সেকালের বাঙলায় কালী
আরাধনা ও দীপাবলী উৎসব
অতীত বাংলাদেশে
প্রাক্-আধুনিক কালের দুর্গাপূজা ও কালীপূজার উদ্ভবের কাহিনীতে কিছু মিল আর গরমিল দুইই দেখতে পাওয়া যায়। শহর
কলকাতায় দুর্গাপূজার সূচনা ও বিস্তারের সঙ্গে
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির সাম্রাজ্যবিস্তার আর শহরপত্তনের ইতিহাস যেমন
অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল, কালীপূজার ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটা নয়। এর একটা বড় কারণ
বাংলাদেশের নানা স্থানে আনুমানিক ষোড়শ শতক থেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থাৎ
বিত্তবান রাজা, জমিদার বা বাবুদের ছাড়াই সাধারণ মানুষের গৃহে বা মন্দির-দেবালয়ে
দেবী কালীর আরাধনা যথেষ্ট প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। শহর হিসেবে কলকাতার
গড়ে ওঠার আগে এখানেও গড়ে উঠেছিল বিশ্রুত শক্তিপীঠ কালীঘাটের
মন্দির। অনেকের মতে কলিকাতা
নামটির পেছনেও দেবী কালিকার পীঠস্থান কালীঘাটের নামটিই রয়েছে। এই কালীক্ষেত্রটির
কথা মনে রেখেই তাঁর কলকাতা বিষয়ক কবিতাটির প্রথমেই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন, “এই কলিকাতা
কালিকাক্ষেত্র, কাহিনী ইহার সবার
শ্রুত, / বিষ্ণুচক্র ঘুরেছে হেথায়, মহেশের পদধূলে এ
পূত!” এই দেশবিশ্রুত শক্তিপীঠে দূর দূরান্ত থেকে পদব্রজে ও নৌকাযোগে
তীর্থযাত্রীরা আসতো। সেদিক থেকে কালীকে এক রকম এই শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও বলা যায়। শহর গড়ে ওঠার পরেও কলকাতায় গড়ে ওঠে চিত্তেশ্বরী
কালী [কাশীপুর], সিদ্ধেশ্বরী বা ডাকাতে কালী [চিৎপুর ও বাগবাজার], ফিরিঙ্গী কালী
[বউবাজার], সিদ্ধেশ্বরী কালী [ঠনঠনিয়া], পুঁটে কালী [পোস্তা বাজার], ভবতারিণী
[দক্ষিণেশ্বর], আনন্দময়ী [নিমতলা], আদ্যাকালী [দক্ষিণেশ্বর
আদ্যাপীঠ] ইত্যাদি প্রসিদ্ধ কালী আরাধনার কেন্দ্র, যেগুলির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কোনও ডাকাত,
সাধু-ব্রহ্মচারী অথবা কোম্পানির অনুগ্রহভাজন জমিদার, কখনও বা এমন কি খ্রিস্ট
ধর্মাবলম্বী কোনও কালীভক্তের নাম! আর এইভাবেই আপামর বাঙালির কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে
এই দেবীর আরাধনা।
কালী আরাধনা - বৃহত্তর বঙ্গে
কিন্তু কলকাতার কথা
আপাতত মুলতুবি রেখে আমরা আর একটু দূর অতীতে বাঙলার প্রাচীনতর ইতিহাসে কালী আরাধনার
সূত্রের খোঁজ করব। আজ আমরা যে কালীমূর্তির আরাধনা সর্বত্র দেখতে
পাই, তার রূপটি [দক্ষিণাকালী] সর্বপ্রথম বিখ্যাত তন্ত্রসাধক
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশ [১৬ শতক] কল্পনা করেছিলেন বলে কথিত আছে। শোনা যায়, তিনি অমাবস্যার রাতে স্বহস্তে
কালীমূর্তি তৈরি করে সে-রাতেই নিজে পূজা সম্পন্ন করে প্রতিমা বিসর্জন দিতেন। অবশ্য
অনেকে মনে করেন যে, তাঁর আগেও বাঙলায় কালী আরাধনা প্রচলিত ছিল। এ-ভাবেই বাঙলার কালী আরাধনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে
গেছে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। জনশ্রুতি এই যে, এই কালীভক্ত রাজা
আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁর রাজ্যে প্রতি গৃহস্থকে কার্তিকী অমাবস্যায় তার বাড়িতে
কালীপূজা করতে হবে, অন্যথায় শাস্তি পেতে হবে। তাঁর পরবর্তী দুই পুরুষও এই আদেশ
বহাল রাখেন। এর ফলে শুধু কৃষ্ণনগর জেলাতেই নাকি দশ সহস্রাধিক বাড়িতে কালীপূজা
অনুষ্ঠিত হতো, যার পরিণতিতে ঐ অঞ্চলে শ্যামাপূজার রাত্রিতে পূজারী ব্রাহ্মণের অভাব দেখা দেয়।
কালীপূজায় ঐ জেলায় পশুবলিও নাকি হতো প্রায় দশ হাজারের মতো।
চিন্তাহরণ চক্রবর্তী রচিত ‘বাঙলার পূজাপার্বন’ বইটিতে এই তথ্য পাওয়া যায়। এই লেখকের মতে আঠারো
শতকের শেষের দিকেও কালীপূজা বাংলাদেশে ততটা জনপ্রিয় হয়নি। ‘তন্ত্রসার’-এর মতো
প্রাচীন কোনো গ্রন্থে কালীপূজার উল্লেখ নেই। যে ‘শ্যামাসপর্যা’ গ্রন্থে এই পূজার
উল্লেখ পাওয়া যায়, তা অপেক্ষাকৃত আধুনিক।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের
পৌত্র ঈশানচন্দ্রের কালী আরাধনা নিয়েও অনেক কাহিনী শোনা
যায়। কালীপূজায় তাঁর এক
হাজার মণ মিষ্টান্ন ও সেই ওজনের চিনি, চাল-কলা ইত্যাদি সহ এক হাজারটি শাড়ি ও
মেয়েদের এক হাজার রেশমি পোশাক ইত্যাদির হাজার রকমের ভোগ নিবেদনের কাহিনী পাওয়া যায়। ঐ কাহিনী অনুসারে এই কালীপূজায় মহিষ,
পাঁঠা ও ভেড়া [প্রতিটি এক হাজার করে] বলি দেবার খরচ পড়েছিল প্রায়
দশ হাজার টাকা আর পূজার অন্যান্য খরচ ধরলে আরও প্রায় কুড়ি হাজার টাকা! এই বেহিসেবী
ব্যয় মেটাতে গিয়ে ঈশানচন্দ্রকে নাকি
সর্বস্বান্ত হতে হয়েছিল।
কালীপূজার আড়ম্বরে
এমনই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া আর এক রাজার গল্প পাওয়া যায় শ্রীরামপুরের মিশনারি উইলিয়াম
ওয়ার্ডের লেখায় [১৮১৫]। এই রাজা রামকৃষ্ণ বরানগরে কালীর এক মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠার
উৎসবে নাকি তখনকার দিনে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। ওয়ার্ড লিখেছেন, কালীর নামে
রাজা বিপুল সম্পত্তি দান করেছিলেন, সেই সম্পত্তির আয় থেকে দৈনিক পাঁচশ’ লোক
খাওয়ানো হয়।... কালীপূজার খরচের ফলে এখন তিনি প্রায় সর্বস্ব হারিয়েছেন।
সারা বাংলাদেশ জুড়ে
ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহ্যমন্ডিত কালী-আরাধনার কেন্দ্র আর তাদের
নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনীরও শেষ নেই! যেমন,
মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ার দেবী কীরিটেশ্বরী,
জনশ্রুতি - বাংলার নবাব মীরজাফর অসুস্থ অবস্থায় এই দেবীর
চরণামৃত পান করতেন। এ-রকম আরো কয়েকটি কালীমন্দিরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শান্তিপুরে
শাক্ত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশ আর বৈষ্ণব অদ্বৈত আচার্যের বংশধরদের প্রতিষ্ঠিত কালী,
রামপ্রসাদের সাধনপীঠ কুমারহট্টের [হালিশহর] ও কমলাকান্তের কোটালহাটের কালী,
ভদ্রপুরে মহারাজা নন্দকুমারের প্রতিষ্ঠিত দ্বিভুজা কালী, বিষ্ণুপুরের ময়নাপুরে
প্রাচীন কালী, কালনা, সিঙ্গুর ও রাণাঘাটের সিদ্ধেশ্বরী, সিউড়ি ও নবদ্বীপের
ভবতারিণী, চূঁচুড়ার দয়াময়ী, নলহাটির ললাটেশ্বরী, শেওড়াফুলির নিস্তারিনী, বাগনানের
মহাকালী, বর্ধমানের কঙ্কালেশ্বরী ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া বীরভূমে বীরসিংহপুরের
কালী, অম্বিকা-কালনার দারুময়ী অম্বিকা ও ২৪ পরগ্ণার ময়দার কালীও
বিখ্যাত।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও
বিশ্রুত কালীক্ষেত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ঝাড়খন্ডে ধানবাদের নিকটবর্তী
কল্যাণেশ্বরী ও রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তার মন্দির ভক্তদের কাছে সুপরিচিত। এ ছাড়া
পূর্ববঙ্গে [বাংলাদেশ] বিক্রমপুরে সোনারঙের কালী, ঢাকার জয়দেবপুরে শ্মশানকালী,
বগুড়ার কালঙ্কেশ্বরী [বা প্রেতাসনা কালী], ত্রিপুরার মেহারে মেহার-কালী ইত্যাদিও
সুপরিচিত। তমলুকের দেবী বর্গভীমা এবং কাঁথির কপালকুণ্ডলার
নামাঙ্কিত মন্দির বা বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরে পূজিতা দেবীও আদতে কালীরই নানা
রূপ। বীরভূমের তারাপীঠে পূজিতা দেবী কালীর নিকটতম রূপান্তর তারার মন্দিরের কথা
ছেড়ে দিলেও সেখানে রয়েছে বোলপুরের কাছে কঙ্কালী, ভাঙ্গালি ও বর্ধমান সীমান্তে
অট্টহাস ইত্যাদি কালী-উপাসনাস্থলগুলি, যার মধ্যে কয়েকটি শক্তিপীঠ হিসেবে পরিগণিত
হয়ে থাকে। এছাড়াও রয়েছে নানা ডাকাতের নামের সঙ্গে জড়িত অগণিত কালীমন্দির।
এ-রকমই একটি, সিঙ্গুরের
ডাকাতকালীর মন্দির দেখতে যাবার এক বিবরণ মেলে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিখ্যাত বই ‘বাংলার
ডাকাত’-এ। শেওড়াফুলি যাবার পথের বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখছেন, “শীর্ণ সংকীর্ণ সর্পিল
পথ। চৈত্র মাস। শুষ্ক পথের পাশে স্থানে স্থানে জঙ্গলঘেরা ডোবা। অতিকষ্টে মন্দিরের
কাছে আসিলাম। ডাকাত কালীর মন্দির ভগ্ন ও জীর্ণ। ইঁট খসিয়া পড়িতেছে। এদিক ওদিক সাপ
ছোটাছুটি করিতেছে। দিনের বেলায়ও অন্ধকার। মন্দিরে ভীষণাকৃতি কালীমূর্তি। ভিতরে
আবর্জনা পূর্ণ।......একপাশে একটি বড় হাড়িকাঠভূমিতে পড়িয়া আছে।......আমি ডাকাতে
কালীকে দেখিতে আসিয়া ভয়ে বিস্ময়ে শিহরিয়া উঠিলাম...। নানা আগাছায় পূর্ণ
ভয়াল স্থান। দিনের বেলায়ও ভয় করে।...” সিঙ্গুরের এই ডাকাতে কালীর
মন্দির কিন্তু আজও আছে, যদিও প্রাচীন জরাজীর্ণ মন্দিরের সংস্কার হয়েছে। এই কালীর
নাম সিদ্ধেশ্বরী। গগন সর্দার, সনাতন বাগদি, রঘু ডাকাত ইত্যাদি নানা ডাকাতের নাম ও
গল্প সিঙ্গুরের এই কালীর সঙ্গে জড়িত।
এই সূত্রে কালীপূজোয়
আরও দুটি বিদেশী-লিখিত নরবলির বিবরণের উল্লেখ এখানে করা যায়। একটি পর্তুগীজ
জার্নালে ক্যাপটেন নরোনহা নামে এক ধর্মভীরু পর্তুগীজের বিবরণ পাওয়া যায়। মেদিনীপুরের
কাছাকাছি কোনো স্থানে ডাকাতদের সঙ্গে গিয়ে তিনি এক বটগাছের নীচে
তিনি তাদের আরাধ্যা কালীমূর্তি দেখতে পান। বলি হিসেবে সেখানে দু’টি অর্ধমূর্ছিত
বালক ও অদুরে সিঁদুর মাখানো খড়গ দেখে তিনি ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। আর একটি
বিবরণ যার লেখা, তিনি ধর্মে ক্যাথলিক হলেও পেশায় ছিলেন ডাকাত। এক স্থানীয় জমিদারের
পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি খুলনা ও নোয়াখালি অঞ্চলে ডাকাতি করতেন, পরে পালিয়ে যান সুন্দরবনের
গভীরে। সেখানে তিনি ‘ভবানীপূজা’র আয়োজন করেন বলে জানিয়েছেন, যাতে নরবলির জন্য
মানুষ কেনাবেচার কথা পাওয়া যাচ্ছে ও বলির যোগ্য মানুষের লক্ষণ মিলিয়ে সওদা করছেন
স্ব্য়ং পুরোহিত!
ওয়ার্ডের বিবরণে
এরকম আরো কালীভক্তদের বিবরণ মেলে, যারা কালীপূজো উপলক্ষে বিপুল ব্যয় করতেন, যেমন
ধরা যাক, খিদিরপুরের ন্যায়নারায়ণ ঘোষাল বা গোপীমোহন নামে কলকাতার এক বৈষ্ণব
ব্রাহ্মণ। প্রথমজন নাকি ১৭৯৫ সাল নাগাদ কালীপূজায় পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয় করে ২৫টি
মহিষ, ১০৮টি পাঁঠা ও ৫টি ভেড়া বলি দিয়েছিলেন। অপর ব্যক্তি ১৮১১ সালে কালীপূজায় দশ
হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন।
কলকাতার আরেক বাবু
শোভাবাজারের কালীশঙ্কর ঘোষের বাড়ির কালীপূজার আড়ম্বরের বিবরণ পাওয়া যায় হরিহর
শেঠের লেখায়ঃ- “কালীশঙ্কর ঘোষের বাটীতে তান্ত্রিকমতে অতি ভয়ানক
ভাবে কালীপূজা হইত। শ্যামাপূজার রাত্রে মদ্যপান অব্যাহতভাবে চলিত এবং বলির রক্তে
প্রাঙ্গণ ভরিয়া যাইত, নর্দমা দিয়া রক্তস্রোত বহিয়া যাইত।” এই বাড়ির পূজোতেই
পশুবলির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন পূর্বে উল্লিখিত পাদ্রি ওয়ার্ড তাঁর বইয়ে। বাড়ির মাঝখানে খোলা আঙিনায় রয়েছে বলির পশুগুলি,
পাশেই স্ব্য়ং কালীশংকর। তাঁর কয়েকজন সঙ্গী ও বলির কাজে সহায়তার জন্য জনা বিশেক লোক।
আঙ্গিনার চারদিক ঘিরে দালান, তার একটি ঘরে উত্তরমুখী করে প্রতিমা বসানো, অপর
কয়েকটি ঘর দর্শকে ঠাসা। এর পর এই পাদরি জানিয়েছেন যে, প্রথমে বলি পড়ে পাঁঠা, তারপর
মহিষ ও সবশেষে দু’ তিনটি ভেড়া। ওয়ার্ডের বর্ণনা কিছুটা শোনা যাকঃ- “একজন পূজারী
বলি দেওয়া পাঁঠার মুন্ডুটি ধরে নাচতে নাচতে মূর্তির সামনে নিয়ে গেল। সদ্য কাটা
মুন্ড থেকে তাজা রক্ত তার সর্বাঙ্গে গড়িয়ে পড়তে থাকে। বলিদান শেষ হলে কালীশঙ্কর, যে লোকটি বলি দিল, তাকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। তাকে বস্ত্র
ইত্যাদি প্রভূত জিনিষপত্র দান করা হলো। পশুর মুন্ড, রক্ত, দেহের
বিভিন্ন অংশের মাংস পূজারী দেবীকে নিবেদন করলেন। তারপর বালির ওপর আগুন জ্বেলে ঘৃত সহযোগে
হোম শুরু হলো। তখন সারা আঙিনা রক্তে ভাসছে।” এ-ছাড়াও কালীপূজার
বিষয়ে ওয়ার্ড যে-সব তথ্য জানিয়েছেন, তার মধ্যে আছে, দেবীকে যে মদ্য নিবেদন করা হয়,
তা কর্তা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের লোকেরা একান্তে পান করে। আর প্রতিমার সম্মুখে
নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
পশুবলি অবশ্য গৃহস্থ
বাড়ির কালীপূজোয় ছিল বহুল প্রচলিত প্রথা। কাঁসারিপাড়ার মল্লিকবাড়িতে আর সিমলার
হোগলকুঁড়িয়ায় গুহবাড়িতে কালীপূজোয় মহিষ বলির প্রথা ছিল বলে জানা যায়। পাঁঠা বলি তো
ছিল সাধারণ ব্যাপার! আবার বিখ্যাত ধনী আশুতোষ দেবের [ছাতুবাবু] বাড়ির কালীপূজায়
কোনো বলিই হতো না। ১৭৫৭ সালে সুতানুটি অঞ্চলে রাজা মাণিক
বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত পুঁটে-কালীর মন্দিরে বৈশিষ্ট্যই ছিল অসংখ্য বলিদান।
পলাশির যুদ্ধের সমকালে যখন কলকাতার অধিকাংশ জায়গা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, তখন ডাকাতি
করতে যাবার আগে কালীমূর্তির সামনে এমন কি, নরবলি দেবার গল্পও শোনা যায়। চিতু ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত চিত্তেশ্বরী কালী
মন্দিরে ১৭৭৮ সালের গ্রীষ্মের এক অমাবস্যায় এমনই নরবলি হয়েছিল বলে জানা যায়।
কালীঘাটেও কোম্পানির আমলে নাকি একবার নরবলির জন্য একজনের ফাঁসি হয়েছিল
বলে ডঃ ডাফের বিবরণে উল্লিখিত আছে।
কলকাতার সবচেয়ে
বিখ্যাত কালীক্ষেত্র কালীঘাটের মন্দিরে কার্তিকী অমাবস্যায় কালী আরাধনার আড়ম্বরের
উল্লেখ করে মিশনারি ওয়ার্ড জানিয়েছেন যে, এই পূজায় প্রায়
হাজার চারেক লোকের সমাগম হতো। অনেকেই পূজা উপলক্ষে
প্রচুর খরচ করত। ১৭৬৫ সালে রাজা
নবকৃষ্ণ নাকি এই কালীমন্দিরের পূজোয় লাখ খানেক টাকা ব্যয় করেন ও মূর্তির জন্য দান
করেন সোনার মুন্ডমালা। পাদরি ওয়ার্ডের বিবরণ অনুযায়ী এই রাজা কালীমূর্তির জন্য দান করেন
হাজার টাকা মূল্যের সোনার হার সহ অন্যান্য অলঙ্কার ও রুপোর
বাসনপত্র। তিনি দু’ হাজার আতুরকে অর্থদান করেন
ও যে-পরিমাণ
ভোজ্যবস্তু ও মিষ্টি দান করেন, তা দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল এক হাজার মানুষকে। এই
বিশ্রুত কালীমন্দিরে কালীর নিত্যপূজাও হতো এবং সে সূত্রে এর
সঙ্গে নানা ধনাঢ্য মানুষের
নাম শোনা যায় নানাজনের লেখা বিবরণে ও সমকালের সংবাদপত্রের পাতায়। শোভাবাজারের রাজা
গোপীমোহন দেব ১৮২২ সালে একবার কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে ধূমধাম সহকারে কালীঘাটে পূজো
দিয়েছিলেন ও এই পূজো দেখতে এত ভীড় হয় যে
শান্তিরক্ষায় পুলিশের প্রয়োজন হয়েছিল। রাজা বাহাদুর কালীমূর্তির হাতের রুপোর খড়্গ
আর সোনার নরমুন্ড গড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও
নানা রকমের অলঙ্কার পট্টবস্ত্র আর শাল-দোশালায় মূর্তিকে মন্ডিত করেন।
অতীত বাঙলার, এমন
কি, ভারত ও নেপালের নানা ধনী ভক্তজন নানা সময়ে কালীঘাটের কালীমূর্তির জন্য বিভিন্ন আভরণ দান
করেন বলে শোনা যায়। দেবীর চারটি রুপোর হাত
দিয়েছিলেন খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল। পরে চারটি সোনার হাত দেন কলকাতার কালীচরণ মল্লিক। বেলেঘাটার
রামনারায়ণ সরকার দিয়েছিলেন সোনার একটি মুকুট আর পাইকপাড়ার
রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ দেবীর সোনার জিভটি গড়িয়ে দেন। পাতিয়ালার মহারাজা দিয়েছিলেন
দেবীমূর্তির গলার একশো আটটি নরমুন্ডের মালা, মূর্তির মাথার ওপরের রুপোর ছাতাটি নাকি দেন নেপালের
প্রধান সেনাপতি জঙবাহাদুর।
মূর্তির পরেই
কালীঘাটের মন্দিরের ও মন্দির পরিসরের নানা অংশের নির্মাণেও রয়েছে নানা বিচিত্র
মানুষের যোগদান। ১৭৭০-৭১ সাল নাগাদ মন্দিরের সামনের গঙ্গার ঘাটটি এক বিশ্বস্ত
পাঞ্জাবি সৈনিক হুজুরিমল্লের শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাঁধিয়ে দেয় ইংরেজ সরকার। কালীর
বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয়েছিল বরিশার জমিদার সন্তোষ রায়চৌধুরী ও তাঁর
উত্তরাধিকারীদের সৌজন্যে। এছাড়াও শ্যামরায়ের মন্দির, তোরণদ্বার, বিভিন্ন ভোগঘর,
নহবতখানা ইত্যাদির নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাওয়ালির বৈষ্ণব জমিদার উদয়নারায়ণ
মণ্ডল, গোরখপুরের টীকা রায়, শ্রীপুরের জমিদার তারকচন্দ্র চৌধুরী, তেলেনিপাড়ার
জমিদার কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নাম। ১৮৩৫ সালে নাটমন্দিরটি তৈরি করান
আন্দুলের জমিদার রাজা কাশীনাথ রায়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, এই নাটমন্দিরেই ১৮৯৯
সালে কালী সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশিনী
শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা। সে এক অন্য কাহিনী!
অ্যালবার্ট হলে
[অর্থাৎ এখনকার কফি হাউস] কালী বিষয়ে তাঁর প্রথম বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন আইরিশ দুহিতা
নিবেদিতা। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার শিক্ষিত সমুদায় ও
ব্রাহ্মসমাজের নানা বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন সত্যেন্দ্রমোহন ঠাকুর, ব্রজেন্দ্রনাথ
গুপ্ত, ডাঃ নিশিকান্ত চ্যাটার্জি ও ড: মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ। সাধারণ শ্রোতারা
নিবেদিতার ভাষণে সন্তুষ্ট হলেও কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তি তাঁর বক্তব্যের
প্রতিবাদ করেন। নিবেদিতা এই বক্তৃতায় কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে সবচেয়ে
তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন মহেন্দ্রলাল। কলকাতার কালীবিরোধীদের বক্তব্যের জবাব দেবার
সুযোগ আসে যখন কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েত হালদারেরা নিবেদিতাকে মন্দির প্রাঙ্গনে বক্তৃতা দিতে
আমন্ত্রণ জানান। এই কালীঘাটেই নাটমন্দিরের চত্বরে নিবেদিতা ২৮শে মে শ্রোতায় ঠাসা এক
সভায় কালী আরাধনার বলিপ্রথা, মূর্তিপূজা ও মূর্তির তথাকথিত কুৎসিত রূপ ইত্যাদি
অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন। পরে তাঁর এই বক্তৃতা পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেন মন্দির
কর্তৃপক্ষ। উল্লেখযোগ্য যে, ‘কালী দি মাদার’ নামে নিবেদিতার একটি বইও আছে।
কালীঘাটের কালীর
প্রতি শুধু যে বাঙালি বা হিন্দুরাই ভক্তি বা বিশ্বাস পোষণ করতেন, এমন কিন্তু নয়।
শোনা যায়, পাঞ্জাব আর বার্মা দখল করবার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে কালীঘাটে
ষোড়শোপচারে পূজো পাঠানো হয়েছিল। মার্শম্যানের বিবরণেও এর সমর্থন মেলে। কালীপূজোয়
কোম্পানির এই এলাহি খরচের পেছনে অবশ্য ভক্তির চেয়ে দেশী সেপাইদের সন্তুষ্ট করার
বাসনাই সম্ভবত কাজ করেছিল। কিন্তু পাদরি ওয়ার্ড কালীঘাট
সহ বিভিন্ন কালীমন্দিরে অহিন্দু ভক্তদের আনাগোনার কথা লিখেছেন। তিনি জানাচ্ছেন,
“শুধু হিন্দুরাই যে এই কালো পাথরের দেবীমুর্তির পূজা করে, এমন কিন্তু নয়। আমি
জানতে পেরেছি, অনেক ইয়োরোপীয় বা তাদের এ-দেশীয় স্ত্রীরা কালী মন্দিরে যায় ও দেবীর
আরাধনায় হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে। আমি যে-ব্রাহ্মণের সাহায্য নিয়ে এই বিবরণ
প্রস্তুত করেছি, তিনি বলেছেন, তিনি...... বহুবার সাহেব-মেমদের কালী মন্দিরে পূজো
দিতে পালকি করে আসতে দেখেছেন।...... তাঁকে মন্দিরের কর্তৃপক্ষ
সুনিশ্চিত ভাবে জানিয়েছেন, কোনো প্রার্থনা নিয়ে কালীর কাছে দিতে ইয়োরোপীয়রা প্রায়ই
এসে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক বিশিষ্ট কর্মচারী সম্প্রতি মামলা জিতে
কালীদেবীকে দু’ তিন হাজার টাকা দামের টাকা মূল্যের নানা সামগ্রী দান করেছেন।”
কালীঘাটের মন্দির
সম্পর্কে পাদ্রি ওয়ার্ড লিখেছেন, “কলকাতার কাছে কালীর এক বিখ্যাত মন্দির রয়েছে।
সমগ্র এশিয়া, এমন কি, সমগ্র বিশ্বের হিন্দু এই দেবীর পূজা করে।” ওয়ার্ডের বিবরণে এই
অতিরিক্ত সংবাদও পাওয়া যায় যে, প্রায় পাঁচশো মুসলমান নাকি প্রতি
মাসে কালীকে পূজো দিয়ে যেতেন। এর পরে তাঁর অধিকন্তু
মন্তব্যঃ- “কি আশ্চর্য ভাবেই না এই দেবীমূর্তি সাধারণ লোকের মনে প্রভাব বিস্তার
করেছে! ......বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমসংখ্যক
গণিকারা এসেও মন্দিরে পূজো দিয়ে যায়। তাদের কারো প্রার্থনা উপপতির রোগমুক্তি, কেউ
বা চায় তার ঘরে আরও বেশি লোকের আগমন!” পবিত্রকুমার ঘোষ জানিয়েছেন, একসময় অবিভক্ত
বাংলার, পরে পূর্ব পাকিস্তানের জননেতা শহিদ সুরাওয়ার্দি নাকি পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী হবার বাসনায় কালীঘাটে মানত করেছিলেন ও কলকাতায় দু’জন লোক পাঠিয়ে
তাঁর হিন্দু বন্ধুদের মারফৎ ‘বিরাট ডালা সাজিয়ে’ কালীঘাটে পূজো দেবার
ব্যবস্থা করেছিলেন। আর একজন বিখ্যাত বাঙালি শিল্পপতি স্যার বীরেন মুখার্জিও নাকি
প্রতি সপ্তাহে কালীঘাটের মন্দিরে পূজো দিতেন।
কালীঘাট ব্যতিরেকে
কলকাতার অন্যান্য প্রাচীন কালী মন্দিরগুলি নিয়েও আড়ম্বর-বৈচিত্র্যের কাহিনী কম
নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিপত্তিশালী দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্রের প্রতিষ্ঠিত
সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির ছিল কলকাতার মনুমেন্টের থেকেও উঁচু, আর তা খ্যাত ছিল
‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’ নামে। এই মন্দির বেশ কয়েকবার ঝড়ে আর ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে ও তা পুনরায় তৈরি করা হয়। তাঁর
কালীপূজোর ঘটাও নাকি ছিল খুব বিখ্যাত।
কলকাতার
কালীমন্দিরগুলোর মধ্যে সম্ভবত প্রাচীনতা আর খ্যাতির বিচারে কালীঘাটের পরেই চিত্তেশ্বরী
মন্দিরের নাম উল্লেখ্য। অতীতের সেই যুগে গঙ্গার তীর ধরে তীর্থযাত্রীরা চিৎপুরে
দেবী চিত্তেশ্বরী বা চিত্রেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজো দেবার পর মশাল জ্বালিয়ে দল
বেঁধে যেত কালীঘাটে। জনশ্রুতি আছে, এই পথের ধারেই
তীর্থযাত্রীদের ওপর লুঠপাট চালাতো
চিতে ডাকাত, এমন কি, এইসব অসহায় যাত্রীকে ধরে নাকি বলিও দিত কালীর সামনে। এই চিতু
ডাকাতের নাম থকেই দেবী চিত্তেশ্বরী বা চিৎপুর নামের জন্ম হয়েছে [বা এর উল্টোটাও
হতে পারে], এমন লোকশ্রুতিও আছে [কলকাতা কলেক্টরেটের ১৭৬১ সালের এক পাট্টায়ও এ কথার
উল্লেখ আছে]। জঙ্গলাকীর্ণ এই পায়ে চলা রাস্তাটি ইংরেজদের নথিতে পরিচিত ছিল
পিলগ্রিমস রোড নামে। বর্তমানে এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরে [কাশীপুরে] প্রতিষ্ঠিত
বিগ্রহটি দুর্গা বা চন্ডীর হলেও কলকাতার আদিযুগে এটি যে কালীমন্দির হিসেবেই পরিচিত
ছিল, তার বহু প্রমাণ আছে। ‘ক্যালকাটা রিভিয়ু’ পত্রিকায় ১৮৪৫ সালে লেখা হয়েছিল, “Chitrapur was noted for the temple of ChitreswariDeby or
the goddess of Chitru, known among Europeans as the temple of Kali at Chitpore”। এখানে আরও লেখা হয়েছিল, “This was the spot where the largest number
of human sacrifices was offered to the goddess in Bengal before the
establishment of the British Government.” একই ধরনের কথা পাওয়া যায়
কটন সাহেবের ‘ক্যালকাটাওল্ড অ্যান্ড নিউ’ গ্রন্থেও। এই বইটির মতে এই স্থানটি ছিল “noted
for the temple of Chitru or Kalee, renowned for the number of human sacrifices
formerly offered at her shrine.”
কলকাতা বা তার
উপকন্ঠের আর একটি প্রসিদ্ধ কালীক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বর, যা রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন। ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে এই মন্দিরে
ভবতারিণী কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিনের
কাহিনী পাওয়া যায় ‘সমাচার দর্পণে’, সেদিন নাকি “কলিকাতার বাজার দূরে থাকুক্, পাণিহাটি,
বৈদ্যবাটি, ত্রিবেণী ইত্যাদি স্থানের বাজারেও সন্দেশাদি মিষ্টান্নের বাজার আগুন
হইয়া উঠে। এইমত জনরব যে পাঁচশত মণ সন্দেশ লাগে।” এই দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণির
পূজারী হিসেবে নিযুক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসের দৌলতে এই মন্দির পরবর্তী কালে বিশ্বখ্যাত
হয়ে ওঠে। অথচ একথা আজ হয়তো অনেকেই জানেন না, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য
বিবেকানন্দের এই মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছিল সমুদ্র অতিক্রম করে ম্লেচ্ছদেশে
যাবার কারণে! এই মন্দিরের কালীকে নিয়ে ইংরেজিতে চমৎকার একটি কবিতা লিখেছিলেন
হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
সার্বজনীন কালীপূজার
যুগ
কলকাতায় এই সব রাজা-জমিদারদের
কালী আরাধনার রমরমার যুগের পরবর্তী কালে শুরু হয় বারোয়ারি কালীপূজার চল। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় আছেঃ- “বারোজনে একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজো মড়ক হতেই
সৃষ্টি হয়- ক্রমে সেই অবধি মা ভক্তি শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ার দলে গিয়ে পড়েন। মহাজন,
গোলদার, দোকানদার ও হেটোরাই বারোইয়ারি পূজার প্রধান
উদ্যোগী।” হুতোম আরও জানিয়েছেন, বারোইয়ারি পূজার অধ্যক্ষের কাজ ছিল ঘুরে ঘুরে
চাঁদা তোলা ও বারোইয়ারি সং ও নানাবিধ তামাশার ব্যবস্থা করা। কলকাতা থেকে চুঁচুড়ার
বারোইয়ারি পূজোর নাকি সুনাম বেশি ছিল, লোকে নাকি পানসি ভাড়া করে চুঁচুড়ায়
যেত বারোইয়ারি পূজার তামাশা দেখতে।
বারোইয়ারি পূজার
পরবর্তী যুগ সার্বজনীন কালীপূজার যুগ। যত দূর জানা যায়, গত শতকের বিশের দশকের শেষের
দিকে কলকাতায় সার্বজনীন কালী আরাধনার সূত্রপাত হয়।
সে সময় কালীপূজার
উদ্যোগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল স্বাধীনতা-আন্দোলনের প্রেরণা। ১৯২৮ সালে বেশ কয়েকটি
সার্বজনীন কালীপূজার খবর পাওয়া যাচ্ছে। পটুয়াটোলা আর হ্যারিসন রোডের মোড়ে
কালীবাবুর মাঠের সার্বজনীন পূজোটিতে সন্ধ্যায় ছায়াছবির প্রদর্শনী ও ‘ভক্তির
ভোজ’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। এ ছাড়া ছিল শিমলা ব্যায়াম সমিতি, জেলেপাড়ার
জিম্ন্যাস্টিক দল ও আরো কিছু দলের শরীরচর্চার
প্রদর্শন। পরের দিন বিকেলে বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে হয়েছিল প্রতিমার বিসর্জন।
এ-বছরেই আরো কয়েকটি সার্বজনীন কালীপূজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যথা- বঙ্গীয় হিন্দুসভা, হিন্দু মিশন, বউবাজারের
ডায়মন্ড বোর্ডিং আর বিবেকানন্দ সোসাইটির পূজো। স্বামীজি শিল্পমন্দিরের মেয়েদের
আয়োজিত পূজোও ছিল উল্লেখযোগ্য, আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে পূজো
দেখার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পাথুরিয়াঘাটা সার্বজনীন ‘শ্রী শ্রী কালিপূজা’-র
প্রতিমার উচ্চতা ছিল শোলার মুকুট সহ সাকুল্যে ২৮ ফুট। তখনকার দিনে এটিই হয়তো ছিল
‘বিশ্বের সবচেয়ে বড়’ কালীপ্রতিমা!
কালীপূজার
আমোদপ্রমোদ ও নানা তামাশা
বাঙলার সম্পন্ন
গৃহস্থ ও জমিদারশ্রেণী কালীপূজাকে উপলক্ষ করে যেসব আমোদ-অনুষ্ঠান করতেন, তা যে সব
সময়ই সাত্ত্বিকতায় মন্ডিত থাকত, এমন কিন্তু আদপেই নয়। তন্ত্রসম্মত কারণবারি পানের
কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, কালী আরাধনার সুযোগে ঢালাও দেশি ও বিলিতি মদ্যপানের
রেওয়াজের কাহিনীও শোনা যায়। অনেক বাড়ির কালীপূজায় প্রসাদ হিসেবেও
মদ্যপানের চল ছিল, যেমন শিমলার বসুবাড়ি। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাওয়া যায় যে,
এই বাড়ির গৃহস্থ ও ভক্তেরা সবাই মাটির গামলায় প্রসাদী কারণবারি ঢেলে তার চারদিকে
গোল হয়ে বসতেন ও সেখান থেকে মদ টানতেন মুখে নল লাগিয়ে। গামলার সুরার ওপর ভাসত একটা
জবাফুল। নলের টানে জবাফুল যার দিকে যেত, তার নামে উঠত জয়ধ্বনি!
এর আগে উল্লিখিত
শোভাবাজারের কালীভক্ত কালীশংকর ঘোষের বাড়ির পূজোয় সুরাপান নিয়ে প্রচলিত ছিল নানা
গল্প। বাড়ির ভৃত্য থেকে শুরু করে গৃহিনী পর্যন্ত কেউই ঐ রসে বঞ্চিত হতেন না! এমনই
কিছু কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে প্রাণকৃষ্ণ দত্তের লেখায়। একবার নাকি কারণ পানের নেশার ঘোরে
কালীপূজক গুরুদেবকেই বলি দেবার জোগাড় হয়েছিল। এ নিয়ে প্রাণকৃষ্ণের আর একটি কাহিনী এ-রকম। কারণবারির প্রসাদ পেয়ে আপ্লুত এক ভৃত্য প্রভুর
পদসেবা করতে আগ্রহী হয়ে কিছুতেই আর বাবুর পা খুঁজে পাচ্ছে না। পায়ের খোঁজে
সারা বাড়ি তোলপাড় হচ্ছে। গিন্নি মা’র আদেশে পূজামন্দিরেও পা খুঁজে দেখা হলো! সেখানেও না পেয়ে
খোঁজ করা হলো পূজারী ব্রাহ্মণের
বাড়িতেও, যদি পূজার নৈবেদ্যের সঙ্গে বাবুর পদযুগলও সেখানে চলে গিয়ে থাকে! ব্রাহ্মণ বললেন, এত নৈবেদ্যের
মধ্যে তো সারা রাত ধরে পা খুঁজতে হবে, খুঁজে পেলে তিনি পরের দিন গিয়ে দিয়ে আসবেন।
এ সব কাহিনীর সত্যমিথ্যা কতটা, তা নিরূপণ করা দুরূহ হলেও
এগুলি থেকে কালী আরাধনার নামে ওই সব বাড়িগুলিতে
সুরাপানের আমোদের ব্যাপকতা সম্পর্কে একটা ধারণা অবশ্যই করা যায়।
কালীপূজোর নাচগানের
আসরে কলকাতার ‘জেন্টু’দের দুর্গাপূজার মতোই আগমন হতো আমন্ত্রিত সাহব-মেমদের। নাচগান বলতে বাই-নাচ
ছাড়াও ছিল কবিগান, পাঁচালি, বিদ্যাসুব্দর পালাগান, তরজা, আখড়াই-হাফ আখড়াই ও আরো
পরবর্তী যুগে যাত্রাগান। এ ছাড়া ছিল বিখ্যাত জেলেপাড়ার সঙ। এরা দেওয়ালী ও কালীপূজা
উপলক্ষে টাঙ্গির মতো এক বিশেষ অস্ত্র নিয়ে সঙ সেজে সারা রাত ধরে নাচত। এই নৃত্যগীতের
বিষয় ছিল কালী ও শিবের নানা রূপ ও দশমহাবিদ্যার কাহিনী ইত্যাদি।
কালীপূজার সময়ে
দীপান্বিতা উপলক্ষে আলো আর আতসবাজির নানা প্রমোদের আয়োজন ছাড়াও কালীপ্রতিমা নিয়ে
আলোর মিছিল ও বাদ্যবৃন্দ সহকারে শহর পরিক্রমারও প্রচলন ছিল। প্রতিমার সঙ্গে কখনও
বা থাকত সঙের দল, ঢোল, নাকাড়া ও শিঙে-বাজিয়ে আর মশালধারী লোকজন। এ নিয়ে ধনবান
বাবুদের মধ্যে চলতো প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা! কলকাতার বাবুরা গঙ্গায় পানসি ভাসিয়ে
হয়তো যেতেন বাগানবাড়িতে ও সেখানে বসতো গান বাজনা খানাপিনার আসর, কখনো বা নৌকার
ওপরেই তারা জমাতেন চলমান আসর ও তা নিয়ে বাবুদের পান্সিগুলির মধ্যে লেগে যেত পারস্পরিক বিবাদ।
বাইরে থেকেও কেউ কেউ আবার এইসব তামাশা দেখতে নৌকো করে চলে আসত কলকাতায়।
সংবাদপত্রের বিবরণে
কালী আরাধনার খবর
কলকাতার নানা
কালীমন্দিরে ও ধনাঢ্য বাবুদের বাড়িতে কালীপূজার নানা সংবাদ পাওয়া যায় পুরনো
সংবাদপত্রের পাতায়। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় ১৮২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঠনঠনিয়া
কালীবাড়ির কাছে পশুবলির এক অদ্ভুত সংবাদ দেখা যায়ঃ- “মোকাম কলিকাতার ঠনঠনিয়া
বাজারের উত্তরে কালীবাটীর নিজ পূর্ব তেমাথা পথে ১৪ মাঘ রবিবার ২৬ জানুয়ারি গ্রহণ
দিবসে রাত্রিকালে ১ রাঙ্গা বাছুর ও ১ বানর ও ১ কালো বিড়াল ও ১ শৃগাল ও ১ শূকর এই
পাঁচ পশু কাটিয়াছে। পরদিন প্রাতঃকালে সকলে দেখিল যে এই পাঁচ জন্তুর শরীর মাত্র আছে
কিন্তু মুন্ড নাই, ইহাতে অনুমান হয় যে মুন্ড কাটিয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার
কারণ জানা যায় নাই।” [১-২-১৮২৩] বোঝা যায় যে, এই সব পশুবধ যে কালীপূজার বলির সঙ্গে
সম্পর্কিত, এ কথা পত্রিকাটি জোর দিয়ে বলতে পারেনি, কারণ সচরাচর কালীপূজায় এই সব
পশু বলি দেওয়া হয় না। হতেও পারে যে, এই বলি ছিল
ঐ কালীপূজার কোনো গুপ্ত ক্রিয়াচারের সঙ্গে
জড়িত।
১৮২২ সালে কলকাতার
সবচেয়ে বিখ্যাত কালীমন্দির বিষয়ে একটি খবর দেখা যাচ্ছে এই কাগজটিতেই। কালীঘাটে রাজা
গোপীমোহন ঠাকুর পূজো দিতে গিয়ে যে দানধ্যান করেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে
‘সমাচার দর্পণ’ লেখে যে রাজা নানাবিধ গহনা, “জরি ও পট্টবস্ত্রাদি ও নৈবেদ্যাদি ও
পূজোপকরণেতে নাটমন্দির পূর্ণ তদুপযুক্ত দক্ষিণা ও শাল ও প্রণামী ও তত্রস্থ
অধিকারীবর্গ ও স্বস্তয়নকারক ব্রাহ্মণ ও
তাবৎ বাঙ্গালীয়দিগকে বহু মুদ্রা প্রদানপূর্বক সন্তুষ্ট করিয়াছেন। এ বিষয়েতে
কলিকাতার ও জেলা হওয়ালী শহরের পুলিশের দারোগা প্রভৃতি নিযুক্ত থাকিয়া নির্বিঘ্নে
সম্পন্ন হইয়াছে...।” [১৬-২-১৮২২]
এর কাছাকাছি সময়েই
কালীঘাট মন্দিরে কালীপূজা-সংক্রান্ত আর একটি খবর দেখা যেতে পারে এই পত্রিকাটি
থেকেই :- “এই কালীঘাটে এক অবাঙ্গালী আশ্চর্যজনক ঘটনার সৃষ্টি করে। সেই ব্যক্তি
শ্রীশ্রীকালীঠাকুরানীর সম্মুখে আপন জিহ্বা ছূরিকা দ্বারা ছেদন পূর্বক বলিদান করিল,
তাহাতে রক্ত নির্গত হইয়া ভূমি পর্যন্ত ভূপতিত হইল এবং সেই ব্যক্তি রক্তাক্ত কলেবর
হইয়া একেবারে মূর্ছাপথ হইল।” এই কাজকে কিছুটা যেন বাহবা দেবার সুরেই পত্রিকাটি
মন্তব্য করেঃ- “এ ব্যক্তির অসমসাহসী কর্ম দেখিয়া ও শ্রবণ করিয়া যাঁহারা
কনিষ্ঠাঙ্গুলির এক দেশ ছেদনপূর্বক ভগবতীকে কিঞ্চিৎ রক্ত দর্শন করাইয়াছিলেন বা
করাইবেন তাঁহারা অবাক হইয়াছেন ও হইবেন।” [সমাচার দর্পণ, ২১-৪-১৮২৭]
“কলিকাতার মধ্যে এবং
চতুর্দিকে শ্যামাপর্ব উত্তমরূপে সম্পন্ন হইয়াছে”, এই সংবাদ জানিয়ে ‘সম্বাদভাস্কর’
কাগজটি একদা সখেদে লিখেছিল যে, কলকাতার সব প্রধান ধনীদের বাড়িতেই শ্যামাপূজা হয় না, যারা পূজা করেন,
তারাও সমারোহ না করে নিয়মরক্ষা করেন। এই মন্তব্য করে পত্রিকাটি অতীতের কিছু
গৃহস্থবাড়ির কালীপূজার আড়ম্বরের কথা মনে করিয়ে দিয়ে লেখে, “কম্বোলিয়াটোলানিবাসী
শ্রীযুক্ত বাবু রামচন্দ্র মৈত্রমহাশয় শ্যামাপূজায় সমারোহ করিয়াছিলেন, তাঁহার বাটীতে দান, ভোজন ও
নৃত্যগীতাদির বিলক্ষণ আমোদ হইয়াছিল এবং বাগবাজার নিবাসী
শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামাচরণ মিত্র মহাশয়ও শ্যামাপূজায় ব্যয় করিয়াছেন। মিত্রবাবুদিগের
বাড়ির শ্যামাপূজা স্মরণ হইলে কে না দুঃখ করিবেন, তাঁহারদিগের গুরু ভট্টাচার্যেরা
শ্যামাপূজার ধনে ধনী হইয়াছিলেন। মিত্রবাবুরা প্রতি বৎসর শ্যামাপূজায় ভগবতীর
আপাদমস্তক স্বর্ণমন্ডিত করিতেন আর তৈজস বস্ত্রাদি কত দিতেন তাহার
সংখ্যা ছিল না। চারি পাঁচ মণ তন্ডুল না হইলে এক একটি
নৈবেদ্য হইত না, নৈবেদ্যের পশ্চাদভাগে মনুষ্য লুক্কায়িত হইয়া থাকিতে পারিত। এক
একটা সন্দেশের পরিমাণ দশ সেরের ন্যূন ছিল না, অর্দ্ধ মোন পরিমিত এক এক সন্দেশ কেবল ঐ বাড়িতেই
হইত। মিত্রবাবুদিগের সে সে পূজার সহিত তুলনা করিলে শ্যামাচরণবাবুর এপূজার ব্যয়
তাহার একাংশও বলা যায় না। তথাচ শ্যামাচরণ পরায়ণ
শ্যামাচরণ শ্যামাচরণ পূজায় যাহা করিয়াছেন কলিকাতা নগরে অন্যত্র কুত্রাপি এমত হয়
নাই।......” [১-১১-১৮৫৬]
পুজার উপাচার
ইত্যাদির জন্য খরচের আতিশয্য ও “দান ভোজন ও নৃত্যগীতাদির বিলক্ষণ আমোদে”
‘সম্বাদভাস্কর’-এর কোনো আপত্তি না থাকলেও কাগজটিকে বিসর্জনের সময় পথে পথে প্রতিমা
নিয়ে ঘোরানোর কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যায়! এই একই প্রতিবেদনে এই কাজকে
শাস্ত্রবিরুদ্ধ অনাচার হিসেবে অভিযুক্ত করে হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারীদের নানা
ভন্ডামি ও ভেকধারণ সম্পর্কে দীর্ঘ উপদেশ বর্ষণ করা হয়। “অনেকে বিসর্জন দিন রাত্রি
সাত আট ঘণ্টা পর্যন্ত...... আলো করিয়া পথে পথে প্রতিমা দেখাইয়া বেড়ান”, এই কথা
উল্লেখ করে লেখা হয়েছিল,“.....এদেশের অধিকাংশ লোক হাটেবাটে ধর্মধ্বজিত্বের ঠাট
দেখাইতে ভালোবাসেন, শাস্ত্রে লেখেন, শ্যামাসাধন অতি গুপ্ত সাধন, রাত্রিতেই পূজা,
রাত্রিতেই বিসর্জন, যাহাকে রাত্রিতেই আবাহন করিয়া আনিলেন, যেভাবেই হোক, ইষ্টভাব
দেখাইয়া অর্চনা করিলেন এবং সেই রাত্রিতেই মন্ত্রযোগে বিদায় দিলেন, যদি
তন্ত্র-মন্ত্র সত্য বহন করেন, তবে তন্ত্রমতেই চলিতে হয়, তাঁহাকে পরদিন চন্ডীমন্ডপে
উপবাসে রাখেন, একবিন্দু গঙ্গাজল, একটি বিল্বফল দিয়াও সম্বর্ধনা করেন না, রজনীতে
সেই উপবাসিনী উলঙ্গিনী ঠাট হাটেবাটে বেশ্যাদিগকে দেখাইয়া
বেড়ান, যাঁহাকে মাতা বলেন তাঁহার এই অপমান করেন ইহাতে
কি তিনি সন্তুষ্ট হন?......ভগবতীর এই দুর্গতি কি ধর্মকর্ম বলা যায়?
তন্ত্রশাস্ত্রের কোন গ্রন্থে ইহার প্রমাণ আছে?...” ইত্যাদি। পথে পথে প্রতিমাকে
ঘোরানো নিয়ে এই পত্রিকাটির আপত্তির আর একটি কারণ ছিল এই যে, হিন্দুরা যাদের
অস্পৃশ্য জাতি মনে করেন, তারা “পথে পথে প্রতিমা সকলকে স্পর্শ করিয়া যাইতেছেন”! [ঐ]
কালী আরাধনায়
বলিসংক্রান্ত গুপ্তপূজার একটি বিবরণের উল্লেখ করা যায় ১৮২২ সালের সংবাদপত্রের পাতা
থেকে। তারকেশ্বরের কাছে শিববাটি কালিকাপুর গ্রামের অদূরে এক সিদ্ধেশ্বরী
কালীপ্রতিমা সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদটির কিছুটা এ-রকম :- “সম্প্রতি ৯ মাঘ সোমবার
রটন্তী পূজার রাত্রিতে ওই সিদ্ধেশ্বরীর গুপ্তরূপে পূজা হইয়াছে। সে পূজা কে করিল
তাহা স্থির হয় নাই। কিন্তু পর দিবস প্রাতঃকালে সেই সিদ্ধেশ্বরীর সেবাকারী ব্রাহ্মণ
সেখানে গিয়া পূজার আয়োজন দেখিয়া চমৎকৃত হইল। চারি জোড়া পটবস্ত্র ও চারি বর্ণের
চারিখান পট্ট শাড়ি বস্ত্র আর ঘড়া প্রভৃতি এক প্রস্থ তৈজসপত্র এবং প্রচুর
উপকরণযুক্ত নৈবেদ্য ও আট প্রমাণ পিতলের বাটিতে আট বাটি রক্ত আছে। কিন্তু কী বলিদান
করিয়াছিল তাহার নিদর্শন কিছু নাই। কেহ কেহ অনুমান করে যে নরবলি হইয়া থাকিবেক। এবং
নগদ ৫ পাঁচটি টাকা রাখিয়াছে ও লিখিয়া রাখিয়াছে যে এই তাবৎ সামগ্রী ও পাঁচ টাকা
দক্ষিণা সেবাকারী ব্রাহ্মণের কারণ রাখা গেল।” [ ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’/
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দয়োপাধ্যায়]
সেকালের কলকাতার
দীপাবলি উৎসব
ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির আমলের আগেই বাংলাদেশে কালীপূজা প্রচলিত হলেও সেসময় দীপাবলি বা
দীপান্বিতা উৎসব সীমাবদ্ধ ছিল মাটির প্রদীপের আলোকসজ্জার মধ্যে, তা’ও খুব
ব্যাপকভাবে নয়, কারণ দীপাবলি আদতে ছিল মূলত পশ্চিম ভারতের উৎসব। মাটির প্রদীপে
ব্যবহৃত হতো কখনো সরষের তেল, কখনো বা রেড়ির তেল বা ঘি। এর পরে আসে গ্যাসের
বাতি। আলোকসজ্জার সমারোহে ধনীরা সেকালেই হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতেন ও এ নিয়ে
চলতো প্রতিযোগিতা। অতুল সুর লিখেছেন, কলকাতার অনেক বাবুদের নাকি শখ ছিল
বারবনিতাদের গৃহে গিয়ে বাজি পোড়ানোর। বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসটিতে
এমনই এক বাবুর এক রক্ষিতার বাড়ি্র ছাদে কালীপূজোর রাতে মাদুর পেতে হার্মোনিয়াম
বাজিয়ে গানের আসর আর তুবড়ি জ্বালিয়ে পতিতাপল্লীর অন্য বাবুদের সঙ্গে রেষারেষির
দৃশ্য আছে। কোম্পানির আমলে দেওয়ালির সমারোহে যুক্ত হয় নানা
ধরনের আতসবাজি। এই সব বাজি তখন আসত সাধারণত বাংলার বাইরের নানা স্থান থেকে, যেমন
লখনৌ। পলাশির যুদ্ধের কয়েক বছর পর মইনুদ্দি নামে এক বাজিওয়ালা কোম্পানির কাছ থেকে
বাজি তৈরির লাইসেন্স নিয়েছিল। কালীচরণ সিংহ নামে আর একজন হিন্দু বাজিওয়ালার নাম
পাওয়া যায়। বাজির কারিগর ছিল মুর্শিদাবাদের লোক। দীপান্বিতার দিন ছাড়াও সেকালের
কলকাতায় ইংরেজ ও দেশীয়দের আয়জিত ভোজসভা ও অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জা ও
বাজি পোড়ানো হতো। গার্ডেনরিচে মেনউইক নামে এক
সাহেবের বাগানবাড়িতে মেলা বসত, সেখানে চলতো বাজির নানারকম কসরত
আর খেলা। এ ছাড়া বাজির প্রদর্শনীও হতো।
পলাশির যুদ্ধের
সমসময়িক কালে কলকাতার বেশির ভাগ বাড়িতেই ছিল খড়ের ছাউনি। তাই নিরাপত্তার কারণে
হাউই ছিল সেসময় নিষিদ্ধ বাজি। শিমুলিয়া অঞ্চলে চড়কের মাঠে বিক্রি হতো তুবড়ির খোল।
এছাড়া প্রচুর ফানুস ওড়ানো হতো। বাজিকরদের কেরামতিতে রাতের আকাশে ঐ সব ফানুস
নানারকম জীবজন্তুর চেহারা নিত। কখনও বা আলোর মালায় লেখা ফুটে উঠতোঃ-
‘গড সেভ দি কিং’! কালীপূজোর কয়েকদিন
আগে থেকেই ঐ মাঠে শুরু হতো বাজি পোড়ানো। পরে অবশ্য কলকাতায় আতসবাজির তালিকায় হাউইও
ঢুকে পড়ে, হাউইয়ের প্রতিযোগিতাও শুরু হয়। বড়লোকেরা অর্ডার দিয়ে পছন্দ মতো বাজি
তৈরি করাতেন। মফঃস্বলের বহু লোক কলকাতার বাজি পোড়ানো দেখতে আসত। বাজি পোড়ানো নিয়ে
বর্তমান কালের মতো রেষারেষি আর অন্যান্য হাঙ্গামাও বিরল ছিল না।
চিত্রকরদের তুলিতে কালী আরাধনা
পুরনো দিনের
বাংলাদেশে, বিশেষত কলকাতায় কালীপূজার পুরনো ছবি খুব বেশি পাওয়া যায়নি। কালীঘাট
মন্দিরের দুটি পুরনো ছবি আমরা পেয়েছি, যার একটি আলোকচিত্র, অন্যটি কোনো অজ্ঞাত
শিল্পীর আঁকা স্কেচ। দুটিতেই কালীঘাট মন্দিরে নৌকাযোগে ভক্তদের আগমনের দৃশ্য দেখা
যায়। অলোকচিত্রটিতে দু’টি মন্দির দৃশ্যমান।
আদিগঙ্গায় অনেক নৌকা ও
অদূরে একটি সাঁকো দেখা যাচ্ছে। রেখাচিত্রটিতে তিনটি মন্দির ও
আদিগঙ্গায় দুটি নৌকা ও কিছু পুণ্যার্থীর স্নানের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এই ছবিটি ইন্টারনেটের সূত্রে পাওয়া গেছে
[সৌজন্য- উইকিপিডিয়া], যেখানে কোনো শিল্পীর নামের উল্লেখ নেই, শুধু এটি ১৮৮৭ সালের
ছবি, এটুকুই জানা যাচ্ছে।
এই সূত্রে কয়েকজন
ইয়োরোপীয় শিল্পীর আঁকা কালীপূজার ছবি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আঠারো শতকের বেলজিয়ান
শিল্পী ফ্রাঁসোয়া বালথাজার সলভিনস কলকাতায় এসেছিলেন ও এখান থেকেই তাঁর আঁকা ছবির
যে অ্যালবাম প্রকাশিত হয় [১৭৯৯], তাতে দুর্গাপূজার মতো কালীপূজার একটি ছবিও ছিল।
এই ছবিটিতে নৌকার ওপর একটি বিশাল কালীমূর্তি সহ
অনেক লোককে দেখা যাচ্ছে, অদূরে একটি ঘাটের সিঁড়িও দৃশ্যমান। ঘাটের ধারে কিছু লোক
দাঁড়িয়ে আছে। কালীমূর্তির চিত্রায়নও যতটা বোঝা যাচ্ছে, সঠিক। নৌকোর ওপর দাঁড়িয়ে
একজন মনে হয় কাঁসর বাজাচ্ছে। খুব সম্ভব এটি বিসর্জনের ছবি। এটি ঠিক কোন স্থানের
ছবি, সে ব্যাপারে সলভিনস কিছু জানান নি।
আমাদের আলোচ্য
পরবর্তী ছবিটির চিত্রকর রুশ শিল্পী প্রিন্স আলেক্সি
দিমিত্রিভিচ সলটিকফ। তিনি ১৮৪১ সালের অক্টোবরে প্রথম কলকাতায় আসেন ও ডিসেম্বর
পর্যন্ত বাঙলাদেশে ছিলেন। তাঁর আঁকা আলোচ্য চিত্রে গাছপালা-সমাকীর্ণ এক পথ দিয়ে রাত্রিবেলা
মশালের আলোয় কিছু লোককে কালীমূর্তি বহন করে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। এইসব লোকজন কেউ
কেউ মাথায় পাগড়ি বাঁধলেও সকলেই নগ্নগাত্র ও হ্রস্ববাস। এরা ঢোল, শিঙ্গা ইত্যাদি বাজাচ্ছে।
এটি কোনো বনপথের দৃশ্য কিনা বলা মুশকিল, কারণ পটভূমিতে কালীমূর্তির ছায়া পড়েছে মনে
হয় ও সেখানে নানা জীব জন্তুর পিঠে কিছু দেবদেবীর [?] আকৃতি দেখা যাচ্ছে, সেগুলি
ছবি, না মূর্তি তা পরিষ্কার নয়। হতে পারে কোনো চিত্রিত পর্দা পেছনে রয়েছে ও তার
সামনে দেবীমূর্তিটি স্থাপিত হয়েছে। মূর্তিটি কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ছবিতে সে
ব্যাপারটি তেমন স্পষ্টভাবে অবশ্য চিত্রিত হয়নি, তবে মানুষগুলির মধ্যে একটি চলমান
ভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়। ছবিতে কালীমূর্তিটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পরনে বাঘছাল জাতীয় কিছু আর দুই বাম হাতে খড়্গ ও নরমুন্ড
থাকলেও ডানদিকের একটি হাতে একটি অতিরিক্ত নরমুন্ড দেখা যাচ্ছে! দেবীর কন্ঠের
মুন্ডমালা ও রক্তলোলুপ শৃগাল, পদতলে শায়িত শিব ইত্যাদি যথাযথভাবেই চিত্রিত হয়েছে।
এই ছবিটি পাওয়া যায়
১৮৪৮ সালে পারী থেকে প্রকাশিত শিল্পীর ভ্রমণকাহিনী ‘LettressurL’Inde’ নামক বইয়ে। এ ছাড়াও এই ছবিটি পাওয়া যায় পারী থেকে প্রকাশিত তাঁর
অ্যালবামে [“Voyage dansL’Inde, Pendent les Annees 1841-1842-1843,
1845-1846]।
কালীমূর্তির আর একটি
পুরনো ছবি আমরা ইন্টারনেটে দেখেছি, যার নীচে লেখা পরিচিতিটি একটু
বিভ্রান্তিকরঃ-‘দি সেরিমনি অব ওয়াশিং অব গডেস কালী অ্যান্ড দি জগন্নাথ’! [কালীর বানান লেখা হয়েছে ‘Caly’!] ছবির নীচে খুব ছোট করে ‘এ চ্যাপম্যান জুনিয়র’ লেখা থাকলেও তিনি যে এই
ছবিটির শিল্পী, তা স্পষ্ট করে লেখা নেই। এই নামে কোনো শিল্পীর পরিচিতিও আমরা খুঁজে
পাইনি। ছবির সঙ্গে যুক্ত এই পরিচিতি অংশটি বাদ দিয়ে মূল ছবিটি [সঙ্গের পঞ্চম ছবি]
দেখলে অবশ্য মনে হয় এটি নৌকো করে কালীপ্রতিমার বিসর্জনের দৃশ্য। নৌকোর ওপর একজনকে
মূর্তির সামনে চামর দোলাতে ও আর একজনকে কাঁসর বাজাতে দেখা যাচ্ছে। নৌকার ওপর
কয়েকটি ধ্বজা, একটি গৃহদেবতার সিংহাসন ইত্যাদি আর পুরুষ আরোহীদের সঙ্গে একজন
ঘোমটায় মুখ ঢাকা মহিলাকেও দেখা যাচ্ছে।
কালীমূর্তির চিত্রণে সবচেয়ে অস্বাভাবিক
হচ্ছে এর সুবিশাল আকার ও পদতলচুম্বী কেশরাশি। তা ছাড়া কালী মূর্তির প্রচলিত চেহারা
অনুযায়ী দেবী দিগম্বরী না হয়ে সবসনা। খড়্গ আর নরমুণ্ড দেখা যাচ্ছে দেবীর বাম হাতের
বদলে দুই দক্ষিণ হাতে! সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে কালীর পদতলে শায়িত শিবকে দেখা যাচ্ছে না, তার বদলে দেখা
যাচ্ছে কিছু বাক্সজাতীয় বস্তুর ওপর রাখা মহাদেবের একটি আবক্ষ মূর্তি। তবে দেবীর
গলার মুন্ডমালা ও লোলজিহ্বা এখানে স্বাভাবিকভাবেই চিত্রিত।
আমাদের আলোচ্য সর্বশেষ ছবিটিও ইন্টারনেট মারফৎ পাওয়া গেছে,
এতে শিল্পীর কোনও উল্লেখ নেই, শুধু লেখা ‘ব্রিটিশ স্কুল’।[ষষ্ঠ ছবি] ছবিতে একটি ছোট
মন্দিরে কালীমূর্তির সামনে
কিছু নারী ও পুরুষকে পূজা নিবেদন করতে দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের স্থাপত্য দেখে ছবিটি
দেশের কোন অঞ্চলের তা বলা কঠিন হলেও নারী ও পুরুষদের পোশাকের ধরন আর পশ্চাদ্পটে
নারকেলগাছ ও কলাগাছ ইত্যাদি দেখে মনে হয়, এটি বাংলাদেশের দৃশ্য হতেই পারে। তবে এটি
দক্ষিণ ভারত হওয়া একেবারে অসম্ভব না হতেও পারে, কারণ কেরল বা
মহীশূরেও কালী আরাধনা খুব অপরিচিত নয়। তবে ছবিটিতে কালীর যে রূপ আঁকা হয়েছে, তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে
দেবী কৃষ্ণবর্ণা, নৃমুন্ডমালিনী ও লোলজিহ্বা হলেও
রক্তাম্বরধারিনী ও পদ্মাসনে উপবিষ্টা। পদতলশায়ী শিব এখানে নেই। এরকম কোনো
কালীমূর্তি সত্যিই বাংলাদেশ বা ভারতের কোনো মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত আছে কিনা, তা নিয়ে
অনুসন্ধান করা যেতেই পারে।
উল্লেখপঞ্জীঃ-
১। শ্যামাপূজাঃ সংবাদের দর্পণে - যুগান্তর,
২৭-১০-১৯৮১।
২। সেকালের কলকাতায় কালীপূজো / কমল চৌধুরী –
যুগান্তর সাময়িকী, ২৫-১০-১৯৮১।
৩। সেকালে বাঙালীর কালীপূজা /অভী দাস -
রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০-১১-১৯৮৫।
৪। রাজা ও বাবুদের কালীপূজো / নির্মল কর – ঐ, ঐ, ৩০-১০-১৯৯৪।
৫। কালী কলকেত্তাওয়ালী / চন্ডী লাহিড়ি,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১-১১-১৯৬৭।
৬। সেকালের কলকাতায় দেওয়ালি / অমিতাভ চক্রবর্তী
– যুগান্তর, ২৭-১০-১৯৮১।
৭। কালীঘাটে সুরাবর্দির মানত / পবিত্রকুমার ঘোষ,
সাপ্তাহিক বর্তমান, ৯-১১-১৯৯৬।
৮। দেওয়ালীর দেয়ালা / অতুল সুর, সংবাদ
প্রতিদিন [উপহার], ৯-১১-১৯৯৬।
৯। ‘কালীরে রহে বক্ষে ধরি কাল’ / কিশলয় ঠাকুর,
আনন্দবাজার পত্রিকা,১-১-১৯৮৬।
১০। কলকাত্তাওয়ালী কে? - দেবী দুর্গা না
কালিকা? / বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বর্তমান, [রবিবার],
৭-১১-১৯৯৯।
১১। দুই বিদেশীর শাক্তপ্রেম / ইন্দ্রলাল
বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমান, ২১-১০-২০০৬।
১২। সারা বাংলার প্রাচীন ও জাগ্রত মা কালীর কথা / শিবশংকর ভারতী-
সাপ্তাহিক বর্তমান, ১১-২০১০।
১৩। মা কালী / জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী –
দেশ, ৯-১১-১৯৮৫।
১৪। কালীর শহর কলকাতা / সুনীল দাস - আনন্দবাজার
পত্রিকা, ৪-১১-১৯৯১।