কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

রঞ্জনা ব্যানার্জী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৪


আয়না

উনি বসতে বসতেই বললেন, ‘বসি?’

মেয়েটা দেখল।    

অফিস ফেরার পথে এখানেই গাড়ি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর পার্কে দুই চক্কর দিয়ে বাড়ি ফেরেন। ক’জন বখাটেকে ঘুরঘুর করতে দেখেই সিদ্ধান্ত পাল্টেছিলেন।

‘এদিকটা নিরাপদ নয়’, উনি তথ্য দিলেন যেন।  

‘গাছের নিচে ভালো লাগছে। খানিক পরেই চলে যাব

‘তবে আমিও সেই পর্যন্ত বসি। কোন ক্লাসে পড়?’

‘নাইন।’

‘গাছ ভালোবাস?’

‘সমুদ্র বেশি। ঢেউয়ের চুড়োয় সাদা ফেনা কিংবা অহল্যার মত জমাট বালিয়াড়ির ওপরে বিশাল আকাশ - মনে হয় এইসব আমারই অংশ।’ 

‘সাংঘাতিক গুছিয়ে কথা বল তো তুমি! অহল্যার মতো বালিয়াড়ি’ - এটা কি কবিতায় পেয়েছ?’

‘নাহ’  

‘অহল্যাকে চেন?’

‘গৌতম বুড়ো ঘুমিয়ে পড়লে ইন্দ্রের সাথে ইনি মেসেঞ্জারে চ্যাট করতেন।’

হো হো করে হেসে ওঠেন তিনি, ‘এটা কোথায় পেলে?’

মেয়েটা নির্লিপ্ত স্বরে বলে, ‘মজা করছি। আমি রামায়ণ পড়েছি।’

‘তুমি চ্যাট কর?’

‘নিজের সঙ্গে করিসেই কারণেই গুছিয়ে কথা বলতে পারি। আমার কথারা মগজের খোপে গোছানো থাকে। তাসের ম্যাজিকের মতো ঠিক কথাটা বার করে দিই।’  

‘তার মানে ফাঁকিবাজি’

মেয়েটা ফের বিষণ্ণ হয়। তিনি প্রসঙ্গ ঘোরান।

তুমি তাস খেল?

নাহ্‌, মা-বাবা খেলতেন। সাজুমামা আর মা পার্টনার, বাবা আর মল্লিকাআন্টি’

‘ওরা কারা?’  

‘মা-বাবার বন্ধু। মল্লিকাআন্টি মরে গেল।’

‘আহা! অসুখ করেছিল?’

মেয়েটা উত্তর দেয় না।

উনি এবার মোক্ষম প্রশ্নটি করেন, ‘তুমি যে এখানে তা বাড়িতে জানে?’ 

‘আমি বাড়ির সব আয়না ভেঙে দিয়েছি আজ’, মেয়েটা আনমনে বলে।

‘সেকি!’

‘আয়না আপনাকে বদলে দেয়।’

‘কীভাবে?’

‘আয়নায় যাকে দেখেন সে তো আপনি নন। আপনার ডান চোখ ওর বাম চোখ, আপনার ডান হাত ওর বাম হাত। আপনি, আপনি থাকেন না আর।’

‘প্রতিবিম্ব তো অমনই হয়। হুবুহু কেউ কারো মুখোমুখি হতে পারে না। মনে মনেও নয়।’ 

মেয়েটা ওর স্নিকারের আগা দিয়ে একমনে মাটি খুঁটে যায়।

‘শোনো সবসময় নিজের সঙ্গে কথা বলে কিন্তু অনেক কিছুর সমাধান হয় না। বাড়িতে এতক্ষণে নিশ্চয় তোমার খোঁজ পড়ে গেছে? তুমি যদি চাও তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি।’

‘না আমি একাই যেতে পারব’

উনি উঠে দাঁড়ান, ‘তবে ওঠা যাক’

মেয়েটাও দাঁড়ায়।

রিক্সাতে ওঠার আগে মেয়েটা হঠাৎ তাঁর দিকে ফেরে। রাস্তার লাইটে ওর চোখ  অদ্ভুত চিকচিক করে।

‘সাজুমামা, মল্লিকাআন্টি, আম্মু, আমি সুর্যাস্ত দেখতে গিয়েছিলাম। আন্টির কপালে জ্বলজ্বলে লাল টিপ।  বাবার জরুরি কল আসবে বলে মোটেলে ছিলেন। আন্টির মাইগ্রেনের ব্যথা উঠল। মোটেল কাছেই। আন্টি একাই ফিরে গেলেন। ফেরার পথে আমরাও গেলাম আন্টিকে দেখতে। টিপ নেই তাও আন্টিকে ঝলমলে দেখাচ্ছিল। ওয়াশরুমে ঢুকতেই দেখি টিপটা জ্বলজ্বল করছে আমাদের আয়নায়। সাজু মামার হাতে দিয়ে এসেছিলাম টিপটা। পরদিন সূর্য ওঠার আগেই মল্লিকাআন্টি হেঁটে ঢুকে গেল সমুদ্রে।’ 

মেয়েটার রিক্সা ক্রমে মিশে যাচ্ছে ভিড়ে।

উনি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তখনো...

 


2 কমেন্টস্:

  1. অসাধারণ এই লেখার সামনে এসে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপরে যেন এক আল্পনা কাটা। আয়নার কাচেই যার পরিচয়, তার সম্পূর্ণতা ওই কাচের ওপরেই থেকে গেল শেষে। কী সাংঘাতিক!

    উত্তরমুছুন
  2. এতো ভাল লিখে রঞ্জনা যে ওর গল্প পড়ে অনেক্ষণ ভাবতে থাকই।

    উত্তরমুছুন