কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


বাবলা

আজ অফিস থেকে বেরোতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। ওদিকে ছেলেকে তার ইংরেজি স্যারের বাড়ি ট্যুইশনে নিয়ে যেতে হবে ঠিক সন্ধ্যে সাতটায়। ছেলে তাই সাড়ে ছ'টার সময় আমাদের বাড়ির গলির মুখে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। অফিসের গাড়ি রোজই পিয়ারলেস হসপিটাল মোড় অব্দি ছেড়ে দেয়। সেখান থেকে অন্য দিন হেঁটেই ফিরি, আজ একটা রিক্সা নিলাম। পঞ্চসায়রের পুকুরের পাশ দিয়ে রিক্সাটা যখন  যাচ্ছে, চোখে পড়ল, পুকুরপারে বকুলগাছের নিচে, বাবলা বসে আছে ঘাস লতাপাতার ওপর, গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে, পুকুরের দিকে তাকিয়ে। আমি রিক্সাটাকে তাড়াহুড়ো করে দাঁড় করালাম, 'দাঁড়ান! দাঁড়ান! দাঁড়ান!'  চেঁচালাম রিক্সায় বসেই, 'বাবলা! অ্যাই বাবলা! এখানে কী করছিস?'

বাবলা ফিরে তাকালো। চাহনিতে একরাশ শূন্যতা।

'মায়ের শরীর খুব খারাপ, কাকীমা! আমার মন ভালো নেই। তুমি একটু আমাদের বাড়ি হয়ে যাবে? প্লিজ!'

বাবলা, কুশলদা আর রমাবৌদির ছেলে। কুশলদা মারা গেছেন কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে। আমার বাড়ির মুখোমুখিই ওদের বাড়ি। আমি সকালে অফিসে বেরোনোর সময় তো বৌদি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন দেখলুম!

 'আয়, বাড়ি চল। তোদের বাড়ি হয়েই যাই একেবারে। মা অসুস্থ জেনে মনখারাপ করে বসে আছিস, এ কেমন কথা? এখন তো তোর মায়ের সঙ্গেই থাকা উচিত!' আমি বাবলাকে স্নেহের ধমক দিলুম।

'তুমি যাও। আমি আসছি!'

কী যে ছিল ওর স্বরে, আমি আর কিছু বলতে পারলাম না ওকে। রিক্সাচালককে অনুরোধ করলাম, দাদা, একটু তাড়াতাড়ি চালান।

বাড়িতে ঢোকার গলির মুখে ছেলে যথারীতি দাঁড়িয়ে ছিল। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ওকে বললুম, 'আয় তো বাবা! রমাজেঠিমা না কি অসুস্থ খুব!' দুজনেই প্রায় ছুটে ঢুকলাম গলিতে। কিন্তু রমাবৌদিদের বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ তো! এ কী রে বাবা! অসুস্থ মা'কে রেখে বাবলা বেরিয়েছে যদি, তবে দরজা বন্ধ করলো কে? ছেলে কলিংবেল বাজালো। আমি ডাকলাম বেশ কয়েকবার, ‘রমাবৌদি! রমাবৌদি!’  

সাড়া নেই। শব্দ নেই। আমাদের হাঁকডাকে এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে ক'জন মুখ বাড়িয়ে দেখে গেল, এই মাত্র। আমি ছেলেকে বললাম, 'দরজা ভাঙতে হবে। ক্লাবের ছেলেদের ডেকে আন!'

তিনমিনিটের মাথায় ক্লাবের চারজন ছেলে চলে এলো। এই তিনমিনিট ধরে আমি বৌদি আর বাবলার মোবাইলে সমানে ফোন করে গেলাম। মনে হচ্ছিল, ঘরের মধ্যেই রিং হচ্ছে। কিন্তু কেউ তো ধরছে না!

ক্লাবের ছেলেরা এসে দরজা ভেঙে ফেললো। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে রমাবৌদি পড়ে আছেন। দৌড়ে গিয়ে নাকের সামনে হাত দিয়ে দেখলাম, নিঃশ্বাস পড়ছে। নাড়ি দেখলাম, মন্দগতি। কেউ একজন জলের বোতল এনে দিল। আমি জলের ঝাপটা দিচ্ছিলাম বৌদির মুখে। ক্লাবের একটি ছেলে হঠাৎ চীৎকার করে উঠলো,  'বাবলা! বাবলা!' ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাবলার শোবার ঘরের দরজা দিয়ে প্রথমেই নজরে এলো, ঝুলন্ত দুটো পা! আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে, বাবলা ঝুলছে ছাদের পাখা থেকে, চোখদুটো খোলা, তাতে একরাশ শূন্যতা। 

কেউ একজন বললো, 'ইসস! স্কুলে চাকরি করতো তো! কী এমন হলো?'

আমি বাবলার পড়ার টেবিলে তালা চাপা দেওয়া  চিঠিটা দেখতে পেলাম, 'মা! যে চাকরিটা পাবো বলে তোমার আর বাবার সব সঞ্চয় ভেঙে টাকা দিয়েছিলাম, সেই চাকরিটা আর নেই। আমাকে ক্ষমা কোরো না।'

আমি ক্লাবের ছেলেদের অনুরোধ করলাম, 'বৌদিকে হসপিটালে নিয়ে যেতে সাহায্য করো। বেঁচে যাবেন হয়তো। আর থানায় ফোন করে দাও।'


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন