কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

শুক্লা মালাকার



বইমেলা… বইমেলা…




ঢং ঢং ঢং… ন’বার বেজে ঘন্টা বিশ্রাম নিল। আবেগ মিশ্রিত উল্লাসের হাততালি জড়িয়ে এই
বছরের কলকাতা বইমেলার সমাপ্তি। প্রতিবছর এভাবেই শেষ হয়। প্রতিজ্ঞা থাকে আবার
নতুন ছাপা স্বপ্নের বুড়বুড়ি তুলে একসাথে জমজমাট ১২দিন কাটানোর।

ক্রমশঃ খসে পড়বে স্টল। কাঠের ভাঁজে ভাঁজে জমা হবে লিটিল ম্যাগ টেবিলের
সীমানার লড়াই, মুক্তমঞ্চের রোজকার পত্রিকা উদ্বোধনের জাঁক। ফুডপার্ক থেকে
উড়ে আসা রকমারি গন্ধে সুর সুরে জিভের
  ভিজে যাওয়া ঘুমিয়ে পড়বে। কাঠে
পেরেকে জড়াজড়ি করে ডাই হবে সেলফির তোড়ে ভেসে যাওয়া এই প্রাঙ্গন।

অবশ্য শুধু সেলফি নয়, এবারে অসময়ে এসে পড়া পশ্চিমী ঝঞ্ঝাও ভাসিয়েছিল। মাত্র
কুড়ি মিনিটে বহু প্রকাশকের মাথায় হাত তুলে দিয়ে দিব্য ড্যাং ড্যাং করে চলে
গেল সে। তবুও ধ্বসে যাওয়া স্টল, মুছে যাওয়া অক্ষর বুকে তুলে বাকি দিনগুলো
কিন্তু হৈ হৈ করে পেরিয়ে গেল এই বইমেলা।

প্রতি বছরই বইমেলা তার রূপ বদলায়। অনেকেই বলেন, ময়দানের বইমেলার স্বাদ
গন্ধ আলাদা ছিল।
 একদম ঠিক কথা। মিলনমেলা থেকেই বইমেলা বাণিজ্যিক হয়েছিল।
সেন্ট্রাল পার্কে তার চুড়ান্ত রূপ। গত বছর থেকেই হিন্দিভাষী মানুষের আনাগোনা বেড়েছিল।
এবছর কিন্তু বেশ লক্ষণীয় ভাবে সেই সংখ্যা বেড়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালীয়ানায় থাবা
বসেছে।

ব্যাপারটা হল এই নস্টালজিয়া, এই আবেগ বাদ দিলে অনেক কিছুই ভালো।
প্রকাশকদের অনেকের মুখেই চওড়া হাসি। প্রতি বছর বই বিক্রির হার নাকি
বাড়ছে। বাড়ছে নতুন নতুন ছোট প্রকাশকদের ভিড়। মেলা মানেই বাণিজ্য। তাই বই
বিক্কিরি করে লাভবান হওয়াটা মোটেই দোষের নয়। এখন, কে ভালোবেসে বই কিনছে,
আর কে ড্রইংরুম সাজানোর জন্য, সেটা না হয় চায়ের কাপে তুফান তোলার বিষয় হয়েই
থাক।

সেদিন রমাপদ সরণী বেয়ে একপ্লেট চাউমিনকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে
পড়েছিলাম। সাদা রঙের কাঁটাচামচ দিব্যি ডুবছে উঠছে। লক্ষ্য করে দেখলাম, 
প্লেটের পিছনে একটি মুখ।
  গাউন পড়া ছোট ফুটবলের মতো শরীর দু’দিকের স্টলের
বই দেখতে দেখতে এগোচ্ছে।

আর একদিন চিৎকার শুনে পিছন ফিরে দেখলাম, ছোট একটা স্টল থেকে এক ব্যক্তি বই
ছুঁড়ে বাইরে ফেলেছেন, সঙ্গে গালাগাল। ইংরেজি বলেই হয়তো কাঁচা লাগল না।
মুহূর্তে গোলাকার ভিড়। অন্য একজন ততক্ষণে মুখ লাল করে বই তুলতে শুরু করেছেন।
 
ষাঠোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ছেলেমানুষি এখানেই থেমে যায় নি। মিনিট কুড়ির মধ্যেই পুলিশ
সিকিউরিটি নিয়ে লাল গাল পাল্টা জবাব দিলেন। খেয়াল করলেন না যে শুধু দর্শক নয়,  
সিকিউরিটি স্টাফদের মুখেচোখেও হাসির ঝিলিক।

প্রতিবাদ আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। মেলার মাঠে সেই প্রতিবাদ নিয়ে যা হুল্লোড় হল!
মিছিল, পাল্টা মিছিল, থানা–পুলিশ। এমন না হলেই মনে হয় ভালো হতো। বইমেলায়
আগেও অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। তার রকম ছিল আলাদা।

ময়দান থেকেই পেন্টিং, গ্রিটিংস কার্ড, ক্যালেন্ডার বানিয়ে কিছু শিল্পী বইমেলার মাঠে বসে
বিক্রি করতো। সঙ্গে গীটার বাজিয়ে গান কবিতা বেশ আর্টিস্টিক ব্যাপার স্যাপার। মিলন
মেলায় সেটি আকারে অনেকটাই বেড়েছিল। হ্যান্ডমেড পেপারের ডায়েরি, টেবিল ক্যালেন্ডার
ক্রমে হ্যান্ডমেড পেপারের ডায়েরি, রকমারি জিনিসে তৈরী গহনা। তারপর বাংলা লেখা
টি-শার্ট, ইনস্ট্যান্ট লিখিয়ে নাও মনের মতো কথা কিংবা কবিতা। আজকাল বইমেলার
অনেকখানি জুড়ে সেই বাজার বসে। একটু আগেই ছাপানো টি-শার্ট এবং ডায়েরি বিক্রেতার
আলোচনায় জানলাম, বাজার তাদের আশা পূরণ করতে পারেনি। মাত্র দেড় লাখের মতো
বেচাকেনা হয়েছে। একজন গহনা বিক্রেতা নাকি তাদের টেক্কা দিয়েছে। আচ্ছা এ কি
বইমেলা!

তবে নতুন কিছু তরুণ প্রকাশক দারুণ আইডিয়া নিয়ে এসেছেন।
  লেখকেরা নামমাত্র
খরচে বই ছাপাতে পারছেন। এতে করে একদিকে লেখা এবং লেখকের সংখ্যা লাফাতে
লাফাতে বাড়ছে অন্যদিকে নতুন প্রকাশকের সংখ্যাও বাড়ছে। এঁরা দেখিয়ে দিচ্ছেন বই
ছাপিয়েও রোজগার করা যায়। ছোট ছোট স্টলগুলি রোজ জমজমাট। আজ দুটো তো কাল
চারটে নতুন বই প্রকাশ পাচ্ছে। একাধারে লেখক ও ক্রেতাদের ভিড়ে টইটুম্বুর। কার ক’টি
লেখা বেরোল, ক’টি বই, উচ্চস্বরে তার হিসেব নিকেশ হতেও দেখলাম। সে নিন্দুকেরা অনেক
কিছু বলতেই পারেন, এটি তো আর সাহিত্য মেলা নয়, এ যে বইমেলা!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন