কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল’ ৪র্থ পর্ব
রূপবাণী-অরুণা-ভারতী
ভারতী
১৯৬৬ সালে অধুনালুপ্ত ‘ভারতী’তে দেখি
‘দোলগোবিন্দের কড়চা’, হাসির ছবি, নাম ভূমিকায় রবি ঘোষ। দেখতে আমার সঙ্গে ছিলেন মা ও আমার এক
কাকা। ছবিটি তাঁদের এত ভালো লেগেছিলো যে বাবাকে জানানো হয়, এবং তিনি একদিন আমাকে
নিয়ে ‘ভারতী’তে আসেন নিজে আমাকে ও মাকে নিয়ে ছবিটি দেখবেন ব’লে। কেন মনে নেই, ওই ছবির টিকিট না কেটে, শেষ অবধি কাটা
হয় পাশে ‘বিজলী’তে রম-রম করে চলা ‘মণিহার’-এর টিকিট। (প্রসঙ্গত দুটি ছবিই একদিনে
মুক্তি পায়ঃ ৪ঠা ফেব্রুয়ারী)। ‘দোলগোবিন্দের কড়চা’-য় চিত্রনাট্যকার বিধায়ক
ভট্টাচার্য (মূল কাহিনী বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের) একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
আর এই ছবির আগেই দেখানো হয়েছিল বাংলা ভাষায় ‘মেট্রো নিউজ’ আর তারপর টম আর জেরির
একটি কার্টুন! এসব সাধারণত দেখানো হতো
ধর্মতলার অভিজাত ‘মেট্রো’ সিনেমাতেই! আর এই বছর দেখি, এবং খুব ভালো লাগে, আমার
প্রথম তপন সিংহ পরিচালিত ছবিঃ ‘গল্প হলেও সত্যি’। পরিবারের সবাই ছবিটির প্রশংসা
করেন। দেখা হয়েছিল ভারতীতে, ছবিটি মুক্তি পায় ১৩ই অক্টোবর। ছবি শুরুর আগেই
কর্তৃপক্ষ পর্দায় ‘স্লাইড’ ফেলে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণযন্ত্র কাজ
করছে না! বাংলা ছবি দেখানো প্রেক্ষাগৃহে দর্শক-স্বাচ্ছন্দ্যের ইতি খুব তাড়াতাড়ি
শুরু হয়েছিল!
১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে মুক্তি পায় আমার –
মুক্তির সময়ের নিরিখে – দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রিয় বাংলা ছবি, তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান
পৃথ্বীরাজ’! এটিও মোট চারবার দেখি ভারতীতে! এ নিয়ে এর আগে যা লিখেছি, তাই এখানে
দিলামঃ দশ বছর বয়েসে ‘ইন্দিরা’য় ‘বালিকা বধূ’ দেখা
আর ষোল পেরিয়ে ভারতীতে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ দেখার অভিজ্ঞতা যে সম্পূর্ণ পৃথক হ’বে, তা বলা বাহুল্য। ‘বালিকা
বধূ’র একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ সপরিবারে কোণারক বেড়াতে গিয়ে একটি
আদিরসাত্মক মূর্তি দেখে রজনীর চমকে ওঠা! তখন, ১৯৬৭ সালে খুব একটা কিছু বুঝিনি,
যদিও দৃশ্যটি অস্বস্তিকর লেগেছিল। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ অন্য স্তরের ছবি। দামাল
ছেলে রসিক বিয়ের পরেও তার দস্যিপনা বজায় রাখে, এমনকি স্ত্রী অমলার সঙ্গে স্ত্রীর
সখীর (সন্ধ্যা রায়) কথামতো ‘গায়ে গা ঠেকিয়ে’ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ পড়ার সময়েও! আর
বহুবিবাহের বিরুদ্ধে কী দারুণ মজার প্রতিবাদ, যেখানে রসিক নিজেই দুই মায়ের সন্তান! রসিক অমলাকে হরণ
ক’রে নিয়ে আসবেই শ্বশুরবাড়ি থেকে, তার বাবা তাকে দ্বিতীয়বার ছাঁদনাতলায় দাঁড়
করাবার যতই চেষ্টা করুন না কেন! হাজার হোক রসিক তো নিজেই অমলাকে শ্বশুরবাড়িতে ছেড়ে
পালিয়ে এসেছে, ‘ম্যাজিস্টর সায়েবের শালার’ নাকে এক ঘুঁষো ঝেড়ে দেবার পর! পৃথ্বীরাজ
সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে হরণ করেছিলেন, রসিক অমলাকে তার শ্বশুরের সাধের মোটরগাড়ি
চুরি করে তাতেই চাপিয়ে তার বাবার কাছে এনে ফেলে! নইলে যে বাবা এই বিংশ শতাব্দীর
পৃথ্বীরাজের দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে দেবেন রসিকের চিরশত্রু ‘আলেকজান্ডারে’র বোন ‘ভূতি’র
সঙ্গে – সেই ভূতি যে রসিকের স্বপ্নদৃশ্যে হয়ে ওঠে অমলাকে প্রাণদণ্ডদাত্রী সংযুক্তা!আমার চিরকালের সবচেয়ে প্রিয় তিনটি বাংলা
ছবির মধ্যে প্রথম স্থানে একে অপরকে গোঁতাগুঁতি করছে তরুণবাবুর এই অনবদ্য
প্রেমগাথাটি, তাঁরই ‘দাদার কীর্তি’র (১৯৮০) সঙ্গে! মুখ্য চরিত্রে অয়ন
বন্দ্যোপাধ্যায় অবিস্মরণীয়। ‘বালিকা বধূ’তে রজনী/চিনি-রূপিনী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়
বেশী নজর কেড়েছিলেন, অমলরূপী পার্থ মুখোপাধ্যায়ের তুলনায়। এখানে, সজ্ঞানে কিনা
জানি না, তরুণবাবু পাশা উল্টে দিয়েছেন। অমলাবেশিনী
মহুয়া রায়চৌধুরী মিষ্টি, কিন্তু ছবির ফাটাফাটি শেষ দৃশ্যের আগে অয়নের পাশে কিছুটা
নিস্প্রভ। ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অমলাকে রসিক তার চিঠিতে যা
নিবেদন করেছিল, তা ‘বালিকা বধূর’ অমলের রজনীকে ‘প্রিয়তমা’ সম্বোধনের চেয়ে কয়েক
যোজন এগিয়ে! সলজ্জ অমলা শেষ দৃশ্যে স্বামীকে তার সেই দাবী নিজের কথামত মিটিয়ে দেয়!
ছবিটি যে আমাকে পাগল করে ছেড়েছিল, তার কারণ অবশ্যই এই দৃশ্যটি! চারবার ভবানীপুরের
অধুনালুপ্ত ‘ভারতী’তে দেখেছি, তার মধ্যে একবার আমার ইংরেজী-মাধ্যম স্কুলের দুই
সহপাঠীকে বগলদাবা ক’রে (“ওরে দেখবি চল, একটা দারুণ বাংলা ছবি! ইংরেজী তো অনেক
হ’লো!”)। অভিনয় নিয়ে কাকে ছেড়ে কার প্রশংসা করবো? রসিকের বাবার ভূমিকায় সত্য
বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিকের শ্বশুর পান্নালালের ভূমিকায় উৎপল দত্ত, রসিকের ঠাকুমা
নিভাননী দেবী, আর ইতিহাসের মাস্টারমশাইয়ের ছোট্ট ভূমিকায় একমেবমদ্বিতীয়ম সন্তোষ
দত্ত, যিনি ক্ষেপে গিয়ে রসিককে বেত মারতে থাকেন এই রাগে যে সে কোন আস্পর্ধায়
পৃথ্বীরাজ সেজে আলেকজান্ডারের সঙ্গে টিফিনের সময় যুদ্ধ করছিল! এবং যাঁকে স্বপ্নে
পৃথ্বীরাজরূপী রসিক নিজের রাজসভায় ড্রিল-স্যারের (মনু মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে শৃঙ্খলিত
বন্দীরূপে দেখে! শুধু একটি জিনিসই এই ছবিতে নিতে পারিনি – আমার পরিবারের অনেকেই
একই কথা বলেছিলেন। তৎকালীন এক সমালোচকের মতে ছবির ‘সবচেয়ে সু-গীত গান’, লতা
মঙ্গেশকরের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে’! সত্তরের দশকে ঐ গানটির
স্বত্ব নিয়ে রেখেছিল যাঁর কণ্ঠ তাঁর কাছে কয়েক মাস পরেই আমি গান শেখবার সুযোগ পাবঃ
শ্রীমতী সুমিত্রা সেন!
আমার নিজের এই ছবিতে সবচেয়ে প্রিয় গান
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়, ‘ওরে মন, তল্পিতল্পা নিয়ে এবার ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো’!
কর্মস্থল থেকে অবসর গ্রহণের মুহূর্তে এই গানটিই বারবার মনে পড়েছিল!
আর সত্তরের দশকে প্রাক-উত্তম যুগের একগুচ্ছ
ছবি দেখেছি প্রধানত মা’র উৎসাহে। তিনি ছিলেন মূলত কানন দেবীর ভক্ত। এই মহিয়সী অভিনেত্রীর যে ছবিগুলি দেখেছি, সেগুলি বেশীর ভাগই
মুক্তি পেত দু’টি নতুন বাংলা ছবির মাঝখানে, এক সপ্তাহের জন্যেঃ
·
‘যোগাযোগ’ (১৯৪৩, রবীন্দ্রনাথের
নয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাহিনি ও গীত রচনা, অভিনয়ে কানন দেবীর সঙ্গে জহর গাঙ্গুলী, রবীন মজুমদার, অহীন্দ্র
চৌধুরী, এবং খলনায়কের চরিত্রে বড় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রেক্ষাগৃহ ভারতী।)
·
‘মুক্তি’ (১৯৩৭, অভিনয়ে পরিচালক
প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, অমর মল্লিক, মেনকা দেবী, পঙ্কজ মল্লিক, গীত রচনা
রবীন্দ্রনাথ, সজনীকান্ত দাস, অজয় ভট্টাচার্য। প্রেক্ষাগৃহ ‘ভারতী’। ব্যতিক্রমঃ এক
সপ্তাহের জন্যে নয়, বিপুল সমারোহের সঙ্গে
অন্তত তিন সপ্তাহ চলেছিল।) ১৯৩৭ সালে তোলা আসামের জঙ্গলের বহির্দৃশ্য এককথায়
চমকপ্রদ। তাছাড়া ছিল চারটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ, যার মধ্যে আমার সবচেয়ে আগ্রহ
ছিল ছবির সুরকার পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত ও গীত ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’। একটু
ধাক্কা খেয়েছিলাম যখন দেখলাম যে পঙ্কজবাবু ‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ স্তবকটি
গাইলেন না। এই সাম্প্রতিক জেনেছি যে উক্ত পংক্তিগুলির সুর করেছিলেন হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়, সেই সত্তর দশকের গোড়ায় তাঁর প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘অনিন্দিতা’ ছবিতে!
‘মুক্তি’-তে পঙ্কজ-অভিনীত চরিত্রটিই গানটি গেয়েছে। ‘অনিন্দিতা’-য় গানটি আছে
নেপথ্যে।
১৯৮০-র ২৮শে নভেম্বর মুক্তি পায়, তারিখ
অনুযায়ী, তৃতীয়, কিন্তু গুণের বিচারে ৭৩-এর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর সঙ্গে আমার
সবচেয়ে প্রিয় বাংলা ছবি, তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’! বাবা-মা আর আমি দেখতে যাই
লেক টাউনের ‘জয়া’য় প্রথমবার। দেখে মুগ্ধ, আপ্লুত হয়ে স্থির করি আমার মাতৃসমা
মাসীমাকে – যাঁর উৎসাহে আমরা সবাই প্রথম
‘বালিকা বধূ’ দেখি, এবং যিনি আমাদের সঙ্গে তারপর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ও
‘ফুলেশ্বরী’, দুটিই দেখেছেন, এবং অনেক আগে ‘একটুকু বাসা’ও – এ ছবি দেখাতেই হবে। মা
আর আমি ছুটলাম দক্ষিণ কলকাতার ‘ভারতী’তে তাঁকে নিয়ে। এরপর দাদার পালা। তিনি চাইলেন ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ দেখতে (এটি ততদিনে দেখা হয়ে গেছে আমার, সে কথা আগের পর্বে
বলেছি)। কিন্তু আমি জোর করলাম, এবং নিয়ে চললাম শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশে ‘অরুণা’য়
তাঁকে নিয়ে। এবার মুখ খুললেন বাবা, যিনি ১৯৭০-এ ‘বিজলী’তে ‘এই করেছ ভাল’ দেখে চরম
বিরক্তি-সহকারে তাঁর জন্যে বাংলা ছবির টিকিট আর না কাটার নিদান দিয়েছিলেন (প্রথম
পর্ব দ্রষ্টব্য)। “দিব্যি নিজেরা বারবার
দেখছো তো ছবিটা! আমাকে তো আরেকবার নিয়ে যাওয়া যায়, নাকি?” সেই তাঁকে নিয়ে ‘অরুণা’য়
চতুর্থবার ‘দাদার কীর্তি’! ততদিনে ১৯৮১ সাল পড়ে গেছে!
তরুণবাবুর ছবি দেখার মুখ্য আকর্ষণ হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর স্বর্ণজুটি। তাছাড়া কিশোর প্রেমের এমন রুচিসম্মত
উপস্থাপন তাঁর মতো কেউ করতে পারেন না। ‘দাদার কীর্তি’তে এর ওপর কাহিনি ও
চরিত্রবিন্যাসে গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার, অভূতপূর্ব। স্বয়ং হেমন্ত
‘চরণ ধরিতে’ দিয়ে তরুণবাবু যে অলৌকিক মাধুর্য্য সৃষ্টি করতে চলেছেন তা বোঝেননি।
গানটির চিত্রায়নও ভাবুনঃ সঞ্চারীতে ‘তোমারই কাছেতে হারিয়া’ গাইছে সরলপ্রাণ কেদার
(তাপস পাল), আর ক্যামেরা ঘুরে তাকাচ্ছে পিয়ানো-বাদনকারিনী সরস্বতীর (মহুয়া
রায়চৌধুরী) দিকে। পূজা ও প্রেম যে এভাবে সমার্থক হয়ে যেতে পারে তা একনিষ্ঠ
রবীন্দ্র-পূজারী ছাড়া এমন করে কে বোঝাবে? এই গান তো শুনে এসেছি রেকর্ডে আরও দ্রুত
লয়ে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে, ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনের গান হিসেবেই! হেমন্ত বলেছেন
যে গানটি ‘শ্যামা’ গীতিনাট্যের বিকল্প রূপ ‘পরিশোধে’ শ্যামার মুখে শোনা যেত! ছবির
শেষে সরস্বতীর দিক থেকে এই একই গান তার পূজামিশ্রিত প্রেম নিয়ে ফিরে আসবে কেদারের দিকে। কেদার তার নিজের
অবচেতনে নিজেকে এই গানটির মাধ্যমে নিবেদন করেছিল সরস্বতীর কাছে। এবার সরস্বতী তার
কেদারকে ভুল বোঝার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে নিজেকে নিবেদন করলো কেদারের কাছেঃ ‘নিজ
হাতে তুমি গেঁথে নিও হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে’! এখানে ‘ফুলেশ্বরী’র কথা মনে
পড়েছিল, ঐ শেষ মুহূর্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার ফর্মুলা ব্যবহারের জন্য। কিন্তু
কিভাবে ভুল বোঝাবুঝি মিটল সেটা গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলায় ‘ফুলেশ্বরী’র মতো
গোঁজামিল মনে হয়নি। এর একটু আগে, ভোম্বল ভটচাযের (অনুপকুমার) চক্রান্তে সরস্বতীর
বিরাগভাজন হবার পর কেদারের মুখে ‘এই করেছ ভালো, নিঠুর হে’ শুনে মা চমৎকৃত হয়ে বলে
উঠেছিলেন, “কি শিল্পসম্মত প্রয়োগ!” তারও আগে চিত্রাঙ্গদার বেশে সরস্বতীর মুখে
‘বঁধু, কোন আলো লাগলো চোখে’র মধ্য দিয়ে পরিচালক পরিস্ফুট করলেন কেদারের মনে
অব্যক্ত ভক্তি-মেশানো প্রেমের জাগরণ, আবার কেদারের মাধ্যমে আপাত-কঠোর সরস্বতীর
অন্তরে যে ভালোবাসার আলো পড়তে চলেছে, তারও ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। ধন্য তরুণবাবু! এর
অনেক পর ‘আলো’ (২০০৩)তে ‘শ্রাবণের ধারা মতো’ আর ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, আর
সাম্প্রতিক ‘ভালোবাসার বাড়ি’ (২০১৮)তে ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’! আপনি স্বয়ং
কবিগুরুর আশীর্বাদ-ধন্য।
অন্য গানগুলিই বা কম কিসে? আমি তো মুগ্ধ
হয়েছিলাম ‘এসো প্রাণ-ভরণ দৈন্য-হরণ হে’ উপাসনাসঙ্গীতটি শুনে! আবার, বসন্ত-উৎসবে
‘কী রূপে যে কখন আসো ওগো বসন্ত’! মাঝে কাহিনিকার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের
স্বরচিত ‘জনম অবধি’, যাতে কীর্তন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, ভাটিয়ালী,পশ্চিমী আধুনিক – সব
মিশিয়েছেন সুররত্নাকর হেমন্ত, আর কণ্ঠে রেখেছেন মান্না দে’কে! আর হৃদয়েশ পাণ্ডের
হিন্দি-বাংলা মেশানো হোলি-দোলযাত্রার গানে বিহারী হিন্দিভাষীর কণ্ঠ যে হেমন্তর তা তো
রেকর্ড কেনার আগে বুঝতেই পারিনি! এই ছবির জন্যে শুনেছি হেমন্ত পেয়েছিলেন ‘পঙ্কজ
মল্লিক স্মৃতি পুরষ্কার’, যা তাঁর সুরসৃষ্টির প্রতি প্রাপ্য সম্মানই প্রদর্শন
করেছিল।
এক কথায় নিস্পাপ সততা, সরলতার জয়
আত্মম্ভরিতা আর অতি-চালাকির বিরুদ্ধে – ছবির কাহিনির অন্যতম বক্তব্য বোধহয় এই।
কেদারের নম্রতা, নিজের সম্বন্ধে বেশ খানিকটা হীনমন্যতা, অন্যকে নির্দ্বিধায়
বিশ্বাস করা, কারুর দ্বারা নির্যাতিত এবং প্রতারিত হয়েও তার অমঙ্গল কামনা না করা,
এবং ভালোবাসার মানুষ ভুল বুঝে কষ্ট দিলেও পূজা-মিশ্রিত প্রেমে তাকে অভিবাদন –
লিখতে-লিখতেই চোখে জল এসে যাচ্ছে!
আর সরস্বতী আপামর যুবকের হৃদয়ে বাণ হেনেছিল,
ব্যতিক্রম বোধহয় শুধু আমি! সরস্বতীর ছোট বোন বিনি (দেবশ্রী রায়) যখন জানলার মধ্যে
দিয়ে চোখ তুলে তার হবু স্বামীর (অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়) দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করছে, “তোমার শরীর ভালো আছে?” তখন আমি পুরো কাৎ!
দেবশ্রীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে-খেতে এর পর তাঁর দেখা পাব অপর্ণা সেনের 36 Chowringhee Lane ছবিতে! সেখানে তাঁর ক্রিয়াকলাপ দেখে তো আমি
ভগ্নহৃদয়! শেষে তরুণবাবুই আমার কষ্টের ‘মেঘমুক্তি’ ঘটাবেন। সে কথা যথাস্থানে (১ম
পর্বে) বলা হয়ে গেছে। শুধু একটা কথা মনে খটকা লাগায়! ১৯৮০তে ছবিটি মুক্তি পাবার
সময় পোস্টারে দেখেছিলাম ‘জীবনে যখন প্রথম রামধনু ওঠে!’ কে এই কথা লিখেছিলেন এবং
কেন, জানি না। এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে প্রশ্ন জাগে, এই উক্তির মধ্যে ভোম্বলের
ক্রমাগত কেদারের পেছনে লাগা এবং শেষ অবধি কেদারের কাছে নতিস্বীকারের কোন কারণের
প্রতি ইঙ্গিত আছে কিনা!
১৯৮২ সালে আমি অবশেষে যতীন দাস পার্ক-সংলগ্ন
শ্যামাপ্রসাদ (সান্ধ্য) কলেজে অধ্যাপনায় রত হই। মোটামুটি এই সময়েই ‘ভারতী’তে পুনর্মুক্তি
পায় ১৯৫৪ সালের সুপারহিট হিন্দী ছবি ‘নাগিন’, যাতে সুরারোপ করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ভারতজোড়া খ্যাতি লাভ করেন
তাঁর ‘হেমন্তকুমার’ অভিধায়। তাঁর আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’ পড়েছিলাম কিভাবে ক্ল্যাভিওলাইন
যন্ত্রের সঙ্গে হারমোনিয়ম মিশিয়ে এক অদ্ভুত উপায়ে সাপুড়েদের বীণ-এর ধ্বনি সৃষ্টি করেছিলেন
হেমন্ত। আমি হেমন্ত-পূজারী, আর এই ছবি দেখার সুযোগ হারাব?
সত্যি কথা বলি? ছবির কাহিনি বহুশ্রুত,
সাপুড়েদের দুই যুযুধান সম্প্রদায়ের সভ্য সনাতন (প্রদীপকুমার) আর মালা (বৈজয়ন্তীমালা)-র
মধ্যে কণ্টকাকীর্ণ প্রেম, হরেদরে সেই রোমিও-জুলিয়েট, যদিও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মিলনান্তক,
বিয়োগাত্মক নয়। গানগুলি সুখশ্রাব্য কিন্তু আমার অশিক্ষিত শ্রবণে ঐ ১৯৫৪-তেই একই প্রযোজনা-সংস্থা (ফিল্মিস্তান) থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত, এবং ১৯৬৯ সালে ইস্কুলে প্রদর্শিত
‘আনারকলি’ ছবির গান অনেক, অনেক বেশী হৃদয়গ্রাহী ছিল! সেগুলোও ছিল, একটি বাদে, লতা
মঙ্গেশকর আর হেমন্তর কণ্ঠে। পরে সঙ্গীত-বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যুক্তিগ্রাহ্য
ব্যাখ্যা শুনেছি যে কোন কোন প্রায়োগিক কারণে ‘নাগিন’-এর সঙ্গীতই তুলনায়
যুগান্তকারী ছিল। আর হেমন্ত স্বয়ং তো বলেইছেন যে বর্তমানে সাপুড়েরা ‘নাগিন’-এর
বীণের সুরই বাজায়! এও শুনেছি যে বৈজয়ন্তীমালা কোনো রেস্টুরেন্টে
গেলে সেখানকার ব্যান্ড তৎক্ষণাৎ ‘মন ডোলে মেরা, তন ডোলে মেরা’-র সুর বাজাতো!
১৯৮৮-তে বিদেশ থেকে ফেরার পর শেষবারের
মতো ‘ভারতী’তে গেছি অজয় কর পরিচালিত এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত-সমৃদ্ধ শরৎচন্দ্রের
‘দত্তা’ দেখতে, নাম ভূমিকায় সুচিত্রা সেন। ছবিটি প্রথম ১৯৭৬-এ ‘শ্রী’ আর ‘ইন্দিরা’য়
মুক্তি পেয়েছিল।
অরুণা
অবশেষে ১৯৮২ সালে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের
প্রেমে পড়ি শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশে ‘অরুণা’য়
১৯৫৭ সালের ‘হারানো সুর’ দেখে। আজও আমি তাঁর মুগ্ধ ভক্ত! এর আগে সত্তরের
দশকে তাঁকে দেবী চৌধুরাণী-রূপে যে মনে ধরেনি তা প্রথম পর্বেই বলেছি। পরে ‘পূর্ণ’-তে
‘ঢুলী’ দেখে তাঁর রূপলাবণ্য এবং অভিনয়-ক্ষমতা উপলব্ধি করেছিলাম; সে কথা পরে। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে
‘হারানো সুর’-এ উত্তমই অভিনয়ে মহানায়িকাকে টেক্কা দিয়েছেন, আমার তো মনে হয় উত্তম
ইচ্ছে করেই, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে, একটু চেপে অভিনয় করেছেন, সুচিত্রাকে
আবেগ-প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ ছেড়ে দিয়ে, আর প্রথমার্ধে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এটাই
অভিনেতা-পরিচালকের মধ্যে ‘টিম ওয়ার্কের’ নিদর্শন। মূল কাহিনির (James Hilton-এর উপন্যাস ‘Random Harvest’ এবং সেটির ওপর আধারিত ১৯৪২ সালের Ronald
Coleman ও Greer Garson অভিনীত ছবিটি) তুলনায় ‘হারানো সুর’-এর চিত্রনাট্যও দুর্বল লাগে আমার, যদিও
‘শাপমোচন’-এর মতো ততটা নয়। তবে অভিনয়, আবহ-সঙ্গীত এবং গান মিলে সব ত্রুটি ঢেকে
দিয়েছে। ‘তুমি যে আমার’ গানটি ছবিটি দেখার আগে প্রথম শুনি উত্তমকুমারের প্রয়াণের
পর HMV-র ‘মহানায়ক উত্তমকুমার’ নামক
ডিস্কে। শুনে যেন কি-রকম অদ্ভুত লেগেছিল, মনে হয়েছিল গীতা দত্ত যেন যাকে বলে
‘এদরে-এদরে’ কথাগুলো উচ্চারণ করছেন। অনেক,
অনেক পরে, তরুণ মজুমদার তাঁর ‘ভালোবাসার অনেক নাম’ (২০০৬) ছবিতে যে একাধিক পুরনো
দিনের বাংলা ও হিন্দি গান নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে
‘তুমি যে আমার’ একটি।
অজয় করের স্মৃতিচারণায় পড়েছি যে ‘হারানো
সুর’-এর আগে সুচিত্রা খ্যাতি লাভ করেছিলেন ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ (১৯৫৩) ছবিতে
বিষ্ণুপ্রিয়া-রূপে, কিন্তু সে অভিনয় অজয়বাবুর মনে তেমন দাগ কাটেনি। তাঁর নিজের
‘গৃহপ্রবেশ’ (১৯৫৪) ছবিতে সুচিত্রার অভিনয় নিয়েও অজয়বাবু কিছু বলেননি। ‘তুমি যে
আমার’-এর চিত্রায়নের আগে সুচিত্রা পরিচালককে নাকি প্রশ্ন করেন কিরকম অভিব্যক্তি
দিতে হবে। উত্তরে অজয়বাবু বলেন যে একজন যুবতী সদ্য প্রেমে পড়ে যেমন করে সেইরকম একটা
কিছু, আর কি! এরপর একটু ভেবে নিয়ে মহানায়িকা যা শট দেন, তাতে পরিচালক বাক্যহারা
হয়ে পড়েন! ১৯৮২ সালে ছবিটি দেখে বুঝতে পারি কেন ঐ দৃশ্যটি এবং তার সঙ্গের গানটি
অনেকের মতো আমার কাছেও মধুর, মার্জিত প্রেমের এক চিরকালীন দলিল এবং সংজ্ঞা! অথচ
হেমন্ত যখন গানটি প্রথম উত্তমকুমার এবং অজয় করকে শোনান, দুজনেই নাকি মুখ
চাওয়া-চাওয়ি করে, দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলেছিলেন, “বেশ!” তারপর হেমন্ত জানান যে গানের
রেকর্ডিং হবে কলকাতায় নয়, বোম্বেতে, কারণ এই গানের জন্যে যে প্রযুক্তির প্রয়োজন তা
কলকাতায় নেই, এবং সর্বোপরি, গাইবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নন, গীতা দত্ত, কারণ
হেমন্তবাবুর মতে আর কারুর পক্ষে এই গানের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব নয়। হেমন্তবাবু
চলে যাবার পর, প্রযোজক-পরিচালকদ্বয় উপস্থিত দোর্দ্যণ্ডপ্রতাপ চলচ্চিত্র-সম্পাদক
অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে নাকি বলেন, “যাক গে, অসুবিধে হ’লে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত
দিয়ে দেওয়া যাবে ’খন!” দ্বিতীয় গান হিসেবে নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীতই বাছা হয়েছিলঃ
‘আমার এ পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে’। পরে ঐ গানের অনুপ্রেরণাতেই
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লেখেন ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ ওগো দু’টি দিকে গেছে বেঁকে’। ছবির
প্রোজেকশান চলাকালীন নাকি পরিচালক অজয় করের মনে হয় গানটি নিস্প্রয়োজন, আর ছবিকে
অকারণ দীর্ঘায়িত করছে। তাঁর কথা অনুযায়ী সম্পাদক অর্ধেন্দুবাবু নাকি তাঁর কাঁচি
নিয়ে প্রোজেকশান রুমে উঠতে উদ্যত হয়েছিলেন, অজয়বাবুর ভাষায় গানটি ‘কাইট্যা’ দিতে! কিন্তু
ছবির নাম ‘হারানো সুর’ এবং সুরকার সুরের জহুরী হেমন্ত! পরলোক থেকে শেষ হাসি এখনো
হাসেন আমার জীবনদেবতা!
‘অরুণা’তে এরপর
১৯৮১ সালে আরও দু’বার যাই, প্রথমবার দাদাকে ‘দাদার কীর্তি’ দেখাতে, এবং পরের বার বাবাকে দ্বিতীয়বার এবং মা এবং নিজেকে চতুর্থবার
উক্ত ছবিটি দেখাতে!
রূপবাণী
স্বয়ং কবিগুরুর
দেওয়া নামের এই প্রেক্ষাগৃহে মোট দু’বার গেছি, ১৯৮৮-এ বিদেশ থেকে ফেরার পর। একবার
আমার হবু-শাশুড়িকে নিয়ে সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত শরৎচন্দ্রের ‘রাজলক্ষ্মী ও
শ্রীকান্ত’ (১৯৫৮) দেখতে। ব্যক্তিগত মতঃ
শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ থেকে বাংলায় যে
চারটি ছবি হয়েছে - ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ (১৯৫৮), ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত
ও অন্নদাদিদি’ (১৯৫৯), ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ (১৯৬৫), এবং ‘কমললতা’ (১৯৬৯) – তার
মধ্যে এই প্রথম ছবিটিই খানিকটা অতিদীর্ঘ
লেগেছে, বাংলা ছবির সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর উপস্থিতি সত্বেও। এঁরাই আবার ‘কমললতা’-য়
মুগ্ধ করবেন।
১৯৮৯-তে দেখা
শেষ বাংলা ছবি, হাতিবাগানের ‘রূপবাণী’তে আমার হবু-শ্যালিকার সঙ্গে ‘শ্রীমতী
হংসরাজ’। ১৯৭৬-এর মূল ছবির – যা দেখেছিলাম
কৃষ্ণনগরে ‘ছায়াবাণী’ নামের প্রেক্ষাগৃহে – ধারে-কাছে আসে না, কি গল্প, কি অভিনয়,
কি গানে। একমাত্র টিয়ারূপিনী শতাব্দী রায়ের জন্যে শেষ অবধি বসে ছবিটা দেখতে
পেরেছিলাম।