উদ্বাস্তু মানুষের হাহাকার রয়েছে পাতায়। আর তারসঙ্গে রয়েছে সাতষট্টি বছর পরবর্তী জনজীবনে দেশভাগ ও সমকালীন ঘটনার সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনাবলির বিবরণ অন্যান্য রচনার থেকে সায়ন্তনী পূততুন্ডের 'শঙ্খচিল' উপন্যাসটিকে স্বতন্ত্র করে তোলে।