কবিতা, গপ্পো, উপন্যাস,
মুক্তগদ্য, অনুবাদ গ্রন্থ, গবেষণা ভিত্তিক বই... অনেক ক’টিই হল। হইচই করে উদযাপন
হয়নি। 'চুড়েইল' উপন্যাসটির মোড়ক খোলার অনুষ্ঠান করেছিল ঐহিকের তমাল, মফ:স্বলের
লেখকের সেটা বড়ো পাওয়া।
নতুন বই পার্সেলে এসেছে, মুখ দেখেছি, এই রকম অভিজ্ঞতাই
বেশি।
আলপথ,সংগীতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন প্রকাশনা থেকে গল্প সিরিজ বেরিয়েছে তিন ফেব্রুয়ারি... আম্মোও
সেই সিরিজে আছি। ফেবুতে প্রচ্ছদ দেখা সারা, তবু একটা উত্তেজনা থাকে। মালদা থেকে
চার তারিখ রওনা হয়ে পাঁচ তারিখে এসেছি। সংগীতা পোস্ট দিয়েছিল, বেলা দুটো অব্দি
মাঠে থাকবে। হুড়ুম দুড়ুম করে আমি আর পিন্টু ছুটেছি। বাসে বিল্ডিং মোড়। ক্রসিং
পেরিয়ে অটো। এবিপির অভিজিৎ ফোন করেছে, কলকাতা বইমেলায়, মালদার লেখকদের কার কার বই
বেরোচ্ছে,জানতে চায়। কি হবে ?কাল উত্তরবঙ্গের কড়চায় খবর করতে হবে। ম্যাডাম আপনি একটু ছবিটবি
দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ করুন। আমার বই ছাড়া বেরোচ্ছে অনুরাধা কুন্ডার গল্প বই, দিবারাত্রির
কাব্য থেকে। দাঁড়াও, মেলায় ঢুকি সব পাঠাচ্ছি, এটাই আমার হোয়াটসঅ্যাপ নং। এবং
প্রয়াস থেকে শতানীক রায়ের সম্পাদনায় মলয়দার একটা অনুবাদ বেরোবে শার্ল বোদলেয়রের...
সব ছবিটবি তোলার উত্তেজনা, নয় নম্বর গেট খুঁজে পাওয়া, দেখলে হবে খরচা আছে...
বইমেলায় এলেই স্মৃতি
কাতর হই। অমৃতলোকের টেবিল
খুঁজি। সমীরণ মজুমদার, অমিতাভ সমাজপতিকে খুঁজি... কত স্মৃতি, আড্ডা, কাজ।
লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে
আগের মতো ঠাসাঠাসি নেই, স্পেস আছে, এটা ভালো।
এবং প্র্য়াসের টেবিলে
সেলিম, শতানীক,তিতিরের টেবিলে সঞ্জয়... এদের এড়িয়ে আগে তো অনুরাধার বইয়ের একটা ছবি
তুলি, বইমেলার কিছু স্টলের ছবি, পাঠাই, অভিজিতের আজকেই লাগবে। তো মেলায় নেটওয়ার্ক
পালায়, যোগাযোগ হয় না। শুধু বিঘে দুই,
আলপথও খোলেনি তখনও... আমি তিতিরের স্টলে নিত্যদার চালাঘরে বসি... তাঁকে নিয়ে কত জন
লিখেছেন-প্রবন্ধ, স্মৃতি, কবিতা... আমি লিখতে পারিনি। বইয়ের পিছন পাতায় নিত্যদার
সেই আন্তরিক ছবি। যেন খুব মৃদু গলায়
বলছেন, হবে হবে,তাড়া কী!
এক বসন্তে মাথাভাঙায়
উনার বাড়িতে ছিলাম। দালানে বৌদি, মিতু থাকে। খাওয়াদাওয়া
সেখানেই। তবে কবির নিভৃত যাপন উঠোনের টিনের চালায়। গুটিকয় বই, ডায়েরি, খাতা... মদ্যপান কমে এসেছে, কিন্তু
সিগারেট ছাড়তে পারেন নি। কেন অতো অত্যাচার করেন শরীরের? ছবিটা এমন জীবন্ত, যেন
প্রশ্ন করা যায়। ধমক দিলেন, এই উত্তরের লোকের গেয়োমি। আটকে যায় বড়ো! আগে মেলা ঘুরে
এসো। এক জায়গায় আটকে গেলে চলে?
সে চলে না। লিটল
ম্যাগাজিনে বসার জায়গা নেই। দেড়মাস আগে অপারেশন হয়েছে, ক্ষিধে পায়। পিন্টুর সুগার, সে বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে
পারে না। ৩/২এ মালদা শহরে CAA, NRC, NPR নিয়ে
এপিডিয়ারের বিরাট মিছিল। রতুয়া, কালিয়াচক, গাজোল... সব প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছেন।
উৎসাহে সারা শহর চক্কর দিয়েছি। কোমর, পা সবাই ধর্নায় উৎসাহী মিছিলে
নয়।
ফেবুর মনস্ক পাঠকদের
থেকে অবশ্য পাঠ্য বইয়ের তালিকা পেয়েছি। সে সব নিতে হবে। মেয়ের একটি বইয়েরই দাবি ছিল। সে বইয়ের সম্পর্কে অভিষেক ও পোস্ট দিয়েছে... এই যুবকের পঠন
প্রতিভা ঈর্ষণীয়। শ্রদ্ধা জাগায়। জয়াদি, যশোধরা, জয়া চৌধুরির পোস্টে
প্রচুর বইয়ের খবর। খুঁজে পেতে হ্যালাকান হই।
কিছু লিটল ম্যাগাজিন
তালিকায় আছে। তো আল্পনা ঘোষ সংখ্যার জন্য 'শহর' খুঁজতে ‘আয়না নগর’ আর ‘আরশিনগর’ হারিয়ে ফেলি। 'নিরন্তর' কোন স্টলে পাওয়া
যাবে? তটিনী দত্তকে ফোন করে পাই না। খাওয়ার জন্য মুড়িও পাই না।
তাড়াহুড়োয় বিস্কূটের
প্যাকেট ফেলে এসেছি। অবশেষে প্রাণের টোস্ট প্রাণ বাঁচায়। ফিরে আসার তাড়া। বাসের
লাইন। সাড়ে সাতটার মধ্যেই মেলা ছাড়ি।
আমার 'মেয়েদের
চোরাগোপ্তা স্ল্যাং, শরীর ও অন্যান্য আলাপ' বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য অনুমতি চেয়ে ফোন
করেছিলেন কারিগরের দেবাশিস সাউ। এর চেয়ে আনন্দের খবর হয় না। গেল বছর বইমেলায় বইটি
প্রকাশিত হতে পারেনি, প্রকাশ হয়েছে পরে। এত তাড়াতাড়ি আবার ছাপতে হবে তার মানে বিতর্কিত এই বইটির
বিষয়কে গ্রহণ করার মতো বাঙালি পাঠক
সাবালক হয়েছেন। বিদুষী নামে এক পাঠিকা ফোন করেছিলেন, এই
বই নিয়ে খুব উৎসাহী, আলাপ করতে চান। শুভংকর গুহর সাথে দেখা হবে। দেখা হবে আমার
নতুন বইয়ের সাথে। এতো ভিড় এতো ভিড় কারিগরে পরে যাব করে যেতে পারলাম না। শুভংকরের
সাথে কথোপকথন হল না। বিদুষীকেও খুঁজে পেলাম
না। কমলদার কৌরব দেখে পালিয়ে যাচ্ছি। ভালোপাহাড় গিয়েছিলাম। উনার বই নিয়ে লিখতে
বলেছিলেন। তো সেখান থেকে ফিরেই তো নার্সিং হোমে। আর সুদেষ্ণা নেই দোকানে, ভালো লাগে না... 'দমদম
জংশন'এর বৈদ্যনাথ মিশ্র ও মালদার। উনার পত্রিকা শূদ্রকে প্রথম গল্প লিখেছি। ভিড়ে
কথা হল না। পুনশ্চর স্টল বড়ো। বসার জায়গা আছে। চা, বিস্কুট আড্ডা সবই দেদার। এবার সন্দীপ, শক্তিসাধনদা, উৎপলদা
কারো সাথেই দেখা হল না।
সাত তারিখ ঐহিকের
সম্মাননা অনুসঠান। অভিজিৎ সেনকে লাইফটাইম সম্মাননা দেওয়া হবে। থাকতে হবে। প্রিয় লেখক। প্রিয় মানুষ। তমাল রায় বড়ো
যত্ন করে এই কাজটা করেন। অনুষ্ঠানে দেখা হয়। আড্ডা হয় না। ওকে নিয়ে কনিষ্ক
ভট্রাচার্য চমৎকার বললেন। বাংলাদেশের জুয়েল মাজাহারকে নিয়ে বললেন কবি সৌমনা
দাশগুপ্ত। কী গভীর ভাবে ভাবতে পারে মেয়েটা। মেয়েদেরই বই কিনেছি বেশি। কত অন্য রকম লিখছে তারা, কেমন অন্য
লিখছে... জানতে হবে না? পত্রিকা, প্রকাশনা সবই করছে, মুগ্ধ হয়ে যাই। ভূমধ্যসাগর,
লিরিক্যাল, কাগজের ঠোঙা, পদ্য, অহল্যার পাশাপাশি
এবার খুঁজে পেলাম অনুষা প্রকাশনী। সেই যে বিদুষী আলাপ করতে চাইছিল, ওদেরই কর্মকান্ড। শুক্তি রায়ের প্রতিষ্ঠান না বলে সংসার বলা যায়। স্প্যানিশ থেকে সরাসরি
অনুবাদ করেন এঁরা। এরেন্দিরা,প্লাতেরো... শুক্তির অনুবাদে চমৎকার!
ছবি তোলার কথা না বললে
পাপ হবে। প্রথম দিনই বইমেলা যাচ্ছি শুনে জয় পুরিয়া কলেজ থেকে বর্ণালি পাইন এসেছিলেন, দু’ কপি নিলেন। আমার
গভীর পাঠক, ভয়ে ভয়ে থাকি ওর মতামতের জন্য, কিন্তু ফটো সেসনে হাসিহাসি মুখ দিই। আলপথ
স্টলে সঙ্গীতার সাথেও বই হাতে ছবি। পীযূষ বিশ্বাস -দিল্লীর, দীপায়ন কোচবিহারের, মাঝ মাঠে হঠাৎ ঝলক তৃষ্ণা,
যশোধরা... প্রিয় লেখক, প্রিয় মুখ। তণ্বীর সাথে দেখা হল না। রিমির সাথেও না। সৌমনার
মাসান নিয়েছি, শতাব্দী আর বিতস্তার সাথেও ছবি। আর 'অনুষা'য় পিন্টু, মঞ্জিরার সাথে
সব্বার ছবি। জলপাইগুড়ির তনুশ্রীর নতুন বই গাংচিল থেকে। কিন্তু ও আসেনি। জলপাইগুড়ির
অলোক গোস্বামীর সাথেও ছবি হল।
বই কি কিনেছি তার
ফিরিস্তি দিচ্ছি না। বই টেনে নিয়ে যেতে হবে। শহরের প্রীতমের পুনশ্চই বেশি স্টেডি
আমার জন্য। বই উপহার পেলাম অনেকগুলো। তরুণ কবিরা পাঠ প্রতিক্রিয়া চায়। বাংলা দেশের
মেঘ অদিতির 'উপসংহারে অন্য সকাল'এর কী চমৎকার প্রচ্ছদ। বইগুলো পড়ার উত্তেজনায়
টানটান আছি। এই সব ছবি তোলা, বই কেনা, বই দেখার মাঝে স্টল নং ভুল করে ঘুরপাক। হারিয়ে
যাওয়া। কবিতা পাক্ষিকের স্টলে মাত্র একশো টাকায় মলয়দার আধুনিকতার বিরুদ্ধে
কথাবার্তার সাথে সমীরদা, প্রভাতদার উত্তর আধুনিক বই। কী চমতকার রবি ঠাকুরের
বইগুলো, একটু রঙিন। ছোটোদের ভালো লাগার মতোই। 'আমার পটল ডাঙার বাড়ি যাবে তৃপ্তি,
সকালে যাবে’ প্রভাতদাই এইরকম সাদর আহ্বান করতে জানেন।
তিন নং গেটের পাশে আমরা
যখন আড্ডায় ব্যস্ত, লিটল ম্যাগাজিনের স্টলের বাইরে গন্ডগোলের খবর পাই। এপিডারের
মিছিল নিয়ে এবিভিপির ঝামেলা। আরেস্ট, মেয়েদের সাথে অশোভনীয় আচরণ, মারধোর আর যা যা
করতে পারে একটি ফ্যাসিস্ট দল।
আমাদের ফিরতে হয়। লম্বা
লাইন বাসের। সিটের পাশে লাগেজ রাখার জায়গায় বসে, দাঁড়িয়ে। নিশ্চিত জানি, তরুণদের সাথে প্রবীণ প্রতিবাদীরাও
আছেন। আমরাও আছি অক্ষর নিয়ে। কত ছোটো পত্রিকা। নিজ নিজ শৈলিতে স্থানিকতা, আঞ্চলিকতা,
পান গান ধান, রন্ধনশিল্প কারুশিল্পের বৈচিত্র নিয়ে কী ভাবে ছুঁয়ে থাকতে চান মাটিকে
ভাষাকে।
হাইলাকান্দির কমলেন্দু
ভট্রাচার্য হন্যে হয়ে খুঁজছেন লুৎফর রহমানের বই 'বিশ্বনাথ মাঝি ও বিভূতিভূষণের
গ্রাম', হেঁসেল হারিয়ে, মাটি হারিয়ে বাঙালি খুঁজছে 'বাজার ভ্রমণ', 'ছাদ পেটানোর
গান', ভিল মহাভারত, জলবনের কাব্য, 'মোমেনশাহী উপাখ্যান'...
আমাদের মফ:স্বলের
বাদিয়া মিছিল, মহানগরীর বইমেলার মিছিল, পার্ক সার্কাস, শাহীনবাগের লাগাতর অবস্থান,
প্রতিবাদ সব সেই রুটি, ভাত আর ভাষার
স্বপ্নে। 'আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বন্টন, / পরম শান্তির মন্ত্রে গেয়ে উঠো
শ্রেণির উচ্ছেদ / এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী কর উচ্চারণ / যেন না লোকধর্মে আর
ভেদাভেদ'।
অমর একুশে এই আমাদের দৃপ্ত উচ্চারণ... মেলা শেষ হলে আবা