গরিবের গরম ভাত,
বা এক নিছক বিবাহবিচ্ছিন্ন সাহিত্যিক দম্পতির গল্প
গত তিন দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে উদারনৈতিকায়ন গণবিতরণব্যবস্থার কোমর ভেঙে দেওয়ার পরে, তার চাপে অনেক রাজ্যসরকারকে
ভোটের দায়ে গরিবকে কম পয়সায় চাল দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছিল। পরে চতুর্দশ সাধারণ নির্বাচনের আগে
দেশের এনজিওগুলি যে সাধারণ ইস্তাহার বের করে তার চাপে কেন্দ্রের সরকার বাহাদুরের
গঠক রাজনৈতিক দলজোট তাদের সাধারণ ন্যূনতম কার্যক্রমে ‘খাদ্যের অধিকার’-কে কিছুটা
স্বীকার করে নেয়। আর সেটা করে বাঁকা পথে, পিছনের দরজা দিয়ে, চুরি করে তথাকথিত
উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কার জারি রাখার স্বার্থেই। তার থেকেই আস্তে আস্তে এসেছে
রাষ্ট্রের তরফে বাড়িতে গরিবমানুষদের সব্বার দু’টাকা দামের চাল১ (পঃ বঙ্গে আবার একটাকায়), আর ইস্কুলে
দুপুরের মিনি পয়সার ভাত-ডাল-সব্জি- ডিম যোগানোর দায়। এটাকে আবার শহরের শিক্ষিত সমাজ-সচেতন লোক ‘পপিউলিজ্ম’ বলে নাক সিঁটকান। সিঁটকাতেই
পারেন। ধনিকের না শোধ করা ব্যাঙ্কের ঋণ যে দেশে শতলক্ষ কোটি টাকার অনেক বেশি,
সেখানে দেশের গরিবের অর্ধাহারের অভিশাপ দূর করার প্রকল্প, দুপুরে একটু ভাত
খাওয়াবার প্রকল্প যদি অর্থনাশ না হয় তবে আর কোনটা হবে? ফলে তাঁদের কষ্টের,
মনস্তাপের বিরাম নেই যে ইস্কুলে দুপুরের মিনি পয়সার ভাত-ডাল-সব্জি-ডিম যজ্ঞি কেমন করে নেকাপড়ার পরিবেশ নষ্ট করছে, মাস্টারদের ক্যাটারার করে দিচ্ছে, ছাত্রদের/ছাত্রীদের
পেট চেপে পড়ার পিতিজ্ঞে নষ্ট করে দিচ্ছে ইত্যাদি।
কিন্তু এই সারাদেশের গরিবের
ভাতযজ্ঞির কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে এক বিবাহবিচ্ছিন্ন সাহিত্যিক দম্পতির কথা। একটু তাঁদের কথা বলি। বাংলা নাটকের কিংবদন্তী নট নাট্যকার পরিচালক অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা গল্প বলেছিলেন ‘নবান্ন’ নাটকের যুগন্ধর রচয়িতা বিজন ভট্টাচার্য সম্পর্কে
যেটা বাংলা সংস্কৃতির
মণিমুক্তোর সংগ্রহে স্থান পেয়ে আছে। সেটা অর্ধেক তাঁর আর অর্ধেক আমার ভাষায় বলি — ঋত্বিক ঘটক পরিচালনা করছেন ‘কোমল গান্ধার’ ছবি, পাজামা পাঞ্জাবি পরে জ্বলন্ত বিড়ি টানতে টানতে কুঁজো হয়ে ঝুঁকে স্ক্রিপ্ট-এর দিকে। তার একটি দৃশ্য হলো অবনীশবাবু একটা
প্রগতিশীল নাটকের দলের
নির্দেশক। সুপ্রিয়া দেবী সেই দলের নায়িকা। একটা সাধারণ ধর্মঘটের দিন বন্ধ দোকানের ভেতরে ওঁরা নাটক করছেন ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’। নায়িকা বুঝছেন
না আধুনিক সময়ে শকুন্তলা অভিনয় কেন প্রাসঙ্গিক হবে। নায়ক উত্তেজিত হয়ে টেবিলে কিল মেরে বলবেন, ‘ইমোশান মেমারি ইউজ করো না কেন?’ সেটা ঋত্বিক অবনীশবাবুকে অভিনয় ক’রে দেখিয়ে দিলেন। আর নায়িকা সুপ্রিয়াকে বললেন ‘‘তুমি তো বাংলাদেশের
মেয়ে,
দেশ ছেড়ে চিরকালের মতো চলে আসতে তোমার যা কষ্ট, পতিগৃহ ছেড়ে
যেতে শকুন্তলারও সেই কষ্ট। ঐ যে ভিখারি ছেলেটি তোমার আঁচল ধরে টানল ঐ তো হরিণশিশু!’’ পাশের নিঃশব্দ প্রায়ান্ধকার থেকে একজনের আওয়াজ এলো, ‘‘আহা!’’
ঋত্বিকবাবু থেমে সেদিকে ফিরে কাউকে শুধোলেন, ‘‘কি ঠিক আছে?’’ চেয়ারে দু’পা তুলে ঝিমোনোর ভঙ্গীতে বসে থাকা এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘‘খুব ঠিক আছে।’’ শুটিংএর আগাগোড়া
ঋত্বিকবাবু চলতে ফিরতে কোণের অন্ধকারকে, ‘‘ঠিক যাচ্ছে তো?’’ অন্ধকারের ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘‘ঠিক।’’ বারদুয়েক এমনি হওয়ার পর পাশের একজনকে অজিতেশ জিজ্ঞাসা করলেন
ইনি কে?
ভদ্রলোক ফিস ফিস করে বললেন — বিজন ভট্টাচার্য।২
এই বিজন ভট্টাচার্য হচ্ছেন ‘নবান্ন’
নাটকের রচয়িতা, নট। নাটকের
ক্ষেত্রে অজিতেশের উল্লেখ এই জন্যেই যে তাঁর
আগে বিজন ভট্টাচার্যই বাংলা নাটকের প্রথম ট্রাজিক নায়ক। স্বয়ং ঋত্বিক
যাঁর কাছে নির্দেশনার মান বা অন্তর্দৃষ্টি খতিয়ে নেন তাঁর মাপ কী তা বুঝতে কষ্ট
হওয়ার কথা নয়। বস্তুতঃ বাংলা চলচ্চিত্রে এই গল্পের তুলনা একটাই আছে। সত্যজিৎ রায় ‘পথের
পাঁচালি’ করার পরে দেখাচ্ছেন আগে কমলকুমার
মজুমদারকে আর কমলকুমার এটা কিসসু হয়নি বলার পরে অম্লানবদনে অগ্রাহ্য নয় মলিনমুখে
মেনে নিচ্ছেন এই সমালোচনা আর ধাতানি।
বিজন
ভট্টাচার্যর একষট্টি বছরের ক্লিষ্ট জীবন (জুলাই ১৭, ১৯১৭-জানুআরি ১৯,
১৯৭৮) আমাদের বাংলা সাহিত্য ও
শিল্পের কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা আর প্রবণতার জ্যান্ত দলিল। অনেকগুলি নাটক লিখেছেন
বিজন, আগুন (১৯৪৩), জবানবন্দী
(১৯৪৩), নবান্ন (১৯৪৪), জীয়নকন্যা (১৯৪৬), কলঙ্ক
(১৯৪৬), অবরোধ (১৯৪৭), মরাচাঁদ
(১৯৫১), লাশ ঘুইর্যা যাউক, দেবী গর্জন (১৯৬৬), গর্ভবতী জননী
(১৯৬৯), গোত্রান্তর (১৯৫৯), কৃষ্ণপক্ষ (), আজ বসন্ত, চল সাগরে,
হাঁসখালির হাঁস। ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), সুবর্ণরেখা (১৯৬৫), যুক্তি-তক্কো-গপ্পো (১৯৭৭)-এ তাঁর অসাধারণ অভিনয় ছাড়াও সাড়ে
চুয়াত্তর (১৯৫৩), তথাপি (১৯৫০), ছিন্নমূল (১৯৫০), কোমল গান্ধার(১৯৬১), কষ্টিপাথর(১৯৬৪), পূর্ণেন্দু পত্রীর স্বপ্ন নিয়ে (১৯৬৬), বাড়ি থেকে
পালিয়ে (১৯৬৬)
কমললতা(১৯৬৯), মৃণাল সেনের পদাতিক (১৯৭৩), ভোলা ময়রা (১৯৭৭), স্বাতী (১৯৭৭),
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর দূরত্ব
(১৯৭৯)-তে তাঁর অভিনয় মনে রাখার।
‘নবান্ন’ বিজন ভট্টাচার্যর
প্রথম তিনটি নাটকের তৃতীয়। তিনটির মিলও আছে। সবকটিই
দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় লেখা। প্রথমটি পথনাটিকার আঙ্গিকে লেখা ‘আগুন’, ১৯৪৩ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে শহর কলকাতায় যখন রেশনের দোকান থেকে
কলের জলে মানুষের কিউয়িং বা লাইন দেওয়াই জীবনের সব চেয়ে চেনা ছবি সেখানে নাটকের
শেষ দৃশ্যে রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে পাঁচজন মানুষ বাঁচার পথ খুঁজতে চাইছে। দ্বিতীয়
নাটক ‘জবানবন্দী’। অস্থির কলকাতায় যখন অনাহারে মরা
মানুষের পাশাপাশি পুলিশের গুলিতে মরা যুবকের মৃতদেহ নাগরিক জীবনের সংজ্ঞা দিচ্ছে, তখন নাটকের ভাষা খুঁজে পেতে আকুল বিজন পার্কের রেলিঙে বসা
এক নারী পুরুষকে তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের, নবান্নর, পুজো পার্বণের গল্পরত অবস্থায় নিজেদের গ্রামের এখন কী অবস্থা সে বিষয়ে
ভাবনা করতে দেখে তাদের আত্মকথনকে ‘জবানবন্দী’ নাটকে নিয়ে আসেন ১৯৪৩এই। ‘নবান্ন’
নাটক আসে ১৯৪৪ সালে, যখন মন্বন্তরের কালো ছায়া দেশের আর কলকাতার বুকে আরো গাঢ় হয়ে চেপে বসেছে।
সেখানে মাতঙ্গিনী হাজরার দেশ মেদিনীপুর জেলার পটভূমিকায়
প্রধান সমাদ্দারের জবানবন্দীতে লেখা ‘নবান্ন’ বাংলা নাটকের দিক পরিবর্তন করে দেয়।
যুদ্ধের সময় কলকাতায় আসা ইংরেজ সৈনিকদের
একজন বৈমানিক বিল বাটলার এই নাটক দেখে বিজনকে এক আবেগমথিত চিঠি লেখেন। এইরকম বহু
ইংরেজের মানবতাবাদী ক্ষোভের মুখে পড়ে ব্রিটিশ সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন
চার্চিল ১৯৪৪-এর 'দুর্ভিক্ষ তদন্ত
কমিশন' গঠন করতে বাধ্য হন। এই কমিশনের প্রতিবেদনে পরিস্থিতির
সন্নিষ্ঠ বিশ্লেষণ ছাড়াও যুদ্ধের স্বার্থে ইংরেজ সরকারের সুপরিকল্পিত লুণ্ঠন ও
কৃষকহত্যার নীতি, বেপরোয়া চোরাকারবার ও মজুতদারিকে কাঠগড়ায়
তুলেছিল। এই দিক থেকে দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পণ’ ছাড়া সামাজিক রাজনৈতিক অভিঘাতের ব্যাপারে ‘নবান্ন’র
জুড়ি নেই।
বক্তব্য ছাড়াও ড্রামাটার্জির
দিক থেকেও ‘নবান্ন’ বাংলা নাটকের
গতিধারা পালটে দিয়েছিল। ঋত্বিক এই নাটক সম্বন্ধে
লিখলেন - “বিজনবাবুই প্রথম দেখালেন কি করে
জনতার প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়, কি করে
সম্মিলিত অভিনয়-ধারার প্রবর্তন করা যায় এবং কি করে বাস্তবের একটা অংশের অখণ্ডরূপ
মঞ্চের উপর তুলে ধরা যায়। আমরা যারা এমন চেষ্টা করেছিলাম, সেসব
দিনের কথা ভুলব না। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আলোড়ন বাংলার একপ্রান্ত থেকে আর এক
প্রান্তকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টবৎ শিহরিত করে তুলল”।৩
গণনাট্য সঙ্ঘের প্রয়োজনে মাত্র ন’ দিনে লেখা হয়েছিল এই নাটক। প্রগতি
লেখক সংঘে এর পাঠ শুনে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন — আপনি তো জাত চাষা! সেই সময়কার ব্যবসায়িক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, মেলোড্রামাটিক, চটকদারি
থিয়েটারের চাপে কলকাতার মানুষ যখন মাইকেলের ভাষায় ‘অলীক কুনাট্যরঙ্গে মজে’, তখন উৎপল দত্তর কথায় “অমরেন্দ্রনাথের মঞ্চসজ্জা ব্যবসায়িক চটকে পরিণত হয়ে
পরবর্তীকালে নাট্যশালায় বহু সস্তা জিনিসের প্রবেশপথ করে দিয়েছিল।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ স্রেফ চট টাঙিয়ে অভিনয় করে ঐ জীর্ণ ব্যবসায়িকতার মৃত্যুবাণ হানেন। বুর্জোয়া বাস্তববাদের বিরুদ্ধে 'নবান্ন' ছিল শ্রেণীসচেতন গণনাট্য সংঘের অভিযান”।৪
বিজনের
নাটকগুলির বিষয় সবসময়েই ছিল গরিব মানুষের সমস্যা। যেমন — ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পটভূমিকায় জীয়নকন্যা; চব্বিশ পরগনার এক অন্ধ গায়কের জীবনকাহিনী নিয়ে মরাচাঁদ; বাঁকুড়ার সাঁওতাল জীবনকে নিয়ে কলঙ্ক, ছিন্নমূল পূর্ববঙ্গবাসীর ভাগ্যবিপর্যয় নিয়ে গোত্রান্তর
(১৯৬০);
মুনাফাখোর মিল-মালিক ও শোষিত শ্রমিকদের নিয়ে অবরোধ (১৯৪৭); প্রবাদপ্রতিম দেবীগর্জন (১৯৬৬) যার শেষ দৃশ্যে নির্যাতিতার খড়্গধারণে দেবী দুর্গার ছায়া; পরের বহু নাটক আর চলচ্চিত্রে ক্লিশে হয়ে গিয়েছিল; বেদেদের জীবন
নিয়ে গর্ভবতী জননী ইত্যাদি। গরিবের স্বার্থে বামপন্থী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারের কাজ করলেও দেবীগর্জন ছাড়া এই সব নাটকের কোনোটাই নবান্ন-র সমান
অভিঘাত তৈরি করেনি। ঋত্বিকের
অনেক ছবিতেও তিনি অভিনয় করেন — যেমন বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা, পদাতিক, যুক্তি তক্কো গপ্পো। এইসব ছবিতে তাঁর অভিনয় কতটা মঞ্চভাঙা হয়ে উঠেছিল কেবল রসজ্ঞ তার সন্ধান রাখে।৫
মহাশ্বেতা
দেবীর সঙ্গে বিজনের বিয়ে হয় ১৯৪৭-এ, তাঁদের প্রথম যখন দেখা হয় তখনও তিনি ‘নবান্ন’র অভিনয় দেখেননি। সেই সময়ে
বিজন তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির
সাংস্কৃতিক সম্মুখমঞ্চ আইপিটিএ-র সক্রিয়
নেতৃস্থানীয় সদস্য,
আর মহাশ্বেতা দেবী ছাত্র শাখায়।
বিপ্লবী ও সাংবাদিক সত্যেন মজুমদার বিজনের কথা বলেন মহাশ্বেতার বাবা মণীশ ঘটককে।
দুজনের আলাপের পরিণতি হয় বিয়েতে।
প্রথাভাঙা কবি আর ঔপন্যাসিক, কনখল আর পটল ডাঙার পাঁচালীর লেখক মণীশ, আর প্রথাভাঙা চলচ্চিত্রকার ঋত্বিকের পরিবারের কন্যার
সঙ্গে এই বিয়ে ছিল সেই সময়কার কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
প্রত্নবতীও, কারণ হার্বার্ট, কাঙাল
মালসাট-এর
লেখক নবারুণ মণীশ-ঋত্বিক-মহাশ্বেতার সাহিত্যিক ধারার সঙ্গে বিজনের নাট্যধারারও
বাহক যে। ভুলে গেলে চলবে না বিজনের ‘নবান্ন’ বাংলা পেরিয়ে ভারতীয় নাটক ছবিকে প্রভাবিত করেছিল। খোয়াজা আহমদ আব্বাস যে বিখ্যাত
ধ্রুপদী ছবি ‘ধরতি কে লাল’ করেন ১৯৪৬-এ, ১৯৪৩-৪৪-এর মন্বন্তরের কঠোর সমালোচনা নিয়ে তার ভিত্তি ছিল বিজনের নবান্ন নাটক আর কৃষেণ চন্দরের ‘অন্নদা’ গল্প। সলিল সেন,
দিগিন ব্যানার্জি, আর তুলসী লাহিড়ির সঙ্গে বিজন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী
নাট্য আন্দোলনের পুরোধা।
তাঁদের
বিয়ে কিন্তু ভেঙে যায় ১৯৬২তে। মহাশ্বেতা লেখক অসিত গুপ্তকে বিয়ে করেন সেই বছরেই। চোদ্দ বছরের ছেলে আর স্বামীকে ছেড়ে আসেন
মহাশ্বেতা। কারণটা কী? আজকের নারীবাদী ভাষায় ‘স্পেস’, অথবা
অন্য কিছু? মহাশ্বেতা দেবী একাধিক জায়গায় বলেছেন — বিবাহিত জীবনে বিজন
তাঁর কোনো কাজে বাধা দেন নি। এমনকি যখন ছেলে নবারুণের চোদ্দ বছর বয়সে মহাশ্বেতা নিজের সৃষ্টিশীল স্পেসের জন্যে বিজন আর ছেলেকে ছেড়ে আসেন,
তখনও নয়। নিজের অধিকারে সাহিত্যের পরিসর বাড়ানো উপন্যাসিক নবারুণের মৃত্যুর পরে
একাধিক লেখায় / সাক্ষাৎকারে নিজের ত্রুটিস্বীকার প্রসঙ্গে মহাশ্বেতা দেবী বিজনের মহত্বের কিছু পরোক্ষ ছবি তুলে ধরেছেন। এগুলির একটি এই সময় কাগজে সেগুলিতে বিজনের অপুরুষী স্বামীত্বের আর মাতৃপ্রতিম পিতৃত্ব ও বাৎসল্যর যে ছবি ফুটে ওঠে, সেগুলি খুব অন্তর্দৃষ্টিশীল।৬ আমি এর থেকে একটু অংশ
তুলে দিচ্ছি।
মহাশ্বেতা নিজেই বলছেন-
আমার ছেলের ১৪ বছর বয়সে স্বামীকে ছেড়ে এসেছিলাম৷ ঠিক করেছিলাম, একা থাকব। এমন নয় যে, বিজন আমাকে কোনো
বাধা দিয়েছিলেন৷ উনি আমার সব কাজেই আমাকে অসম্ভব উৎসাহ দিয়েছেন৷ বলা যায়, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা৷ আমার অসম্ভব স্বাধীনতা ছিল৷ আমার সব কিছু, প্রতিটি কাজকর্মেই তিনি থাকতেন৷ মানুষ হিসাবে অসম্ভব খোলামেলা৷ আর একদম
খাঁটি শিল্পী৷
এমন নয় যে, আমার সঙ্গে
বিজনের কোনো বড়োসড়ো ঝগড়া হয়েছে৷ কোনো কথা-কাটাকাটিও হয়নি, যা হয়েছে সে
যৎসামান্য মতবিরোধ৷ অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে৷ বাট আই ওয়াজ ফোর্সড টু লিভ মাই সান৷
বিজন
কি তবে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন মহাশ্বেতাকে?
এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে? কারণ শেষ উদ্ধৃতিতে একটা কথা আছে ‘বাট আই ওয়াজ ফোর্সড টু লিভ মাই সান৷’ আমাদের নির্ভর করতে হয় মহাশ্বেতার বয়ানের উপর। বিজন
নীরব ছিলেন। নবারুণও কিচ্ছু বলেননি। কিন্তু তাতেও শেষ উক্তিটিতে যে মেঘ জমাট হয়ে
আছে!
কিন্তু
বিবাহবিচ্ছেদের পরেও মহাশ্বেতার উপরে বিজনের প্রভাব ছিল না কি? তার বিচারের আগে বিজনের গানের কথা বলি।
বিজন
কিছু গান লিখে সুরও দিয়েছেন, অবশ্যই নাটকের
প্রয়োজনে। গানগুলি কিন্তু কাব্যগুণে এমন কিছু নয়, কিন্তু তার মেসেজ সেই সময়ে ছিল অমোঘ। গান ‘নবান্ন’
নাটকেও ছিল। তার এক তুঙ্গ মুহূর্তে দুর্গত
মানুষের প্রতিনিধি প্রধান সমাদ্দার যখন
নাগরিক জীবনের দুর্গত উদাসীনতাকে ধাক্কা দিয়ে বলছে ‘আর কত চেঁচাব বাবু দুটো ভাতের জন্য, তোমরা কি সব বধির হয়ে গেছ বাবু কিছু কানে শোন না?’, সেখানেই নাটক শেষ করেন নি বিজন। এই নাটকেরই চতুর্থ অঙ্কে ফকিরের গলায় যে গান ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম মিথ্যা সে বয়ান।/ হিন্দু মুসলমান যতেক চাষি
দোস্তালি পাতান।/ এছাড়া আর উপায় নাই সার বুঝ সবে।/ আজও যদি শিক্ষা না হয় শিক্ষা
হবে কবে।’ ঘুরে ফিরে এসেছে বিজনের গানে। ‘ও ওই! ও হোসেন ভাই দামুকদিয়ার চাচা’ নামের দীর্ঘ গানের শেষ দুই স্তবকে যে কথা বলা হচ্ছে, আজকের এই সঙ্ঘী আমরা-ওরার দীর্ণ দিনে তার
প্রাসঙ্গিকতা অমোঘ—
‘তোমার আমার মধ্যিখানে আস্মান জমিন ফারাক কইরে
তারা দুই সতীনের ঘর বানিছে
দেইখ্যাও দেখি নাই।
এখন আমার হাসি হইছে বাঁকা
তোমার কথা সন্দো মাখা
পরস্পরের মন বিষাইছে অদৃষ্টের
বালাই।
এখনও সময় আছে দুইখানা হাত এক করিতে
ওই যে সোনার হরিণ আছে দেইখ্যা
শ্যাষে পাছে ছুইট্টো না
ও যে গোলক ধাঁধা বুঝা কথা
হুস ফিরাইয়া আনো চাচা;
ঘরের কথা পরের কাছে কইবার যাইও না।’৭
আমরা
কিন্তু এখনও ‘ঘরের কথা পরের কাছে কইবার’ প্রয়াসে অবিচল। মহাশ্বেতার সঙ্গে বিজনের সম্পর্ক ছিল
না পরে। কিন্তু প্রভাব? মহাশ্বেতার বিপুল
সাহিত্যসম্ভারের কথা আর তাতে প্রান্তিক মানুষের কথা এখানে আনছি না। কারণ মহাশ্বেতা
বিজনের চেয়ে অনেক বহুমাত্রিক, তাঁর সাহিত্যকর্মে, যাতে জনজাতির, আদিবাসীর দুঃখও
অনেক বেশি দেদীপ্যমাণ। কিন্তু তাঁর ‘ভাত’ গল্পে ‘নবান্ন’র ছায়াপাত নেই? বানভাসি বাদা অঞ্চল থেকে ভাতখোরাকিতে কাজ করতে শহরে এসেছে নিরন্ন মানুষ। বাড়ির বড় বৌমার
পছন্দ হয়নি তার উগ্র,
বুনো চেহারা আর হ্রস্ব লুঙ্গি। গল্পে ‘বড়কর্তা মৃত্যুশয্যায়। ... মেজবউ উনোন পাড়ে বসেছে।
শাশুড়ীর মাছ খাওয়া বুঝি ঘুচে যায়। তাই কয়েকদিন ধরে বড় ইলিশ, পাকা পোনার পেটি, চিতলের কোল, ডিমপোরা ট্যাংরা, বড় ভেটকি মাছের যজ্ঞি লেগেছে।... বাড়িতে নানান রকমের চাল
বের করতে হচ্ছে। ... ঝিঙেশাল চালের ভাত নিরামিষ ডাল তরকারির সঙ্গে। রামশাল চালের
ভাত মাছের সঙ্গে। বড়বাবু কনকপানি চাল ছাড়া খান না, মেজ আর ছোটর জন্য বারোমাস পদ্মজালি চাল রান্না হয়। বামুন-চাকর-ঝি-দের
জন্যে মোটা সাপটা
চাল।... বাদার লোকটি কাঠ কাটতে কাটতে চোখ তুলে দেখে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে তার’।
কিন্তু তার খিদের আগুন দেখেও
শ্বশুরগতপ্রাণ বড় বউয়ের রাগ, ‘তা ওই
লোকটাকে ধরে আনা কাঠ কাটার জন্যে। ও নাকি কদিন খায়নি। … বাদায় থাকে অথচ ভাতের আহিংকে এতখানি। এ আবার কী কথা? বাদায় চালের অভাব না কি? দেখো না একতলায় গিয়ে। ডোলে ডোলে কতরকম চাল থরে থরে সাজানো আছে।’ কেউ বলছে ‘উচ্ছবের মতিচ্ছন্ন হয়েছে বই তো নয়। বউ-ছেলে-মেয়ে অপঘাতে মরল, মানুষ পাগল হয়ে যায়। উচ্ছব ভাত ভাত করচে দেখো।’
কিন্তু বড়কত্তাকে বাঁচাতে যজ্ঞি
শেষ হওয়ার আগে রান্না ভাত, তরকারি,
মাছ খাওয়া যায়নি। ফলে উচ্ছবও গল্পে খেতে পায়নি সহজে, অশুচি হওয়ার আগে। যদিও নিজের গ্রামে বানে পরিবার ভেসে যাওয়ার কথা ভেবে জল
গড়ানো চোখে সে ভাবছে ‘ভাত খাবে আজ।
সেই আশাতেই প্রেত উচ্ছব মানুষ হয়ে গেল নাকি? বড়-মেয়ে
ছোট খোকার কথা মনে হতে চোখে জল এল এমন হঠাৎ? ভাতই সব। ... অন্নই লক্ষ্মী, ঠাগমা বলত।
ঠাগমা বলত, রন্নো হল মা নক্কী।’
অশৌচের বাড়ির ভাত ফেলে দেওয়ার
ভার নিয়ে সে নিয়ে স্টেশনে চলে যায়। গিয়ে—
খাবল খাবল ভাত খায়। ভাতে হাত
ঢুকিয়ে দিতে সে স্বর্গসুখ পায় ভাতের স্পর্শে। ... খেতে খেতে তার যে কী হয়। মুখ
ডুবিয়ে দিয়ে খায়। ভাত, শুধু ভাত।
বাদার ভাত। বাদার ভাত খেলে তবে তো সে আসল বাদাটার খোঁজ পেয়ে যাবে একদিন। ... সে
বাদাটার খোঁজ নির্ঘাৎ পাবে উচ্ছব। আরো ভাত খেয়ে নি। চন্নুনিরে! তুইও খা, চন্নুনির মা খাও, ছোট খোকা খা, আমার মধ্যে
বসে তোরাও খা! আঃ এবার জল খাই, জল। তারপর আরো ভাত। ভোরের টেনে চেইপে বসে সোজা ক্যানিং
যাচ্চি। ভাত পেটে পড়েচে এখন ঝানচি ঝে ক্যানিং হয়ে দেশঘরে ঝেতে হবে।৬
মানছি নাগরিক নিম্নবর্গের গল্প পটল ডাঙার পাঁচালীর লেখক মণীশের কন্যা, ঋত্বিকের ভ্রাতুষ্পুত্রী, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মহাশ্বেতা প্রান্তিক মানুষের কথা ভাবতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু বিজনের
প্রভাব ছিল না?
বিজনের গৃহে দরিদ্র মানুষের কষ্টের
ছোট নাট্যিক ফ্রেমে হয়তো মহাশ্বেতার প্রতিভা আঁটেনি। কিন্তু তাও? তাঁদের ভাঙা বিয়ে ভাতে জিতে গিয়েছিল। সেই ভাত আজ
নিরন্ন, গরিব মানুষকে দিচ্ছে, বা দিতে বাধ্য হচ্ছে রাষ্ট্র। মানি এর পিছনে কেবল এই
দম্পতির কৃতিত্ব নেই। কিন্তু যে চেতনা তাঁরা তয়ের করেছিলেন তার অবদান ছোট করা
যাবে?
সংক্ষিপ্ত
সূত্র
১। এর জন্য পড়ুন, Rob Jenkins, ‘Political Skills: Introducing
Reforms by Stealth’, যত্র Rahul Mukherjee (ed.), India’s Economic
Transition: The Politics of Reforms (Delhi: Oxford University Press, 2007),
pp. 171-90 ।
২।কিংশুক রায় ‘আর কত চেঁচাব বাবু দুটো ভাতের
জন্য’, গণশক্তি, ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=70143)।
৩। 'গন্ধর্ব', বিজন
ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা।
৪। শোভন গুপ্ত, ‘বিজন ভট্টাচার্য ফিরে দেখা’, https://www.parabaas.com/PB61/LEKHA/pSovon61.shtml।
৫। bn.banglapedia.org/index.php?title=ভট্টাচার্য,_বিজন।
৬। এই সময়, আগস্ট ১২, ২০১৪।
৭। সুব্রত
রুদ্র, গণসঙ্গীত সংগ্রহ, ১৯৯০।
৭। গল্পপাঠ: মহাশ্বেতা দেবী'র গল্প: ভাত, www.galpopath.com/2016/08/blog-post_97.htm।