সমকালীন ছোটগল্প |
ডিমওয়ালি
(১)
বাড়ি ফিরে এসে বিকেলে বোমাটা ফাটিয়েই দিলাম।
- আমি ঠিক করেছি গীতাকে বিয়ে করব।
- কে গীতা?
বাবা চা খাচ্ছিল, মা কোন একটা ফর্দ
দেখছিল। দুজনেই একসঙ্গে প্রশ্ন করল।
- কেন, গীতাকে তোমরা চেন না? আমাদের
পাড়ার গীতা, নতুনগঞ্জ বাজারে যার ডিমের দোকান।
প্রথমে বাবার পালা। কাগজটা সজোরে
পাশে ছুঁড়ে ফেলে বাবা চেঁচিয়ে উঠল।
- তুই বর্ধমানের বাঁড়ুজ্জে পরিবারের
ছেলে হয়ে ঐ হাড়হাভাতে মেয়েটাকে বিয়ে করবি? আমি ওকে এবাড়িতে হারগিস ঢুকতে দেব না।
এবার মায়ের পালা।
- কী বলছিস রে তুই বাবাই, ওরা তো
বাঙালিও নয় রে! ওরা তো নিচু জাতের বিহারি রে – বাল্মিকী। একটা নিচু জাতের মেয়েকে তুই এবাড়িতে বউ করে আনবি ভাবলি
কী করে?
এবার বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া লাগল।
আমি উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে জলের বোতল এনে খেতে খেতে সেটা উপভোগ করতে শুরু করলাম।
- দাও না, আরো দাও, ছেলেকে রোজ
টাকা হাতে ধরিয়ে বাজারে পাঠাও, ছেলে নাকি সংসারী হয়ে উঠবে, ভবিষ্যতে ওর নাকি কোন অসুবিধে
হবে না – এবার ঠ্যালা সামলাও।
- থামো তো, সব বাড়ির বেকার ছেলেরাই
বাড়িতে বসে না থেকে বাবা-মাকে হেল্প করে, সংসারের টুকিটাকি কাজ করে। তোমার ছেলে যে
বাজারে গিয়ে এই ফুল ফোটাবে, আমি কী করে জানব?
- আমার ছেলে নয়, ও তোমার ছেলে।
নিজে হাতে মার্ক্সের বই তুলে দিয়েছ ওর হাতে, সমাজের বৈষম্য নিয়ে কত কী লেকচার দিয়েছ,
তার ফল ভোগ!
- হ্যাঁ, সেটা সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে
একটা ধারণা তৈরির জন্য। কিন্তু তাই বলে একটা ডিমওয়ালিকে বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে
হবে?
- পাড়ায় কী মুখ দেখাব?
এবার মা কাঁদতে শুরু করল। সুতরাং
আমাকে আসরে নামতেই হল।
- আচ্ছা, তোমাদের ওকে মেনে নিতে
অসুবিধেটা কোথায়? ও বিহারী বলে? নাকি ডিমওয়ালি বলে? ভাবো তো, ওরা দু’বোন তো আমাদের
পাড়াতেই জন্ম থেকে আছে, ওদের নিয়ে কোনদিন কোন গসিপ শুনেছ? ওদের বাবা মারা যাবার পরেও
ওদের বাড়িতে কোন হৈ-চৈ শুনেছ? ঝগড়া শুনেছ? এবং গীতা সকাল থেকে দুপুর অবধি বাজারে ঐ
দোকান সামলায়, আবার সন্ধেবেলা বাচ্চাদের ফ্রি-তে টিউশন পড়ায়। এরকম স্বাবলম্বী এবং ভদ্রমেয়ে
আজকাল কি খুঁজলেও পাওয়া যায়?
(২)
রাত্রে খাবার পর বাবা-মা আবার এসে আমায় ধরল।
- বাবাই, শোন্, তোর জন্য তোর বাবা
তোর তাপসকাকুর সঙ্গে কথা বলে রেখেছে, ওনার মেয়ের জন্য। ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে বেরিয়েছে,
এখন বাচ্চাদের গান শেখায়। স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলি। তুই এখন হঠাৎ যদি এইসব আজেবাজে ডিসিশন
নিস, তাহলে আমাদের বাড়ির মান ইজ্জত কোথায় যাবে ভেবে দ্যাখ একবার!
- এখানে ভাবার কিছু নেই। কারণ আমি
কোনদিন কোন মেয়ের সঙ্গে ঘুরিনি, প্রেম করিনি, কোথাও বসে বাদাম খাইনি। কাউকে মিথ্যে
প্রতিশ্রুতি দিইনি। সুতরাং আমার লাইফ, আমি নিজে বুঝব।
- তাহলে তুই গীতাকে বিয়ে না করে
ওর জমজ বোন সীতাকে বিয়ে কর। তোর সঙ্গে DYFI করে, লেখালেখি করে, অন্তত তোর কাছাকাছি
স্ট্যান্ডার্ড। আমি ওকে বক্তৃতা দিতে শুনেছি, বেশ ভাল বলে। আমরা তাহলে বলতে পারব, তোরা
দুই রাজনৈতিক সহকর্মী, নিজেরা ডিসিশন নিয়েছিস।
- না, সীতা আমার ভাল বন্ধু, কিন্তু
ওর সঙ্গে আমি ঘর করতে পারব না। ঘর করলে গীতার সঙ্গেই করব।
- কেন? একটা ডিমওয়ালির জন্য তোর
মনে এত প্রেম কোত্থেকে এল? তোদের সম্পর্ক কতটা এগিয়েছে? তুই কি ওকে কিছু করেছিস যে
বিয়ের ডিসিশন নিতেই হচ্ছে?
এবার না হেসে থাকতে পারলাম না।
(৩)
আসলে ঘটনাটা ঘটল গতকাল। আমি বাজারে গিয়ে ফল-সব্জি-মাছ-মাংস কেনার পর সবার শেষে গিয়ে গীতার ৫ বাই ৭-এর ছোট্ট দোকানঘরটায় বসি। খানিক কথা বলি, ডিম নিই, চলে আসি। কাল গিয়ে কথা বলতে বলতে একটা ডিম তুলে ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে হাতেই ফাটিয়ে ফেললাম। গীতা হেসে ফেলল।
- শোন সন্তুদা, ডিম হোক আর মানুষ,
কাউকেই চেপে ধরতে নেই। তাহলেই সে হাঁসফাঁস করে এরকম ফেটে যায়। বোসো, ঐ ডিমের পোচ বানিয়ে
দিই, খেয়ে যাও।
চট করে দু’মিনিটে ও ফাটা ডিমের
পোচ বানিয়ে ফেলল। ভালই লাগল। বললাম,
- বাড়িতে কে রাঁধে? তুই না সীতা?
শুধু ডিম বানাতে পারিস না আরো কিছু?
গীতা আবার হেসে ফেলল। হাসলে দীপিকা
পাড়ুকোনের মত ওর গালেও মিষ্টি একটা টোল পড়ে।
- সীতা তোমার মতই বকবক করতে পারে
আর লিখতে পারে। চা কফি ম্যাগি আর খিচুড়ি ছাড়া কিছুই রাঁধতে পারে না। বাড়িতে সব রান্নাই
আমায় করতে হয়। দোকান বন্ধ করে গিয়ে রান্না করে তারপর চান খাওয়া। বাবা বেঁচে থাকতেও
করতে হত, এখনো করতে হয়। অবশ্য শরীর খারাপ হলে সীতা যা রাঁধে খেয়ে নিই।
- একদিন খাওয়াস তো, দেখব কেমন রাঁধতে
পারিস।
- কেন, একটা বিয়ে করে নাও না, তোমার
বউ এসে ভাল ভাল রেঁধে খাওয়াবে।
- অচেনা কাউকে বিয়ে করব না। তুই
করবি? বল্।
চোয়ালের ফাঁকে আলগা হাসি ঝুলিয়েই
কথাগুলো বললাম। দেখলাম গীতা সিরিয়াস হয়ে গেল।
- আমি বিহারী ডিমওয়ালি গো সন্তুদা।
আমি জানি আমাকে কেউ বিয়ে করবে না। করলেই তার জাত যাবে। নইলে আমাকে চাপ দেবে এই ডিমের
দোকান বন্ধ করে দিতে। সেটাও পারব না, কারণ বাবা মারা যাবার পর দেখতে দেখতে আটবছর হয়ে
গেল ব্যবসা করছি, এখন এভাবেই মাথা তুলে বেঁচে থাকতে চাই। তুমি বরং সীতাকে প্রোপোজ কর।
ওর বোহেমিয়ান লাইফ ঠিক হওয়া দরকার।
ডিমের প্যাকেটটা নেওয়ার সময় ওর
হাত ধরলাম।
- আমি যদি তোকেই চাই? তুই কি আমাকে
না বলবি? নাকি ছোটবেলার মত আবার খোলা ময়দানে লুকোচুরি খেলবি আমার সঙ্গে?
গীতা এবার ওর বাঁ-হাতটাও আমার হাতের
ওপর রাখল।
- না। না বলব না। কিন্তু প্রথমে
তোমার বাবা-মা কে রাজি করাও। ওনারা রাজি হলে আমিও রাজি।
(৪)
এরপর দু’সপ্তাহ কেটে গেছে। একটা মঝঝিম পন্থা ঠিক হয়েছে। বিয়ের পর গীতা আর সীতা দুজনেই বসবে ঐ ডিমের দোকানে। গীতা হিসেবপত্র বড়সড় অর্ডার সাপ্লাই এসব করবে আর সীতা রোজ খদ্দেরদের নিজে হাতে ডিম দেবে। তারপর দোকান বন্ধ করে দুজনেই আমাদের বাড়ি এসে সীতা খেয়েদেয়ে নিজের বাড়ি ফিরবে। এই ব্যবস্থায় বাবা-মা আর আপত্তি করেনি।
সবথেকে খুশি হয়েছে আমার খুড়তুতো
দাদা। দক্ষিণ ভারতে ওর এমু আর অস্ট্রিচের মাংসের ব্যবসা। ও বলেছে আমাদের বিয়ের পর গীতার দোকানে রোজ এমু আর অস্ট্রিচের
ডিম পাঠাবে। বাঙালির কাছে এই দুটো ডিম জনপ্রিয় করতেই হবে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন