কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


 

কালিমাটি অনলাইন / ১২৪ / দ্বাদশ বর্ষ : চতুর্থ সংখ্যা

সুদূর অতীতের কথা নয়, অদূর অতীতেও, আমাদের এই উপমহাদেশে বাঙালি জাতি একটা স্বতন্ত্র সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিল। সেই মর্যাদা ও সম্মানদান করেছিলেন এই উপমহাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য  জাতির মানুষেরা। এবং শুধু এই উপমহাদেশেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সেই সম্মান ও মর্যাদালাভ করেছিলাম আমরা বাঙালিরা। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্মভাবনা, আধ্যাত্মিকতা, দার্শনিকতা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের মানুষদের প্রভাবিত করেছিল, পথনির্দেশ করেছিল বাঙালিরা। বিশেষত বাঙালির ঘরে এমন কিছু মহাপুরুষ এবং প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল, যাঁরা তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। একইসঙ্গে বাঙালিরা ছিল বিপ্লব ও আন্দোলনের প্রথম সারিতে। তাদের অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের ইতিহাস কখনও বিস্মৃত হবার নয়। আর তাই মহামতি গোপালকৃষ্ণ গোখলে একদা মন্তব্য করেছিলেন, আজ বাংলা যা ভাবে, কাল ভারত তা ভাবে।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের ও লজ্জার কথা, আমরা বাঙালিরা আমাদের সেই সম্মান ও মর্যাদাকে রক্ষা করতে পারিনি। সময় যত অতিবাহিত হয়েছে, বাঙালিজাতি ততই নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ তাঁদের প্রতিভার দরুণ উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছেন, কিন্তু জাতিগতভাবে নয়। আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করি না, যেমন আমি বসবাস করি ঝাড়খন্ডে, প্রায়শই অন্যান্য ভাষাভাষির মানুষেরা বাঙালির সাম্প্রতিক বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের কারণে বাঙালির প্রতি আর আগের মতো শ্রদ্ধাভাব পোষণ করেন না। কখনও বা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে থাকেন। তাঁরা পরিষ্কার উচ্চারণে বলে থাকেন যে, বাঙালিজাতির অতীত নিঃসন্দেহে গৌরবময়, কিন্তু বর্তমান অত্যন্ত হতাশাজনক। বাঙালিজাতি এখন পরিণত হয়েছে ভীরু ও সুবিধাবাদী জাতিতে। বস্তুতপক্ষে এই অভিযোগ অস্বীকার করারও নয়। তবু প্রত্যুত্তরে উল্লেখ করতেই হয়, দেশ স্বাধীন হবার পর পশ্চিমবঙ্গে যে সত্তর দশকের আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল মূলত বাঙালিরাই, নেতৃত্বেও ছিল তারাই, শহিদের মৃত্যুবরণ করেছে অধিকাংশ তারাই। এই আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত। সত্তর দশকে মুক্তির দশকের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা সবাই।

তবু বলতে হয়, সত্তর দশকের সেই আন্দোলন ছিল একটি রাজনৈতিক দল পরিচালিত আন্দোলন, যা কখনই গণ আন্দোলনে পরিণত হয়নি বা উৎসারিত হয়নি। কিন্তু এবছর আগষ্টমাসে কলকাতা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় ডাক্তার তরুণী তিলোত্তমাকে নৃশংসভাবে হত্যা ও ধর্ষণের  প্রতিবাদে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জনসাধারণ যেভাবে বিচারের দাবিতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে শ্লোগানে শ্লোগানে সোচ্চার হয়ে উঠলেন, তা ছিল অভূতপূর্ব। বলা বাহুল্য, এই আন্দোলন তারপর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে এবং বিস্তৃতিলাভ করেছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে, কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া অস্বীকার করে বাঙালিদের এই প্রতিবাদ দুরন্ত মাত্রা লাভ করেছিল মূলত  মহিলাদের রাত দখলের কর্মকান্ডে। তারই সঙ্গে বিভিন্ন পথমিছিল, পথসভা এবং জুনিয়র ডাক্তারদের  কর্মবিরতি ও আমরণ  অনশন চলেছে সমান্তরালভাবে। সিনিয়র ডাক্তাররা তারই সমর্থনে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে গণ-ইস্তফা দিচ্ছেন। তিলোত্তমার বিচারের প্রক্রিয়া এখন চলছে সুপ্রিম কোর্টে এবং অনুসন্ধানকাজে নিমগ্ন আছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাসংস্থা সি বি আই। বিচার সম্পন্ন হলে আমরা যেমন জানতে পারব, এই নিকৃষ্ট হত্যা ও ধর্ষণকান্ডের অপরাধী কারা কারা এবং তাদের জন্য কোন শাস্তির আদেশ করা হয়েছে।

পরিশেষে একটা কথা উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি, তিলোত্তমার হত্যা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করে যেভাবে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষেরা, বিশেষত মহিলারা ঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন, তা বাংলা ও বাঙালির পূর্বগৌরবকে ফিরিয়ে এনেছে, বাঙালিজাতি তার স্বাভাবিক মর্যাদায় মহিমান্বিত হয়েছে।    

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৯



আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা কেউ কেউ হয়ত জানেন যে আমার লেখক সত্ত্বার বাইরে আরেক যে মেরুতে আমি চড়ে বেড়াতে পছন্দ করি, তা হল ফটোগ্রাফি। কালিমাটির প্রতি সংখ্যাতেই আমার ফটোগ্রাফি থাকে। এখনো মনে পড়ে, ৯০-এর দশকের শেষদিকে যাদবপুরে পড়ার সময় ওটা শিখেছিলাম। সেই সময়  ফটোগ্রাফি ক্লাবের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে হঠাৎ হঠাৎ শিয়ালদা স্টেশন বা ভিক্টোরিয়া বা বোটানিকালে কয়েকটা SLR নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। খুব আগ্রহের সঙ্গে অ্যাপার্চার, ফোকাস, ম্যাট এরিয়া, এক্সপোজার টাইম, এসব শিখতাম। মাঝে মাঝে ডার্করুমে ধূপের আলোয় ফিল্ম ডেভেলপ করতেও শিখেছি। স্মৃতিতে সেইসব রাম্বলিং কচ্চিৎ উঁকি মারলে নিজের থেকেই আজকাল যেন ডিলানের গানের কয়েকটা লাইন ঠোঁটে চলে আসে – ‘Don’t get up gentlemen, I’m only passing through/ People are crazy and times are strange/ I’m locked in tight, I’m out of range/ I used to care, but things have changed…’। যাইহোক, ফটোগ্রাফির প্রতি সেই ভালবাসার জন্যই ঠিক করেছি আমার এই প্রায় শেষ হয়ে আসা ধারাবাহিকের দুটো পর্ব ফটোগ্রাফির জন্য উজাড় করে দেব। মনে হয় মন্দ লাগবে না।

আগের পর্ব অবধি আমরা ৩৩ জন বিশ্বসেরা পরিচালককে নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছি। এই পর্বে তাদের উল্লেখযোগ্য কিছু ক্যামেরাম্যানদের নিয়ে। সবাইকে হয়ত আলোচনায় আনতে পারব না, কিন্তু চেষ্টা করব এমন কয়েকজনের কথা তুলে আনতে যারা ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে ছবির সংজ্ঞা বদলে দিতে চেয়েছিলেন। দু’পর্বে আমি মোট ১২ জন সিনেমাটোগ্রাফার, যারা ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে পরিচালকের কথা অনুযায়ী এবং মাঝে মাঝে নিজের প্রজ্ঞায় সিনেমার অনুভূতি ও দর্শন বদলে দিতে পেরেছেন, তাদের তুলে ধরব। তার ভেতর এই পর্বে আমি হলিউডের ৩ জন ও ইউরোপের ৩ জন ক্লাসিক যুগের ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে আলোচনা করব।

হলিউড থেকেঃ আর্নেস্ট হলার (১৮৯৬-১৯৭০), গ্রেগ টোল্যান্ড (১৯০৪-১৯৪৮) এবং রবার্ট বার্কস (১৯০৯-১৯৬৮)। ইউরোপ থেকেঃ সেন নিকভিস্ট (১৯২২-২০০৬), ভাদিম ইউসেভ (১৯২৯-২০১৩) এবং জন অ্যাল্‌কট (১৯৩০-১৯৮৬)।

গন উইথ দ্যা উইন্ড টেকনিকালার
ভিক্টর ফ্লেমিং-এর ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯)। আমি বেশ কয়েক পর্বে এই ছবি নিয়ে আলোচনা করেছি। ভুললে চলবে না, গন উইথ দ্য উইন্ড সেই প্রথম ছবি যা একাধারে দশটা অস্কার পেয়েছিল। কারণ এই ছবি সেই সময়ে এমন কিছু এনেছিল যা শিক্ষনীয় - আলোর খেলা, রঙের সাবলীল ব্যবহার, আউটডোর সিন, অনবদ্য অভিনয়, লং শট, এরকম বেশ কিছু ব্যাপার। আরো বড় কথা, এই ছবি সিনেমার ইতিহাসে সাদা কালো ছবির ভীড়ে প্রথমদিকের কয়েকটা রঙিন ছবির ভেতর একটা। এবং এই ছবি সেই প্রথম ছবি যা রঙের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দর্শকের মুড ভাল করার জন্য অনারারি অস্কার পেয়েছিল। সেই ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন আর্নেস্ট হলার। এই ছবি ছাড়াও উনি জেজেবেল (১৯৩৮), অল দিস, অ্যান্ড হেভেন টু (১৯৪০), মাইল্ডরেড পিয়ার্স (১৯৪৫), দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দি অ্যারো (১৯৫০) ইত্যাদি বেশ কিছু ছবির জন্যও অস্কার নমিনেটেড হয়েছিলেন।

কিন্তু কথা হচ্ছে, গন উইথ দ্য উইন্ড নিয়ে কেন এত হৈ-চৈ হয়েছিল? প্রধান কারণ, এর সিনেমাটোগ্রাফি।  প্রথমত, সেই প্রথম কোন এক রঙিন ছবি ‘টেকনিকালার’ ব্যবহার করেছিল। প্রায় ৮৫ বছর আগের রঙিন ছবি, কিন্তু সেই সময়েও মনে হয়েছিল রং যেন জীবন্ত। দ্বিতীয়ত, আলোর ব্যবহার। এই ছবিতে হলার কোন কৃত্রিম লাইট ব্যবহার করেননি। পুরোটাই ছিল স্বাভাবিক লাইটের কাজ। যেমন, মেলানি বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে,  সেই সিনটাও জানলা দিয়ে আসা স্বাভাবিক আলো ব্যবহার করে নেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়ত, হলারের এক অদ্ভুত টেকনিক, যা এখন আমাদের মত ফটোগ্রাফারদের ভুরু কপালে তুলে দেয়। কি রকম? একটা কাচের ওপর কিছু কিছু জায়গায় কালো ম্যাট পেইন্টিং করে সেটা ক্যামেরার সামনে রেখে কালার ছবির শুটিং করা হত। পরে নেগেটিভের সেই ব্ল্যাক-আউট জায়গাগুলো কালার পেইন্ট করে ফাইনাল প্রিন্ট তৈরি করা হত। বেশির ভাগ কালার শট এইভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এবং অবশ্যই লং শট, ওয়াইড শট ও ট্র্যাকের মধ্যে খুব মসৃণভাবে ক্যামেরা গড়িয়ে নিয়ে চলে যাওয়া।

আজকাল যেহেতু সিনেমার পুরোটাই ডিজিটাল শুটিং হয়, তাই স্পেকট্রাম অ্যানালিসিস (এক বিশেষ পদ্ধতি) করে, তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী কালার গ্রেডিং, কালার কনট্রাস্ট, কালার হারমোনি – কত কি করা যায়। কিন্তু ভাবুন, ৮৫ বছর আগে এই রঙিন ছবিতে হলার আমাদের কি কি শিখিয়ে গেছেন!

সিটিজেন কেন ডিপ ফোকাস

অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১)। ওয়েলেসের ক্যামেরা মানেই নন লিনিয়ার বর্ণনা, অদ্ভুত লাইট, বেয়াড়া রকমের ক্যামেরা অ্যাঙ্গল, অফবিট ক্যামেরার জায়গা, লং শট, মন্তাজ এবং অবশ্যই ডিপ ফোকাস। আগে একবার বলেছিলাম। আর এই সমস্ত ব্যাপারগুলো মুন্সিয়ানার সঙ্গে করে দেখিয়েছিলেন সেই ছবির ক্যামেরাম্যান গ্রেগ টোল্যান্ড।

এই ছবি গোটা পৃথিবীকে বিশেষ করে শিখিয়েছিল ডিপ ফোকাস কী। আমি এর আগে সংক্ষেপে ব্যাপারটা একবার বলেছিলাম ৪ নম্বর পর্বে। এবার আরেকটু ব্যাখ্যা করি। ডিপ ফোকাস ফটোগ্রাফি এবং সিনেমাটোগ্রাফি, দুয়ের ক্ষেত্রেই এক বিশেষ কৌশল। ধরুন ক্যামেরার সামনে একটা গোলাপফুল আছে, আশেপাশে কিছু গাছপালা আছে আর অনেক দূরে কয়েকটা পাহাড় আছে। আমরা এগুলো ফটোগ্রাফির  ভাষায় বলি - ফোরগ্রাউন্ড, মিডল গ্রাউন্ড, ব্যাকগ্রাউন্ড। সাধারণ ফটোয় আমরা অ্যাপার্চার বড় করে নিই, অনেকটা আলো ঢোকাই, চট করে ফটোটা তুলে নিই - ফলে সামনের গোলাপফুল স্পষ্ট ফুটে ওঠে, পেছনের বস্তুগুলো আবছা হয়ে যায়। ডিপ ফোকাস করতে হলে ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স থাকা বাঞ্ছনীয়, এবং অ্যাপার্চার একদম ছোট করে ও এক্সপোজার টাইম দীর্ঘায়িত করে সব বস্তুগুলোকে সমানভাবে ফোকাসে আনা হয়। কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফিতে ব্যাপারটা তত সহজ নয়। কারণ ৪০ মিলিমিটারের ক্যামেরায় সাধারণত ৩০ ডিগ্রি অনুভূমিক কোণ পাওয়া যায়। কোণ ঠিকঠাক রেখে ঐ ক্ষেত্রফলে ডিপ ফোকাস করতে গেলে মোটামুটি ১৩  মিলিমিটার ক্যামেরা লাগবে। তারজন্য আলাদা খরচ কত হবে জানেন? প্রচুর। আবারো বলি, এ যুগের ডিজিটাল ক্যামেরার সঙ্গে সেই সময়ের অ্যানালগ ক্যামেরা গুলিয়ে ফেলবেন না। গ্রেগ টোল্যান্ড সেই সময়ে বসে ডিপ ফোকাস করেছেন, ওনাকে কুর্নিশ তো জানাতেই হয়।

এই ছবি ছাড়াও টোল্যান্ড লা মিজারেবল (১৯৩৫), উদারিং হাইটস্‌ (১৯৩৯), দ্য লং ভয়েজ হোম (১৯৪০) ইত্যাদি ছবির সিনেমাটোগ্রাফির জন্যও অস্কার নমিনেটেড হয়েছিলেন। এটাও জেনে রাখা দরকার যে ‘দ্য লং ভয়েজ হোম’ ছবিতে উনি প্রথম ডিপ ফোকাস কৌশলের ব্যবহার করেছিলেন।

দ্যা বার্ডস স্পেশাল এফেক্ট

আলফ্রেড হিচকক হলিউডে আসার পর বেশ কয়েকজন ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু ১৯৫১ সালের পর যার সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন, তিনি রবার্ট বার্কস। ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন’ (১৯৫১) থেকে শুরু করে ‘মার্নি’ (১৯৬৪) অবধি। এর মধ্যে ‘টু ক্যাচ আ থিফ’ (১৯৫৫) ছবির জন্য রবার্ট বার্কস অস্কার পেয়েছিলেন। যে সাসপেন্সের জন্য হিচকক পৃথিবী বিখ্যাত, তার অনেকটার নেপথ্যে কিন্তু বার্কস। কি রকম, দুটো ছবির উদাহরণ দিয়ে বোঝাব। দ্য বার্ডস (১৯৬৩)। এই ছবিতে প্রায় ১৫০০ শট্‌ নেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে প্রায়  ৪০০ শট্‌ ছিল কৌশল বা একাধিক শট্‌ জুড়ে তৈরি। কি রকম? প্রথমে ভাবা হয়েছিল কাকেদের কিছু রোবোট মডেল নিয়ে শটগুলো তোলা হবে, কিন্তু বাধ সাধলেন বার্কস। উনি বললেন সেটা খুব কৃত্রিম হয়ে যাবে,  দর্শক বুঝে যাবে। অতএব, কিছু আসল পাখি আর কিছু নকল পাখি নিয়ে একাধিক শট জুড়ে তৈরি করা হোক একেক সিন। তাহলে কেউ ধরতে পারবে না। সেইসব ব্যাকগ্রাউন্ড সিন তৈরি করার জন্য বার্কস প্রায় এক বছর ধরে পাখিদের নিয়ে বিভিন্ন শট্‌ তৈরি করলেন, তারপর সেগুলো বার্ডস ছবিতে জোড়া হল। এরপর আসুন মার্নি (১৯৬৪) ছবিতে। সেখানে বার্কস দেখালেন মূলত লাল আর হলুদ রং ব্যবহার করে টেলিফটো লেন্স আর ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স দিয়ে ছবি তৈরির মুন্সিয়ানা। এবং এই দুটো ছবিতেই কিন্তু স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স দারুনভাবে ফুটে উঠেছে, যা হিচককের ব্রান্ড স্টাইল। মার্নি ছবিতে ক্লোজ-আপে এক দীর্ঘ চুমুর দৃশ্য, যেখানে শুধু ঠোঁটে ঠোঁট মিশে যাওয়া, অতি বড় সমালোচকও ওটাকে পর্নোগ্রাফি বলতে সাহস পাবেন না। দুর্ভাগ্য, ১৯৬৮ সালে রবার্ট তার স্ত্রী-সহ এক দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা না গেলে আমরা আরো কিছু ভালো সিনেমাটোগ্রাফি তার হাত থেকে পেতাম।

ক্রাতজ অ্যা ন্ড হুইস্পার্স লাল সাদা ফ্রেম

ক্যামেরাম্যান গানার ফিশার বিখ্যাত সুইডিশ পরিচালক ইঙ্গমার বার্গম্যানকে ছেড়ে ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্সে চলে যাবার পর ১৯৬০ সালে সেন নিকভিস্ট প্রথম বার্গম্যানের সঙ্গে ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’ ছবিতে কাজ করতে শুরু করেন। একে একে বেশ কিছু ছবি, এবং ‘ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস’ ছবিতে নিকভিস্ট অস্কার পাবার পর সব জায়গায় লেখা শুরু হয় বার্গম্যানের ছবির কাব্যিক আলোময় ক্যামেরার পেছনে নিকভিস্ট না থাকলে সেগুলো সম্ভব হত না। এরপর হলিউড থেকে নিকভিস্টের কাছে একে একে অফার আসতে থাকে। যদিও উনি ১৯৮২ সালের ‘ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার’ অবধি বার্গম্যানের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, কিন্তু তারমধ্যে রোমান পোলানস্কি, উডি অ্যালেন ইত্যাদি অনেকের সঙ্গেই ওনাকে কাজ শুরু করতে হয়েছিল।

বলা হয়ে থাকে ফিশার যেমন তার ক্যামেরায় অন্ধকার বেশি পছন্দ করতেন, নিকভিস্ট একদম উল্টোদিকে হেঁটে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান পেইন্টারদের মত স্বাভাবিক ও উজ্জ্বল আলো বেশি পছন্দ করতেন। সাদা কালো যে  যে ছবি বানিয়েছেন, তার মধ্যে আলো বেশি। ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস শুধুমাত্র সাদা আর লাল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, সেটা দর্শকরা নিশ্চয়ই জানেন। তেমনি ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার নিয়ে বলা হয়ে থাকে ‘The camera is about the point-of-view in the storytelling. That’s what Nykvist and Bergman understood. Where they place the camera creates the point of view for the audience’। সুতরাং আরেকবার অস্কার। উনি যখন মারা যান, লেখা হয়েছিল - দ্য মাস্টার অব লাইট ইজ নো মোর।

এই লেখার ১৭ আর ৩৭ নম্বর পর্বে একজন রাশিয়ান পরিচালককে নিয়ে বলেছিলাম – সারা জীবন মাত্র ৭ খানা ছবি, তার মধ্যে শেষ দুটো দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর, তবুও সাহসী ও ব্যতিক্রমী। আন্দ্রেই তারকোভস্কি। এও বলেছিলাম, ক্যামেরার স্লো মোশনে উনি সময়কে ফ্রেমবন্দী করার চেষ্টা করেন। ফ্রেমে প্রাণবন্ত ছবি ছাড়াও তারকোভস্কির ক্যামেরার কাজ ‘মাইজ-এন-সিন’ বার্তা বহন করে, যা প্রতি ডিটেলিংয়ের  দিকে ধীরগতিতে নজর দেয়। অভিনেতাদের ঠিক মুখের সামনে ক্যামেরা রেখে আস্তে আস্তে মুভমেন্ট, একটা ক্ষয়ে আসা ল্যান্ডস্কেপের সামনে বা পুড়ে যাওয়া বাড়ির দৃশ্যে ক্যামেরার ধীরগতি – সময়কে আপনা থেকেই থামিয়ে দেয়। ওনার সুইডেনে করা একমাত্র ছবি ‘দ্য স্যাক্রিফাইস’ (১৯৮৬)-এর ক্যামেরার পেছনে ছিলেন সেন নিকভিস্ট। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে উনি কি বলেছিলেন শুনুন – ‘The Russian director has scenes that run 7, 8 or 9 minutes, as a rule; and it is not just the camera that moves – within the shot itself there is constant movement. Usually we film the establishing shot and then a large number of close-ups are cut into it. With Tarkovosky everything is complex. He devotes a great deal of time to the mise-en-scene and the overall atmosphere within the frame, and this is much more interesting, both from a technical and an artistic standpoint, but it takes a lot of time.’। এবার ভাবুন, এহেন তারকোভস্কির প্রথম ৩-টে ছবির (এবং ১-টা শর্ট ফিল্ম) রাশিয়ান সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন ভাদিম ইউসেভ। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ভাদিমের ধৈর্য এবং টেকনিক, দুই’ই ছিল। নইলে তারকোভস্কির সাথে কেউ ৩-টে ছবি করতে পারে না।

সোলারিস লং শট

ভাদিম প্রথম থেকেই ক্যামেরার সামনের চরিত্রদের আর আবহের পুরো পরিবেশকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন, মনে করতেন এদের আলাদা করা যায় না। তাই তারকোভস্কির মতই তারও পছন্দ ছিল ধীরগতিতে ক্যামেরার চলন। ইভান’স চাইল্ডহুড ছবিতে কিভাবে গ্রাউন্ড লেভেলের নিচে ক্যামেরা রেখে শুট করা যায়, সোলারিসে লাইব্রেরীর মধ্যে জিরো গ্র্যাভিটি সিনে ক্যামেরা আর মুখ্য চরিত্রদের আলাদা ক্রেনে রেখে আলাদা স্পিডে তোলা নামানো, সাদা-কালো আর সেপিয়া কালার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, বেশ কয়েক মিনিটের লং শট, এগুলো ভাদিমের কিছু অনবদ্য কাজ। সিনেমার সাইকোলজির সঙ্গে ক্যামেরার মুভমেন্ট ভাদিমকে অন্য ক্যামেরাম্যানদের থেকে আলাদা করেছে।

তাহলে মুশকিলটা কোথায় হয়েছিল? কেন ৩-টে ছবির পর তারকোভস্কি আর ভাদিমের জুটি আলাদা হয়ে গেছিল? কারণ, নিকভিস্টের লেখাটা আরেকবার পড়লে বুঝবেন, তারকোভস্কি তার ক্যামেরাম্যানকে বিশেষ  কোন স্বাধীনতা দিতে চাইতেন না, যেহেতু উনিও পোলারয়েড ক্যামেরায় পারদর্শী ছিলেন। আর ভাদিম ছিলেন ওনার থেকে বয়সে বড়, এক রাশিয়ান সিনেমাটোগ্রাফি কলেজের প্রফেসর, ক্যামেরার পেছনে চোখ রেখে নিজের জায়গাটা খুব ভাল বুঝতেন। ফলে ঠোকাঠুকি, এবং সোলারিস-এর পর দুজনে আর একসঙ্গে কাজ করেননি।

স্ট্যানলি কিউব্রিক হলিউড ছেড়ে ব্রিটেন চলে যাবার পর যখন ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮) বেশ খানিকটা করে ফেলেছেন, তখন ব্রিটিশ ক্যামেরাম্যান জন অ্যাল্‌কটের সঙ্গে ওনার পরিচয় হয় এবং সেই ছবিতে জনকে ক্যামেরার পেছনে পাঠানো হয়। এরপর আরো তিনটে ছবি ওনারা একসঙ্গে করেছিলেনঃ এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ (১৯৭১), ব্যারি লিন্ডন (১৯৭৫) এবং দ্য শাইনিং (১৯৮০)।

ব্যারি লিন্ডন মোমবাতির আলোয় স্পেশাল লেন্স

বলা হয়ে থাকে অ্যাল্‌কট ‘ব্যারি লিন্ডন’ শুট করেছিলেন শুধুমাত্র মোমবাতির আলোয়। এই কাজ করার জন্য অ্যাল্‌কট এবং কিউব্রিক প্রায় একমাস বিভিন্ন লেন্স এনে মোমবাতির আলোয় টেস্ট করেন, অবশেষে NASA অ্যাপোলো মহাকাশযানের চাঁদে নেমে ছবি সংগ্রহ করার জন্য কম আলোয় যে ফটোশুট লেন্স তৈরি করেছিল, সেই লেন্স দিয়ে ছবির শুটিং হয়েছিল। এছাড়াও উনি দ্য শাইনিং ছবির জন্য কিউব্রিকের হ্যান্ডিক্যামে এক  বিশেষ যন্ত্র বসিয়েছিলেন, দেহের ওপর ক্যামেরা স্টেবিলাইজার মাউন্ট করে সেটার সাহায্যে মসৃণভাবে হ্যান্ডিক্যাম চালাতে শিখিয়েছিলেন। এবং এই কৌশলের নাম রাখা হয় ‘স্টেডিক্যাম’। স্টেজ লাইটিং পছন্দ করতেন না, চাইতেন আলো যেন স্বাভাবিক হয়। স্পেস ওডেসি সিনেমায় স্পেশাল এফেক্ট আনার জন্য সেই সময়ে অ্যাল্‌কট ব্যবহার করেছিলেন ফ্রন্ট প্রোজেকশন, যা তখন কেউ করত না। শুটিং-এর সময় চরিত্রদের সামনে একটা বিশাল স্বচ্ছ কাচ রেখে তার মধ্যে দিয়ে আবহের ফুটেজ তুলে ধরা, ১৯৬৮ সালে কেউ ভাবতেই পারত না। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে অ্যাল্‌কট হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবার পর ছ’জন বিখ্যাত ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে এক ডকু ফিল্ম তৈরি হয়েছিল ‘সিক্স কাইন্ডস অব লাইট’। ওনার কিছু ছবি তার মধ্যে জায়গা পেয়েছিল। মানতেই হবে, অ্যাল্‌কট লেন্স এবং আলো, এই দুয়ের যুগলবন্দীকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।

সামনের পর্বে বাকি ৬ জনকে নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু একজন বাঙালিকে নিয়ে সবার শেষে বলতেই হবে, নইলে সিনেমাটোগ্রাফির অপমান। সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র। বলা হয়ে থাকে সবার প্রথম ‘বাউন্সিং লাইট’ ধারণাটা ১৯৫৪ সালে উনিই শুরু করেছিলেন।

(ক্রমশ)

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরজী ছবি

 


(সপ্তম পর্ব)

কলকাতায় কনিষ্ঠতম ৭০ মিমি প্রেক্ষাগৃহ

কলকাতায় দু’টি সিনেমা হলে – একটি বোধহয় এখনও আছে, আর একটি অধুনালুপ্ত – তাদের সারিয়ে নবরূপদানের আগে এবং পরে গেছিঃ হুমায়ুন প্লেসে নিউ এম্পায়ার আর চৌরঙ্গীর ওপর টাইগার। এর মধ্যে নিউ এম্পায়ার নিয়েই প্রথমে কথা হবে, কারণ এটি ১৯৭০ সালে ‘Home of Warner Bros. 7 Arts’ পরিচয় নিয়ে, গ্লোবের মতো প্লাস্টিক পেন্ট করা ৭০ মিমি প্রোজেকশানের উপযুক্ত wall নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।

দ্বিতীয় পর্বেই বলেছি যে, এর আগে, নিউ এম্পায়ারে সাদা পর্দার পেছনে ছিল মঞ্চ, যেখানে অনেক সময় নাটক বা সঙ্গীতানুষ্ঠান হতো। এখানে দেখা কিছু ইংরাজী ছবির নামও ঐ পর্বে উল্লেখ করেছি। নবরূপদানের আগে এখানে অনেক ছবিই দেখেছি। সবচেয়ে বেশী মনে আছে আমার দেখা প্রথম The Three Stooges-এর ছবি The Outlaws Is Coming, আর ডাইনোসরদের নিয়ে দুটি ছবি । প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রেক্ষাপটে One Million Years B. C., দেখেছিলাম ১৯৬৮ সালে, ও ১৯৭০ সালে দেখা, আধুনিক সময়ের পটভূমিতে The Valley of Gwangi।

১৯৭০-এর দ্বিতীয়ার্ধে নিউ এম্পায়ার মঞ্চ তুলে দিয়ে পুরোপুরি সিনেমা হল হয়ে গিয়ে সর্বপ্রথম নিয়ে এল হলিউডে আমার সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা জন ওয়েন অভিনীত Chisum, যে ছবি ঠিক ঐ বছরেই বিদেশে মুক্তি পেয়েছিল। অর্থাৎ, আগের মতো অন্তত এক বছরের – কখনও চার-পাঁচ বছরের – অপেক্ষার দিন শেষ হয়েছিল, অন্তত কিছু ছবির ক্ষেত্রে। ১৮৭৮ সালে ঘটে যাওয়া Lincoln County War ছবির বিষয়বস্তু। ওয়েন অভিনীত ইতিহাসে নাম-থাকা চরিত্রের – John Chisum - পাশাপাশি একাধিক এমন কিছু কুশীলবদের আমরা দেখতে পাই যাদের নামও ইতিহাসে পাওয়া যাবে – যেমন Billy the Kid এবং বাস্তবে যার হাতে বিলির মৃত্যু ঘটেছিল (এই ছবিতে নয়), সেই Pat Garrett, ইত্যাদি।  একটি অসাধারণ Western, মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম। দেখতে ঢুকে দেখি দেওয়ালে ছবিটি নির্বাক অবস্থায় চালিয়ে দেখে নেওয়া হচ্ছে – বোধহয় নবরূপলাভের পর উদ্বোধনের দিনেই দাদার সঙ্গে গিয়েছিলাম। তবে, যতদূর মনে পড়ছে, ছবির প্রোজেকশান পুরো ৭০ মিমির বড় দেওয়াল জুড়ে ছিল না – সিনেমাস্কোপেই দেখানো হয়েছিল।

দেওয়াল জুড়ে প্রোজেকশান দেখেছি নিউ এম্পায়ারে দেখা জন ওয়েন-অভিনীত এর পরের একাধিক ছবিতে। তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় ১৯৭২ সালে আমার বৌদির সঙ্গে দেখা The Cowboys। এটিও ঐ একই বছরে বিদেশে মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম ডেল জেনিংস রচিত উপন্যাসের ওপর আধারিত এই ব্যতিক্রমী Western-এ হলিউডের অন্যতম ‘স্টার ওয়েন অনেকটাই কাহিনির পশ্চাদভূমিতে, পুরোভাগে একদল বালক-কিশোর। সাময়িক gold rush-এর জন্য নিজের গবাদি পশুদের ৪০০ মাইল তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে লোকের অভাবে উইল অ্যানডারসেন (ওয়েন) বাধ্য হন স্থানীয় ইস্কুল থেকে দশজন, এবং বাইরে থেকে এই ছেলেদের চেয়ে কিছু বড় আরেকজন, শিশু-কিশোরদের নিযুক্ত করতে। পথে ছেলেদের সঙ্গে উইলের সম্পর্কের বিবর্তন, ছবির বিয়োগান্ত সমাপ্তির আগে তাদের চোখে উইলের কঠোর কিন্তু স্নেহময় পিতায় বিবর্তিত হওয়া ছবির বিষয়। আমার মতো ওয়েন-ভক্তদের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল খলচরিত্রের গুলিতে উইলের মারাত্মকভাবে আহত হওয়া এবং অবশেষে তাঁর মৃত্যু!

এছাড়া ওয়েনের ছবি নিউ এম্পায়ারে দেখেছি আরেক Western-কমেডি The Train Robbers, যার কাহিনির শেষে খুব উপভোগ্য চমক ছিল, আর Western ছবি ধীরে-ধীরে অচল হয়ে যাবার কারণে Clint Eastwood-এর হ্যারি ক্যালাহান-নামক পুলিশ-গোয়েন্দার আদলে সৃষ্ট McQ চরিত্র-কে নিয়ে রহস্য ছবি।

ক্লিন্ট ইস্টউডের Dirty Harry-ও স্কুলের সহপাঠী-বন্ধু রাহুল চৌধুরীর সঙ্গে এই প্রেক্ষাগৃহে দেখেছি, তবে ছবিটির প্রথম মুক্তির সময়ে নয়, কয়েক বছর বরে যখন সেটি পুনর্মুক্তি লাভ করে। রাহুল তখন পরপর ‘Adults Only’ মার্কা ছবি দেখতে বদ্ধ-পরিকর! আমার এই বন্ধুর কথা আমার বাংলা ছবি দেখার প্রসঙ্গে এসেছিলঃ কিভাবে আমাকে স্বাতী দেখতে না দিয়ে, জোর করে আনন্দ আশ্রম দেখতে বাধ্য করেছিল (কারণ প্রথমবার ঐ ছবি দেখতে গিয়ে তার পেট হড়কেছিল)!

ইস্টউড খ্যাতিলাভ করেছিলেন Western ছবি করে – তাঁকে অনেকে ঐ জঁরের ছবিতে জন ওয়েনের উত্তরসূরি (তবে ওয়েনের ‘কাউবয় চরিত্রের একেবারে বিপরীতধর্মী উত্তরসুরি) বলে থাকেন। ইস্টউডের আমার দেখা প্রথম দেখা Western ঐ নিউ এম্পায়ারেইঃ এম এর ক্লাস কেটে (সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকের পড়ানো একেবারেই ভালো লাগত না!) The Outlaw Josey Wales। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পাশবিকতায় স্ত্রী-সন্তান হারানো জোসি ওয়েলসের Outlaw-এর জীবন যাপন।

১৯৭৩ সালে ইস্কুলের প্রান্তিক পরীক্ষা – আই এস সি, তখনও বলা হতো ‘সিনিয়র কেম্ব্রিজ – শেষ হবার পর তিন সহপাঠী মিলে – উদ্যোগ ছিল সেই রাহুলের – দেখলাম রাশিয়ার তৈরি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-সংক্রান্ত ছবি Battle for Berlin, যা Liberation-নামের সিরিজের চতুর্থ ছবি। চমকপ্রদ ছিল উক্ত সময়ের রাষ্ট্রনেতাদের চরিত্রে আবির্ভূত অভিনেতাদের বাস্তব চরিত্রগুলির সঙ্গে অদ্ভুত চেহারাগত সাদৃশ্য, বিশেষ করে যে অভিনেতা স্ট্যালিন হয়েছিলেন, তাঁর ক্ষেত্রে।

১৯৭৮ সালের পর মাকে সঙ্গে নিয়ে নিউ এম্পায়ারের বড় দেওয়াল জুড়ে পরপর দেখেছি ক্রিস্টোফার রীভ-রূপায়িত Superman-কে নিয়ে তিনটি ছবি, যার মধ্যে দ্বিতীয়টিই আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছিল। সাময়িক ভাবে প্রেমিকা লোইস লেনের সঙ্গে ঘর-বাঁধার স্বপ্নে ক্যাল-এল (ভিনগ্রহী সুপারম্যানের পিতৃদত্ত নাম) যাবতীয় পরাশক্তি বিসর্জন দিয়ে তারপর বিপাকে পড়ছে।

ঠিক এইভাবেই, আশির আর নব্বইয়ের দশকে যিনি প্রথমে ছিলেন আমার হবু-স্ত্রী এবং পরে গৃহিণী, এবং তারপর তাঁকে আর শ্যালিকা-শ্যালককে নিয়ে এই প্রেক্ষাগৃহে পরপর দেখেছি Batman, Batman Returns, আর Batman Forever।

আগে, মার সঙ্গে এখানে দেখেছি এককালে জেমস বন্ড-করে খ্যাত শন কনারি অভিনীত কল্পবিজ্ঞান আখ্যান Outland, যার ঘটনাক্ষেত্র বৃহস্পতি গ্রহের অন্যতম উপগ্রহ আয়ো, যেখানে পাকাপাকিভাবে মনুষ্যবসতি শুরু হয়ে গেছে, এবং যেখানে মানুষ নিজের অপরাধ-প্রবণতা পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখেছে!


বড় দেওয়াল-জোড়া না হলেও উল্লেখের দাবী রাখে Warner Bros.-এর দ্বারা মুক্তিপ্রাপ্ত, ব্রিটেনের Hammer-সংস্থা নির্মিত ‘ড্র্যাকুলা সিরিজের ছবি, যা এই নিউ এম্পায়ারেই মুক্তি পেত। আমার চোখে বড় পর্দায় এক এবং একমাত্র ড্র্যাকুলা, no one else Counts, ক্রিস্টোফার লী-রূপায়িত দুটি ছবি এখানে দেখেছি, যে দুটিতে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই রক্তপিপাসু কাউন্টকে এনে ফেলা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর লন্ডন শহরে – Dracula A. D. 1972 (বেশ ভয় পেয়েছিলাম, পর্দায় কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া ড্র্যাকুলা আর ভ্যান হেলসিং-রূপে লী এবং পিটার কাশিং-দের সংঘাত দেখে) আর The Satanic Rites of Dracula (একটি দৃশ্য – বাড়ির ভূগর্ভে একের পর এক কফিনের ডালা খুলে রক্তশোষিকাদের উঠে এসে ভ্যান হেলসিং-এর নাতনী জেসিকাকে আক্রমণ – ছাড়া তেমন জমে নি!)

এছাড়া মার খুব ভাল লেগেছিল Dark Shadows সিরিজের দ্বিতীয় ছবি Night of Dark Shadows, যাতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ডাইনি হওয়ার – এবং নিজের দেবর বা ভাসুর Charles-এর সঙ্গে পরকীয়া করার – অপরাধে ফাঁসিতে চড়া Angelique-এর প্রেতাত্মা ফিরে আসে Quentin Collins-রূপে পুনর্জন্ম-প্রাপ্ত নিজের প্রেমিকের ওপর দাবী নিয়ে, যার ফলে Quentin-এর স্ত্রী Tracy-র জীবন হয়ে ওঠে বিপন্ন!

সম্ভবত নিউ এম্পায়ারে দেখা আমার শেষ ছবি হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম কিস্তিঃ Harry Potter and the Philosopher’s Stone।

নতুন বিদেশী ছবি ছাড়াও পুনর্মুক্তি-প্রাপ্ত কিছু ক্ল্যাসিক ছবিও দেখেছি নবরূপী নিউ এম্পায়ারেঃ

১৯৫২ সালের কমেডি-Western Son of Paleface, অভিনয়ে বিখ্যাত কৌতুক-শিল্পী বব হোপ, আর ছোটবেলায় যাঁকে নিয়ে একাধিক গল্পের বই আর কমিকস দেখেছি, সেই Roy Rogers ও তাঁর অসাধারণ ঘোড়া Trigger। ডাকাতরাণী নায়িকার ভূমিকায় জেন রাসেল (যাঁকে ব্যক্তিগত-ভাবে আমার ম্যারিলিন মনরোর চেয়ে অনেক বেশী আকর্ষণীয় লাগে)।

১৯৪০ সালের বিয়োগান্ত প্রেম-কাহিনি Waterloo Bridge, ১৯৩০ সালের নাটক, আর তার থেকে হওয়া ১৯৩১ সালের চলচ্চিত্রের পুনর্নির্মাণ, অভিনয়ে ঠিক তার আগের বছর, ১৯৩৯-এ, স্কারলেট ওহারা চরিত্র রূপায়িত করে সাড়া ফেলে দেওয়া Vivien Leigh, আর নায়কের ভূমিকায় Robert Taylor।

১৯৩৯ সালের যুগান্তকারী ছবি Gone with the Wind, যা প্রথম দেখেছিলাম এলিট সিনেমার ৭০ মিমি পর্দায় ১৯৬৮ সালে বাবা-মা-দাদার সঙ্গে। নিউ এম্পায়ারে দেখলাম শ্বশুরবাড়ীর সকলকে নিয়ে, তবে এবার ৩৫ মিমি প্রোজেকশানে।

নিউ এম্পায়ারে বিদেশী ছবি ছাড়াও একবার ফিল্মোৎসবের সময়ে দেখেছি একাধিক পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী ছবি, বেশীর ভাগ তিরিশ অথবা চল্লিশের দশকে তৈরি, যেমন নিউ থিয়েটার্সের অধিকার (প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ও অভিনীত, সঙ্গে যমুনা দেবী, মেনকা দেবী, পাহাড়ী সান্যাল, পঙ্কজ মল্লিক), বিদ্যাপতি (নাম-ভূমিকায় পাহাড়ী সান্যাল, রাজার ভূমিকায় দুর্গাদাস, রাণী ছায়া দেবী, বিদূষক অমর মল্লিক, এবং, সবাইকে ম্লান করে দিয়ে অনুরাধা-রূপে কানন দেবী), বম্বে টকীজের অছূত কন্যা (নাম ভূমিকায় দেবিকা রাণী, আর বিপরীতে অশোককুমার), সোহরাব মোদি পরিচালিত  এবং অভিনীত পুকার।

(ক্রমশ)


তপজা মিত্র

 

‘টেক্কা’, ‘বহুরূপী’, ‘শাস্ত্রী’র ত্র্যহস্পর্শ  কি বাঁচাতে পারবে বাংলা ছবিকে?


 Welfare economicsএর জন্ম হয়েছিল বস্তুনিষ্ঠ রাষ্টব্যবস্থার ত্রূটি মেরামত করার জন্য। welfare cinema সেই ভিত্তিভূমির সন্তান। নব্য সিনেমার আন্দোলন যেখানে ভিত্তোরিয়ো দি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভসে’র উড়ান নিশ্চিত করেছিল, যেখানে সিনেমা নিজস্ব ঘেরাটোপ থেকে, ঘূর্ণায়মান আবর্ত থেকে বের হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে সেখানে ভাষা সম্পূর্ণ স্বকীয়তা অর্জন করে। সেই আপন বাংলাভাষায় বাস্তবতার প্রক্ষিতে জন্ম নেয় রুচিকর মুহূর্ত। সিনেমা হয়ে ওঠে রুচিশিল্প। এখনকার ক্রমবর্ধমান বাস্তবতার ক্যানভাসে অনেক ছবির ভিড়। এমন ভিড় আগেও ছিল, এখনও আছে। এই ভিড়ের মধ্যে প্রকূত সিনেমার মেরুদণ্ড কোনটি, সেটা দেখার দরকার।

‘টেক্কা’য় মাছের বাজারে দরদাম করা পুলিশ, রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অমানবিক ম্যানেজার, ইগোসর্বস্ব দুর্নীতিবাজ রাজনীতির কারবারী - কে নেই! কিন্ত মোটা দাগের। একটি জনবহুল রাস্তা। অপহরণকারী বাচ্চা এক মেয়েকে নিয়ে ছুটছে, পিছনে জনতা। কোনও পুলিশ নেই। এই দৃশ্য আমাদের সমাজের চরম বাস্তব। এমন ঘটনা যখন ঘটে তখন সবসময় কি নগরপালদের দেখতে পাওয়া যায়? সিনেমার সারবত্তা সমাজের বহুধাবিস্তৃত চিত্রায়নের বাইরে নয়। কিন্ত টেক্কার মেজাজ কিছু অগভীর সংলাপের দৃশ্যায়ন। যদিও গান সময়োপযোগী। অভিনয়ে স্বাভাবিকতার মাত্রাকে স্পর্শ করেছেন আরিয়ান, সৃজা, সুজন, লোকনাথ, স্বস্তিকা। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে চমক থাকে। কিন্ত ক্যামেরার নিজস্ব নির্মাণ শৈলী থাকে না। বিশ্ব সিনেমার মানচিত্রে এমন ধরনের ছবির স্থান কোথায়! রুক্মিণী মৈত্রের অভিনয়, তাঁর পর্দাচিত 'আবির্ভাব' অবশ্যই নজরকাড়া, কিন্ত ধ্রুপদী কি? কৌশিক সেন, কমলেশ্বর, পরাণ স্তর বিন্যাসে এসেছেন আবার চলে গিয়েছেন। দাগ কাটলেন কি? পুজোর মরসুমে থ্রিলার বানানোর প্রচেষ্টায় একমাত্র উল্লেখযোগ্য ফসল দেব।  অসম্ভব পরিণত। উদাত্ত। পরিমিত। সবাইকে ছাপিয়ে তাসের দেশে তিনি ‘টেক্কা’ দিয়েছেন। আসলে সৃজিত নিজস্ব একটা ঘরানা তৈরি করেছেন। সেই ঘরানার আধিপত্যে পূর্বসুরীদের প্রভাব খুব একটা নেই। জলসাঘরের মায়াময় আলো আছে। শাস্ত্রীয় সংগীতের আভিজাত্য নেই।



২০১৭ সালের ওয়েব সিরিজ মানি হেইস্ট-এর বঙ্গীয় সংস্করণের প্রচেষ্টায় নন্দিতা-শিবপ্রসাদ সফল জুটি পরিচালক। নব্বই দশক। একের পর এক চটকল বন্ধ। ইউনিয়নের দাপট আর ক্রমবর্ধমান শ্রমিক অসন্তোষ জন্ম দিল ঘটনাচক্রে চটকল কর্মী থেকে ব্যাঙ্ক ডাকাতে পরিণত হওয়া বিক্রম প্রামাণিকের। মিথ্যা খুনের মামলায় ফেঁসে যায় সে। বাড়ির লোকও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। জেলে তাকে বেধড়ক মার মারে পুলিশ অফিসার সুমন্ত ঘোষাল। জেদ চাপে, শোধ তুলতে হবে। এই ছবির মাধ্যমে বহুরূপীর মতো ধুঁকতে থাকা এক শিল্পের পুনর্জাগরণের ইংগিত দেওয়া হয়েছে। লোকশিল্পের মুখোশের আড়ালে যান্ত্রিক সভ্যতার কষ্ট ধরা পড়েছে। কৌশানী, শিবপ্রসাদ, আবীর, ঋতাভরী চার স্তম্ভের বুনিয়াদ neo realismএর টানটান চিত্রনাট্যে সংযত ও ঋদ্ধ।



‘শাস্ত্রী’ ছবির মেরুদণ্ডে মিঠুন চক্রবর্তীর মাপা অভিনয়ের সঙ্গে সোহমের মতো নব্য যুবকের উদাত্ত উচ্চারণ মিশে যায়। বিজ্ঞান ও জ্যোতিষের যুযুধান দ্বন্দ্বে যুক্তিবাদ জিতে যায়। আসলে ভণ্ডামি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তা সে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হোক বা জ্যোতিষের ক্ষেত্রে। ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা আলো ধরতে ভালবাসি।

পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবা অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় মহাপুরুষ ছবিটি নির্মাণ করেন। পথিকৃৎ বসু সত্যজিৎ রায় নন। তাঁর কাছ থেকে মহাপুরুষের আলোকিত উচ্চারণ আশা করা অন্যায়। তিনি সেটা পারবেন না। কিন্ত যেটা পারতেন সেটা করলেন কী? Dissolve বলে film এর একটি ভাষা আছে। আছে pan shot, tilt up, tilt down, long shot, mid long. সেগুলোর মাননীয় অনুশাসন তো প্রয়োগ করা যেত । তা না করে দারুণ বিষয় থাকা সত্ত্বেও কোনও টানটান চিত্রনাট্য কেন তৈরি হল না সেটা পরিচালক হয়ত বলতে পারবেন। অথচ মিঠুন ছিলেন। দাদাসাহেব ফালকে পাওয়া গৌরাঙ্গর পরিমল সান্যাল থেকে পরিমল শাস্ত্রীর কাল পরিক্রমায় তাঁর অভিনয় তো সম্পদতুল্য। সেই গুপ্তধনে হাত না দিয়ে পথিকৃৎ বাণিজ্য করতে চাইলেন, কিন্ত সেটাও হল না। সোহম astrophysicist কিন্ত নেশা ভণ্ড জ্যোতিষীদের মুখোশ খোলা। বিরিঞ্চিবাবায় ধোঁয়ার আড়ালে ছিল সত্যের নির্যাস এখানে সংলাপের পিঠে সংলাপ বসিয়ে নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করতে চেয়েছেন পরিচালক। মিঠুন ও দেবশ্রী জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই অভিনেতার যুগলবন্দিতে জমাটি তবলা লহড়া শোনা গেল না। কত অলংকরণ, বাক্যবিন্যাস, শব্দ তীর যে সঞ্চিত যোদ্ধার তূণে, সময়ে ব্যবহৃত হল না। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ঘেরাটোপে ছবি হারাল কক্ষপথ। তবুও এই সময়ের আবর্তে, ভাসমান জটিল প্রবাহে সিনেমা নামক বৃহত্তম শাস্ত্রে এটি শিরদাঁড়া স্বরূপ কারণ বর্তমান সময়ের সমস্যার কথা সরবে প্রকাশ করেছে, ভয় পায়নি।




মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি-তে প্রতিবাদী মাসের থিয়েটার




 

প্রতি,

এই প্রতিবাদী মাসে থিয়েটারের কথা লিখতে বললেন সম্পাদক কাজল সেনতিনি সবসময়ই থিয়েটারের ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া রীতিটিকে সমর্থন করে চলেছেন। তাই এইসময়ে এক নজরে একজন প্রতিবাদী শিল্পীর কথা তুলে ধরা যাক।

তাঁর সঙ্গে একদিন দেখা হয়। তখন অতিমারি চলছে। চারদিকে মরণের ভয় নিয়ে মেলামেশা বন্ধ। এদিকে থিয়েটারেও তখন দুরবস্থা। বিশেষ গবেষণার কাজে তাঁর কাছে যেতে হবে। ভাবলাম বর্ষীয়ান শিল্পী আমাকে সময় দেবেন কেন? এমনিতে তিনি এতটাই ব্যস্ত থাকেন। সিনেমা, টেলিভশনের কাজ অল্পস্বল্প চলছে। কিন্তু আগের মতো দুরন্ত নয় সেই গতি। তারই মধ্যে তাঁকে পেলাম, তাঁর কাজের ফাঁকে। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা হবে থিয়েটারের কথা নিয়েই। তিনি কেন এতগুলো বছর ধরে থিয়েটারে যুক্ত? ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এটা তো ভাবাচ্ছিল তাঁর কাছে যেতে যেতে …।

থিয়েটারে টিকে থাকা মানে আর্থিকভাবে সংগ্রাম করা। অন্তত বিশশতকের গ্রুপ-থিয়েটারে যখন অভিনেত্রীদের দেখা গেল। একটা লড়াই সামাজিক। প্রশ্ন, কেন থিয়েটারে? কেন আর কোনও চাকরিতে  নয়? একটা লড়াই আর্থিক। কেন থিয়েটারে? কেন অন্য কোনও চাকরিতে নয়?

এই দুই লড়াইয়ের একটাই উত্তর। তা দিতেই থিয়েটারে থাকা।

একটি এর কারণ নির্ণয়ের জন্যে থিয়েটার কর্মীদের মধ্যে ততদিনে কাজ করছেন  রেবা রায়চৌধুরী, শোভা সেন, তৃপ্তি মিত্র এবং আরও অনেকে। এখানের আলোচনা চিত্রা সেন সম্পর্কে।  জন্ম ৫ মে ১৯৩৪।

পারিবারিকভাবে নৃত্য শিক্ষা চলে মণিপুরী, ভরতনাট্যম। মূলত নৃত্যগুরু বালকৃষ্ণ মেনন, শক্তি নাগ।

গণনাট্যে চিত্রা।

নৃত্যশিল্পী হিসেবে শুরু। তখন তিনি চিত্রা মণ্ডল। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-এ যোগদান। নৃত্যশিল্পীরূপে ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণগণনাট্য সংঘের পর, গ্রুপ থিয়েটার পর্ব। যেখানে ছিল আদর্শ, গড়ে ওঠার প্রবচন ছিল। ভাল নাটক করব, ভাল করে করব'

গ্রুপ থিয়েটারের চিত্রা।

থিয়েটার গিল্ড, বিবেক নাট্যসমাজ, চলাচল প্রভৃতি নাট্যদলে।

অভিনয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে 'নীলদর্পণ' নাটকের ক্ষেত্রমণি বা ছোট বউ। সাড়া ফেলে দেন অলকানন্দা চরিত্রটি রূপদান করেনাটক 'অলকানন্দার পুত্রকন্যা' বিখ্যাত অনেক কারণেই। এক্ষেত্রে অভিনেত্রী চিত্রা নাটকে অলকানন্দা-চরিত্রের জন্যে সম্মান পান রাজ্যের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী সম্মান, সাল ১৯৯০। নাটকের দুনিয়ায় তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য চরিত্রে বিখ্যাত।

অতসী, হেমাঙ্গিনী, নয়না, সেনতে সুইতা, অচলা, বনলতা সেন এবং কুন্তী। তাঁর অভিনীত নাটকের নাম যথাক্রমে 'শোভাযাত্রা', 'অলীকবাবু', 'যদুবংশ', 'ভালো মানুষের মেয়ে', 'গৃহদাহ', 'আঁখিপল্লব', 'প্রথম পার্থ'। আবার তিনি পুরস্কৃত হন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি ২০১০ সালে।  নাটক 'জলছবি'

প্রশ্নঃ থিয়েটার মানে তো রিহার্সাল এবং রিহার্সাল। লাইভ অভিনয় বলে কথা। এজন্যে তৈরি হওয়াটা বেশ কঠিন, সময়সাপেক্ষের এবং একটানা করে যাওয়াটাও তো থাকে। খুব শক্ত।

কথা শুনে হেসে বললেন বর্ষীয়ান চিত্রা, দেখো, অভিনয় মানে তো থিয়েটার। মঞ্চ। সেটাই শিখে এসেছি। আমরা তো গণনাটো কাজ করে এসেছি। নৃত্যশিল্পী থেকে একদিন পাঠ পেলাম। অনেক স্ট্রাগল করে অভিনয় চালিয়েছি।

গ্রুপ থিয়েটার চালাতে গিয়ে অফিস ক্লাবে অভিনয় করেছি। আর ক্যামেরায় কাজে অনেক পরে এসেছে দূরদর্শন, সিনেমার পর্দা। এবং যে মাধ্যমে যতটুকু আজ অভিনয়ের কথা বলছি সবটাই তো মঞ্চে শেষ। কথা বলা, মেপে কথা বলা, স্বরক্ষেপণ। শরীর সুস্থ রাখা। সবটাই তো থিয়েটার শিখিয়েছে। ফলে, এটি  প্রথম পছন্দের। রক্তে মিশে গেছে। বোধে মিশে গেছে। আলাদা করে উল্লেখের দরকার নেই যে থিয়েটার আমার সত্তায় মিশে গেছে।

প্রশ্নঃ গ্রুপ থিয়েটারের চিত্রা থেকে চিত্রা-র থিয়েটার?

নাট্য-বিশ্লেষক এবং রঙরূপ দলের প্রধান অভিনেত্রী, নাট্যকার ও নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায়-এর কথায়,

চিত্রাদি, একজন কমপ্লিট আর্টিস্ট। নিয়মানুবর্তিতা যেমন, তেমনই হলেন বড় মাপের চিন্তক। কেমন, উদাহরণ, চিত্রাদি রিহার্সালে আগে পৌঁছে গিয়ে ঘর ঝাঁট দিয়ে সাফ করেন। এবং হাসিমুখে সবার জন্যে অপেক্ষা করেন। ১৯৩৪ সাল থেকে ২০২১ সাল। কত বছর? অভিনয় করতে থাকাটাই একটা লড়াই। নয়?”

প্রশ্নঃ গ্রুপ থিয়েটারের চিত্রা থেকে চিত্রা-র থিয়েটার?

নাট্য-বিশ্লেষক এবং সংলাপ কলকাতা দলের প্রধান অভিনেতা, নির্দেশক কুন্তল মুখোপাধ্যায়-এর কথায়, “রবীন্দ্র- উত্তরকালে গ্রুপ থিয়েটারে অভিনেত্রীদের এক বিশেষ স্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়। থিয়েটারে টিকে থাকার জন্যে চিত্রাদি অন্য মাধ্যমে কাজ করেননি। উনি দল, মানে শ্যামল সেন এর গ্রুপ থিয়েটার দল স্বপ্নসন্ধানীর জন্যেই উপার্জন করেছেন। সে খুব কঠিন সময় পার করেছেন। এবং তাঁর ভূমিকা একারণেই স্মরণীয় যে, তিনি চলচ্চিত্র, ছোট পর্দা, বেতার মাধ্যমে কাজ করলেও, বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন গ্রুপ থিয়েটারকেই। তাই ২০২১ শে উনি 'জলছবি' অভিনয় করেন। মানে করতে পারেন সাবলীলভাবেই। ওঁর অভিনয় দেখে তো বোঝার উপায় নেই, ওঁর বয়স কত

থিয়েটার মানে সময়ের হাতে অভিনেতা। এবং অভিনেত্রীও। সেটাই এক লড়াই এবং লড়াইয়ের ব্যাটন রইল দর্শকের হাতেই

এই কিস্তির লেখা যখন শুরু করেছিলাম, তখন মাননীয় লেখক-সম্পাদক কাজল সেনের ‘কালিমাটি অনলাইন’এর পাতায় প্রথম কিস্তিতে ছিল দর্শক। আমাদের যা কিছু লড়াই সব ধরা থাকে সময়ে যেমন, তেমনই দর্শকের কাছেও। তাই ফিরে দেখার এই ইতিহাস দর্শকের কাছের। 

 _ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী

(ছবি সৌজন্যঃ চিত্রা সেন ও সীমা মুখোপাধ্যায়)   

 

 


মধুবন চক্রবর্তী

 

বাংলাসাহিত্যে প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক হানা ক্যাথরিন মুলেন্স এবংন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী

 


বাংলা উপন্যাস লেখা শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে। ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিণত হয়েছিল। একটি বিশেষ ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে বাংলা উপন্যাস।  ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলো ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ নামক গ্রন্থ, যা বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবেই গণ্য হয়। ‌কেউ কেউ বলেন, প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। রবীন্দ্রনাথের থেকে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। সাহিত্যে যখন পুরুষদের দাপট, সেই সময় স্বর্ণকুমারী দেবী পুরুষ মহলে নিবিড় এক সাহিত্যচর্চার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। সেই সাহিত্যচর্চার প্রতিবেশ প্রবেশ করেছিল অন্দরমহলে যা স্বর্ণকুমারীকে স্পর্শ করেছিল প্রগাঢ়তার সঙ্গে। অনুপ্রেরণা দিয়েছিল সাহিত্য চর্চায়। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস হলো দ্বীপনির্বাণ’ যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। পরিসংখ্যান বলছে, ইতিপূর্বে ১৮৫২ সালে হানা  ক্যাথরিন ম্যলেন্স তাঁর প্রথম উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন। যার নাম ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’। উপন্যাসটি প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন তিনি। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক, যিনি কবিতা নাটক সহ সাহিত্যের বিভিন্ন আঙিনায় রচনার ক্ষেত্রেও সাবলীল ছিলেন। ‌এদিকে হানা ক্যাথরিন মুলেন্ সম্পর্কে বলতে গেলে সত্যি বড় অবাক হতে হয়।  এখানে অবাক আর মুগ্ধতা কোনটা বলবো? দুটোই প্রকারান্তরে একই অর্থ বহন করে, কিন্তু মুগ্ধতার মধ্যে রয়েছে বিস্ময়, এক অসম্ভবকে সম্ভব করার মধ্যে যে আনন্দ থাকে উচ্ছ্বাস থাকে। সেই বিষয়টাই প্রতিষ্ঠিত হয় মুগ্ধতার মধ্যে। একজন অবাঙালি হয়ে বাংলাসাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা তাও আবার বাংলা সাহিত্যের মূলধারা উপন্যাসে, যা আমাদের মুগ্ধ করে। সর্বোপরি একজন মহিলা হয়ে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে। তবে বাংলাভাষার প্রতি তাঁর এই অমোঘ টান বাংলা ভাষাকে কি যথার্থ সম্মান দিতে পেরেছে? এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় আপামর বাঙালিকে? ক'জন মনে রেখেছেন এই নারীকে? হানা ক্যাথরিন মুলেন্স ছিলেন সুইস নারী। বাবা ফ্রাসোঁয়া ল্যক্রোইকস একজন সুইস পাদ্রী ছিলেন, যিনি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন মিশনারি সোসাইটির তরফে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের চুঁচুড়া যাত্রা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, অনুবাদক ও নানা মিশনের নেত্রী ছিলেন। সেইসঙ্গে মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করেছিলেন। নারী শিক্ষার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। নারী জাগরণ, নারীর শিক্ষা, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হানা ক্যাথরিন ম্যলেন্স বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতায়। মেয়েদের একটি বোডিং স্কুলের প্রধান ছিলেন তিনি। বাইবেলের ক্লাস নিতেন। তাঁর উপন্যাস ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’  গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টান মহিলাদের জীবন যাপনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। উপন্যাসটিতে বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের নিখুঁত বিবরণ তুলে ধরা হয়। ভারতের একটি অঞ্চলের বাঙালি খ্রিস্টান নারীদের জীবন কথা, উপন্যাসের মূল উপজীব্য। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপন্যাসটির গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে, বিশেষ করে সাহিত্য অনুরাগী পাঠকের কাছে বিশেষ মর্যাদারও দাবি রাখে।



যদিও ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ গ্রন্থটি  মূলত ইংরেজি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত, কিন্তু বইটির উল্লেখ বাংলা রচনার বিভিন্ন তালিকাগ্রন্থে পাওয়া যায়। কিন্তু মূল রচনাটি দুষ্প্রাপ্য। ১৯৫৮ সালে বিশিষ্ট গ্রন্থাগারিক  এবং প্রাবন্ধিক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বইটি প্রকাশিত হলে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবে এর দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায়, লন্ডন মিশনারি  সোসাইটির সুইস সদস্য রেফারেন্ড ফ্রঁসোয়া লাক্রোয়া খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে ১৮২১ সালে চুঁচুড়ায় আসেন, তার পাঁচবছর পর কন্যা ক্যাথরিনের জন্ম হয়। দীর্ঘদিন বাংলায় বসবাসের সুবাদে, ধীরে ধীরে হানা ক্যাথরিন বাংলাভাষায় অভ্যস্ত হতে থাকেন। বাংলা ভাষা তাঁর কাছে হয়ে ওঠে আপনজন। বাংলা বাঙালিকে ভালোবেসে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন। পরে ভবানীপুর মিশনের স্কুলে দেশি ক্রিস্টান ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়াতেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে মিশনের অপর কর্মী  যে মুলেন্সের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি খ্রিস্টান মহিলাদের জীবন নিয়ে লেখা ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান ট্রাস্ট এন্ড বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসটি প্রায় বারোটি ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষায় অনূদিত হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খ্রিস্টানদের বিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়। তাঁর এই উপন্যাস মূলত ইংরেজি  গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছিল। তবে গ্রন্থটি মৌলিক রচনা না অনুবাদ মূলক, সেই নিয়ে কিন্তু পরবর্তীক্ষেত্রে বিতর্ক তৈরি হয়। ক্যাথরিন কি নিজে এই বইটি লিখেছিলেন? না অন্য কেউ তার নামে লিখেছিলেন? ১৯৫৯ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগারের একটি তাক থেকে একই লেখিকার 'বিশ্বাস বিজয়' নামে একটি পুঁথি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটি ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণে’র ইংরেজি রচনার বঙ্গানুবাদ।

১৮৪৫ সালের ১৯শে জুন মিশনের কর্মী মি .জে মুলেন্সের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহের পর থেকে তাঁর নামের শেষে মুলেন্স সংযুক্ত হয়। এই সময় তিনি মহিলাদের স্কুল পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। মিশন  স্কুলের শিক্ষায়ত্রী হয়েও  বাঙালি মেয়েদের দেশীয় সংস্কৃতি ও প্রথায় জীবনযাপনে উৎসাহ দিয়েছেন। ১৮৫৪ তে তাঁরই উৎসাহে কলকাতায় জেনানা মিশন স্থাপিত হয়। এই মিশনের কাজ ছিল কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবারের অন্দরমহলে গিয়ে মহিলাদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দেওয়া। কলকাতার নারীশিক্ষার কেন্দ্রগুলির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এছাড়া ১৮৫১ এবং ১৮৫৬ সালে 'TRAVELS OF A BIBLE' and

‘DAY BREAK IN BRITAIN' তাঁর আরও দুটি বই বাংলায় অনুবাদ করেন। পাশাপশি তাঁর আর একটি বই

‘বিশ্বাস বিজয়’ অর্থাৎ বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্মের গতির রীতি প্রকশার্থ উপাখ্যান, সেটিও প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর একাগ্রতা অগাধ ভালোবাসা তাঁকে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। তাঁর প্রথম  উপন্যাস নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক থাকলেও, তাঁর কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না। একসময় সুকুমার সেন বলেছিলেন, "বইটি আকারে প্রকারে উপন্যাসের মত। বাংলায় উপন্যাসোপম প্রথম আখ্যান রূপে তাই  ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

হানা ক্যাথরিন মুলেন্সকে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও, স্বর্ণকুমারী দেবীকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য বাঙালি মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে পরিগণিত করা হয়।

১৮৭৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্বীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়, যা স্বর্ণকুমারী দেবীর অল্প বয়সের রচনা। ‘দ্বীপনির্বাণ’ ছিল জাতীয়তাবাদী ভাবে অনুপ্রাণিত এক উপন্যাস। স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্য প্রতিভা ছিল  বিচিত্রমুখী। উপন্যাস, কবিতা নাটক, গল্প সাহিত্যের বিচিত্র প্রকরণেই তাঁর পারদর্শিতা প্রমাণিত হয়। সাময়িক পত্র সম্পাদনাতে ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর সম্পাদিত 'ভারতী’ পত্রিকাও সমকালে বেশ গুরুত্ব লাভ করে। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে নবজাগরণ যুগের নারী চেতনার প্রতিমূর্তি ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী।

এই দুই মহীয়সী নারীকে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম

 


মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধর্ষণ সংস্কৃতি ও ধর্ষকের মনস্তত্ব




যাপনচিত্র দুইয়ে আমরা দেখব যে ঘটনাটা সেটা এই রকম একজন মহিলা জানিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা তিনি বলছেন, বিশেষ কারণবশত তাঁদের পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে দেন তাঁর বাবা এর প্রতিক্রিয়ায় সমাজের অন্যান্যদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বন্ধুর মা তাকে বারবার এই বলে খোঁচাতে থাকেন যে বাড়ির একটা মাত্র ছেলে সন্তান হওয়া স্বত্বেও তাঁর বাবা কেন বাড়িটা  তাকে অর্থাৎ ছেলেকে না দিয়ে বিক্রি করে দেন (যদিও ভদ্রমহিলার বক্তব্য অনুসারে বাড়ি বিক্রি করে তাঁর বাবা অন্যত্র আবার একটা বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনেন তাদের সুবিধের জন্য) এই ঘটনাটা উল্লেখের মধ্যে দিয়ে আমি এটা বোঝাতে চাইছি যে এখনও সমাজে মানুষ এই ধ্যানধারণা মজ্জায় নিয়ে চলে যে যদি পুত্রসন্তান কারো থাকে, যোগ্য হোক বা অযোগ্য  হোক, পৈত্রিক সম্পত্তি একমাত্র তারই অবশ্য প্রাপ্য এই যে ছেলে সন্তান সম্পর্কে লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেরই এমন ধারণা, এমন একটা আবেগ, বৃহত্তরভাবে যা আসলে লিঙ্গ অসাম্যেরই একটা উদাহরণএই মানসিকতা কিন্তু আসলে ধর্ষণ সংস্কৃতিকেই উজ্জীবিত করে  ধর্ষণ বিষয়টা যেহেতু একজন নারীর ওপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়, তাই সমাজের প্রতিটা নারীর ব্যাক্তিগত ও সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব মুশকিল আর এই বিষয়টাই অপরপক্ষ কাজে লাগাচ্ছে তাদের গোটা মৌলবাদী ব্যাপারটাকে বিছিয়ে রাখার স্ট্রাটেজি হিসেবে চক্রান্তটা আসলে এইখানে আবার ধর্ষণ করার কাজটা যেহেতু পুরুষরা করে থাকে সাধারণভাবে, যেহেতু ধর্ষণ সম্পর্কিত নানা গবেষণা ও সমীক্ষা থেকে এটা পাওয়া গেছে যে একজন পুরুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যই এই কাজটি করে থাকে, তাই মহিলাদের তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে হবে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের পথ অনুসরণ করে এর দ্বিতীয় কোনো উপায় আর নেই

যাপনচিত্র তিনে আমি দেখাতে চাই যে ঘটনাটা সেটা এইরকম একজন মা আমাকে অভিযোগ করেছেন যে এখনকার সব মায়েরা তাদের মেয়েদের কি সব বেহায়া অসভ্যের মতো জামাকাপড় পরায় মেয়েরা সব প্যান্ট সার্ট পরে বেলেল্লাপনা করে বেড়ায় আমার মেয়েকে কেউ শাড়ি আর চুড়িদার ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেখেছে! আমার মেয়েকে কেউ আমার সঙ্গে ছাড়া অন্য কোথাও বসতে, চলতে, দাঁড়াতে, হা হা হি হি করতে দেখেছে? বনেদি রক্ষণশীল পরিবারের এই মা তাঁর জ্ঞানে বা অজ্ঞানে এমন সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে গেছেন যা আসলে ধর্ষক সংস্কৃতিকেই উজ্জীবিত করে কেননা ধর্ষণ সম্পর্কিত নানা গবেষণা ও সমীক্ষায় ইতিমধ্যেই জানা গেছে যে ধর্ষকরা নারীর কাছ থেকে এমন ব্যবহার ও চলাফেরা আশা করে যা ঐতিহ্যগতভাবে শান্ত, কোনোভাবেই উত্তেজক নয় ধর্ষকদের মধ্যে এরকম একটা মানসিকতা পাওয়া গেছে যে কোনো নারীর পোষাক আশাক, চলাফেরা, যদি তাদের উত্তেজিত করে তাহলে সেই নারীকে ধর্ষণ করার পূর্ণ অধিকার একজন পুরুষের আছে বলে তারা মনে করে বলা বাহুল্য আলোচ্য এই মা জেনে হোক বা না জেনে হোক ধর্ষকদের এই মানসিকতাকে উজ্জীবিত করছেন, তোল্লাই দিচ্ছেন, প্রতিবাদ করার বদলে সবচেয়ে বড় কথা যে কোনো নারীর যে কোনো পোশাক পরার, যে কোনো জায়গায় চলাফেরা করার অধিকার, জীবনের যে কোনো আনন্দে অংশগ্রহণ করার অধিকার যে জন্মগত অধিকার রয়েছে, উপরোক্ত এই মায়ের সংস্কৃতি নারীর সেই অধিকারকে খর্ব করছে সামগ্রিকভাবে গোটা পৃথিবীর অর্ধেক সংখ্যক মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ও স্বাধীনতাকে লাঞ্ছিত করছে এই লাঞ্ছনা মানবতাবিরোধী

যাপনচিত্র চারে আমি দেখাতে চাইব যে ঘটনাটা সেটা এইরকম সম্প্রতি একটি বিয়ে হল যে বিয়েতে পাত্রী জানিয়ে দিয়েছে তার হবু শাশুড়িকে বিয়ের আগেই যে সে তাকেমাবলে ডাকতে পারবে না ডাকবে আন্টি বলে কেননা পাত্র মেয়েটির মাকে ওইভাবেই ডাকে এই বিয়েটির বৈশিষ্ট পাত্রী পাত্রের চেয়ে ছমাসের বড় স্কুল লেভেলের পর থেকে এরা পারস্পরিক প্রেমের আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছে মানসিক এবং শারীরিক সঙ্গ বিয়ের আগেই এদের প্রেমকে ঋদ্ধ করেছে ক্যারিয়ার তৈরীতে একে অপরের সাহায্য পেয়েছে সর্বোপরি বিয়ের পরঘর করতেমেয়েটিকে শ্বশুরবাড়িতে উঠতে হয়নি ওরাঘর করতেগেছে মেয়েটির কাজের জায়গায় আর এই সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল মেয়েটির মায়ের ইচ্ছেতে স্কুলের পরে মেয়েটির মা মেয়েটিকে জানিয়ে দেয় যে সে যেন তার পছন্দ মতো জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে দেয় এবং এ ব্যাপারে মেয়েটি মায়ের কাছ থেকে অনেক বুদ্ধি ও পরামর্শ পেয়েছে

সমাজকে, মেয়েদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে এর চাইতে ভালো প্রয়াস খুব কমই দেখা যায় সবচেয়ে বড় কথা একজন মা সাহস করে উদ্যোগ নিয়ে তার মেয়েকে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দিচ্ছে, তাকে উপযুক্ত পরামর্শ উপদেশ দিচ্ছে সমাজে এ ঘটনা খুব বিরল বললেও কম বলা হয় তার একটাই কারণ এই সমাজে নিরানব্বুই দশমিক নয় শতাংশ মায়েরাই আজও এত কিছুর পরও পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে বেশি নিরাপদই শুধু মনে করে না, তারা  এই ব্যবস্থাটা কে কায়েম রাখতে রীতিমতো আচরণও করে থাকে মায়েরা যদি মেয়েদের পাশে একটু একটু করে দাঁড়াত বা দাঁড়ায় তাহলেও মেয়েদের জীবনটা খানিকটা এগিয়ে যেতে পারে তবে এখানে একটা কথা আছে সাধারণত মায়েদের ওপর পরিবারের পুরুষদের একটা চাপ থাকে, মায়েরা যেন তাদের সন্তানদের যথাযথ পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে শিক্ষিত করে তোলে এবং এই চাপটা একটা চরম চাপ  একজন মা বাধ্য ক্রীতদাসের মতো এই চাপ মেনে কাজ করতে বাধ্য থাকে নতুবা সামনে পড়ে থাকে তাঁর মৃত্যু অথবা হত্যার হুমকি যে কোনো মৌলবাদের ভেতরের চরিত্র বা ঘাঁতঘোত গুলো যেরকম হয় আর কি এই সব কিছুকে পেরিয়েও যে উপরোক্ত মা তাঁর কন্যাকে এভাবে এগিয়ে দিতে পেরেছেন তার কারণ অস্তিত্ববাদী মনস্তত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যাবে যে এই মা চেয়েছিলেন তাঁর কন্যা সন্তানকে ভালো দেখতে ভবিষ্যতে তাঁর লক্ষ্যটা ছিল তাঁর কাছে স্পষ্ট এবং তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তিনি তাঁর সাহসের ওপর ভর করেছেন সেই সঙ্গে তিনি তাঁর বিশ্বাস দ্বারা চালিত হয়েছেন সামাজিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন নি এই ফ্যাক্টর গুলোই তাঁকে শেষ পর্যন্ত তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে সমাজের অন্য বেশির ভাগ মায়েদের মধ্যে এই ফ্যাক্টরগুলো অনুপস্থিত, হয়তো বা আংশিকভাবে তাই অন্য মায়েরা এইরকম অকৃত্রিম জীবনযাপনের তাগিদ পান না তাঁরা বাধ্য হন সবসময় একটা কৃত্রিম জীবনযাপন ও আচরণ বেছে নিতে অবশ্যই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় চাপ আসে তাঁর স্বামী ও সব ধরনের আত্মীয়স্বজনের থেকে প্রাথমিকভাবে এবং বৃহত্তরভাবে গোটা সমাজের কাছ থেকেলোকে কী বলবের চাপ বড় সাংঘাতিক চাপ, একটা জাঁতাকল যা আসলে এক প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি  এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, দেখা গেছে যেসব ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনে বাবারা অনুপস্থিত, সেসব ক্ষেত্রে মায়েরা ভালো ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন অনেকটাই, যদিও সব ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য একেবারেই নয় এবং মেয়েদের মুক্ত ভবিষ্যৎ জীবন বেছে নেওয়ায় অনেকটাই সফলতা দেখা যায় বাবাদের নিয়ন্ত্রণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরাধীনতার পরাকাষ্ঠা হয়ে দাঁড়ালে পরিবারে তাদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা হয়তো কখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নচিন্থ হয়ে দাঁড়াবে কেননা মানব প্রকৃতি সব সময় প্রগতি ও স্বাধীনতার দিকেই এগোতে চাইবে এবং চায়, এ কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত

যাপনচিত্র পাঁচে আমি তুলে ধরতে চাই যে উদাহরণটা সে এইরকম বাবা মার একমাত্র মেয়ে পড়াশোনায় ভালো ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে ভালো পড়াশোনা করে মেয়েটি চাকরি পেয়েছে। চাকরি সূত্রেই দেখা হয়েছে সেই ছেলেটির সঙ্গে যাকে সে পরবর্তী কালে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর দুজনে চাকরির উপার্জন জমিয়ে তারা একটা বড় সড় বাসস্থান করেছে। সেই বাসস্থানে মেয়েটি তার মাকেও এনে রেখেছে। আবার ছেলেরবাবা মাও থাকছে। তাদের সঙ্গে তার সুন্দর সম্পর্ক। মেয়েটিকে ছাড়া তাদের শ্বশুর শাশুড়ির চলে না বললেই চলে। ঘরের কাজ, রান্না, এগুলো সে করে না বললেই চলে। এর জন্য রাখা আছে লোক। খুব শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েটি কিন্তু বেশ জেদি

প্রখর আত্মসচেতন এই মেয়েটি ঠিক যেভাবে তার জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছে তেমনটা এখনকার দিনে অনেক মেয়েই চাইছে তার কারণ সম্ভবত এই যে মেয়েদের মধ্যে কমবেশি একটা সচেতনতা তৈরী হয়েছে, যেটা তারা হয়তো প্রকাশ্যে আলোচনা করে না চারহাতপাওলা একটা জীব ও প্রায় কমবেশি সমমেধাসম্পন্ন মানবমস্তিস্ক নিয়ে জন্মাবার পরও সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে কেন দ্বিতীয় লিঙ্গের সম্মান নিয়ে বাঁচতে হবেএ যৌক্তিক বোধের উন্মেষ নারী মনে হচ্ছে তাই এখনকার মেয়েরা সামাজিক চাপ, ‘লোকে কী বলবের তোয়াক্কা না করে সাহস করে নিজেদের পছন্দ মতো জীবন নির্বাহ করছে এরা বুঝতে পেরেছে সামাজিক মৌলবাদ, ধর্ষণ, পৌরুষের ইগো ও কনসেপ্টকে যতই মাথায় চড়তে দেওয়া যাবে, ততই এগুলো আরও আরও চড়তেই থাকবে তাই এরা একটু একটু করে ছোট ছোট পদক্ষেপে দায়িত্ব নিয়ে সাহস করে খানিকটা বা সামাজিক সামঞ্জস্য বজায় রেখে একটা অকৃত্রিম জীবন যাপন করবার চেষ্টা করছে কোনোরকম ইমোশনাল ব্লাকমেকিংএর শিকার না হয়ে এই যাপন কিন্তু আসলে গোটা নারীসমাজকেই অনেকটা এগিয়ে দেবে শুধু নয়, মৌলবাদী ও ধর্ষণ সংস্কৃতিকেও অনেকটাই গুটিয়ে যেতে সাহায্য করবে

মেয়েরা যদি ধর্ষণ না চায় বা তার আনুষঙ্গিক মৌলবাদী থাবা তাদের জীবনে না চায়, তাহলে তাদের সাহস করে নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে, পারিবারিক ও সামাজিক ঘেরাটোপকে অমান্য ও অগ্রাহ্য করে ঐতিহ্যগত লিঙ্গবৈষম্যমূলক মূল্যবোধের শেকল থেকে বেরিয়ে আসতে একাই নিজের শিক্ষা ও পেশাকে সম্বল করে নতুন বন্ধুজগৎ  গড়ে তুলতে হবে কিয়র্কগার্ডের  বক্তব্য মতো, নিজের বিশ্বাসের পথে চলতে শিখতে হবে তবেই নারীরা একমাত্র তাদের অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্ত হতে পারবে একটু একটু করে অস্ত্বিত্ববাদী মনস্ত্বত্বের দেখানো পথে অকৃত্রিম জীবনযাপনের মধ্যে দিয়েই একমাত্র নারীরা তাদের পূর্ণ অস্তিত্ব বিকাশের সুযোগ ও অধিকার পেতে পারবে সমাধান এই একটাই

(ক্রমশ)