কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১০৯  

 

মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার বয়স হলো চুয়াল্লিশ বছর। ইতিপূর্বে ১০৮টি সংখ্যা  প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী ১০৯তম সংখ্যা প্রকাশিত হবে এই ডিসেম্বর (পৌষ) মাসেই। দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছরের জার্নিতে, শততম সংখ্যা পর্যন্ত সাধারণ সংখ্যা রূপে প্রকাশিত হবার পর, একশ-একতম সংখ্যা থেকে বিশেষ সংখ্যা রূপে প্রকাশিত হচ্ছে। আগে বছরে পত্রিকার একাধিক সংখ্যা প্রকাশিত হতো। ১০১তম সংখ্যা থেকে বছরে একটি সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। বিগত আট বছরে যে আটটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, তার বিষয়গুলি ছিল – পরকীয়া, সমকামিতা ও রূপান্তরকামিতা, অতিপ্রাকৃত, মৃত্যুচেতনা, সৃষ্টি, ভূত, মহামারি, ভন্ডামি। এবং এবছর বিষয় হচ্ছে ‘ক্ষমতা’। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ক্রমসংখ্য ১ থেকে ১০০র মধ্যেও চারটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল – চিত্রাঙ্গদা সংখ্যা, জামশেদপুরে চলচ্চিত্রচর্চা সংখ্যা, স্বদেশ সেন সংখ্যা এবং সমীর রায়চৌধুরী সংখ্যা।

‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০৯তম সংখ্যার বিষয় আমরা বেছে নিয়েছি – ক্ষমতা (Power)। এই বিষয়টি মূলত পদার্থবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। পদার্থবিদ্যা বা ফিজিক্সে ক্ষমতার পরিভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে, একক সময়ে সম্পাদিত কাজের পরিমাণই ক্ষমতা। এস্ আই একক পদ্ধতির পরিমাপে ক্ষমতার একক ওয়াট।  ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বৈজ্ঞানিক জেমস ওয়াটের নামানুসারে ক্ষমতার একক ‘ওয়াট স্থির করা হয়েছে। ১ সেকেণ্ড সময়ে ১ জুল পরিমাণ কাজ করার ক্ষমতা হলো ১ ওয়াট। আবার এই ক্ষমতা বা power বিষয়টির পাশাপাশি পদার্থবিজ্ঞানে আর  একটি বিষয় হচ্ছে শক্তি (Energy)। বলা বাহুল্য যে, এই দুটি বিষয় আলাদা  হলেও, একে অপরের পরিপূরকও।

পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনা আপাতত থাক, আমরা বরং এই ক্ষমতা ও শক্তির যে প্রয়োগ এবং ব্যবহার আমাদের সামগ্রীক জীবনযাপন ও চর্যার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করি, সে সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি এই সংখ্যায়। বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’। এখানে যে ‘জোর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তার অন্যতম প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘শক্তি’ এবং ‘মুল্লুক তার  অর্থে ক্ষমতা দখল। অর্থাৎ শক্তি থাকলে যেমন ক্ষমতা দখল করা যায়, তেমনি শক্তি হারালে ক্ষমতাও হারাতে হয়। আর এই শক্তি ও ক্ষমতার যুগলবন্দী চলে আসছে প্রাণীসভ্যতার সূচনা থেকে। তবে যেহেতু মানবসভ্যতা ক্রম বিকশিত হলেও অন্যান্য প্রাণীদের সভ্যতার কোনো বিকাশ হয়নি, তাই তাদের মধ্যে ক্ষমতার ব্যবহার থাকলেও ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো সুযোগই ঘটেনি। কিন্তু মানবসভ্যতা যেমন যেমন বিকশিত হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার ততই প্রকট ও বীভৎস হয়ে উঠেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, শিক্ষা, সাহিত্য, কলা, ধর্ম, দাম্পত্য – সর্বত্রই। ‘কালিমাটি পত্রিকার একশ-নয়তম সংখ্যায়  ক্ষমতার সেই ব্যবহার ও অপব্যবহারের রূপরেখা ও চিত্র মোটামুটিভাবে তুলে ধরার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস। 

এই সংখ্যায় যাঁদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য। তাঁদের সুচিন্তিত ও মননশীল লেখাগুলি প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সমাদৃত হবে, এ ব্যাপারে আমরা সুনিশ্চিত। আশাকরি, আপনারা সবাই মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার এই সংখ্যাটি পড়ার জন্য আগ্রহী হবেন এবং সংখ্যাটি সংগ্রহ করার জন্য উৎসাহী হবেন।

সবাইকে জানাই আমাদের পৌষালী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।   

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২৬    



   

আগের পর্বে আমরা ফিরে দেখেছি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এই পর্বে আরেকটু ওপরে উঠব। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের ছবি নিয়ে আজ  কাটাছেঁড়া। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ছবি মানেই প্রধানত ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড ও  ইন্দোনেশিয়ার ছবি। এর সঙ্গে আমরা জুড়ে নেব সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়ার কিছু ছবিকেও, যাতে এই এক পর্বেই আমরা মোটামুটি পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াকেই আওতায় নিয়ে চলে আসতে পারি।  ব্রুনেই, লাওস আর টিমরের কোন সিনেমা আমি দেখিনি, ফলে এইসব দেশের ছবি আজ আমাদের আলোচনায় আসবে না।

তবে একটা কথা বলে রাখি। আজ কিন্তু অন্যান্য পর্বের মত এইসব দেশের ২০-২৫ টা সেরা ছবির কোন লিস্ট তুলে ধরব না। এইসব দেশের সিনেমা বিষয়ক স্বতন্ত্র কিছু গল্প করব আর একটা করে সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব। আশা করব, আমার পাঠক-পাঠিকারা নিজেরা এইসব দেশের ছবি সম্বন্ধে একটু কষ্ট করে জেনে নেবেন।

আজকের আলোচনায় প্রথমেই তুলে আনব ফিলিপিন্সের ছবির কথা কারণ এ দেশের সিনেমার ইতিহাস বাকি দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে পুরনো। ১৮৯৭ থেকে শুরু করে ১৯১৯ সালে প্রথম নির্বাক ছবি হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাময়িক কর্মবিরতি এবং তারপর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক অব্ধি সিনেমার স্বর্ণযুগ – এই পুরোটাই ফিলিপিন্সের ছবির ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে। ভাবুন, ‘চেঙ্গিস খান’ (১৯৫০) যখন তৈরি হয়েছে এবং ভেনিস ও কান ফিল্ম  ফেস্টিভালে দেখানো হয়েছে, তখনো বিদেশী ছবি বিভাগে অস্কার পুরস্কার দেওয়া চালু হয়নি, নইলে হয়তো এই ছবি সেটা পেতেও পারত। আজ আমি ফিলিপিন্সের এক অদ্ভুত ছবি নিয়ে আলোচনা করব – ‘মিরাক্‌ল’ (১৯৮২) যা পরিচালক হিসেবে ইসমাইল বার্নাল-কে এবং অভিনেত্রী হিসেবে নোরা অনর-কে পৃথিবীজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

এক গ্রাম্য মেয়ে এলসা দাবী করে সে নাকি ভার্জিন মেরি-কে দেখেছে, তার আদেশ পেয়েছে। সে এক গ্রামে গিয়ে গ্রহণের সময় নিজের কথা প্রচার করে। প্রথমে তারা সন্দেহ করলেও যখন দেখে এলসা মুমূর্ষুকে সারিয়ে তুলতে পারছে,  তারা অন্ধভাবে এলসাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সেই সময় গ্রামে কলেরা মহামারির আবির্ভাব হয়। তারা এলসাকে ধরে ওদের সারিয়ে তোলার জন্য, কিন্তু এলসা সেটা করতে পারে না। ফলে গ্রামবাসীরা এলসাকে ঘরবন্দী করে রাখে। এরপর একদিন এলসা সবার সামনে বলে যে মিরাক্‌ল বলে কিছু হয় না, সে মিথ্যে বলেছে, গ্রামবাসীরা নিজেদের বিশ্বাসের জন্যই সেরে উঠেছে, এতে তার কোন হাত নেই। এটা শুনেই এক আতঙ্কে গ্রামের লোকজন পালাতে গিয়ে কেউ কেউ চাপা পড়ে মারা যায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় এলসা তার মায়ের কোলে মৃত্যুশয্যায়। এক সিনেমা পরিচালক, যে এলসার জীবনী শুটিং করতে এসেছিল, তখনো শুটিং করে চলেছে।

এই সিনেমা আমার ভাল লেগেছে বেশ কয়েকটা কারণে। এক, থিম। পরিচালক  খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মান্ধতার খারাপ দিকগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন, সাধারণ মানুষকে সাবধান করেছেন। আশির দশকে ধর্মান্ধ ফিলিপিন্সে  এই রকম সিনেমা সাহসী তো বটেই। দুই, নোরা অনরের অনবদ্য অভিনয়। শুধুমাত্র চোখের ভঙ্গি দিয়ে তিনি অর্ধেক অভিনয় ফুটিয়ে তুলেছেন। তিন,  ইসমাইল বার্নালের দারুন সিনেমাটোগ্রাফি। এক অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম, কিন্তু ক্যামেরার কাজে সেই গ্রাম হয়ে উঠেছে নয়নাভিরাম। লং শট বা প্যানোরামিক শট, এগুলো মাটি থেকে বড়জোর আট-দশ ফুট ওপরে ক্যামেরা রেখে করা। ফলে প্রচুর লোকের ভীড় এবং আসা-যাওয়া বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ফুটে ওঠে। ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ মনে পড়ে যায়। আরো এক কথা না বললেই নয়।  এই ছবি ছিল ‘এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা অব ফিলিপিন্স’-এর প্রথম প্রযোজনা।

ফিলিপিন্সের মত থাইল্যান্ডের সিনেমার ইতিহাসও দীর্ঘ। সেই তিরিশের দশক থেকে স্টুডিও পাড়ার অভিযান শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় নতুন করে যাত্রা শুরু করে আজ থাইল্যান্ডের অ্যাকশন ছবি হলিউডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে। এদেশের ছবির দুটো বৈশিষ্ট্য হল হাতি এবং মার্শাল আর্ট। হাতিকে এদেশে দেবতা হিসেবে পূজো করা হয়, তাই হাতি এদেশের ছবিতে বিশেষ স্থান দখল করেছে। প্রকৃতি ও গ্রাম্য জীবনের পাশাপাশি থাই মানুষদের মার্শাল আর্টে পারদর্শীতাও এখানকার সিনেমায়। আপনারা যারা টনি জা নামক এক থাই হিরোর ‘ওং ব্যাক’ সিনেমাগুলো দেখেছেন, বুঝতে পারবেন আমি কেন একথা বললাম। অবশ্য এখন অনেক তরুণ পরিচালকরা থাইল্যান্ডের শহুরে জীবনের জটিলতা ও মনস্তত্ব নিয়ে বেশ ভাল ভাল ছবি বানাচ্ছেন। এমনকি রোহিঙ্গা সমস্যাও ছবিতে উঠে আসছে। কিন্তু আমি এমন এক ছবি নিয়ে আজ আলোচনা করব, যার ভেতর প্রকৃতি থেকে শুরু করে সাহসিকতা, সবকিছুই আছে। ‘ট্রপিকাল ম্যালাডি’ (২০০৪)। আমার দেখা অন্যতম সেরা থাই ছবি।

কেং থাইল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত গ্রামে্র সৈনিক। টং সেই গ্রামের এক যুবক। এদের  দুজনের ভেতর সমকামি এক প্রেম শুরু হয়। কিন্তু শুধু সেই নিয়ে এই ছবি নয়। গ্রামের বয়স্ক এক মহিলার থেকে তারা গল্প শোনে, বাইকে চেপে ঘুরে বেড়ায়, তারপর একদিন কেং তার সেনাবাহিনী নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এদিকে আরেক সৈনিককে জঙ্গলে পাঠানো হয় এক দুষ্টু তান্ত্রিককে হত্যা করতে কিন্তু সেই সৈনিক আর ফেরে না। এর মাঝে সেই হারিয়ে যাওয়া সৈনিকের জবানিতে দেখা যায় সে জঙ্গলের মধ্যে সেই তান্ত্রিকের মুখোমুখি। তার সঙ্গে বন্দুক বা অন্য কোন আত্মরক্ষার অস্ত্র নেই। এক সময় সে বিড়বিড় করতে থাকে ‘I give you my spirit, my flesh, my memories’। ১২৫ মিনিটের এক টানটান সিনেমা।

আপিসাতপং উইরাসেতাকুল-এর এক মনে রাখার মত ছবি। প্রথম অর্ধে যেখানে প্রকৃতির মনভরা সৌন্দর্য, সমলিঙ্গ প্রেম, দ্বিতীয় অর্ধে সেই প্রকৃতির ভেতরই লুকিয়ে থাকা এক আশ্চর্য যাদু। গল্প বদলে যায়, গতি বদলে যায় এমনকি এই ছবির চরিত্রেরাও বদলে যায়। সেখানেই মজা। এবং অন্ধকারে জঙ্গলের দৃশ্যে উইরাসেতাকুলের ক্যামেরা যেন কথা বলেছে। রহস্যকে রোমাঞ্চে বদলে দিয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার ছবির জগতের যাত্রা শুরু ১৯৩১ সালে, জাকার্তায় এক থিয়েটার হলের সাথে। কিন্তু এখানে আশির দশক অব্ধি সিনেমা তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি যেহেতু লোকেরা হলিউডের ছবি দেখতেই উৎসাহ দেখাত। আশির দশক অব্ধি এখানকার সিনেমা তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কাজ করতেও পারেনি, শুধুমাত্র কিশোর প্রেম, ভয় আর কিছু অ্যাডাল্ট ছবি তৈরি করা ছাড়া। কিন্তু ২০০০ সালের পর অনেক তরুণ পরিচালক এগিয়ে এসে এখানকার ছবির হাল  ধরেছেন। এখন ইন্দোনেশিয়ার ছবি দারুন এগোচ্ছে। এই তরুণ প্রজন্মের হাতে  সুররিয়েলিজমের পাশাপাশি এখানকার বিভিন্ন জ্বলন্ত সমস্যাও প্রতিফলিত হচ্ছে। এইরকম এক সমস্যা হল ইন্দোনেশিয়ার (এবং মালয়েশিয়ার) মুসলিম সমাজের বহুগামিতা। সেই নিয়ে বিখ্যাত পরিচালক নিয়া দিনাতার ছবি ‘লাভ ফর শেয়ার’ (২০০৬)।

এই ছবির তিনটে অংশ। প্রথমভাগে এক মহিলা ডাক্তার, তার স্বামীর বহুগামিতায় বিরক্ত, সেই নিয়ে তার প্রশ্ন ও ক্ষোভ। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন  হিসেবে সে এটা মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয়ভাগে এক সদ্যযৌবনা গ্রাম্য সরল মেয়ে, যাকে জাকার্তায় বিউটি কনটেস্টের নামে কোন এক বস্তিতে তার পরিচিত এক বহুগামী পুরুষের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তৃতীয়ভাগে এক সুন্দরী ওয়েট্রেস যে হাতে প্রচুর টাকা চায়, সেজন্য এক বহুগামী পুরুষের সঙ্গী হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই সিনেমার তিন মহিলার সামাজিক, আর্থিক ও শিক্ষাগত আবহে প্রচুর ফারাক, কিন্তু তারা সবাই বহুগামিতার শিকার। এই ছবি কখনোই কিন্তু  বহুগামিতা ভাল বা খারাপ, এইসব মন্তব্য করে নি। বরং সেদেশের এক বিশেষ  শ্রেণীর পুরুষদের সামাজিক ও মনস্তাত্তিক অবস্থা দেখিয়েছে। ক্যামেরার কাজ মোটামুটি।    

ভিয়েতনাম সিনেমা সেই চল্লিশের দশক থেকে বেশ কিছু ভাল কাজ করে আসছে। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক অব্ধি অনেক ভাল সিনেমা তৈরি হয়েছে,  যার পেছনে ফ্রান্সের অবদান অনেকটা। এখানকার সরকার সিনেমার জন্য সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু সেটা নিজের ঢাক বাজানোর জন্য। ভিয়েতনামের এখনকার তরুণ পরিচালকরা তাই সরকারী সাহায্য না নিয়েই নিজের মত ছবি  বানাচ্ছেন। আজ ভিয়েতনামের যে ছবি আলোচনা করব, মনে হয় আপনারা অনেকেই সেই সিনেমার নাম শুনেছেন – ‘দ্য সেন্ট অব গ্রীন পাপায়া’ (১৯৯৩)।

এই সিনেমাও প্রযোজনা হয়েছে ফ্রান্স থেকে। এমনকি এর পরিচালক ট্রান আন হাং এখন ফ্রেঞ্চ নাগরিক হয়ে গেছেন। ফলে এই ছবিকে আধা ভিয়েতনাম, আধা ফ্রেঞ্চ বলাই ভাল। এই ছবির মূল চরিত্র মুই এক কিশোরী, এক ধনী পরিবারের কাজের মেয়ে হয়ে চলে যায়। সেই পরিবারের কর্তা মাঝে মাঝেই কোন মেয়ের সঙ্গে পালিয়ে যায়, কিছুদিন বাইরে কাটায়, আবার ফিরে আসে। পরিবারের কর্ত্রীর এক ছোট ব্যবসা থেকেই সংসার চলে। তাদের তিন ছেলে তিন রকম। শেষবার কর্তা বাড়ি ফিরে আসার পর কঠিন রোগে পড়ে, তার চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে কর্ত্রী নিঃস্ব হয়ে পড়ে। কর্তা মারা যান। কয়েক বছর পর, মুইয়ের খরচ আর চালাতে না পেরে কর্ত্রী তাকে বিদায় দেন। মুই চলে আসে কর্ত্রীর বড় ছেলের এক বন্ধুর বাড়ি, যে অনেকদিন ধরে তাকে মনে মনে ভালবাসত এবং পিয়ানো বাজাত। এখন সে এক নামকরা পিয়ানোবাদক। তার সঙ্গে একটি মেয়ের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। কিন্তু মুইকে তার জীবনে ফিরে পেয়ে সেই পিয়ানোবাদক আবার যুবতী মুইকে আকর্ষণ করে। মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে  ভেঙ্গে যায়। বোঝা যায় সে বাকি জীবনটা মুইয়ের সঙ্গেই কাটাতে চায়।

মুইয়ের এক ১০ বছরের বালিকা থেকে ২০ বছরের যুবতী হয়ে ওঠার যে রূপান্তর, তা পরিচালক অদ্ভুত মুন্সিয়ানার সঙ্গে দেখিয়েছেন। বিশেষ করে ১০৪ মিনিট সিনেমার শেষ ১২ মিনিট যেন অসাধারণ। আবহে পিয়ানো থেকে শুরু করে চেলো, তিব্বতি গং, এমনকি ঝিঁঝিঁর ডাকও সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। পেঁপে  নিয়ে কবিতা পড়া, পেঁপে কেটে তার স্যালাড বানানো, পেঁপের পেট থেকে একটা বীজ তুলে পাত্রে রাখা, একটু পরেই গর্ভবতী মুইয়ের ওপর ক্যামেরা একবার ফোকাস করেই অন্যদিকে, তারপর সব আলোর ডি-ফোকাসড হতে থাকা – সেলুলয়েডে আস্ত কবিতা। এটা দেখে আরেক ফ্রেঞ্চ ছবির কথা মনে পড়ে গেল – ‘দ্য লাভার’ (১৯৯২)। অনবদ্য ক্যামেরা।   

সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয় ১৯৬৫ সালে। তার আগেই কিন্তু সিঙ্গাপুরে মালয় ও চিনা ফিল্ম রমরমিয়ে তৈরি হত এবং চলত। বরং স্বাধীনতার পর এখানে ছবি তৈরি খুব কমে যায়। নব্বইয়ের দশকের পর এখানে আবার নতুন করে প্রচুর সিনেমা তৈরি শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের এক সিনেমা ‘মানি নো এনাফ’ এখানকার ফিল্ম সংস্থাগুলোকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। তারপর সিঙ্গাপুরের সিনেমা আবার তরতরিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে। বাইরের দেশের সঙ্গে অনেক টাই-আপ তৈরি হয়। ‘ক্রেজি রিচ এশিয়ানস্‌’-এর (২০১৮) মত বিখ্যাত ছবি তৈরি হয়।

আজ আমরা এই ‘মানি নো এনাফ’ নিয়েই আলোচনা করব। হাসির ছবি। তিন  বন্ধু কিয়ং, ওং এবং হুই, কিভাবে বারবার তাদের টাকা কম পড়ে এবং ধার করার অভ্যেস ছাড়তে পারে না। গল্প অনেক বড়, সেই দিকে যাব না। শুধু একটাই কথা - এই সিনেমা গোটা সিঙ্গাপুরবাসীকে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে বাধ্য করেছিল, তারা প্রাণ খুলে হেসেছিল, দেখেছিল কিভাবে স্থানীয় অচেনা কয়েকজন অভিনেতা দিয়েও হিট ছবি করা যায়। এবং এরপর সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আবার অক্সিজেন পায়। যদিও এই ছবি মেলোড্রামায় ভর্তি, কিন্তু এই ছবিকে আজো কি বলা হয় জানেন? ‘An effective satire of…Singaporean culture’। 

কম্বোডিয়ার সিনেমার ইতিহাস বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। পঞ্চাশের দশকে শুরু হয়ে ষাটের দশকে বেশ কিছু ভাল ছবি তৈরি হয়েছিল, খেমের রুজের সময়ে একদম অস্তমিত। এখন তরুণ পরিচালকদের সাহায্যে কম্বোডিয়ার  সিনেমা আবার জায়গা তৈরি করছে। এখানকার এক ছবি ‘দ্য মিসিং পিকচার (২০১৩) কয়েকবছর আগে বেশ হৈ-চৈ ফেলেছিল। খেমের রুজের সময়ে কিভাবে লোকেদের মেরে ফেলা হত, অন্যদের জানতেও দেওয়া হত না, সেই নিয়ে এক ডকু। দারুন স্টাইল। খানিক শুটিং, খানিক অ্যানিমেশন, কিছু মানুষ, কিছু কাঠের পুতুল। কিন্তু আমি এক অন্য ছবি আজ বেছেছি যা এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরাধীনতার শৃঙ্খল, দুটোই তুলে ধরেছে। ‘দ্য রাইস পিপ্‌ল’ (১৯৯৪)। অবশ্য এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্‍্য নিয়ে বিদেশী পরিচালকরাই বরং বেশি ছবি বানিয়ে গেছেন।

কম্বোডিয়ার রিফিউজি ক্যাম্পের বাচ্চারা জানে না ভাত কোথা থেকে আসে, কারণ তারা জীবনে কোনদিন সেইসব ক্যাম্পের বাইরে যায়নি। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা সরল উত্তর দেয়, ধান ইউনাইটেড নেশনের লরি থেকে আসে। কিন্তু বড় হয়ে একদিন এইসব বাচ্চাদের ধানচাষ শিখতে হবে। খাবার জন্য, জীবনধারনের জন্য তাদের পরিশ্রম করতেই হবে। কৃষক হিসেবে যে কঠিন জীবন তাদের সামনে এগিয়ে আসছে, সেই গল্প তাদের জানতে হবে। এই সিনেমায় মেকং নদীর তীরে সেইরকম এক কৃষক পরিবারের গল্প, কোন এক চাষের ঋতুতে ধানচাষ করতে করতে তাদের কত বেগ পেতে হচ্ছে, সেই দলিল। চাষ করতে গিয়ে বিষাক্ত কাঁটায় পা পড়ে চাষী মারা যায়। চাষীর বউ দুঃখে মদ খেতে শুরু করে, প্রায় পাগল হয়ে যায়। তাদের বড় মেয়ের ওপর সেই ধান বড় করে কাটার দায়িত্ব বর্তায়।

এই ছবিতে আমি অভিভূত হয়ে দেখেছি গ্রাম্য প্রকৃতি। পুকুরে ফাঁদ পেতে মাছ ধরা থেকে শুরু করে বর্ষায় সবুজ ক্ষেতে ধানচাষ এবং একসঙ্গে মেঝেতে বসে গোটা পরিবারের খাওয়া – এই ছবি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন বাংলার কোন গ্রামের সিনেমা দেখছি।

মালয়েশিয়ায় ১৯৩৩ সালে প্রথম সিনেমা তৈরি করেছিল এক ভারতীয় কোম্পানি – ‘মোতিলাল কেমিক্যাল কোম্পানি অব বোম্বে’। কিন্তু জাপান এই  দেশ দখল করে নেওয়ার পর এখানে সিনেমা তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। আবার পঞ্চাশের দশকে এখানে বেশ কিছু ভাল সিনেমা তৈরি হয়েছিল, যার নেপথ্যেও ছিলেন ভারতীয়রা। যেমন ‘হাং তুয়া’ (১৯৫৬) বানিয়েছিলেন বাঙালি পরিচালক  ফণী মজুমদার। অবশ্য এখানে বিভিন্ন রকম ভাষাভাষীর আধিক্যের কারণে বেশ  কিছু ভাষায় সিনেমা তৈরি হয় – মালয়, মান্দারিন, ক্যান্টোনিজ, তামিল ইত্যাদি। কিন্তু সেই অতীত আর নেই, এখন এখানে তেমন উল্লেখযোগ্য বা সিরিয়াস কাজ বিশেষ হচ্ছে না। একটা ছবির কথা আজ বলব – ‘দ্য বিগ ডুরিয়ান’  (২০০৩)। আমার মনে হয়েছে গতানুগতিক ছবির বাইরে একটু অন্যরকম।

ডুরিয়ান হল একরকম বড় কাঁটাওয়ালা ফল (কাঁঠালের মত) যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এইসব বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। অবশ্য কাঁঠালের থেকে এর বৈসাদৃশ্য হল যে এর মধ্যে কোন আঠা থাকে না। যাইহোক, সেই ডুরিয়ানের রূপক হিসেবে এই ছবির নাম ‘দ্য বিগ ডুরিয়ান’। ঘটনা ১৯৮৭ সালের রাত্রে, এক  সৈনিক তার M16 রাইফেল নিয়ে কুয়ালালামপুরের রাস্তায় এলোপাথারি গুলি চালিয়েছিল। গোটা শহর জুড়ে এক প্যানিক তৈরি হয়েছিল। লোকেরা ভেবেছিল হয়ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেছে। সেই ঘটনাকে আধার করে এই ছবিতে পরিচালক খানিক ডকু, খানিক কল্পনা তৈরি করেছেন। কেন এমন হল? এরপর কি হল? সেই নিয়ে পরিচালক ২৩ জন বাসিন্দার ইন্টারভিউ নিয়েছেন। কেউ সত্যি, কেউ কল্পিত। মসৃণ মিশ্রণ। সেটাই আমির মহম্মদের এই সিনেমার  সাফল্য। অবশ্য এই ছবি স্পষ্ট করে এটাও দেখিয়েছে মালয়েশিয়ায় ধর্ম ও রাজনৈতিক বিছিন্নতা কতখানি।  

শেষ করার আগে তাইওয়ানের একটা ছবির কথা বলব, যেটা একইসঙ্গে সাহসী ও মজার। ‘ডিয়ার এক্স’ (২০২০)। যদিও তাইওয়ান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোন  দেশ নয় (এটা অফিসিয়ালি চিনের এক অংশ), ফিলিপিন্সের ওপরের এক ছোট্ট দ্বীপ, কিন্তু এই ছবির কথা এখানে উল্লেখ না করে থাকতে পারলাম না। এক ব্যক্তি মারা যাবার পর তার বৌ এবং তার সমকামী পার্টনারের ভেতর ঝামেলা শুরু হয় কারণ সেই মৃত লোকটির সমস্ত ইনস্যুরান্সের মালিক এখন সেই পার্টনার। ঝাঁঝালো ছবি, এবং অবশ্যই দমফাটা হাসির। ছবিটা দেখুন।

(ক্রমশ)

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরেজী ছবি

শেষ পর্বঃ আমার সবচেয়ে প্রিয় দু’টি ছবি

 


প্রথমটি কলকাতায় মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে, গ্লোব সিনেমায়। মনে হয় এক বছরের মতো চলেছিল, যা ইংরেজী ছবির পক্ষে অপ্রত্যাশিত। পরে, সত্তরের দশকে রাজ কাপুরের ববি বছরখানেক চলবে, আর প্রায় এক বছর চলবে ইয়াদোঁ কী বারাত

The Sound of Music চলচ্চিত্রায়িত হয় ১৯৬৫ সালে। উৎস ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত Maria Von Trapp-এর আত্মজীবনীমূলক The Story of the Trapp Family Singers, যার থেকে ১৯৫৯ সালে এক মঞ্চসফল সঙ্গীতবহুল নাটক প্রযোজিত হয়। লেখক ছিলেন Richard Rogers এবং গীত রচয়িতা Oscar Hammerstein II। ১৯৬১-তে এইরকম সংগীতধর্মী নাটক West Side Story চিত্রায়িত করে সফল Robert Wise এবার The Sound of Music-এর দায়িত্ব নেন। মুক্তি পাবার পর মিশ্র, অনেক সময় নেতিবাচক, সমালোচনা সত্বেও ছবিটি অভূতপূর্ব দর্শকানুকুল্য পায়, যা ডলারের অঙ্কে ১৯৩৯ সালের Gone with the Wind-কেও ছাড়িয়ে যায়। আমেরিকার National Film Registry-তে ছবিটি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা শৈল্পিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে সুরক্ষিত হয়েছে।

আমাদের বাবা ১৯৬৫ থেকে সিনেমা দেখার ব্যাপারে এক নির্মম-সদয় রীতি চালু করেন। বছরের নির্দিষ্ট সময় জ্বর-উৎপাদক এবং অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক T. A. B. C. ইনজেকশন নিতে হবে, এবং তার কষ্ট ভোলার জন্য সিনেমা দেখা যেতে পারে! The Sound of Music প্রথমবার দেখা এই পীড়াদায়ক প্রতিষেধক নেওয়ারই ফসল! ছবিটির ট্রেলার দেখে (১৯৬৬ সালে) তেমন কিছু লাগেনি। দেখার আগ্রহও ছিল না। জ্বর আর ব্যথা নিয়ে দেখে অনিচ্ছাসত্বেও স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, ছবিটি “মন্দ নয়”! সেটা ১৯৬৭ সাল। তারপর ঠিক মনে নেই কিভাবে, ছবিটি অভূতপূর্বভাবে ভালো লেগে গেল। সেই গ্লোবেই দেখেছি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্যে চারবার! প্রায় প্রতি বছরেই ছবিটি পুনর্মুক্তি পেত। তারপর, সত্তরের শেষের দিকে, টাইগার প্রেক্ষাগৃহে পঞ্চমবার দেখি। বড় পর্দায় যে চারটি ছবি – বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী মিলিয়ে – সবচেয়ে বেশীবার দেখেছি, তার মধ্যে একটি এই Sound of Music

ভালো লাগার অন্যতম কারণ ইংরেজী গানের সম্বন্ধে বোধহয় আপামর মধ্যবিত্ত বাঙালী ছেলেমেয়ের ধারণা পালটে দেওয়া। ছোটবেলা থেকে রেকর্ডে বা রেডিওতে যৎসামান্য ইংরেজী গান যা শুনেছি, সে সবই অপেরাধর্মী – সেই হু-উউউউ আর হাআআআআআআ। কথাগুলো ইংরেজী, হিব্রু, গ্রীক না লাতিন – বোঝা অসম্ভব! এর আগে, বোধহয় ১৯৬৫-তে, My Fair Lady এসেছিল, কিন্তু সেটা ঠিক ছোটদের জন্য নয় বলেই আমাদের দেখানো হয়নি। The Sound of Music মুগ্ধ করলো গানের সুরে শুধু নয়, গানের কথায় – যেমন সরল শব্দ, তেমনই মর্মস্পর্শী। দুটি উদাহরণ দেব। নাৎজি জার্মানির আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে আল্পস পর্বতে ফোটা Edelweiss ফুলকে স্বদেশ অস্ট্রিয়ার প্রতি দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ছবির মুখ্য পুরুষ চরিত্র ক্যাপ্টেন ভন ট্র্যাপ গেয়ে ওঠেনঃ

Edelweiss, Edelweiss – every morning you greet me.

Small and white, clean and bright, you look happy to meet me.

Blossom of snow, may you bloom and grow, bloom and grow forever!

Edelweiss, Edelweiss – bless my homeland forever!

অথবা, যে শীর্ষগান থেকে ছবির নামকরণ, গায়িকা-নায়িকা মারিয়ারূপিনী জুলি অ্যান্ড্রুজের উদাত্ত মধুপ্রদ কণ্ঠেঃ

The hills are alive with the sound of music –

With songs they have sung for a thousand years!

The hills fill my heart with the sound of music –

My heart wants to sing every song it hears!

My heart wants to beat like the wings of the birds
That rise from the lake to the trees;
My heart wants to sigh like a chime that flies
From a church on a breeze;
To laugh like a brook when it trips and falls
Over stones on its way,
To sing through the night like a lark who is learning to pray!

I go to the hills when my heart is lonely.
I know I will hear what I've heard before –
My heart will be blessed with the sound of music,
And I'll sing once more!

কি নেই ছবিটিতে! প্রতিটি চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীর নিখুঁত অভিনয়, এমনকি ক্যাপ্টেন ভন ট্র্যাপের সাত-সাতটি মাতৃহীন সন্তানদের – যাদের বয়স ষোল থেকে পাঁচ! ছোট্ট গ্রেটেলের চরিত্রে পাগল করা মিষ্টি শিশু কিম ক্যারাথ অবধি অবিস্মরণীয়। ষোল বছরের লিসেল চরিত্রে একুশ বছরের Charmian Carr যেমন সুশ্রী তেমনই নিপুণ। আর দুই কেন্দ্রীয় চরিত্রে মারিয়ারূপিনী জুলি তো সবার প্রিয় গভরনেস-অবশেষে শিশুদের নতুন মা হিসেবে একেবারে মন কেড়েছিলেন। পত্নীবিরহে আপাত-কঠোর কিন্তু মারিয়ার প্রভাবে স্নেহের ফল্গুধারা নির্গত হওয়া ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় ক্রিস্টোফার প্লামার একদম যথাযথ।

এছাড়া ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশে সুখী পরিবারের জীবনে শত্রুর অন্ধকার উপস্থিতি, তাদের গ্রাস থেকে রূদ্ধশ্বাস দৃশ্যে কোনক্রমে মুক্তিলাভ – প্রতিটি জিনিস স্মৃতিতে অত্যুজ্জ্বল আজও! আর প্রায় প্রতিটি গান কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল সেই দশ-এগারো বছর বয়সে!

এবার আসি আমার প্রিয়তম ছবির প্রসঙ্গে। এর উল্লেখ আগে করেছি, যখন বলেছিলাম যে ১৯৬৪-তে আমি প্রথম ওয়াল্ট ডিজনীর ছবি দেখি। ঐ ১৯৬৪-তেই তৈরি কিন্তু এদেশে ১৯৬৮-তে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি হলো প্যামেলা ট্র্যাভার্সের চারখানা (ছবির পর তিনি আরও ২/৩ টি লিখেছিলেন) বই অনুপ্রাণিত Mary Poppins। নাম ভূমিকায় সেই The Sound of Music-এর জুলি অ্যান্ড্রুজ। এটিই তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি, এবং প্রথম আবির্ভাবেই তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর ‘অস্কার’ জিতে নেন! ছবিটি ১৯৬৪-তে আমেরিকায় প্রথম মুক্তি পেলেও – অর্থাৎ The Sound of Music-এর আগে – দ্বিতীয়োক্ত ছবি যে মঞ্চনাটকের ওপর আধারিত সেটি তো ১৯৫৯-এর। অতএব, Mary Poppins-এর চিত্র্যনাট্যে তখন এখানকার দর্শক The Sound of Music-এর আখ্যানের যে প্রভাব লক্ষ করেছিলেন, তা যথার্থই মনে হয়। এবং এও ঘটনা যে দ্বিতীয়োক্ত ছবির পরিচালক রবার্ট ওয়াইজ ৩০শে অক্টোবর ১৯৬৩-তে ডিজনী স্টুডিওতে গিয়ে তখনো অমুক্তিপ্রাপ্ত Mary Poppins-এর কিছু ফুটেজ দেখেই গ্রেস কেলি, অ্যান ব্যাঙ্ক্রফট প্রমুখদের কথা বাতিল করে জুলিকেই নির্বাচন করেন।




ব্যাঙ্কস পরিবারের কর্তা জর্জ (ক্যাপ্টেন ভন ট্র্যাপ- এর নাম ছিল Georg!) ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তাঁর স্ত্রী উইনিফ্রেড স্বামীর অজান্তে সেই ১৯১০ সালে মেয়েদের ভোটাধিকার-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের দুই শিশু, বড় মেয়ে জেন আর ছোট ছেলে মাইকেলের জন্য বাবা-মার সময় কোথায়? তারা মানুষ হয় গভরনেসের হাতে। এবং ভন ট্র্যাপ ছেলেমেয়েদের মতোই জেন-মাইকেলের দস্যিপনায় এক গভরনেস যায়, আরেকজন আসে! এ ঘটনা অবশ্য ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস Mary Poppins-এই আছে! শেষ গভরনেস কেটি ন্যানা বিদায় নেবার পর বাবা মাকে দিয়ে খবরের কাগজের জন্য বিজ্ঞাপন লেখান এক কড়া, কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তী গভরনেসের আবেদন করে। তার মাঝখানে দুই ভাইবোন এসে তাদের পছন্দের গভরনেস কিরকম হবে লিখে এনে তা বাবা-মাকে গেয়ে শুনিয়ে নার্সারিতে ফিরে যায়। চরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জর্জ ব্যাঙ্কস তাদের লেখা কাগজটি ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফায়ারপ্লেসে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু আমরা দেখি, সকলের অজান্তে কুচোনো কাগজগুলোকে আপনা থেকে উঠে চিমনি দিয়ে আকাশে উড়ে যেতে! (এর আগে, ছবির শুরুতেই দেখেছি লন্ডনের আকাশে মেঘের ওপর বসা অতি মিষ্টি দেখতে এক মহিলাকে!)

পরের দিন ১৬ নম্বর চেরি ট্রি লেনের (ব্যাঙ্কসদের বাড়ি) বাইরে গোমড়ামুখো প্রৌঢ়া গভরনেসদের লম্বা লাইন। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় তারা সবাই উড়ে  যায়! মাথায় ছাতা দিয়ে বাড়ির সামনে উড়ে এসে নামেন শিশুরা ঠিক যেমনটি  চেয়েছিল, তেমনি মিষ্টি, গোলাপি গাল সেই মেঘের ওপর বসে থাকা মহিলা! জর্জ তাঁর মূল্যায়ন করবেন কী, তিনিই ঢুকে শিশুদ্বয়ের লেখা (কোন জাদুবিদ্যায় কাগজের টুকরোগুলো সব জুড়ে গেছে!) চিঠি গৃহকর্তাকে গড়গড় করে পড়ে বলেন তাঁর পূর্ণ যোগ্যতা রয়েছে, তিনি নার্সারিতে চললেন! এরপর সকলের অলক্ষ্যে সিঁড়ির ব্যানিস্টারে বসে ওপরদিকে দিব্যি উঠে যান – ইনিই মেরি পপিন্স!

‘সাউন্ড অব মিউজিক’-এ মারিয়ার স্নেহের প্রভাবে ছেলেমেয়েরা এবং তাদের বাবা ক্যাপ্টেন পালটে যান। মেরি পপিন্স একই রকমের পরিবর্তন আনেন ব্যাঙ্কসবাড়িতে – তবে আক্ষরিক অর্থে ম্যাজিকের মধ্য দিয়ে! আত্মসর্বস্ব জর্জ  স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে শেখেন দুই সন্তানকে, তাদের সহজ-সরল শখ-আহ্লাদের মূল্য দেন নিজের হাতে তাদের খেলার ঘুড়ি মেরামত করে তাদের এবং স্ত্রীকে নিয়ে জীবনে প্রথম পার্কে সেই ঘুড়ি ওড়াতে নিয়ে গিয়ে। আর তাঁর অব্যক্ত ইচ্ছা – ছেলেমেয়েরা তাঁর সঙ্গে ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকার মূল্য কী তা শিখুক, অর্থনীতি, লাভ-ক্ষতির হিসেব করুক – কাজে লাগিয়ে ব্যাঙ্কে হুলুস্থুল ফেলে দিয়ে নিজের যে আপাত সর্বনাশ – চাকরী থেকে বরখাস্ত হওয়া – ডেকে এনেছিলেন, তাও উল্টে যায়, মেরি পপিন্সের সহযোগীদের বলা একটি মজার গল্পের কল্যাণে! ব্যাঙ্কস সসম্মানে ব্যাঙ্কে ফিরে আসেন কর্মচারী হিসেবে নয়, পার্টনার রূপে!

এর মাঝখানে এসেছে একের পর এক ম্যাজিকের ঘটনা। মেরির হাতের তুড়িতে নার্সারির যাবতীয় ছড়িয়ে থাকা জিনিস, খেলনা ইত্যাদি নিজেদের গুছিয়ে ফেলে, মেরির বন্ধু বার্টের রঙিন খড়ি দিয়ে ফুটপাথে আঁকা ছবির মধ্যে মেরি, বার্ট, জেন আর মাইকেলের ঢুকে গিয়ে জ্যান্ত কার্টুন চরিত্রদের সঙ্গে খেলা করে, মেরির আত্মীয় আংকল অ্যালবার্টের ঘরে সবাই সিলিং-এ বসে চা খায়, আরও কত কী!

‘সাউন্ড অব মিউজিক’-এর মতো ‘মেরি পপিন্স’-এর প্রতিটি গান সেই থেকে আজও কণ্ঠস্থ!

মেট্রোতে ছ’ সপ্তাহ চলাকালীন ছবিটি দেখি তিনবার, প্রথমে সপরিবারে, দ্বিতীয়বার মাসীমাকে নিয়ে দাদা আর আমি, তৃতীয়বার বাবার সঙ্গে। এর কয়েক বছর পর, ঐ মেট্রোতেই রবিবার সকালে চতুর্থবার আর আরও পরে আরেক রবিবার সকালে এলিট সিনেমায়, এই দু’বারেও বাবার সঙ্গে। Mary Poppins আজও আমার কাছে আমার সারা জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ ছবি। দ্বিতীয় স্থানে আছে The Sound of Music

 


শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী ১৯৪৫



(২)

 ১৯৪৫-৫০ রাশিয়া ও চীন যোগ :

জে বি পি মুরে, একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এক সাক্ষাৎকারে ‘ইকোনমিক টাইমস’কে বলেন তিনি ১৯৪৭ সালের ১১ই ডিসেম্বর তারিখের একটি রিপোর্ট  পেয়েছেন ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ ফ্রান্স থেকে, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে ১৯৪৭  সাল পর্যন্ত নেতাজি মারা যায়নি, তবে তিনি কোথায় আছেন, সেটি তাদের অজানা। মুরে ইটি-কে আরও বলেন, ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিসের একটি রিপোর্টে  পাওয়া গেছে ২৬ সে সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে কন্ট্রোল কমিশন অফ এলায়েড ফোর্স মাউন্টব্যাটেনকে চিঠিতে বলে সাইগন থেকে ৭ জন ব্যক্তিকে এরেস্ট করা হয়েছে যার মধ্যে ৩ জন খুব বড় মাপের নেতা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেনস লীগের এবং হিকারি কিকনের সদস্য। পাঠকের জ্ঞানার্থে বলে রাখি হিকারী কিকন হচ্ছে একটা হাইলি সিক্রেট গ্রুপ যারা আই এন এ এবং জাপান সরকারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। তার মধ্যে একজন ছিলেন লিওন পুরুচন্ডি যাকে নেতাজি দাদু বলে ডাকতেন এবং সাইগনে তার বাড়ি ছিল ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস লীগের মুখ্য কার্যালয় এবং জানা যায় সুভাষচন্দ্র বসু ১৭ই আগস্ট থেকে ২১শে আগস্ট পর্যন্ত ওই বাড়িতে ছিলেন এবং তারপর ইন্দো চায়না বর্ডার দিয়ে পালিয়ে যান।  অনেকে মনে করেন এই সময় তিনি মঞ্চুরিয়া হয়ে রাশিয়া চলে যান এবং সেই বিষয়ের স্বপক্ষে ও কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু মুরে মনে করেন ঐ তিনজন হাই প্রোফাইল লিডারের মধ্যে একজন ছিলেন নেতাজি এবং বিশেষত তাঁকে এরেস্ট করে রাশিয়া নিজের হেফাজতে নিয়ে নেয় এবং কূটনৈতিকভাবে নেতাজি এবং স্ট্যালিন-এর সাথে আগেই যোগসাজস ছিল, তাই অনেকের মতে   পুরোটাই নেতাজির প্রি প্ল্যান রাশিয়ার সঙ্গে ঠিক যেমন জাপানের সঙ্গে প্লেন দুর্ঘটনার ভনিতা ও সমগ্র বিশ্বকে চমক দেওয়ার একটা প্ল্যান ছিল। ডক্টর ওয়াই এস ইউড়লভা ১৯৯০ সালে কলকাতায় দাঁড়িয়ে বলেন রাশিয়া নেতাজি সম্পর্কে অনেক টপ সিক্রেট ডকুমেন্ট রেখে দিয়েছে। মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টে নরেন্দ্র সিন্ডকার নামে এক ব্যক্তি জানান নেতাজি ১৯৪৫ সালে বেশ কিছুদিন রাশিয়াতে জেলে ছিল এবং স্ট্যালিন তাঁকে নিয়ে কী করা যায় এই বিষয়েও খুব চিন্তিত ছিলেন। ডক্টর পূরবী রয়ও রাশিয়া গিয়ে এইরকমই কিছু ঘটনা জানতে পারেন যে ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ স্ট্যালিন এবং মলতভের মধ্যে কথা হচ্ছে যে নেতাজিকে নিয়ে কী করা যায় এবং তাঁরা লন্ডনে ভারতীয় কনসালটেন্ট  কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে কথা বলেন এবং মেনন নেহেরুর হয়ে সওয়াল করেন। এই ঘটনা একটু প্রচার হতেই ব্রিটিশ নেতাজীকে ওয়ার ক্রিমিনাল ঘোষণা করে দেয় এবং ভারতবর্ষের জন্য সবথেকে ক্ষতিকারক একটি আইন নিয়ে আসে, যেখানে  বলা আছে, সুভাষচন্দ্র দেশে ফিরলে ব্রিটিশ যেকোন সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ  ঘোষণা করতে পারে এবং সেই সময় নেহেরু বলেন, সুভাষ যদি দেশে ফেরেন, আমি প্রথম ব্যক্তি হব যে তার বুকে গুলি করব। নেতাজির ভারতে অফিসিয়ালি  না ফেরার এটা খুবই গুরুত্বপূর্ন কারণ যা পরবর্তী আলোচনায় আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।

যাইহোক, আমরা ফিরে যাই ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়াতে। শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিন কিছু গোপন চুক্তি এবং জাপানের হাত থেকে চীনকে স্বাধীনতা প্রদানের বিষয়ে নেতাজির সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন ও বেশ কিছু দিন সেখানে থেকে পুনরায় সংগঠনের কাজ চালিয়ে  যান। সমর গুহ তাঁর এক চিঠিতে গর্বাচেভকে বলেছেন, আফগানি ট্রাইব ঘিলজাই-এর সাধু হয়ে তিনি ঘুরছেন রাশিয়াতে এবং এই কথা আফগান গভর্নর  খোস্টকে রাশিয়া জানায়। তবে রাশিয়ার সঙ্গে বিশেষত স্ট্যালিন-এর সঙ্গে যে নেতাজির সুসম্পর্ক ছিল এবং পরবর্তী কালে বহু বছরই নেতাজি সেখানে থেকেছেন, সাহায্য পেয়েছে্‌ন, তা পাঠকগণ কিছুটা অর্ধেন্দু সরকারের রিপোর্ট থেকেই জানতে পারবেন এবং পরবর্তী সাল নিয়ে আলোচনার সময় ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন।

১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ নেতাজি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কাজ চালাতে আবার জাপানে ফিরে আসেন এবং ভারতবাসীর জন্য রেডিওতে তিনটি  বক্তৃতার কথাও আগে উল্লেখ করা হয়েছে ৪৫ এর ডিসেম্বর থেকে ৪৬ এর ফেব্রুয়ারি সময়কালে। জাপান নতি স্বীকার করার পর তাইপেই চলে যায় চিন  সরকারের হাতে এবং বাকি সমস্ত দ্বীপও চলে যায় অক্ষ শক্তির হাতে। সেই সময়ে চিনে আবার গৃহযুদ্ধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে এবং মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। শোনা যায়, পরিকল্পনা মাফিক স্ট্যালিন ও মাও দুজনের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস এবং সেই সূত্রে ৪৬ ও  ৪৭ সালের বহু সময়ই তিনি রাশিয়াতে কাটান। রাশিয়া ছাড়াও এই সময়কালে চিনে ইউনান প্রদেশ যেখানে মাও সে তুং এর হেড কোয়াটার ছিল সেখানে থাকার ও প্রমাণ মেলে। এই সময় তাঁর দেখা হয় হো চি মিনের সঙ্গে, ফরাসি আগ্রাসন রুখতে বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠক করেন তিনি ভিয়েতনাম গিয়ে।

১৯৪৯ সাল নাগাদ তাঁর দাদা সুরেশচন্দ্র বোস এক আন্তজার্তিক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, নেতাজি রেড কন্টিনেন্ট-এ আছেন এবং তাঁর এই মতামতকে সুইস জার্নালিস্ট লিলি অ্যবেগ সমর্থন করেন, তাঁর কাছে সেইরূপ তথ্য ও  প্রমাণ থাকার জন্য। বলে রাখা ভালো, এই সময় লিলি জাপানে ছিলেন এবং একজন জাপানি আর্মি চিফের থেকে তিনি এই খবর পান। এছাড়াও ১৯৪৯ সালে বোম্বে থেকে বেরোনো একটি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ব্লিৎস দাবী করে সুভাষচন্দ্র  বসু চিনে আছেন এবং এই ব্যাপারে তাঁদের হাতে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ এসেছে।   এছাড়াও এই ব্যাপারে অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু ব্যক্তির থেকে যাঁরা  পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নেতাজি - চিন ও মাও সে তুং এর যোগসাজস পান। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন এস এম গোস্বামী, যিনি বলেছেন নেতাজি  চিনে আছেন এবং মাও এর এডভাইজার হিসেবে কাজ করছে্ন। এছাড়া তিনি আরো বলেন, নেতাজি ৪-৫ লক্ষের একটা গেরিলা এশিয়ান লিবারেশন আর্মি বানিয়েছেন, যাদের মূল লক্ষ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী নাগপাশ থেকে মুক্ত করা। বিখ্যাত চিনা সাংবাদিক চেন বোদা যিনি প্রথম জীবনে মাও-এর সঙ্গে কাজ করেছেন, তিনিও একথা লিখেছেন যে মাও সে তুং বলতেন আমি যখনই বিপদে পড়ি এক অদৃশ্য মহামানব এসে আমাকে সবসময় রক্ষা করেন, সেই মহামানব আর কেউই নন আমাদের নেতাজি। এছাড়াও নেতাজি এবং চিনা যোগের অন্যতম প্রধান সাক্ষ্য প্রমাণ হলেন মুথুরালিঙ্গম তেভর, যিনি প্রখ্যাত ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা এবং বোস অফ সাউথ নামে পরিচিত, তিনি নেতাজির অন্ধ  ভক্ত ছিলেন। তেভর ১৯৫৬ সালে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ১৯৫০ সালে তিনি নেতাজির সঙ্গে দেখা করেন চিনে গিয়ে এবং সেই যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন স্বয়ং সুরেশচন্দ্র বোস। তিনি এও বলেন চিনের কোনো এক অচেনা জায়গায় তিনি নেতাজির সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটান এবং প্রয়োজনে এর স্বপক্ষে প্রমাণ দিতেও তিনি প্রস্তুত। সুতরাং উক্ত আলোচনার মধ্যে আমরা নেতাজির তথাকথিত মরণোত্তর ৫-৬ বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাই।  

(ক্রমশ)


আফসানা কিশোয়ার

 

মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মৃত্যুর গান – সমান্তরাল




১৯৯২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জানা ২৩৯-জন মানুষ ইসলামী জিহাদীদের হাতে  বাংলাদেশে খুন হয়েছে, এর মধ্যে ৩৩-জনের হত্যার দায় ইসলামী জিহাদী  গ্রুপগুলো স্বীকার করেনি। প্রথম দিকে এ হত্যা ছিল রাজনীতি ঘেঁষা হত্যাকান্ড। পরবর্তীতে যারাই ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করেছে তারাই মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ থেকে শুরু হয় ধর্ম না মানা ব্লগারদের হত্যা। ধর্মকে পুঁজি করে এই যে মানুষ হত্যা, এ কি হাল আমলের ট্রেন্ড? না তো! আর সে ইতিহাসই যেন আমরা উপন্যাসের আঙ্গিকে পড়তে শুরু করি লেখক অদিতি ফাল্গুনী'র ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’ বইটিতে।

বইয়ের শুরু সক্রেটিসের মৃত্যুর আবহ দিয়ে - তিনি কীভাবে নিঃশঙ্ক চিত্তে তাঁকে দেয়া বিষ পান করেন, সেই ঘটনার বর্ণনা আমরা পড়ি। সক্রেটিস হেমলক পান করার পর শিষ্যদের বলেন – “আমি চিরদিনই শুনে এসেছি যে একজন পুরুষ  মানুষের অন্তিম পরিণতিও এমনভাবে মেনে নেয়া উচিত, যা পরিমিত ভাষেরই আহবান জানায়, কাজেই তোমাদের অবশ্যই ধৈর্য থাকতে হবে এবং তোমরা অবশ্যই সহ্য করবে”।

জ্ঞানের লড়াইয়ে এ বিষ পান সক্রেটিসের থেমে থাকেনি - বিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান প্রচারের লড়াইয়ে তাই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এক অলৌকিক এম্বুলেন্স,  সেখানে আমরা আকবর আসাদের মোড়কে পাই ২০০৪-এ অধ্যাপক হুমায়ূন  আজাদ হত্যাচেষ্টার এক পোস্ট মডার্ন বর্ণনা। দুই হাজার চার-এ শুরু হওয়া  একই স্টাইল সেই বইমেলায় আড্ডা তরুণদের সাথে, সন্ধ্যা ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে ভার্সিটি এরিয়ার আলো আঁধারে ঘাড় মাথা বরাবর চাপাতির কোপ। জীবন্মৃত হুমায়ূন আজাদ শেষ পর্যন্ত বিদেশে মারা যান, তাঁর মরদেহ আসে এম্বুলেন্সে করে। লেখক আমাদের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, 'পাক সার জমিন সাদ  বাদ' বইটির জন্যই কি হুমায়ূন আজাদের হত্যাকান্ড?

স্মৃতির রেললাইনে এসে দাঁড়ান চৈতন্য - তিনি সংকীর্তন করেন, তাঁর সাথে ডোম, দরজি, পাঠান পীর, বামুন সবাই যোগ দিচ্ছে। রাজা প্রতাপরুদ্র পর্যন্ত তাঁর  সমর্থক হয়ে উঠেন। মহামন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধর ভীষণ রুষ্ট হয়ে উঠেন এসব দেখে। এবং কাজে কাজেই পুরীর জগন্নাথ ধাম থেকে একদিন হারিয়ে গেলেন মহাপ্রভু। অথচ মহাপ্রভু ভূ-খন্ডে বিরাজমান অসহনীয় জাতপাতের তাপ থেকে সবাইকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন প্রেমের পরশে। মহাপ্রভুর অন্তর্ধান নিয়ে পদকর্তা লোচন দাস লিখেছেন-

“তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে।

জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে”।

আবার অচ্যূতানন্দ শূন্য সংহিতায় লিখেছেন-

'কলারে কলা মিশিলা নোহিন্দ

সে বারি”।

অর্থাৎ জগন্নাথের কালো অঙ্গে শ্রীচৈতন্য মিশে গেলেন এবং তাঁর চিহ্নও আর  কোথাও থাকলো না। মহাপ্রভুর তিরোধানের পর পঞ্চাশ বছর বাংলা ও ঊড়িষ্যায় কোন কীর্তন হয়নি। আমরা অধ্যাপক মহতাবের বয়ানে শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের ৪৪৪ বছর পর জানি কীভাবে তাঁর দেহ মন্দিরেই সমাধিস্থ করা হয়েছে। তার  মানে কি ইতিহাসের ভেতর বসে ইতিহাস লেখা যায় না? সেজন্যই ব্লগার হত্যার কোন স্পেসিফিক, লজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস ভিত্তিক পূর্বাপর গবেষণা আমরা ২০১৩ থেকে আজ পর্যন্ত পড়ার জন্য পাই না!

ব্লগারদের উপর আক্রমণের আগে হরকাতুল-জিহাদ-আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) ১৯৯৯-২০০৫ পর্যন্ত ৯৩-জনকে খুন করে, জামায়াত-উল-মুজাহেদিন  বাংলাদেশ (জেএমবি) ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত ৯০-জনকে খুন করে।

২০১৩ তে আমরা পাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও নিও জেএমবি। তাদের যাত্রা শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যখন বাংলাদেশ অনলাইন এক্টিভিস্টদের ব্যানারে শাহবাগে কাদের মোল্লার ফাঁসী চেয়ে আন্দোলন শুরু হয়,  তখন। সজল হায়দায় বা রাজীব হায়দার বা থাবা বাবাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই মহোৎসব। ১৫ফেব্রুয়ারি রাজীব হায়দারকে মারা হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এ হত্যার দায় স্বীকার করে। একই কায়দায় ২০১৩ এর জানুয়ারিতে আসিফ মহিউদ্দিনকে আক্রমণ করলেও সে কোনভাবে বেঁচে যায়। রাজীব হায়দার মারা যাওয়ার পর তৈরী হয় ফেইক একাউন্ট, ফেসবুকে তার মরদেহ পোস্ট করে জানানো হয় সে ইসলামের শত্রু, তার বিশেষ বিশেষ পোস্ট মাহমুদুর রহমানের 'আমার দেশ' পত্রিকা, জামায়াতের মিডিয়া উইং বাঁশের কেল্লা অনবরত ছাপাতে থাকে, পোস্ট দিতে থাকে অনলাইনে। মাহমুদুর রহমান, ফরহাদ মাজহার গং-দের অব্যাহত প্রচারণার মুখে দেশবাসী বিশ্বাস করতে শুরু  করে ব্লগার মানেই নাস্তিক, তারা ইসলামের শত্রু এবং তাদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ, পবিত্র দায়িত্ব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাজীবের হত্যার পর গিয়ে দাঁড়ান, তাই হয়তো রাজীব হত্যাকারীদের মধ্যে ৫জন গ্রেফতার হয় ২০১৩ এর ২রা মার্চ, ২০১৬ তে ফয়সাল নাঈম ও রেদওয়ান রানাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ফাঁসীর শাস্তি দেন।

ভীমরাও অচ্ছুৎ বর্ণের মানুষ হয়েও পড়ালেখা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন, তাঁর বয়ানে আমরা শুনি 'বাপুজি (মহাত্মা গান্ধী) ঈশ্বরাল্লার কথা বললেন অথচ সারা জীবন বর্ণাশ্রমও করে গেছেন। অদ্ভূত!'

অজেয় বা সুজেয় চৌধুরীর ছেলে শুভ্রজিৎ বা অভিজিতের হত্যাকান্ড ঘটে ২০১৫ এর ২৬ফেব্রুয়ারি, একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে। এবিটি ও AQIS (Al-Qaeda in the Indian Subcontinent) একই সাথে অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করে। অভিজিতের কসুর কী ছিলো? একের পর এক বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা-বিশ্বাসের ভাইরাস, সমকামী নামক বই লেখা। মুক্তমনা নামক ব্লগ চালানো ২০০২ সাল থেকে। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী, সংশয়বাদী, নাস্তিক ও মানবতাবাদীদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার কৃতিত্ব অভিজিতের। ফারাবী গ্রেফতার হয় ২রা মার্চ ২০১৫তে কিন্তু অভিজিৎ হত্যাকান্ডের পুরো বিষয় রয়ে যায় রহস্যাবৃত। ত আদ্যাক্ষর, ও ফ আদ্যাক্ষর-এর নামগুলো সরাসরি শিবির কানেকশন থাকা সত্বেও, হত্যার পরিকল্পনায় তাদের সংযুক্তির সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স থাকা সত্বেও এরা মামলার চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পায়।

১৯৪৬ সালে ঘটে যাওয়া নোয়াখালী হত্যাকান্ড আমাদের লেখকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই রায়টে ৫০০০ হাজার হিন্দু নর নারী শিশু অক্টোবরের ১০ তারিখ রাতে মারা পড়ে, সাথে ধর্ষণ, ধর্মান্তর তো বোনাস। অক্টোবর থেকে নভেম্বর এই দুই মাস ব্যাপি চলা এথনিক ক্লিনজিং-এ ৭৫০০০ হিন্দু আগরতলা ত্রিপুরা আসামে আশ্রয় নেয়। তারা আর জন্মভূমিতে ফিরে আসতে পারেনি। ২০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী মুসলমানরা এই তান্ডব চালায়। সরকারী হিসাবমতে ১০০০০ ধর্মান্তকরণ ঘটনা ঘটে। এরই জেরে ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮এ গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হন। আমরা বইটির পড়তে পড়তে এভাবে ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটতে থাকি আর দেখতে পাই শুদ্ধ ও ভুলের লড়াই বহমান। কেউ পিতা হারা কেউ সন্তানহারা কেউ বন্ধুহারা ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে। উপমহাদেশে এ যেন প্রতিদিনকার এক ছক। সেই ছকে এসে পড়েন আমাদের কুচ্ছিত হাঁসের ছানা বা ওয়াশিকুর রহমান বাবু বা বইয়ের মোস্তাফিজুর। যে একটি ট্রাভেল কোম্পানিতে জব করে, আর ব্লগ লেখে। তার ছদ্মনাম ছিল বোকামানব। ৩০ মার্চ ২০১৫ তে এই বোকামানবের শ্বাস থেমে যায় চাপাতির কোপে; কসুর? মাত্র ৫২ পর্বে 'অযৌক্তিক ধর্মীয় বিশ্বাস' নামে সিরিজ লিখেছিলো আমাদের বোকা ছেলেটা। যেমন লিখতে চেয়েছিলো কালবি সেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার যুগে। যেখানে কালবিকে তার শতবর্ষীয়া দাদী জিজ্ঞেস করে-'আল-কালবি!' আমাকে কি এই জীবনে কোন প্রতিবেশীর সাথে কলহ করতে দেখেছ? কারো হক কেড়েছি? সাধ্যমতো এতিম-মিসকিনদের দান করি নাই? কারো মনে দাগা দিয়েছি?'

কালবি 'না' সূচক উত্তর দেয়।

কালবিকে দাদী বলেন, তাহলে আমার সালাত নিয়ে তোমার এত ভাবনা কেন? সালাত আদায় করেও তো কত মরদ বা আওরত ঝগড়া করে, অন্যের ক্ষতি করে, গরীবকে তার হক দেয় না?'

বেদুইনদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা শুরু করে কালবি, কিতাব আল আনাম্ম সেই বইয়ের নাম। আল-লাত, আল-উজ্জাত ও আল-মানাত আল্লাহর তিন কন্যা ছিল আরবের মানুষের প্রতিদিনের হৃদয়দেবী। মানুষের মন কেমন হওয়া উচিৎ বলে আমাদের মনে হয়? এখানে এসে আমরা হঠাৎ শাহবাগের ফুল বিক্রেতা সূর্য আলী ও তার পাতানো ভাগ্নে রিপনকে পাই। যে ফুল বিক্রেতা রিপনের মামা লাবলু রিপনকে মাদ্রাসায় ভর্তি করতে চাইলে খেঁকিয়ে উঠেন- "মাদ্রাসায় গিয়া কী হইব? ভালো কাম পাবে কোনো? গরীবের বাচ্চা হইলে যেন মাদ্রাসায় যাওয়াই নিয়ত।"

লেখক মীরা বাঈয়ের চোখ দিয়ে আমাদের দেখান আমাদের সমাজ পরিবার রাষ্ট্র কেউ কোন ব্যতিক্রম মেনে নেয় না। সেই ১৫৪৭ সালেও শুধু একজন মানুষ ঈশ্বর প্রেমে ভক্ত ও ভজন রচনা করে গায় বিধায় তাকে তার দেবর ননদ রা মিলে অনার কিলিং স্টাইলে হত্যা করে। সেই ধারাবাহিকতা শেষ হয়? হয় না। দেশে দেশে আদতে ক্ষমতার লিপ্সাকে ধর্মের আবরণে ঢেকে কতিপয় ধূর্ত ব্যক্তি সামষ্টিক চেতনাকে উসকে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে সাধারণ মানুষের কাঁধে বন্দুক রেখে।

চট্টগ্রাম হাসপাতালে তাই ত্রিশ বছর ধরে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর শুধু হিন্দু এ কারণে মেট্রনের পদটি উপন্যাসের সিন্ধুসারদা তো হারানই, চির পরিচিত শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন কারণ তিনি কমন রুমকে নামাজের স্থান বানানোতে অন্য সহকর্মীদের যে সমস্যা হচ্ছে তা শিবির সমর্থক নার্সদের বলেন, তিনি বলে ফেলেন নার্সদের যে ইউনিফর্ম তার উপর হিজাব জড়ানোর আলাদা করে কোন মানে নেই।

শিবাজি কোন হতা? গোবিন্দ পানসারের সামনে রাখা টাইপরাইটারে খটখট করে ফুটে উঠতে থাকে অক্ষররাজি 'শিবাজি ভোঁসলে, যাকে আজ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ বলা হয়, ছিলেন একজন ভারতীয় যোদ্ধা সম্রাট এবং মারাঠি ভোঁসলে গোত্রের সদস্য। ১৬৪৭ সালে রায়গড়ে প্রথম তাকে ছত্রপতি বা সম্রাট আখ্যা দেয়া হয়। হিন্দুত্ববাদীরা আজকে যতই তাকে হিন্দু নৃপতি হিসেবে পরিচয় দানের জন্য মেতে উঠুক না কেন, একটি সুশৃংখল সেনাবাহিনী ও সুগঠিত প্রশাসনের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন একটি দক্ষ ও প্রগতিশীল বেসামরিক শাসনব্যবস্থা। শিবাজির আলাপে ঢুকেছি কি ঢুকিনি তাকে তার বসবাসের কম্পাউন্ডেই স্ত্রী উমাসহ গুলি করা হচ্ছে এমন সময় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস বা উপন্যাসের চরিত্র সুতীর্থ। যে কিনা জাফর ইকবাল বা ওয়াসিক বাহারের মতো পদার্থবিজ্ঞানীকে স্থানীয় এমপি চাবুক পেটা করতে চাইলে ক্ষুব্ধ হয়। সে ব্লগার অভিজিৎ, ওয়াশিকুরের হত্যা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে অফিসে যাবার পথে মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১২ই মে ২০১৫ তে সিলেটেই খুন হবে নিজে কি জানতো! অনন্ত বিজয় দাস কি করেছিলো? মানুষের বিবর্তন নিয়ে লেখা বই অভিজিৎ এর বাবা অজয় এর সাথে বঙ্গানুবাদ করেছিলো। যুক্ত ছিল সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের সাথে।

আশামণি বা সন্ধ্যামণি কেন যেন নীলাদ্রি চক্রবর্তী অরফে নিলয় নীল বা হিমের সাথে একসাথে থাকতে শুরু করেছিলো ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে মানুষ পরিচয়ে? কারণ প্রেম। হাজার বছর ধরে মানুষ যে বোধের জন্য অন্য প্রাণীর চাইতে আলাদা সেই অনুভবে তারা মুসলমান সন্ধ্যামণি ব্রাক্ষ্মণ হিম বা নীলের সাথে থাকতো ঢাকার গোরান এলাকায়। পবিত্র শুক্রবারে নিলয় নীলকে লালে ভাসিয়ে দেয় জিহাদীরা, সেদিন ছিল ৭ই আগস্ট ২০১৫। অথচ নিলয় নীল অনবরত পুলিশকে নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছে। পুলিশ কিছুই করেনি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির দর্শনের ছাত্র নীলাদ্রি চক্রবর্তী চাপাতির আঘাতে মুক্তমনা হবার দায় চুকান জীবন দিয়ে। বরাবরের মতো আনসারুল্লাহ আল ইসলাম বাংলাদেশ এবং আল কায়েদা গ্রুপ এ হত্যার দায় স্বীকার করে।

হত্যার পর পুলিশ এসে যা জিজ্ঞেস করে বাড়িওয়ালাকে তা হলো আশামণি মুসলমান ও নীলাদ্রি হিন্দু এবং তারা যে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ নয় তা বাড়িওয়ালা জানে কি না। বাড়িওয়ালার মনটা খুব বিষণ্ণ ছিল, 'ছেলেমেয়ে দুইটা সত্যিই ভালা আছিল। কত মানুষ আমারে কত রকম কথা কয়। কেউ কয় ওরা নাস্তিক। কেউ কয় ওরা হিন্দু-মুসলিম হইয়া, কেউ কারো ধর্ম না বদলায়ে একসাথে থাকছে। আমি হাজ্বী মানুষ, আমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে। আমি বুঝি সবাই তো কোন না কোন বাপ মায়ের সন্তান। পোলাটা কত অল্প বয়সে মারা গেল! আর দোষ বা অন্যায় যদি ওরা কইরা থাকে, তার বিচার আল্লাহই করব। আমি বিচার করার কে? আল্লাহ মালিক!' বাড়িওয়ালা হোসেনউদ্দিনের মতোই হওয়া উচিৎ ছিল আমাদের ভাবনার জগৎ। কিন্তু আমাদের ভাবনার জায়গাটাই একদম আটকে দেয়া। আমরা একের পর এক নৃশংস হত্যার সাক্ষী হয়ে থাকলাম বছরের পর বছর।

যুক্তি ও মুক্ত চিন্তার সাথে চলতে থাকে রক্তের হোলিখেলা হাতে হাত ধরে। ব্যাঙ্গালোরে গৌরী লঙ্কেশ নামক এক্টিভিস্ট যখন হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কলম তুলে নেয়ায় খুন হচ্ছেন তখন খোদ রাজধানী শহরে চাপাতির কোপের নীচে ভেসে যাচ্ছেন আমাদের প্রকাশক টুটুল বা লেখকের চরিত্র রাতুল। রাতুল বা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে প্রকাশক টুটুল তাঁর লালমাটিয়ার অফিসে কাটা মুরগীর  মতো তড়পাচ্ছেন তার বন্ধু রণদীপম ও তারেক রহিমসহ সেদিন ছিল ৩১শে অক্টোবর ২০১৫। লেখক এই যে সময়ের ক্রনোলজি না রেখে এক কালের সাথে আরেককাল মিশিয়ে দিচ্ছেন এখানেই তাঁর মুন্সিয়ানা, কারণ গৌরী লঙ্কেশ খুন হয়েছেন ২০১৭ এর সেপ্টেম্বরে। টুটুলের সমস্যা? অভিজিতের বই ছেপেছেন।

এই ৩১শে অক্টোবর ২০১৫ আমাদের জন্য ছিল এক গ্রহণের দিন। একই দিনে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন, বা লেখকের উদ্দীপন চরিত্রটি আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের ব্যবসার অফিসে চাপাতির কোপ খেয়ে পড়ে থাকেন, দোকানের শাটার নামিয়ে লক করে চলে যায় হত্যাকারীরা। দীপন অভিজিতের বই প্রকাশ করেছিলেন। অভিজিতের বন্ধু ছিলেন ছেলেবেলার। অভিজিৎ হত্যার পর প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন দীপন।

জঙ্গীরা কি কাউকে ছেড়েছে? তাদের ধর্ম ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে যদি মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চলা শুরু করে। তাই কেউ তাদের চাপাতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। জুলহাস মান্নান ও তনয়ের মতো নির্বিরোধী মানুষরাও প্রাণ হারায় ছুরি চাপাতির নীচে-জুলহাস 'রূপবান' নামক ম্যাগাজিন বের করেছিলেন সমপ্রেমীদের নিয়ে। তনয় ছিল জুলহাসের পার্টনার। আমাদের পাশেই 'চিত্রাঙ্গদা' মুভি হয় কিন্তু আমরা একটা রূপবান মেনে নিতে পারি না। লেখক এখানে যে শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন তা পড়ে মনে হয়েছে এ নিয়ে তার গবেষণা কম ছিল-কারণ তিনি মাদ্রাসায় ঘটা ছেলে শিশু বলাৎকারকে সমপ্রেমের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। ধর্ষণ বা বলাৎকার একটি যৌন নিপীড়ন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, অন্যদিকে সমপ্রেম  দুজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যখন নিজের জেন্ডারের মানুষের সাথেই মনোদেহ দিয়ে বাঁধা পড়েন সেই প্রেম ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সেই ভালোবাসার কারণে ২০১৬ সালের ২৫শে এপ্রিল জুলহাস ও তনয় প্রাণ হারান। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা সরকারের এক মন্ত্রীর কাজিন হওয়ার পরেও জুলহাস-তনয় হত্যার সুবিচার আজও দেশের আইন আদালত নিশ্চিত করতে পারেনি।

রাজশাহী ইউনিভার্সিটির শিক্ষক তাহেরের মতোই কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিক্ষক রেজাউল করিমকে। রেজাউল করিমের ভুল ছিল গান বাজনা করা, ছাত্র ছাত্রীদের সংস্কৃতমনা করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। রেজাউল করিম বা ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে-এর চরিত্র আজিজুল রহিম তাই লুটিয়ে পড়েন চাপাতির  কোপে নাস্তিকতার ট্যাগ মাথায় নিয়ে, রাগ পুরিয়া ধানেশ্রির বন্দিশ 'পায়েলিয়া ঝঙ্কার মেরি ঝনন ঝনন বাজে ঝঙ্কারি, পিয়া সমঝাত নাহি সাস ননদ মোরি দেগি গালি।' হারিয়ে যায় মতিহার চত্বরে।

শিয়াদের হোসেনি দালানে আশুরা উৎসবে বোমা মারা? এসেছে তো হত্যার গানে। আচ্ছা, পাইরুজ যেন কেন খলিফা উমরকে হত্যা করেছিলো? কারণ উমর পাইরুজকে করেছিলো ধর্মান্তরিত, নিজ মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত ও মেনে নিতে হয়েছিলো পাইরুজের দাসের জীবন। এমন কি নিজের নামটি পর্যন্ত পাইরুজের বদলে গিয়েছিলো। মানুষের ধর্ম জোর করে বদলে দিলে, নাম বদলে দিলে ভেতরের মানুষটাও কি বদলে যায় আমূল? না তো। সেই উপলদ্ধি থেকে খলিফা উমর মৃত্যুকালে নিজের ভুল বুঝতে পারেন, সাথীদের বলেন মুহাজিরুন ও আনসারদের প্রতি সদয় হও হে বিশ্বাসীগণ!

বিদেশী হলে কি ছাড় আছে মৃত্যুর তালিকা থেকে? না,ভিনসেন্ট বা তাভেল্লা খুন হন গুলশানে, তিনি ছিলেন এনজিও কর্মী। খুন হয়ে যায় জগন্নাথের ছাত্র সামাদ বা আরিফ ৬ই এপ্রিল ২০০৬ এ, চাপাতি চুমু দেয় ঘাড়ে মাথায় সবখানে। বাউল, সাধক, গির্জার পাদ্রি, এনজিও কর্মী কাওকে ইসলামিস্ট জঙ্গীরা ছাড় দেয়নি। রংপুরের জাপানী হোসি কোনিওর মতো ধর্মান্তরিত মুসলিমকেও ছাড়ে না তারা। সে আকিমাসা হয়ে মারা যায় আমাদের লেখকের কলমে। মুন্সিগঞ্জ সিপিবির নেতা শাহজাহান বাচ্চু পঠিত উপন্যাসে জাহাঙ্গীর বাবলু হিসেবে আবির্ভূত হন। যে মুন্সিগঞ্জে গিয়েছিলেন ঢাকাকে নিরাপদ মনে না করে সেই মুন্সিগঞ্জেই তাকে হত্যা করে জঙ্গীরা।

ব্লগার হত্যায় কিছুটা হলেও যবনিকা পাত ঘটে আদতে গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার পর। বিদেশী নাগরিক বিশেষ করে অধিক সংখ্যক ইতালীয় ও জাপানীদের মৃত্যু সরকারকে বাধ্য করে তিন বছর ধরে চলা হত্যার মহোৎসবের রাশ টেনে ধরতে। হোলি আর্টিজানের হৃদয়বিদারক ঘটনা যে কোন শিমারের চোখেও জল নিয়ে আসবে-সন্তানসম্ভবা ইতালীয় নারী, ভারতীয় নাগরিক তরিশি জৈনকে সর্বাধিক আঘাত করে এই জঙ্গীরা। ২৪ জন মানুষকে নির্বাসরা একরাতে খুন করে। তাদের সহযোগী ছিল নর্থ সাউথের শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিম ও অপর এক শিল্পপতির ছেলে তাহমিদ। এই দুইজন সন্দেহভাজনকে নানা নাটক করে মুক্তি দেয়া হয়। হাসনাত করিমের ওয়াইফ ২রা জুলাই মিডিয়ার সামনে এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে সে হিজাব পরা থাকায়, কোরান থেকে সুরা বলতে পারায়, তাকে মুসলমান হিসেবে জঙ্গীরা কিছু করেনি। এমন কি তাদেরকে সেহরীও খেতে দিয়েছে। আমাদের মিডিয়া ও গান্ডু দেশবাসী আরেকটু হলে এই সেন্টিমেন্টে ভেসে যেত যদি না বিদেশী একজনের ছাদ থেকে ভিডিওতে দেখা যেত হাসিখুশি হাসনাত ও তাহমিদ আনন্দের সাথে জঙ্গী নিবরাসদের সাথে দাঁড়িয়ে রিল্যাক্স মুডে সিগারেট টানছে। এ আক্রমণে কোল্যাটারাল ডেমেজ ঘটে ট্রান্সকম গ্রুপের ফাইয়াজের। যাকে নিয়ে কাল্পনিক এক বীরত্ব গাঁথা লিখে ফেলেন প্রথম আলোর উপ সম্পাদক আনিসুল হক। ইশরাতের মতো নির্বিরোধী শিল্পমনা মেয়ে বা ল্যাভেন্ডারের নাতনি অবন্তির জন্য প্রাণ না কাঁদলেও আমাদের ডেইলি স্টারের গায়িকা এলিটা তাহমিদের জন্য ফ্রি তাহমিদ হ্যাশট্যাগ চালু করেন পর্বত আরোহী ওয়াসফিয়া নাজনীন সহ।

'ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে' প্রকাশিত হয়েছে সংবেদ প্রকাশনী থেকে। উপন্যাস কোন ঐতিহাসিক গবেষণার দলিল নয়। তাই লেখক এখানে আধুনিক লেখকদের যে ধারা সেই ধারায় ডকুফিকশন ঘরানায় মুক্তিযুদ্ধে ভূ-খন্ড জিতে নেয়া একদেশের মানুষ কিভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চার যুদ্ধে চাপাতির নীচে বিলীয়মান হয়ে যাচ্ছে-ধর্ম, রাজনীতি ও আশেপাশের দেশের ঘটনার প্রবাহের কারণে তার এক নিরপেক্ষ বয়ান তুলে ধরেন আমাদের সামনে। তিনি ইসলাম ধর্ম,হিন্দু ধর্ম, চার্চ, মন্দির, মসজিদ, শিয়া-সুন্নি, বাউল, বৈষ্ণব কোনদিকে আলোকপাত করেননি?

আফসানা কিশোয়ার

পাঠক হিসেবে আমি অভিভূত এ কারণে যে এক মলাটে আমাদের দুঃসময়ের এমন বর্ণনা সেই ২০১৩ থেকে এই ২০২২ পর্যন্ত কেউ লেখেনি। বইটি পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এই বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া অত্যন্ত জরুরী।  মানবতার উপর যে আঘাত সর্বকালে এসেছে তার এক প্রমাণ দলিল এ বই।

অদিতি ফাল্গুনী 


অদিতি সব সময় পরিশ্রমী লেখক। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেই মধ্যযুগ থেকে শুরু করে সব কাল যেভাবে তিনি অক্ষরে অক্ষরে গেঁথেছেন তা মাধুর্যময়, বই শেষ করে বুকে থম ধরে থাকবে। মনে হবে মানুষ হিসেবে আমাদের অর্জন কী? কেন আমরা মনুষ্যত্বের চর্চা করতে পারলাম না! তারপর মনে হবে আলো ও আঁধার সৃষ্টির প্রথম থেকেই পাশাপাশি হেঁটেছে, টি এস এলিয়টের মতো তাই আমরা দিনশেষে বলে ফেলব- But if you kill me,I shall rise from my tomb/To submit my cause before God's throne.

 

বই - ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে

প্রকাশক - সংবেদ

মূল্য - ৪২৮টাকা           

লেখক - অদিতি ফাল্গুনী

 

বই কেনা যাবে বাতিঘর থেকে

https://linktr.ee/baatighar

রকমারি থেকে

https://www.rokomari.com/book/199677/kromagoto-hottar-serenade

 


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি

 


প্রতি,

থিয়েটার বা মঞ্চনাটকের যে ইতিহাসে জুড়ে রয়েছে দেশ, পরাধীনতার দ্রোহকাল, স্বাধীনতা। নাটকের জন্যে তাই এককালের শাসক, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ব্রিটিশ – আইন তৈরি করে। যে আইনে নাটকের গতি নিয়ন্ত্রিত হয়। আলোচনার বিষয় এ নিয়ে নয়। আলোচনার বিষয় হল – দেশের স্বাধীনতা ও ৭৫ বছরের সময়কাল। বলা যায়, যে যে ধরনের থিয়েটার তখনকার বাংলায় চালু ছিল, তারমধ্যে দু-ভাগ করা যায়  আলোচনার সুবিধার্থে। এক, থিয়েটার – যেখানে সমাজের দিকটা ধরা পড়ত। উপন্যাস, গল্প থেকে নাট্য-রূপান্তর। দুই, থিয়েটার – যেখানে সমাজের বৃহত্তর দিক, অর্থাৎ, স্বদেশ ধরা পড়ত। যে নাটকের মূল উদ্দেশ্যে দেশের পরাধীনতার কথা বলা। আর তাই, নাট্য-নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হয়ে যায় ১৮৭৬ সালের পরাধীন ভারতে। বাংলার স্বদেশ নিয়ে লেখা নাটকের নাম সবারই জানা। ‘নীলদর্পণ’ নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। রচনাকাল তাও জানা। তবুও লেখার সাল-তারিখ ১৮৫৮-৫৯। আর ১৮৭২ সালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নাটকটি মঞ্চস্থ করেন ন্যাশনাল থিয়েটারে। এইটিকে প্রথম নাটক ধরে আলোচনা করার সুবিধে রয়েছে। কারণ, এক, সন-তারিখের হিসেবের জন্যে। কারণ, দুই, একটি অত্যাচারিত প্রেক্ষাপট, যা নাটকের দ্বারা শুধুমাত্র নীলচাষীদের কেন্দ্র করে প্লট গঠিত হলেও, এর মূল থেকে যাচ্ছে শাসকের অত্যাচার। ফলে, এটিকেই ধরা হল। এর আরেকটা কারণও অগ্রাহ্য করার নয়। বিশেষত, যে নাটককে কেন্দ্র করে ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ পাশ হয়। সেই নাটকের নাম আন্দোলনকারী তালিকায় না থাকলেও, দেশ-পরাধীনতার শীর্ষকে মিলে যায়। একদিকে ভূমিকা-স্তরে এই নাটকের কথা লেখা গেল। এবারে স্বাধীনতার নাট্য।

স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট এদেশে এমনি আসেনি। এসেছিল উদ্বাস্তু মানুষের হাহাকার নিয়ে। একদিকে ভিটেমাটি ছেড়ে শাসকের নতুন নিয়মে মানুষের দলে দলে অজানা ভূগোলে এসে পড়া। কখনও স্টেশনে, কখনও রাস্তার ধারে। বাংলা হয়ে যায় পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ। এহেন অবস্থায় দুই-বাংলার ভূগোলের বাস্তুহীনদের পাশাপাশি এক মন্দা বাজারের সম্মুখীন হয়ে যায় খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের নাটক। যেখানে ধারকর্জ করে টিকিয়ে রাখা রঙ্গমঞ্চ ব্যবস্থা। দর্শক না থাকলে নাটকের কিছুই থাকে না – একথা এদ্দিনে বুঝে গিয়েছেন পাঠক। ফলে, দর্শকই সব। এহেন অবস্থায়, স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কয়েক বছর মন্দা চলে থিয়েটারের বাজার। এরমধ্যের নাটক অভিনয় নিয়ে বিশেষ করে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে কিছুই ঘটে না। অভিনয় চলে বহু-পরিচিত পুরনো নাটকেরই। যদিও এরই মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার তার অবস্থান সূচিত করেছে। কিন্তু নাটকের পেশাদার কাজ তা নয়।

স্বাধীনতার পর একটি বিশেষ নাটক ‘বাংলার প্রতাপ’, নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত। নাট্য পরিচালক বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরী। উপস্থাপনার তারিখ ১৯৪৭ সাল ১৫ আগস্ট। মঞ্চস্থ হয় রঙমহল থিয়েটারে। যে থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন আর নেই। অথচ, স্বাধীনতার সময়ের দিক থেকে ধরলে উল্লেখ্য মঞ্চ – না-পরাজয়ের ইতিহাস বহনকারী।  বিশিষ্ট নাট্য-গবেষক দেবনারায়ণ গুপ্ত, উল্লেখ্য নাটকটিকে দেশাত্মবোধক নাটক বলেই মনে করেন। এবং তাঁর মন্তব্যে নাট্য-প্রযোজনায় নতুন কিছু ঘটেছিল আলোকসম্পাতে এবং দৃশ্যপট সজ্জায়। যেহেতু তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, তাই নাটকের উপস্থাপনা বিশেষভাবে বর্ণনা রেখেছেন। আমরা শুধু ফ্ল্যাশব্যাকে সেই ইতিহাস পড়ি। এবং ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক কাজল সেন–এর বহুমাত্রিক চিন্তনে – তা লেখার সুযোগ পেয়ে থাকি। অর্থাৎ, পুনরায় মূল্যায়ন করার জন্যে ফিরে দেখা। ফিরে দেখার সেই পর্বে – ‘দেশ’ একটা ফ্যাক্টর। তার সীমানা যতখানি, তারও বাইরের কোন দেশ পর্যন্ত এই ইতিহাস নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। এবং দেশের এক বিশেষ কাজ হয়ে থাকে থিয়েটার, অর্থাৎ নাট্য-চর্চা। এক্ষেত্রে শচীন্দ্র সেনগুপ্ত নাটককার। যিনি অনেক বিষয়েই নাটকরচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত নাটকটি, আলোচ্য নাট্য-প্রযোজনা স্বাধীনতার উদযাপন পর্বের অতীত ও নাট্য-ইতিহাসের এক বিশেষ চিত্র। যেখানে নাটককার তাঁর ‘দেশ’ বোধে নির্মাণ করছেন। স্বাধীনতার বছরের সব নাটক যে একই বিষয়ের হয়েছিল তা নয়। নাটককারদের মধ্যে সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে নাটক লেখার প্রবণতা ছিল। যেমন, কালোবাজারি একটি বিষয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই অবিভক্ত বাংলার যে অবস্থা ঘটেছিল – যার জন্যে সমগ্র ভারতবর্ষে তোলপাড় হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে গান, নৃত্য ও নাটক পরিবেশন করে গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা অর্থ জোগাড় করে থাকেন। ঠিক তারই পরের ঘটনায় – স্বাধীনতা। যাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বাংলা। সেই বাংলার মানুষের তখন ইচ্ছে কোথায় যে, নাটক দেখতে আসবেন। আর দর্শক হল নাটকের প্রাণ। সেই টালমালাল সময় চলেছিল। এরই মধ্যে কলকাতার পেশাদার রঙ্গালয় চলছিল। রঙমহলের কথা উঠে আসে ইতিহাসের পাতা থেকে। আর রঙমহলের সঙ্গে থিয়েটারেরও। একদিকে তখন প্রবণতা থাকে ইতিহাসের চরিত্রকেন্দ্রিক নাটক-উপস্থাপনার। কারণ, বোঝা খুবই সহজ। বাংলার হল-মালিকদের সেই সামর্থ্য থাকে না যে তারা থিয়েটার চালাবেন। ফলে, একই নাটক নামানো হতে থাকে, যা আগে থেকেই রিহার্সাল করে তোলা এবং জনমনরঞ্জনে সাফল্যের মুখ দেখেছে। বাংলা থিয়েটারের জন্মলগ্ন থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে পরাধীনতা শব্দটি ছিল। সঙ্গে ছিল স্বাধীনতাবোধের এক চেতনা। যা থিয়েটারে এনেছিল একদল নব্য-চিন্তক। প্রত্যক্ষ দেখার সুবাদে তথ্যকেন্দ্রিক উপাদান না থাকলেও, সামগ্রিকভাবে দেবনারায়ণ গুপ্ত এই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। যেখানে গুটিকতক দর্শকের উপর নির্ভর করে হলগুলো চালু ছিল। এবং তারজন্যে স্বাধীনতার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে ‘রানাপ্রতাপ’ মঞ্চস্থ হয়। তারিখ ১৪ আগস্ট ১৯৪৮। নাটককার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। পরের নাটক ১৯৪৯ সালে ‘আবুল হাসান’ মঞ্চস্থ হয়। নাটককার শচীন সেনগুপ্ত। এরপরের নাটক একই সালে ‘রজনী’ মঞ্চস্থ হয়। নতুন নাটক হিসেবে পরের নাটক ‘নিষ্কৃতি’। নাটকটির নাট্য-রূপান্তর করেছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি অবশ্য আরও অনেক উপন্যাসের নাট্য-রূপান্তর করেছিলেন। তারিখ ১৯৫০ সালের ২ অক্টোবর। এই নাটক নামতেই (থিয়েটারে এই হল কথ্যভাষ) রঙমহলের আর্থিক অবস্থা ফেরে। মন্দা বাজারে এমন একটি নাটকের প্রয়োজন ছিল। যেখানে জহর গাঙ্গুলি, প্রভা দেবী, রানীবালা, হরিধন মুখোপাধ্যায়-এর মতন গুণী শিল্পী অভিনয় করেন।  ১৯৫১ সালে আরেকটি নাটক জনপ্রিয় হয়। নাটকের নাম ‘চাঁদবিবি’। নাটককার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ।

পরের নাটক  ‘জিজাবাঈ’। তারিখ ১৯৫২ সালে ১ জানুয়ারি। নাটককার সুধীর বন্দ্যোপাধ্যায়। দুটি নাটকেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রভা দেবী। একসময় চলতে থাকা রঙমহলের অবস্থায় ছেদ ঘটে। সে পৃথক আলোচনার বিষয়। গল্প বা প্লটের যে নাটকীয়তা, তার দ্বন্দ্ব – যার মধ্যেই নাট্যশালার ইতিহাসের ঘটনা। উত্তরণের পর যে ইতিহাস জন্মায় – তার চর্চা বুঝিয়ে দেয় যে, বাংলা নাট্যশালা বিদেশিদের দেখাদেখি শুরু হলেও, তার পেশাদারিত্ব ততটা হয়নি। সেই আর্থিক মন্দা থিয়েটারের ইতিহাস থেকে দুচারটি থিয়েটার হলের নাম মুছে দিয়েছে। সংখ্যার নিরিখে দেখলে তার ক্ষতি চোখে পড়বে না। কারণ, থিয়েটার হলগুলো যে ইতিহাসের বাহক – তাতে অনেক মঞ্চ আরও সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু, সময়ের জরিপে যে মঞ্চ আর রইল না, তার খামতি তো মোছে না। যেমন, রঙমহলের ইতিহাসে অন্যান্য অভিনেত্রীদের মধ্যে প্রভা দেবীর নামোল্লেখ রইল। আগামিতে অভিনেত্রী না থাকলেও, মঞ্চ-থাকলে তার কাজের ছায়াপাত রয়ে যায়। কিন্তু অবলুপ্ত থিয়েটার হলের তালিকায় ইতিহাস হয়ে রয়ে রইল, আর যে ইতিহাসের সংরক্ষণও রইল না। অথচ, স্মরণ করতে গিয়ে তাত্ত্বিকরা বলছেন, এখানে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর রচনা নাট্যরূপ পেয়েছে। এবং পরবর্তীতে নাট্যকার মনোজ মিত্র-এর নাটকও। এখানে বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক অভিনীত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও, টিকে রইল না। শুধু রইল স্মৃতি। আর ফ্ল্যাশব্যাক-র উত্থানে সেই স্মৃতি থেকে লেখা হয়ে চলল। যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে ছিলেন যাঁরা, শুধু তাঁরাই পারেন আমাদের নাটকের সম্পদ রক্ষা করতে। নাটক থিয়েটার রঙ্গমঞ্চ পেরিয়ে যে ইতিহাস – যেখানে জ্যান্ত কিছু অভিজ্ঞ মানুষ আজও -- অন্তর থেকে থিয়েটার ভালোবাসেন সেই স্পর্ধায় থিয়েটারে রয়েছেন। তাঁদের নিষ্ঠাকে স্যালুট। এবং রঙমহলের ইতিহাসচারী অরুণিতা রায়চৌধুরীকে কুর্নিশ। তারপরের আরও ইতিহাস রইল ফ্ল্যাশব্যাকের আগামী কিস্তির জন্যে।

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী … ০১ ১২ ২০২২ শান্তিনিকেতন

সঙ্গে ছবি স্কেচ _ অংকনশিল্পী অর্ঘ্য চক্রবর্তী

 

(ক্রমশ)