কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৮৮  


এবছর গত ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে আমরা জামশেদপুরে আয়োজন করেছিলাম বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সমবেত সম্মেলন। আমরা এই আয়োজন করেছিলাম জামশেদপুরের সংগঠন ‘মুক্তমঞ্চ’র সৌজন্যে। ইস্পাতনগরী জামশেদপুরে শুধুমাত্র লৌহ ও ইস্পাতের কারখানাই নয়, বরং আরও অজস্র শিল্প কারখানা আছে। এইসব কারখানায় স্বাভাবিক কারণেই কর্মসূত্রে সমবেত হয়েছেন সারা ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ। আবার বৃহৎ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা। এরই পাশাপাশি বিস্তার লাভ করেছে বিভিন্ন ব্যবসা ও বাণিজ্যের স্তর ও পর্যায়। রুটি রুজির তাগিদে এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন শিল্প শহরে ও বাণিজ্য কেন্দ্রে সব সময়ই বসতি স্থাপন করেছে। এবং যখন এসেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে নিজের নিজের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা। সবাই সবকিছু নিয়ে এসেছেন, কিন্তু কারও সঙ্গে কারওর বৈশিষ্ট্য  মিলেমিশে যায়নি। প্রত্যেকেই নিজস্বতা বজায় রেখে এবং পারস্পরিক বিনিময়মূলক আদান প্রদানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে থেকেছে। আবার যেসব গ্রাম শহরকে কেন্দ্র করে এইসব শিল্প কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, সেইসব স্থানের ক্ষেত্রসীমার স্থায়ী বসবাসকারী মানুষজনেরা তাদের নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা বহন করে এসেছে। বহিরাগত মানুষেরা সেইসব স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গেও মিলিত হয়েছে। এবং এভাবেই ভারতীয় সভ্যতার যে চিরকালী ভাবনা ও বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বিবিধতার মাঝে ঐক্য, তা অক্ষুণ্ণ রেখেছে।

জামশেদপুরের ‘মুক্তমঞ্চ’র স্থাপনাও এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে সম্ভব হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে যাত্রা শুরু। মূলত বাংলা ভাষা শহীদ দিবস রূপেই দিনটি পালিত হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে তার পরিসর আরও বিস্তৃত করে ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিনটি পালিত হয়েছিল বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের  সমবেত যোগদানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে। অনুরূপভাবে এবছরও দিনটি আমরা উদযাপন করেছি বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষা দিবস রূপে। বাংলা, হিন্দী, ভোজপুরি, সাঁওতালি, হো, কুরমালি, অসমীয়া, তামিল, পাঞ্জাবী, গুজরাটি, উড়িয়া ভাষায় কবিতা পঠিত হয়েছে, বক্তৃতা হয়েছে, সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশিত হয়েছে।

প্রসঙ্গত আমরা আবার স্মরণ করি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা শহরে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের কথা। ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে মিছিল করেছিলেন বাংলা ভাষাকে দেশের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি সেই মিছিলের ওপর গুলি চালায়। মৃত্যু হয় আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমান ছাড়াও আরও অনেকের। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। এঁরা সবাই শহীদ হয়েছিলেন বাংলাভাষাকে ভালোবেসে। আমরা তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জানাই প্রণাম ও শ্রদ্ধা।  

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৬  




 

রহস্য আমার পিছু ছাড়ছে না। তাই ঠিক করলাম, কোরিয়ার পর এই ফাঁকে স্প্যানিশ ছবি নিয়ে কিছু বলে নেওয়া যাক। স্পেন ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ সমেত মোট ২০টি দেশের সরকারি ভাষা স্প্যানিশ। ফলে স্প্যানিশ ছবি নিয়ে কিছু বললে দক্ষিণ আমেরিকার সিনেমার কথাও আসবেই। আর স্পেনের সিনেমা মানেই লুই বুনুয়েল দিয়ে শুরু, সেটা নিশ্চয় বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না।

স্প্যানিশ সিনেমার মূল লুকিয়ে আছে অনেক গভীরে এবং ফ্রেঞ্চ সিনেমার পরেই স্প্যানিশ সিনেমার বিস্তার বহুধাযুক্ত। কিন্তু আজ আমরা আলোচনা করব কিছু রহস্যময় স্প্যানিশ ছবি নিয়ে। একদম বাছাই করে। যাতে আগেরবারের কোরিয়ান সিনেমার স্মৃতি আমাদের মনে ভাসে।

প্রথম ছবি লুই বুনুয়েলের ‘দ্য এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ (১৯৬২)। দ্বিতীয় ভিক্টর এরিসের ‘স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ’ (১৯৭৩)। তৃতীয় আলেহান্দ্রো আমেনাবারের ‘ওপেন ইওর আইজ’ (১৯৯৭)। চতুর্থ ছায়াছবি পেদ্রো আলমোদোভারের ‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’ (১৯৯৯)। এবং শেষ সিনেমা গিলের্মো ডেল-টোরোর ‘প্যান’স ল্যাবাইরিন্থ’ (২০০৬)।

লুই বুনুয়েলের ৯৫ মিনিটের সিনেমা ‘দ্য এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ আমার মনে হয়েছে সিম্বলিজম ও সুররিয়েলিজমের মিশ্র। এক ডিনার পার্টিতে এসে খাওয়ার  পর অতিথিরা সোফায় বসে পড়ে এবং সকাল হবার পর বুঝতে পারে তারা এই বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারছে না। আস্তে আস্তে খাবার ও জল শেষ হয়ে আসে। তখন সবার আসল রূপ বেরিয়ে আসে, তারা একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠে। একজন বয়স্ক অতিথি মারা যান। একজোড়া তরু-তরুণী সুইসাইড করে। জীবিতরা  কোনমতে দেওয়ালে একটা ফুটো করে বেরোনোর চেষ্টা করে, কিন্তু সেখান দিয়ে  কিছু ভেড়া ঢুকে পরে। তার ভেতর একটা ভেড়া অতিথিরা কেটে খায়। এবং গল্প আরো এগোতে থাকে। চূড়ান্ত পরাবাস্তব গল্প। সাদা কালো ছবি, ক্যামেরার কাজ অনবদ্য। বিশেষ করে যেখানে সবাই একে অপরকে শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করছে। এই সিনেমা সুররিয়েলিজমের জন্য বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়েছে।

ভিক্টর এরিসে বেশ কিছু বিখ্যাত সিনেমা করেছেন যার ভেতর ‘স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ’-এর নাম সবার আগে উঠে আসে। ১৯৪০ সালের পটভূমিকায় স্বৈরাচারী ফ্রাঙ্কো-র রাজত্বে এই সিনেমা। ছ’বছরের এক বাচ্চা মেয়ে আনা তার বাবা-মা-দিদির সঙ্গে নিজের গ্রামে থাকে। দু-বোন একবার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সিনেমা দেখতে যায়। সেই থেকে আনাকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ছায়া তাড়া করে বেড়ায়, এমনকি চোখ বুজে তার সঙ্গে কথাও বলে। এক পরিত্যক্ত বাড়িতে গিয়ে তার মনে হয় এর ভেতরেই হয়ত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন থাকে। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখতে পায় এক আহত সৈনিককে। আনা সেই আহত সৈনিককে খাবার-জল-বাবার কোট, সবকিছু দিয়ে আসে যাতে তার কষ্ট না হয়। কিন্তু একদিন ফ্রাঙ্কোর পুলিশবাহিনী এসে এই সৈনিককে মেরে ফেলে। পুলিশ আনার বাবাকে সন্দেহ করে যেহেতু তার কোট সেই সৈনিকের গায়ে পাওয়া যায়। আনার বাবা বুঝতে পারেন এটা তার মেয়ের কাজ। পুলিশ চলে যাবার পর আনাকে তার বাবা খুব বকে। আনা পালিয়ে যায়। তাকে না পেয়ে সারারাত গ্রামের সবাই খুঁজতে থাকে। একসময় সমুদ্রের ধারে এক ভাঙ্গা বাড়ির পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় আনাকে পাওয়া যায়। তারপর থেকে আনা রোজ জানলার ধারে বসে থাকে, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আশায়।

বেশ ভাল ছবি। এবং এই সিনেমা থেকে ভবিষ্যতে আরো অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে, একটু পরেই যেরকম একটা সিনেমা নিয়ে আমরা কথা বলব। এবং আমার দারু লেগেছে দুই বাচ্চার অভিনয়। আনার ভূমিকায় আনা টোরেন্ট এবং তার দিদি ইসাবেলের ভূমিকায় ইসাবেল টেলারিয়া দুজনেই সুন্দরভাবে নিজের রোল ফুটিয়ে তুলেছে। স্কুলফেরত আসার সময় রেললাইনে কান পেতে শব্দ শোনা বা শুয়ে শুয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলা, বেশ সাবলীল অভিনয়। এবং অনেকেই এই সিনেমাকে সিম্বলিজমের মোড়কে ঢাকা ফ্রাঙ্কোর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ওঠা আওয়াজ হিসেবে দেখেন।  

এরপর আলেহান্দ্রো আমেনাবারের ‘ওপেন ইওর আইজ’। এই সিনেমায় যেটা আমার সবথেকে টেনেছে, সেটা হল আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের মত এক নতুন ধারণা, আর্টিফিসিয়াল পারশেপশন। গল্পটা বলি। ২৫ বছরের সুদর্শন যুবক সিজার।  রমনীমোহন। এক রাতে সে প্রেমে পড়ে সোফিয়া-র। সোফিয়ার ভূমিকায় সর্বকালের সেরা স্প্যানিশ সুন্দরী পেনেলোপ ক্রুজ। আবার পরেরদিন তার পুরনো প্রেমিকা নুরিয়া ফেরত আসে এবং সিজারকে নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে চায়। সিজার রাজি হয়। কিন্তু সেই জার্নিতে নুরিয়া ইচ্ছে করে অ্যাকসিডেন্ট ঘটায়। আহত সিজারের মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে অঠে, তাকে প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়। আর কেউ তার কাছে আসে না। সোফিয়া তার এই ভয়াবহ রূপ দেখে তাকে এড়িয়ে চলে। সিজার একদিন মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়, উঠে দেখে সোফিয়া আবার তার কাছে ফিরে এসেছে। সোফিয়াকে ভালবাসতে গিয়ে সিজার বোঝে আসলে সেই মহিলা নুরিয়া। রাগে উন্মত্ত হয়ে সিজার বালিশ চাপা দিয়ে নুরিয়াকে মেরে ফেলে। এরপর আবার তার ঘুম ভাঙ্গে জেলের ভেতর। খুনের দায়ে দোষী হিসেবে। এবং সেই সময় সে জানতে পারে, যেদিন সে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়েছিল, সেইদিন ‘ক্রায়োনিক্স’ নামক এক কোম্পানির সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছিল, যারা ‘আর্টিফিসিয়াল পারশেপশন’ নামক এক ধারণা  বাজারে নিয়ে এসেছে। এরপর বাকিটা নিজে দেখুন, সাসপেন্স থাকবে।

‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’ ১৯৯৯ সালের সেরা বিদেশি সিনেমা হিসেবে অস্কার ও বাফটা পেয়েছিল। আলেহান্দ্রোর ছবিগুলো একটু জটিল হয়। এই সিনেমায় যেমন এইডস্‌, হোমোসেক্সুয়ালিটি, ট্রান্সভেস্টিজম এরকম বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। এক নার্স মা (সিসিলিয়া রথ) নিজের টিনেজার ছেলে মারা যাবার পর ছেলের ট্রান্সভেস্টিট বাবাকে খুঁজতে বেরোয়। গিয়ে আরো অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপ হয় এক নান-এর সঙ্গে (পেনেলোপ ক্রুজ), যে সেই ট্রান্সভেস্টিট লোকটির  দ্বারা গর্ভবতী হয়েছে এবং এখন এইডস্‌-এ ভুগছে। সেই নান মারা যায় এবং তার সদ্যোজাতকে সেই নার্স মা মানুষ করতে শুরু করে। মাঝে শুধু রয়ে যায় এক ড্রাগ অ্যাডিক্ট আভিনেত্রী এবং আলঝেইমারে ভুগতে থাকা এক বয়স্ক মানুষ। সব মিলিয়ে এই মহিলাপ্রধান সিনেমা রহস্যে ও ড্রামায় উপভোগ্য।

‘স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ’-এর আর ‘অ্যালিস’এর ছায়ায় তৈরি গিলের্মো ডেল-টোরোর ‘প্যান’স ল্যাবাইরিন্থ’ এখনো অব্ধি সারা পৃথিবীতে ছোটদের জন্য রূপকথার গল্পের মত। এই সিনেমার পটভূমিকাতেও ১৯৪৪ সাল, ফ্রাঙ্কোর রাজত্ব। সেখানে এক ১০ বছরের মেয়ের চোখে বাস্তব আর পরাবাস্তব কীভাবে মিলেমিশে এক হয়ে  যাচ্ছে। আর এই পটে আস্তে আস্তে উঠে আসছে গণ আন্দোলন, গৃহ-যুদ্ধ। এই ছবিতে যদিও কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ আছে, কিন্তু সেট তৈরি, মেকাপ আর কস্টিউম ডিজাইন তারিফ করার মত। তবে হ্যাঁ, ডেল-টোরোর পরিচালনার এক বিশেষত্ব হল বাস্তব আর পরাবাস্তব এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া যাতে বাস্তব ঠিক কোথায় শেষ হল, সেটা দর্শক বুঝতেই না পারে। যেমন ‘শেপ অব দ্য ওয়াটার’। আর এজন্যই ডেল-টোরোর প্রত্যেক সিনেমা শেষ অব্ধি দেখতে ইচ্ছে হয়। 

সবশেষে বলি, এই রহস্যের ফাঁদে পড়ে আমি বেশ কিছু ভাল স্প্যানিশ সিনেমা বাদ দিলাম যেগুলো নিয়ে আরো দীর্ঘ আলোচনা করা যেত। যেমন ‘মোটরসাইকেল ডায়েরিজ’ (২০০৪)। চে গুয়েভারা, বিখ্যাত চে হয়ে ওঠার আগে তার এক বন্ধুকে নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যখন ঘুরে বেরিয়েছিলেন, এটা সেই থিম নিয়ে তৈরি ছবি। এবং এখানে ক্যামেরার কাজ ও সিনেমাটোগ্রাফি দেখার মত। তাই ঠিক করলাম, রহস্য এই অব্ধিই থাক। সামনের বার প্রকৃতির পটভূমিকায় জীবন ও সিনেমাটোগ্রাফি, এই দুই নিয়ে হাজির হব। এবং এই দুই-কে এক করতে গেলে আমাকে প্রাথমিকভাবে জাপানের সিনেমা ঘাঁটতেই হবে। তাহলে সামনের বার আমরা জাপানি ছবি নিয়েই বসব।


ফারহানা রহমান

 

কবি নুরুল হুদার সাহিত্যভাবনা




 

“মাথার উপর আকাশ জোড়া সূর্যছাতা,

মহাদেশীয় হাইওয়ে ছেড়ে আমরা পা রাখলাম,

এই পলিবাংলার ধুলি রাস্তায়।

আমাদের পা যেন কিংবদন্তির লাঙ্গল

ক্রমাগত এগিয়ে চললো

ব্রক্ষের আদি পুত্রের খোঁজে।

না, আমরা প্রায়শ্চিত্ত করতে আসিনি আদিপাপের,

আমরা পরখ করতে আসিনি কোন সনাতন তীর্থ,

আমরা দেখতে আসিনি

নদীতীরের রোগশোক, মানুষের ক্ষরণ-মরণ”।

[লাঙ্গল মানুষ, ‘নির্বাচিত ২০০ কবিতা]

এমনই আধুনিক অথচ দেশপ্রেমের গভীর ব্যাঞ্জনা ফুটে ওঠে কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদার কাব্যের পঙক্তিতে পঙক্তিতে। কবি নুরুল হুদার চেতনাজগৎ নির্মিত হয়েছে এদেশের জীবনবৈচিত্র্য, গতিবেগ, প্রত্যাশা, প্রেম, যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি এদেশের সম্ভাবনার সমন্বিত সচেতন কাব্য-আন্দোলনের মাধ্যমে। আবেদের স্বতঃস্ফূর্ততা, দেশপ্রেম মানবপ্রেমাবেগ প্রকাশের সহজতা ও মননশীলতা কবি নূরুল হুদার কবিতাকে করে তুলেছে তাঁর সমসাময়িক কবিদের কবিতা থেকে অনন্য। ষাটের দশকে এদেশের কবিতার বিষয় ও শিল্পমূল্যের বিচারে যে সম্পন্নতা অর্জন করে, তার উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে কবিতার নতুন আলোড়ন সৃষ্টি নিঃসন্দেহে সহজ কাজ ছিলো না। তবে ষাটের কাব্যান্দোলনের অন্তরালে একটা বিশেষ শূন্যতা ছিলো, কিন্তু নূরুল হুদার বহুমাত্রিক কাব্যচর্চা, মেধা ও মননের  সুনির্দিষ্ট ব্যবহার  আমাদের  কাব্যজগৎ-এ এনেছিলো একধরনের পূর্ণতা। আমরা তাঁকে  দেখি বিচিত্র পটভূমির উপর লিখতে। কবি নূরুল হুদার কবিতায় আছে দর্শন, আছে প্রেম, আছে মিথ আর সেইসাথে আছে দেশ ও ঐতিহ্যের ভাবনার মিশেল। তাঁর প্রত্নস্মৃতিতে মিশে থাকে গ্রামজীবনের স্বপ্ন। তাঁর অনুভূতিলোকে আছে নারীর  প্রতি প্রেম, অবচেতনলোকে আছে  প্রকৃতিভাবনা –

“পুষ্প, তুমি কতদিন রয়েছো উন্মুখ

সময়ের ফুল্ল আঙিনায়, থাকো কত কাল?

গোধূলিতে দ্যাখো এই বৃক্ষটিকে,

দ্যাখো, পত্রময় কারুকাজে

এই বৃক্ষ পৃথিবীর সুপ্রাচীন ছায়া –

আমি বসে আছি তার পদমূলে”।

[কৌমার্যের শ্বেত-পত্র]

কবির লেখা উপরোক্ত কবিতাটির এই কয়েকটি পঙক্তি তো শুধু কিছু আবেগের সমাহার নয়, এটি কোন আংশিক দৃশ্যরূপও নয়, এর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডকে এক করে দেখার পূর্ণরূপ। পুস্পের কাছে কবি জানতে চান যে সে কতদিন ধরে সময়ের ফুল্ল আঙিনায়  রয়েছে উন্মুখ? কবি পুস্পকে বলছে্ন গোধূলিকে দেখতে, পত্রময় কারুকাজ করা বৃক্ষকে দেখতে বলছেন, যে বৃক্ষ যুগ যুগ ধরে মানুষকে, আমাদের কবিকে তাঁর পদমূলে ছায়া দিয়ে চলেছে। এ যেন কবির কণ্ঠে এক অমোঘ উচ্চারণ। এই কয়েকটি পঙক্তি যেন হয়ে উঠেছে এক  মহাকাব্য যেখানে বিজ্ঞান, কল্পনা, দর্শন সব কিছু মিলে মিশে একাকার।

এভাবেই “মানুষ মূলত কবি” কবিতাটিতে আমরা একই ব্যপার লক্ষ্য করি –

“সমুদ্রের পাশে জন্ম, কিন্তু তবু সমুদ্র দেখেনি

এই দুঃখে বসে আছে মর্মাহত ম্লান দাঁড়কাক।

দাঁড়কাক জানে না নিজেও

আত্মসুখ মিলে কি বিষে”।

[মানুষ মূলত কবি]

‘সমুদ্রের পাশে জন্ম, কিন্তু সমুদ্র দেখেনি’ – এমন বিস্ময়কর কথা ভাবলেও শিউড়ে উঠতে হয়। এখানে কবি আসলে আমাদের কী বলতে চেয়েছেন? এই বিস্ময়কর পঙক্তির মাঝে কি কোথাও কোন গণিত বিশ্বের যুক্তিবাদ রয়েছে? এর পরের লাইনে আছে ‘এই দুঃখে বসে আছে মর্মাহত ম্লান দাঁড়কাক’। তাহলে কি এই দাঁড়কাকটি কবি নিজেই? যার জন্ম হয়েছে সমদ্রের খুব কাছাকাছি কিন্তু তিনি ভাবছেন যে তাঁর এখনো আসলে এই বিশাল জলরাশির ধারা এই সমুদ্রকে দেখা হয়েই ওঠেনি। আর কবি নুরুল হুদার মনন বিশ্বের দার্শনিকতা আমরা ঠিক এখানেই দেখতে পাই। তাই তাঁর কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে ছড়ানো দেখতে পাই কখনো বিপন্ন-বিশ্বের আত্ম-যন্ত্রণা, কখনো বা মহান কাব্যরসের সঙ্গীত হিল্লোল।



ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতা পূর্বতন কবিদের দর্শন ও সামাজিক অঙ্গীকারকে সচেতনভাবেই অতিক্রম করতে চেয়েছিলো। আমাদের  আধুনিক কবিতার ভিত্তিমূলে রবীন্দ্র–পরবর্তী দুজন কবির সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের কবিতার মূল পটভূমিতে ছড়িয়ে আছে নজ্রুলের সামাজিক অঙ্গীকার এবং জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি, নিসর্গলোক ও বিমূর্ত প্রেমাকাঙক্ষার সুস্পষ্ট স্পন্দন। তবে কবি নূরুল হুদার কবিতায় আমরা পূর্বনির্ধারিত এ পথকে সচেতনভাবে অতিক্রম করার অব্যাহত চেষ্টা দেখতে পাই-

“আমি যে কোথায় আছি বলে দে  না ভাই

আমাকে বাড়ি যেতে হবে;

এ কোন বিজনলোকে আনলি আমাকে,

এ কোন ঠিকানাহীণ অলীক আস্তানা,

জানালা দরজাগুলো এমন বন্ধ রাখা কেন?”

[নির্বাসিত ঘাতকের স্বীকারোক্তি]

কবি নূরুল হুদা তাঁর বহু শক্তিশালী কবিতা সৃষ্টি করেছেন তাঁর গভীর অবচেতনের জগৎ থেকে। এই অবচেতনের জগৎ-এর মধ্যেই তিনি নিরন্তন সন্ধ্যান করেছেন ইন্দ্রজাল। তাঁর কবিতার প্রকাশের মধ্যেই রয়েছে বিশেষ এক নন্দনতাত্ত্বিক চমক। কবি মাত্রই হয়তো কোন না কোনভাবে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারি আর শেষপর্যন্ত তিনিও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঈশ্বরের অনুসন্ধ্যান  করেন। এমনই অবচেতনের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে তিনি লিখেছেন –

“তমি তবু তুমি জন্ম-জন্মান্তরের শীতার্ত তন্দ্রা।

তুমি দাঁড়িয়ে আছো অনন্ত শীত-রাত্রির ভিতর, সময়ের দুঃশীল

দুর্গের ভিতর;

তোমার চারপাশে চতুর্মাত্রিক অন্ধকার, সেই অন্ধকার সারি সারি প্রহরা;

আমাকে দারুণ উপেক্ষা হেনে তুমি মৌনতামগ্ন ঐ প্রহরীকুঞ্জে ;”

[একটি শীতার্ত তরুর প্রতি]

আবার একইভাবে ‘আকাশ জোনাকি’ কবিতায় দেখতে পাই –

“একটি জোনাকির বুকে কোটি আকাশ

কোটি জোনাকির বুকে একটি তারা;

অন্ধকারে, ঝোপেঝাড়ে, বাঁশবাগানের মাথায়

জোনাকিরা কুচিকুচি করে চিরে ফেলে তমসার কারা”

[আকাশ জোনাকি]

কবি নূরুল হুদা তাঁর কবিতায় শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। তাঁর এক একটি কবিতায় যেন এক একটি নতুন নতুন গল্প সাজানো থাকে। তাঁর বাক্যবন্ধন আধুনিক, চিত্রকল্পের ব্যবহার সংযত, অথচ প্রাঞ্জল ও বৈচিত্র্যময় যেন ধ্রুপদী  সংগীতের বর্ণময় উচ্ছ্বাস। তাঁর প্রকৃতির প্রতি, দেশের ঐতিহ্যের প্রতি, সৃষ্টিকলার  প্রতি নিবিড় অনুভব তাঁকে তাঁর কবিতা লেখার মূল প্রেরণা। তাঁর কবিতার ঝর্ণামুখটি তাই হয়ে উঠেছে বিচিত্র ধারার উৎসমুখ। সেখান থেকেই আমরা দেখতে পাই বহুবর্ণের নিঃসরণ। তাঁর নিজের কথাই তিনি বলেছেন নার্সিসাস কবিতা –

“নিবিড় নীলাভ সন্ধ্যা অহরহ জ্বলে অবয়বে

গতায়ু রোদের মতো যেখানেই হাঁটি ধীর পায়ে

আমাকে শিকারী ভেবে আলোককণা পালিয়ে বেড়ায়

সন্ত্রস্ত হরিণী যেন, খুঁজে ফেরে ছায়ার বিবর

চৌদিকে পাতারা কাঁপে, পাখী ডাকে,

অলিন্দে অরণ্য হয় দুঃখের শহর”

[নার্সিসাস]

ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় আমরা নাগরিক উল্লাস, বিকার, আত্মরতি, আত্মখননের যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ করি, নূরুল হুদার কবিতায় তার প্রভাব পড়েছে কম। বরং তার বদলে আমরা দেখতে পাই শিল্প ও দর্শনের সংমিশ্রণে তৈরি করা জাতি সত্তার কবিতা। তাঁর নানা কাব্যিক শৈলীতে ফুটে উঠেছে বিশ্ব-মানব সংস্কৃতির প্রতি প্রেম ও শৈল্পিক অনুরাগ। তাঁর কাব্যে দেখতে পাই গণমানুষের  সংগ্রাম। তাদের ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য, তাদের স্বাধীনতার জন্য তাঁর কলমে রক্তক্ষরণ হয়েছে বারবার। তিনি কখনই জীবনবিমুখ নন। অস্তিত্বের স্বাধীনতা আর সৃষ্টিশীলতার স্বাধীনতা তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু –

“পদব্রজে পৃথিবী ভ্রমণ  - অদৃষ্টই ঠিকানার ভিন্নতর নাম

প্রতিটি মুহূর্তে আছে শৈলাবাস, দার্জিলিং নিত্য খোলা দ্বারা

চড়াই উৎরাই আর পদে পদে প্রাকৃতিক ব্যারিকেড নয়

চতুর গোলতু তুমি, পায়ে পায়ে বাজো তবু গোপন নূপুর”।

[শোভাযাত্রা দ্রাবিদার প্রতি]

 অথবা

“অন্তহীন স্বপ্ন নিয়ে মানুষের চলে যেতে হয়

অনন্ত স্বপনের মাঝে হয়তো সে হয়ে ওঠে চির স্বপ্নময়

হয়তো সে নিশি–লগ্ন নিদ্রায় নিবিড় –

প্রবীণ পৃথিবী ছেড়ে মানুষের পায় নাকি

ভিন্ন কোন নীলিমায় নীড়?”

[চির স্বপ্নময়]

নূরুল হুদা একজন মানবতাবাদি কবি আর সেটাই তাঁর মূল পরিচয়। তাঁর কাব্য-আবেগের মূল অনুষঙ্গ যে মানব ও প্রকৃতিপ্রেম তার বিবরণ আমরা দেখতে পাই নানা কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে। তবে সময় অভিজ্ঞতা যে একজন কবির চেতনা ও রূপকল্পের বড় ধরনের রূপান্তর সাদর করে সেটাও আমরা দেতে পাই তাঁর যুদ্ধ পরবর্তী কবিতায় –

“আজ পনের আগস্ট, আজ বাঙালির শোক।

অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটাও আজ নট হোক।

আজ খাঁ খাঁ, আজ ধু ধু, আজ ছিন্নভিন্ন মানুষের অশোক

রাঢে বঙ্গে হরিকেল সমতটে

বাঙালির বজ্রবুকে আজ ঘোর বারিপাত হোক”।

[পনের আগস্ট]



কবি নুরুল হুদা কাব্যভাবনার দিক থেকে সব সময় অন্যদের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। তাঁর আকাঙ্ক্ষা, ভাবনার বিস্তার তাই আলাদা মাত্রা পেয়েছে আমাদের  কাব্যজগতে। তাঁর দর্শন প্রেম, মরমিয়াবোধ, কবিতার নির্মাণ শৈলী, চিত্রকল্প, ভাষা ও ছন্দের ব্যবহার সবসময় তাঁকে অন্যদের কাছ থেকে ভিন্ন আসনে রেখেছে। তাঁর ভাবনার সাথে সংশয়হীনভাবে মিশে গেছে অন্য মানুষের ভাবনা। অন্তর্জগতের সাথে বহির্জগতের সৌন্দর্যবোধের যে মিশেল, তাই তাঁর কবিতাকে  করে তুলেছে অনন্য। তিনি কবিতার পাশাপাশি বহু উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ ও গান লিখেছেন। ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের পূর্ব পোকখালি গ্রামে কোনই মুহম্মদ নূরুল হুদার জন্ম হয়। ঈদগাহ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। এরপর তিনি ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালক ছিলেন এবং জার্মান, জাপান, আমেরিকা, হাওয়াই, লন্ডন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, তুরস্ক, পাকিস্থান, শ্রীলংকা, চায়না প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে নানা সময় সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি তাঁর কাছের স্বীকৃতি ও সম্মাননাস্বরূপ বিশেষ ভাবে  লাভ করেন বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, সুকান্ত পুরষ্কার, কক্সবাজার মেয়র কর্তৃক নগর চাবি প্রদান ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি ‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব’এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

 

 


পৃথা কুণ্ডু

 

অর্বাচীনের রবিযাপন (পর্ব – ৫)





একটা সময় ছিল, এই ধরুন বছর কুড়ি আগেও তার রেশ চোখে পড়ত-- যখন ‘শ্যামা, ‘চিত্রাঙ্গদা, ‘চণ্ডালিকা- এদের দেখা পাওয়া যেত পাড়ায় পাড়ায়। মানে পাড়ার ক্লাবে বা নাচ-গানের স্কুলের ফাংশনে যারা এইসব চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা পেত, তাদের আসল নামের বদলে চালু হয়ে যেত চরিত্রের নামগুলোই। অনেক অনামী মফস্বলের সাধারণ স্কুলেও ক্লাস নাইন-টেনে সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের ‘আমি তো পয়তাল্লিশ নম্বরের কয়েদির কথা পড়াতে গিয়ে প্রায় অবধারিত ছিল শ্যামার কোটালের রেফারেন্স টেনে আনা- মাস্টারমশাই বা দিদিমণি বলে উঠতেন- “এই যে নির্দোষ লোকটিকে ধরে আনা হল, একজন অপরাধী খাড়া করতে না পারলে প্রশাসনের ব্যর্থতা ধরা পড়ে যাবে, এই ব্যাপারটার সঙ্গে তুলনা করা যায়- ‘চোর চাই যে করেই হোক... নইলে মোদের যাবে মান ফার্স্ট থেকে শুরু করে লাস্ট বেঞ্চের ছেলেমেয়েরা-- সবাই বুঝে ফেলত মুহূর্তে। বিশেষ করে লাস্ট বেঞ্চের ছেলেগুলো-- কোটালের রোলের জন্য ওদের মধ্যেই কাড়াকাড়িটা হত কিনা! তেজি স্বাধীনচেতা মেয়ে বললেই মনে পড়ত চিত্রাঙ্গদার কথা(সেই ‘দাদার কীর্তির সময় থেকেই), আর ভালবাসার জন্য আত্মত্যাগ বললেই উত্তীয়। সাধারণের রবিনামচার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল এইসব নৃত্যনাট্য।

ভালো নাচ-জানা যে বন্ধুটি বরাবর নায়িকার রোলে নামত, সে স্কুল ছাড়ার আগে একবার মজার ছলেই দুঃখ করে বলেছিল, “ধুর, এতবার স্টেজে নামলাম, একটা ভাল নায়ক পেলাম না রে। আনন্দর তো জল খাওয়া ছাড়া কিছু করারই নেই, অর্জুনটা তো আমার(মানে চিত্রাঙ্গদার)পাশে দাঁড়াবার যোগ্যই নয়, আর বজ্রসেন তো লাথি মেরে চলেই গেল। রসিকতা বাদ দিয়ে ভাবলেও কথাটা নেহাত উড়িয়ে দেবার মত নয়। নৃত্যনাট্যে বরাবর তিন কন্যেরই দাপট, নায়কদের দিকে তেমন নজর পড়ে না। অর্জুনকে নিয়ে তো আমরা অর্বাচীনের দল রীতিমত হাসাহাসি করতাম এককালে, “আহা রে, কি আমার ব্রহ্মচারী, ব্রতধারী এলেন! যেই না দেখল রূপ বদলে সুন্দরী হয়ে এসেছে, তখন ‘লহো পৌরুষগর্ব, লহো আমার সর্ব!’ বিরক্তিও লাগত- সুরূপার সঙ্গে কদিন ঘুরেটুরে যখন আবার ক্লান্তি আসে, তখন তাকেই জিজ্ঞেস করে চিত্রাঙ্গদার ব্যাপারে, “শুনি সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী/জান যদি বল প্রিয়ে, বল তার কথা। এ কেমন নায়ক রে ভাই, কি যে চায় নিজেই জানে না!

আসলে স্টেজে ‘চিত্রাঙ্গদা দেখার সময় চোখ আর কান আলাদা হয়ে যায়, মন ভেবে পায় না কার সাথে যাবে। পরে যখন শুধু এইচএমভির ক্যাসেট চালিয়ে শুনেছি একা একা, মনে হয়েছে, অর্জুনের ওপর এই বিরক্তি আসে বলেই না চিত্রাঙ্গদার মহিমা আরও বেশি করে ফুটে ওঠে! স্বাভাবিকের চেয়ে খানিক নিচু স্কেলে গেয়ে, সুরে আর অভিব্যক্তিতে এই আণ্ডারঅ্যাক্টিং ধরে রাখা কী যে কঠিন, তা যদি অর্বাচীন প্রথমেই বুঝে যেত, সে কি আর অর্বাচীন থাকত? স্রষ্টার পক্ষপাত যার ওপর, সেই চিত্রাঙ্গদার মান তো রাখতে হবে, আর অর্বাচীনের না-বোঝার সম্মান রাখার দায়ও বড় কম নয়।



তবু তোমায় ‘নায়ক ভাবতে পারিনি, অর্জুন। চিত্রাঙ্গদার দীপ্তির পাশে তো নয়ই। হয়ত জেনেবুঝেই তুমি গুটিয়ে থেকেছ কিছুটা। আর আনন্দ? জানি, দুটো গানেই তুমি যা করার করে দিয়েছ, “জল দাও আমায় জল দাও আর “যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা বলে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছ, চণ্ডালিনীর কূপ হয়েছে অকূল সমুদ্দুর- তবু তোমাকে টেনে আনার পর সে-ই পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তে হয়, তুমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আশীর্বাদ করতে থাক, পর্দা পড়ে যায়। তুমি প্রভু হয়েই থেকে যাও, প্রিয় হতে পারো না।

তাসের দেশ এমনি ভাল লাগলেও সেভাবে দাগ কাটেনি কখনও- আর ‘মায়ার খেলাতেও দুই নায়িকার প্রাধান্য। ‘বাল্মীকিপ্রতিভায় নায়ক সবটা জুড়ে আছেন অবশ্যই, কিন্তু দস্যুদলের আদিম হুল্লোড় আর খানিক কমেডি-ভরা জমাটি নাটকের পাশে বাল্মীকির গান যেন বড় বেশি সূক্ষ্ম মনে হয়। ‘অমানিশা আজিকে, পূজা দেব কালীকে, এমনকি ‘নিয়ে আয় কৃপাণ-এ্রর সুরেও এত নরম কারুকাজ! ‘এ কেমন হল মন আমার বা ‘থাম থাম কি করিবি না হয় ঠিক আছে, কিন্তু প্রথমদিকেও তো রত্নাকরের গানের মধ্যে সেভাবে দস্যু-সর্দারের মেজাজ ফোটে না। আসলে অল্প বয়সের লেখা, সদ্য বিলেত থেকে অপেরা-ধাঁচের সুরের আমেজ নিয়ে ফিরেছেন, আর তখন নিজের গলাখানা ছিল চড়া আর মিষ্টি, তাই নিজে বাল্মীকি সেজে নামবেন বলে সেইমত সুর দিয়েছেন স্রষ্টা! অনেক বছর পরেও এইচএমভির রেকর্ডে বাল্মীকির চরিত্রে গেয়েছিলেন যিনি, নিজের গান শুনে নিজেই খুশি হতে পারেন নি, “ওটা রত্নাকর হয় নি...। ঠিকই তো। প্রথম থেকেই সরস্বতীর আশীর্বাদ পেয়ে গেলে কি আর রত্নাকর হওয়া যায়?

শ্যামা বহুবার দেখা, শোনা- অনেক ছোটবেলা থেকে। সেখানে নায়কত্বের অন্যতম দাবিদার হিসেবে উত্তীয় অনেকদিন ধরেই করুণ মুখে তাকিয়ে থেকেছে, শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণটাও দিয়ে দিয়েছে- সে-দাবির কাছে মাঝে মাঝে বজ্রসেন দু এক-পা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে বৈকি। অবশ্য তার চরিত্রটাও তেমনি। উচ্চকিত নয়, মধ্যবিত্ত বণিক-ভদ্রলোক। আত্মসম্মানবোধ প্রবল, কিন্তু ক্ষমতা আছে যাদের হাতে, তাদের হুঙ্কারের সামনে দীনহীন অনুনয়ের সুরে ‘নই আমি নই চোর বলে মুহূর্তে সবটুকু সহানুভূতি টেনে নেয় নিজের ওপর। “অন্যায় অপবাদে আমারে ফেলো না ফাঁদে- মেরে ফেলো তাও ভাল, কিন্তু অপবাদ দিয়ো না। মধ্যবিত্তের মানসম্মান গেলে আর কী থাকে! শ্যামার করুণা নিতেও প্রথমদিকে তার বড় অস্বস্তি- “এ কি খেলা হে সুন্দরী,... কেন দাও অপমানদুখ, মোরে নিয়ে কেন, কেন, কেন এ কৌতুক।



উত্তীয় সরে যাবার পর বজ্রসেনের আসল টানাপোড়েন শুরু। এমনই মানুষ, যে প্রেমের মধ্যেও ঋণ আর শোধের হিসেব না কষে পারে না! এটা তার দোষ নয়, মূল্যবোধের একমাত্র সম্বল- সে ঋণী থাকবে না কিছুতেই। ‘প্রেমের জোয়ারের উচ্ছ্বাস কাটিয়ে বারবার জানতে চায়, “আমারে করেছ মুক্ত কি সম্পদ দিয়ে... জানি যদি, প্রিয়ে, শোধ দিব এ জীবন দিয়ে। শ্যামার অপরাধের কথা শুনে সে যখন ঘৃণায় মুখ  ফিরিয়ে নেয়, তখনও তার মধ্যে কাজ করে সেই ঋণ আর মূল্যের ভাবনা, “তোর পাপমূল্যে কেনা এ জীবন... ধিক নিঃশ্বাস মোর তোর কাছে ঋণী। কোথায় নিজের স্বচ্ছ, সৎ, নৈতিক জীবনে কালি লাগতে না দেবার আকুতি আর প্রেমিকার অপরাধকে ঘৃণা করতে চাওয়ার জ্বালায় জ্বলতে থাকা এই ভদ্রলোক, আর কোথায় পাগলাটে প্রেমিক উত্তীয়- “ন্যায় অন্যায় জানি নে জানি নে জানি নে... শুধু তোমারে জানি ওগো সুন্দরী বলে যে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারে! ঋণ, মূল্য- কথাগুলো সেও বলে (‘নেবে মোর প্রাণ ঋণ, ‘তার মূল্যের পরিমাণ), কিন্তু সে এমনই মিষ্টি করে, নিজেকে বিলিয়ে দেবার আবেগ মাখিয়ে বলা- যে সেগুলো তার মুখে নেহাত কথার কথা। অবশ্য যতই মায়া পড়ে যাক উত্তীয়র ওপর, ওকে শেষ পর্যন্ত ‘নায়ক ভাবা যায় না, কেমন যেন ভাই-ভাই মনে হয়, বলতে ইচ্ছে করে, “শ্যামা তোমার দাম দেয় নি তো কি হয়েছে ভাই, আমরা তো বুঝি!” তাহলে নায়ক বলব কাকে?

ভাবতে ভাবতে রাত আটটা বেজে যায়, আর ফাংশনে থাকা যাবে না, নৃত্যনাট্য চলছে চলুক। অগত্যা বয়স্ক অভিভাবকের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাঁর গজগজানি কানে আসে, “কী সব নাটক! বাচ্চাদের সামনে এগুলো কেউ করায়!...ঠিক হয়েছে, মেয়েটার মার খাওয়াই উচিত!” তা উচিত, শ্যামা যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়, সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্বাচীনের কেবলই মনে হতে থাকে, বজ্রসেনের শেষ গানটা শোনা হল না! ওই গানটা শুনলে কেমন যেন গুলিয়ে যায় সব, এতক্ষণের হিসেবি লোকটার গলায় ‘ক্ষমিতে পারিলাম না বলার যন্ত্রণা, হাহাকার চারিয়ে যায় শ্রোতার মনের মধ্যেও। আর বাড়ি ফিরে, রাতে বিছানায় শুয়ে অর্বাচীন উত্তীয়র কাছে শুনে শুনে তোলা গানটা গুনগুনিয়ে গেয়ে ফেলে তার স্বপ্নের নায়কের উদ্দেশে- “আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান। না, বজ্রসেন নয় কিন্তু। অনেক পরে জেনেছে অর্বাচীন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি বলেছিলেন, তাঁর সহশিল্পীকে ‘বজ্রসেন হয়ে উঠতে হয় নি, তিনি নিজেই যেন বজ্রসেনঅন্তত সেই মঞ্চ বা স্টুডিয়োর পরিসরে, সেই গীতিনাট্য-পরিবেশে। কথাটা মেনে নিতে আপত্তি নেই, ‘শ্যামার নায়ক তিনি হতেই পারেন, তবে অর্বাচীনের নায়ক খুঁজে পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ‘শাপমোচন পর্যন্ত।

তার নাম অরুণেশ্বর। শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব। বাইরের চেহারা শ্রীহীন, অসুন্দর। তার সব গেছে, শুধু গানটুকু ছাড়া। ‘ভুলো না- ভুলো না- ভুলো না-’ বলে সে যখন আর্তি জানায়, ‘সেদিন দুজনের মত একটা ‘হালকা প্রেম-পর্যায়ের গানও(স্বয়ং কবি এমন ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন!) কেমন ‘পূজার কাছাকাছি চলে আসে ‘কি জানি কি মহালগনে  উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে! লজ্জায় সে পূর্বজন্মের প্রিয়ার সামনে এসে দাঁড়াতে পারে না, তার বাইরের রূপ দেখে যদি সে ঘৃণা করে! সে গায়, “বাহিরে ভুল হানবে যখন, অন্তরে ভুল ভাঙবে কি?” কমলিকা সামনাসামনি দেখার জন্য জোর করলে বলে, “আমার গানেই তুমি আমাকে দেখ। আগে দেখে নাও অন্তরে, বাইরে দেখবার দিন আসবে তার পরে। নইলে ভুল হবে, খেলা যাবে ভেঙে। শুধু বাইরে থেকে দেখতে গেলে যে কতবড় ভুল হতে পারে, কমলিকা বোঝেনি আগে। সে হল রানি, তার ভুল করা সাজে। অর্বাচীনের সে সাধ্য কোথায়? বরং সে-ই তো নিজের তুচ্ছতা, অযোগ্যতা আর নিকৃষ্টতার বোঝা, আর অন্যের ভুল বোঝার দায় মাথায় নিয়ে পড়ে আছে। যে কিনা তারই হয়ে এমন অতল স্নিগ্ধতায় বলে ওঠে- ‘অসুন্দরের পরম বেদনায় সুন্দরের আহবান।... মর্ত্যের অভিশাপে স্বর্গের করুণা যখন নামে, তখনই তো সুন্দরের আবির্ভাব, তাকে ভুল বোঝার ক্ষমতা তার নেই।



জীবনটাই ভুল করার আর ভুল ভাঙার, গরমিল থেকে মিল খোঁজার। অরুণেশ্বর মিলিয়ে দিয়েছে ‘রাজা আর ‘অরূপরতনকে, গানে আর সংলাপে- যে সংলাপকে সুর থেকে আলাদা করা যায় না। বারে বারে শিখিয়েছে, ভুলের ভয়ে বীণা থামাতে নেই।  নিজের কাজটা করে যেতে হবে, সুর তুলে যেতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে, শুনতে হবে কান পেতে- “কার পদ-পরশন আশা/ তৃণে তৃণে অর্পিল ভাষা! সে অপেক্ষার শেষ এ পৃথিবীতে, এ জন্মে নাই বা হল, অনন্তে গিয়েও হতে পারে। আর তখন যদি কেউ ভুল-ভাঙানো প্রদীপ নিয়ে এসে দাঁড়ায় সামনে, তার দ্বিধা, সংকোচ মুছিয়ে দিয়ে বলতে হবে জলভরা মেঘের গভীর আন্তরিকতায়- ‘ভয় কোরো না। উল্টোদিকের মানুষটাকে যেন হার মেনে পায়ের কাছে বসতে না হয়, সে দাঁড়াক তোমার মুখোমুখি, সত্য হোক নিজের অধিকারে নিরাবরণ। তুমি যা, তুমি তা-ই।

কিন্তু ক্ষতের দাগ, ভুলের ভার আর অভিমান? সে কি এত সহজে যায়? অরুণেশ্বর কিন্তু দেখিয়েছে, শিল্পীর অভিমান না থাকাটাই তার সবচেয়ে বড় অভিমান। আর অর্বাচীনেরও তাই। এই একটা জায়গায় এসে তুচ্ছ আর মহতের ভেদ যায় ঘুচে, সুন্দর-অসুন্দর- আপেক্ষিক শব্দগুলো যায় হারিয়ে। জেগে থাকে শুধু একটাই কথা, ‘বড় বিস্ময় লাগে