সিনেমার পৃথিবী – ৩৯
আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা কেউ কেউ
হয়ত জানেন যে আমার লেখক সত্ত্বার বাইরে আরেক যে মেরুতে আমি চড়ে বেড়াতে পছন্দ করি, তা
হল ফটোগ্রাফি। কালিমাটির প্রতি সংখ্যাতেই আমার ফটোগ্রাফি থাকে। এখনো মনে পড়ে, ৯০-এর
দশকের শেষদিকে যাদবপুরে পড়ার সময় ওটা শিখেছিলাম। সেই সময় ফটোগ্রাফি ক্লাবের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে হঠাৎ হঠাৎ শিয়ালদা
স্টেশন বা ভিক্টোরিয়া বা বোটানিকালে কয়েকটা SLR নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। খুব আগ্রহের সঙ্গে
অ্যাপার্চার, ফোকাস, ম্যাট এরিয়া, এক্সপোজার টাইম, এসব শিখতাম। মাঝে মাঝে ডার্করুমে
ধূপের আলোয় ফিল্ম ডেভেলপ করতেও শিখেছি। স্মৃতিতে সেইসব রাম্বলিং কচ্চিৎ উঁকি মারলে
নিজের থেকেই আজকাল যেন ডিলানের গানের কয়েকটা লাইন ঠোঁটে চলে আসে – ‘Don’t get up
gentlemen, I’m only passing through/ People are crazy and times are strange/
I’m locked in tight, I’m out of range/ I used to care, but things have
changed…’। যাইহোক, ফটোগ্রাফির প্রতি সেই ভালবাসার জন্যই ঠিক করেছি আমার এই প্রায় শেষ
হয়ে আসা ধারাবাহিকের দুটো পর্ব ফটোগ্রাফির জন্য উজাড় করে দেব। মনে হয় মন্দ লাগবে না।
আগের পর্ব অবধি আমরা ৩৩ জন বিশ্বসেরা
পরিচালককে নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছি। এই পর্বে তাদের উল্লেখযোগ্য কিছু ক্যামেরাম্যানদের
নিয়ে। সবাইকে হয়ত আলোচনায় আনতে পারব না, কিন্তু চেষ্টা করব এমন কয়েকজনের কথা তুলে আনতে
যারা ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে ছবির সংজ্ঞা বদলে দিতে চেয়েছিলেন। দু’পর্বে আমি মোট ১২ জন
সিনেমাটোগ্রাফার, যারা ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে পরিচালকের কথা অনুযায়ী এবং মাঝে মাঝে
নিজের প্রজ্ঞায় সিনেমার অনুভূতি ও দর্শন বদলে দিতে পেরেছেন, তাদের তুলে ধরব। তার ভেতর
এই পর্বে আমি হলিউডের ৩ জন ও ইউরোপের ৩ জন ক্লাসিক যুগের ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে আলোচনা
করব।
হলিউড থেকেঃ আর্নেস্ট হলার (১৮৯৬-১৯৭০),
গ্রেগ টোল্যান্ড (১৯০৪-১৯৪৮) এবং রবার্ট বার্কস (১৯০৯-১৯৬৮)। ইউরোপ থেকেঃ সেন নিকভিস্ট
(১৯২২-২০০৬), ভাদিম ইউসেভ (১৯২৯-২০১৩) এবং জন অ্যাল্কট (১৯৩০-১৯৮৬)।
|
গন উইথ দ্যা উইন্ড টেকনিকালার |
ভিক্টর ফ্লেমিং-এর ‘গন উইথ দ্য
উইন্ড’ (১৯৩৯)। আমি বেশ কয়েক পর্বে এই ছবি নিয়ে আলোচনা করেছি। ভুললে চলবে না, গন উইথ
দ্য উইন্ড সেই প্রথম ছবি যা একাধারে দশটা অস্কার পেয়েছিল। কারণ এই ছবি সেই সময়ে এমন
কিছু এনেছিল যা শিক্ষনীয় - আলোর খেলা, রঙের সাবলীল ব্যবহার, আউটডোর সিন, অনবদ্য অভিনয়,
লং শট, এরকম বেশ কিছু ব্যাপার। আরো বড় কথা, এই ছবি সিনেমার ইতিহাসে সাদা কালো ছবির
ভীড়ে প্রথমদিকের কয়েকটা রঙিন ছবির ভেতর একটা। এবং এই ছবি সেই প্রথম ছবি যা রঙের ব্যবহারের
মধ্যে দিয়ে দর্শকের মুড ভাল করার জন্য অনারারি অস্কার পেয়েছিল। সেই ছবির ক্যামেরাম্যান
ছিলেন আর্নেস্ট হলার। এই ছবি ছাড়াও উনি জেজেবেল (১৯৩৮), অল দিস, অ্যান্ড হেভেন টু
(১৯৪০), মাইল্ডরেড পিয়ার্স (১৯৪৫), দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দি অ্যারো (১৯৫০) ইত্যাদি বেশ
কিছু ছবির জন্যও অস্কার নমিনেটেড হয়েছিলেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, গন উইথ দ্য উইন্ড
নিয়ে কেন এত হৈ-চৈ হয়েছিল? প্রধান কারণ, এর সিনেমাটোগ্রাফি। প্রথমত, সেই প্রথম কোন এক রঙিন ছবি ‘টেকনিকালার’
ব্যবহার করেছিল। প্রায় ৮৫ বছর আগের রঙিন ছবি, কিন্তু সেই সময়েও মনে হয়েছিল রং যেন জীবন্ত।
দ্বিতীয়ত, আলোর ব্যবহার। এই ছবিতে হলার কোন কৃত্রিম লাইট ব্যবহার করেননি। পুরোটাই ছিল
স্বাভাবিক লাইটের কাজ। যেমন, মেলানি বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে, সেই সিনটাও জানলা দিয়ে আসা স্বাভাবিক আলো ব্যবহার
করে নেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়ত, হলারের এক অদ্ভুত টেকনিক, যা এখন আমাদের মত ফটোগ্রাফারদের
ভুরু কপালে তুলে দেয়। কি রকম? একটা কাচের ওপর কিছু কিছু জায়গায় কালো ম্যাট পেইন্টিং
করে সেটা ক্যামেরার সামনে রেখে কালার ছবির শুটিং করা হত। পরে নেগেটিভের সেই ব্ল্যাক-আউট
জায়গাগুলো কালার পেইন্ট করে ফাইনাল প্রিন্ট তৈরি করা হত। বেশির ভাগ কালার শট এইভাবে
তৈরি করা হয়েছিল। এবং অবশ্যই লং শট, ওয়াইড শট ও ট্র্যাকের মধ্যে খুব মসৃণভাবে ক্যামেরা
গড়িয়ে নিয়ে চলে যাওয়া।
আজকাল যেহেতু সিনেমার পুরোটাই ডিজিটাল
শুটিং হয়, তাই স্পেকট্রাম অ্যানালিসিস (এক বিশেষ পদ্ধতি) করে, তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী
কালার গ্রেডিং, কালার কনট্রাস্ট, কালার হারমোনি – কত কি করা যায়। কিন্তু ভাবুন, ৮৫
বছর আগে এই রঙিন ছবিতে হলার আমাদের কি কি শিখিয়ে গেছেন!
|
সিটিজেন কেন ডিপ ফোকাস |
অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১)।
ওয়েলেসের ক্যামেরা মানেই নন লিনিয়ার বর্ণনা, অদ্ভুত লাইট, বেয়াড়া রকমের ক্যামেরা অ্যাঙ্গল,
অফবিট ক্যামেরার জায়গা, লং শট, মন্তাজ এবং অবশ্যই ডিপ ফোকাস। আগে একবার বলেছিলাম। আর
এই সমস্ত ব্যাপারগুলো মুন্সিয়ানার সঙ্গে করে দেখিয়েছিলেন সেই ছবির ক্যামেরাম্যান গ্রেগ
টোল্যান্ড।
এই ছবি গোটা পৃথিবীকে বিশেষ করে
শিখিয়েছিল ডিপ ফোকাস কী। আমি এর আগে সংক্ষেপে ব্যাপারটা একবার বলেছিলাম ৪ নম্বর পর্বে।
এবার আরেকটু ব্যাখ্যা করি। ডিপ ফোকাস ফটোগ্রাফি এবং সিনেমাটোগ্রাফি, দুয়ের ক্ষেত্রেই
এক বিশেষ কৌশল। ধরুন ক্যামেরার সামনে একটা গোলাপফুল আছে, আশেপাশে কিছু গাছপালা আছে
আর অনেক দূরে কয়েকটা পাহাড় আছে। আমরা এগুলো ফটোগ্রাফির ভাষায় বলি - ফোরগ্রাউন্ড, মিডল গ্রাউন্ড, ব্যাকগ্রাউন্ড।
সাধারণ ফটোয় আমরা অ্যাপার্চার বড় করে নিই, অনেকটা আলো ঢোকাই, চট করে ফটোটা তুলে নিই
- ফলে সামনের গোলাপফুল স্পষ্ট ফুটে ওঠে, পেছনের বস্তুগুলো আবছা হয়ে যায়। ডিপ ফোকাস
করতে হলে ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স থাকা বাঞ্ছনীয়, এবং অ্যাপার্চার একদম ছোট করে ও এক্সপোজার
টাইম দীর্ঘায়িত করে সব বস্তুগুলোকে সমানভাবে ফোকাসে আনা হয়। কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফিতে
ব্যাপারটা তত সহজ নয়। কারণ ৪০ মিলিমিটারের ক্যামেরায় সাধারণত ৩০ ডিগ্রি অনুভূমিক কোণ
পাওয়া যায়। কোণ ঠিকঠাক রেখে ঐ ক্ষেত্রফলে ডিপ ফোকাস করতে গেলে মোটামুটি ১৩ মিলিমিটার ক্যামেরা লাগবে। তারজন্য আলাদা খরচ কত
হবে জানেন? প্রচুর। আবারো বলি, এ যুগের ডিজিটাল ক্যামেরার সঙ্গে সেই সময়ের অ্যানালগ
ক্যামেরা গুলিয়ে ফেলবেন না। গ্রেগ টোল্যান্ড সেই সময়ে বসে ডিপ ফোকাস করেছেন, ওনাকে
কুর্নিশ তো জানাতেই হয়।
এই ছবি ছাড়াও টোল্যান্ড লা মিজারেবল
(১৯৩৫), উদারিং হাইটস্ (১৯৩৯), দ্য লং ভয়েজ হোম (১৯৪০) ইত্যাদি ছবির সিনেমাটোগ্রাফির
জন্যও অস্কার নমিনেটেড হয়েছিলেন। এটাও জেনে রাখা দরকার যে ‘দ্য লং ভয়েজ হোম’ ছবিতে
উনি প্রথম ডিপ ফোকাস কৌশলের ব্যবহার করেছিলেন।
|
দ্যা বার্ডস স্পেশাল এফেক্ট |
আলফ্রেড হিচকক হলিউডে আসার পর বেশ
কয়েকজন ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু ১৯৫১ সালের পর যার সঙ্গে ক্যামেরা
নিয়ে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন, তিনি রবার্ট বার্কস। ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন’ (১৯৫১) থেকে
শুরু করে ‘মার্নি’ (১৯৬৪) অবধি। এর মধ্যে ‘টু ক্যাচ আ থিফ’ (১৯৫৫) ছবির জন্য রবার্ট
বার্কস অস্কার পেয়েছিলেন। যে সাসপেন্সের জন্য হিচকক পৃথিবী বিখ্যাত, তার অনেকটার নেপথ্যে
কিন্তু বার্কস। কি রকম, দুটো ছবির উদাহরণ দিয়ে বোঝাব। দ্য বার্ডস (১৯৬৩)। এই ছবিতে
প্রায় ১৫০০ শট্ নেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে প্রায় ৪০০ শট্ ছিল কৌশল বা একাধিক শট্ জুড়ে তৈরি। কি
রকম? প্রথমে ভাবা হয়েছিল কাকেদের কিছু রোবোট মডেল নিয়ে শটগুলো তোলা হবে, কিন্তু বাধ
সাধলেন বার্কস। উনি বললেন সেটা খুব কৃত্রিম হয়ে যাবে, দর্শক বুঝে যাবে। অতএব, কিছু আসল পাখি আর কিছু নকল
পাখি নিয়ে একাধিক শট জুড়ে তৈরি করা হোক একেক সিন। তাহলে কেউ ধরতে পারবে না। সেইসব ব্যাকগ্রাউন্ড
সিন তৈরি করার জন্য বার্কস প্রায় এক বছর ধরে পাখিদের নিয়ে বিভিন্ন শট্ তৈরি করলেন,
তারপর সেগুলো বার্ডস ছবিতে জোড়া হল। এরপর আসুন মার্নি (১৯৬৪) ছবিতে। সেখানে বার্কস
দেখালেন মূলত লাল আর হলুদ রং ব্যবহার করে টেলিফটো লেন্স আর ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স দিয়ে
ছবি তৈরির মুন্সিয়ানা। এবং এই দুটো ছবিতেই কিন্তু স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স দারুনভাবে
ফুটে উঠেছে, যা হিচককের ব্রান্ড স্টাইল। মার্নি ছবিতে ক্লোজ-আপে এক দীর্ঘ চুমুর দৃশ্য,
যেখানে শুধু ঠোঁটে ঠোঁট মিশে যাওয়া, অতি বড় সমালোচকও ওটাকে পর্নোগ্রাফি বলতে সাহস পাবেন
না। দুর্ভাগ্য, ১৯৬৮ সালে রবার্ট তার স্ত্রী-সহ এক দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা না গেলে
আমরা আরো কিছু ভালো সিনেমাটোগ্রাফি তার হাত থেকে পেতাম।
|
ক্রাতজ অ্যা ন্ড হুইস্পার্স লাল সাদা ফ্রেম |
ক্যামেরাম্যান গানার ফিশার বিখ্যাত
সুইডিশ পরিচালক ইঙ্গমার বার্গম্যানকে ছেড়ে ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্সে চলে যাবার পর ১৯৬০
সালে সেন নিকভিস্ট প্রথম বার্গম্যানের সঙ্গে ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’ ছবিতে কাজ করতে
শুরু করেন। একে একে বেশ কিছু ছবি, এবং ‘ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস’ ছবিতে নিকভিস্ট অস্কার
পাবার পর সব জায়গায় লেখা শুরু হয় বার্গম্যানের ছবির কাব্যিক আলোময় ক্যামেরার পেছনে
নিকভিস্ট না থাকলে সেগুলো সম্ভব হত না। এরপর হলিউড থেকে নিকভিস্টের কাছে একে একে অফার
আসতে থাকে। যদিও উনি ১৯৮২ সালের ‘ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার’ অবধি বার্গম্যানের
সঙ্গে কাজ করেছিলেন, কিন্তু তারমধ্যে রোমান পোলানস্কি, উডি অ্যালেন ইত্যাদি অনেকের
সঙ্গেই ওনাকে কাজ শুরু করতে হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে ফিশার যেমন তার ক্যামেরায়
অন্ধকার বেশি পছন্দ করতেন, নিকভিস্ট একদম উল্টোদিকে হেঁটে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান পেইন্টারদের
মত স্বাভাবিক ও উজ্জ্বল আলো বেশি পছন্দ করতেন। সাদা কালো যে যে ছবি বানিয়েছেন, তার মধ্যে আলো বেশি। ক্রাইজ অ্যান্ড
হুইস্পারস শুধুমাত্র সাদা আর লাল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, সেটা দর্শকরা নিশ্চয়ই জানেন।
তেমনি ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার নিয়ে বলা হয়ে থাকে ‘The camera is about the
point-of-view in the storytelling. That’s what Nykvist and Bergman understood.
Where they place the camera creates the point of view for the audience’। সুতরাং
আরেকবার অস্কার। উনি যখন মারা যান, লেখা হয়েছিল - দ্য মাস্টার অব লাইট ইজ নো মোর।
এই লেখার ১৭ আর ৩৭ নম্বর পর্বে
একজন রাশিয়ান পরিচালককে নিয়ে বলেছিলাম – সারা জীবন মাত্র ৭ খানা ছবি, তার মধ্যে শেষ
দুটো দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর, তবুও সাহসী ও ব্যতিক্রমী। আন্দ্রেই তারকোভস্কি। এও বলেছিলাম,
ক্যামেরার স্লো মোশনে উনি সময়কে ফ্রেমবন্দী করার চেষ্টা করেন। ফ্রেমে প্রাণবন্ত ছবি
ছাড়াও তারকোভস্কির ক্যামেরার কাজ ‘মাইজ-এন-সিন’ বার্তা বহন করে, যা প্রতি ডিটেলিংয়ের
দিকে ধীরগতিতে নজর দেয়। অভিনেতাদের ঠিক মুখের
সামনে ক্যামেরা রেখে আস্তে আস্তে মুভমেন্ট, একটা ক্ষয়ে আসা ল্যান্ডস্কেপের সামনে বা
পুড়ে যাওয়া বাড়ির দৃশ্যে ক্যামেরার ধীরগতি – সময়কে আপনা থেকেই থামিয়ে দেয়। ওনার সুইডেনে
করা একমাত্র ছবি ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’ (১৯৮৬)-এর ক্যামেরার পেছনে ছিলেন সেন নিকভিস্ট।
সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে উনি কি বলেছিলেন শুনুন – ‘The Russian director has scenes that
run 7, 8 or 9 minutes, as a rule; and it is not just the camera that moves –
within the shot itself there is constant movement. Usually we film the
establishing shot and then a large number of close-ups are cut into it. With Tarkovosky
everything is complex. He devotes a great deal of time to the mise-en-scene and
the overall atmosphere within the frame, and this is much more interesting,
both from a technical and an artistic standpoint, but it takes a lot of time.’।
এবার ভাবুন, এহেন তারকোভস্কির প্রথম ৩-টে ছবির (এবং ১-টা শর্ট ফিল্ম) রাশিয়ান সিনেমাটোগ্রাফার
ছিলেন ভাদিম ইউসেভ। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ভাদিমের ধৈর্য এবং টেকনিক, দুই’ই ছিল। নইলে
তারকোভস্কির সাথে কেউ ৩-টে ছবি করতে পারে না।
|
সোলারিস লং শট |
ভাদিম প্রথম থেকেই ক্যামেরার সামনের
চরিত্রদের আর আবহের পুরো পরিবেশকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন, মনে করতেন এদের আলাদা
করা যায় না। তাই তারকোভস্কির মতই তারও পছন্দ ছিল ধীরগতিতে ক্যামেরার চলন। ইভান’স চাইল্ডহুড
ছবিতে কিভাবে গ্রাউন্ড লেভেলের নিচে ক্যামেরা রেখে শুট করা যায়, সোলারিসে লাইব্রেরীর
মধ্যে জিরো গ্র্যাভিটি সিনে ক্যামেরা আর মুখ্য চরিত্রদের আলাদা ক্রেনে রেখে আলাদা স্পিডে
তোলা নামানো, সাদা-কালো আর সেপিয়া কালার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, বেশ কয়েক মিনিটের লং শট,
এগুলো ভাদিমের কিছু অনবদ্য কাজ। সিনেমার সাইকোলজির সঙ্গে ক্যামেরার মুভমেন্ট ভাদিমকে
অন্য ক্যামেরাম্যানদের থেকে আলাদা করেছে।
তাহলে মুশকিলটা কোথায় হয়েছিল? কেন
৩-টে ছবির পর তারকোভস্কি আর ভাদিমের জুটি আলাদা হয়ে গেছিল? কারণ, নিকভিস্টের লেখাটা
আরেকবার পড়লে বুঝবেন, তারকোভস্কি তার ক্যামেরাম্যানকে বিশেষ কোন স্বাধীনতা দিতে চাইতেন না, যেহেতু উনিও পোলারয়েড
ক্যামেরায় পারদর্শী ছিলেন। আর ভাদিম ছিলেন ওনার থেকে বয়সে বড়, এক রাশিয়ান সিনেমাটোগ্রাফি
কলেজের প্রফেসর, ক্যামেরার পেছনে চোখ রেখে নিজের জায়গাটা খুব ভাল বুঝতেন। ফলে ঠোকাঠুকি,
এবং সোলারিস-এর পর দুজনে আর একসঙ্গে কাজ করেননি।
স্ট্যানলি কিউব্রিক হলিউড ছেড়ে
ব্রিটেন চলে যাবার পর যখন ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮) বেশ খানিকটা করে ফেলেছেন, তখন
ব্রিটিশ ক্যামেরাম্যান জন অ্যাল্কটের সঙ্গে ওনার পরিচয় হয় এবং সেই ছবিতে জনকে ক্যামেরার
পেছনে পাঠানো হয়। এরপর আরো তিনটে ছবি ওনারা একসঙ্গে করেছিলেনঃ এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ
(১৯৭১), ব্যারি লিন্ডন (১৯৭৫) এবং দ্য শাইনিং (১৯৮০)।
|
ব্যারি লিন্ডন মোমবাতির আলোয় স্পেশাল লেন্স |
বলা হয়ে থাকে অ্যাল্কট ‘ব্যারি
লিন্ডন’ শুট করেছিলেন শুধুমাত্র মোমবাতির আলোয়। এই কাজ করার জন্য অ্যাল্কট এবং কিউব্রিক
প্রায় একমাস বিভিন্ন লেন্স এনে মোমবাতির আলোয় টেস্ট করেন, অবশেষে NASA অ্যাপোলো মহাকাশযানের
চাঁদে নেমে ছবি সংগ্রহ করার জন্য কম আলোয় যে ফটোশুট লেন্স তৈরি করেছিল, সেই লেন্স দিয়ে
ছবির শুটিং হয়েছিল। এছাড়াও উনি দ্য শাইনিং ছবির জন্য কিউব্রিকের হ্যান্ডিক্যামে এক
বিশেষ যন্ত্র বসিয়েছিলেন, দেহের ওপর ক্যামেরা
স্টেবিলাইজার মাউন্ট করে সেটার সাহায্যে মসৃণভাবে হ্যান্ডিক্যাম চালাতে শিখিয়েছিলেন।
এবং এই কৌশলের নাম রাখা হয় ‘স্টেডিক্যাম’। স্টেজ লাইটিং পছন্দ করতেন না, চাইতেন আলো
যেন স্বাভাবিক হয়। স্পেস ওডেসি সিনেমায় স্পেশাল এফেক্ট আনার জন্য সেই সময়ে অ্যাল্কট
ব্যবহার করেছিলেন ফ্রন্ট প্রোজেকশন, যা তখন কেউ করত না। শুটিং-এর সময় চরিত্রদের সামনে
একটা বিশাল স্বচ্ছ কাচ রেখে তার মধ্যে দিয়ে আবহের ফুটেজ তুলে ধরা, ১৯৬৮ সালে কেউ ভাবতেই
পারত না। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে অ্যাল্কট হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবার পর ছ’জন বিখ্যাত ক্যামেরাম্যানকে
নিয়ে এক ডকু ফিল্ম তৈরি হয়েছিল ‘সিক্স কাইন্ডস অব লাইট’। ওনার কিছু ছবি তার মধ্যে জায়গা
পেয়েছিল। মানতেই হবে, অ্যাল্কট লেন্স এবং আলো, এই দুয়ের যুগলবন্দীকে এক অন্য মাত্রা
দিয়েছিলেন।
সামনের পর্বে বাকি ৬ জনকে নিয়ে
আলোচনা করব। কিন্তু একজন বাঙালিকে নিয়ে সবার শেষে বলতেই হবে, নইলে সিনেমাটোগ্রাফির
অপমান। সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র। বলা হয়ে থাকে সবার প্রথম ‘বাউন্সিং
লাইট’ ধারণাটা ১৯৫৪ সালে উনিই শুরু করেছিলেন।
(ক্রমশ)