কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

আমার মা


আমার জন্মের বহু আগেই আমার মা মারা যায়। শুনেছি মাকে দেখতে খুব সুন্দর ছিল। একেবারে চাঁপাফুলের মতো গায়ের রঙ, ঝিনুক কপাল। এক পিঠ কোঁচকানো চুল।

বাড়িতে একবার মাঝরাত্রে চোর ঢুকেছিল। চোরটা কতগুলো দামী জিনিষপত্র চুরি করে পালাচ্ছিল পালাতে গিয়ে রেড হ্যান্ডেড কট। কেউ বলছে উত্তম মধ্যম দাও, কেউ পুলিশ, মা মানে আমার মা ছেলেটাকে ছেড়ে দিতে বলল। মমতা বা  সহানুভূতি বললে যা বোঝায়, খানিকটা সেইরকম। এদিকে চোর ততক্ষণে টেনশন ফ্রী।

আর একবার, বন্যার সময়। চর্তুদিক বানভাসি। খাবার নেই পানীয় জল নেই, পথঘাটই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। সরকারী সাহায্য আসছে আসছে বলছে সবাই, কিন্তু কোথায় কী? তখন আমার মা আমাদের বাড়ির পুরো একতলাটা বন্যা দুর্গতদের জন্য ছেড়ে দেয়। ঘরে চাল ডাল ইত্যাদি যা কিছু রাখা ছিল, সবই ত্রাণে  চলে যায়। এসবই আমার কানে শোনা কথা। কি করব? আমি তো আর তখন জন্মাইনি। গাঁয়ের একদম শেষ প্রান্তে থাকত বুড়ি দিদিমা। প্রায় একশো বছর বয়স। পাকা সনের মতো চুল। সে আমার মাকে খুব ভালোবাসত। দিদিমাই আমাকে ডেকে ডেকে মায়ের গল্পগুলো শোনাত। বলত, সব কি আর মনে আছে বাপ? সে সব কোন কালের কথা! তোর দাদু তখন খুব ছোট। নয় কি দশ বছর বয়স হবে। তবু তোর মা দাদুর সব কথা শুনত। কোনোদিন অবাধ্য হয়নি কোনোদিন ইস্কুল যাব না বলে বায়না করেনি। লক্ষ্মী মেয়ে হলে যা হয়!

এক একদিন রাত্রে মাকে স্বপ্নে দেখি। তখন যে কী ভালো লাগে! এক একদিন মায়ের  পুরনো শাড়িগুলো নাকের সামনে ধরে গন্ধ শুঁকি। মাঝে মাঝে বাগানে লেবুগাছতলায় দাঁড়াই গিয়ে। ও গাছটা মা লাগিয়েছিল। আমি অবশ্য লেবু টেবু খাই না। একে তাকে বিলিয়ে দিই। যারা খায়, তারা আবার লেবু চাইতে আসে। এসে মায়ের সুখ্যাতি করে যায়।

মাঝে মাঝে মায়ের কথা মনে পড়লে বেদম রাগও হয়। কেন আমাকে একা রেখে  মা মরে গেল? মা বেঁচে থাকলে কি আজ আমার এমন দশা হতো? চাদ্দিকে তার ছেঁড়া তানপুরা ।

কিছুটা খাসির মাংসর কিমাকে নুন হলুদ দিয়ে জলে এমন করে সেদ্ধ করত মা,  যাতে জলও শুকিয়ে যায় আবার মাংসও সুসেদ্ধ হয়। তারপর সেই শুকনো মাংস  সেদ্ধর সঙ্গে নানান মশলা যেমন আদা পেঁয়াজ রসুন গরমমশলা লংকা সব মিশিয়ে সেদ্ধ করা চটকানো ছোলার ডাল মিশিয়ে এক একটা চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা বড়া ... শামি কাবাব নাকি এমনি করেই তৈরি করতে হয়।

শাশ্বত ক্ষুধার্তর  মতো মা মা করে ডেকে উঠি। নাভীর গহীন থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে উঠে আসে ঝড় আর বৃষ্টি। কিন্তু সেই বৃষ্টিতে কোনো জল ছিল না। কিছু ঝুরঝুরে বরফ...

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন