কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

স্বপ্নাদ্য  


তপন স্বপ্নে খালি দেখে বাবা হাত নেড়ে চলে যাচ্ছে। তপনের হাত থেকে বাবার হাত খুলে যাচ্ছে। বাবার ধুতির কোঁচা উড়ছে।
এস্বপ্ন বারেবারে কেন দেখে, জানে না তপন। বাবা চলে গেছে প্রায় একযুগ হতে চলল।
তপনদের কলোনির অদূরে বাণীদের বাড়ি। তপন বাণীকে বিয়ে করবে, সবাই  জানে। তপন বাণীকে চুমু খেয়েছে, আরও অল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তপন বলে,
- জানো একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখি।
- কী স্বপ্ন? মাথায় কাকে হেগেছে?
- ঐ আসলে...
তপন চেপে যায়। বাণীও জিদ করে না। খুব প্র্যাক্টিক্যাল মেয়ে। নিজের আয় আছে, বাড়ির কাছে বিউটি পার্লারে কনে সাজায়, বাড়িতে দুটো টিউশনিও  করে। তপনের মতো অলস না।
তপন ভাবে, বাণীটা একটু মেয়ে মেয়ে হতে পারত! একটু ন্যাকা, একটু  আধো-আধো কল্পনা। যেমন,
- এই কিসের স্বপ্ন গো? ফুলসাজানো রথে তুমি আর আমি উড়ে যাচ্ছি আর ওপর থেকে পুষ্পবৃষ্টি...?
একটা বিখ্যাত গয়নার দোকান এরকম চমৎকার বিজ্ঞাপন দিত। ইদানিং অন্য কিছু দিচ্ছে। তপনের মনে হলো বেশ বিজ্ঞাপন।
বাণী চা আনল, দুটো বিস্কিট। চুল বেঁধে ফ্রেশ হয়েছে। বলল,
- খাও। এক্ষুণি বেরুব। বিয়ের সিজন চলছে। কাজ অনেক আসছে। তোমার কী হলো? যাও এবারে...
তপন একটা প্যাথোলজি সেন্টারে ক্যাশে বসে। টাকা জমা করে, পেশেন্টের নামধাম লিখে রাখতে হয়। মাথার ওপরে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল, টান হয়ে বলল,
- এ-ই যাচ্ছি এবারে।  
- বাসায় গিয়ে স্নান করো। বগল থেকে গন্ধ আসছে।
বাণী কাঠকাঠ করে কথা বলে চলে যায়। তপন তাকিয়ে ভাবে, বাণীর পেছন  বেশি সুন্দর, যদিও রোগাই। বাণীকে ওই বিশেষ দোকানের কোনো একটা  গয়না কিনে দিতে ইচ্ছে করে। কীরকম খরচ? বাণীর কি সোনার গয়না  আছে? চুড়ি-কানের দুল-গলার হার?


মা ভাত বেড়েছিল। ডাকল,
- তপুউ, ভাত খাইয়া যা। তোর দেরি হয় না?
- একটা স্বপ্ন প্রায় রোজ দেখি, বুঝেছ মা?
- মগজ খালি থাকলে স্বপ্নই দেখবা। যাও, খাইয়া উদ্ধার কর্‌... কাজে বার হ
- আরে শোনো না!
এখন আর কলকাতায় বাঙালভাষায় কথা বিশেষ শোনা যায় না। তপুর মা সত্তরের দশকে ইণ্ডিয়ায় আসে। ভাষাটা ছাড়তে পারেনি। ঘড়িতে বেলা জানান দিচ্ছে। অন্যদিনের চেয়ে একটু আগে হয়ে গেছে। বেশিরভাগ দিন একেবারে শেষ মুহূর্তে টাল সামলাতে সামলাতে সে হাজির হয়। তাদের দোকানের পাশে গ্রহরত্নের দোকানে জ্যোতিষ বসেন। ওখানে স্বপ্নের অর্থ জানা যাবে?
ভাবতে ভাবতে অটোতে ওঠে তপন। ঠিক পাশে বিরাট বাস। কয়েক পাক ঘুরতেই লাল-আলো। ওটা সবুজ হলে গাড়িগুলো একসাথে ছুটতে শুরু করবে। যদি তপনদের অটো বাসের তলায় পিষে যায়? তপনের পেট কামড়ে ওঠে। বাণী তাহলে কি কোনও স্বপ্ন দেখবে?

শুতে যাওয়ার আগে মা ডাকল,
- তপু শুইনা যা ত।
- কী, বল!
- এত ব্যস্ত হস্‌ ক্যান?
মা তক্তপোষের ওপরে ছড়িয়ে বসেছে গোটাকয়েক শাড়ি, লম্বা লম্বা ফল। পিকোর মেশিন মেঝেতে। অনেক রাত অবধি বসে বসে লাগাবে।
- বল কী বলবে। ঘুম পাইতাছে।
- দ্যাখ দেখি চিনস নাকি, দ্যাখ।
সার সার আঁধার মানুষ। ছাইয়ের মতো ছোপছাপ লেগে অস্পষ্ট ফোটোগ্রাফ। তপন চোখ ডলে বলে,
- ধুর্‌ কী যে দেখাও!  
- ক্যান? এই দ্যাখ সারিকা, এই রাধিকা, এই বড়মণি, এই তোর জ্যাঠা, তোর বাপে তখন কইটুক, মাটির লগে কথা কইত। ঠাহর কইরা দেখ।
তপন ফোটোখানা হাতে ধরে বসে থাকে। তার মা একটা পুচকি বাক্স ধরায়। বলে,
- দ্যাখ।
সাদা পাথর-বসানো খুব ছোট সোনার আংটি। দেখিয়ে নিয়ে আবার বাক্সে তুলে রাখল। ফিসফিস করল কানের গোড়ায়,
- বড়মণি আমার জিম্মায় দিছিল, তর বাপের মুখেভাতের। আসল হী-রা, রাইখা দিছি। তর ছেলে পরব। ফোটোটা তুই রাখ। বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমাবি। স্বপন দেখবি।
তপু ফোটো হাতে করে তার আধখানা খুপরিতে ঢুকল। বালিশে মাথা দিয়ে কেমন ক্লোরোফর্মের গন্ধ এলো নাকের গোড়ায়। এবারে পর পর স্বপ্নরাশি  আসবে। কী কী স্বপ্ন দেখা যাবে আগে ভেবে নিতে পারলে হতো।
বাবা হাত ছেড়ে দিয়ে হাসিমুখে চলে যাচ্ছে...
বাণী আর তার মাথায় ঝিলমিল...
হীরে রঙের গোল চাঁদ সোনালি বেড় দেওয়া... 



2 কমেন্টস্: