কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৭৬   



সম্প্রতি সারা বিশ্ব জুড়ে চলেছে মহামারী কোরোনা ভাইরাসের ভয়াবহ দাপট। ইতিমধ্যেই কত মানুষ যে আক্রান্ত হয়েছেন এবং কত মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন, তার সঠিক হিসেব রাখা সম্ভব হচ্ছে না, কেননা প্রতি  মুহূর্তে হিসেবটা বদলে বদলে যাচ্ছে। এর আগেও পৃথিবী জুড়ে আরও অসংখ্যবার মহামারী হানা দিয়েছে, কিন্তু হয়তো এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেনি। আসলে সারা বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানের হাত ধরে প্রযুক্তি যেভাবে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে, তাতে সারা বিশ্ব যেন সংকুচিত হয়ে একটা অঞ্চল বিশেষে পরিণত হয়েছে। প্রয়োজনে এখন খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে এক দেশের মানুষ অন্য দেশে,  এক দেশের পণ্য অন্য দেশে পৌঁছে যায়। এবং অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই এইসব পণ্য ও মানুষ বাহিত হয়ে পৌঁছে যায় নির্মম ঘাতক ভাইরাসও। কিছু বোঝার আগেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে; জীবনীশক্তি কম থাকার দরুন বা সেই  নিষ্ঠুর ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্য শরীরে প্রয়োজনীয় ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি না হওয়ার দরুন অনেকে মারাও যাচ্ছে। অথচ এই ভাইরাস সংহারে এখনও কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে এই পর্যায়ে নিরন্তর গবেষণায় মগ্ন আছেন চিকিৎসা-বিজ্ঞানীরা।  আর পাশাপাশি সব দেশের অসংখ্য চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা অক্লান্ত ভাবে নিয়োজিত আছেন আক্রান্ত মানুষদের সেবা ও শুশ্রূষায়। এ এক আশ্চর্য সংকট ঘনিয়ে এসেছে সারা বিশ্ব জুড়ে। নিজেদের সাধ্যমতো তারা সাবধানতা অবলম্বন করছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। কিন্তু মনের মধ্যে ঘনিয়ে আছে অস্থিরতা ও আতঙ্ক। অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় ভয়ার্ত। আরও সমস্যার কথা, যেহেতু মানুষের যে কোনো সমাবেশ সরকারী ও বেসরকারী ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ঘরের বাইরে বিনোদনের যাবতীয় আয়োজন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র বন্ধ রাখা হয়েছে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া্র আশঙ্কায়, এককথায় বলা যেতে পারে এই চরম বিপর্যয়ের সময়ে মানুষকে অসামাজিক করে তোলার যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ সুরক্ষিত থাকলেও তাদের মনে একধরনের নেতিবাচক মানসিকতাও জন্ম নিচ্ছে। সংক্রমণের ভয়ে এক মানুষ অন্য মানুষকে এড়িয়ে চলছে, দূরত্ব বজায় রাখছে, অবিশ্বাসও করছে। একটা অযাচিত সন্দেহের বাতাবরণ সর্বদা তাকে ঘিরে থাকছে। জানা নেই, এই অসহনীয় অবস্থার মধ্যে আরও কতদিন যাপন করতে হবে। তবে যেহেতু আমরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির স্বর্ণময় সময়ে এই পৃথিবীতে অবস্থান করছি, বিশ্বের চিকিৎসা-প্রযুক্তিতে নিযুক্ত আছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা-বিজ্ঞানীরা, তাই আমরা সাগ্রহে তাকিয়ে আছি তাঁদের সেই গবেষণালব্ধ ফলের দিকে, যা হয়তো অতিশীঘ্র এই মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং তাকে পরাজিত ও নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীকে কোরোনা ভাইরাস মুক্ত করবে। আমরা সবাই সেই শুভদিনের প্রতীক্ষায় আছি।

সবার সুস্থতা কামনা করি। সবার দীর্ঘজীবন প্রার্থনা করি।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India.


<<<< কথনবিশ্ব >>>>


আলম তৌহিদ




জগত সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির গল্প      


 
 (১)

আদিম গোত্র-সমাজে মানুষের নাম রাখার প্রয়োজন হতো না। কারণ তখন মানুষ ছিল গোত্র মানুষ। গোত্রের নামেই হতো মানুষের পরিচয়। জনসংখ্যা কম থাকার দরুন ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারণে তেমন কোনো সমস্যা হতো না। পরস্পরের মধ্যে জানাশোনা হতো গোত্রগত ভাবে।  

জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুন গোত্রের আকার-আয়তন যখন বৃদ্ধি ঘটল এবং মানুষ যখন জীবিকার প্রয়োজনে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন একই গোত্রভুক্ত  লোকজনও পরস্পরের মধ্যে অচেনা হতে লাগল। ফলে ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারণে মাঝেমধ্যে তারা সমস্যায় উপনীত হতো। এই অসুবিধা দূর করার জন্য সম্ভবত তাদের মধ্যে নাম রাখার প্রথা চালু হয়েছিল।

আধুনিক সমাজে ব্যক্তির প্রথম আইটেনডিটি হচ্ছে তার নাম। অর্থাৎ আমরা নাম দ্বারাই প্রথমে ব্যক্তিকে চিনি। শিশু জন্মের পর হিন্দু সমাজে নাম রাখার অনুষ্ঠান পালন করা হয়, যেটাকে বলা হয় 'নাম থুয়ানি'। মুসলিম সমাজে পালিত হয় 'আকিকা'।

পৃথিবীতে যত মানুষ তত নাম। যত পদার্থ-অপদার্থ, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্তু আছে, সবকিছুর নামকরণ করেছে মানুষ। বিজ্ঞানীরা গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কারের সাথে সাথে তার একটা নামকরণ করেন। আবিষ্কৃত গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে এখন আমরা নাম দ্বারাই চিনি। কোনো বস্তু সম্পর্কে যথার্থ ধারণা লাভ করতে গেলেও প্রথমে তার একটা নামের প্রয়োজন পড়ে। কবি-সাহিত্যিকগণও স্বীয় গ্রন্থের একটা নাম দিয়ে থাকেন। অন্যথায় কোনটা কার রচনা নাক্ত করা মুশকিল  হতো। তেমনি সৃষ্টিকর্তাকেও আমরা নাম দ্বারা চিনতে পারি, কে কোন জাতির সৃষ্টিকর্তা।  

বিজ্ঞানীরা বলেন, নিয়ানথার্ডাল যুগেই মানুষের মধ্যে ধর্মবোধের উম্মেষ ঘটে। প্রকৃতি পুজো ও জাদুবিদ্যার মধ্য দিয়ে ঘটে ধর্মের যাত্রা। আদিতে মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুর পুজো করতো। চন্দ্র, সূর্য, বজ্র, মেঘ, বায়ু, নদী, সমুদ্র, পর্বত, বৃক্ষ, পাথর ইত্যাদি বস্তু মানুষের পুজ্য ছিল। মানুষ মনে করেছিল প্রকৃতির সর্ববস্তুতে আত্মা নামক এক অদৃশ্য সত্তা বিরাজমান। এই বিশ্বাস থেকেই ফেটিশবাদ ধর্মের রূপ লাভ করেছিল। টোটেম বিশ্বাস থেকে মানুষের মধ্যে প্রচলন হয়েছিল প্রাণী পুজোর। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, মহামারী, আগ্নেয়গিরি, বজ্রপাত ইত্যাদি প্রাকৃতিক  দুর্যোগে মানুষ হয়ে পড়ত ভীত। তারা মনে করেছিল এইসব দুর্যোগের পিছনে  কোনো অশুভ শক্তির হাত আছে। ফলে এই অশুভ শক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় এগুলোর পুজো শুরু করেছিল এবং এদের উপর আরোপ  করেছিল দেবত্ব। সুতরাং তাদেরও এক একটা নামের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। প্রকৃতির  সাথে সঙ্গতি রেখেই মানুষ দেবদেবীদের নামের কল্পনা করেছিল। এসব নাম মানুষের কল্পনাপ্রসূত বলেই স্থান-কাল-জাতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে, আবার এক ধর্ম অন্য ধর্ম দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছে। তাই সৃষ্টির গল্প ও দেবদেবীদের নামের মধ্যে সমিলও দেখা যায়। সৃষ্টিকর্তা আছে কিংবা নেই সেটি  বড় কথা নয়; বড়  কথা হল এখন আমরা নাম দ্বারাই চিনে নিতে পারি কে সৃষ্টিকর্তা,‍ আর কে সৃষ্টিকর্তা নয়। পৃথিবীতে কত কিছুর অভাব রয়েছে, যেমন  মানুষের খাদ্যের অভাব। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অভাব নেই। ধর্ম-পুরাণের কল্যাণে আমাদের সেই অভাব পূর্ণ হয়েছে।       

ইয়োরোপে স্যাটার্ন হচ্ছে ভাগ্য ও ফসলের দেবতা। চাষাবাদের পূর্বে অধিক ফসল লাভের আশায় এই দেবতার পুজো দেয়া হতো; এমন কী করা হতো রীতিমতো উৎসব। দেবতা স্যাটার্ন ভারতবর্ষে পূর্ব থেকেই ছিল। তবে তাঁর ভারতীয় নাম 'শনি'। স্যাটার্নের যে গুণাবলী, ভারতীয় দেবতা শনির গুণ এর বিপরীত। ভারতীয়দের কাছে 'শনি' হলো অপদেবতা বা অমঙ্গলের দেবতা। তাই ভারতবাসীরা শনিবারে কোনো শুভকাজও করে না। এই অপদেবতাকে তুষ্ট করার জন্যই তারা চালু করেছিল শনি পুজোর। ইয়োরোপ ও ভারতে একই দেবতার উপর বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণ হলো জাতিভেদে চিন্তাধারার পার্থক্য। ফলে জন্ম নেয় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস। যদি সত্যিই স্যাটার্ন বা শনি দেবতার অস্তিত্ব থাকত এবং তিনি যদি একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তাঁর অস্তিত্বের কথা মানুষকে জানাতেন, তবে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের কোন তারতম্য হতো না। এমন কী হতো না নামের ভিন্নতাও।   

আদি আফ্রিকানরা সূর্যের উপাসনা করতো। নীলনদের অববাহিকায় মিসর ছিল কৃষিনির্ভর দেশ। মানুষ তার স্বীয় অভিজ্ঞতায় বুঝেছিল ফসল উৎপাদনে সূর্যের ভূমিকা রয়েছে। তারা মনে করতো সূর্য অসীম শক্তির আধার। তাই সূর্য তাদের কাছে দেবতা বা ঈশ্বর। সুতরাং এই দেবতারও একটা নাম থাকা চাই। তাদের কল্পনায় এই দেবতার নাম হলো এটন, রা, রে। ফারাও রাজারা দেবতা এটনের উপাসনা করতো। ফারাও রাজারা মনে করতো তারা এটনের প্রতিনিধি (আরবিতে বলা হয় পয়গম্বর/নবী/রসুল)। ভারতীয়রাও সূর্য দেবতার উপাসনা করে। কিন্তু তাদের এই দেবতা এটন নয়। তিনি হলেন সূর্য, বিষ্ণু, রুদ্র, নচিকেতা। প্রাচীন ইরানীয়ের সৃষ্টিকর্তা হলেন অহুর মজদা। তিনি জোরওয়াস্টার উপর আবেস্তা ধর্ম নাযিল করেছিলেন। পণ্ডিতগণ মনে করেন ভারতের দেবতা অসুর থেকেই অহুর নামের উৎপত্তি। ভারতের ইন্দ্র ও যম ইরানের দেবতা আন্দ্রা ও যিম। ভারতের দেবতা মিত্র ইরানে মিথরা এবং ইয়োরোপে মিথেরা। মূলত মানুষের চিন্তাধারা থেকেই দেবতাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম ও বিশ্বাসের উৎপত্তি হয়েছে। তাই ধর্মগুলোর মধ্যে এক প্রকার সাদৃশ্য দেখা যায়। 

এক সময় সারা পৃথিবীতে প্যাগানিজম ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিমা পুজোই ছিল মানুষের প্রধানতম ধর্মপালন। তখনও একেশ্বরবাদ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত  হয়নি। প্রত্যেকটা সমাজেই প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধবাদী কিছু মানুষ থাকে। এই বিরোধিতা থেকেই জন্ম নেয় নতুন মত, নতুন বিশ্বাস। আফ্রিকা ও এশিয়ার একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতা ও কিছু বাস্তব কারণ থেকে। ধর্মাধিক্যের সাথে সাথে আমরা একাধিক ঈশ্বরের খবরও জানতে পারি ধর্মের কল্যাণে আরও জানতে পারি তাদের সৃষ্টিতত্ত্বের রসাত্মক গল্প।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাণী হলো - 'যত মত তত পথ'। তাহলে তো বলতে হয়, যত ধর্ম তত ঈশ্বর। সৃষ্টিকর্তা যদি একজন হতো তাহলে একাধিক ধর্ম নাযিল  করার প্রয়োজন পড়ত না। সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মশাস্ত্র মানব মতবাদ থেকে সৃষ্টি বলেই আমরা বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র ও একাধিক স্রষ্টা ও সৃষ্টির গল্প পেয়েছি। মেসোপটেমিয় পুরাণ থেকে জানা যায়, সৃষ্টির আদিতে সমুদ্রের নিচে ছিল পৃথিবীর সমস্ত ভূ-ভাগ। দেবতারা পানি থেকে মাটি বিচ্ছিন্ন করতে চাইলে অসুর বাধা দিত। এতে প্রধান দেবতার সঙ্গে অসুরের যুদ্ধ হয়। দেবতা অসুরকে হত্যা করে কেটে দু-খণ্ড করেন। তার দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকে সৃষ্টি করেন আকাশ। তারপর তারকারাজী দ্বারা তা সুশোভিত করেন। তার দেহের নিম্নাঙ্গ থেকে সৃষ্টি করেন পৃথিবীর ভূ-ভাগ। তার উপরে বৃক্ষাদি রোপণ করে সেখানে বসবাসের জন্য পশুদের নিয়ে আসা হল। দেবতারা এঁটেল মাটি থেকে প্রথম যুগের মানুষ বানালেন। সেই মানুষগুলো হল দেবতাদের প্রতিরূপ।

হিন্দুধর্মে (সনাতন) শাস্ত্রের সংখ্যা অধিক। তাই দেবদেবীর সংখ্যাও অধিক।এই ধর্মে এক দেবতা কর্তৃক অন্য দেবতা সৃষ্টি হন। তাই একাধিক সৃষ্টিকর্তাও পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে সৃষ্টির বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে-  
"যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন তাকে তোমরা বোঝতে পার না। তোমাদের অন্তঃকরণ তা বোঝার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়নি। কুজ্জটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা প্রকার জল্পনা করে। বিশ্বকর্মা এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। এই বিশ্বভুবন প্রথমে জলাকৃতি ছিল। পরে তিনি এ জলাকৃতিকে বিশ্বভুবনে পরিণত করলেন। যখন চতুঃসীমা ক্রমশ দূর হয়ে উঠল, তখন দ্যুলোক (স্বর্গ) ও ভূলোক (পৃথিবী)পৃথক হয়ে গেল(১০.৮২)।"১
দশম মণ্ডলের পুরুষসূক্তে আছে - সহস্র মস্তক, চক্ষু ও চরণবিশিষ্ট এক পুরুষ।  তিনি অমর। তাঁর তিন পাদ আকাশে (অমর অংশ) এবং এক পাদ ব্যক্ত হয়ে বিশ্বজগৎ হয়েছে।

নাসদীয় সুক্তে বলা হয়েছে - সেকালে যা নেই তা ছিল না, যা আছে তাও ছিলনা। পৃথিবীও ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবৃত করে এমন কিছু ছিল না। সেখানে কেউ ছিল না। দুর্গম ও গভীর জলও ছিল না। তখন মৃত্যু ছিল না, অমরত্বও ছিল না। রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না। কেবল মাত্র তিনি একমাত্র বস্তু (আত্মা) বায়ুর সাহায্য ব্যতিরেকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল। চতুর্দিক ছিল জলময়। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা তিনি সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তপস্যার প্রভাবে এক বস্তুর জন্ম নিল। সর্বপ্রথম মনের উপর কামের আবির্ভাব হল। তা হতে সর্বপ্রথম উৎপত্তির কারণ নির্গত হল। বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তু উৎপত্তিস্থান নিরূপণ করলেন। রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হলেন, মহিমা (পঞ্চভূত) সকল উদ্ভব হল। ওদের রশ্নি  দুই পার্শ্বে ও নিচের দিকে এবং ঊর্ধ্বদিকে বিস্তারিত হল, নিম্নদিকে স্বধা (নিকৃষ্ট অন্ন) থাকল, প্রযতি (ভোক্তা পুরুষ) ঊর্ধ্বদিকে থাকলেন। এরপর দেবতারা সৃষ্টি হলেন।

ঐতরেয় উপনিষদ বর্ণনা করে, সৃষ্টির পূর্বে এই দৃশ্যমান জগৎ আত্মাস্বরূপ বর্তমান ছিল। সেই আত্মা সৃষ্টি করলেন অম্ভলোক (দ্যুলোকের উপরে অবস্থিত জললোক), মরীচিলোক (আকাশ), মরলোক (পৃথিবী) ও অপলোক (নদী-সমুদ্র)। তারপর তিনি জল থেকে পুরুষাকার পিণ্ডকে গ্রহণ করে সেই পিণ্ডকে উদ্দেশ্য করে সঙ্কল্প করলেন। ফলে পাখির ডিমের মতো ফুটে মুখবিবর বের হলো। সেই মুখ-গহবর থেকে বাক্‌-ইন্দ্রিয় এবং দেবতা অগ্নির জন্ম হলো। অতপর নাসিকা থেকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় এবং তা থেকে বায়ু প্রকাশিত হলো। এরপর ক্রমে ক্রমে দর্শন-ইন্দ্রিয়, শ্রবণেন্দ্রিয়, স্পর্শেন্দ্রিয়, সূর্য ও দিকসমূহ প্রকাশ পেল। তারপর হৃদপদ্ম প্রকাশিত হলো। হৃদপদ্ম থেকে মন,বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত এবং এদের দেবতা চন্দ্র প্রকাশিত হলেন। চন্দ্রের পর নাভি প্রকাশিত হলো। নাভি থেকে অপান (পায়ু) এবং অপান হতে এর অধিদেবতা মৃত্যু অভিব্যক্ত হলেন। তারপর শিশ্ন (জননেদ্রিয়) বের হলো, শিশ্ন থেকে রেতঃ (শুত্রু) এবং রেতঃ থেকে  এর অধিদেবতা প্রজাপতি প্রকাশিত হলেন। ঈশ্বর পিণ্ডাকৃতির পুরুষে ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রবিষ্ট করালেন। তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর দেবতাগণ ঈশ্বরের কাছে অন্ন প্রার্থনা করলেন। দেবতাদের কথা শুনে ঈশ্বর প্রথমে গরু আকৃতির পিণ্ড তৈরি করলে দেবতারা অসন্তুষ্ট হলেন। তখন ঈশ্বর অশ্বাকৃতির পিণ্ড বানালেন। কিন্তু তাতেও দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন না। অতপর ঈশ্বর পুরুষাকৃতির এক পিণ্ড তৈরি করলে দেবতারা সন্তুষ্ট হলেন। ঐ পুরুষের দেহে ক্ষুধা-তৃষ্ণাকেও স্থান দেয়া হল। তারপর দেবতারা ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের জন্য অন্ন সৃষ্টি করলেন।

তৈত্তিরীয় উপনিষদে আছে, ব্রহ্ম হতে আকাশ, আকাশ হতে বায়ু, বায়ু হতে অগ্নি, অগ্নি হতে জল, জল হতে পৃথিবী, পৃথিবী হতে ওষধিসমূহ, ওষধিসমূহ হতে অন্ন, অন্ন হতে বীর্য এবং বীর্য হতে পুরুষের সৃষ্টি হয়েছে। 
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলে ভিন্ন কথা। সেখানে বর্ণিত আছে, জগৎ পূর্বে অসৎ (নাম ও রূপহীন) ছিল। সৃষ্টির সময় এটি হল সৎ (সত্তা বিশিষ্ট) এবং ডিম্বে পরিণত হল। ডিম্বের একভাগ রজতময় (রৌপ্যময়) এবং অপরভাগ হল স্বর্ণময়। রজতময় অংশ থেকে সৃষ্টি হলো পৃথিবী। স্বর্ণময় অংশ থেকে সৃষ্টি হলো স্বর্গ, পর্বত, মেঘ, তুষার, নদী ও সমুদ্র। তারপর সৃষ্টি হলো সূর্য।

(ক্রমশ)


ফারহানা রহমান




আকিরা কুরোশাওয়া ও তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি ‘রশোমন’


পিঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে আবিষ্ট হয়ে থাকা নিষ্কম্প সত্যকে উন্মুক্ত করার গল্প আকিরা কুরোশাওয়ার অনন্য সিনামা রশোমনরশোমন এমন এক আশ্চর্য ছবি যা আজও আমাকে সত্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে। আমার বোধকে, আমার গভীর চেতনাকে এ ছবিটি এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো যে আমি এখনো সত্য ও মিথ্যের মধ্যেকার ছলনা ও বিভেদ বুঝতে পারি না। আপাতদৃষ্টিতে রসোমনকে খুব সাধারণ একটি গল্প মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে মানব জীবনের সুন্দর ও সত্যের শুদ্ধতম অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা। জীবন যে শুধুই সরলতার প্রতিচ্ছবি নয় বরং আপাত দৃশ্যমান সত্যের পিছনেও রয়েছে বস্তুগত সত্যের আপেক্ষিকতার অনুসন্ধান, আকিরা কুরোশাওয়া তাঁর  কিংবদন্তীতুল্য চলচ্চিত্র রশোমন-এর মাধ্যমে আমাদের সেই কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেনজাপানের এক নিভৃত বনের মধ্যে সংগঠিত একটি যৌন অপরাধ ও খুন সম্বন্ধে চারজন ব্যক্তির পরস্পরবিরোধী কিন্তু এককভাবে বিশ্বাসযোগ্য চারটি বিবৃতি নিয়ে তৈরি হয়েছে এই সিনেমা । কোন এক বিষণ্ণ দিনে জাপানের প্রাচীন  নগরী কিয়োটোতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে চলেছে। একটি পুরনো মন্দিরের ভাঙা দরজা বা রশোমন দরজার কাছে একজন কাঠুরিয়া, একজন পুরোহিত এবং একজন সাধারণ ব্যক্তি এসে বৃষ্টি থেকে বাঁচার আশায় আশ্রয় নেয়। বহুক্ষণ একসাথে সময় কাটাতে হলে যা করে সবাই, এই তিন ব্যক্তিও তাই করে। সময় কাটাতে তারা নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে গালগল্প শুরু করে দেয়। এভাবেই একজন তার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকে অন্য দুজনের কাছে। সে বলে যে, সে নিজেই একটি খুন ও ধর্ষণের বিচারের সাক্ষী হয়েছিলো একসময়। জাপানের গহীন বনের মধ্যে এক দুর্ধর্ষ দস্যু তাজোমারুর কাছে একটি নারী ধর্ষিত হয় এবং সেইসাথে তার সামুরাই স্বামীটিও খুন হয় । বিচার চলাকালীন সময়ে অপরাধ সম্বন্ধে চারজন ব্যক্তি পরস্পরবিরোধী কিন্তু এককভাবে বিশ্বাসযোগ্য চারটি বিবৃতি দেয়। ফলে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটন নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ঘটনার সাথে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তির বর্ণনাকে সত্য বলে মনে হতে থাকে, অথচ তাদের প্রত্যেকের ভাষ্যই আলাদা। ছবির প্রথম দৃশ্যই  শুরু হয় কাঠুরিয়া কিকুরির প্রশ্নবোধক ভাষ্য অনুযায়ী, সে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে এমনভাবে বলে, “আমি আসলে কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে কেন তিনজন আসামীই নিজেদেরকে খুনি হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে?” কাঠুরিয়া জানায় যে সে তিনদিন আগে বাগানের ভিতর কাঠ খুঁজতে গিয়েছিলো এবং সেখানে সে একজন সামুরাই-এর মৃতদেহ দেখতে পায়। ফলে সে আতঙ্কিত অবস্থায় কর্তৃপক্ষকে খবর দেয়। এদিকে পুরোহিত বলেন যে তিনি সামুরাইকে তার স্ত্রীর সাথে খুন সংগঠিত হওয়ার দিনেই ঘুরে বেড়াতে দেখেছিলেন। দস্যু তাজোমারুর ভাষ্য অনুযায়ী সে সামুরাইকে প্রাচীন একটি তালোয়ারের লোভ দেখিয়ে পর্বতের একপাশে নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখে এবং তার স্ত্রীকে সেখানে নিয়ে এসে ধর্ষণ করে। এরপর তাজোমারু ফেরার পথে সামুরাইয়ের স্ত্রী তাকে অনুরোধ করে যেন সে তার স্বামীর সাথে ডুয়েল লড়াই-এ লিপ্ত হয় যাতে সে বিজয়ীর সাথে চলে যেতে পারে। দস্যু তাজোমারু বলে যে সে সামুরাইকে হত্যা করার পর দেখতে পায় যে সামুরাই-এর স্ত্রী সেখান থেকে  পালিয়ে গেছে। কিন্তু সে সামুরাইয়ের স্ত্রীর ব্যবহৃত দামি ছুরিটি আর সেখানে খুঁজে পায় না। এদিকে সামুরাই-এর স্ত্রী অন্য একটি কাহিনী বলে। তার ভাষ্য  অনুযায়ী দস্যু তাজোমারু তাকে ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়। এরপর সে স্বামীর কাছে গিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে তাকে গ্রহণ করতে বলে, কিন্তু সামুরাই তার দিকে  এমনই শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যে সে তার স্বামীর হাতে ছুরি তুলে দেয় তাকে হত্যা করার জন্য। এরপর সে একসময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে এবং জেগে দেখে যে তার স্বামী সেই ছুরি দ্বারা খুন হয়েছে। সেও নিজেকে খুন করতে চায়,  কিন্তু পারে না। এদিকে সামুরাইয়ের আত্মা আরেকজনের মাধ্যমে সাক্ষী দেয় যে দস্যু তাজোমারু তার স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু তার স্ত্রী দস্যুকে  পরামর্শ দেয় যাতে তাকে যাওয়ার আগে সে তার স্বামীকে খুন করে। তখন দস্যু রেগে যায় এবং সামুরাইকে জিজ্ঞেস করে যে সে কি তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেবে নাকি মেরে ফেলবে! এরই মাঝে নারীটি পালিয়ে যায়। ফলে দস্যু যখন সামুরাইকে  ছেড়ে দেয় তখন সে তার স্ত্রীর ছুরি দিয়ে নিজেই আত্মহত্যা করে। কাঠুরিয়া কিকুরির ভাষ্য অনুযায়ী সে ধর্ষণ ও খুন নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছে। যদিও বা সে এসব ঘটনার সাথে নিজেকে জড়াতে চায়নি। সে দেখেছে যে দস্যু তাজোমারু সামুরাইয়ের স্ত্রীকে ধর্ষণের পর তাকে বিয়ে করার জন্য নানাভাবে অনুনয় বিনয় করতে থাকে, কিন্তু মহিলাটি তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাকে বাধ্য করে।  দুর্ভাগ্যবশত সামুরাই তার স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সে দুজন পুরুষকে তিরস্কার করতে থাকে এবং বাধ্য করে ডুয়েল লড়াইয়ে লিপ্ত হতে। এতে সামুরাই দস্যুর হাতে খুন হয় এবং তার স্ত্রী সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

এভাবেই প্রত্যেকের বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্পটি বর্ণনা করা হয় যদিওবা দর্শক শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে না যে আসলে কার বক্তব্য সঠিক। গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে একটি শিশুর কান্নার শব্দে ঘটনাটি অন্যদিকে মোড় নেয়। এ পর্যায়ে এসে আমরা দেখি, তিনজনের মধ্যকার একজন সেই সাধারণ ব্যক্তিটি, যে কাঠুরিয়া ও পুরোহিতের সাথে এতক্ষণ গল্পে মক্ত ছিল, সে পরিত্যাক্ত বাচ্চাটির  কাছ থেকে কিমোনো নিয়ে নেয় বিক্রি করবে বলে। এ ঘটনাতে কাঠুরিয়া বাধা দিলে সে বলতে থাকে যে দামী ছুটিটি আসলে কাঠুরিয়াই চুরি করেছিলো, তাই  সে বিচারের সাক্ষী হতে চায়নি। ফলে সে কাঠুরিয়াকে চোর বলে সাব্যস্ত করে এবং কিমোনো ফিরত দিতে অস্বীকার জানায়। ব্যক্তিটি রশোমন ত্যাগ করার সময় জানিয়ে যায় যে প্রত্যেকেই আসলে শুধু নিজের স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়। এভাবেই মানবতা ও প্রকৃত সত্যর স্বরূপ সন্ধানের গল্প রশোমন দর্শককে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মধ্যে ফেলে দেয়। আকিরা কুরোশাওয়া তাঁর  আত্মজীবনীতে তাই বলেছেন, “মানুষ কখনো তার নিজের সম্পর্কে নিজের সাথে সৎ হতে পারে না । নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার পক্ষে শোভাহীন, অলংকার বর্জিত কোন কথা বলা সম্ভব হয় না”। ১৯৫০ সালে সৃষ্ট আকিরা কুরোশাওয়ার  রশোমন এক অসাধারণ সৃষ্টি যার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের দর্শক জাপানী ছবির সাথে প্রথমবারের মতো এতো ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে পারলো। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৫১ সালে এ ছবি শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার গোল্ডেন লায়নজিতে নেয়, যার মাধ্যমে শুধু কুরোশাওয়াই নন, জাপানি চলচ্চিত্র সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর এরই মাধ্যমে শুরু হয় কুরোশাওয়ার মহৎ জীবনের জয়যাত্রা। একদিকে ফ্ল্যাশব্যাকের যথার্থ ব্যবহার, অন্যদিকে ক্যামেরা ও লাইটিংয়ের অনবদ্য ব্যবহার, গল্পের দারুণ বিন্যাস, অসাধারণ দৃশ্যরস, পরিবেশের অমোঘতা ও অভিনয় শিল্পীদের বলিষ্ঠ অভিনয় এ ছবিটিকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে। গহীন অরণ্যে সূর্যের আলোর সঙ্গে গাছের ছায়ার অদ্ভুত ব্যবহার দেখিয়ে এ ছবিতে আলোছায়ার নৈপুণ্য দেখিয়েছেন কুরোশাওয়া। তিনি চাইতেন প্রাকৃতিক আলোতে শ্যুট করতে, কিন্তু বনের ভিতর গাছপালার যে আলো  আসতো তা চিত্রায়নের জন্য ছিল দুর্বল, তাই তিনি এ সমস্যা সমাধানের জন্য  এ ছবিতে বহু আয়নার ব্যবহার করেছিলেন। বিভিন্ন দিক থেকে আয়নার আলো প্রতিফলিত হয়ে রিফ্লেক্টিং বোর্ডে ফেলা হতো। ফলে সূর্যের আলোতে শ্যুটিং করা  হলেও সে আলোকে এতোটা তীব্র মনে হয়নি। শুধুমাত্র ছায়ার ক্রমাগত জোরালো হয়ে ওঠার শক্তি ব্যবহার করে, অসাধারণ ফ্রেমিংয়ে একটি শক্তিমান স্টেজ পিকচার সৃষ্টির গভীরতর বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। এই ছবির  মাধ্যমেই কুরোশাওয়ার নির্জল ভিজুয়াল স্কিল অস্পষ্টভাবে হলেও ফুটে উঠেছিলো। কুরোশাওয়া তাঁর এ ছবিতে শব্দ ও সংগীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুটি  বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। একটি হলো, সিকোয়েন্সের দৃশ্যকে অর্থবহ করে তোলা ও তার গভীরতা ও গুরুত্বকে প্রয়োজনে অনেকগুন বাড়িয়ে তোলা। অপরটি হলো, দৃশ্যের বিকল্পরূপ গড়ে তোলা এবং কোন কোন জায়গায় তার এফেক্ট বদলানো। নির্বাক ছবির ভীষণ ভক্ত ছিলেন কুরোশাওয়া। তিনি মনে করতেন শব্দ চলচ্চিত্রের ভাষাকে আরও জটিল করে তোলে। কুরোশাওয়া এ ছবিতে একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন। ছবিতে শ্যুটিং করার সময় তিনি  সব অভিনেতাদের নিয়ে একসাথে থাকতেন যাতে তিনি যখন খুশী অভিনয়ের ব্যপারে নানা নির্দেশনা দিতে পারেন। সেট তৈরির কাজের সময় সবাইকে নিয়ে তিনি মারটিন এবং ওসা জনসনের একটি আফ্রিকান চলচ্চিত্র দেখতেন। ছবিটিতে সিংহের গর্জন ও বন্যতা ছিল। ছবিটি তিনি প্রধান অভিনেতা তোশিরো মিফুনকে দেখতে বলতেন এবং দস্যু চরিত্রে সিংহের মতো প্রবল হতে পরামর্শ দিতেন। সাদা-কালো ছবিতে স্বচ্ছ পানির বৃষ্টি স্পষ্ট দেখা যায় না বলে বৃষ্টির পানির সাথে এখানে কালো রঙ মেশানো হয়েছিলো চলচ্চিত্রের প্রায় সব ক্রিটিকের বিবেচনাতেই কুরোশাওয়ার রশোমন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি এমনই এক সিনেমা যা আমাদের নতুন  জীবনবোধে ঋদ্ধ করে। এটি বস্তুসত্য বনাম শিল্পসত্য তথা সত্যের আপেক্ষিকতা বিষয়ে প্রাজ্ঞ শিল্পীর এক দার্শনিক ভাষ্য। রশোমন একদিকে কুরোশাওয়ার চিত্রশৈলীটিকে সুনিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে, অন্যদিকে জাপানি চলচ্চিত্র সম্বন্ধে সারা বিশ্বের আগ্রহ জাগ্রত করে দেয়। অনেকের মতে কুরোশাওয়ার জগতের ভারকেন্দ্রটি ন্যস্ত এই ছবিটিতেই। আকিরা কুরোশাওয়া এমনই এক মহান চলচ্চিত্র স্রষ্টা যিনি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার তাবৎ স্বরূপকে বিশ্বজনীন করেছেন সমগ্র বিশ্বকে তিনি প্রতিফলিত করেছেন তাঁর কল্পনায়। কাবুকী নাটক,  প্রাচীন জাপানি চিত্রকলা, লৌকিক উপকথা, দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, নন্দনতত্ত্ব কোনটাই তাঁর ছবিতে অনুপস্থিত নয়। আত্মায় বিশিষ্ট জাপানি হয়েও  দেশায়তনের বাইরে তাঁর বিশ্বচেতনাকে শিল্পের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।  তাঁর চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিকতার একটা বড়ো কারণ মানবিকতায় তাঁর বিশ্বাস।  তাঁর ছবিতে মানুষের দুর্বলতার মধ্যেই মানবিক গুণের সন্ধান মেলে। তিনি  কখনো মানবিকতায় আস্থা হারাননি। এবং তাঁর চলচ্চিত্রের বিশ্বজনীন আবেদন এইখানেই। তাঁর বহু ছবিই মানুষের প্রত্যয় অর্জনের শিল্পইতিহাস।


কুরোশাওয়াকে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মমেকারদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবু এতো কিছুর পরও তিনি ৬১ বছর বয়সে একবার আত্মহত্মার চেষ্টা করেছিলেন। যে সংঘাতময় সময়ে কুরোশাওয়া বেঁচে  ছিলেন, সিনেমায় সেই ঐতিহাসিক অতীত ও বর্তমানকে তিনি হাজির করেছেন অনবদ্যভাবে। আর সেটা করতে গিয়েই তাঁকে নিজের পাশাপাশি জাপানি  সমাজের প্রতিও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়েছে। ফিল্মমেকার হিসেবে নিজেকে বিকশিত করার পথে কুরোশাওয়া কখনোই স্রেফ বিনোদন দেওয়ার জন্য ক্যামেরায় চোখ রাখেননি। বরং বর্তমানকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য ইতিহাসকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে কাহিনীর জাল বুনেছেন। কোন সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে একটি সহজবোধ্য কাহিনীর মধ্যে আবদ্ধ করা ছিল তাঁর সবচেয়ে বোধগম্য সম্পত্তির একটি। আর এটাই তাঁর বেশীরভাগ কাজকে করে তুলেছে  উপভোগ্য। তাঁর সি্নেমার ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার ইতিহাসের একটি বিস্তৃত  উপস্থাপনাকে উজ্জ্বলভাবে হাজির করে, ফলে এইসব শক্তিধর কাহিনী দর্শকদের  সমবেদনা অর্জন করতে পারে। কুরোশাওয়ার ফিল্ম ক্যারিয়ার ছিল প্রায় ৫০ বছর ধরে। তিনি নির্মাণ করেছেন ৩০টি ফিল্ম আর লিখেছেন ডজন ডজন স্ক্রিপ্ট। তিনি কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জিতেছেনও বহু এওয়ার্ড। ১৯৯০ সালে তিনি জিতে নেন শ্রেষ্ঠ সম্মানজনক পুরস্কাঅস্কারসিনেমা জগতের এই কৃতিপুরুষ  মহাকবি আকিরা কুরোশাওয়া ১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সেতাগায়া, টোকিও, জাপানে মৃত্যুবরণ করেন।







শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের  রানি - ৭




"...তোমার হাতের মাঝে আছে পর্যটন-
এ কথা কি খুশি করে মন?
এ কথা কি দেশ ঘুরে আসে
স্মরণীয় বসন্ত বাতাসে!

এবার হলো না তবু ছুটি
দুলে ওঠে মোরগের ঝুঁটি
বেলা গেলো – বুকে রক্তপাত

বাগানে কি ধরেছিলে হাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত? "
দফতরে বসে মাথা গুঁজে দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটছিলুম। পার্থ বলে, দ্যাখো, কে এসেছে? দেখি কুন্তল হাসিমুখে সামনে এসে বসলেন।
-শুনুন থলকোবাদ ফরেস্টবাংলো বুক হয়ে গেছে শুককুরবার রাতের জন্য। পার্থ বলছে আপনি বৃহস্পতির মধ্যে এখানে গুটিয়ে নেবেন। আমরা শুককুরসকালে বেরোবো, এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে রাতে ওখানে থাকা। পরদিন সকালে আরামসে উঠে ফিরে আসবো। এগ্রিড?
-পার্থ, তুমি যাবে?
-আরে না, আমার ফুরসত নেই, তোমরা যাও...
-ঠিক আছে, থ্যাংকস...
-আজ আসি, এরমধ্যে একদিন আসুন না!
-যাওয়া যেতো... আজ খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে, সময় পাচ্ছি না...
-ঠিক আছে, বৃহস্পতিবার আমি একবার এসে বাকি ডিটেলসগুলো পাকা করে নেবো, আসি...
কুন্তল চলে যা'ন।

তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করে নিচ্ছিলুম সেদিন। রিপোর্টটাকে একটা মোটামুটি জায়গায়     আনতে হবে। সংখ্যাতত্ত্বের চাপে বেশ ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। যে কোনো ব্রাঞ্চ ক্লোজ করার সময় এই চাপটা থাকে।
-নমস্কার!
দেখি কুন্তল দাঁড়িয়ে আছেন। বলি, বসুন; আর একটুক্ষণ লাগবে, শেষ হয়ে এলো...
কিন্তু তিনি বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়েই রয়েছেন,
একটু অবাক হই, কিছু ঘটলো নাকি ?
-একটা মুশকিল হয়ে গেছে, আজ রাতে আমাকে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে...
-বেশ তো, তাতে কী হয়েছে ?
-নাহ, আমি কাল যেতে পারবো না। আজ রাতেই আমাকে কলকাতা বেরিয়ে যেতে হবে, কাল ওখান থেকে দিল্লির ফ্লাইট...
-জরুরি কাজ নিশ্চয়...
-অত্যন্ত, মার্চ মাসেই আমাদের পরের বছরের বাজেট অ্যালোকেশনটা করিয়ে নিতে হয়... ভেবেছিলুম ডাকটা পরের সপ্তাহে আসবে,  কিন্তু...
-কিন্তু কীসের?
-থলকোবাদ...!
-ধ্যুৎ মশাই, ওটা কি আর কোনো ব্যাপার হলো...? নিশ্চিন্তে যান। পরেরবার আসবো যখন, তখন হবে...
-ওটাই তো বলতে এলুম, আপনি কালই যাবেন... আমার লোক চলে গেছে ওখানে... সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে... শুধু আমি যেতে পারছি না... যা তা ব্যাপার...
- না না, আমি একা একা গিয়ে আর কী করবো, বহুবার গেছি, পরে যাবো না হয় আপনাদের সঙ্গে...
-একা কেন যাবেন? রিমা যাবে তো...
-তো...
-আপনিও যাবেন...
-পাগল হলেন নাকি?
তারপর অনেকটা সময় ধরে চললো একটা অসম্ভব রকমের দরাদরি। এভাবে তো যাওয়া যায় না। পূর্ব পরিচিতি অনেক ধূসর হয়ে গেছে কালের ধুলো সরে। তার উপর রাতে থাকার একটা ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু অনুভব করি এই ঘটনাক্রমটি ইতোমধ্যেই নিঃশব্দে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যাবতীয় সংলাপ বৃথা এবং সদিচ্ছা বাহুল্য বোধ হচ্ছে। পার্থ'কে আরো একবার যেতে অনুরোধ করি, লাভ হয় না। এতো দ্বিধা নিয়ে তো আমি দেবমন্দিরেও যাই না। অসহায় লাগে...

"...একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূন্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন -
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।..."
----------------------------------------------

"...যেতে-যেতে ফিরে চায়, কুড়োতে-কুড়োতে দেয় ফেলে
যেন তুমি, আলস্যে এলে না কাছে, নিছক সুদূর
হয়ে থাকলে নিরাত্মীয়; কিন্তু কেন? কেন, তা জানো না।
মনে পড়বার জন্য? হবেও বা। স্বাধীনতাপ্রিয়
ব'লে কি আক্ষেপ? কিন্তু বন্দী হয়ে আমি ভালো আছি..."
সমস্ত সুন্দরেরই একটা নির্মাণ থাকে। তা'কে গড়ে উঠতে হয়। কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনানন্দকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, তিনি শুধু কবিতাই লেখেন। কবিতা ছাড়া আর কিছু লেখেন না। এই 'শুধু কবিতা লেখা' বলতে বুদ্ধদেব কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? জীবনানন্দ বিহান যামিনী কেবল কবিতার 'ঘোরে' থাকেন। তাঁর সব চিন্তা, সব কাজ, প্রার্থনার সকল সময়, শুধু কবিতার ভাষাতেই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে? বুদ্ধদেবের মতো বাংলাভাষার একজন ধীমান মনস্বী কি তবে সত্যিই বিশ্বাস করতেন কবিতায় শ্রমের স্থান নেই। জানি, দেশে-বিদেশে অনেক মনস্বীই সেরকম ভেবে থাকেন। কবিতাট্র্যান্স থেকে, ঘোর থেকে উঠে আসা স্বয়ম্ভূ ব্যক্তিগত উচ্চারণ শুধু। কিন্তু যখন তা মুদ্রিত অক্ষরে লক্ষ মানুষের দরবারে গিয়ে পড়ে, তখন তার অবস্থান কী হবে? এই মোড়টিতে এসে বহু জিজ্ঞাসু থমকে যা'ন। পাঠক কি কবির জুতোয় সমান মসৃণতায় স্বচ্ছন্দ হয়ে থাকতে পারেন? স্পর্শ করতে পারেন কবির সব অভিমান।  নয়তো তাঁর কাছে কবি নিজের পসরা নিয়ে যা'ন কেন?
বুদ্ধদেব জীবিত থাকতে যদি ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের সব পান্ডুলিপির খাতা উদ্ধার করতে পারতেন, তবে বুদ্ধদেব কি নতুন ভাবতে পারতেন 'ঘোর' আর শুদ্ধ সচেতন 'শ্রম' ব্যবহার করে জীবনানন্দ কেউ কেউ 'কবি'দের মধ্যে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। যে জীবনানন্দ ছাত্রপাঠ্য 'ইতিহাস চেতনার কবি' ন'ন, ন'ন 'অবক্ষয়ের প্রতীক' পদ্যকার, তিনি কে? কৃতার্থ পাঠকের কাছে তাঁর সৃষ্টির স্বরূপটি কী হতে পারে?
প্রতীক, রূপক, কিংবদন্তি, মিথস্ক্রিয়া, জীবনানন্দের সবকিছুই ছিলো একটু অন্যরকম। যদি কবিতার আত্মার কথা ভাবি, তবে তিনি একজন ইংরেজ। কিন্তু কবিতার শরীর বাঙালি মেয়ের মতো। আর্দ্র, শ্যামল, নমনীয়, অলংকৃত, রহস্যময়। শক্তি নিজের কবিতায় জীবনানন্দের কাব্যশরীর'টিকে নিজের মতো করে গ্রহণ করেছিলেন। তাই তাঁর পদ্যে জীবনানন্দের উপস্থিতি বড্ডো প্রত্যক্ষ। কিন্তু শক্তির অনুভবের জগৎটি রবীন্দ্রনাথের বেশি কাছাকাছি। অতোদিন আগে যখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, "আমি শুধু ঐ বুড়োটার চ্যালা", তখন আমারও বেশ বিস্ময় লেগেছিলো। জীবনানন্দের সঙ্গে শক্তি'কে, সমর সেনের সঙ্গে সুনীল'কে যুক্ত করে বিচার করার একটা প্রচেষ্টা হয়েছিলো। তার কিছু রেশ এখনও রয়েছে।
শক্তি কবিতা'র ক্ষেত্রে শ্রম স্বীকার করার পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন  "অনুশীলন করে প্রথমে ছন্দোবদ্ধ লেখা তৈরি করা কবিতা রচনার প্রথম ধাপ।" কবি যশোপ্রার্থীদের জন্য তাঁর নির্দেশ ছিলো " অনুশীলনকামী মাত্রের প্রতি আমার সাদর নির্দেশ হলো- অন্তত একশোটা সনেট লিখুন। তারপর নিজের পথ চোখের সামনে খুলে যাবে।" প্রথম জীবনে তাঁর অনুশীলন পর্বে প্রচুর সনেট লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতাটি একটি সনেট, 'যম’,  যে'টি 'কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি এই কবিতাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, "ওটি বাজে পদ্য" এই অভিযোগে। কোনও কাব্যগ্রন্থে সংকলিতও করেননি।
কিন্তু এতোদিন ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস করে মনে হয়, বাংলা কবিতায় স্বভাব, মেজাজ, শরীর ও আত্মার নিরিখে জীবনানন্দের প্রধান উত্তরাধিকারী এক ও অদ্বিতীয়, বিনয় মজুমদার। শক্তি সে অর্থে উত্তরাধিকারী ন'ন, অধমর্ণ বলা যেতে পারে। অবশ্য তাতে শক্তির কোনও গৌরবহানি হয় না, অথবা বিনয়ের গরিমার প্রশ্নে কোনও সংশয় নেই।
----------------------------------------------

"...সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির।
ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদলা হাওয়া নয়
ক্রন্দন রঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার..."
রোদ ক্রমে আসিতেছে। সকালে ঠিক সাতটা নাগাদ ফোন এলো রিসেপশন থেকে। গাড়ি এসে গেছে। নেমে আসি সামনের গাড়িবারান্দায়। কালো বন্ধ জীপগাড়ি। খোলা জীপে ধুলোয় লাল হয়ে যেতে হয়। ড্রাইভার গাড়ির দরজাটা খুলে দেয়। উঠতে গিয়ে দেখি রিমা অন্যদিকের জানালার ধারে বসে।
-গুডমর্নিং...
সে ফিরে তাকাতেই চোখ পড়লো একটা টিপের দিকে, তার কপালে, লাল টুকটুকে। আমি রিমাকে সিঁদুরের টিপ পরে কখনও দেখিনি। সকালের আলো ধন্য হলো ঐ রংটাকে বিশ্বস্তভাবে ধরতে পেয়ে।
-দারুউউণ...
-কী...
-টিপ...
-মানে?
-কিছু না...
গাড়ি ড্রাইভওয়ে ধরে রাস্তায় নেমে এলো।
- শুনলাম তুমি নাকি আসতে চাইছিলে না!
-না না, ঠিক তা না; সবচেয়ে উৎসাহী ব্যক্তিটি যদি আটকে যান, তবে…  মানে স্ফূর্তিটা একটু নিভে যায় তো...
-ওহ, আমি ভাবলাম অন্য কোনও কারণ রয়েছে...
-তুই খুব ভাবিস, না?
-কেন? আমাদের কি ভাবতেও মানা?
-ঝগড়া করার মতলব আছে নাকি রে?
-নাহ, সেটাও তো মানা...
-বোঝো... তবে বহুবচনটা, মানে 'আমাদের', ইহার ব্যাখ্যা বলহ...
-'আমাদের' মানে, যাদের পর্ণার মতো এলেম নেই, লেসার মর্ট্যালস...
এবার আমি ওর চোখের দিকে তাকাই, রিমা মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।

"যাবো না আর ঘরের মধ্যে
অই কপালে কী পরেছো
যাবো না আর ঘরে
সব শেষের তারা মিলালো
আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না
ধরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না
বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো
কখন যেন পরে?
সবার বয়স হয়
আমার
বালক-বয়স বাড়ে না কেন
চতুর্দিক সহজ শান্ত
হৃদয় কেন স্রোতসফেন
মুখচ্ছবি সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো
অচেনা,
কিছু চেনাও চিরতরে।"

(ক্রমশ)

(সৌজন্য - গুরুচণ্ডালি)