কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৪৩


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে আজকের প্রজন্ম যেসব অভূতপূর্ব সুযোগ ও সুবিধে  অনায়াসে আয়ত্ত্ব করে তার ব্যবহার করতে পারছে, আমাদের কৈশোর, প্রথম যৌবন, এমনকি উত্তর যৌবনেও তা ছিল না সেই সময় আমদের অনেক কিছুই ছিল নাযেমন টিভি ছিল না, ডিভিডি ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, কমপিউটার ছিল না এবং আরও অনেক অনেক কিছুই ছিল না তবে রেডিও ছিল, তাতেই আমরা খবর শুনতাম, গান শুনতাম, নাটক শুনতাম, খেলার ধারা বিবরণী শুনতাম দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য চিঠি লিখতাম সিনেমা দেখার জন্য যেতাম সিনেমাহলে, খেলা দেখার জন্য মাঠে ময়দানে  বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের গান শোনার সুযোগ ঘটত বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আয়োজিত জলসায় আর ঘরে গ্রামাফোনেরেকর্ডবাজিয়ে প্রিয় শিল্পীদের গান শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে থাকতাম আমাদের মধ্যে যাদের সাহিত্যচর্চার উৎসাহ ছিল, নিজেদের তাগিদেই বিভিন্ন লেখকের বই সংগ্রহ করে পড়তাম, সাহিত্যের আড্ডায় ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতাম, নিজস্ব লেখার তাগিদে লিখতাম। কিছু একটা লিখলেই লেখাটা অন্যকে পড়ে শোনানোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম, আর প্রকাশ করার উপযুক্ত হয়েছে মনে করলে পাঠিয়ে দিতাম বিভিন্ন মুদ্রিত পত্র পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে। এবার অপেক্ষা, শুধুই অপেক্ষা, কবে আসবে সেই লেখাটির মনোনয়ন অথবা অমনোনয়ন সংবাদ। অমনোনীত হলে ভীষণ মনখারাপ, আর মনোনীত হলে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম ও লেখাটি দেখার জন্য আকুলতা। আজকের  কাছে অবশ্য এসবই নেহা ৎই অকল্পনীয় ব্যাপার-স্যাপার। যদিও একথা ঠিক যে, এখনও  কোনো মুদ্রিত বা অনলাইন পত্রিকায় লেখা প্রকাশের জন্য  ‘সম্পাদক’ জাতীয় এক ধরনের জীবের ভালোলাগা বা না লাগার জন্য লেখককে হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়; বিশেষত সেই ‘সম্পাদক’ জাতীয় জীবটির আদৌ কোনো বিচারযোগ্যতা আছে কিনা, এই ভাবনাটাও সমানেই মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়। কিন্তু  শুরুতেই যে কথাটা বলেছিলাম, আজকের উন্নততর প্রযুক্তির কারণে বর্তমান প্রজন্ম এই  সমস্যা  ও পরমুখাপেক্ষিতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছেনকেননা এখন মুদ্রণব্যবস্থা এতটাই সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে, যে কোনো সাহিত্যযশঃপ্রার্থী কোনো পত্র পত্রিকায় লেখা পাঠানোর ঝামেলায় না গিয়ে নিজেই একটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা যথেচ্ছ প্রকাশ করতে সক্ষম হচ্ছেন। আবার আন্তর্জালের ব্যাপক সুবিধের ফলে নিজেরাই অনলাইন পত্রিকা ‘লঞ্চ’ করে নিজেদের লেখা ‘আপলোড’ করে দিতে পারছেন।  আবার যারা প্রযুক্তির এত সুযোগ সুবিধে থাকা সত্ত্বে নিজেরা ঝাড়া হাত-পা থাকতে চান, তাঁদের জন্যও সাজানোই আছে ‘রেডিমেড’ ব্যবস্থা। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়,  যেমন  ফেসবুক,  নিজের ‘ওয়ালে’ নিজের লেখা অনায়াসে পোস্ট করা যায়, যা সেই মিডিয়ার বন্ধুদের কাছে সহজেই পৌঁছে যায়। লেখা মনোনয়নের জন্য কোনো সম্পাদকীয় বাধাও থাকে না। আগ্রহী বন্ধুরা সেই লেখা পড়ে তাঁদের অভিমত  জানান বা জানানো প্রয়োজন মনে করেন না। সে যাইহোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে, এখন একান্তে কিছু লেখার পর তা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখার কোনো জোরালো  যুক্তি নেই;  বিশেষত লেখক স্বয়ং যদি মনে করেন তা পাতে দেবার যোগ্য, তা তিনি দিতেই পারেন। যারা পাত পেতে বসে আছেন তারা নিজেদের রুচি অনুযায়ী তা গ্রহণ করতে পারেন, সমালোচনা করতে পারেন, এমনকি প্রয়োজন মনে করলে  কিছু আলোকপাতও করতে পারেন। এবং এই দৃষ্টিকোণে ব্যাপারটা ভেবে দেখলে একথা বলা যেতেই পারে যে, সাহিত্যের ক্ষেত্র এখন আগের থেকে ব্যাপক হয়েছে এবং লেখক ও পাঠক সরাসরি একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পারস্পরিক মত বিনিময় করতে  পারছেন। এবং এটা নিঃসন্দেহে সম্ভব হয়েছে আজকের উন্নততর প্রযুক্তির কল্যাণে। কালিমাটি অনলাইনব্লগজিন সবাইকে জানাচ্ছে সমাদর ও শুভেচ্ছা

 প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এই সংখ্যাটি প্রকাশের সঙ্গে শুরু হলো ‘কালিমাটি অনলাইন’এর পঞ্চম বর্ষে পদচারণা। আপনাদের সবার শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা একান্ত কাম্য।  

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অদ্বয় চৌধুরী

ফ্রম জেমস বন্ড, উইথ ইডিওলজি




 তৃতীয় পর্ব

দেয়ার ইজ আ ম্যান কলড বন্ড

He [Bond] exemplifies what Nietzsche extolled as a ‘fusion of a Stoic and a frivolous appearance of happiness, characteristic of noble cultures’...In Bond, as Anthony Burgess observed, the ‘gusto is controlled: the banquet of the senses is a reward for dangerous work performed on behalf of a free world.’”

              এখানে উদ্ধৃতি একটি, কিন্তু উক্তি দু’টি। প্রথমে নীৎশের উক্তি, শেষে অ্যান্টনি বার্গেস-এর। আপাতত বার্গেস-এর পর্যবেক্ষণটিকে নেওয়া যাক। জেমস বন্ড একক দক্ষতায় একা হাতে সমস্ত ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড’-এর হয়ে কিছু ‘ডেঞ্জারাস’ কাজ সমাধা করে। একটি বৃহত্তর জগতের হয়ে একা কিছু কাজ সম্পাদন করার মাধ্যমে বন্ড-এর মিথিক ইমেজ, লার্জার-দ্যান-লাইফ ইমেজ তৈরি হয়। বন্ডকে ক্রমশ শুধুমাত্র কোনো একটি দেশের নয়, বরং একটি ভাবধারার, এবং সেই ভাবধারায় বিশ্বাসী সমস্ত মানুষ, দেশ ও সভ্যতার প্রতীক ও রক্ষাকর্তার মোড়কে মুরে ফেলা হয়। ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ গল্পে শত্রুপক্ষ বন্ডের এই বৃহত্তর ইমেজকেই আক্রমণের ও ধ্বংসের বিষয়বস্তু সাব্যস্ত করে। ঠিক এখানেই, এই বিন্দুতেই, ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ হয়ে ওঠে বন্ডের সমস্ত গল্পের মধ্যে সর্বাপেক্ষা রাজনৈতিক। বুর্জোয়া ফ্রি ওয়ার্ল্ড-এর শত্রু কম্যুনিস্ট রাশিয়া বন্ডের সামাজিক সম্মান নষ্ট করে মানুষ-বন্ড নয়, বরং বন্ডের লার্জার-দ্যান-লাইফ মিথিক ইমেজকে হত্যা করতে চায়। তাদের মতে ব্রিটিশদের শক্তি লুকিয়ে আছে বিভিন্ন মিথ-এর মধ্যে:

“…the myth of Scotland Yard, of Sherlock Holmes, of the Secret Service…this myth is a hindrance which it would be good to set aside…Have they no one who is a hero to the organization? Someone who is admired and whose ignominious destruction would cause dismay? Myths are built on heroic deeds and heroic people. Have they no such men?”

অবশ্যম্ভাবীভাবে উত্তরটা হচ্ছে: “There is a man called Bond.”

ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ-এ মোট ২৮টি চ্যাপ্টার দু’টি ভাগে বিভক্ত। একটিই অক্ষরেখা, কিন্তু দু’ই প্রান্তে দুই গোষ্ঠী। তারা ধীরে ধীরে, একই কক্ষপথে, একে-অপরের দিকে অগ্রসর হয়ে রাজকীয় যুদ্ধে মিলিত হয়। প্রথম ১০টি চ্যাপ্টার— ‘দ্য প্ল্যান’— রুশদের ভয়ঙ্কর স্বভাব, ভয়ঙ্কর চিন্তা-ভাবনা ও বন্ড-বিরোধী ভয়ঙ্করতর পরিকল্পনার বিবরণ। এই অংশে খলনায়কেরা বন্ডকে ঘিরে তার দিকে অগ্রসর হয়, গোপনে, ধীরে ধীরেবিপরীত গতিপথে, দ্বিতীয় অংশে, ‘দ্য এগ্জিকিউশন’ শিরোনামের অধীনে, বন্ড রুশদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ধীরে ধীরে তাদের দিকে অগ্রসর হয়। সঙ্গম বিন্দুতে একটি রাজকীয় যুদ্ধ জন্ম নেয়। এই যুদ্ধটি ব্যক্তিগত স্তরে সংঘটিত হলেও এক মহাকাব্যিক গুরুত্ব লাভ করে বন্ডের লার্জার-দ্যান-লাইফ মিথিক ইমেজের জন্যেই।




              বন্ডের লার্জার-দ্যান-লাইফ বা মিথিক ইমেজকে ধ্বংসের রুশ পরিকল্পনাটি ইমারতি আকার পায়। কিন্তু সেই ইমারতের ভিতটি ওই লার্জার-দ্যান-লাইফ ইমেজ দিয়েই গঠিত! এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স! রুশরা ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসকে বিশ্বাস করায় যে এক রুশ মহিলা এজেন্ট বন্ডের একটি ফটোগ্রাফ দেখে তার প্রতি অপার প্রেমে ভাসমান। এখন বন্ড যদি তার প্রেম স্বীকার করে নিজে গিয়ে সেই ডুবন্ত মেয়েটিকে উদ্ধার করে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসে তবে সে KGB-এর ব্যবহার করা এক অত্যন্ত গোপন ও মূল্যবান যন্ত্র বন্ডের হাতে তুলে দেবে। স্পেক্টার যন্ত্র। যৌতুক হিসেবে দেবে। এই সমগ্র বিষয়টির মধ্যে যে অবাস্তবতা রয়েছে তা বন্ডের উপরওয়ালা ‘এম’-এর কাছে একদম সাদামাটা লাগে, স্বাভাবিক মনে হয়। তার মতে, যে সমাজ বিভিন্ন রকমের ইমেজের দ্বারাই তৈরি, এবং যেখানে বিভিন্ন রকমের ইমেজ চারিদিকে আপাত-ভাসমান, সেখানে ওই রুশ মহিলা এজেন্ট-এর এইরূপ ব্যবহার ভীষণই বাস্তব, ভীষণই ‘কমন’:

“Suppose you happened to be a film star instead of being in this particular trade. You’d get draft letters from girls all over the world stuffed with Heaven knows what sort of rot about not being able to live without you and so on. Here’s a silly girl doing a secretary’s job in Moscow…And she gets what I believe they call a “crush” on this picture [of Bond], just as secretaries all over the world get crushes on these dreadful faces in the magazines.”

এক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তি-বিশেষ হিসেবে বন্ডের কাজ হবে তার নিজের ঐ বিশেষ ইমেজের সাপেক্ষে নিজের ব্যবহারকে, এবং কার্যকলাপকেও, গতিরূপ দেওয়া। একজন ব্যক্তি থেকে একটি ইমেজে নিজেকে অনুবাদ করাই বন্ডের দায়িত্ব ও কাজ। অতএব, ‘এম’-এর আদেশ ঘোষিত হয়:

       “It is with an image she has fallen in love. Behave like that image.”

              এই জীবন্ত রক্ত-মাংস থেকে প্রাণহীন প্রতিকৃতিতে রূপান্তর, আসল থেকে নকলে পরিমার্জিত পরিবর্তনের মাধ্যমে বন্ড তার মূলবিন্দু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে এক বর্তমান-কালের চরিত্র হয়ে ওঠে— কোনো বিশেষ অতীতহীন, কোনো বিশেষ শ্রেণী-ইতিহাস বা আঞ্চলিক ইতিহাসহীন। সে এক বৃহত্তর আধারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে যে আধার বর্তমান সময়ে স্থবির, জঙ্গম। সে কোনো ‘টাইপ’ চরিত্র নয়। তার শ্রেণী-ইতিহাস তার নিজের কাছেই এক বিদ্রূপে পরিণত হয়:

“EYE AM A SCOTTISH PEASANT AND EYE WILL ALWAYS FEEL AT HOME BEING A SCOTTISH PEASANT.”

আসলে বন্ড হচ্ছে সেই ‘নতুন শ্রেণীর’ মানুষ যারা প্রকৃত অর্থে ‘শ্রেণীহীন’, অথচ তারা নিজেদের একটি প্রতিকৃতি বা ইমেজ গঠন করে এবং সেই ইমেজকেই ‘শ্রেণী’ হিসেবে কল্পনা করে বহন করে চলে নিরন্তর:

“image of affluence, fashion, modernity, and classlessness. These ‘New Aristocrats’ are creators of images.”

সেই সময়ের ইতিহাসে, বাস্তবে, অনেকেই এই ‘নব্য অভিজাত’ গোষ্ঠীভুক্ত ছিল যারা অতীত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ‘নিউ অ্যারিস্টক্রেট ইমেজ’ গঠন করে, এবং সেই ইমেজের উপর ভিত্তি করে জীবন ধারণ করত। ক্রিস্টোফার বুকার-এর চর্চার বিষয় ছিল ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর ব্রিটিশ জীবনে এই ‘নব্য অভিজাত’ ব্যক্তিগণ। এর উল্লেখ পাওয়া যায় ডেনিং-এর লেখায়:

“Booker cites pop singers (the Beatles, Mick Jagger), photographers (David Bailey), interior decorators, spy novelists (Deighton), actors (Michael Caine, Connery), and fashion designers. Though they may have come from working-class, lower-middle-class and northern backgrounds, the effect of the aristocracy of images was to efface their origins.”




              আধুনিক যুগে বুর্জোয়া শ্রেণীর দু’টি মূল দণ্ড হল উৎকর্ষ ও ক্ষমতা। বুর্জোয়া তন্ত্রের এই যমজ শিশুর ধাত্রী হিসাবে এক নতুন ডিসকোর্স নিযুক্ত হয়— ‘নিও অ্যারিস্টোক্রেটিক ডিসকোর্স’। নীৎশিয়ান হিরোয়িজম-এর অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্যই হল আদি অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে সম্পৃক্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবন-প্রণালীকে বনবাস থেকে ফিরিয়ে এনে সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ওই বিশেষ জীবন-প্রণালীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাদের উৎকর্ষ— রুচির, পঞ্চেন্দ্রিয়ের, জীবন-যাত্রার মানের। এই উৎকর্ষের প্রমাণ বন্ডের শৌখিন গাড়ি, উন্নত টেকনোলজির ব্যবহার। হাইডেগার-এর বিশ্লেষণে টেকনোলজি হল Technê একদম প্রাথমিক স্তরে। এই Technê এক একান্ত গাঁটছড়ায় আবদ্ধ হয়ে আছে Wissen বা উইসডোম-এর সাথে। এই Technê হল মানুষের উন্নত শৈল্পিক সত্তার প্রকাশক। অর্থাৎ, উৎকর্ষের দলিল। এই একই প্রেক্ষিতে বিচার করলে জেমস বন্ডের ‘এক্সকুইজিট কিউলিনারি ডিমান্ডস’-এর কারণগুলোও স্পষ্ট হয়। বন্ডের “shaken, not stirred” Dry Martinis এর মতো উৎকৃষ্ট মদের প্রতি আকর্ষণ, অথবা তার উৎকৃষ্ট প্রাতরাশ খাওয়ার অভ্যাস— সবই এই ‘নিও অ্যারিস্টোক্রেটিক ডিসকোর্স’-এর অংশ, এর প্রান্তিক ফল। ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ-এ বন্ডের প্রাতরাশের নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়:

The single egg, in the dark blue egg cup with a gold ring round the top, was boiled for three and a third minutes. . .  Then there were two thick slices of deep yellow Jersey butter and three squat glass jars containing Tiptree ‘Little Scarlet’ strawberry jam; Cooper’s Vintage Oxford marmalade and Norwegian Heather Honey from Fortnum’s. The coffee pot and the silver on the tray were Queen Anne, and the China was Minton, of the same dark blue and gold and white as the egg-cup.



বিভিন্ন টুকিটাকি সমেত এই বিলাসবহুল প্রাতরাশের বর্ণনার এক বিশেষ উদ্দেশ্য আছে: নিম্নবর্ণ এবং প্রলেতারিয়েত শ্রেণী থেকে ‘নিও অ্যারিস্টোক্র্যাট’ বন্ডের তফাৎ করা, তার উৎকর্ষ প্রমাণ করা। যদিও নীৎশে বলেছেন,

“‘predominance of suffering over pleasure’ or the opposite (hedonism): these two doctrines are already signposts to nihilism.”

কিন্তু এই ধরনের হেডোনিজম নীৎশের মানস-পুত্র প্রফেট জরাথুষ্ট্রের দাবিসনদের ফলাফল বলে মনে হয়—

“The best belongs to me and mine; and if we are not given it, we take it: the best food, the purest sky, the most robust thoughts, the fairest women!”

তবে, এক্ষেত্রে, বন্ডের হেডোনিজম ভীষণ শৃঙ্খলাবদ্ধ, সুষম। ফলে নিহিলিজম-এর সঙ্গে তার কোনো সংঘর্ষ ঘটে না। আসলে বন্ড কোনো অর্থলোভী হেডোনিস্ট নয়, বরং সে একজন পিউরিটান হেডোনিস্ট, এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে চলা হেডোনিস্ট- ‘আ পিউরিটান হেডোনিস্ট উইথ আ পারপাস’।

আলোচনার এইরকম পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই তৃতীয় পর্বের একদম শুরুর উদ্ধৃতিটিতে ফেরা যাক আবারদু’টি উক্তি আছে। দ্বিতীয় উক্তিটি নিয়ে এর আগে আলোচনা শুরু হয়েছিল। এবারে প্রথম উক্তিটি নেওয়া যাক। নীৎশে ‘উইল টু পাওয়ার’ গ্রন্থের ৪১ পৃষ্ঠায় noble cultures’-এর প্রয়োজনীয় গুণাবলীর বর্ণনা করেছেন। এই গুণাবলীর হুবহু প্রতিফলন ঘটে বন্ডের মধ্যে—


He [Bond] exemplifies what Nietzsche extolled as a ‘fusion of a Stoic and a frivolous appearance of happiness, characteristic of noble cultures’.”

তানিয়া চক্রবর্তী

সমধর্মী সমধর্মীর সবচেয়ে বড় শ্ত্রু



প্লেটো / লাইসিসি এখানে সক্রেটিস লাইসিস ও মেনেক্সেনাসের সঙ্গে বন্ধুত্বের আলোচনায় ব্রতী হয়েছেন সক্রেটিস ও মেনোক্সনাস এর এই বন্ধুত্ব বিষয়ক পদটি অনেকাংশে পড়ার পর অসফল মনে হতে পারে, কিন্তু সক্রেটিস এখানে একটি  বিষয় ঘটিয়েছেন তা হলো তিনি কিছু প্রশ্ন মনের ভেতরে জাগিয়ে তুলেছেন। তিনি প্রাথমিক ভাবেই ব্যক্তিকে তিনটি ভাগে এখানে এনেছেন ১) সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি ২) যারা জ্ঞান খোঁজেন সেই দার্শনিক ৩)  অজ্ঞ ব্যক্তি যারা নিজেদেরকে জ্ঞানীভাবে। সক্রেটিস বন্ধু হওয়ার ক্ষেত্রে সে ব্যাক্তি প্রেমিক হতে পারে, প্রেমাস্পদ হতে পারে, বা উভয় পরস্পরের বন্ধু হতে পারে। তিনি মনে করেন সমধর্মী সমধর্মীর সবচেয়ে বড় শ্ত্রু, তবে সমধর্মীকে অন্য সমধর্মী ভালোবাসতেই পারে। আসলে অন্যায়কারী এবং অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষ পরস্পরের বন্ধু হতে  পারে না। 

আর ম্নদ লোকেরা একে অপরের সঙ্গে, এমনকি নিজের সঙ্গেও ঐক্য-সম্পর্কে সম্পর্কিত নয়। কারণ তারা আবেগপ্রবণ, অস্থিরমতি। আর কোনো জিনিস যদি ভিন্নধর্মী হয়, নিজের সাথে ভিন্ন প্রকৃতির হয়, তবে কী করে তা সমধর্মী বা অন্য কিছুর বন্ধু হবে যারা বলে সমধর্মী সমধর্মীর বন্ধু, তারা বলতে চায় ভালো কেবল ভালোর মধ্যেই তার অস্তিমান থাকে। কিন্তু সক্রেটিস এর সূত্রকে নাকচ করেন পরে। কোনো মানুষ যদি ভালো হয় তবে সে সেই পরিমাণ স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকে। তাই বিপরীতধর্মীই বন্ধু হয়। কারণ প্রতিটা জিনিস সমধর্ম নয় বরং বিপরীতধর্মই কামনা করে,  যেমন ঠাণ্ডা চায় গরম, তেতো চায় মিষ্টি, পূর্ণ চায় শূন্য। কারণ বিপরীত হলো বিপরীতের খাদ্য। যা হোক, শেষ পর্যন্ত এখানে আসা হয়, যে তবে  কী ন্যায়পরায়ণ অন্যায়পরায়ণের পরম বন্ধু! তা তো নয়! তাই সক্রেটিসের মতে যা ভালোও নয় মন্দও নয় , তা ভালোর এবং কেবল ভালোরই বন্ধু হবে। এইভাবে সম্পূর্ণ বিষয়টি একটা কাউন্টার আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়ে... এবং বিষয়টি শুধু সন্দেহের উদ্দীপনা দিতে থাকে যে এর নিরসন কী, আর পাঠকের দিকে তা ছুঁড়ে দেওয়া হয়

প্লেটো ইউথিদামাসে প্লেটো অন্যান্য টীকার মতো এখানে জেতেন নি বরং তিনি সফিষ্টদের জায়গা করে দিয়েছেন তাকে পরাজিত করার বাগবিতণ্ডার এই টীকা ও সংলাপে । সংলাপটি যে কাঠামো ও বিন্যাসে গড়ে তোলা হয় তাতে সক্রেটিস সফিস্টদের পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তাদের বাগবিতণ্ডাকে তুচ্ছ ও হাস্যকর করে তোলেন। যেমন সুখের প্রত্যয় - যা থেকে সকল দর্শনের যাত্রা শুরু এবং যাকে সক্রেটিস এই সংলাপে বিতর্কহীন বলে মনে করেন। উত্তমত্বের ধারণা ও উত্তম জীবনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে ভাবি যে, ইউথিদামাস দর্শনের উদ্দীপনা-জাগানিয়া। অতএব ইউথিদামাস আসলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী সংলাপ  


তুষ্টি ভট্টাচার্য

মনের ভেতর বসত করে কয়জনা  




কখনও পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে, হয়ত অনেক কথা বলা হল কিন্তু পরে দেখলাম, সেই বন্ধুটির নাম আর কিছুতেই মনে পড়ছে না এত যে পুরনো স্মৃতি নিয়ে আলোড়ন তুললাম দুজনে, ভাল লাগায় ভরে রইলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু সেই পুরনো সঙ্গীর নাম মনে পড়ল না বলে কোথায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল আর লজ্জায় মুখ ফুটে নাম জিজ্ঞেস করতেও পারলাম না আবার হয়ত চেনা কেউ, মানে তার নাম বিলক্ষণ জানি, দেখা গেল কোনো অমুকের কথা  আমাকে বলছে, আমি সেই অমুকের মুখটা ভাবার চেষ্টা করছি, কত রকম রূপ দিচ্ছি, তবুও চেহারাটা ধরতে পারছি না হয়ত তাকে একবার দেখলেই চিনতে পারব, হয়ত তখন আবার তার নাম মনে পড়বে না... এই রকম বিভ্রান্তি নিয়ে আমি থাকি প্রায়ই অথচ অনেক পুরনো স্মৃতিই আমার মনে টাটকা ধরা পড়ে শুধু নামের ব্যাপারেই এমন হয় এও হয়ত এক ডিসঅর্ডার সে যাইহোক, নামের ফেরে আরও অনেক ক্ষেত্রেই পড়ি যেমন শিরোনাম নিয়ে আমি প্রায়শই দ্বিধায় থাকি কিছু লিখে তার শিরোনাম দেওয়াটা আমার কাছে এক মহা ঝক্কির ব্যাপার তাই সম্পাদকের হাতেই এই ঝামেলার কাজটা গছিয়ে দিই মনে আছে, সেই কোনো এক কালে বই করার সময়েও নাম দিতে পারি নি নামে আসলে কিছু যায়  আসে না নাকি যায় আসে? কী জানি!

 নাম ভুলে যাওয়া একটি ডিসঅর্ডার অবশ্যই। একে বলে নমিনাল অ্যাফাসিয়া। আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে স্মৃতি সঞ্চয়ের জন্য তিনটে ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথমে স্মৃতি সঞ্চিত হয় সেনসরি মেমরিতে। এখানে এই স্মৃতি মাত্র তিরিশ সেকেন্ড থাকে। এরপর এরা চলে যায় শর্ট টার্ম মেমরিতে। সেখানে স্মৃতি অল্প সময় থাকে। যেন একটা ওয়েটিং রুম এই শর্ট টার্ম মেমরিটি। এরপর এরা পাকাপাকি ভাবে চলে যায় নিজেদের বাড়িতে অর্থাৎ লং টার্ম মেমরিতে। স্মৃতিভ্রংশ মানুষ যেমন নিজের বাড়ির ঠিকানা মনে করতে পারে না আর নিখোঁজ হয়ে যায়, আমাদের মস্তিষ্কের কিছু স্মৃতিও তেমনি ভাবে লং টার্ম মেমরিতে যেতে ভুলে যায়। যারা নাম ভুলে যায়, তাদের ক্ষেত্রে এটাই ঘটে। দীর্ঘদিন বাদে তারা আর পরিচিত মানুষের নাম মনে আনতে পারে না। তবে এই ডিসঅর্ডার মারাত্মক কিছু ব্যাধি না, কারণ রোগটির নামেই তার উল্লেখ রয়েছে। কমন অ্যাফাসিয়া সত্যিই কিন্তু খুব কমন।



এইসব কমন ব্যাপার স্যাপারের বাইরে অনেক অনেক আনকমন প্রশ্ন আসে কিন্তু পরীক্ষায়! তখনই আমরা যারা কমন পিপল তাদের ধাঁধা লেগে যায়। মানে ধরুন গিয়ে প্রশ্নটা হয়ত খুব শক্ত না, কিন্তু একটু পেঁচিয়ে গেছে ডানদিকে, আর বাঁদিকে  একটু বেঁকে গেছে। আর তার মাঝখানে পড়ে আমরা আকূল পাথার দেখছি চোখে। ধরাযাক একজন গুরুগম্ভীর ব্যক্তি, যাঁকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে, সম্ভ্রমের চোখে, কিছুটা ভয়ের চোখেও দেখে, তাঁকে যদি কোনোদিন বিকেলে ছাদে উঠে লেবু লজেন্স খেতে  বা কিতকিত খেলতে দেখা যায়, তাহলে নিশ্চই আমরা ধরে নেব ওঁর মাথার গন্ডগোল হয়েছে। যাঁর যেমন ব্যক্তিত্ব, তার বাইরের কাজটি তিনি যদি করে ফেলেন, আমাদের তা মানতে অসুবিধে হয়। আসলে ওই আদি, অকৃত্রিম শিশুটি সেই গম্ভীর মানুষটির মধ্যে ছিলই। হঠাৎই তার প্রকাশে আমাদের অস্বস্তি বেড়েছে। একটি  মানুষের মধ্যে অনেক সত্ত্বা থেকেই যায়। আমরা তো মিস্টার জ্যাকল অ্যান্ড হাইডের গল্প শুনেছি। বাস্তবেও কি তেমন চরিত্র নেই? অবিকল না হলেও কিছুটা কাছাকাছি? একেকটি মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক বা একাধিক চরিত্র। সেই চরিত্রগুলো যখন প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে কারুর আচার ব্যবহারে, তখনই হয় সমস্যার শুরু। সমস্যা তার না, আমাদের। আমরা তার কোন চরিত্রটি খাঁটি, তা ভাবতে গিয়ে বিভ্রান্ত হই। প্রকৃতপক্ষে এই মানুষরা এক বা একাধিক চরিত্রের মধ্যে নিজেদের মিশিয়ে দেয়। তার ফলে আমরা তাদের স্বাভাবিক বা সুস্থ মানতে পারি না। অবশ্যই এটিও একটি মেন্টাল ডিসঅর্ডার। আর একে কমন বলা যাবে না কিছুতেই। বেশ জটিল এই অসুখ। সাধারণত স্প্লিট পার্সোনালিটি নামেই এই অসুখকে আমরা চিনি। ডাক্তারি ভাষায় ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার বা ডিআইডি এই অসুখের নাম। আগে অবশ্য মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা এমপিডি বলা হত একে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছোটবেলার কোনো  আকস্মিক আঘাত থেকে এই সমস্যার সূত্রপাত হয়। কিন্তু কেমন ধরনের দেখতে  হয় এই রোগ? এই রুগীরা কি ‘পাগল’? একটু জানার চেষ্টা করি বরং...

‘কমন’ শব্দটাকে ইচ্ছে করলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যেমন এড়ানো যায় না কমন ম্যানদের, কমন প্রবলেমদের। ডিআইডির মতো বিতর্কিত এক অসুখকেও  আমরা কিছু কমন ছকে বেঁধে ফেলতে চেয়েছি। সাতটি ‘কমন’ চরিত্রর রূপ আছে এই ‘আনকমন’ ডিআইডির। 

১) ডিআইডি খুব অপ্রচলিত একটি ঘটনা, এরকম বলা হয়ে থাকে এবং মাত্র ১%  থেকে ৩% মানুষের এই রোগ হতে দেখা গেছে। কমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা স্কিজোফ্রেনিয়ার মতো অসুখের উৎপত্তি স্থল বলা যেতে পারে এই ডিআইডিকে।  যদিও রিসার্চের ফলে উঠে আসা এই তথ্য যে কতদূর সঠিক, তা নিয়ে সন্দেহর অবকাশ রয়েছে। আজ অবধি ন্যাশনাল ইন্সটিউট অফ মেন্টাল হেলথ ডিআইডি নিয়ে একটিও চিকিৎসা সংক্রান্ত রিপোর্ট লিখে উঠতে পারে নি।

২) সাধারণত টিভি বা সিনেমায় ডিআইডি আক্রান্তদের নিয়ে যেসব ঘটনা বা তথ্য পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই অতিরঞ্জিত। ডিআইডি আক্রান্তদের সঠিক রোগনির্ণয় করাটাই হল আসল সমস্যা। হতাশা, পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার , ইটিং ডিসঅর্ডার – এই ধরনের চিকিৎসার জেরে এদের সত্যিকারের ক্রাইসিসটাই অধরা থেকে যায়। এমনও দেখা গেছে এই পরিস্থিতি ধরা পড়তে প্রায় সাত বছর লেগে গেছে!

৩) এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা যে, ডিআইডি আক্রান্তদের বিভিন্ন রকম চরিত্র থাকে। বরং এদের বিভিন্ন রকমের চরিত্রের দশা (স্টেট)-র মধ্যে অবস্থান থাকে। আমাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরও যেমন বিভিন্ন রকম সত্ত্বা থাকে কিছুদূর পর্যন্ত, এরা কিন্তু এই বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে যখন অবস্থান করে, তখন এরা প্রত্যেক পর্যায়ে কি বলছে বা কি করছে, নিজেরাও মনে রাখতে পারে না। বিভিন্ন সত্ত্বায় এরা সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা ক্রিয়াকর্ম করে থাকে। যদিও খুব সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যায়, সমস্ত সত্ত্বাগুলোর মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা মিল রয়ে গেছে।



৪) সমালোচকরা বলেন যে ডিআইডির রুগীদের চিকিৎসা করলে নাকি আরও মুশকিল! অবশ্য এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায়, থেরাপিস্টরা ভুল বা পুরনো ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেন। যদিও  ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি অফ ট্রমা অ্যান্ড ডিসোসিয়েশন তাদের নিজস্ব হোমপেজে এই চিকিৎসার সম্পূর্ণ গাইডলাইন দিয়েছে।

৫) থেরাপিস্টরা প্রায়শই এই রুগীদের বিভিন্ন মানসিক দশার মধ্যে সমন্বয় রাখার চেষ্টা করেন। তাঁরা রুগীদের শেখান কীভাবে তাদের অনুভূতি, উদ্দীপনা, স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এটা অবশ্যই জরুরী, কারণ কখনও কখনও দেখা যায় রুগীরা নিজের নিজস্ব দশাকে অতিক্রম করে তীব্র কোনো স্মৃতি যেমন ভয় বা রাগ  ইত্যাদির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। রুগীদের বিভিন্ন মানসিক দশাকে একত্রিত করে দেওয়াই একজন অভিজ্ঞ থেরাপিস্টের কাজ, যা অনেক সময় সাপেক্ষ। এভাবেই একদিন দেখা যায়, সেই রুগীর বিভিন্ন মানসিক দশাগুলো আবছা হতে থাকছে আর নিজস্ব মানসিক দশাকে সম্পূর্ণ মুছে না দিয়েই সে তার তীব্র অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে।  
৬) ব্রেন স্টাডি থেকে জানা গেছে, হাই ডিসোসেটিভ আর লো ডিসোসেটিভদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকর্ম পৃথক পৃথক। হাই ডিসোসেটিভরা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সাড়া দেয়। কারণ এদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ অধিক সক্রিয় থাকে।  
৭) অনেকে বলেন হিপনোসিসের মাধ্যমে নাকি এই ধরনের রুগীরা তাদের ‘খারাপ’  স্মৃতিগুলো থেকে বেরোতে পারবেন। কিন্তু রিসার্চ বলছে, অভিজ্ঞ থেরাপিস্টরা কখনই হিপনোসিস ব্যবহার করেন না। কারণ পূর্বের মারাত্মক স্মৃতি খুঁড়ে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব না। একমাত্র প্রচণ্ড উত্তেজনা বা উদ্বেগ কাটাতে হিপনোসিস ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায়, সেলফ হিপনোসিস বা অটো হিপনোসিস কিন্তু মানসিক স্থৈর্য আনতে থেরাপিস্টরা রুগীদের শিখিয়ে দেন। এই পদ্ধতিতে ওঁরা রুগীদের একটা নির্দিষ্ট শব্দ বা শব্দ-বন্ধ বারবার আউড়ে যান যার ফলে রুগী ক্রমশ শান্ত হতে থাকেন। এরপর সেই রুগী যখন ওই শব্দ-বন্ধকে নিজের আয়ত্ত্বে এনে ফেলেন, তখন তিনি নিজেই ওই শব্দ-বন্ধের দ্বারা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হয়ে যান। একেই বলা হয় অটোহিপনোসিস। ধ্যানেও কাজ হয় অনেকসময়।  


 সাধারণত ডিআইডি আক্রান্তদের মধ্যে এক অসীম শূন্যতার বোধ কাজ করে। সে ভাবতে থাকে - সে একা, তাকে সবাই কোনো না কো্নো কারণে বঞ্চিত করে চলে  গেছে, সময় নিয়েও এদের ভয়ানক ক্রাইসিস তৈরি হয়। একটা ‘টাইম গ্যাপ’-এর মধ্যে এরা থাকে। বিভিন্ন রকম অসুখের কল্পনা করে, কখনও বলে জ্বর হয়েছে, কখনও বলে পেটব্যথা বা মাথাব্যথা। আবার দেখা গেল সেই রুগী নিজেকে প্রচন্ড রকম মদ্যপ ভেবে নিচ্ছে, তার জন্য হ্যাং ওভারেও আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ সে হয়ত মাঝেমাঝে নেশা করে বাস্তবে। এই রকম নানাধরনের খুঁটিনাটি নিয়ে নিজেকে ও  তার আশেপাশের মানুষদের সে ব্যস্ত রাখতে ভালবাসে, অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের একটা চেষ্টা সব সময়ে তার মধ্যে সক্রিয় থাকে। আরও একটা কথা বাদ গেল, অতিরিক্ত হতাশার কারণ জনিত শূন্যতাবোধ থেকে এরা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ে। যার ফল হয় মারাত্মক।

থেরাপির বাইরে যে কোনো ধরনের মনোরোগীর সব থেকে বেশি প্রয়োজন তার পাশের মানুষটির সহানুভূতি, সঙ্গ ও ভালবাসা। আর হ্যাঁ, অবশ্যই ধৈর্য। কমবেশি  পাগল আমাদের প্রত্যেকের মনেই বাস করে। প্রকাশের বিভিন্নতা দিয়ে আমরা কে সুস্থ আর কে অসুস্থ, তার বিচার করি, এই যা। মনে রাখতে হবে এটিও একটি অসুখ মাত্র। এর ওষুধ আছে আমাদেরই কাছে। একটু মনের ছোঁয়া আর একটু যত্ন, একটু স্নেহই এই ধরনের অসুখকে অনেকটা কমিয়ে দিতে পারে। আমরাও একটু  চেষ্টা করে দেখি না এবার!    


রোখশানা রফিক

শিক্ষানীতি প্রণয়নে প্রয়োজনীয়তাঃ ধর্মীয় সচেতনতা নাকি বিজ্ঞান মনস্কতা?

বাংলায় বহু পুরনো একটি প্রবাদ বাক্য আছে এরকম, “জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর  চীনদেশ পর্যন্ত যাও।” -- মহাপ্রাচীর পরিবেষ্টিত দূর্লঙ্ঘ্য চীন পর্যন্ত জ্ঞানতাপস বিদ্যার্থীদের যাওয়ার যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তা কি ধর্মভিত্তিক শিক্ষালাভের  জন্য? নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব নব সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা অর্জনের জন্য?

আসুন, প্রবাদটির অন্তর্নিহিত বক্তব্যের দিকে একটু মনোযোগী হই। সোশালিষ্ট পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না মানে সমাজ-প্রজাতন্ত্রী  গণচীনের অধিবাসী চীনা বংশোদ্ভুতরা কি পৃথিবীর সবকটি প্রধান প্রধান ধর্মের ধারক বাহক? -- না, তা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মহামতি বুদ্ধের বা কনফুসিয়াসের অনুসারী। তাহলে প্রতীকি অর্থে সে দেশের কথা বলা হলেও, আসলে কি এরকম কোনো স্থানেই ধর্মভিত্তিক শিক্ষালাভের জন্য যাওয়া আদৌ ফলপ্রসু হবে কারো জন্য?

বেছে বেছে এই বিশেষ প্রবাদটিকেই ব্যবচ্ছেদ করলাম এজন্য যে, বহু প্রাচীন কাল থেকেই শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানাবিধ শাখা-প্রশাখা চর্চার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়ে আসছে। সেক্ষেত্রে এই একবিংশ শতকের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা মূলতঃ ধর্মের ছায়ারূপ থেকে শিক্ষালাভ করবে -- এই ধরনের চিন্তার সূচনাই একটি ভিত্তিহীন বাহুল্য প্রসঙ্গ মাত্র।

ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইহুদী, জৈন, পার্সী, জরস্থ্রুশীয়, বাহাই -- এগুলো মোটামুটি এখনকার বিশ্বে প্রচলিত প্রধানতম ধর্ম। যাদের অধিকাংশের উদ্ভব বহু শতক বছর আগে এবং এসব ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থগুলোও সেই পুরনো সময়েই রচিত। বেশির ভাগই ঐশীবাণী হওয়ায় কালের সাথে তা সংশোধন বা পরিমার্জনের কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু মানব সভ্যতা এক জায়গার দাঁড়য়ে নেই।  এখন প্রশ্ন, কালের বিবর্তনে পৃথিবীর বুকে সভ্যতার যে বিকাশ বা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষালাভ না করলে, আদৌ কি সেই শিক্ষা বাস্তবমুখী হবে? অথবা বিদ্যার্থীদের বা সমাজের কোনো কাজে আসবে?

একটি ঘটনার উল্লেখ করি, ইসলাম ধর্মের অনুসারীগণ অনেকেই এই সংবাদ পাঠ  করে চমৎকৃত হয়েছিলেন যে, নাসার বিজ্ঞানী সুনীতা উইলিয়ামস চন্দ্র পরিভ্রমণে  গিয়ে মহানবী( সাঃ) কর্তৃক অঙ্গুলী ইশারায় চন্দ্র পৃষ্ঠকে দ্বিখন্ডিত করার চিহ্ন এখনো বিদ্যমান দেখতে পেয়ে, খ্রীষ্টান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছেন। (সংবাদের সত্য / মিথ্যা আমার জানা নেই।) ধরে নিলাম ঘটনা সত্যি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু, হে মুসলিম উম্মাহ, চাঁদ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য, আগে সুনীতাকে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত রকেটযানে চড়তে হয়েছে, সে কথাও মনে রাখতে হবে আমাদের।

আরো বিপত্তি, মনুষ্যকুলের যে ক্রমবর্ধমান অংশ এথিষ্ট বা নাস্তিক, আরেক কথায় কোনো প্রচলিত ধর্মেরই অনুসারী নয়, অপ্রচলিত ধর্মেরও নয়, আরেক কথায় তারা অনেক সময় হিউম্যানিষ্ট... সেই সব মানুষেরা কি তাহলে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক  শিক্ষাকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকবে? নাকি নিজেদের জন্য ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করবে? সেটা কি সম্ভবপর হবে?

চিকিৎসা এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের প্রার্থনা কেন্দ্র সমূহ, মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা-মঠ সব স্থাপনাগুলোই কিন্তু আগে স্থাপত্যনীতি শিক্ষালাভ করে,  তবে বানাতে হয়েছে ওগুলোর নির্মাতাদের। এবার আসি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার বিষয়বস্তু নিয়ে। ধর্ম হচ্ছে মূলতঃ বিশ্বাসকেন্দ্রিক জীবনাচরণ। প্রায় সব ধর্মেরই প্রতিপাদ্য  বিষয় হচ্ছে, কী উপায়ে সৎ পন্থায় জীবনাচরণ করলে ইহলৌ্কিক এবং  পারলৌকিক মোক্ষধামে শান্তিলাভ করা সম্ভবঅপরপক্ষে, বিদ্যাশিক্ষার দ্বারা মূলতঃ মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান বা ধারণা লাভ করে একটি বিশ্বাসে বা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া পরস্পরের থেকে একেবারে  ভিন্ন, তা একসাথে মিলিয়ে ফেলা যাবে কোন যুক্তিতে বলুন? সেক্ষেত্রে, এই দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্বে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ধীরে ধীরে ডালপালা মেলে আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে, তা থেকে কি বিরত থাকা সম্ভব আজকের আধুনিক মানুষের পক্ষে?

আরো গুরুতর সমস্যা, শিক্ষাব্যবস্থা যদি ধর্মীয় রীতিতেই ঢেলে সাজাতে হয়, তাহলে এতগুলো প্রচলিত ধর্মের মধ্যে কোনটির রীতিনীতিকে প্রাধান্য দেয়া হবে? কোনো দেশের জনসংখ্যার ধর্মভিত্তিক সংখ্যা গরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে ও যদি  সেদেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়, তাহলে সংখ্যা লঘিষ্ঠরা কি শিক্ষাগ্রহ থেকে  বিরত থাকবে? নাকি আলাদা আলাদা ধর্মানুসারীদের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হবে?... অত্যন্ত জটিল আবহ নয় কি?

শাস্ত্র, গণিত, স্থাপত্যবিদ্যা, চারুকলা, ভাষাতত্ত্ব, নৃ-বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, ভূগোল... বিদ্যাশিক্ষার এরকম নানা বিষয়ের কোনটি মূলতঃ ধর্মীয় চিন্তাধারা থেকে রচিত? উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চিকিৎসা শাস্ত্রে যত শত রোগের নাম ও প্রতিকার শিক্ষালাভ করা যায় বা শল্যবিদ্যার কোনো কৌশল, কোনটাই কি মূলতঃ কোনো ধর্মীয় দৃষ্টিকো থেকে জানা সম্ভব?

উপসংহারে বলতে চাই, ধর্ম মূলতঃ একটি বিশ্বাস, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বংশ পরম্পরায় অনুসারিত, আবার কখনো তা অন্ধ বিশ্বাসেরও নামান্তরমাত্র, তা মেনে চলা হয় অতীতের জ্ঞান বা বাণী অনুসরণ করে। অপরপক্ষে বিদ্যাশিক্ষা (বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা)  শিক্ষক-ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে একটি  নিরন্তর অনুশীলন বা চর্চার ফলশ্রুতি; বলা যায়, বর্তমানের ধারক বাহক। এই দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়াকে একত্রে জারিত করার মতো কোনো জারক রস আমার জানা নেই, যদিও দুটোরই উদ্দেশ্য মানুষকে পরিশীলিত করা। তবুও এমন কোনো দ্রাবকের সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, যা দ্বারা এই দুইটি বিষয়কে একত্রে দ্রবীভূত করা যায়সে চেষ্টা করতে গেলে, মিঠা স্বাদের শরবত না হয়ে, বরং তালেগোলে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাওয়ারই সম্ভাবনা প্রবল।

তাই এরকম একটি অবান্তর ব্যবস্থার চকিত চিন্তাও যদি কারো স্বপ্নমানসে উদিত হয় বা কোনো অতি ঊর্বর মস্তিষ্কে  এর বীজ অংকুরিত হয়, তবে যুক্তি-বুদ্ধির শানিত কুঠারাঘাতে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে, এ ধরনের উদ্ভ্রান্ত চিন্তার মর্মমূল, বিষবৃক্ষের শেকড় খুব বেশি গভীরে প্রোথিত হওয়ার আগেই।


জিনাত রেহেনা ইসলাম

মেয়েখেলা  (পর্ব - ১০)




দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়েআসছে ভেঙ্গে যাচ্ছে শ্বাসের একেকটি দৈর্ঘ্য মৃত্যু টানছে দুর্নিবার চোখের সামনে প্রবল সম্ভাবনময় গোলাপ বাগানটির সব ফুল একে একে ঘুমিয়ে পড়েছে তাদের বাচিঁয়ে রাখার সব প্রতিশ্রুতিই একটু একটু করে ঝরেপড়ছে আমি কথা রাখতে পারিনি প্রেম ঠকিয়ে নিয়ে গেছে অচিরেই আমার সব বিশ্বাস চেতনাl অস্তিত্ব ভালোবাসার সিংহদুয়ারে কাঁটা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেছে এক মৃত্যুপুরীতে l রুদ্ধনগরীরবন্ধ ফাটকের ঠিক পেছনে এক প্রকান্ড ধরাশায়ী জীবন ধিক ধিক করে জ্বলে আছে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত, গুলিবিদ্ধ কিন্তু পলাতক নয় জীবন এখনো সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে, রাতে তারাদের সাথে আলো বিনিময় করে শুধু ফাটকের ভারী ভারী শেকলে পিষ্ট হয় জীবনের ভারবাহী নিঃশ্বাস নিজের ক্ষত নিজেকেই লালন করতে হয়আমি করি কোথাও কোনো ঘাটতি নেই প্রতিদিন আমার মাতম মৃত্যুকে পরাস্ত করার কৌশল, নিত্য আপডেটেশনl বিশ্বের এক কিনারায় ধুলিকণা  সম চুর্ণ বিচুর্ণ অণু একমনে মরণ আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে, অন্যদিকে জনজোয়ারের গতি অব্যাহত জীবনের শাখায় শাখায় সুখ, উল্লাসে স্নানাতুর সব প্রাণ

জীবনের আনন্দ উপভোগ সেলিব্রেসনের কত না পথ খুঁজে পেয়েছে আধুনিক মানুষ শুনেছিলাম লা ভেগাসে নাকি একসময় এমন এক বিনোদমূলক অনুষ্ঠান চালু ছিল নিশানাবাজির মতো আমরা যেমন হাতে খেলনাবন্দুক নিয়ে একটা পঞ্চ লেয়ারের কেন্দ্রে গুলি ফাটিয়ে নিশানা লাগাতে থাকি সেরকম আমাদের এখানে থাকে বেলুন আর ওখানে থাকে নাকি নগ্ন নারীদেহ পয়সা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বডি পার্টের বিভিন্ন পছন্দ মতো স্থানে নিশানা লাগানো যেতে পারে এই কদর্য অনুষ্ঠান বা বিকৃতির পক্ষে স্থানীয় যুক্তিটি এমন যে ভোগের চূড়ান্ত জায়গা থেকে নিজেদের, মেয়েদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে মানে পুরুষের যৌনতা অবদমিত হচ্ছে যা  মহিলাদের পক্ষে আখেরে নাকি শুভ কমছে ধর্ষণের পরিসংখ্যানl কি আবোল  তাবোলের পৃথিবীতে আমাদের বাস! সভ্যতাও এমন করে নগ্নতার কথা বলে যায় অকপটে

চালাক বা বুদ্ধিমান সলিড পার্সোনালিটির ধারণাও বদলেছে নিজের শ্বশুরবাড়ি  স্বামীর চরিত্রের কথা সহসা যে প্রকাশ করে না তাকে আমরা বুদ্ধিমতী বলে থাকি আবার হ্যাসব্যান্ডকে তৃতীয় মেয়ের কাছ থেকে সরিয়ে এনে সংসারের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে যে নারী তাকে আমারা গর্বের সাথে সলিড পার্সোনালিটি বলে থাকি যে মেয়ে সংসার থেকে বিদ্রোহ করে বা অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে বেরিয়ে  আসে তাদের আমরা বোকা বলে থাকি মেয়েদের আইকিউ কম বলে সমাজ, মানসিকতায় এক চেনা বলয় কাজ করে তারপর আবার তাদের জন্য এমন একটি ব্যবহারিক স্কেলও থাকে এই নির্দ্ধারিত স্কেলে আমার মতো মেয়েদের সংখ্যা একটু কম সকলেই খুব গোছানো, আত্মসচেতন, নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে পারে আমার মতো সারাটা জীবন অন্যেরটা বুঝতে বোঝা বইতে কেউ তেমন আগ্রহী নয় আসলে নীট ফলটা তো শূন্যই সেখানে সেটা ক্যালকুলেট করার মতো প্রাজ্ঞ সকলেই




আমার মা এখনো কাঁদেন এই বলে যে আমি কীভাবে সারাজীবন অন্যদের দান  করে এসেছি শুরু করেন আমার নিজের পিজি হষ্টেলে ফেলা রাখা বেডিং নিয়ে যাতে মায়ের একটি সাধের কম্বলও ছিল সে এক করুণ অভিজ্ঞতা! আমি যে কম্বল ফেরৎ নিতে যায়নি এমনটা নয় গিয়ে দেখি আমার নাইটি ইনারএর আকার নিয়ে একজনের দেহে বিরাজমান কেটেকুটে তাদের নিজেরদের পচ্ছন্দমতো করে নিয়েছে আবাসিক কাম ছেড়ে আসা হষ্টেলমেট চা করার সরঞ্জাম ভাগাভাগি হয়ে গেছে তাদের মধ্যে বালিশ, বেডসিটেরও এক হাল কম্বলের উপর প্রতিষ্ঠা হয়েছে ঘরোয়া ঠাকুর আমার উপস্থিতির কারণ তাদের কাছে খুব আস্বস্তিকর তাই তাদের চাপ না  বাড়িয়ে দেখা করার ফরম্যালিটি বজায় রেখে মায়ের কম্বলসহ বেডিংএর শ্রাদ্ধ সেরে ফিরলাম তারপর অগণিত সময় জুড়ে দানপর্ব অনেকটাই মা জানেন না তাতেই এত আফসোস আমার জীবন আবার স্পেশাল মানুষে ভরা তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি কাউকে কিছু দান করলে বা ভালোবেসে দিলে তা প্রকাশ করতে নেই, তাতে দাতার মহিমা কমে যায় নিতে মহিমা বাড়ে বুঝি! যার সাথে  কোনোভাবে জুড়ে নেই তার দেওয়া জিনিস ধারণ করা খুব কঠিন শুনেছি এক বিখ্যাত বলিউড অভিনেত্রীর কাছে তার প্রাক্তন প্রেমিক তার গিফট দেওয়া ফ্ল্যাট ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা পাননি যে পুরুষ নিয়ত পয়সার জন্য প্রেমিকার কাছে হাত পাতে তাদের কী বলে আমার জানা নেই, কিন্তু পরবর্তীতে  তারা গর্ব করে বলে টাকা তো ফিরিয়ে দিয়েছিলাম! এমন চালবাজ লোকেরাও নিজেরদের প্রেমিক হিসাবে তুলে ধরতে পারে মেয়েদের সামনে!

অভিজ্ঞতায় চোখ ছেয়ে থাকে একজন পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি রাতের পর রাত মেসেজ করতে থাকে নানা অব্জেক্সনাবেল বা আনপ্লিজাণ্ট কথা বলে তার প্রতিবাদ করলে অবোধ শিশুর মতো বলে ম্যাসেজ তিনি সকলকে পাঠিয়ে থাকেন কেউ কিচ্ছুটি বলেনি আমিই প্রথম মানে আমি বেশি পাকা সুন্দর সোনা সম্বোধনকে আমি কালো করে দেখছি এমন সফিষ্টিকেটেড পার্ভার্টদের চিহ্নিত করতে শুরু করলে ঠগ বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে এই আর কি! এদের আবার একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী আছে যার গল্প তাদের বন্ডিং-এর কথা কথায় কথায় পেড়ে ফেলেন এরা ঘরের মহিলাটিকে একদম তার বিপুল বিনোদন স্বভাবের বাইরে রেখে থাকেন তারা একটা ডুয়াল পারসোনালিটির জীবন তাদের শিকারী শুধু শিকার  চেনে, বাকীদের কাছে সে সাধারণত ভদ্রমানুষ হিসেবে কাউণ্টেবেল এদের কাছেই শোনা সিঙ্গল মাদার নাকি খুব পপুলার হয়ে উঠেছে এদের খুব ডিম্যান্ড বাহ! কি অপুর্ব দৃষ্টিকোণ! সমাজের একশ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের প্ল্যাটফর্মেও এমন ভাবা হয় নাকি! কি অপার বিস্ময়ে ভাবি এই সিঙ্গলশব্দটার পেছনে যে কি হাহাকার আর দৈন্যতা পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে তা তাদের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব যারা এইপথটা পেরোয় এবং নিঃশব্দে যারা খুব কাছ থেকে দেখে এই জার্নি কতটা দুর্গম, কতটা অনিশ্চয়াতার! এই লম্বছায়ার দৈর্ঘ্যের ফাঁকে ফাঁকে কিছু শ্রদ্ধার মানুষরা তাদের স্বমহিমায় উজ্জ্বল তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভারে অবনত হতে পারাটাও এক অনন্য অভিজ্ঞতা




মহিলাদের কমোডিফিকেশনের দায় শুধু সিরিয়াল, সিনেমার নয়, এগুলিতে আমারা তার রিফ্লেকশন দেখি মাত্র এদের সেন্সুয়াস করে তোলে পুরুষের দৃষ্টি সমাজই মিনিয়েচার সোসাইটি যাতে একটি রাবিশ ছবির প্রাণ পোঁতা আছে, যার কলেবর  দিন দিন আয়তনে বাড়ছে যা বর্তমানে প্রায় অনিয়ন্ত্রিত মেয়েদের মর্য্যাদা সেখানে মূল্য রাখে অক্ষরে, কথায়, শপথে, পূজায় কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে কমোডিটির কন্সেপ্ট থেকে ফোকাস সরে না কিছুতেই হস্টেলের গেট অনির্দিষ্টকালের জন্য  সব্ধ্যে ৬ টা বেজে ৩০ মিনিটেই বন্ধ হবার নির্দেশ থাকে। হোলির দিনে ক্যাম্পাসের বাইরে না যাওয়া বা নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার নির্দেশ থাকে। সমাজ বদলায়, মানুষ চাঁদ জয় করে, শুধু মেয়েদের সিকিউরিটি প্রোভাইড করার বদলে অবরোধকেই বেছে নেওয়া হয়। অন্দরমহল খুব সুরক্ষিত কেননা সেখানে দায় পরিবারের রাষ্ট্রীয় সাইনবোর্ডের যে প্রচার তাতে আঁচড় না কাটলেই সফল প্রশাসন ও সমানাধিকারের সাংবিধানিক বার্তার মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠা আসলে ফেক বিজ্ঞাপনের চেয়েও খোকলা মানুষের নারীর অধিকার চেতনা ও ক্ষমতার ধারণা যার বিরুদ্ধে যতবার রব ততবার শতাব্দীর এক সেরা খারাপ মেয়ের উত্থান। নতুন করে তার চরিত্র ও স্বভাবের ক্রুশিফিকেশন। আবার রেজারেক্সন।