কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১১৭ / একাদশ বর্ষ : সপ্তম সংখ্যা

 


 

 

চিন্তা প্রকাশনী থেকে সম্প্রতি মলয় রায়চৌধুরীর একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে আমার সম্পাদনায়, শিরোনাম ‘চাইবাসা আবিষ্কার’। চাইবাসাকে আবিষ্কার করার জন্য অবশ্য চাইবাসায় যেতে হয়নি, কেননা তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, চাইবাসায় সংঘটিত সাহিত্যের একটি কালখন্ডের ইতিহাস। আমার এমন কোনো আবিষ্কারের প্রয়াস আদৌ নেই, তবে আমি কোথাও প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে বেড়াতে গেলে সেখানকার একটা মোটামুটি পরিচিতি অনুসন্ধান করি। সেইসব স্থানের ভৌগলিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক পরিচিতি। এই যেমন দিন কয়েক আগে আমরা বন্ধুরা গেছিলাম পুরুলিয়া জেলায় একটি মনোরম জায়গায়। বড়ন্তি। জায়গাটির এমনিতে কোনো ভৌগলিক বা ঐতিহাসিক অথবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা গুরুত্ব নেই, তবে প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্যে অসাধারণ। যেদিকেই চোখ  মেলি, সেদিকেই প্রকৃতি যেন অদ্ভুত সুন্দরভাবে সেজে বসে আছে। দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মন জুড়িয়ে যায়। এমন একটা জায়গায় দু’দিন অতিবাহিত করে আমার মনে হয়েছে, সব সৃষ্টিশীল মানুষের এখানে আসাটা একান্ত জরুরি। যিনি কবিতা-গল্প লেখেন, যিনি অঙ্কনশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী – সবাই এখানে এসে প্রকৃতির অনবদ্য রূপ ও সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হতে বাধ্য। এবং শুধুমাত্র কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী নয়, যিনি সাহিত্যবোদ্ধা, শিল্পবোদ্ধা, সংস্কৃতিবোদ্ধা – সবাই এক অনস্বাদিত ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন। আমি জানি না, আমার এই মাত্র দু’দিনের এই পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত বড়ন্তি গ্রাম, পাহাড় ও লেকের সান্নিধ্যে এসে কী আবিষ্কার করেছি, কিন্তু মনের আনন্দ যে খুঁজে পেয়েছি, তা বলাই বাহুল্য। আসলে আমরা যারা কোনো সৃষ্টিমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকি এবং নতুন কোনো সৃষ্টির প্রয়াস করি, তাদের প্রতিদিনের ঘেরাটোপ থেকে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসাটা একান্ত প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনের কথা মনে রেখেই স্বয়ং প্রকৃতি যেন আনন্দের ভাঁড়ার গচ্ছিত রেখেছে তার প্রতিটি কোণে, প্রতিটি খাঁজে।

 

এই বড়ন্তি থেকেই আমরা দেখতে গেছিলাম পুরুলিয়ায় অবস্থিত জয়চন্ডী পাহাড়। যদিও জয়চন্ডী একটি পাহাড়ের নাম, কিন্তু মূলত চারটি পাহাড়ের সমষ্টিকে জয়চন্ডী পাহাড় নামে অভিহিত করা হয়। এই চারটি পাহাড়ের আলাদা আলাদা নাম আছে – যোগীঢাল, রামসীতা, সিজানো ও জয়চন্ডী। জয়চন্ডী পাহাড়ের চূড়ায় আছে জয়চন্ডী মায়ের মন্দির। এই মন্দিরে পৌঁছতে গেলে পাঁচশোর বেশি সিঁড়ি ভাঙতে হয়। অনেকেই সিঁড়ি ভেঙে জয়চন্ডী মায়ের মন্দির দর্শন করে আসেন। এই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অথবা পাহাড়ের পাদদেশ থেকেই চারিদিকে ছড়ানো প্রাকৃতিক রূপ  ও সৌন্দর্য দেখে মন আনন্দে ভরে ওঠে। তাছাড়ে এই পাহাড়ে স্পর্শ লেগে আছে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশে’র শ্যুটিং হয়েছিল জয়চন্ডী পাহাড়ে। পাহাড়ের পাদদেশে সত্যজিৎ রায়ের নামে একটি মুক্তমঞ্চ আছে, সেই মঞ্চ তিনিই উদ্বোধন করেছিলেন। শুনলাম, প্রতি বছর ২৮শে ডিসেম্বর থেকে ১লা জানুয়ারী পর্যন্ত জয়চন্ডী পাহাড়ে পর্যটন উৎসব ও মেলা উদযাপিত হয়। আগ্রহী পর্যটকদের আগমনে তখন রীতিমতো সরগরম থাকে সারাটা পাহাড়।

 

এবারের নিতান্ত সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ সূচিতে আরও  ছিল পুরুলিয়ার গড় পঞ্চকোটও। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক  স্থান। বি ডি ও অফিস, নিতুরিয়া ব্লক, পোস্ট রামকানালির সৌজন্যে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তি পড়ে জানতে পারলাম, পঞ্চকোট রাজবংশের রাজপুরোহিত ও সভাপন্ডিত রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী 'পঞ্চকোট ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, মহারাজা বিক্রমাদিত্যের উত্তরপুরুষ উজ্জয়নী নগরীর ধার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দেও সিংহের পুত্র দামোদর শেখর সিংদেও (জন্ম ঝালদায় ৮০ খৃষ্টাব্দে) যে 'শেখর রাজবংশে'র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই রাজবংশের ৩১তম রাজা কীর্তিনাথ শেখর (রাজ্যাভিষেক ৯২৬ খৃষ্টাব্দ) এর পর কোনো এক সময়ে তাঁর রাজধানী পাড়া থেকে পঞ্চকোট পাহাড়ের দক্ষিণ পাদদেশে স্থানান্তরিত করেন। এখানে প্রায় তিরিশজন রাজা দীর্ঘ আটশ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় রাজত্ব করেন। ১৭৫০ খৃষ্টাব্দে মহারাজা শত্রুঘ্ন শেখরের আকস্মিক মৃত্যুর পরে সিংহাসন নিয়ে একাধিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ফলে রাজধানী প্রথমে মহারাজনগর, পরে ১৭৬২-৬৩ সালে রামবনী মৌজায়, ১৭৯৩ সালের পরে কেশরগড় এবং  অবশেষে ১৮৩২ সালে কাশীপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। এবং পঞ্চকোট তারপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। ১২ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে পঞ্চকোট গড় (রাজধানী)  সুরক্ষিত ছিল সেইসময়। উত্তরে পঞ্চকোট (শিখর) পাহাড়, অন্য তিনদিকে পরিখা ও মাটির প্রাচীর। প্রাচীরগুলোতে ছিল প্রবেশ তোরণদ্বার মোট পাঁচটি। চারটি তোরণদ্বার এখন আর নেই, একটি তোরণদ্বার 'দুয়ার বাঁধ' এখনো টিকে আছে।

 

পঞ্চকোট দর্শনে এসে আমাদের মন তার চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও পাহাড়ের প্রশান্তিতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের হেরিটেজ কমিশন পঞ্চকোটকে হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে তার সংস্কার এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। পুরো এলাকাটিকে জোন অফ সাইলেন্স বা নৈ:শব্দের এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর তাই এই এলাকায় মাইক, ডিজে এবং মোবাইলে জোরে গান বাজানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭২ সালে কাশীপুরে এসেছিলেন এবং পঞ্চকোট এস্টেটের ম্যানেজার হিসেবে প্রায় দু’মাস কাজ করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পঞ্চকোট নিয়ে তিনটি কবিতা রচনা করেছিলেন।

 

এছাড়া আমাদের ভ্রমণ সূচিতে ছিল বিহারীনাথ পাহাড় ও মন্দির। বিহারীনাথ পাহাড়ের পাদদেশেই বিহারীনাথ মন্দির। এই এলাকা অবশ্য পুরুলিয়া জেলার মধ্যে নয়, বরং বাঁকুড়া জেলার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের এই পাহাড় ও মন্দির দর্শনে যেতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছিল, প্রায় সন্ধ্যের মুখে পৌঁছেছিলাম। আর তাই বিহারীনাথ পাহাড়ের ছবি আলাদাভাবে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গত জানাই, বিহারীনাথ পাহাড় বাঁকুড়া জেলার সবথেকে উঁচু পাহাড়, উচ্চতা মোটামুটি ৪৫১ মিটার। আর এই পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘন অরণ্য পরিবেষ্টিত। বিহারীনাথ পাহাড়কে পশ্চিমবঙ্গের আরাকু ভ্যালি বলা হয়। বিহারীনাথ শিবের আরও এক নাম, আর সেই নামেই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। জনশ্রুতি আছে, বিহারীনাথের শিবলিঙ্গটি এখানকার রাজা স্বপ্নাদেশে পেয়েছিলেন। প্রতি বছর শিবরাত্রিতে এই উপলক্ষে মন্দির চত্বরে মেলা আয়োজিত হয়। শিবভক্ত মানুষের সমাগমে তখন বিহারীনাথ মন্দির এবং বিহারীনাথ পাহাড়ের পাদদেশ মুখরিত হয়ে ওঠে।

 

সবাইকে জানাই আমাদের শারদ শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

 

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 




<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৩

 


অনেক বিশ্বভ্রমণ হয়েছে। এবার আমরা পৃথিবী বিখ্যাত পরিচালকদের নিয়ে, তাঁদের কাজ নিয়ে কিছুদিন কাটাছেঁড়া করব। শুরু করব নিজের মহাদেশ এশিয়া দিয়ে। আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন, ইউরোপ আমেরিকা ছেড়ে এশিয়া দিয়ে শুরু করছি কেন? আমার বিনীত উত্তর, charity begins at home. এবং এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশ যদিও আমি দফায় দফায় কভার করেছি, অনেক নাম-না-জানা দেশ থেকেও অদ্ভুত সব সিনেমা তুলে এনেছি, আজ কিন্তু স্ট্রেট ড্রাইভ ছাড়া অন্য কোন শট মারব না। ফলে একদম ক্লাসিক পরিচালকদের নিয়েই আলোচনা। আমার আলোচনায় আজ যাঁরা যাঁরা আসবেন, তাঁদের নিয়েও কিন্তু ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পর্বে বলা হয়ে গেছে। দেখুন, ত্রয়ী হিসেবে এঁদের এভাবে যদি সাজাই -

১) জাপানের আকিরা কুরোশাওয়া, ইয়াসুজিরো ওজু, কেঞ্জি মিজোগুচি

২) ভারতের সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক

৩) চিনের চেন কাইগে, শ্যাং ইমো, ওয়াং কার-ওয়াই

৪) ইরানের কিয়ারোস্তামি, মখ্‌মলবাফ্‌, মজিদ মজিদি

৫) দক্ষিণ কোরিয়ার লি চাং-ডং, কিম কি-ডুক, পার্ক চান-উক

শুধুমাত্র ভারতের তিনজন বাদে বাকি সবাইকে নিয়ে আমি কিন্তু কোন না কোন পর্বে ছুঁয়ে গেছি। এবং আজ এইসমস্ত ত্রয়ীদের মধ্যে থেকে কোন একজনকে বাছতে বাছতে যাব। হতেই পারে, আপনার পছন্দ অন্যজন, এবং আমিও সেটাই চাইব। প্রায় তিনবছর এই ধারাবাহিক চলছে, এবার আর আমার কথা শুনবেন না, বরং নিজের পছন্দের ওপর, নিজের স্বাদের ওপর ভরসা রাখুন।

জাপানি ছবির প্রায় প্রতি শটে ল্যান্ডস্কেপিং ফুটে ওঠে। ফলে জীবন বা রহস্য বা জটিলতা বা ফিকশন, সব কিছুই প্রকৃতির মাঝে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ভাবুন, জাপানি ছবির স্বর্ণযুগে একদিকে যেমন আকিরা কুরোশাওয়া রশোমন (১৯৫০), ইকিরু (১৯৫২), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪)-এর মত অনবদ্য ছবি বানিয়ে চলেছেন, আরেকদিকে ইয়াসুজিরো ওজু লেট স্প্রিং (১৯৪৯), আর্লি সামার (১৯৫১), টোকিয়ো স্টোরি (১৯৫৩) বানাচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে কেঞ্জি মিজোগুচি তৈরি করছেন দ্য লাইফ অব ওহারু (১৯৫২), উগেৎসু (১৯৫৩), সানশো দ্য বেইলিফ (১৯৫৪) ইত্যাদি। গায়ে কাঁটা দেয়। দুর্ভাগ্য, মিজোগুচি বেশিদিন বাঁচেননি। বাঁচলে আরো অনেক মনে রাখার মত সিনেমা আমরা পেতাম। তবে জাপানে আমার প্রথম পছন্দ আকিরা কুরোশাওয়া। কারণ আমার মতে, রশোমনের যাত্রা দিয়েই জাপানের সিনেমা আন্তর্জাতিক হয়।  এক হত্যা আর এক ধর্ষণ, সেই নিয়ে চারজন সাক্ষীর চার রকম ভিন্ন বয়ান, যা থেকে পরবর্ত্তীকালে ‘রশোমন এফেক্ট’ আইনের চোখে এক স্বীকৃত তত্ত্ব হয়ে ওঠে। কুরোশাওয়ার ছবি ভাললাগার প্রধান কারণ  তিনটে। এক, ভিস্যুয়াল এফেক্ট। অনবদ্য ক্যামেরা। দুই, বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হয়। তিন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এই তিন মিলে কুরোশাওয়ার ক্যানভাস যেন জীবন্ত কবিতা। আসলে, কুরোশাওয়া, কিউব্রিক, বার্গম্যানের মত পরিচালকেরা ক্যামেরার পেছনে চোখ লাগিয়ে সেলুলয়েডে রং-তুলি নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। তাই তাঁদের ছবি অনুভব করতে হয়, বুদ্ধি দিয়ে ধরতে হয়। ভাবলে অবাক লাগে, কুরোশাওয়া জাপানি হয়েও রাশিয়ান ছবি (দারসু উজালা) পরিচালনা করেছেন, সেটাও এক পর্বে লিখেছিলাম।

সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিককে নিয়ে এখানে কিছু লিখব না। কারণ এঁদের ছবির বিষয়ে আমরা সবাই জানি, হয়ত আপনারা আমার থেকেও বেশি জানেন। তাই চর্বি চিবোব না। কিন্তু হ্যাঁ, এই ধারাবাহিক শেষ হবার পর আলাদা এক লেখায় এঁদের নিয়ে অন্য এক অ্যাঙ্গল থেকে লিখব, আশা করছি সেটা আপনাদের মনে  ধরবে। আপাতত এটাই বলতে পারি, সত্যজিৎ যেমন গ্রাম্য ও মফস্বল বাংলাকে জীবন্ত করেছেন, মৃণাল মানুষের এক শ্রেণীর না পাওয়ার বেদনাকে ক্যামেরার আয়নার সামনে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে এনেছেন, তেমনি ঋত্বিক দেশভাগের যন্ত্রণাকে বয়ে বেড়িয়েছেন সেলুলয়েডের ফ্রেম থেকে ফ্রেমে। কিন্তু আমাকে যদি এঁদের  ভেতর থেকে কাউকে বেছে নিতে বলা হয়, আমি টেকনিকাল লোক হিসেবে টেকনিকালি পারফেক্ট সত্যজিতকেই বাছব।

এই লেখার ১৯তম পর্বে বলেছিলাম, চিনের ছবি সাহসী হতে পারেনি, কিন্তু তাই বলে চিনের ছবি দুর্বল নয়, বরং মূলত ইতিহাস আশ্রয়ী। এবং সেই কারণেই চিনের ছায়াছবির সিনেমাটোগ্রাফি কিন্তু বেশ শক্তিশালী। চিনের যে তিনজন পরিচালকের নাম আমি ওপরে লিখেছি, তাঁরা সবাই কমবেশি ঐতিহাসিক ছবি বানিয়েছেন। চেন কাইগে ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ করেই পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে গেলেন, এবং কার-ওয়াই ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ করে, কিন্তু শ্যাং ইমো আস্তে আস্তে উঠেছেন। রেড সোরঘাম থেকে শুরু করে জু দো, রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন, টু লিভ, দ্য রোড হোম হয়ে হিরো হয়ে কামিং হোম অব্ধি। ইতিহাস, পারিবারিক ড্রামা, যুদ্ধের ছবি, যৌনদাসী প্রথা, রাজনৈতিক বন্দী। সবধরনের ছবি। আজ তাই আমি বেছে নিলাম শ্যাং ইমো-কে। অবশ্য আমি জানি আমার নিন্দুক পাঠক, যাঁরা ১৯ নং পর্ব খুঁটিয়ে পড়েছেন, বলবেন যে, গং লি এর প্রধান কারণ। হ্যাঁ, শ্যাং ইমো-কে বাছার আরেক কারণ হল উনি আমার অন্যতম  প্রিয় নায়িকা গং লি-কে ওনার ছবির মধ্যে দিয়েই বিখ্যাত করেছিলেন। কিন্তু যে কারণে শ্যাং ইমোকে আমি এগিয়ে রাখব, তা হল সিনেমাটোগ্রাফি। উনি নিজে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে শুরু করেছিলেন। এবং সময় যত এগিয়েছে, ওনার ছবিতে রং-এর ব্যবহার যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গল্প বলার ধরন যেন প্রা্ণ  পেয়েছে। রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন দেখুন। বুঝবেন। চিন জাপান যুদ্ধের পটভূমিকায় জু দো দেখুন, চিনের প্রাচীন রীতি নীতির বর্ণনা, আবার উল্টোদিকে সম্প্রতি তৈরি ওয়ান সেকেন্ড (২০২০) দেখুন, সত্তরের রাজনীতির আবহে গল্প কী ভাবে বলতে হয়, সিনেমার গুরুত্ব কাকে বলে, সিনেমা মানুষের জীবন কি করে বদলে দেয়।

ইরানে কিয়ারোস্তামির সিনেমা যেমন বেশিরভাগ সোশাল স্যাটায়ার – বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে চাবুক, মজিদির ছবি যেমন গ্রাম্য ইরানের পটভূমি ফুটিয়ে তোলে, ভাললাগার রেশ রেখে যায়, মখ্‌মলবাফের ছবি উল্টোদিকে রাজনৈতিক, জটিল ও সাহসী। আর সেজন্যই আজ আমি মোহসেন মখ্‌মলবাফকেই বেছে নিলাম। কিয়ারোস্তামির সিনেমাতেও এক জায়গায় মখ্‌মলবাফের রেফারেন্স এসেছে। ৯০এর দশকে মখ্‌মলবাফ্‌ হয়ে ওঠেন ইরানের সিনেমার প্রধান মুখ। ক্রিটিকাল কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। দ্য সাইক্লিস্ট (১৯৮৯), ওয়ান্স আপন এ টাইম, সিনেমা (১৯৯২), হ্যালো সিনেমা (১৯৯৫), এ মোমেন্ট অব ইনোসেন্স (১৯৯৬), দ্য সাইলেন্স (১৯৯৮), কান্দাহার (২০০১), সেক্স অ্যান্ড ফিলজফি (২০০৫) ইত্যাদি অদ্ভুত এবং সাহসী সব সিনেমা। এর মধ্যে আমার ফেভারিট ‘সেক্স অ্যান্ড ফিলজফি’। সেটাও আগেই বিস্তারিত লিখেছি। ১৮ নম্বর পর্বে। আসলে আমি সাহস খুব পছন্দ করি। মখ্‌মলবাফ্‌ যেমন আদ্যান্ত ভয়ডরহীন, তেমনি তাঁর সিনেমার স্টাইল। বনিবনা হয়নি বলে মখমলবাফ্‌ ইরান ছেড়ে চলে যেতেও দ্বিধা করেননি। এটাই তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য। ওনার মেয়ে সমীরার বানানো কয়েকটা ছবিও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত,  ক্রিটিকাল।

আগেই বলেছি, দক্ষিণ কোরিয়ান সিনেমার কয়েকটা ধাঁচ আছে। বেশিরভাগ ছবি এখানে কোন এক ফ্যামিলি ঘিরে তৈরি হয়, যার শেষে লুকিয়ে থাকে রহস্য বা সূক্ষ্ম অনুভূতি। অথবা সমাজের দু’একজন দলছুটকে নিয়ে তৈরি হয়, যারা বিভিন্নভাবে কাছাকাছি আসে এবং সেখানেও থাকে রহস্য। অথবা কোন রহস্যঘেরা ঘটনা নিয়ে আদ্যান্ত অনুভূতির সিনেমা। আর এই কারণেই আজ আমি কোরিয়ার তিনজনের মধ্যে থেকে বেছে নেব ভার্সেটাইল পরিচালক লি চাং-ডং কে, কারণ একদিকে পোয়েট্রি, ওয়েসিস, টু দ্য স্টারি আইল্যান্ড, অন্যদিকে পেপারমিন্ট ক্যান্ডি, আবার আরেকদিকে বার্নিং আর হার্টবিটের মত ছবি। ওনার পোয়েট্রি, পেপারমিন্ট ক্যান্ডি আর বার্নিং নিয়ে আমি ৫ নম্বর পর্বে লিখেছি। উৎসাহী পাঠককে অনুরোধ, সেই রেফারেন্স ঘেঁটে একটু দেখে নিন। আর ওনার এই তিনখানা সিনেমাও দেখুন। আমি আজ অব্ধি ঐ ‘বার্নিং’ নামের মানে খুঁজে ফিরছি। ধাঁধাঁ।

হ্যাঁ, কোরিয়ার ছবির কথা বললে এখনো ভারাক্রান্ত লাগে। এই ধারাবাহিক শুরু করেছিলাম ২০২০ সালে, কোভিড ও লকডাউনের আবহে, সেই সমস্ত সিনেমা কলমের ডগায় তুলে এনে। যখন সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম, এবং প্রথম যে দেশের সিনেমা নিয়ে কাটাছেঁড়া করলাম – কোরিয়া, এখনো মনে আছে সেটা ডিসেম্বর ২০২০। কিম কি-ডুকের রহস্যময় ‘দ্য আইল’ দেখছি আর ভাবছি এই সিনেমাটা আমার লেখায় আনব কিনা, খবর পেলাম, উনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমরা কোভিডাচ্ছন্ন হওয়ার পর বুঝেছিলাম, জীবনানন্দের কবিতা ‘সৃষ্টির মনের কথা, মনে হয় – দ্বেষ’ কত মর্মান্তিকভাবে সত্যি।

(ক্রমশ)


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

সাহিত্যিক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক কলমে তিন বাঙালী আইকন

সৌরভ মুখোপাধ্যায়, যুক্তি তক্কো আর গদ্য

প্রকাশকঃ অন্তরীপ পাবলিকেশন, ২০২৩

 


‘কথামুখ’-এ লেখক বলে দিয়েছেন যে তাঁর ‘আগের বইটির’ (ফোনের ওপারে নীললোহিত এবং অন্যান্য গদ্য) – যেটি ছিল ‘ব্যক্তিগত বা আত্মকথামূলক’ – তুলনায় বর্তমান সংকলনের লেখাগুলি ‘নৈর্ব্যক্তিক, বিচার-বিশ্লেষণ আর অনুসন্ধান-পর্যবেক্ষণে ঠাসা, তথ্য-যুক্তি-তর্কে খচিত।’ ন’টি লেখার মধ্যে পাঁচটিরই বিষয় বাঙালীর তিন ‘আইকন’ঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় এবং দেবব্রত বিশ্বাস। প্রথমে সেগুলি নিয়েই কথা হোক।

 

২য় পর্ব

বিষয় সত্যজিৎ

 

(১) সত্যজিৎ-উত্তমকুমার




একজন বিদগ্ধ উচ্চ-সংস্কৃতিমার্গী, বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র-নির্মাণে বিশ্বাসী। অপরজন মূলধারার জনপ্রিয় বাংলা ছবির একমাত্র এবং অদ্বিতীয় মহানায়ক, জনগণের নয়নমণি! এক আকাশে এত ভিন্ন দুটি সূর্য একসঙ্গে, পরস্পরের দীপ্তি অক্ষুণ্ণ রেখে, কি বিরাজ করতে পারে? ‘বাস্তবতার একটু অভাব: সত্যজিতের ‘নায়ক প্রবন্ধে (‘অন্তরীপ’-‘একাই ১০০’ সংখ্যা, ১৪২৮) এই সমস্যাসঙ্কুল প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়। এবং তাঁর বিশ্লেষণ থেকে এটাই উঠে আসে যে এক সূর্য অতি সূক্ষ্মভাবে অপরটিকে কলঙ্কিত করতে গিয়ে, এবার ইংরেজী প্রবচন উদ্ধৃত করতেই হচ্ছে, is hoist [hoisted নয়] with its own petard, যুগপৎ ছবিতে এবং বাস্তব জীবনে!

ছবির বিষয়বস্তু বাংলা ছায়াছবির একজন ‘স্টার’। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মধ্যভাগে (নায়ক মুক্তি পায় ১৯৬৬-তে) এ ছবির কেন্দ্রে যে একজনকেই মানাতো, তা সত্যজিৎ নাকি স্বীকার করেছিলেন যখন ঐ ভূমিকায় অভিনয়েচ্ছুক আরেকজনকে তিনি বলেন, “তুমি তো উত্তম নও!” কিন্তু, ‘নায়ক’ করার সময় সত্যজিতের ‘অনেকগুলি ছবি বাণিজ্যসাফল্যবঞ্চিত অথচ টলিঊডের বক্স অফিস বারংবার ফেটে পড়ছে উত্তমকুমারের নামে’! এর মানসিক প্রতিক্রিয়া, সৌরভবাবু দেখিয়েছেন, অত্যন্ত পীড়াদায়ক অবাস্তবতার সঙ্গে (সত্যজিৎ আর অবাস্তবতা!) প্রকট ছবিটির চিত্রনাট্যে এবং তার ফলে বিভিন্ন দৃশ্যের চিত্রায়নে।

ছবির মূল কাহিনি কি? জাতীয় পুরস্কার নিতে বাংলা ছবির তারকা অরিন্দম চ্যাটার্জী দিল্লী যাচ্ছে, এবং যাত্রাপথে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তার নানারকম মিথষ্ক্রিয়া হচ্ছে। একজন তারকা কলকাতা থেকে দিল্লী যাবে তো প্লেনে! কিন্তু তাহলে তো খুব বেশী মানুষের সঙ্গে তার আদানপ্রদান হবে না! অতএব প্লেনের টিকিট না পাবার ছুতোয় তাকে চাপাও ট্রেনে – অবশ্য স্লিপার তো নয়ই – সেখানে সে mobbed হবেই, এমনকি এয়ার কন্ডিশনড ফার্স্ট ক্লাসেও নয়, (কারণ সে তো প্রায় প্লেনেরই সগোত্র, বেশী লোকজন কোথায়?) – এক ভেস্টিবিউল ট্রেনে, যেটিকে সৌরভবাবু সনাক্ত করেছেন ‘সম্ভবত ‘ডিলাক্স’ এক্সপ্রেস, যেটি পরে পূর্বা এক্সপ্রেসে রূপান্তরিত হয় (রাজধানী এক্সপ্রেস নয়, তা এসেছে আরও পরে)’ বলে। এই ট্রেনে অরিন্দমের সহযাত্রীরা, সৌরভবাবুর ভাষায় ‘উঁচুতলার শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ও কর্পোরেট জগতের প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা – যাকে বলে enlightened community, cream of the society – এবং বাংলার বাইরে অন্য প্রদেশের লোকজন, কেউ টালিগঞ্জের সুপারস্টারের প্রতি মনোযোগী নয়! সাদা বাংলায়, এরা তাকে পোঁছে না!’

এদের বিপরীতে অরিন্দমকে নিয়ে বিমুগ্ধা কারা? ‘মূলত মহিলারা – যারা আবার [ছবিতে অনেকাংশে সত্যজিতের মানসিকতার প্রতিভূ, শর্মিলা ঠাকুর রূপায়িত সাংবাদিক অদিতির মতো] ততটা আলোকপ্রাপ্তা নয়’! কিন্তু তাদেরও মুগ্ধতায় উত্তমকুমারকে ঘিরে বাস্তব জীবনে তৎকালীন মহিলাদের লাগামছাড়া উন্মাদনা নেই, সবাই ‘বেশ সংযত … দূর থেকে সামান্য বিস্ময়-উচ্ছ্বাস, নয়তো মুখে হাত চেপে চোরা ফিসফাস!’ এর পাশাপাশি রাখব উত্তমকুমারের আত্মজীবনী ‘আমার আমি’ থেকে নায়ক ছবির এক দশক আগে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনাঃ

(ক) ‘সবার উপরে’ (১৯৫৫) ছবির শুটিং চলছে আর তার সঙ্গে উত্তমকুমার স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী নাটকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করছেন। এক বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগরে আউটডোর শুটিং সেরে আবার হাতিবাগানে মঞ্চাভিনয় সেরেছেন তিনি। মেক-আপ তোলার সময় এক ভদ্রমহিলা, উত্তমের ভাষায় ‘অভিজাত কোন পরিবারের কূলবধূ’, এসে উত্তমকুমারকে জানান যে তিনি সেই কৃষ্ণনগর থেকে অভিনেতার গাড়ি অনুসরণ করে স্টারে উপস্থিত হয়ে, টিকিট কেটে মঞ্চে উত্তমের অভিনয় দেখেছেন। এরপর তিনি ঘোষণা করলেন, “আমি আর বাড়ি ফিরব না!” মহিলাকে অনেক বুঝিয়ে, মিনতি জানিয়ে, বহু কষ্টে তাঁকে শান্ত করে, তাঁর ফিরে যাবার ব্যবস্থা করা হয়।

(খ) ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭) ছবি তৈরির সময় উত্তমকুমার বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, এমন সময় তাঁর পথ আটকে দাঁড়ালেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। তাঁর শুকনো মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখমুখ উদভ্রান্ত। ক্ষিপ্তভাবে সে ভদ্রলোক প্রশ্ন করেন, “আপনিই তো উত্তমকুমার? … আমার স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে আজ চারদিন হ’ল বাড়ি থেকে বেরিয়েছে – আজও ফেরেনি –” … সেই ভদ্রমহিলাকে [উত্তম বলছেন] আমি চোখেও দেখিনি (দুটি ঘটনাই পাওয়া যাবে আমার আমি বইটির ১০০-১০১ নং পৃষ্ঠায়। প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮০, নতুন সংস্করণ ১৯৮৮)

এগুলো সত্যজিৎ-ভক্ত উন্নাসিকেরা উত্তমকুমারের অহমিকা-প্রসূত গালগল্প বলতেই পারেন, যেখানে উত্তম স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে ‘জনপ্রিয়তার এই নিদর্শনের কোন প্রমাণ হয়তো আজ আমি দাখিল করতে পারব না’। কিন্তু, বাস্তব জীবনে ‘নায়ক’ ছবির একটিমাত্র বিশেষ দৃশ্য শুটিং করতে গিয়েই হাওড়া স্টেশনে তুমুল জনজোয়ার ভেঙে পড়েছিল ‘গুরু’ উত্তমকুমারের জন্য, চরম নাজেহাল হতে হয়েছিল পরিচালককে। তখন কি তাঁর একটিবারও মনে হয়নি – ফিল্মে ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী অরিন্দম’কে নিয়ে তিনি যা ঘটাচ্ছেন তা একেবারেই বাস্তবের বিপরীত?’

উত্তরঃ না, মনে হয়নি। মূলধারা ও তার ধারক ‘ম্যাটিনি হিরোদের সম্পর্ক’ সত্যজিতের অশ্রদ্ধা এতটাই গভীর ছিল যে ‘ ‘নায়ক’-এর প্রিমিয়ারের দিন উত্তমকুমার যে ‘গণ-বিশৃঙ্খলার’ আশঙ্কা করেছিলেন, তা,  ‘এটা উত্তমকুমারের ছবি নয়, সত্যজিৎ রায়ের ছবি, এখানে ওসব কিছু হবে না’ বলে উড়িয়ে দিয়ে, ‘উপযুক্ত পুলিশি ব্যবস্থা বিনাই শো-এর শেষে প্রেস মিট পর্যন্ত ডেকে দিয়েছিলেন’ বিদগ্ধ, ‘সস্তা জনপ্রিয়তার’ বাস্তবরূপ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, পরিচালক। সৌরভবাবু বর্ণনা করেছেন কিভাবে এর ফলে রীতিমত দক্ষযজ্ঞ ঘটে এবং উন্মাদ জনতার হাত থেকে জনৈক অপরিচিত ভদ্রলোক উত্তমকে উদ্ধার করার আগেই ‘স্টার’-এর কোটের হাতা ছিঁড়ে নেওয়া হয়।

তাই ছবিতে বঙ্গ সংস্কৃতি, বিশেষ ‘সৎ’ চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা, নিরলসভাবে, হলিউডের অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডোর  ভাষায় ‘প্রতিশোধ’ নিয়েছেন মূলধারার বাংলা ছবি ও তার সবচেয়ে বড় প্রতিভূর ওপর। কারণ বাংলা ছবির  দর্শক – ইংরেজীতে the great unwashed masses – সত্যজিতের ‘উন্নতমানের’, ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ ছবির পৃষ্ঠপোষকতা না করে ভিড় জমায় ‘সূর্যতপা’, ‘কাল তুমি আলেয়াবা ‘রাজদ্রোহী’-র মতো ছবি যেখানে চলছে সেখানে!

এমনকি ‘নায়ক’ ছবির বহু-আলোচিত ‘খন্যান’ অংশে, অরিন্দম-উত্তম ‘প্লাটফর্মে নেমে চা-ওয়ালাকে ডেকে  চা খেলেন, কয়েকজন লোকও রয়েছে প্লাটফর্মে – কোথাও কোনও আলোড়ন হল না, নিরুপদ্রবে ভাঁড় শেষ করে মহানায়ক উঠে পড়লেন কামরায়! আবার মনে করাই … এ, কোনও সৌমিত্র-শুভেন্দু-প্রমুখ নন, এ ‘নায়ক’ কিন্তু আসলে ১৯৬৬-র জলজ্যান্ত উত্তমকুমার স্বয়ং, গ্রামবাংলার চাষিভূষিও যাকে এক-দেখায়  চিনতে ভুল করত না, ট্রেনের চা-হকারও না। সত্যজিৎ এখানেও … তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে যে চোরা statementটি রাখতে চাইলেন – দুঃখের সঙ্গে আমরা বলতে বাধ্য, তাতেও ‘বাস্তবতার একটু অভাব’!’

ছবিতে আরও অনেক সমস্যা নিয়ে সৌরভবাবু আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে উত্তমকুমার, এবং তাঁর মাধ্যমে, মূলধারার বাংলা ছবির প্রতি সত্যজিতের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রমাণ নিয়েই কথা বললাম। শেষ করব আমার প্রয়াতা মাতৃদেবীর মুখে শোনা একটি প্রবচন উদ্ধৃত করেঃ ‘হনুমানের ল্যাজে মোচড়’! নইলে রেল- কামরার স্টুডিওর মধ্যে তোলা দৃশ্যগুলিতে দুলুনির অভাব নিয়ে সাক্ষাৎ সত্যজিতের চিত্রায়নকে বাস্তবতার নিরিখে ‘শুন বরনারী’ (১৯৬০) ছবিতে অজয় করের চিত্রায়নের নীচে রাখা! সৌরভবাবুকে অন্তর থেকে  সাধুবাদ জানাই, বাংলা ছবি মানেই যে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক নন এই সত্যটি নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করার জন্য। অজয় কর, বিভূতি লাহা, তরুণ মজুমদার, এবং এঁদের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র, তপন সিংহের প্রতি বাঙালী দর্শকের ঋণ অপরিশোধ্য।

এই লেখার উত্তরে জনৈক সত্যজিৎ-ভক্ত অতি-অসন্তুষ্ট হয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন, যার একটিতেও কিন্তু সৌরভবাবুর দেখানো বাস্তবতার অভাবের প্রমাণগুলি যে কোনভাবে ভুল, তা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। ভক্ত মূলত তিনটি তথাকথিত ‘যুক্তি’ রেখেছিলেনঃ

(ক) ছবি যদি এতই ত্রুটিপূর্ণ হবে, তাহলে এত বছর পরেও লোকে ‘নায়ক’ দেখছে কেন?

উত্তরঃ এত বছর পরে লোকে শুধু ‘নায়ক’ নয়, উত্তমকুমারের মূল ধারার ছবিগুলি আরও বেশী সংখ্যায়  দেখছে, যেমন উপরে-উল্লিখিত ‘সূর্যতপা’, ‘রাজদ্রোহী’, বা অসম্ভব জনপ্রিয় ‘হারানো সুর’, যার গল্পেই অবাস্তবতা প্রকট।

(খ) ছবি যদি এতই ত্রুটিপূর্ণ, তবে তার ‘রিমেক’ হলো কেন?

উত্তরঃ সত্যজিতের মতোই তাঁর ভক্তও hoist [আবার বলি, hoisted নয়] with his own petard! হয়তো যে পরিচালক ‘অটোগ্রাফ’ বানিয়েছিলেন – সেই পরিচালক ব্যক্তি-হিসেবে যথেষ্ট আত্মম্ভরী – তিনি এইসব ত্রুটি, বা তাঁর নিজের চোখে অন্য কোন ত্রুটি, নায়ক ছবিতে দেখে সেসব ‘সংশোধন’ করে আরও ভাল একটি ছবি করতে চেয়েছিলেন! আর তা যদি নাও হয়ে থাকে, সেই একই পরিচালক উত্তমকুমারের আরও দুটি ছবি – ‘এ্যান্টনী ফিরিঙ্গী’ আর ‘সন্ন্যাসী রাজা’ - নিজের মতো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন! এতে কী প্রমাণ হয়? ছোট পর্দায় একটি চ্যানেল তো এক সময় ‘অতি-উত্তম’ শিরোপা দিয়ে মহানায়কের একের পর এক ছবি নতুন করে তৈরি করেঃ ‘হারানো সুর’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘পথে হ’ল দেরী’, ‘বিভাস’ ইত্যাদি। এগুলিও তাহলে নিখুঁত হবার দাবীতে ‘নায়ক’-এর পাশে রাখা যেতে পারে?

এবার, এই ‘যুক্তি’ যদি মেনে নেওয়া হয় যে ‘নায়ক’ এমনই নিখুঁত ছবি যে তাঁর পুনর্নির্মাণ অবধারিত – কারণ বাজারে শ্রেষ্ঠেরই নকল হয় – তাহলে সত্যজিতের বেশির ভাগ ছবিরই যে ‘রিমেক’ হয়নি, সেগুলি কি তত ভাল নয়? ‘অপুর তিনপর্ব’, ‘জলসাঘর’, কলকাতা ট্রিলজি তবে কি?

আর, চলচ্চিত্রের পুনর্নির্মাণ সারা বিশ্বের সিনেমায় অনেকবার হয়েছে ও হচ্ছে। তার মানে যে সব সময়েই ‘শ্রেষ্ঠের নকল’ তা একেবারেই নয়। ১৯৫৬ সালের The Ten Commandments এবং ১৯৫৯ সালের Ben Hur, দুটিই ছিল যথাক্রমে ঐ নামের ১৯২৩ ও, দ্বিতীয় ছবির ক্ষেত্রে ১৯০৭ আর ১৯২৫-এ হওয়া, ছবির ‘রিমেক’। এদের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে নানান মুনির নানান মত! আবার যে ছবিকে অনেকে সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ বলে থাকেন, সেই Citizen Kane কিন্তু পুনর্নির্মিত হয়নি!

(গ) সৌরভবাবু একটি অভিভাবন রেখেছেনঃ উত্তমকুমার ‘নায়ক’-এ অভিনয়কালীন সত্যজিতের উদ্দেশ্য  বুঝতে পারেন, এবং প্রত্যুত্তরে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দিয়ে উন্নাসিক (এবং ঈর্ষাকাতর) পরিচালককে মানসিকভাবে এতটাই নিরস্ত্র করেন যে মহানায়কের প্রয়াণের পর সত্যজিতের কলম থেকে বেরোয় ক্ষণজন্মা এই অভিনেতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা!

ক্ষিপ্ত সত্যজিৎ-ভক্ত এর উত্তরে শর্মিলা ঠাকুরের একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে সত্যজিৎ নিজে অভিনয় করে যা দেখিয়েছিলেন, উত্তমকুমার নাকি তাঁর মাত্র ষাট শতাংশ নিজে করতে পেরেছিলেন!

উত্তরঃ তাহলে তো সত্যজিৎ নিজের ছবি এবং তার দর্শকদের প্রতি অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন! কেন তিনি এমন এক অভিনেতাকে বাছলেন যিনি সত্যজিতের প্রত্যাশার মাত্র ষাট শতাংশ পূর্ণ করতে পারবেন? পরিচালকের তো উচিৎ ছিল, হয় তাঁর প্রিয় অভিনেতাকে ব্যবহার করা, নতুবা নিজেই ক্যামেরার পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ানো! চলচ্চিত্রে অভিনেতা-পরিচালকের তো অভাব নেই, কি হলিউডে (Orson Welles বা Clint Eastwood), কি বলিউডে (রাজ কাপুর বা দেব আনন্দ) কি টলিউডে (উত্তমকুমার বা অঞ্জন দত্ত)! সত্যজিৎ পরিচালক-অভিনেতা হয়ে দেখিয়ে দিতেই পারতেন!

আবার বলি, ভক্তের তিনটি তথাকথিত ‘যুক্তি’-র একটিও কিন্তু সৌরভবাবুর দেখানো ত্রুটিগুলির অস্তিত্ব  অস্বীকার করতে পারেনি!

আর শেষ কথা বলেছেন সৌরভবাবু স্বয়ংঃ

গোটা ব্যাপারটা ঠাকুর্দার ঝুলি-মার্কা আষাঢ়ে গপ্পোর পর্যায়ে নেমে আসছে দেখেও আমরা চুপ করে থাকি (অচলপত্রে দীপ্তেন সান্যাল যেমন বলেছিলেন একদা) – ‘কারণ পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়’! [The] King can do no wrong!’

 

(২) সত্যজিৎ-দেবব্রত বিশ্বাস




হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে সৌরভবাবুর পূর্বে-আলোচিত প্রবন্ধেই উদ্ধৃত হয়েছে ‘সঠিক’ রবীন্দ্রসঙ্গীত-গায়ন নিয়ে সত্যজিতের বিভিন্ন উক্তি। সেখানে হেমন্তর গায়ন সম্বন্ধে সত্যজিতের মতামত অনেকটা উত্তমকুমার এবং মূলধারার বাংলা ছবির প্রতি তাঁর তাচ্ছিল্যের সমতুল্য। ‘পপুলার’ গাইয়েরা ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের সূক্ষ্ম কাজগুলি … সরল সাদামাটা করে গান, কারণ তাদের গলায় সেই কাজের উপযোগী সক্ষমতা নেই’। ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় সত্যজিৎ অধিকাংশ গাইয়েদের ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, মাঝারিদের দলভুক্ত’  বলে বর্ণনা করেন, এবং তার পরে সুভাষ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় নাম করেই বলেন ‘এই তো ধরো আমাদের হেমন্তই তো … তবু লোকে শুনতে চাইছে’। আবার, ঠিক উত্তমকুমারের ভক্তদের মতো সেই great  unwashed masses-এর প্রতি অলিম্পিয়ান অবজ্ঞা! আর এই একই কথোপকথনে দেবব্রতর ‘ম্যানারাইজড’ ‘আকাশ ভ-ও-রা’ যখন সুভাষ চৌধুরী ভুল উচ্চারণ বলেন, তাঁর প্রতিবাদ তো সত্যজিৎ করেনইনি, বরং সহাস্যে বলেছেন “যেন একটু বিলিতি মেজাজ…”।

এমন একজন গর্বিত ‘এলিটিস্ট’ তাহলে দেবব্রত বিশ্বাস সম্বন্ধে কী মনোভাব পোষণ করতে পারেন, যে শিল্পীর শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডের বিক্রি নাকি অন্য সব রবীন্দ্র-শিল্পীদের বিক্রি ছাড়িয়ে গিয়েছিল শিল্পীর জীবদ্দশায়? উত্তরে সৌরভবাবুর মন্তব্যঃ ‘বিনোদনদাতা হিসেবে, স্বভাবগতভাবে একজন চিরকাল massকে প্রাধান্য দিয়ে গেছেন, অন্যজন classকে।

তাই, প্রত্যাশিতভাবেই, সত্যজিতের প্রভূত রচনার মধ্যে সৌরভবাবু পাননি ‘এই কিংবদন্তিপ্রতিম গায়কের কোনও সরাসরি প্রশস্তি এমনকি নিরপেক্ষ’ মূল্যায়ন! যা পাওয়া যায় তা হলো শিল্পীর প্রয়াণের পর উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর তথ্যচিত্র ‘গান আমার পড়ে পাওয়া ধন’ থেকে সত্যজিতের ক্যামেরা-ধৃত বক্তব্য। সেখানে সত্যজিৎ  বলেছেন কিভাবে, যখন মাইকের ব্যবহার চলে আসায় অনেকেই ‘ক্রুনিং’ শুরু করেন, দেবব্রত কখনও তা করেননি। তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপির সঙ্গে মিলুক বা নাই মিলুক, সত্যজিতের মতে তিনি গানগুলি ‘খুব যথাযথভাবে, ভাবের সঙ্গে, পরিষ্কার বাচনভঙ্গিতে’ গেয়েছেন, যে গুণ নাকি সত্যজিৎ খুব বেশী লোকের মধ্যে  দেখেননি। অথচ সেই ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের ‘এক্ষণ’-এ, অর্থাৎ ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, সত্যজিৎ অধিকাংশ  রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েদের ‘মাঝারিদের দলভুক্ত’ বলছেন, সেখানে ব্যতিক্রম হিসেবে কারুরই নাম উল্লেখ  করছেন না! এই সময় দেবব্রত বিশ্বাস খ্যাতির মধ্যগগনে! এমনকি বিশ্বভারতীর সঙ্গে দেবব্রতর প্রবল সংঘাতের সময়ও সত্যজিৎ নীরব! আর ঋত্বিক ঘটক যেখানে তাঁর ছবিতে একের পর এক সিচুয়েশন সৃষ্টি করে দেবব্রতর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত রাখছেন, বিপরীতে সেরকম কোন প্রচেষ্টাই সত্যজিৎ করেননি। তাঁর ছবিতে পুরুষকন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা গেছে শুধু কিশোরকুমারের গলায়, আর ‘চারুলতা’-তে দু-এক কলি স্বকণ্ঠে গেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া আছে ‘আগন্তুক’ ছবিতে ‘বৃদ্ধ উৎপল দত্তের গলায় ততোধিক বৃদ্ধ  সত্যজিতের নিজের অশক্ত কণ্ঠের একটিমাত্র কলি (…‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ’, বেশ বেখাপ্পা শোনায়, তবু)’। এমনকি সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথ্যচিত্রেও ‘আর্কাইভ থেকে নেওয়া কবিকণ্ঠের গান ছাড়া আলাদা করে একক পুরুষকন্ঠের গান নেই, কিন্তু একক নারীকণ্ঠে আছে’।




তথ্যের ভিত্তিতে সৌরভবাবুর সিদ্ধান্ত হলো যে, একা দেবব্রত বিশ্বাস নন, ‘অন্য কোনও পুরুষ গায়কের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কেই [সত্যজিৎ] স্বতঃস্ফূর্ত-আন্তরিক প্রশংসা করে উঠতে পারেননি, ছবিতেও ব্যবহার করেননি’। ব্যতিক্রম ‘ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বরাবরের শুভানুধ্যায়ী’ কিশোরকুমার!


পঙ্কজকুমার চ্যাটার্জি

 

ওপেনহাইমারের গবেষণা-উপদেষ্টা ম্যাক্স বর্ন এবং সি ভি রমণ 




ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ‘ওপেনহাইমার’ বায়োপিক সারা বিশ্বে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে। এই তথ্য এখন সবারই জানা যে জে রবার্ট ওপেনহাইমার এক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী যিনি আমেরিকার ‘ম্যানহাটান প্রোজেক্ট’কে নেতৃত্ব দিয়ে প্রথম আণবিক বোমা তৈরি করেছিলেন। আর এই বোমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির উপর ফেলা হয়। আমরা জেনে খুশী হবো যে এই ওপেনহাইমারের পিএইচডি গবেষণার গাইড ছিলেন ম্যাক্স বর্ন, যিনি ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত দেশের সেরা বিজ্ঞান-গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটে (আইআইএসসি) অধ্যাপনা করে গেছেন নোবেল পুরস্কার জয়ী ভারতীয় বিজ্ঞানী সি ভি রমণের আমন্ত্রণে।

পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম গতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যে সব বিজ্ঞানীর অবদান আছে তাদের মধ্যে ম্যাক্স বর্ন অন্যতম। তিনি তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রের সবচেয়ে সন্তোষজনক ফর্মূলা তৈরি করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর ছাত্র ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ নতুন কোয়ান্টার তত্ত্বের প্রথম সূত্র প্রণয়ন করলে তিনি তাঁর সঙ্গে কাজ করে গাণিতিক ফর্মূলাকে আরো উন্নত করেন। এর পরে যখন এরউইন শ্রডিংগার কোয়ান্টাম তাত্ত্বিক তরঙ্গের সমীকরণ প্রণয়ন করেন তখন তিনি দেখান যে তরঙ্গের সমীকরণের সংখ্যাতাত্ত্বিক অর্থের বাস্তব গুরুত্ব। তখন তিনি জার্মানির গটিংজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সেখানে তিনি যেসব বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেন তাঁদের মধ্যে আছেন এনরিকো ফেরমি, রবার্ট ওপেনহাইমার এবং পাস্কাল জর্ডান।

বর্নের জীবনের পেশাগত এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের এক চরম মুহূর্ত ছিল ১৯২৮ সাল যখন আলবার্ট আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করেন। অদ্ভূতভাবে নোবেল কমিটি বর্নের কাজকে পুরস্কারের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেননি, যেখানে এই বিষয়ে তাঁর ছাত্র এবং সহযোগী হাইজেনবার্গ এবং শ্রডিংগার যথাক্রমে ১৯৩২ এবং ১৯৩৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। অবশেষে ১৯৫৩ সালে অবসর গ্রহণের এক বছর পরে ১৯৫৪ সালে তিনি আন্তরাণবিক কণার প্রকৃতির সংখ্যাতাত্ত্বিক ফর্মূলা প্রণয়নের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।

১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার পর ইহুদি হওয়ার কারণে বর্ন ২৫ এপ্রিল কর্মচ্যুত হন। তখন তিনি সপরিবারে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজে চলে আসেন। সেখানে তিনি অস্থায়ী লেকচারারের পদ পান। সেই কাজ করাকালীন তিনি রমণের কাছ থেকে চিঠি পান। ১৯৩৩ সালে সি ভি রমণ যখন আইআইএসসি’র ডিরেক্টর পদে নিয়োজিত হন তখন আইআইএসসি’তে রসায়ন বিদ্যার কয়েকটি বিভাগ এবং শিল্পের প্রয়োজনে নিবেদিত বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির বিভাগ ছিল। রমণ প্রথম এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যার বিভাগ খোলেন। এই বিভাগকে বিশ্বমানের পর্যায়ে আনার জন্য তিনি বর্নকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে রমণ বর্নকে কয়েকজন ‘তরুণ এবং দক্ষ’ বিজ্ঞানীর নাম সুপারিশ করতে বলেন। উত্তরে বর্ন লেখেন যে তিনি ব্যাঙ্গালো্র স্থান হিসেবে কেমন না জেনে কাউকে ভারতে আসতে রাজী করাতে পারবেন না। তখন রমণ বর্নকে অনুরোধ করেন যে তিনি নিজে ছয় মাসের জন্য এসে কাজ করতে আগ্রহী কিনা, যাতে তিনি স্থানটির সম্বন্ধে জানতে পারেন। যেহেতু কেম্ব্রিজের অধ্যাপনার কাজ ছিল অস্থায়ী তাই তিনি স্ত্রী হেডির সাথে আলোচনা করে ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বর্নের রাজী হওয়ার সংবাদ পেয়ে রমণের পক্ষে আইআইএসসি’র পরিচালন সমিতির কাছ থেকে সম্মতি আদায় করতে অসুবিধা হয়নি। বর্নকে মাসিক ১৫০০০ টাকা সান্মানিকে ছয় মাসের জন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের রীডার পদে নিয়োগ করা হয়।

১৯৩৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে ম্যাক্স বর্ন সস্ত্রীক আইআইএসসি’তে আসেন। রমণের স্ত্রী লোকসুন্দরী আম্মাল তাদের অভ্যর্থনা জানান এবং এক দ্বিতল বাংলোতে তাঁদের নিয়ে আসেন, যেখানে তাঁরা পরবর্তী ছয় মাস কাটাবেন। বর্ন লিখেছেন, “আমাদের সুন্দর গাছ এবং ফুলসমন্বিত বিশাল বাগান ছিল। দু’টো টেনিস কোর্ট ছিল যেগুলি চমৎকার বোগেনভালিয়া গুল্মদ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। রমণের পরিবারও একই রূপ এক বাংলোতে রাস্তার ঠিক ওপাড়ে থাকতেন।”

প্রথম কয়েকদিন রমণ ব্যস্ত থাকায় বর্নের পরিবার তাঁর দেখা পাননি। কিন্তু প্রথম দর্শনেই বর্ন দম্পতি রমণের প্রতি আকৃষ্ট হন। বর্নের স্ত্রী হেডির কথায় পাগড়ি মাথায় ভারতীয় পোষাকে রমণকে ‘আরবিয়ান নাইটস’-এর এক যুবরাজ মনে হচ্ছিল। ব্যাঙ্গালোরে বর্নের সঙ্গে মহীশূরের দেওয়ান মির্জা ইসমাইলের সাথে পরিচয় হয়। বর্ন লিখেছেন, “মহীশূরের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দু এবং দেওয়ান মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন সংঘর্ষ ছিল না।” ইসমাইল মহীশূর এস্টেটের নির্মাণ কাজের জন্য ভালো কোন স্থপতির নাম জানতে চাইলে, বর্ন তাঁর ভাইপো অটো কোনিগসবার্গারের নাম প্রস্তাব করেন। ভাইপোও তখন জার্মানি থেকে বিতাড়িত। দেওয়ানের আমন্ত্রণে কোনিগসবার্গার মহীশূর এস্টেটের স্থপতি হিসাবে নিয়োগপত্র পান। তিনি ব্যাঙ্গালোরে আইআইএসসি সহ অনেক বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করেন।

রমণের সাথে আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার আলোচনা প্রায়শ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও বর্ন আইআইএসসি-তে সুখেই ছিলেন। সেই সময় রমণ চেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানে বর্নের জন্য একটি স্থায়ী পদ সৃষ্টি করতে। এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বর্ন দম্পতি এই প্রস্তাব মুক্তমনে গ্রহণ করেন। দুটি গবেষণা কমিটি গঠিত হয় - একটি ব্যাঙ্গালোরে (রমণের অধীনে) এবং দ্বিতীয়টি লন্ডনে (পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের অধীনে)। উভয় কমিটিই বর্নকে একটি স্থায়ী পদ দেওয়ার বিষয়ে সম্মত ছিল এবং নিয়োগ মোটামুটি পাকা হয়ে যায়। কিন্তু, রমণকে প্রতিষ্ঠানের সেনেট এবং কাউন্সিলের কাছে সম্মতি আদায়ের জন্য প্রস্তাব পাঠাতে হয়।



সেনেটে সভা চলাকালীন বর্ন রমণ এবং আইআইএসসি-র পরিচালন সমিতির মধ্যে কুৎসিত বিতর্ক হতে দেখেন। সেই সভায় বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি বিভাগে অধ্যাপক পদে সদ্য নিযুক্ত এক ইংরেজ কেনেথ অ্যাস্টন রমণ এবং বর্ন উভয়কেই আক্রমণ করেন। বর্ন লিখছেন, “ইংরেজ অধ্যাপক উঠে দাঁড়ান এবং রমণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে খুব অপ্রীতিকর ভাবে বক্তব্য রাখেন। তিনি ঘোষণা করেন যে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত এক দ্বিতীয় শ্রেণীর বিদেশী যথেষ্ট উপযুক্ত নন। আমরা অ্যাস্টনের প্রতি সৌহার্দ্রপূর্ণ ব্যবহার করা সত্ত্বেও তাঁর এই ব্যবহার আমাদের কাছে বিশেষ ভাবে হতাশাব্যঞ্জক মনে হয়েছিল। [তাঁদের বাংলো প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত অ্যাস্টন পরিবার বর্নের বাংলোতেই অবস্থান করেছিলেন] আমি এতই ভেঙ্গে পড়ি যে হেডির কাছে ফিরে আসার সময় আমি কেঁদেই ফেলি।”

এইভাবে ম্যাক্স বর্নকে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু, তাঁর লেখা থেকে আর একটি দুঃখজনক ঘটনার কথা জানা যায়। রমণ চেয়েছিলেন খুব দ্রুত আইআইএসসি-র উন্নয়ন ঘটাবেন। তিনি ভৌত রসায়ন বিভাগকে নতুন পদার্থবিদ্যার অধীনে আনতে চান। এই পদক্ষেপে সাধারণ রসায়ন বিভাগের (যে বিভাগের অধীনে ভৌত রসায়ন বিভাগ ছিল) অধ্যাপক এইচ ই ওয়াটসন ক্ষুব্ধ হন এবং প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। বর্ন লিখছেন, “ওয়াটসন এবং তাঁর বন্ধুরা আশা করেছিলেন যে তিনি স্যার মার্টিন ফরস্টার অবসর নেওয়ার পরে নতুন ডিরেক্টর হবেন। নিশ্চিতভাবে ওয়াটসন একজন ভারতীয় ডিরেক্টরের অধীনে কাজ করতে পছন্দ করেননি। ওয়াটসনের কিছু বন্ধুর কাছ থেকে আমি এই তথ্য জেনেছি।”

ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেজের আর্কাইভ থেকে জানা যায় বর্ন নভেম্বর ১৯৩৫ এবং এপ্রিল ১৯৩৬ এর মধ্যে আইআইএসসি’তে অনেক গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। বিজ্ঞানীরা আক্ষেপ করেন যে বর্নের মতো এক বিজ্ঞানীর অবদান ভারত হারিয়েছে।

 


মৌ চক্রবর্তী

 

দর্শক বসতে লক্ষ্মী বনাম একটি নাট্য-প্রযোজনা

 


তৃতীয় ঘণ্টি বাজতেই শুরু হয়ে যায় নাটক, মানে নাট্য প্রযোজনা মানে নাট্যাভিনয়। শুদ্ধ তাত্ত্বিকবর্গের হলেই নাটক নাকি নাট্যকলা নাকি থিয়েটার এসব নিয়ে আলোচনা চলে। সঙ্গে সঙ্গে হরির দোকানের চা আর চা শেষ। নাট্যপ্রেমীদের তিন নম্বর বেলের সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ু সিধে। এবং মনোসংযোগ। দ্বিতীয় বেল বা তার আগেই তো ঢুকে যেতে হয়। বা হত কিছুকাল আগেও। মানে একুশ শতকের শুরুর দিকেও এটাই ছিল থিয়েটারে ঢোকার নিয়ম। এখন কি তবে নিয়ম উঠে গেছে? নাকি অতিমারি বিধি মেনে আসিয়ে দর্শকদের কাছে কৃতজ্ঞ। আগে হলে তো অন্যান্য দর্শক এভাবে কথ্য- খোঁচা দিতেন যেন, এটা গর্হিত কাজ হল। নাটক শুরুর পর আর আসা চলে না। ঢোকার মুখেই বলা হবে যে, শুরু হয়ে গেছে তো। কেন এত দেরি করেন? বা, অপেক্ষা করুন বলব কখন ঢুকতে পারবেন। সবমোট কথা হল গিয়ে, ঢোকা আর নিজের হাতে নেই। এদিকে তো শো-এর ইন্টারভ্যাল বা মধ্য- বিরতিতেও বাকি থেকে যেত আরও ভ্রূ-কুঞ্চিত মুখের টিপ্পনী। যারা মুখে কিছুই না বলেও বলেন, এটা তাদের অস্ত্র। পাশে বসেও তারা যে একই গোত্রের ভাবছেন না, সেটা বুঝিয়ে দিতেন। নিখুঁত অভিনয়ে।  এরাই হলেন থিয়েটারের নিয়মিত দর্শক এবং পৃষ্ঠপোষক। অভিনয়টাও করতে পারেন প্রয়োজন মতন। এরকম ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। নাটকের শেষে আর না তাকিয়ে অপরাধ বুকে সরে পড়া। না, এসব চোখে পড়ছে না। এখন আবার, গেটে কেউই আটকাচ্ছেন না, ফলে সিনেমা হলের মতন কিছু কুরকুরে দর্শক আসছেন। যাদের প্রবেশ অবাধ, মিনিট পনেরো পরেও ঘটে। প্রবেশের নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র এই প্রাবন্ধিক বা প্রবন্ধের উপরই নির্ভরশীল। এখন কি দর্শক এতটাই দুল্রভ? এখন দর্শক মানে নাটকের চলা না-চলা? মানে থিয়েটারের হালফিল অবস্থাতে দর্শকের অস্তিত্ব লক্ষ্মীতেই?  

তাহলে এতক্ষণে বোঝা গেল এ নাটক নিয়ে লেখা। আবার নয়ও। ফলে,  প্রথমেই শুদ্ধ করে নেওয়া গেল যে, থিয়েটারের দর্শক মূল লক্ষ্য। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। বাজল বেল। পর্দা খুলে গেল। বড় দলের নাটক। অতিমারির পর শো-এর সময় আবার আগের সময়ে ফিরেছে। একাডেমী আবার দর্শকের ফুরফুরে গন্ধে ম ম করছে। মানে একটি বহুদিনের চর্চা করা গ্রুপ থিয়েটারের শো। প্রস্তুতি চূড়ান্ত। আশপাশে আর একটা করে আসন ফাঁক রেখে বসতে হচ্ছে না। এবং প্রায় ভর্তি পেছনের দুটো রো বাদে। আর সামনের সারিতে যেমন খালি থাকে। আর বাম দিকের রো-গুলো তো একেবারেই দলের সংগঠনের সদস্যদের জন্যে। দেখে ভাল্লাগে। দেখে মনেহয় ওয়েবসিরিজের বিরতিতে কিছু দর্শক এসেছেন। বা এখনও থিয়েটার দেখতে যাচ্ছি স্ট্যাটাস যেন সংস্কৃতির উঁচুমাচান। সেসব ভেবে, বেশ লাগছিল। ঠিক পেছনের রো থেকে কুরকুর মুরমুর শব্দ। ভাবলাম, ও কান বাজছে। আবার, আবার, বন্ধ হচ্ছে আবার হচ্ছে। মঞ্চে তখন মিনিট পনেরো হবে কলাকুশলীরা চুটিয়ে অভিনয় করছেন। এবং, যে নাটকটি অভিনীত হচ্ছে তার শুরুয়াত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, নাটকের ভাষায় যাকে বলে এক্সপজিশান, তা ঘটেছে। সব চরিত্ররা দর্শককে জানাতে পারছেন যে কেন তাঁরা উপস্থিত হয়েছেন। সংলাপ চলছে। আলো পড়ছে দুই বৃত্তে দুই অভিনেতার মাথা বেয়ে মঞ্চে। উনিশ শতকের প্রেক্ষাপট, একেবারে গোঁড়ার দিক। ওই সময়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অতীতকালের একটি মেয়ে তাঁর কথা বলছে নিজের মতন করে। আটপৌরে পোশাক। মুখে নরম ভাব। ওদিকে ডাক্তারি করতে এসেছেন ডাক্তারবাবু এবং তাঁর সঙ্গীরা। এই মুহূর্তে মঞ্চে এক বিধবার শেষযাত্রার সময়। যখন একদিকে নামসংকীর্তন করতে হাজির দলসহ ব্রাহ্মণ্যবর্গ।  ডাক্তারকে চিকিৎসা করতে দেবেন না পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য। এবং, তারই মধ্যে একটু বুঝতে হচ্ছে, মঞ্চে গোটা দশ চরিত্র কে কি করছেন একই সময়ে। দেখতে হচ্ছে খুঁটিয়ে কে কোন আলোয় খেলছে। ওদিকে দুটো হলুদে হলুদে কথা। আর ডাক্তারবাবু ধমকাচ্ছেন রোগীর বাড়ির লোককে। এরই মধ্যে একদল মাতব্বরি করে বিধবার নাড়ি টিপে চিকিৎসার বিরুদ্ধে সোচ্চার। বোঝা গেল যে, এখানে সমাজকে দেখানো হচ্ছে। দ্রুত লয়ে তারই সঙ্গে পিছনের সারির আসন থেকে চিবিয়ে খাওয়ার শব্দ। অবশ্যই তালজ্ঞান নেই। এসব কি একুশ শতকের দর্শকের ভাবলেশহীন খাদ্য? যে তিনি বা তারা বেমালুম চিবিয়ে যাচ্ছেন জোরকদমে। জিহ্বার টঙ্কারে কে ভাই আপনি? এভাবে সশব্দে খাচ্ছেন? তাও আবার একাডেমির ভেতরে। তাও শো চলার সময়ে। তাও আবার মঞ্চের মেয়েটি যখন ঘোষণা করছে, আমার পড়তে খুব ভাল্লাগে। আমি ডাক্তারি পড়তে চাই। উনিশ শতকের ওই মেয়েটি পায়ে ধরে ফেলেছে তখন। আর একুশ শতকের দুই সাজগোজ করা কন্যে-দর্শক বোদ্ধার ভঙ্গিতে চিবিয়ে নিচ্ছেন রসবোধ। এখন এই অবস্থায় ওদিকে নাটকের দৃশ্য সংলাপ এদিকে দর্শক খাচ্ছেন সশব্দে। চারদিকে খুঁজলাম আড়চোখে নেই, সেই সংশোধনকারী দর্শকদের কেউই নেই।

এমন সময় মনে এল উনিশ শতকের কথা কেন দেখাচ্ছেন নির্দেশক। কেন লিখেছেন নাট্যকার? আর কেনইবা অভিনয় করতে যোগ দিয়েছেন এই সময়ের শিক্ষিত কলাকুশলীর দল। সেটা তো আর আদপে একুশ শতকের নারীদের সমস্যা নয়। দেখতে দেখতে তাই কি লঘু লাগে? এসময়ে একুশ শতকের দর্শকের খিদে পেলে আশ্চর্য লাগার কিছুই নেই। তবে, এও হতে পারে যে, এরকম ভাবার কিছুই নেই। এটা একটা অভ্যেস। যেমন ঘরে বসে হোম-থিয়েটারে দেখতে দেখতে চিবিয়ে যেতে হয়। খাদ্য শুধু তো খিদে নয়, খাদ্য তো এক অভ্যেসের মতন খেতে থাকতেই হয়। না পড়লেও চলে, কিন্তু না খেলে চলে না। আর না থিয়েটার দেখলেও চলে। কিন্তু না খেতে পারলে চলে?  তাছাড়া ভাবনার সূত্রটিই তো নেই যে, পরিবারের বড়কর্তা, বা সমাজ রক্তচক্ষু দেখাবে। সেদিনের সেই যৌথ পরিবার তো নেই। ফলে, অভিভাবকের সংখ্যা কমে গেছে। পড়াশোনা তো করতেই পারা যায়। এবং, এখন দিন নাগালে, যেমন খুশি সাজো। সেইজন্যে আর অন্য মেয়েদের দুঃখ চোখে পড়ে না। অন্তত উপস্থিত দর্শকদের এই সমস্যা স্পর্শ করে না। এসব উদ্বায়ী সমস্যা দেখলে সিনেমা বা গপ্প ফাঁদা উপন্যাস বলে মনেহয়। মাপা আলোয় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। না কোনও ফল হল না। মনেহল, ওই আগের দর্শকদের মতন অভিনয় পারলাম না। ফলে কুরকুর চলল। এসব, মনে করতে করতে নাটকের অনেকটাই হয়ে গেল। একটি মৃত্যু, সমাজের সংকট এবং গৃহহীন সমস্যা, বাল্যবিবাহ, বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ -- তবু দর্শক খেয়ে চলেছেন। রো এফ, সিট নাম্বার ৩২ আর ৩৩। কে ছিলেন সেদিনের দর্শক। হলদে আলো সারাটা মঞ্চে পড়লে নাটক ছেড়ে ওনাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার দেখতেই হচ্ছে। ওদের ঠিক সামনের সারিতেই বসেছি কিনা ভাগ্যক্রমে। তাই, বারবার ফিরে যাচ্ছি পেছনে। পেছনে যখন ফিরলামই তখন নাটকের ইতিহাসেও যাই।

লেখা রয়েছে যে, উনিশ শতকে থিয়েটারের দর্শক ছিলেন, খানাপিনা করিয়ে বাবুর দল। রঙ্গালয়ের ভাষায়, তারাই লক্ষ্মী। কারণ, টিকিট কাটেন। আর থিয়েটার দেখেন কি? সেটা কথা নয়। একটা কোম্পানির মালিকানার যোগ্যতা যার তিনিও তো থিয়েটার দেখেন না। শুধু টাকা ঢালেন। আর এ তো মাত্র একটা আসন। হলের মালিকের খোঁজ করেন কত মুনাফা হল। এসব তো প্রথমদিকের বাবু-দর্শকের কথা। পরের দিকে, শুদ্ধাচারের আদর্শে, ভাল নাটক করব, ভাল করে করব- ভাবনা নিয়েই থিয়েটার।

এত নাটকের মধ্যে দেখতে যাওয়া নাটকের কথাটি লিখছি পরে। তার আগে বুঝিয়ে দিই কিভাবে অব্যক্ত ক্রোধ চাপা রেখে এই নাটকটি দেখলাম। নাটকের মুন্সিয়ানা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করায়। আর দর্শকের মুন্সিয়ানা, নাটক দেখায়।

এখন, ওই দুই দর্শকের প্রতি জিজ্ঞাসা যে, আপনারা কি টিকিট কেটে এসেছিলেন? কোথা থেকে এসেছিলেন? নাটক করেন তো বোঝাই যাচ্ছে। কোন দলে? আচ্ছা, তবে থিয়েটার ভালই জানেন। তাহলে, নিয়ম আদর্শ আর কিছু জানেন বা শুনেছেন দলের সদস্যদের কাছ থেকে? আচ্ছা, থিয়েটার নিয়মিত দেখেন? আর কুরকুর করে প্লাস্টিকের শব্দে আগের পরের রো-এর দর্শকদের বিব্রত করেন? আর থিয়েটারের কিইবা পাওনা। শিক্ষা নিয়ে মেয়েদের ওসব সমস্যা তো কবেই মিটে গেছে। ফলে দর্শক হল গিয়ে দর্শক। যিনি হলে খেতে খেতে সিনেমা দেখার প্রাথমিক কর্তব্যটি পালন করেন। যিনি সিন্থেটিক কালচারের প্রতিনিধি হয়েও সংস্কৃতির পৃষ্ঠে পোষক তা করেন। সুবেশ ধারণ করেন। কলকাতাকে ঝঞ্ঝাটের শহর বলে দোষী করেন। এবং মুঠোফোনটি হাতে ধারণ করেন কলমের মতন। এবং যিনি সেই কারণেই থিয়েটার দেখেন, যে এটাই কালচার এখনও পাড়ায়। এখনও সমাজে থিয়েটারে টিকিটের দামি টিকিট নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি দর্শক যিনি এই দামি টিকিট কেটে,  লাইভ হতে হতে মঞ্চে থুড়ি থিয়েটারে প্রবেশ করেন। এবং খেতে দোষ কিসের? এই তো গানের দল শো করছিল রবীন্দ্র সদনে। সেখানেও খাই? না তো। এমনকি থিয়েটার করতে আসা দলগুলোর প্রতিও এই একই নিষেধাজ্ঞা ও অনুশাসন মেনে চলতে হয়। কিন্তু কবিতা বলতে গেলেও যে খাই? তার বেলা? তবে থিয়েটারে কেন নয়? আর যেখানে হলে পানীয়, খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ঢোকা বারণ লেখা, সেই কবে থেকেই। তবে, বুঝি দেরি হয়ে গেছিল বা যায় রোজই, তাই ওসব লেখায় চোখ যায় না। কতটা সহ্য ক্ষমতা থাকলে এরকম লেখা যায়, সেটা ভেবে দেখবেন মাননীয় পাঠককুল। এটা লেখা মানে তো, নাটকের দৃশ্যের মতন ফের ফের ওসব মনে করা। আর মস্তকে জ্বলুনি। তবুও, ঋণী সেই দর্শকেরই কাছে। রবি ঠাকুরের চেনা কবিতার প্যারোডি করে বলা যায় যে, ' থিয়েটার দেখতে এসেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়।' তবে, তারপর আর হে বন্ধু বিদায় বলার সাহস রাখি না। দর্শক শূন্য মানে শিল্পীর কৃতিত্বে হাততালি কে দেবেন।

হে দর্শক, হে থিয়েটার তোমাদের পরিপূরকতা তো সর্বজনবিহিত। এবং, বেশ ঘটনা দ্বারা সমাদৃত। যেমন, অত অচ্ছেদ্দা করলেও গোলাপসুন্দরী হলেন অভিনেত্রী, নাট্যকার এবং থিয়েটারের ম্যানেজার। যেমন, বিনোদিনী বানালেন স্টার। লিখলেন আত্মজীবনী।  হে দর্শক, আপনাদের জন্যেই তো বিনোদিনী, গিরিশবাবুর প্রিয় ছাত্রীর বিনোদ বি- থিয়েটারটি হতে পেল না। তাহলে? দর্শক কত গুরুতর ব্যাপার সেটা তো জানেন। ক্ষণিকের বিনোদনের জন্যে একই পাড়ায় পাল্লা দিয়ে নাট্যশালা। উনিশের বঙ্গনটীদের নিয়ে কে কোন নাটক নামাবেন সেই মতন ছক কষা। থিয়েটার পুড়িয়ে দেওয়া। আবার বঙ্কিমচন্দ্র মহাশয়ও তো দর্শক হয়ে এসে বলে গিয়েছিলেন যে, অভিনেত্রীর সার্থকতা এখানেই যে, এমন চরিত্র তিনি লেখেননি। আবার দর্শক-রামকৃষ্ণ তো নিমাই-সাজের বিনোদকে আশীর্বাদ করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা এও যে, অভিনেত্রী নেওয়ার আগে পর্যন্ত বিদ্যাসাগরমশাইও তো বিধবা বিবাহ-এর নাটক- প্রযোজনায় উৎসাহী ছিলেন। তিনি নিয়মিত দেখতেন থিয়েটার। কারণ তো সমাজের চেতনা জাগান। অর্থাৎ, দর্শকের চেতনা সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। ফলে, দর্শকের দিকেই পাল্লা ভারি কিনা। তাই, এরপরের আলোচনা ফের দর্শক নিয়েই। এই দর্শকের জন্যেই তো একসময় বাংলা মঞ্চে নটীদের আসা। নাট্য-প্রযোজনা নিয়ে মাতামতি, দর্শক টেনে আনতে একদল পাখা দেয়। তো অন্যদল বাড়িতে গাড়ি পাঠায়। একদল থিয়েটারের দর্শক না হয়েও গিরিশচন্দ্র ঘোষ মশাইয়ের প্রয়াণসভা করে, তখন দর্শকদের সামনে সভায় বলতে দেওয়া নিয়ে সোচ্চার হন একদল অভিনেত্রীরা। এসব নটীদের কৃতিত্ব, মাইনে, বাজার তো দর্শকের আনুকুল্যেই সম্ভব হয়ে থাকে।

হে পাঠককূল, বিব্রত, কুণ্ঠিত উত্তেজিত হয়ে ওঠার এই কৃতিত্ব তো দর্শকেরই। এবং এই লেখার প্রেক্ষাপট দর্শক সমীপেষু। যারা সতত খুঁচিয়ে ভেতর থেকে জমে থাকা বোধ, সংস্কৃতি, ভাবা, ভাবনা আর থিয়েটারের দর্শক হয়ে ওঠার যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলোকে নিরীক্ষায় ফেলেন। এমন নাট্যের ভুবনে থিয়েটার সতত ঋণী করে রাখে আপামর সেইসব দর্শকের কাছে। যাদের জন্যে বাংলা থিয়েটার, হল, মঞ্চের ধারকাছের ব্যবসা  চলে। চলে হলের কাছাকাছি দাদাদের চপ, শিঙাড়া, ঠাণ্ডা আর জলের বিক্রি। চা বিক্রি করে সংসার চলে বাবুদার। আর একঘরে থাকা ছেঁড়া জামা ঠ্যাঁটা মেয়েটারও বেলুন বেচা চলে। চলে একাডেমি। চলে থিয়েটার ব্যানার, ফেস্টুনওলাদের ব্যবসা। গাড়ির রাখার ঠিকে জায়গাওলাদের ব্যবসাও চলে। এতসব চলে বলেই তো একাডেমি চলে। আর অভিনয় চলে।

একাডেমির গেটে কর্তব্যরত আলমদাকে জিজ্ঞেস করলাম, দর্শক মানে কিরকম বুঝঝ? হেসে বললেন, ভাল। খুব ভাল। আজকাল ভিড় খুব। আর দর্শক যে ভেতরে ঢুকে থিয়েটার চলাকালীন খেয়েই চলেছে? তার বেলা? কে যেন বললেন, তবুও দর্শক তো। যারা আসছেন মুঠোফোন নিয়ে, মানে অর্থ খরচ করতে পারবেন। আর তারা খাচ্ছেন, কি আর করা যাবে, বাঁচতে হবে তাই খাচ্ছেন। এবারে শব্দটা খুব বেশি হলে? তখন যেমন ওই অভিনয় থামিয়ে সীমা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, বাজিয়ে নিন, থামালে বলবেন, তারপরই অভিনয় করব।

এবারে, খাওয়ার শব্দে বলি, হে দর্শক, চিবিয়ে নিন বস্তু ও খাদ্যবস্তু, না-হয় তারপরই থিয়েটার করব ইত্যাদি।

ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী 


পি. শাশ্বতী

 

বোধিসত্ত্ব ও ক্ষান্তি

 


বিশ্ব সাহিত্যের ভাণ্ডারে গল্প, উপন্যাস ও নাটক প্রভৃতি রচনার চিরন্তন উৎস হিসেবে জাতকের ভূমিকা অপরিসীম। পালি সাহিত্যে বুদ্ধের পূর্বজন্ম বা জন্ম জন্মান্তরের জীবন কাহিনী ঘটনা প্রবাহই জাতক নামে পরিচিত। জাতকে বুদ্ধের সমকালীন আর্থসামাজিক অবস্থার বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এর রচনাকাল সম্পর্কে তেমন কোন সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে অনুমান হয়, জাতকের রচনাকাল খ্রীষ্ট জন্মের ৩৭০ বছর পূর্বে।  তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি শেষে সম্রাট অশোক ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এবং তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ধর্মদূত প্রেরণ করেন। এর মাধ্যমে ত্রিপিটক ভারতবর্ষের সীমা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী সীমা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী বহু দেশে পৌঁছে দেশ দেশান্তরে বিস্তৃতি লাভ করে। জাতক যেহেতু ত্রিপিটকের অংশ, সেহেতু ত্রিপিটকের সাথে জাতক ও দেশ দেশান্তরে পরিব্যাপ্ত হয়। বৌদ্ধধর্মের সাথে জাতকও প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে প্রতীচ্যে পৌঁছেছে। এর ফলে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে বৌদ্ধচসাহিত্য ও ধর্ম সম্বন্ধীয় গ্রন্থ বিশেষ আকর্ষণীয়।  সুতরাং জাতক শব্দের অর্থ হলো, যিনি উৎপন্ন বা জন্মলাভ করেছেন। বুদ্ধের পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত বোঝাতেই জাতক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে শিষ্যদের তাঁর অতীত জন্মের কাহিনী বর্ণনা করতেন। বুদ্ধের পূর্ব জন্মের ওইসব কাহিনীগুলোকে 'জাতক' বলা হয়। অর্থাৎ বোধিসত্ত্বের বিভিন্ন জন্ম সম্বন্ধীয় ইতিবৃত্ত ও বোধিসত্ত্ব জীবনের পূর্ব কাহিনীকে জাতক বলা হয়।

বুদ্ধ হওয়ার পূর্বে সিদ্ধার্থ গৌতমকে বহু কল্পকাল নানাকুলে জন্মগ্রহণ করে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করতে হয়েছিল। তখন তিনি বোধিসত্ত্ব নামে খ্যাত ছিলেন। জাতকের কাহিনীগুলোতে বোধিসত্ত্বের জীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। কাহিনীগুলো সব গুণাবলী সম্পন্ন এবং আদর্শ জীবন গঠনের সহায়তা করে। এগুলো নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা সমৃদ্ধ। জাতকের সংখ্যা ৫৫০। বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে পারমী পূরণার্থে ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করেন, সেই অনুসারে ৫৫০টি জাতক থাকার কথা। কিন্তু তিনটি জাতক কাহিনী কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। জাতকের সাথে নৈতিকতা শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৈতিক  শিক্ষার অপরিহার্য বিষয় হলো জানো জাতকে যে নৈতিক বিষয়সমূহ পাওয়া যায়, তাকে অবলম্বন করে আদর্শ জীবন ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। শ্রীঈশানচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত জাতকগ্রন্থে মোট ৫৪৭টি জাতক কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো ২২টি অধ্যায়ে বিভক্ত কথিত আছে। নৈতিক ও আদর্শ জীবন গঠনে জাতকের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি  বহুমাত্রিক শিক্ষা ও নৈতিক জ্ঞানে ভরপুর। ধর্মীয় শাস্ত্রের অধীনে হলেও গুণগত বৈশিষ্ট্য তার প্রয়োজনীয়তা এবং এর বহুমাত্রিক প্রামাণিক কারণে জাতকের গুরুত্ব রয়েছে। হাজার হাজার বছরের শিক্ষাও সভ্যতার আকর গ্রন্থ জাতক। নীতি ও প্রদেশের মৌলিক আধার হিসেবে জাতকের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। জাতকের কাহিনীগুলোতে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা পাওয়া  যায়। জাতকের অন্যতম বিশেষত্ব হলো, গল্পের ছলে চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষ সাধন করা। বুদ্ধ কুশল কর্মের সুফল ও কুশল কর্মের কুফল বোঝাবার জন্য জাতকের কাহিনীগুলো বলতেন, তাই জাতকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জাতকের কাহিনী ধর্মের গভীর বিষয় সমূহকে সহজভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। কাহিনী গুলো হিতোপদেশমূলক। ভালো কাজে উৎসাহ দেয়, উদার চিত্তে দান দিতে শিক্ষা দেয়। প্রাণী হত্যা মিথ্যা বলা চুরি করা ব্যভিচার মাদকদ্রব্য গ্রহণ প্রকৃতি থেকে বিরত থাকা শিক্ষা দেয়। প্রায় বাক্য এবং মন সংযত করে।সম্যক  জীবিকা অবলম্বনে উৎসাহ যোগায়। সমাজ থেকে জাতিভেদ প্রথা দূর করতে সহায়তা করে। ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। পরমত সহিষ্ণু এবং পর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয় ।তাছাড়া জাতকের কাহিনী মানুষকে শিক্ষা দেয়ত্যাগ তিতিক্ষা শান্তি সম্প্রীতি মৈত্রী করুণা  প্রেম এবংহিংসা। এতে বর্ণিত উপদেশ সদ্ভাব ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপনে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে। এক কথায় বলা যায়, নৈতিক ও আদর্শ জীবন গঠনে জাতকের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের প্রত্যেকের জাতকের শিক্ষা অনুসরণ করা অবশ্য কর্তব্য।

জাতকে অনেক ছোট ছোট গল্প বা বুদ্ধের জন্মের পূর্বেকার গল্প পাওয়া যায়। পুরাকালে বারাণসীতে কলাবুনামে এক রাজা ছিলেন। সেসময় বোধিসত্ত্ব প্রচুর সম্পদশালী এক ব্রাহ্মণের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম ছিল কুণ্ডল কুমার। তিনি তক্ষশীলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর বিপুল ধনসম্পত্তি দেখে ভাবলেন। আমার পূর্বপুরুষরা এ বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করেছে। তারা এর সামান্যই ভোগ করেছে।  আমিও সামান্য ভোগ করব সময় হলে আমাকেও তাদের মত মৃত্যুবরণ করতে হবে। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দান পাওয়ার উপযোগী ব্যক্তিদের পরিমাণ মতো দান করবেন। এক সময় সব সম্পদ নিঃশেষ করে তিনি গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন। সেখানে গ্রহণ করলেন প্রব্রজ্যা। বনের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করতে লাগলেন।

কিছুদিন হিমবন্তে বসবাসের পর বোধিষত্ব লবণ ও অম্ল সংগ্রহের জন্য হিমবন্ত থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে নেমে এলেন। বিভিন্ন জনপদে ঘুরে বেরিয়ে একদিন রাজ উদ্যানে উপস্থিত হলেন সেখানে রাত্রি যাপন করে পরদিন ভিক্ষার জন্য নগরে প্রবেশ করলেন। তিনি প্রথম রাজার সেনাপতির গৃহদ্বারে উপস্থিত হলেন।তাঁর আচার আচরণে খুশি হয়ে সেনাপতি তাঁর গৃহে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন।একদিন রাজা কলাবু আনন্দ উৎসব করার জন্য উদ্যানে এসে হাজির হলেন। বিপুল আয়োজনে শুরু হল আনন্দ উৎসব।কিন্তু সুরা পানের মত্ত রাজা  অল্পক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনকারীরা ভাবল যার জন্য সংগীত ও নৃত্যের এত আয়োজন, তিনি যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন কি প্রয়োজন নিত্য গীতে।তারা সবকিছু ফেলে রাজ উদ্যানে তাদের খেলায় মত্ত হলো।বোধিসত্ত্ব তখন এক ফুল ফোটা শাল গাছের মূলে বসে প্রব্রজ্যা  উপভোগ করছেন।গীত ও সংগীত পরিবেশনকারীরা ঘুরতে ঘুরতে তাঁকে দেখে সবাই সেখানে হাজির হলো। তারা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগলো চলো ওই সন্ন্যাসীর নিকট ধর্মকথা শুনি। তারা সকলে বোধিসত্ত্ব কে প্রণাম করে ঘিরে বসলো।বোধিসত্ত্ব তাদের ধর্ম কথা শোনাতে লাগল।এদিকে জেগে উঠে রাজা দেখেন তার আশপাশে কেউ নেই তারা কোথায় গেছে প্রশ্নের উত্তরে রাজা যখন জানতে পারেনএক তপস্বীকে ঘিরে সবাই বসে আছে। তখন তিনি ভীষণ রেগে গেলেন। ভণ্ড তপস্বী কে শাস্তি দেবেন বলে খড়্গ হাতে ছুটে। তখন কয়েকজন তার হাত থেকে খড়্গ কড়ে নিয়ে রাগ থামায়।রাজা বোধিসত্ত্বের  কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেন, শ্রমন! তুমি কোন মতাবলম্বী?

বোধিসত্ত্ব উত্তর দিলেন মহারাজ আমি ক্ষান্তিবাদী। রাজা বললেন- ক্ষান্তি কাকে বলে?  বিভিন্ন প্রতিরূপ পরিস্থিতিতে  মনের যে অক্রোধ ভাব,তাকে বলে ক্ষান্তি।রাজা বললেন ঠিক আছে, এখনই দেখা যাবে তোমার ক্ষান্তি আছে কিনা। এ কথা বলে রাজা ঘাতককে ডেকে পাঠালেন। ঘাতক

কুঠার ও চাবুক নিয়ে হাজির হলো যে  কি করবে?  রাজা বললেন একে মাটিতে ফেলে ২০০০ চাবুক মারো। ঘাতক তাই করল। বোধিসত্ত্বের  চামড়া ছিঁড়ে গেল মাংস ছিঁড়ে গেল সর্বাঙ্গে  রক্ত স্রোত বইতে লাগলো। তখন রাজা তাকে প্রশ্ন করলেন। তাপস এবার বলো তুমি কোন বাদী? বোধিসত্ত্ব বললেন মহারাজ আমি খান্তিবাদী। আপনি ভেবেছেন আমার চামড়ার নিচে বুঝি খাচ্ছি আছে। ক্ষান্তি আমার সেখানে নেই। এটা আমার হৃদয়ের গভীরে প্রতিষ্ঠিত। আপনার সাধ্য নেই তা দেখার। ঘাতক বলল এখন কি করবো মহারাজ। রাজা বললেন ভন্ড তপস্বীর হাত দুটো কেটে ফেলো। ঘাতক তাই করল। এর পর রাজার আদেশে দুটি পা, নাক, কান ছেদন করা হল। ঘাতক তাই করল। রক্তস্রোতে ধরণী প্লাবিত হল। আবার রাজা জিজ্ঞাসা করলেন তুমি, কোন বাদী?? বোধিসত্ত্ব বললেন মহারাজ আমি ক্ষান্তি বাদী। ক্ষান্তি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে থাকে না।

ক্ষান্তি  আমার অন্তরের অন্তস্থলে। ভন্ড জটা ধারণ তুমি শুয়ে ক্ষান্তির স্পর্ধা  করতে থাক। রাজা বোধিসত্ত্বের বক্ষস্থলে পদাঘাত করে প্রস্থান করলেন।তখন সেনাপতি এসে বোধিসত্বকে প্রণাম করে প্রার্থনা করলেন প্রভু আপনার প্রতি যিনি অত্যাচার করেছেন যদি ক্রুদ্ধ হন তার ওপর হবেন অন্যের উপর ক্রুদ্ধ হবেন না।  রাজ্যের যেন বিনাশ না সাধন না হয় তা শুনে বোধিসত্ত্ব বললেন-

হস্ত,পদ, নাশা, কর্ণ, ছেদিয়া যেজন, করিলেন মোরে এই দারুন পীড়ন, চিরজীবী হয়ে সেই থাকুক নৃপতি মাদৃশ জনের ক্রোধ অসম্ভব অতি।

রাজার পাপাভার সহ্য করতে না পেরে উদ্যান দ্বারে ধরিত্রী বিদীর্ণ  হয়ে রাজাকে গ্রাস করল এবং অচিরেই মহানরকে নিক্ষিপ্ত হল। সেদিনই বোধিসত্ত্ব প্রাণত্যাগ করলেন উদ্যানের মধ্যে।

এই তাপস জন্মে বোধিসত্ত্বের  ক্ষান্তি, মৈত্রী, করুণা ,মুদিতা, উপেক্ষা, বীর্য, অধিষ্ঠান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, অলোভ, অদ্বেষ, অমোহ, অক্রোধ,ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সহিষ্ণুতা  ইত্যাদি বহুবিধ গুণধর্মের পূর্ণতা লাভ হল। সংসারে সকল প্রকার পাপকে ধ্বংস করে শান্তিবাদী তাপসের জন্ম সার্থক হল।জগতে এমন পরাশক্তির উৎস উৎকৃষ্ট ধর্ম ক্ষান্তি, মৈত্রী রূপ মহাসম্পদ থাকতে আত্মধ্বংসী   নিকৃষ্ট ধর্ম ক্রোধ, হিংসাকে কেন বরণ করে?

এটি বড় আশ্চর্য বিষয় (জাতক ঈশান ঘোষ ৩১৩)

তথাগত যুদ্ধ সম্পর্কে কাকেও কোনরূপ উপদেশ দেয়নি। পালি সাহিত্যে সর্বত্র বিবাদ, কলহ ও যুদ্ধবিগ্রহের কুফল বর্ণনা দেখা যায় ।এমনকি আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের প্রেরণাও দেননি। তিনি বিনা যুদ্ধে সমগ্র বিশ্বে তার ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোশল রাজ প্রসেনজিৎ এর মধ্যে কাশি গ্রাম নিয়ে যে বিবাদ, সেই ঘটনা উপলক্ষে ভিক্ষুদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন-

জয়ং বেরং পসবতি দুখং সেতি পরাজিতো, উপসন্তো সুখং সেতি হিত্বা জয়, পরাজয়ং। (ধর্ম-সুখবর্গ- ২০১গাথা)।

অর্থাৎ,জয় শত্রুতার সৃষ্টি করে, অপরকে পরাজিত করলে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়।পরাজিত ব্যক্তি খুবই দুঃখে ম্রিয়মান হয়।জয় পরাজয় পরিত্যাগী উভয় অবস্থার মধ্যপন্থী পরমসুখী। রাজা প্রসেনজিৎ যুদ্ধ মনোভাব ত্যাগ করে মিত্রতা স্বরূপ তার কন্যাকে অজাত শত্রুর সাথে বিবাহ দিয়ে কাশীগ্রাম যৌতুক হিসেবে প্রদান করে মৈত্রী স্থাপন করে অতঃপর শান্তিতে সহাবস্থান করে রাজ্য শাসন করছিলেন।

এই মৈত্রীবাণীর আদর্শে আদর্শিত বুদ্ধের পরি নির্মাণ হলে তার অস্থি ধাতু সংগ্রহ করার জন্য রাজাগণ যুদ্ধ-বিগ্রহে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দ্রোণ ব্রাহ্মণের মৈত্রী ভাষণে সবাই যুদ্ধ হতে বিরত থেকে বুদ্ধের অস্থি ধাতু সংগ্রহ করেছিলেন।

মুক্তিপথ প্রদর্শনকারী বুদ্ধ মহাপরি নির্বাণ লাভ করলে যথাসময়ে বিভিন্ন উপাচারের মাধ্যমে দাহকার্য সম্পাদন করা হল।

দাহকার্য সমাপ্ত হওয়ার পর অন্তরীক্ষ থেকে জলধারা পতিত হয়ে চিতাগ্নি নির্বাপিত হল। পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ জলভাণ্ডার থেকে জল উঠে চিতা নির্বাপিত হল। কুশীনরার  মল্লগণ নানাবিধ সুগন্ধি জল দ্বারা চিতা নির্বাপিত করল। মল্লগণ ভগবানের অস্থিগুলো সপ্তাহ কাল মন্ত্রানাগারে রেখে চারদিকে ধনু, বানহস্তে প্রহরী নিয়োগ করে নানা প্রকার নৃত্য, গীত, বাদ্য, মাল্য ও গন্ধ সামগ্রী দ্বারা পূজা করল।

মগধরাজ বৈশালীর লিচ্ছবিগণ, কপিলাবস্তুর শাক্যগণ,অল্লকপ্প দেশের বুলিয়গণ, রাম গ্রামের কোলিয়গণ,বেঠদ্বীপের ব্রাহ্মগণ এবং পাবার মল্লগণ ও দূত পাঠিয়ে ভগবানের দেহাবশেষ প্রার্থনা করলেন। তখন কুশীনারার  মল্লগণ বলল-  ভগবান তাদের দেশের পরিনির্বাণ লাভ করেছেন তারা তাঁর দেহাবশেষ কাকেও দেবেন না।

এভাবে বুদ্ধের দেহাবশেষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অবস্থা হয়েছিল ।তখন দ্রোণ নামক ব্রাহ্মণ সবাইকে বললেন আপনারা আমার কথা শ্রবণ করুন। আমাদের বুদ্ধ ছিলেন ক্ষমাশীল, অহিংসা পরায়ণ, মৈত্রী পরায়ণ। তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে বিবাদ করা ন্যায় সঙ্গত হবে না। আপনারা সকলে একমত হয়ে অস্থিসমূহ ৮ ভাগে বিভক্ত করে স্ব স্ব রাজ্যে নিয়ে গিয়ে স্তুপ প্রতিষ্ঠা করে পূজা করুন। এতে সবাই সম্মতি প্রদান করে। অতঃপর ব্রাহ্মণ মধ্যে অস্থিসমূহ ৮ ভাগে বিভক্ত করে স্ব স্ব রাজ্যে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করলেন। আমাদের উচিত একে অপরকে আক্রমণ না করে মৈত্রী পূর্ণ হৃদয়ে সহাবস্থান করা। আক্রমণকারীর যে মনোবৃত্তি আক্রান্তকারীর সেই মনোবৃত্তি। আক্রমণ ব্যক্তির যেমন ক্ষতিসাধন হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরও ক্ষতিসাধন হয়। যেমন একটি রাজ্যের রাজা যদি অন্য রাজ্যকে আক্রমণ করল। আক্রমণ করতে গিয়ে বহু অর্থ জনবল অর্থবল অস্ত্র বল বিসর্জন দিতে হয়েছে। আক্রান্ত রাজ্যটির ও অনুরূপ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমেরিকা ও ইরাক যুদ্ধ। আমেরিকায় ইরাক আক্রমণ করতে গিয়ে ইরাক রাষ্ট্রের বহু ক্ষতিসাধন করে জয়যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু জয়যুক্ত হওয়ার পরেও মূল যুদ্ধে আমেরিকার যত সৈন্য সামন্ত ক্ষতিষাধন হয়েছে তার চেয়ে বেশি নিহত হয়েছে আমেরিকার সৈনিক ।তাহলে দেখা যায় আক্রমণকারী ও আক্রান্ত ব্যক্তি উভয়েরই ক্ষতিসাধিত হয়। তাই আক্রমণ প্রতি আক্রমণ না করে বন্ধুত্ব স্থাপন করাই শ্রেষ্ঠ। তাতে শান্তি বজায় থাকে, সৌহার্দ্য সম্প্রীতি রক্ষা হয়। জনজীবনের উন্নতি সাধিত হয়। মানব কল্যাণের পথ প্রশস্ত হয়।