কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৫৭

 
একটি ছোট্ট খবর। খবরটা ভারতের নয়, বরং আমাদেরই উপমহাদেশের জাপানের। গত ২২ জুন ২০১৮ একটি হিন্দী সংবাদপত্র ‘দৈনিক ভাস্কর’এ প্রকাশিত হয়েছে। খবরের সঙ্গে একটি ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, চারজন জাপানের নাগরিক একটি টেবিলের পেছনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছেন। খবরটা পড়ে জানা গেল, তাঁরা সবাই সে দেশের সরকারী কর্মচারী। একটি ‘লাইভ টিভি শো’তে সারা দেশের দর্শকদের সামনে মাথা নত করে তাঁরা  মার্জনা প্রার্থনা করছেন। কিন্তু কেন এই মার্জনা প্রার্থনা? কী তাঁদের অপরাধ? না,  তাঁরা কোনো অপরাধই করেননি, বরং তাঁরা দেশের সেবা ও কাজে অত্যন্ত তৎপর, একনিষ্ঠ এবং দায়বদ্ধ। আসলে তাঁরা কোনো অপরাধ না করলেও, তাঁদেরই অধীনস্থ এক সরকারী কর্মচারী অপরাধ করেছেন। কী অপরাধ? জানা  গেল, সেই কর্মচারী তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কাজের সময় শেষ হবার তিন মিনিট আগেই তাঁর কাজের আসন ছেড়ে উঠে গেছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, অনুসন্ধান  করে আরও জানা গেছে, সেই কর্মচারী গত সাত মাসে মোট ছাব্বিশবার নাকি এই একই কাজ করেছেন। আর তাই অধীনস্থ কর্মচারীর এই আচরণে অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে উল্লেখিত চারজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী দেশবাসীর সামনে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।  কেননা, সরকারী কাজে এক সেকেন্ড নষ্ট করাও তাঁরা অপরাধ বলে মনে করেন।


আমাদের সবার কাছে এই ছোট্ট খবরটা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হবে, আদৌ হবে কিনা, আমার জানা নেই। জানা নেই কে কতটা গুরুত্ব দেবেন।  কেননা আমাদের দেশের কর্মসংস্কৃতির সঙ্গে অন্য কোনো দেশের তুলনা টানা নিতান্তই বাতুলতা মাত্র। মনে পড়ে আমাদের দেশের সরকারী কর্মচারীদের  সম্পর্কে একটি প্রচলিত রসিকতার কথা। কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা নাকি পৌঁছতে পারেন না বিভিন্ন কারণে ও অজুহাতে। দেরী হয়ে যায়। কিন্তু দেরী করে পৌঁছেছেন বলে দেরী করে বেরোতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই! বেরোনোটা অন্তত তাড়াতাড়ি হোক! দু’বার দেরী করা তো আর যায় না!


এটা রসিকতার কথা। সব সরকারী কর্মচারী যে এভাবেই অভ্যস্ত, তাও নয়।  তবে নিজেদের ও দেশের স্বাস্থ্য ঠিকঠাক রাখার জন্য মাঝে মাঝেই আয়নায় মুখ দেখা খুবই প্রয়োজন। এবং সেক্ষেত্রে যদি নিজেদের আয়না স্বচ্ছতা হারিয়ে থাকে, তাহলে অন্য দেশের আয়নাও ব্যবহার করা যেতে পারে।   
সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। 

 
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675
                                                        
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India



<<<< কথনবিশ্ব >>>>


শিবাংশু দে




কুশারিবাগান




কে সে মোর, কেই বা জানে...
---------------------------

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী গিয়েছিলেন যশোরের নরেন্দ্রপুরে তাঁর বাপের বাড়ির দেশ সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিদাদা, নতুন বৌঠান, সুরেন-বিবি এবং তাঁর ছোটো দেবর। দেবরটির বয়স তখন বাইশ বিলেতফেরত এবং বেশ খ্যাতিমান লেখকের স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। কিন্তু তাঁর পিতৃদেব বিশেষ শংকিত তার নানা বিষয়বুদ্ধিরহিত কার্যকলাপে মেজবৌঠানকে তিনি আদেশ করেছিলেন যতো শীঘ্র সম্ভব দেবরটিকে বিবাহ দিয়ে বিষয়সংসারে লিপ্ত করার প্রয়াস করতে পিতৃদেবের আর কী দোষ? অতো বিশালমাপের ভূসম্পত্তি দেখাশোনা করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না বড়ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিভা পাগলামির সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকেন এলেমদার মেজোছেলে সরকারি চাকরি নিয়ে সুদূরবাসী সেজোপুত্র হেমেন্দ্রনাথের ব্যাপারটি একটু গোলমেলে মহর্ষি যেন তাঁকে ঠিক ভরসা করেন না বীরেন্দ্রনাথ আর সোমেন্দ্রনাথ বদ্ধ উন্মাদ আর জ্যোতিদাদা পিতামহের মতো ব্যবসায় বিশ্বাস করেন, জমিদারিতে নয় অথচ গান-বাজনা-নাটক-কবিতা ইত্যাদির ফাঁকে যে সময়টুকু বাঁচে সেটুকু দিয়ে ব্যবসা চালানোর মতো বিষয়বুদ্ধি তাঁর নেই শেষ পর্যন্ত ভরসা রবীন্দ্র কিন্তু তিনিও নির্ঝরের স্বপ্নে মশগুল এমতাবস্থায় তাঁকে বিয়ে দিয়ে সংসারী না করলে জমিদারি তো প্রায় গোল্লায় যায় অতএব সব পাতি বাঙালি বাপ-মায়ের মতো মহর্ষিও রবি' আশু বিবাহ দিতে অগ্রণী হলেন কিন্তু সেই চিরকেলে বল্লালি বালাই। একে বেম্ম তায় পিরিলি সারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কুলগৌরবের শ্রেষ্ঠতমা কন্যাটি যাঁকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে তাঁর জন্য মেজোবৌঠান হন্নে হয়ে গন্ডগ্রামের আট বছরের একটি শিশুকন্যাকে খুঁজে যাচ্ছেন কিচ্ছু চাই না, শুধু মেয়ে হলেই হলো দু'চারটি দেখেছেনও, কিন্তু এতো নীরেস রবি তো দূরের কথা, তাঁর নিজের পক্ষেও একেবারে নৈরাশ্যজনক এদিকে কলকাতায় ফেরার সময় এগিয়ে আসছে এই সময় তাঁদের দর্শন করতে আসেন জোড়াসাঁকোর সেরেস্তার একজন কনিষ্ঠ কেরানি বেণীমাধব রায় তিনি তাঁর বয়স্থা কন্যাটিকে (বয়স নয় বছর)পাত্রস্থ না করতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে লম্বা ছুটি নিয়েছেন একটা হেস্তনেস্ত করেই ফিরবেন এবার করজোড়ে, বিগলিত বিনয়ে তিনি কর্তাদের আমন্ত্রণ করলেন তাঁর গৃহে একবার পদধূলি দিতে জানেন না কর্তারা আদৌ রাজি হবেন কি না জ্যোতিদাদা বললেন, বেশ যাবো একবার পরদিন সবাই মিলে গেলেন বেণীমাধবের গৃহে বেণীমাধব কীভাবে আপ্যায়ন করবেন ভেবে পান না কন্যা ভবীর উপর ভার দিয়েছেন অতিথিদের মিষ্টান্ন পরিবেশন করতে সেই শ্যামলী নয় বছরের বালিকাটির অবস্থাও তথৈবচ এতোজন রাজাগজাকে কীভাবে আদর করতে হবে সে কিছুই জানে না যাইহোক মেজোবৌঠান ভবীকে দেখে তাঁর স্কন্ধলগ্ন ভারটি থেকে মুক্ত হবার একটা উপায় খুঁজে পেলেন জ্যোতিদাদা একটু আপত্তি করেছিলেন কারণ তাঁর স্ত্রীও ঠাকুরবাড়ির মিষ্টান্নপরীক্ষকের (কিঞ্চিৎ সম্মানিত পরিচারকই বলা যায়) পৌত্রী

আন্না তরখড়, স্কটবোনেদের সঙ্গ করে আসা রবি কিছুতেই রাজি নয় শেষে মহর্ষি তাঁকে মুসৌরিতে ডেকে পাঠালেন সোজা ভেটো, তোমাকে মেয়েকেই বিবাহ করে বিষয়কর্মে মনোসংযোগ করতে হবে ওসব গানবাজনা, গদ্যপদ্য অনেক হয়েছে কত্তাবাবার ইচ্ছাই আইন সেই ভবী ওরফে ভবতারিণী একটি 'কাপড়ের পুঁটলি' রূপ নিয়ে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী হয়ে জোড়াসাঁকোতে পদার্পণ করলেন আসলে বেণীমাধবের ঘরভাড়া করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সঙ্গতিও ছিলো না তাই বিবাহটিও ঠাকুরবাড়িতেই সম্পন্ন হয়েছিলো সেখান থেকে 'ভাই ছুটি' একটি ইতিহাস

----------------------------------------------------------------
'
নতুন বাড়ি' বলে তিনটি খড়ছাওয়া কুঁড়েঘরের যে আশ্রয়টি রয়েছে, সেখানে আমরা দু'জন দাঁড়িয়ে এই সব সাতপাঁচই ভাবছিলুম ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সব ছাত্র, শিক্ষক আর অন্যসব আশ্রমিকদের জন্য সারা দিনরাত কাঠের উনুনে তিনি রান্না করে যেতেন পাচক রাখার সঙ্গতি ছিলো না তখন ছেলে রথী লিখেছেন, মায়ের সম্ভবত কালাজ্বর হয়েছিলো। সারাদিন গরমে, ধোঁয়ায় পাকশাল সামলাতে সামলাতে তাঁর অত্যন্ত স্বাস্থ্যহানি হয়েছিলো। রোগের ধকল আর সামলাতে পারেননি এই নতুনবাড়িটি (বস্তুত নিতান্ত মাটির কুঁড়েঘর) তৈরি করা হয়েছিলো তাঁর জন্যই রোগমুক্তির পর যখন তিনি শান্তিনিকেতনে ফিরে আসবেন, তখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাতে একটু শান্তিতে থাকতে পারেন সেই ফিরে আসা আর হয়নি ছোটোবৌয়ের 'নতুন'বাড়ি তাঁর জন্য নতুনই থেকে গেছে দুদিকে এককামরার দু'টি ঘর আর মাঝখানের একচিলতে উঠোনের  পিছনে আরেকটি মাটির ঘর প্রিন্স দ্বারকানাথের পৌত্রবধূর না-দেখা আশ্রয় ঠিক তার পাশেই বেশ বড়ো দেহলি বাড়ি কবি সেখানে থেকেছেন বহুদিন দেহলি বাড়ির সামনেই তো মুজতবা আলিসাহেবের মরাঠি বন্ধু ভান্ডারে, কবিকে দরবেশ ভেবে জোর করে পুরো অঠন্নি বকশিস দিয়ে এসেছিলো দেহলি বাড়িতে এখন একেবারে ছোটোদের জন্য চলে আনন্দ পাঠশালা, সুন্দর বাগান দিয়ে ঘেরা।
--------------------------------------------------------

খড়ে ছাওয়া আরেকটি বড়ো মাটির বাড়ি রয়েছে চৈতীর সামনে, পাঠভবনের দিকে যেতে নাম বেণুকুঞ্জ বিয়ের পর রথীন্দ্রনাথ সেখানে কিছুদিন প্রতিমাদেবীর সঙ্গে বাস করেছিলেন পরবর্তীকালে পন্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী, দীনবন্ধু এন্ড্রুজও থেকেছেন সেই বাড়িতে। তার ঠিক পাশেই রয়েছে, যে মানুষটির দৌলতে আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে পেয়েছি, সেই দিনেন্দ্রনাথের দোতলা বাড়ি 'দিনান্তিকা' এই বাড়িটির স্থাপত্য ষড়ভুজ দেওয়ালের কাজ দিনের শেষে শান্তিনিকেতনের সব অধ্যাপকদের চা-চক্র বসতো এই বাড়িটির বারান্দায় কে আসতেন না সেখানে ? সেখান থেকে দক্ষিণে পাঠভবনের দিকে একটু এগোলেই ডানদিকে একটি খোলা জায়গা সেটিই বিখ্যাত গৌরপ্রাঙ্গন আশ্রমের আদিযুগের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষ মশায়ের নামে এখানেই আশ্রমের ছেলেরা খেলাধুলো করতো প্রথম যুগে মাঠের পাশেই জমকালো রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিংহসদন কবির বন্ধু রায়পুরের জমিদার লর্ড শ্রীনাথ সিংহের অর্থানুকূল্যে তৈরি হওয়া একটি প্রাসাদ সেখানের সভাগৃহটিতে মহাজনসম্মিলন হয়েছে অসংখ্যবার ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন এই বাড়িটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেই উপলক্ষ্যে তাঁরা সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ডি লিট উপাধি দিয়েছিলেন কবিকে। তাঁদের পক্ষ থেকে এসেছিলেন সার মরিস গয়্যার এবং সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই ভবনটির দুদিকে আছে পূর্বতোরণ আর পশ্চিমতোরণ তিনটি হর্ম্যের সামগ্রিক স্থাপত্য নতুনধরনের ইন্দো-ইস্লামিক পদ্ধতির শান্তিনিকেতনে ভারতীয় স্থাপত্যের নানা  রূপ নিয়ে যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিলো, সিংহসদন চত্বরেই তার সূচনা সিংহসদনের ঘন্টাঘর থেকেই শান্তিনিকেতনের সময় বাঁধা হয়

ঘন্টা বাজে দূরে ...
---------------------------
যারা বিহান-বেলায় গান এনেছিলো...
----------------------------------------------------


সীমান্তপল্লীর পর মাঝিপাড়া সেখানে থাকেন তল্লাটের আদি অধিবাসী সাঁওতালেরা কৌম সমাজের কিছু নিয়ম আছে যা উপর ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থার প্রভাব বিশেষ পড়েনি বিকেল থেকে সাঁঝগড়ানো আলোয় হাঁটছিলুম বাগানপাড়ার দিকে মোড়ে একটি ছোট্টো ঠ্যালাগাড়িছাপ তেলেভাজার দোকান আমাদের দেশের ভাষায় গুমটি। সামনে ভিড় মন্দ নয় কড়াইতে টগবগ করছে বাঙালির পাপের ভরা উঁকি দিয়ে দেখি সাঁওতাল একটি মেয়ে, বড়োজোর বিশবাইশ, সেই কর্ত্রী দু'হাতে কাটাকুটি, ভাজাভুজি করে যাচ্ছে, সঙ্গে দোকানদারিও যাঁরা বাঙালি খদ্দের, তাঁদের সঙ্গে পরিষ্কার বাংলায় কথাবাত্তাও চলছে জায়গাটা তো আদত গ্রাম, সব্বাই সব্বাইকে চেনে, হয়তো একটু বেশিই চেনে তাঁদেরকে বিদায় করে আমার দিকে সপ্রশ্নচোখে তাকায় নতুন চেহারা, আগে দেখেনি তো দেখি একদিকে বেগুন ফালি করে রাখা আছে প্রশ্ন করি, বেগনি ভাজবে নাকি? কতোদিন বাইরে এসব কুখাদ্য খাইনি। সুনীলের ভাষায় প্রবাসে সকলই চলে মেয়েটি বলে, দাঁড়াও, এদেরকে ভাগিয়ে তোমায় দিচ্ছি দেখি তিনচারটি ছোকরা, বাইকে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে মেয়েটি তার বারকোশ থেকে বেশ কয়েকটা ঠোঙা বের করে ছেলেগুলোকে ডাকলো ওরা সাঁওতালিতে কথা বলছিলো, আমি বুঝতে পারছিলুম ছেলেগুলো সন্ধের ঝোঁকে নেশা করবে বলে তেলেভাজা কিনতে এসেছে মেয়েটি ওদের ঠোঙা সরবরাহ করতে করতে দেখলুম বকাবকি করছে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর মতো বিষয়, মদ্যপানের কুফল ছেলেগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ছে, যেন এর থেকে বেশি মজার কথা আর কখনও শোনেনি তার পর মেয়েটি আমার জন্য বেগনি ভাজতে ভাজতে বললো, বলো , মদ কতো সব্বোনাশ করে ! আমি বলি, ঠিক সে আবার বলে, মানুষ নেশা  করলে জন্তু হয়ে যায় আমি আবার বলি, ঠিক। তার পর সে বলে যায়, আমি শুনে যাই মনে পড়ে যায় আমার সিংভূমে দীর্ঘদিন ধরে দেখা আদিবাসী পুরুষদের হাঁড়িয়া থেকে মৌয়া, মৌয়া থেকে চোলাই, তারপর পঞ্চাশ ফুরোবার আগেই ফুড়ুৎ হয়ে যাওয়া সেই সব অরণ্যপ্রান্তরের কেতা শান্তিনিকেতনেও ? পরে শুনলুম এখানেও বহু আদিবাসী পুরুষ ইশ্কুলে লেখাপড়া শেষ করেন বোঝা যায় তারা ধলভূম, কোলহানের ভাইবন্ধুদের থেকে অনেক বেশি আলোকপ্রাপ্ত কিন্তু রক্তের বীজকে উপড়াতে পারেননি। তাঁদের গ্রামকে ঘিরে ফেলেছে বাঙালি মধ্যবিত্তদের মধ্যে সম্ভবত শ্রেষ্ঠ, রুচিশীল, স্বচ্ছল গোষ্ঠীর একটা বড়ো অংশ তাঁদের সঙ্গে নিত্য বিনিময়, তবু অন্ধকারের শক্তি কী ব্যাপক।

পরে শুনলুম মেয়েটিকে নিত্য তার নেশাড়ু স্বামী মারধোর করে আবার ইভনিং শো'তে বাইকে করে সিনিমা দেখাতেও নিয়ে যায়
------------------------------------------------------------
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে
-------------------------------------------------------------

বহুদিন আগে একটা পদ্য লিখেছিলুম, তার প্রথম লাইনটা, "কোনোদিন নদী বয়েছিলো, আজও তার টায়ারের দাগ রয়ে গেছে " উপলক্ষ্যটি ছিলো প্রথম খোয়াই দেখার অভিজ্ঞতা সুরুল থেকে সিউড়ির রাস্তায় একটু এগিয়েই বাঁদিকে মোচড় মেরে বিনুরিয়া খালের পাশে পাশে যে লালমাটির রাস্তাটি এগিয়ে গেছে সোজা পশ্চিমে, সোনাঝুরি নামের প্রান্তরটি তার ডানদিকে অবিন্যস্ত শুয়ে থাকে মৃদু লাল, মধ্য লাল, মেদুর লাল, লালিম আভায় ঘোর ধুলোট মৃত্তিকা, জ্বরতপ্ত প্রেমিকের মতো শুয়ে প্রেয়সী জলধারা এখন শীর্ণ আকালষোড়শী , কোনও শুশ্রূষা এনে দেয় না আর মেঘের কাছে অনিবার্য ফিরে গেছে সে, অন্তরীক্ষের কাছে শুধু দুজনের নখর আশ্লেষের দাগ আঁকাবাঁকা খোয়াই জন্ম নিয়ে অপেক্ষা করে আছে হে মেঘমদির শবরী, এই সব ক্ষতচিহ্নে ভিজে আঙুল বুলিয়ে দিও  একদিন, তার বেশি কোনও প্রত্যাশা নেই তার

সোনাঝুরির খোয়াই পর্যটকদের অবশ্য দর্শনীয় আদি সোনাঝুরি গাছগুলি সংখ্যালঘু এখন সামাজিক বনায়নের দৌলতে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে ইউক্যালিপ্টাস বৃক্ষ মাঝখানের সমতল ধুলোর আঙিনায় প্রতি শনিবার বসে খোয়াইয়ের হাট 'শান্তিনিকেতনী' ব্র্যান্ডের হাতের কাজের ভালো নিদর্শন লভ্য এখানে বাণিজ্যও মনে হয় আশানুরূপ বিশেষত বছরের যেসময়টায় শীত-রুখু বাতাস বয়ে যায় চরাচরে। বাঙালির দেশভ্রমণের খোঁয়ারি মিটতে চায় না। বাউলব্র্যান্ড রঙচঙে সাজানো মোটিফসেলাই জোব্বাও পাওয়া যায় এখানে একতারা, দোতারা হাতে দাড়ির আড়ালে উৎসুক ওষ্ঠের গানও শোনা যায় কেউ কেউ ভালো- গা', কিন্তু আসল বাউল-ফকিরদের দেখিনি এখানে যে পথটি বেয়ে এইখানে পৌঁছোতে হয়, সেই পথটিই আমার কাছে মনে হয় কবির কাছে নিয়ে যাবে আমায় চোখজুড়োনো দৃশ্যছবি আমাদের রাঢ় বাংলার আনাচেকানাচে দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু, এই পথটি এক অন্য জন্মের ঝরনাতলার নির্জন মনে হয় মুখবইতে ছবি দেখে সামরান লিখেছিলেন, এক অসম্ভব পথ সত্যিই, পথে হেঁটে , ধুলো মেখে, স্বেদসিক্ত হয়ে ফিরে আসার পরেও মনে হয় পথটি নিখুঁত জাদুবাস্তবের পরিভাষা প্রবলভাবে আছে, কিন্তু নেই হয়ে
---------------------------------------------------------------



সেই ধুলোডাঙ্গাটির একপাশে খোয়াইয়ের হারিয়ে যাওয়া জলধারার খাদ, জলের মতো- এঁকেবেঁকে কোথাও চলেছে যাঁরা কলোরাডো দেখেছেন, এই আয়োজন তাঁদের জন্য নয় আমার দেখা বাংলায় আর একটি জায়গাতেই এই দৃশ্যের জন্ম দেখা যায়, অনেক ব্যাপক, বিস্তৃত নির্মাণ তা গড়বেতার কাছে গনগনির মাঠে দীর্ঘ ঘোর সবুজ কাজুবনের আঁচল সরিয়ে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় লালপাড় নদীর সীমন্তরেখা শিলাবতী নদীর শুকনো সোঁতা, লালমাটির শিরা-উপশিরা ছিন্নভিন্ন করে, শিহর জাগিয়ে নিশ্চল অপেক্ষায় রয়েছে সেখানে নিচের দিকে উঁকি দিলে একটু শিরশির করে ওঠে অনুভূতিগুলি।

আমাদের গ্র্যান্ড নয়, পাতি ক্যানিয়ন বাঙালি মেয়েদের মতো কৃশা, লঘুত্তমা,  কিন্তু অমোঘ আর্তি জড়িয়ে থাকে তাদের সারা গা' কচি সবুজ আঁচল জড়ানো শিশিরচিকন কলাগাছের মতো মসৃণ, সর্বতো নারীর মতো

সোনাঝুরির খোয়াই সেই বন্যতাকে ধরতে পারে না সে মেঘদেবতার হেলায় রিক্তা অম্বালিকার দোসর

(ক্রমশ)