কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৪ |
উল্টোপোকা
অলস বারান্দা জুড়ে সাদা বালির মত নোনতা নৈরাশ্য ঝরে পড়ে। লোকটা বসে থাকে সেইসব অরবতায় অলম্বিত বরফকুচির ভিতর। ভাবে ঘটনাহীন কেটে যাওয়া তার দেড়-ছটাক জীবনের কথা। তার গোটা প্রজন্মের সামাজিক রাজনৈতিক ব্যর্থতার কথা ভাবতে ভাবতে মনে হয়, সাফল্য কতটা ব্যক্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। সবাই যে যার কর্মক্ষেত্রে কত সফল অথচ সমাজ যা গড়েছে লোকটা আর তার বন্ধুবান্ধব, তাতে কেবল অন্যায়, শোষণ, দ্বেষ আর সংঘাত। নাকি গড়েইনি! সমাজ গড়ার কাজে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়েছে সে আর তার বিষাদপ্রজন্ম। সবাই সবার দৃশ্য-প্রতিযোগী। পৃথিবীতে এত আলো, এত ছবি, অথচ ছায়া পড়েনা কোথাও!
এসব কত কী ভাবতে ভাবতে লোকটার নোনাবালিতে শক্ত হয়ে আসা চোখ চলে যায় বারান্দার কোণে যেখানে প্রায় রোজই কোন না কোন পোকা এসে জড়ো হয়! দমকা বাতাস উল্টে দেয় তাদের না অন্য কেউ, অন্য কিছু, অন্য কোনখানে? কেবল কি উল্টেই যায় এমন যে আর সোজা হতে পারে না? নাকি আঘাত থাকে শরীরে তাই সোজা হওয়া যায় না! কুঁকড়ে থাকে, হাত, পা, দাঁড়াগুলো কুঁইকুঁই শব্দের মূকাভিনয় করে। লোকটা আগে গিয়ে উল্টোপোকা সোজা করে দিত। দেখত মুহূর্তে আবার উল্টে গেছে! তাহলে নিশ্চই উল্টে যাওয়া সমস্যা নয়, ওটা বরং সমস্যার আয়না! মানুষও তো বারবার উল্টে যায়, কই তাতে তো কোন মৃত্যুযন্ত্রণা থাকে না?
আজকাল আর উল্টোপোকা সোজা করতে যায় না! খালি নোনতা চোখে দূর থেকে দেখতে থাকে! সোজা হবে কি? পারবে কি? নাকি দাঁড়া থেমে যাবে অচিরেই! থেমে গেলে কি মরে যাবে? একেবারেই কি মরে যাবে? প্রথম প্রথম এমনটাই ভাবতো লোকটা! তারপর একদিন দেখলঃ পুনর্জন্ম! মরে কাঠ হয়ে যাওয়া উল্টোপোকা সোজা হয়ে উড়ে গেল আধঘণ্টা নিথর পড়ে থাকার পর! সেদিনের পর থেকে মাঝে মাঝেই খেয়াল করে লোকটা। চা নিয়ে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ বাদে ফিরে আসার পর পোকালাশ হাপিশ! না, এটা পিঁপড়ের কম্ম নয়! এ হল পুনর্জন্মের উড়াল! অলস বারান্দার উড়াল কোণ থেকে নব্যসূচনা।
লোকটাও ভাবে, একবার মরে গিয়ে আবার শুরু করবে! উল্টেপাল্টে দিতে গিয়ে ঠোক্কর খেয়ে ভারী বাতাস যখন দাঁড়ায় দাঁড়ায় মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে আসবে, তখন আবার উপুড় থেকে চিত হবে লোকটা কিম্বা চিত থেকে উপুড়! বিষাদপ্রজন্মের একলসেড়ে ভাব কাটিয়ে আবার উড়ে যাবে, যেখানে সম্যক দূরত্বে হয়ত এক স্বাধীন সাম্যবাদী সমাজ রয়েছে! অথচ তার তথাকথিত সফল জীবনে সেখানে ঢোকবার প্রবেশ পত্র নেই।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন