চারানা আটানা
২৭) রামরাজ্য
জম্বুদ্বীপে কংগ্রেস-রাজ্যের তমসা দূরীকরণ ও রামরাজ্যের
অনির্বাণ শিখা প্রজ্বলনের নিমিত্ত লালকৃষ্ণ আদবাণী রথ লইয়া বাহির হইলেন। তাহার
নামের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত আছে রক্তবর্ণ লাল, তাই সকলে আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিল। আছে
প্রেমের দেবতা কৃষ্ণ, সকলে প্রেমানন্দে আপ্লুত হইয়া গেল। আছে বাণী, সকলে তাহার
আনননিঃসৃত বাক্যসমূহকে দৈববাণী ভাবিয়া লইল। অশ্বমেধের অশ্বের ন্যায় তাহার রথ প্রবল
বেগে ধূলি উড়াইয়া দ্যুলোক-ভূলোক-গোলোক বিদীর্ণ করিয়া জগৎসংসার প্রকম্পিত করিয়া
তুলিল। একের পর এক রাজ্যের মনুষ্য তাহার রথদর্শনে আপনাকে ধন্য
জ্ঞান করিতে লাগিল। অকস্মাৎ বেহারপ্রান্তে সেই রথের রশি টানিয়া ধরিলেন যাদবকুলপতি
...
কালান্তরে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মোদি অন্যান্য অধিকাংশ
রাজ্যে আপন ক্ষমতা প্রদর্শন করতঃ বেহারপ্রদেশে ত্রিংশতিবার সভা করিয়া আপন রামরাজ্য
প্রতিষ্ঠার বাসনা জ্ঞাপন করা সত্ত্বেও ভোটযুদ্ধে তাহাকে পরাভূত করিয়া শেষ হাস্য
হাসিল যাদবাধিপতি ...
আপনারা যারা অল্পস্বল্প পুরাণ পড়েছেন, তারা তো জানেন যে
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা যিনি প্রায় সবসময় ঘুমিয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে
জেগে উঠে যুগ, জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি তৈরি করে দিয়ে আবার ঘুমাতে চলে যান। এইভাবে
সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর যুগ চলে গেছে,
হারাধনের চারটি ছেলের রইলো বাকি এক – কলি। আমরা এখন সেই ঘোর কলির ঘোরতর রূপ
প্রত্যক্ষ করছি।
আগের তিনটে যুগের যে প্রচলিত গল্পগুলো আছে, সেগুলো পড়লেই
বোঝা যাবে আমাদের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। সত্যযুগ পুরোপুরি
ব্রাহ্মণদের যুগ। অং বং চং সংস্কিতো মন্তর আউড়ে বাকি সবার মাথায় হাত বুলিয়ে
ব্রাহ্মণ বললেন, আমিই শ্রেষ্ঠ। আমার মুখ দিয়ে ঈশ্বর যা বলাচ্ছেন, এর নাম বেদ, এই
হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের আধার। এই শ্রুতি তোরা স্রেফ শুনে যা। বেদবাক্য শিরোধার্য, তাই
আমি সবসময় তোদের মাথায় চড়ে থাকব। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে
হেদিয়ে যায়, সংস্কিতো তো তাদের কাছে বুলেট। নিষাদ কী বুঝবে উপনিষদের মাহাত্ম্য?
দূর থেকে নমস্কার করে তারা বলল, ঠিক আছে, তাই হবে বাপাঠাকুর। লাঠিসোটা সড়কি-বল্লম
নিয়ে যুদ্ধ করত ক্ষত্রিয়রা, তাদের মাথা কিঞ্চিৎ গরম, তারা মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,
কেন, তোমরা কীসের নেতা? অমনি পরশুরাম সংস্কৃত কুঠার নিয়ে ব্রেনওয়াশ করে তাদের মাথা
কুচকুচ করে কেটে দুনিয়া ক্ষত্রিয়শূন্য করে ফেলল, একবার না, গুনে গুনে আঠারবার।
সত্যযুগ পেরিয়ে গিয়ে এলো ত্রেতা, আমাদের রামরাজ্য। ত্রেতায়
ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ হচ্ছে লঙ্কাধিপতি রাবণ, সে বেদ বেদাঙ্গ বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য
সব জানে, তাই দেবতারাও তার বশ। দশ মুখ দিয়ে সে সর্বক্ষণ সংস্কৃত আউড়ায়, তার বৌ তার
মর্ম বুঝতে না পেরে টয়লেটে গিয়ে বসে থাকে। রাবণ হা হা করে হাসতে হাসতে বৌকে বলে,
তোমার উদর সদা মন্দ, তাই তুমি মন্দোদরী। ভাই বিভীষণ দাদার সংস্কৃতর দাপটে
তিতিবিরক্ত। কুম্ভকর্ণ সংস্কৃত অসহ্য লাগে বলে কানে তুলো দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে,
ইন্দ্রজিৎ বাড়ি ছেড়ে মেঘের রাজ্যের চিলেকোঠায় বসে বিড়ি ফোঁকে। ওদিকে মিথিলার
জমিদার চাষি জনকের সুন্দরী মেয়ে সীতাকে বিয়ে করল অযোধ্যার ক্ষত্রিয় রাজপুত্র রাম,
হানিমুন করতে গেল পঞ্চবটী বনে। আমি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ রাবণ, আমার বৌ অর্ডিনারি নারী
আর এই ক্ষুদ্র ক্ষত্রিয়ের এত সুন্দরী বৌ – এ কেমন কথা? রামের বৌকে সংস্কৃত মন্ত্রে
বশ করে হাতিয়ে নিতে গিয়ে নিজের পতন ডেকে আনল রাবণ। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণ গেল
হেরে। ত্রেতায় ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব হয়ে শুরু হলো ক্ষত্রিয়ের প্রতিষ্ঠা।
যুগান্তরে ত্রেতা পেরিয়ে এলো দ্বাপর। দেশজুড়ে দাপটের সঙ্গে
রাজ্য চালাচ্ছে ক্ষত্রিয় রাজারা।
হস্তিনাপুরে কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র, তার পূর্বে মগধে জরাসন্ধ, তার পূর্বে
প্রাগজ্যোতিষপুরে ভগদত্ত, পশ্চিমে ভোজে কুন্তিভোজ। নিজেদের মধ্যে
বিয়ে-শাদি করে জাঁকিয়ে বসেছে সারা দেশ জুড়ে। পশ্চিমে সুদূর গান্ধার থেকে পূর্বে
মণিপুর, সর্বত্র ক্ষত্রিয়রাজাদের বশে। আমাদের বিধিলিপি তবে এদের হাতেই লেখা, এরাই
যুগ-যুগ ধরে চালিয়ে যাবে শাসন আর আমরা বসে বসে আঁটি চুষব আর গরু চরাব, কেন– ভাবলো মধ্যভারতের গোয়ালাদের নেতা কৃষ্ণ। এতদিন
সে গরু চরাতো, বাঁশি বাজাত আর গোপিনী
যুবতীদের সাথে নদীর ধারে ফষ্টিনষ্টি করত। কিন্তু এই ভাবনা মাথায় ঢুকতেই স্টেডি
প্রেমিকা রাধা আর তার সখীদের ছেড়ে হাজির হলো রাজপ্রাসাদে, তার পিসি ভোজরাজকন্যা কুন্তী হস্তিনাপুরের রাজার
ভাদ্দরবৌ। পিসতুতো ভাইগুলো যদিও যুদ্ধনিপুণ, কিন্তু জারজ
সন্তান বৈ তো নয়! সামান্য সুযোগ আসতেই সূঁচ হয়ে ঢুকে গেল সে পরাক্রমশালী ক্ষত্রিয়
রাজাদের নিভৃত আলাপচারিতায়, আর ফাল হয়ে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ঘোরতর কুরুক্ষেত্র
বাধিয়ে ক্ষত্রিয় যুগের বিনাশ সাধন করল যাদবাধিপতি।
কলিযুগে যে যাদবদের দ্বাপরে-প্রাপ্ত দাপট কিছুটা বজায়
থাকবেই, তা তো জানাই। সেইজন্যেই তো লালু-মুলায়ম-শরদদের রমরমা। কাউ বেল্টে ঢুকে
বাঁশি বাজানো কি এতই সহজ? তবে আগের তিন যুগে শেষমেষ যা হয়েছে, তার থেকে এই শিক্ষা
পাওয়া যেতে পারে যে, কলিযুগের শেষভাগে যাদবদের হাত থেকে ক্ষমতা স্থানান্তরিত হবে
অন্য কারো হাতে। কে সে?
ঋষ্যশৃঙ্গের কথায় আসছি একটু পরেই। আগে রামের কথাটা বলে নিই।
আপনারা জানেন, কোশলদেশের অযোধ্যার রাজা ছিলেন সূর্যবংশীয় রঘুকুলপতি অজপুত্র দশরথ, যার জ্যেষ্ঠ সন্তানের নাম রাম। ভুল জানেন। রামের
এক দিদি ছিল, তার নাম শান্তা। সে ছিল কৌশল্যার মেয়ে, শান্তস্বভাবা, সুন্দরী।
কিন্তু পরাক্রমশালী রাজার শুধু একটা মেয়ে দিয়ে কী হবে? মেয়ে
তো আর রাজ্যশাসন করতে পারবে না ত্রেতাযুগে। সিরিমাভো বন্দরনায়েক, ইন্দিরা গান্ধী,
মার্গারেট থ্যাচার আসবে সেই কলিকালে, ততদিন রাজ্য চালাবে কেবল পুরুষেই, তার জন্যে
রাজার চাই ছেলে, সর্বগুণান্বিত পুত্রসন্তান। কিন্তু দশরথ-কৌশল্যার ছেলে আর হয় না। অযোধ্যা ছেড়ে দশরথ উত্তরে কেকয়রাজ্যে– এখন যে জায়গাটাকে
ইউক্রেন বলা হয়, সেখানে গিয়ে সেখানকার রাজা অশ্বপতিকে বললেন, দ্যাখো, আমার ছেলে
চাই, হচ্ছে না, তোমার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। অশ্বপতি বললেন, তা কী করে হয়?
তোমার একজন রানি রয়েছে। আমার মেয়ে কৈকেয়ীকে তুমি বিয়ে করবে, সে তো কৌশল্যার
চাকরানি হয়ে থাকবে, এ আমি মেনে নিতে পারি না। দশরথ বলতে পারতেন, তুমি কী মেনে নেবে
না নেবে সে তোমার সমস্যা, আমি তোমাকে পটকে দিয়ে কৈকেয়ীকে বিয়ে করেই ছাড়বো, কিন্তু
তা হলে আর তিনি দশরথ কেন? তাই বললেন, শোনো, অশ্বপতি, আমার ছেলে নেই। কৈকেয়ী যদি
আমাকে একটা ছেলে দিতে পারে, সেই হবে পরের রাজা, আর কৈকেয়ী রাজমাতা। তাহলে আর তোমার
কী সমস্যা? অশ্বপতি ভাবলেন, হ্যাঁ, তাই তো।
বিয়ে হয়ে গেল। প্রায়বৃদ্ধ দশরথের প্রাসাদ আলো করে এলো তরুণী
ভার্য্যা কৈকেয়ী।
কিন্তু দশরথের ভাগ্যে তাও ছেলে জুটলো না। কৈকেয়ীর ছেলেও হলো
না, মেয়েও না। উপায় না পেয়ে প্রৌঢ় দশরথ আবার বিয়ে করতে বেরোলেন, ঘরে তুলে আনলেন
কাশীরাজকন্যা সুমিত্রাকে। হায়, তারও ছেলেপুলে হলো না।
এখন কী হবে? অযোধ্যা শাসন করবে কে? মরার পর দশরথ যে বৈতরণী
পার হবেন, সেখানে আলো দেখাবে কে তাকে বা তার পিতৃপুরুষদের? চিন্তায় চিন্তায় রাজার
ঘুম হয় না। মুখে অন্ন রোচে না। শরীরে বল পান না। আইবুড়ো শান্তার বয়স হয়েছে, তার
দিকে তাকালেই দশরথের মেজাজ আরো খিঁচড়ে যায়।
হঠাৎই গাছে না উঠতেই এক কাঁদির মতো সমাধান নিয়ে হাজির হলেন
পার্শ্ববর্তী রাজ্য অঙ্গের অধিপতি বন্ধু
রোমপাদ। দশরথকে বললেন, দশু, আমার ভারি বিপদ, তুই না বাঁচালে আমি ভেসে যাব ভাই। দশরথ বললেন, কী
হয়েছে রোমা? রোমপাদ বললেন, আমার রাজ্যে ভয়ঙ্কর খরা। বিষ্টি-বাদলার খোঁজ নেই। হয়েছে
কী, আমার ওখানে ঋষ্যশৃঙ্গ নামে এক মুনি আছে, সে হচ্ছে বিভান্ডক ঋষির ছেলে। দেবরাজ
ইন্দ্রই তো মেঘ-বৃষ্টির অধীশ্বর, সে এই বিভান্ডক-ঋষ্যশৃঙ্গর ভয়ে অস্থির। বৃষ্টি
হলে তবেই তো গাছে প্রাণ আসে, ফুল ফল হয়। বিভান্ডক ঋষ্যশৃঙ্গের বিয়ে-ফিয়ে না দিয়ে
নাকি দেবতা বানাবে, তাই ইন্দ্রের রাগ তার ওপর, আর তাই আমার দেশে খরা। আমার ধারণা
তোমারও যে ছেলেপুলে হচ্ছে না, তার কারণও ঐ ব্রহ্মচারী তপস্বী ঋষ্যশৃঙ্গই। একমাত্র উপায় হচ্ছে
যদি আইবুড়ো ব্যাটাকে ধরেবেঁধে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যায়। কিন্তু হাজার হোক, মুনিঋষি
মানুষ। খুব সাবধানে এই কাজটা করা দরকার। একবার বুঝে ফেললেই লাল চোখে তাকাবে, সামনে
যা থাকবে সব ভস্ম। আমার যদি একটা শান্তমতি
মেয়ে থাকতো রে, দশু, তাহলে যেভাবেই হোক ঐ ঋষ্যশৃঙ্গকে পটিয়ে তার সঙ্গে
বিয়ে দেওয়াতাম। রাজ্যে শান্তি ফিরে আসত তাহলে। কিন্তু, দশু রে, আমার তো কোনো মেয়ে
নেই। তোর মেয়ে শান্তাকে আমায় দে, আমি ওকে দত্তক নিই। আমার সমস্যা মিটে গেলে, তোকে কথা দিচ্ছি, যে করেই হোক, ঋষ্যশৃঙ্গকে দিয়ে ইন্দ্রকে রাজী করিয়ে
ফেলবো যেন তোর বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারটা সমাধান করিয়ে দেয়।
রোমপাদের জন্যে চা নিয়ে এসেছিল শান্তা। হঠাৎ দশরথের মনে হলো,
আহা, এই মেয়েই আমার সমস্যার সমাধান করে দেবে। রোমপাদের দত্তককন্যা হিসাবে
অঙ্গরাজ্যে চলে গেল শান্তা।
ঋষ্যশৃঙ্গের জন্মকাহিনীও বিচিত্র। বহু বছরের প্রবল
তপস্যার ফলে বিভান্ডক সিদ্ধিলাভ করার
লাস্ট স্টেজে চলে গেছিলেন। সিদ্ধিলাভ করলেই স্পেশ্যাল ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়,
দেবত্বে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। দেবরাজ ইন্দ্র তা মোটেই চান না। একেতেই স্বর্গে দেবতার
ছড়াছড়ি, আবার একটা এক্সট্রা দেবতা, তার ঘরবাড়ি, খাবার-দাবার, বিনোদনের ব্যবস্থা
করা কি চাট্টিখানি কথা? এর সঙ্গে আছে ভয়। যদি নতুন দেবতা এসে তার গদি কেড়ে নেয়!
ইন্দ্র দেবতাদের রাজা হলেও বেসিকালি ভীতুর ডিম, সবসময় ভয়ে ভয়েই থাকে। বিভান্ডকের
তপস্যায় থরহরি-কম্প দেবরাজ তার সাধের ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভার মতো এক অনিন্দ্যসুন্দরী
যুবতী অপ্সরাকে পাঠালেন বিভান্ডকের ভান্ডা
ফুড়ে দিতে। অপ্সরা তপস্যারত বিভান্ডকের সামনে এসে চোলি কা পিছে ক্যা হ্যায় নাচতে
নাচতে চোলি ফোলি হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। চোখ খুলেই বিভান্ডক দেখেন সামনে ঐ জিনিস! যতই
সাধু হোন, সামলাতে পারেন নাকি? অপ্সরাকে স্পর্শ করার আগে সেই মোহময়ী রূপ দর্শনেই
তার স্খলন হয়ে গেল।
এক হরিণী সেখানে ঘাস খাচ্ছিল, ঘাসের সঙ্গে বিভান্ডকের
দেহরসও চলে গেল তার শরীরে আর তার ফলেই জন্ম হল ঋষ্যশৃঙ্গের। তার সবকিছুই মানুষের,
কিন্তু মাথায় হরিণের মতো শিং!
বিভান্ডকের তপস্যা বিফলে গেল বলে নিজের ওপর প্রবল রাগ।
ঋষ্যশৃঙ্গকে কিছুতেই তিনি মেয়েদের সংস্পর্শে আসতে দেবেন না। তার কুটিরের বাইরে
তিনি লক্ষণরেখা এঁকে দিলেন, যা পেরিয়ে মানবী তো কোন ছার, একটা গাইগরু, হংসী বা
হরিণী এলেও মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সেই কুটীরে কোনো ফুল ফুটত না, মৌমাছি আসত না, যা কিছুর
মধ্যে নারীত্ব আছে, সবকিছু বর্জিত সে এক রুখা-শুখা আশ্রম। তার মধ্যে ঋষ্যশৃঙ্গ বড়
হতে লাগল। ঋষ্যশৃঙ্গো বনচরস্তপঃ স্বাধ্যায়সংযুতঃ। অনভিজ্ঞস্তু নারীণাং বিষয়াণাং
সুখস্য চ।। তপ আর স্বাধ্যায় নিয়েই বনচর ঋষ্যশৃঙ্গ সংযুত থাকেন। নারীদের বিষয়ে ও
তদসংযুক্ত সুখের বিষয়ে সে অনভিজ্ঞ।
ইন্দ্র সেখানে কোনো অপ্সরা পাঠাতেও সাহস পেল না। যাবে কী
করে, লক্ষণরেখা পার হলেই ভস্ম! রেগেমেগে
ইন্দ্র তাই পুরো অঙ্গরাজ্যেই বৃষ্টি-বাদলা বন্ধ করে দিলেন। খরায় শুকাতে লাগল
অঙ্গদেশ।
শান্তা তো এলো রোমপাদের অঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে। এখন
ঋষ্যশৃঙ্গকে তো ভুলিয়ে ভালিয়ে সেখানে আনতে হবে। তা কী করে সম্ভব? রোমপাদ ঠিক করলেন
কিছু নাচনেওয়ালী বারাঙ্গনাকে সেখানে পাঠাবেন ছেলেদের পোশাক পরিয়ে। তিনি শুনেছেন
ঋষ্যশৃঙ্গ জীবনে মেয়ে দেখেই নি, সে কী করে বুঝবে মেয়ে কী বস্তু! এদিকে নর্তকীরা
বিভান্ডকের নাম জানে, তারা শাপের ভয়েই সে মুখো হতে রাজী নয়। শেষে রাজা রোমপাদ আর
রাজ্যের মুখ চেয়ে তারা রাজী হলো। বিভান্ডক যখন আশ্রমের বাইরে গেছেন ভিক্ষার
প্রয়োজনে, তখন তারা মুনির বেশে নৌকাযোগে তার আশ্রমের কাছে লক্ষণরেখার বাইরে হাজির।
আগে থেকে চর পাঠিয়ে লক্ষ্য রাখা হচ্ছিল, যাতে বিভান্ডকের সামনে কেউ হাজির না হয়। আশ্রমে
ঋষ্যশৃঙ্গ একা, সে এতগুলো ঋষিপুত্র, তাদের সুন্দর সুন্দর চোখ, ঝুঁটি বাঁধা চুল,
চলাফেরায় অন্যরকম বিভঙ্গ এসব দেখে বিভোর হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করছে, আপনারা কোন আশ্রম
থেকে আসছেন? সে ওদেরকে আপ্যায়ন করে কুটিরের কিছু খাবার ওদের দিয়েছে। ওরা তার
উত্তরে তাদের সঙ্গে আনা রাজকীয় উত্তম খাদ্য আর পানীয় ঋষ্যশৃঙ্গকে খেতে দিয়েছে।
ঋষ্যশৃঙ্গ জীবনে কুয়োর জল আর পাখিতে খাওয়া অতিপক্ক ফল ছাড়া কিছু খায়নি, সে এই
স্বাদিষ্ট খাবার, মিষ্টি, শরবত খেয়ে মজে গেছে। এইসব খেয়ে আর এদের সঙ্গে কথাবার্তা
বলে তার মন উচাটন হয়ে গেছে। সন্ধ্যে নামার আগেই নর্তকীর দল ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রম থেকে নৌকা
নিয়ে হাওয়া। যাতে বিভান্ডক ফেরার আগেই তারা অঙ্গদেশে ফিরে আসতে পারে।
বিভান্ডক ফিরে দেখেন ছেলের মন বিক্ষিপ্ত, জিজ্ঞেস করলেন কী
ব্যাপার। ছেলে বলল, কিছু মুনিকুমারেরা এসেছিল। বাবা বললেন, খবরদার, অচেনা লোকের
সঙ্গে নো কথাবার্তা। এখানে রাক্ষস টাক্ষস মায়ার রূপ ধরে তাদের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতে
আসতে পারে। সাবধান। কিন্তু ছেলের মন মজে গেছে। পরের দিন আবার তারা বিকেল বিকেল
হাজির হতেই ঋষ্যশৃঙ্গ ওদের সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে গেছে। ওরা তাকে বলেছে, আমরা তোমার
আশ্রমে তো এত সময় কাটালাম, আমাদের আশ্রমে যাবে চলো। ঋষ্যশৃঙ্গ বাবার কথা ভুলে
বলেছে, চলো। ব্যাস, তারা তাকে তুলে নিয়েছে নিজেদের নৌকায়। ঋষ্যশৃঙ্গ জীবনে নৌকাও
দেখেনি। বাবার কাছে যা শুনেছে, তাতে তার ধারণা ছিল নৌকা মানে সরু ডিঙি টাইপ কিছু।
রাজার বজরা চড়ে তার মাথা পুরো ঘুরে গেছে। সেখানে কত সুখাদ্য, কত পানীয়, তার ওপর
সুন্দর সুন্দর বন্ধুর দল নাচ গান করছে। ঋষ্যশৃঙ্গ গান বলতে বোঝে সামগান। এরা গাইছে
আইটেম নাম্বার, তার সাথে ঝিঙ্কু নাচ। বাবার মতোই তার রক্তে দোলা দিয়েছে, সে কিছু বোঝার আগেই হাজির হয়েছে অঙ্গদেশে রোমপাদের
রাজপ্রাসাদে। সেখানে তাকে ভোলানোর জন্যে অপেক্ষা করছে সুন্দরী রাজকন্যা শান্তা।
ঋষ্যশৃঙ্গের তাপস ব্রহ্মচর্য ভূলুন্ঠিত হয়ে গেছে।
অঙ্গদেশে ঋষ্যশৃঙ্গের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাই অঝোরে নেমে
গেছে বৃষ্টি। খরায় শুকিয়ে যাওয়া গাছে দেখা দিয়েছে কুঁড়ির চিহ্ন। মাটির বুকে জেগে
উঠেছে ঘাসের কম্পন। চাতকের বুক তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছিল, সে আকাশের দিকে মুখ করে আশ
মিটিয়ে খাচ্ছে বৃষ্টিবারি। রাজ্যের মানুষজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দুহাত তুলে
রাজাকে ধন্য ধন্য করছে।
রাজাও অবাক – এত বড় ঋষি এই ঋষ্যশৃঙ্গ! ঋষিবালককে নিয়ে যাওয়া
হয়েছে রাজ-অন্তঃপুরে। শান্তাকে দেখে একেবারে গলে গেছে ঋষিবালক। ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে
আছে সেই অদৃষ্টপূর্বা অনিন্দ্যকান্তি সুন্দরীর দিকে। রাজা দেরি না করে রাজপুরোহিত
ডেকে বলে দিয়েছেন বিয়ের ব্যবস্থা করতে। তারা অগ্নিকুন্ড জ্বালিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে দিয়ে
মন্ত্র পড়াচ্ছে – যদিদং হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম।
এদিকে বিভান্ডক আশ্রমে ফিরে এসেই দেখেছেন ঋষ্যশৃঙ্গ নেই।
যোগবলে বুঝে গেলেন কেসটা কী। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা জুড়েছেন অঙ্গদেশের দিকে। কিন্তু
যতক্ষণে পৌঁছেছেন, ততক্ষণে অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে তো বটেই, এমনকি ফুলশয্যাও শেষ।
ঋষ্যশৃঙ্গ এখন শান্তা ছাড়া কিছু বোঝে না।
রোমপাদ জানতেন এমনটা ঘটতে পারে।
তিনিও প্রস্তুত
ছিলেন বিভান্ডকের জন্যে। ক্রুদ্ধ বিভান্ডক রাজপ্রাসাদে হাজির হতেই তার সেবায় লেগে
গেছে একগুচ্ছ রাজকর্মচারী। কেউ তার পা ধুয়ে দিচ্ছে, কেউ মুছিয়ে দিচ্ছে, একজন গড়গড়া
দিয়ে গেল তো আর একজন টিকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। পাখার বাতাস করতে লাগল দুদিক থেকে
দুজনে। সুন্দর সুন্দর খাদ্য পানীয় এসে গেল বিভান্ডকের জন্যেও। খেয়ে উঠে বসেছেন,
একজন পান সেজে নিয়ে এলো, আর একজন লেগে গেল পা টিপে দিতে। বিভান্ডক জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? তারা বলল,
আজ্ঞে রাজার জামাই ঋষ্যশৃঙ্গের আদেশেই আমরা এই সব করছি।
বিভান্ডকের রাগ পড়ে আসছিল। সন্ধ্যে নাগাদ শান্তা আর
ঋষ্যশৃঙ্গ তার কাছে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই তিনি কী বলে রাগ দেখাবেন তা
প্রায় ভুলে গেলেন। রোমপাদ এসে তাকে জানালেন, এরাই এ রাজ্যের ভাবী রাজা-রানি।
বিভান্ডক আর কী বলবেন? ছেলে রাজা হতে চলেছে, আর কী চাই?
দশরথের যখন ছেলেপুলে হলোই না, রাজপুরোহিত বশিষ্টের আদেশে এই
ঋষ্যশৃঙ্গকেই অযোধ্যায় নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হলো পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করাতে। আদতে
দশরথের নিজের জামাই যজ্ঞের পুরোহিত, তার যজ্ঞের ফলেই আগুন থেকে উঠে আসে চরু। তার আদ্ধেক
দেওয়া হলো কৌশল্যাকে, বাকি আদ্ধেক কৈকেয়ীকে। এরা খাওয়ার আগে দুজনেই ভাবলেন, তাই তো সুমিত্রা তো পেল না!
কৌশল্যা নিজের ভাগের আদ্ধেক নিজে খেয়ে
বাকি আদ্ধেক দিলেন সুমিত্রাকে। কৈকেয়ীও তাই। ফলে সময়কালে
কৌশল্যা আর কৈকেয়ীর একটা করে বাচ্চা হলো, সুমিত্রার হলো দুটো।
তো এই হলো রামের জন্মের ইতিহাস। সেই রাজ্যই রামরাজ্য। রামের
জন্মের জন্যে প্রয়োজন হয়েছিল বাড়ির
একমাত্র মেয়েকে অন্যের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। এক নিষ্পাপ ঋষিবালককে ছলাকলায় ভুলানোর জন্যে একদল পতিতা
নিয়োগ। বালকের অজ্ঞতা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে
তার বিয়ে দিয়ে তার ব্রহ্মচর্য ঘুচিয়ে দেওয়া। ঋষিবালক ও তার ক্ষমতাধর বাপকে উৎকোচ দিয়ে বশীভূত
করা।
যারা দেশে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা যে এইসব বিশেষ
বিশেষ অস্ত্র অজ্ঞ ভোটার দেশবাসীর ওপর প্রয়োগ করবে এই ঘোর কলিতে, তাতে আর আশ্চর্য
কী!
Khub sundor... :-)
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লেখনী ও উপস্থাপনা !
উত্তরমুছুন