লেখাসমাজ ও লেখামো (একটি
ইন্ট্রোস্পেকশান)
( মনে হতে পারে লেখামো নামক কোনো বস্তুর
বিজ্ঞাপন এটি। কিন্তু তা নয়। এটি আসলে একটি সময়ের ও লেখা সমাজের যে পরিবর্তন
তার এক ভিভিড ইন্ট্রোস্পেকশান। নিজেদের অকাবিলিয়তগুলি খুলে দেখা এবং কি করার সেটি
ঠিক করা। লেখামো এখানে একটা চরিত্র মাত্র। ধরে নিন তার জায়গায় শ্রী অনুলোম বিলোম
বসানো আছে। তাহলেও একই থাকবে লেখাটি। কথাগুলো। খুবই জরুরী কথাগুলো। তাও জ্ঞাতব্য
তথ্য হিসেবে জানাই, ধরে নিন লেখামো একটি লেখা সংক্রান্ত কর্মসূচী যা আমরা কয়েকজন
লেখক ও কবি হাতে নিয়েছি সদ্য। )
লেখক
টু লেখক ইন্ট্যারাকশান পাস্টটেন্স-
আলোচনায় সুখ আছে। কিন্তু শুধু
এই সুখভোগ করার জন্য লেখামোর ওয়ার্কশপ বা সেশান নয়। এর কিছু ইন্ট্যার্যাকটিভ
উদ্দেশ্য ছাড়াও কিছু স্ট্রাকচার্ড ইমপিরিক্যাল উদ্দেশ্যও আছে। তো সেই জন্য এর একটি
মডেল স্ট্রাকচার অনেক দিন ধরে নানান ট্রাই এ্যান্ড টেস্টের পর একটিকে বেছে নেওয়া
হয়েছে। শুধুমাত্র লেখা শোনা ও শোনানোর প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা নেই, কারণ
এই ঘটনাটি পূর্বে একটি সৎ প্রক্রিয়া ছিল তাই কিছু কনস্ট্রাকটিভ আউটপুট
পাওয়া যেত। কিন্তু গত দশ বছর প্রিসাইসলি, তথ্য প্রযুক্তি
ও তজ্জনিত কারণে
পরিচয় ব্যাপ্তি ও প্রচারের বিষ্ফোরণ হওয়ার ফলে এক অচেনা
পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে। আগে লেখকদের মধ্যে যথেষ্ট অচেনাপন ছিল, ফলে লেখায় মতামত দেওয়ার সময় পারস্পরিক সম্পর্কের কন্ডিশনস
এ্যাপ্লাই প্রযোজ্য থাকত না, ফলে কড়া কথা কড়া ভাবেই বলা যেত আর বিস্ময় অভিভূত করলে তাকে প্রকাশ্য করারও
কোনো বাধা ছিল না, অকপট বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার এক নিজস্ব আনন্দ ছিল। লেখার কমজোর
হাড্ডিগুলি সম্পর্কে কবি নিজে সবচেয়ে আগে ওয়াকিবহাল হন, কিন্তু
নিশ্চিত থাকেন না।
ফলে
লেখা শোনানোর একটা বড়ো উদ্দেশ্যই থাকত এই হেন কথোপকথন।
-- “কেমন লাগলো?
লাস্টের ও ‘সূর্যালোকিত
হনুমান’ অংশটা
ঝুলে গেছে, না?”
-- “একদম ঠিক বলেছিস,
শুরুটা ব্যাপক হয়েছিল, এমন কী মাঝের সমুদ্র অপার জায়গাটাও
ব্যাপক, কিন্তু সূর্যালোকিত হনুমানটাই খুন করে দিল”।
-- “এক্সাক্টলি
আমারও মনে হচ্ছিল ওখানে অত্যধিক আলো হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু…”।
-- “ওটাকে ‘সূর্যালোকিত হনুমান’ না
করে ‘চাঁদের পাহাড়ে জাম্বুবান’ করে
দে। জমে যাবে”।
--
“গ্রেট!! ব্যাপক বলেছিস!”
এবং শুধু এখানেই শেষ নয়, অন্যের সাজেস্টেড অংশ
যদি লেখাটিকে ভিন্ন মাত্রায় তুলে দিতে পারে তো কবি নির্দ্বিধায় সেটি ব্যবহার করতেন,
কারণ
লেখাটিকে আরো উন্নত মানের করা, ভ্যালু এ্যাডিশান করাটাই
লেখা শোনানোর পেছনে মুখ্য
কারণ হিসেবে কাজ করত। ‘ভাবা যায় না’, ‘কি লিখেছিস’ শুনতে
চাওয়া নয়। আরো উল্লেখযোগ্য, সাজেশনদাতার কখনো ঘুণাক্ষরেও মনে আসত না এই
লেখাটায় ওনার সৃজনশীলতার স্পর্শ আছে, অন্যদের বলা তো বহু দূরের ব্যাপার। কারণ উনি জানতেন, উনি যে অংশটি বলেছেন সেটি কবিরই লেখা, শুধু কোনো কারণে ওর চোখ
এড়িয়ে গেছে আর ওনার চোখে পড়েছে। এই প্রসঙ্গে আমি কিন্তু কবিতা পাঠের আসর, কাব্যসভা ইত্যাদির কথা একবারও বলছি না। ওই বস্তুগুলি পর্দায় ‘যদা যদা হি ধর্মস্য’ দিয়ে
শুরু হওয়া ‘পিয়াসী জওয়ানি’ সিনেমার
মতোই ভড়ং। কিন্তু ছোটখাটো
কাব্য বিনিময় কেন্দ্রগুলি যা বন্ধুমেসে বা দূর শহরে বন্ধু আস্তানায় গড়ে উঠত, সেগুলি অতুলনীয় পরিমানে ঐতিহাসিক ছিল। কারণ সেখানে উপরোক্ত উদ্দেশ্য ছাড়াও
আরেকটি অতি ভাইটাল জিনিস হতো,
তা হলো জানা বিনিময়। পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলা লেখা ও লেখকদের
ইতিহাস বেদ বা শ্রুতির মতোই মৌখিক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সেটি ট্রান্সফার হতো এইসব
আড্ডায়। বা এমন অনেক তথ্য যা আমার জানা,
তা বন্ধুর জানা নেই এবং ভাইসি ভার্সা। দেওয়া নেওয়া হওয়ার ফলে একটা
ধারণার টোটালিটি গড়ে উঠত এবং ষাট সত্তর এরকম এক একটি দশক তাদের পূর্ণ ক্যারেকটার
নিয়ে দাঁড়াত আমাদের সামনে। ধারাবাহিকতার টেরখানি রক্তেমাংসে মালুম হতো, টেক্সটবুক থেকে নয়। এবং এসবের সাথে হঠাৎ করে এক্কেবারে অজানা অচেনা
মফঃস্বলের কোনো
নাম আচমকা এসে অগাধ থ উৎপন্ন করে দিত। এবং প্রাথমিক থ টুকু কেটে
গেলে যেটা পড়ে থাকত তা নির্জলা উল্লাস, আবিষ্কারের।
এবং তৎপরবর্তী মুহূর্ত থেকে তার লেখার সচলতার সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নেওয়াটা ছিল
জৈবধর্মের মতোই সহজ ও স্বাভাবিক, এবং অন্য কোনো বিনিময় কেন্দ্রে
তুরুপের তাসের মতো তাকে প্রকাশিত করাটিও তার মধ্যে ইনক্লুডেড। এক বড় উদাহরণ
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্জুনের লেখা নিজ ক্রিয়েটিভিটি তুল্যই গর্বের বস্তু ছিল
(বা আছে)। তবে এই প্রথা কোনো
উল্কাপাতের মতো আমাদের মধ্যে আসেনি, এ সবই ছিল
পূর্বসুরীদের দেখে, কথা শুনে শেখা।
স্লাইট
স্মৃতিলজিয়া-
(একটু
ডাইভার্সানে যাচ্ছি। ১৯৯৮ বইমেলা। আমাদের রুকরুকার ততদিনে দুটো সংখ্যা বেরিয়েছে
এবং আমার ও ইন্দ্রনীলের কাছে সেগুলি বেশ বিশ্ব কাঁপানো এক্সপেরিমেন্টে ভরাট
বলেই দৃঢ় বিশ্বাস। বিশেষতঃ প্রথম
সংখ্যার ৯ জন সম্পাদকের একত্রে লেখা একটি ১১ লাইনের
কবিতা সম্পাদকীয়, একসঙ্গে বসে রোটেশান পদ্ধতিতে এক একজনের এক একটা
পংক্তি এইভাবে লেখা হয়েছিল সেই সম্পাদকীয়তে। আজ এই লেখামো
কার্নিভ্যালে যে ডাক আমরা দিয়েছি, কল্পনার ওপর থেকে সব রকমের সেন্সরশিপ, ব্যারিকেড সরিয়ে দিয়ে তার লিমিটকে চ্যালেঞ্জ করা লেখা। ১৯৯৭ সালের ঘোর
মফস্বল জলপাইগুড়িতে সেই ৯ জন ছেলেমেয়ের লেখা সম্পাদকীয়তে আচমকা সেই চ্যালেঞ্জ চলে
এসেছিল। তাতে একটা লাইন ছিল, “(নারকেলগাছ+কাঠবেড়ালী) হোলস্কোয়ার = শ্রডিংগার”। যে লিখেছিল সে কোনো পাগল বা খিল্লিবাজ ছিল
না। ১৯৯৮ বইমেলায় যখন যাচ্ছি, ততদিনে ‘রুকরুকা’র দুটো সংখ্যা এবং সেই
জলপাইগুড়ি থেকেই ‘এরকা’ বহুদিন
বাদে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে, যাতে আমার ও ইন্দ্রনীলের
দুটো করে কবিতা বেরিয়েছে। সেই ময়দানের বইমেলায় স্বর্গে আসা ভানু ব্যানার্জীর মতো
একটা বিপুলে ক্ষুদ্রকায় হয়ে ডুবে আছি, সুকান্তদা
সঙ্গে এবং তৎসহ বইমেলার বিখ্যাত পায়ের ধুলো। পত্রিকা বিক্রির বা
পুশ সেলের সাহস সেই বিশালাকায় দেখে কখন উবে গেছে। নেহাৎ দুর্ঘটনাবশতঃ যদি কেনার
জন্য কোনো দেবদূত চলে আসে, তাই খবরের কাগজ বিছিয়ে একদল আঁকাড়ুর পাশে বসে আছি। সময়টা
যখন বিকেলে ভরপুর, এক খাটো উচ্চতার গাঁট্টাগোঁট্টা ভদ্রলোক এগিয়ে
এলেন আমার দিকে। বেশ ফর্সা, সটান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমিই অমিতাভ প্রহরাজ?” অতিশয় বিস্মিত আমি “হ্যাঁ”, “তোমার ‘এরকা’য় ‘জানালা’ নামের কবিতাটা
খুব ভালো হয়েছে”। তখনো লেখার প্রশংসার উত্তরে কী জাতীয় আচরণ করতে হয় তার
ন্যূনতম পাঠটুকুও জোটেনি, তাই হাঁ-মুখ নিরুত্তর দিয়েই তাকিয়ে আছি। আগের দিনই
শ্রীযুক্ত সন্দীপন চাটুজ্জে মহাশয়ের কাছে পত্রিকা দিতে গিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ শব্দটি
উচ্চারণ করে এক বাপ-ঠাকুর্দার নাম ভুলিয়ে দেওয়া চাট খেয়েছি, মনে মনে সেই স্মৃতি উগরে এনে ভাবছি এও কি নতুন কোনো চাটপদ্ধতি নাকি? কিন্তু আমার ছাপা লেখা পড়ে খুশী হওয়ার মতো
অপরিসীম অলৌকিক ঘটনা কী
করে ঘটলো!! ভদ্রলোক
হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন “আমার নাম বারীন
ঘোষাল, আমাদের পত্রিকার নাম ‘কৌরব’। ওই যে আমাদের স্টল। ওখানে এসো
কিন্তু”। পরবর্তী অধ্যায় যাইই হোক, আমি
যে বলেছিলাম পূর্বসুরীদের দেখে শুনে শেখা, এই ঘটনা তার
জ্বলন্ত উদাহরণ। আজও আমার কাছে রহস্য, বারীনদা আমাকে তো আগে
কোনোদিন দেখেননি, অসংখ্য পত্রিকার মধ্যে একটা ‘এরকা’, তাতে প্রচুর কবিতার মধ্যে
একটি
পড়ে, কী
করে মাঠের মধ্যে জবুথবু বসে থাকা বিশ বছরের ছোট মানুষটির
সামনে এসে পড়লেন!! পরের বছর ‘রুকরুকা’র বেশ সুদৃশ্য একটি
সংখ্যা বেরিয়েছিল, যাতে ‘লক্ষীন্দরের দশটি ঘোড়া’ নামক একটি দশ কবিতার সিরিজ ছিল।
সেই বইমেলা, এবার সন্ধ্যে, খানিকটা
নিজেরই বাগান জাতীয় অধিকারে ‘কৌরবে’র স্টলের সংলগ্নাংঞ্চলে
ঘোরাফেরা করছি, খানিকটা লায়েক ততদিনে। রঞ্জন
মৈত্র এবং স্বপন রায় এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন, কুরুক্ষেত্র থেকে দুর্যোধন
বেঁচে ফিরেছে
গান্ধারীর কাছে। এবং এঁরা তখন আমাদের স্বপ্নমানুষ, যাদের
কবিতার বইগুলি রক্ত-চলাচলের জায়গায় লুকিয়ে রাখা আছে। বাংলা লেখার একটা একটা হারানো
লিগ্যাসীর স্বাদ গন্ধ দিতে এই অংশটি তুলে আনলাম)।
এমনকি রিপন ফিওকে যখন আমি আবিষ্কার করি তখন কলেজ স্ট্রীট, সকাল সাতটা। খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি ফুটপাথ রাত্রি কাটিয়ে অফিস যেতে
ইচ্ছে করছিল না
বলে না গিয়ে কলেজ স্ট্রীটে এসেছি, যদি কারোর সাথে দেখা হয় এবং
শোনা-শোনানোর মজলিস জমানো যায়। রিপন আমার কাছে দেশলাই বা অন্য কিছু চেয়েছিল,
আমি বিনিময়ে বাজে কথায় না গিয়ে সটান কাজের কথায় “তুই লিখিস?”। তারপর লেখা শোনা
ও শোনানোর পালা চুকিয়ে, সেই বছরই ‘বৈখরী ভাষ্য’ প্রকাশনা থেকে বেরোল
প্রথম বই রিপন ফিওর ‘৩৯এ/২’। এবং এই ধরনের কাজে আমি
একাই যে মহান আত্মা
জাতীয় ছিলাম তা নয়। বহু লেখামানুষই এই কাজগুলি করতেন অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে।
জাংচার-
এতক্ষণ পাস্ট টেন্স
ব্যবহার করছিলাম কারণ
গত দশ বছরে এক ওয়াটারশেড পরিবর্তন ঘটে গেছে এই
চালচিত্রে। একসময় আমি সহ আমরা ভাবতাম কাউকে লেখা শোনা ও শোনানো হবে না, লেখা নিয়ে তর্ক হবে না, এই জাতীয় দিনওয়ালা সময়
আমাদের জীবনে আসবে এরকম কল্পনা করাও হাস্যকর। তখন জানতাম না কী ভয়ঙ্কর ডায়মেনশান শিফ্টের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে
আছি। এর দায় ও প্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই। অল্প কয়েক মাস আগে শিয়ালদহ হোটেলের
একটি ঘরে আমি সহ পাঁচজন বেশ জবরদস্ত কবি লেখক একত্র ছিলাম রাত্রি সাড়ে নটা থেকে
সকাল সাড়ে ছটা অবধি। মদ ও মাহোল পর্যাপ্ত ছিল। সকাল সাড়ে ছটায় যখন বেরোচ্ছি তখন গত
৯ ঘন্টায় একটা লাইনও পড়া হয়নি। হয়েছে উত্তপ্ত সাংবিধানিক আলোচনা, অর্থাৎ কোন আচরণটি লেখক গণতন্ত্রের পরিপন্থী ও কোনো ব্যবস্থাবিধি
গণতন্ত্রসম্মত ও প্রয়োগযোগ্য। এর সাথে বাড়তি, কিছু ঘষে ঘষে
কুৎসিত হয়ে যাওয়া খিল্লি। লেখা শোনানো তো নয়ই, লেখার তাত্ত্বিক দিক বা প্রায়োগিক দিক সংক্রান্ত কোনো নতুন চিন্তাভাবনা
কোনোকিচ্ছু নয়। এখানে আমি
সাধু ও বাকি চারজন দোষী, এমন দাবি করা
ঘোর মিথ্যাচার তো বটেই, অশ্লীলও।
লেখাসমাজ
প্রেজেন্ট টেন্স-
আসলে লেখাসমাজের এক নিজস্ব
সমাজতত্ত্ব আছে। গত দশ বছর ইন্টারনেট ও ফেসবুক তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠার ফলে
(যা কোনো দুর্ঘটনা বা অবাঞ্ছিত
ঘটনা বলে আমি মনে করি না)
কিছু পরিবর্তন
হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে অপরিচিতি শূন্য
হয়ে যাওয়া। লেখক ও লেখকের মধ্যে অপরিচয়ই সেই নশিলি রহস্য তৈরি করে যার ফলে একজন লেখক
আরেকজন লেখককে এক্সপ্লোর করতে উদ্যত হয়, যেভাবে অভিযাত্রী এক্সপ্লোর করে নতুন দেশের খোঁজে। আগে যে ছোট ছোট পকেট
ছিল লেখাসমাজের সারা বাংলা জুড়ে এবং সেই পকেটগুলি যুক্ত থাকত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
পত্রিকার দ্বারা। ন-মাসে, ছ-মাসে সেইসব পত্রিকায় একটি দুটি
কবিতা দিয়ে পরিচয় হতো কোনো
অনামা কবির সঙ্গে, শুরু হতো তার খোঁজ। আর
এই খোঁজের প্রসেসে ধীরে ধীরে গড়ে উঠত এক আত্মীয়তা সেই অচেনার সাথে। যা চেনা হওয়ার
মুহূর্তে এক প্রবল বিষ্ফোরণে উদ্ভাসিত হতো, যে বিষ্ফোরণের
নাম ‘যাপন’। প্রচুর অপেক্ষা ও
আদ্যন্ত রহস্যের পর ‘যাপন’ তৈরি হতো বলে তা ছিল এত মায়াময়। কিন্তু এখন প্রায়
নিখিল লেখাসমাজকে সম্পূর্ণ পাওয়া যায় একটি ঠিকানায়। চাইলে তার ছবি বা জীবনেতিহাসও
দেখে নেওয়া যায়। আন্দাজ করা যায় তার জীবনদর্শনটিও। ফলে অচেনাপনটির আক্ষরিক অর্থে
জীবনাবসান ঘটেছে। যে সামাজিক পৃথিবীতে এই একত্রিত হওয়া সেখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন
বাসিন্দার আগমন ঘটে। ফলে মারা গেছে ‘নতুন
অন্য’এর জন্য অপেক্ষা। এবং
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই সমাজে নিজস্ব পরিচয়টি। অবিকল একটি
মাল্টিন্যাশনালের কর্পোরেট স্ট্রাকচারের মতো ফাংশানিং করে এই লেখাসমাজ। এখানে
বিভিন্ন স্তর আছে। সবচেয়ে ওপরে অতিশয় উচ্চপদস্থ কয়েকজন (যাদের বেশিরভাগই সম্পাদক বা প্রিন্ট
জগতের প্রভাবশালী লোক)। তাদের তলায় উচ্চপদস্থদের একটা গ্রুপ। তাদের তলায় মোটামুটি
পরিচিত নাম বা পদস্থদের একটি স্ট্রাটাম। এবং সবচেয়ে নিচে সাধারণ
এমপ্লয়ীদের এক সুবিশাল ধাপ, যেখানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন চলছে। কেউ উঠে যাচ্ছে
ওপরের ধাপে অথবা কোনো
নতুন লেখক এসে যোগ দিচ্ছেন। অবিকল কর্পোরেট স্ট্রাকচারের মতো
এখানে যাতায়াত একমুখী অর্থাৎ নিচ
থেকে ওপরের দিকে।
একবার উচ্চ স্তরে উঠে গেলে সেখান থেকে সাধারণ স্তরে নেমে আসার ঘটনা ঘটে। অথবা
উচ্চস্তরে কোনো তরঙ্গ উঠলে, কো্নো
দুর্দান্ত নতুন লেখার আবির্ভাব ঘটলে, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে নিম্নতম সাধারণ স্তর অবধি। কিন্তু একই ঘটনা নিম্নতম
স্তরে ঘটলে তার আশেপাশের দু-পাঁচজন ছাড়া আর কোথাও ছড়িয়ে পড়ে না, উচ্চতম স্তরে তো নয়ই। কর্পোরেট ল্যাডারে যেমন উচ্চপদস্থের স্বীকৃতি
উন্নতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এখানেও তাই। কোনো উচ্চপদস্থ সদস্য
নিম্নতম স্তরের কাউকে তার মনোযোগ স্পর্শ দিলে, সে রাতারাতি উন্নীত হয়ে যায় উপরের স্তরে। আর বিনিময়ে উচ্চপদস্থ তার
আনুগত্য আশা করে থাকে। পায়ও। আগেকার আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠান আর লিটল ম্যাগাজিন
প্রতিষ্ঠানবিরোধী, এই সিনারিও চুলোয় গেছে। তার বদলে ঘটেছে এক
আশ্চর্য মজার ঘটনা। ইন্টারনেট ব্যাপক হওয়ার ফলে এবং ইন্টারনেট পত্রিকা বা ওয়েবজিন
প্রায় বিনা পয়সায় সহজে বানিয়ে ফেলা
যায় অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে, এই দুই কারণের ফলে প্রিন্ট ম্যাগাজিনের
সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এসেছে এবং
প্রায় সমানুপাতে
না হলেও ওয়েবজিনের সংখ্যা বেড়েছে। লিটল ম্যাগাজিন লিটল হওয়ার কারণ ছিল মূলতঃ অর্থাভাব।
গরীব লেখক কবিরাই একত্র উদ্যোগে প্রকাশ করে ফেলত
লিটল ম্যাগাজিন। কিন্তু এখন ছবিটি সম্পূর্ণ উলটো। একত্রিত মোটামুটি স্বচ্ছল
গোষ্ঠীগুলিই প্রিন্ট প্রকাশ করে। লেখাসমাজের সামাজিক দিক থেকে প্রিন্ট পত্রিকা
একটি অপ্রয়োজনীয় উপকরণ।
প্রিন্টেড
নিউ রোল-
(অপ্রয়োজনীয় কারণ, প্রিন্ট
পত্রিকায় লেখাজনিত এমন কিছু থাকে
না বা থাকতে পারে না
যা ওয়েবপত্রিকায় নেই। একটি
ক্ষীণ সাইজের প্রিন্ট পত্রিকা
প্রকাশ করতে যা খরচ
(আজকের বাজারে আনুমানিক ৬-৭,০০০ টাকা) এতে ওয়েব পত্রিকার
একমাত্র অর্থব্যায়ী কাঁচামাল অর্থাৎ ইন্টারনেট এতটা ক্রয় করা যায় যে তাতে প্রায় দু
বছর (মাসিক ৪ জিবি ইন্টারনেটের খরচ ৩৫৩/-, একটি ওয়েবজিনের
আপলোড সাইজ হয় আনুমানিক ৪০০ এম বি মতো) মাসিক নয়, পাক্ষিক
ভাবে একটি ওয়েবজিন রেগুলার প্রকাশ করা যায়, যাতে প্রায়
প্রিন্ট পত্রিকাটির তিনগুণ সংখ্যক লেখা থাকতে পারে, যে
অলংকরণ ছাপার খরচ প্রিন্ট পত্রিকাটি বহন করতে পারে না সেইরকম অলংকরণে বোঝাই হতে পারে, প্রিন্ট পত্রিকাটির যে সংখ্যা সীমাবদ্ধতা থাকে (২০০ কি
৪০০ কপি) তার নাম ও নিশান থাকে না ওয়েবজিনে। উপরন্তু প্রিন্ট পত্রিকাটির
পাঠ-প্রতিক্রিয়া সময় সাপেক্ষ হয়ে আসে এবং ৯০% ক্ষেত্রে মৌখিক রূপে আসে অর্থাৎ তার
কোনো ট্যাঞ্জিবল প্রমাণ থাকে না, সেক্ষেত্রে ওয়েবজিনটির প্রতিটি পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখিত
রূপ রঙ সহকারে আসে এবং সংখ্যাটির সাথে যুক্ত হতে থাকে। ফলে পত্রিকাটি সচল বস্তুর
মতো সর্বদা বিবর্তিত হতে থাকে। এরপরেও প্রিন্টকে বাতিল না করলেও খুব উপযোগী ও অমর
বস্তু বলে ভাববার কোনো
কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। এখনো প্রিন্ট
প্রকাশিত হওয়ার পেছনে যে কারণটি
মুখ্য থাকে, তা হলো একটি পত্রিকাকে
ঘিরে একটি গোষ্ঠীর যে যাপন, সেই যাপন প্রিন্ট প্রকাশের সময় রক্তমাংসের রূপ
নেয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে যাপনের অবস্থান আগেই বলেছি।)
কিন্তু বর্তমানের এই আজব
পরিস্থিতিটি বোঝানোর জন্য একটি গল্প বলতে হবে। ১৮২৭ সালের গল্প। তখন কলকাতায়
একমাত্র যানবাহন পালকি। প্রাইভেট পালকি ও ঠিকা পালকি। এবং সমস্ত বেহারাই কলিঙ্গআগত
বা উড়িয়া। এমন
সময় পোলিশ অফিস
থেকে নোটিস বেরোলো,
সব ঠিকে বেহারাদের পোলিশ অফিস থেকে লাইসেন্স নিতে
হবে এবং সেটি গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে। অফিস থেকে ভাড়াও ঠিক করে দেওয়া হলো। “সমস্তদিন ফী – চারি আনা। ইঙ্গরেজী ১৪ ঘড়িতে এক দিন
গণা যাইবেক। অর্ধদিন অর্থাৎ ইঙ্গরেজী এক ঘড়ির অধিক পাঁচ ঘড়ির কম – দুই আনা”। লাইসেন্সের তাবিজটি আবার কিনতে হবে নিজের
পয়সায়। তখন ইউনিয়ন, ধর্মঘট কথাগুলির অস্তিত্বও আসেনি। কিন্তু
তার পরের দিন ঘটলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা। শহরের ১১,৫০০ বেহারা
তাদের পালকি নামিয়ে রেখেছে, কেউ কাজে যোগ দেয়নি। ভারতের
ইতিহাসে প্রথম ধর্মঘট, কম্যুনিজম আবির্ভাবের বহু আগে। সমাচার
দর্পনে বেরোলো “অনুমাণ হয় ইহার মধ্যে কোন দুষ্টতা থাকিবেক বা
কেহ তাহাদিগকে কুমন্ত্রনা দিয়া থাকিবেক”। বৃটিশ কতৃপক্ষ তদানীন্তন
পশ্চিমি মুলুক থেকে দলকে দল বেহারা আনাতে লাগলো। কিন্তু মজার ঘটনা ঘটলো অন্য
জায়গায়। পালকির অভাবে পায়ে হেঁটে নাকাল সাহেবদের মধ্যে ব্রাউন সাহেব রাত্রে একটা
স্বপ্ন দেখলেন,
বেহারা ছাড়াই
পালকি গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। পরের দিনই সকালে মিস্ত্রী ডাকিয়ে একটা পাল্কির হাতলগুলো
খুলিয়ে ফেললেন ও তলায় চারটে চাকা লাগালেন এবং সামনে জুতে দিলেন ঘোড়া। কলকাতার
রাস্তায় চালু হলো ‘ব্রাউনবেরি’ ঘোড়ার
গাড়ি। চার পাঁচ বছরের
মধ্যেই শহর ছেয়ে গেল ঘোড়ার গাড়িতে, ফিটন ইত্যাদি,
পালকির থেকে দ্রুত ও সস্তা। ফলে পালকি উঠে গেল। এক্কেবারে উঠে গেল
না। যেহেতু পালকি প্রায় দেখাই যায় না, সেইহেতু অল্প যে
কয়েকটা প্রাইভেট পালকি ছিল, সেগুলি হয়ে দাঁড়ালো আভিজাত্য ও
মর্যাদার প্রতীক। দত্ত বাড়ির বখাটে মধুসূদন পালকি করে কালেজে আসতেন।
সমাজে বিশিষ্ট বা গণ্যমান্য
অংশের পরিচয় হয়ে দাঁড়ালো অবলুপ্ত পালকি। এবং ধীরে ধীরে সেখান
থেকেও লোপ পেয়ে গেল।
গল্পটা এই কারণে বললাম, লুপ্তপ্রায় প্রিন্ট পত্রিকার সাথে অবিকল একই ঘটনা ঘটেছে। লোপ
পেতে পেতে যে মাত্র দু’
চারটে প্রিন্ট পত্রিকা রয়ে গেছে,
তারা লেখা সমাজে এক
বিশিষ্ট আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সম্পাদকেরা হয়ে দাঁড়িয়েছেন সেই
অধিকারে উচ্চতমপদস্থ স্ট্রাটামটির অধিবাসী, তাঁদের আর কষ্ট
করে ধাপ ভেঙে উঠতে হয়নি। আনুগত্য দাবী করলে তুলে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে অনেকেই।
এমনকি এতদূর যে,
অনেক ওয়েবজিন ছ’ মাসে কি বছরে একটা করে
প্রিন্ট সংখ্যা বের করেন সেই দুর্লভ আভিজাত্যের
সদস্যপদ পেতে। প্রিন্টের স্বীকৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে অসম্ভব মূল্যবান পরিচয়। যে
প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব একসময় আনন্দবাজার পালন করত স্বীকৃতিদানের প্রথা সহকারে, সেই একই জায়গা এখন নিয়েছে প্রিন্ট পত্রিকা।
প্রিন্টেড
নিউ রোলের এফেক্ট-
এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে কম
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে খোদ লেখা। কর্পোরেট স্ট্রাকচারে যেমন কতগুলো কনসেপ্ট
খেলা করে, ‘উন্নতি’, ‘উচ্চাভিলাষী’, ‘টীমওয়ার্ক’, ‘কনফিডেন্স’, ‘নেটওয়ার্ক’, ‘প্ল্যাটফর্ম’ ইত্যাদি, এইগুলো সব এসে জড়ো হয়েছে লেখাজগতে। লেখার গ্রোথ বা
পারফেকশান নয়, লেখাকে সাকসেশফুল করে তোলাই প্রধান লক্ষ্য। এমনকি
এই সাকসেশের ইমপিরিক্যাল বা পরিমাপযোগ্য মাপকাঠিও রয়েছে, ফলোয়ার্স,
লাইক, শেয়ার সংখ্যা, ইত্যাদি।
অক্সফোর্ডে একটা কথা চালু আছে গবেষকদের মধ্যে, ‘পাবলিশ অর পেরিশ’। অর্থাৎ গবেষণা
যেমনভাবেই এগোক, নিয়মিত পেপার না পাবলিশ করলে তুমি অপ্রাসঙ্গিক
হয়ে হারিয়ে যাবে। অবিকল একই ফান্ডায় চলছে লেখাসমাজ, প্রতিনিয়ত
নিজেকে দৃশ্যমান করে তোলার, প্রাসঙ্গিক রাখার প্রচেষ্টা। যে কোনো কর্পোরেট সংস্থায় কর্মী নিয়োগের সময় যেমন প্রাথমিকভাবে
দেখা হয় সে কাজ জানে কিনা। হ্যাঁ, কাজটুকু জানে, এটা কনফার্ম হওয়ার পর দেখা হয় অনান্য বিষয়, তার
এ্যাটিটিউড, ম্যান ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। একই রকম এখানেও
লেখাটা জানে কিনা সেটা প্রাথমিক বিষয়। হ্যাঁ, লেখাটা জানে,
(জাস্ট জানাটুকুই ক্রাইটেরিয়া, কেমন কতটা
এগুলো খুব একটা ফ্যাক্টর নয়) তারপর আসরে নামে অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু। তার ইমেজ,
পি আর, নেটওয়ার্কিং, হ্যাপেনিং
ইস্যুজ, কনফিডেন্স, এ্যাটিটিউড,
ম্যান ম্যানেজমেন্ট বা এই বিশাল লেখাসমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে
তার ডীলিংস এইগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবং তার ফলে এই সিস্টেমে যা অবধারিত
হওয়ার, তাই হয়েছে। লেখার যে নিজস্ব স্টাইল বলে বস্তুটি আছে, তা গোল্লায় গেছে। ‘ভালো লেখা’ যেন
ইউনিভার্সাল সেট স্ট্যান্ডার্ড, আই এস ও নাইন থাউজ্যান্ডের
মতো। লেখাটি যাতে সেটা টাচ করে থাকে এটি নিশ্চিত করার পর বাকি অন্যান্য ফ্যাক্টরের
দিকে জোর দিচ্ছেন লেখক। ফলে একটা স্তরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন লেখক থেকে আগত ‘ভালো’ লেখাগুলি
সব একই রকম। আগে একজন দুর্বল লেখককেও তার লেখা পড়ে
চেনা যেত। এখন সদ্যআগত কোনো
লেখকের লেখা পড়ে
গুলিয়ে যাচ্ছে প্রমিনেন্ট লেখকের সাথে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো প্রায়ই উঠছে ‘লেখা চুরি’র অভিযোগ। কর্পোরেট
স্ট্রাকচার যেমন তৈরি
করে ব্রিলিয়ান্ট ওয়ার্কফোর্স, সুপার
ম্যানেজার, আর ভালো মাল তৈরির দায়িত্ব প্রোডাকশান
ডিপার্টমেন্টের ঘাড়ে চাপিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়ে থাকে।
তেমনই এই স্ট্রাকচারে তৈরি
হচ্ছে দারুণ কালারফুল
লেখক, সুপারহিট কবি। লেখা নয়। এখানে যারা দায়িত্ব নিতে
পারত, সেই গোষ্ঠীগুলির অবস্থা ভয়াবহ। যে লিটল ম্যাগাজিন
বিষয়টি একসময় বালকে বাল বলার স্বভাবের জন্য স্বভাব্বিদ্রোহী ছিল, সেখানে এখন সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে
সঠিক ডেমোক্রেসী বজায় রাখার সাথে সাথে পলিটিক্যালি নিখুঁতভাবে কারেক্ট থাকার নানান
জটিল হিসেব নিকেশ। কোথায় কার কোন্
লেখা প্রকাশ করলে তার
সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী
হতে পারে এবং তা পত্রিকার বর্তমান অবস্থানকে উন্নত করবে
না অবনত, কোথায় কোন্ পত্রিকা কী পরিকল্পনা করে
ক্ষতি করার চেষ্টা করছে এবং তার মোকাবিলা কোন্ এ্যাঙ্গেল
থেকে করা সর্বোত্তম এবং কীভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে
সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া যেতে পারে কাউকে অসন্তুষ্ট না করে, এইসব জটিল সাংবিধানিক অঙ্কে মগ্ন থাকে অথবা এই নতুন লেখাসোশাল স্ট্রাকচারে
‘সাকসেস’এর জন্য প্রয়োজনীয় ‘প্ল্যাটফর্মীয়’ ভূমিকা
পালন করে।
এখানে
লেখামো কোথায় ও কেন?
‘যাপন’এর মহিমাকীর্তন এই সময়ে এক অলীক বস্তু, তার জন্য
প্রয়োজনীয় সময় ও স্পেস দুটোই চূড়ান্ত বিলাসিতা এই সময়ে। আর আগের সে দিনগুলি ছিল কত
সোনাময়, আর এই দিনগুলি কত হাগুমাখা, এই
বিলাপ করার জন্য লেখামো তৈরি হয়নি। চার বছর আগে, যখন এই চেঞ্জগুলি ধীরে ধীরে তুঙ্গে পৌঁছোচ্ছে তখনই মনে হয়েছিল, ‘দ্য টাইম নীডস এ্যাকশান’। শুধুমাত্র নিজের
লেখালেখি নিজের ইভোলিউশান এই পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত স্বার্থপর
মনে হয়েছিল। এ্যাকশানটাকে ঠিকঠাক প্রতিমা দিতে কেটে গেল এতগুলো দিন। বেকার কাটেনি।
প্রথমতঃ সমস্যাটার একটা রুট কজ আছে, সেটাকে ধরতেই অনেকটা সময় গেল। ‘নতুন কবিতা’ মুভমেন্ট
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে বিস্তারিত মুভমেন্ট। যা বিষয়ের শাসন
থেকে বাংলা কবিতাকে এবং সেই সূত্রে
বাংলা লেখাকে মুক্ত করেছিল এবং ভাষার দিকে ফিরে তাকাতে জব্বর ইনস্টিগেট
করেছিল। এতটাই ব্যাপক ছিল ইনস্টিগেশান যে একটা সত্তর বছরের চালু প্যাটার্ন ধ্বসে
পড়েছিল। এবং কবির প্রয়োজন সর্বপ্রথম তার নিজের ভাষাটিকে আবিষ্কার করা, এটা অবিসংবাদিত প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কবির স্টাইল তার ভাষায় লুকিয়ে, কবির ম্যানারিজম তাও তার ভাষায় লুকিয়ে। ভাষার ওপর এই ইম্মেন্স ইমপর্টেন্স
কোনো প্রশ্ন ছাড়াই গৃহীত
হয়েছিল। কিন্তু এখানে লুকিয়েছিল একটা অতি সূক্ষ্ম ছিদ্র, লক্ষীন্দরের বাসরঘরের মতো। সেটা হলো যে ভাষাকে
সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু ভাষাচর্চার
প্রয়োজনীয়তাটা অতটা গুরুত্ব না দিয়ে। কোয়ান্টাম ফিজিক্স বা স্টিরিওকেমিস্ট্রির মতো
ভাষা এক অসীম সাবজেক্ট, যা সর্বদা নতুন নতুন কনসেপ্টে সেজে
উঠছে। এই কোনো
পুরোনো কনসেপ্ট বাতিল হচ্ছে তো হঠাৎ কো্নো
অতিবাতিল কনসেপ্ট ফিরে আসছে স্বমহিমায়। ফোনোলজি, মর্ফোলজি,
সাইকোলিংগুইস্টিক্স, কতো দিকে তার ব্যাপ্তি।
(পরিবর্তনগুলি কী পর্বতপ্রমাণ, তা একটা ছোট্ট উদাহরণ
দিলেই স্পষ্ট হবে। নোয়াম চমস্কির ভাষা সম্পর্কিত rational
analysis ও generative grammarএর
তত্ত্ব আসার পর ভাষা সম্পর্কিত empirical study বা ভাষানমুনা সংগ্রহ করে তার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ
হয়ে গেছিল। rationalism vs empiricism দ্বন্দ্বে ভাষার
স্ট্যাটিস্টিকাল এ্যানালিসিস প্রায় তিরিশ বছর বন্ধ ছিল। আশির দশক থেকে আবার ফিরে
আসে সংখ্যাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাষা বিশ্লেষণ। আমরা ভাবি কি
ভাষায়, অর্থাৎ চিন্তাভাবনার ভাষা কি তাই নিয়ে এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা
যায়নি। শুধু ভেসে আছে নানান বিস্ময়কর তত্ত্ব, যার মধ্যে একটা
ফোডরের mentalese বা brainese নামক একটি জেনেটিক্যালি এ্যাকোয়ার্ড ভাষা যার গ্রামার, সিনট্যাক্স সব আছে কিন্তু প্রতিমা বা রূপ নেই, তাই
দিয়ে ভাবার তত্ত্ব)
যে ভাষার জোরে বিষয় উড়ে গেল, সেই ভাষা সম্পর্কে জানার বা শেখার কোনো ‘মাস’ আগ্রহ তৈরি হলো না, বা তার বিজ্ঞানটিকে জানার। সেগুলি নিয়ে কাজ করতে লাগলেন কলিম খান, রবি চক্রবর্তীর মতো ভাষাবিজ্ঞানীরা এবং বাকি লেখকসমাজ তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা
জানিয়ে দূরেই থাকলেন। এখানেও
আবিষ্কৃত হলো ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার ওলট পালট করা তত্ত্ব।
কিন্তু তার প্রায়োগিক দিক নিয়ে মাথা ঘামানো হলো না। বরং স্ট্রেট দুটি ডিভিসান
হয়ে গেল, লেখক-কবি আর পণ্ডিত-ভাষাতাত্ত্বিক। এবং এই
সদাপরিবর্তনশীল ভাষার বিজ্ঞানটি না জানার ফলে এবং ভাষার একটি স্বকৃত, নিজস্ব স্ট্যাটিক ধারণা
রাখার ফলে সেই একই প্যাটার্নের রোগলক্ষণগুলি এই পর্যায়েও দেখা
গেল, যা নতুন কবিতার আগে ছিল, শুধু প্যাটার্নটা বদলে গেল এই যা। তকনিক, গূঢ় অর্থ, এক বক্তব্যের অন্য এক বুদ্ধিদীপ্ত
রিপ্রেজেন্টেশান, ফাঁকা স্পেস বা হঠাৎ থমকে যাওয়ার চালবাজি,
ভাষার গিমিকি কুরিকারি, প্রথম লাইন/থ
(প্রথমের) দ্বিতীয় লাইন/তী (দ্বিতীয়ের) তৃতীয় লাইন/ তৃ (তৃতীয়ের)-চতুর্থ লাইন/ তু
(চতুর্থের)-পঞ্চম লাইন/প (পঞ্চমের)-ষষ্ঠ লাইন… অর্থাৎ হোলসাম বিষয়কে বর্জন
করতে হবে অথচ স্ট্রাকচার খাড়া করতে হবে, তাই র্যান্ডাম
কুড়িয়ে আনা পাথরকুচির মতো অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় অথবা বিষয়াটিক এলিমেন্ট,
এক একটি লাইন বা লাইনাংশ যার আধার এবং ওই আগের বলা প্যাটার্নে,
বিষয়-লিংক-বিষয়-লিংক-বিষয়-লিংক-বিষয়, এভাবে
কাঠামো তৈরি
করার ক্লিশেড ও জঘন্য ভাবে ওভার-ইউজড একটি পদ্ধতি তৈরি হলো আমাদের অজান্তেই, আমাদের মধ্যেও। এইটি লক্ষ্য হতেই লেখামোর মনে হলো
লেখা যে একটি বিজ্ঞান (literascience) এই বিষয়টা খুব ব্যাপকভাবে চাউর হওয়া প্রয়োজন। আর ভয়ংকর প্রয়োজন এই
কাঠামোটার হ্যাবিট থেকে বেরোনো। আজ এই লেখামো কার্নিভ্যালে যে ডাক আমরা দিয়েছি,
কল্পনার ওপর থেকে সব
রকমের সেন্সরশিপ, ব্যারিকেড সরিয়ে দিয়ে তার
লিমিটকে চ্যালেঞ্জ করা লেখা তার একটা মূল কারণ, এই হ্যাবিট থেকে বের করা
নিজেদের।
দ্বিতীয় যে ইমপিরিক্যাল
উদ্দেশ্যর কথা বলা হয়েছিল, সেটা হলো এই প্রতিটি সেশান যতক্ষণ চলে, চলে আক্ষরিক কথ্য
ভাষাতেই। এই মুহূর্তে কথ্য ভাষার দুটো রূপ, একটি
লেখ্য কথ্য ভাষা আর আরেকটি কথ্য ভাষা। লেখ্য কথ্য ভাষার একটা কর্পাস বা ভাষানমুনা
গত চার বছর আমরা ফেসবুকের সাহায্যেই তৈরি
করেছি। এবং তা নানারকম
সিচুয়েশানে কেমন বদলায়, প্রকাশ্য লেখ্য কথ্য ভাষার স্বরূপ এবং একান্ত
অর্থাৎ ওয়ান ইজ টু ওয়ান লেখ্য কথ্য ভাষার স্বরূপ, তা
অন্তরঙ্গতার মাত্রানুসারে কেমনভাবে পরিবর্তিত হয়, তার একটা নমুনা সংগ্রহ করা
গেছে গত চার বছরে। যার ওপরে লেখামোর তরফ থেকে
অমিতাভ প্রহরাজ প্রোজেক্ট ননফেনোমেনন নামক একটি কাজ করছেন। কিন্তু বাংলা কথ্য ভাষার
কোনো কর্পাস এই মুহূর্তে
নেই। আমরা
সেটা তৈরি করতে চলেছি এই লেখামো
সেশানগুলি থেকে যেখানে আগাগোড়া রেকর্ডিং করা হয় এবং পরে
সফটওয়ারের সাহায্যে ট্রান্সফার করা হয় কর্পাসে। যেহেতু কথ্য ভাষার কর্পাস সেহেতু
পশ্চিমবঙ্গ এবং বহির্বঙ্গের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে এটি সংগ্রহ করার প্রোগ্রাম
আমাদের। এটা হলে এর থেকে অনেকগুলি ভাইট্যাল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। লেখ্য কথ্য
ভাষা ও কথ্য ভাষার মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য সেটা কোথায়? কথ্য ভাষায় যেমন আঞ্চলিক
ডায়লেক্টের প্রভাব থাকে সেরকম লেখ্য কথ্য ভাষাতেও কি অন্তর্নিহিত কোনো ডায়লেক্ট তৈরি হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর আমাদের অজানা
এই মুহূর্তে। (প্রসঙ্গতঃ এটি যাতে শুধুমাত্র লেখক বেরাদরির ভাষাতেই সীমাবদ্ধ না থাকে তার জন্য আমরা ননরাইটার ঘরানার
লোকেদেরও ইনক্লুড করছি, সে প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত বলা যাবে)। ফলে লেখামোর
সেশান দু’ভাগে
বিভক্ত থাকে, প্রথমতঃ একটা যতদূর সম্ভব ইনফর্মাল আড্ডা
তৈরি করা (ইনফর্মাল না হলে
কথ্য ভাষার
প্রকৃত স্বরূপ বোঝা যায় না), আলোচনা, কথাবার্তা। আর দ্বিতীয়তঃ লেখাবিজ্ঞান (যা
ভাষাবিজ্ঞান ও মনঃস্তত্ত্বের
ওপর ভিত্তি করেই গড়া) সংক্রান্ত কিছু কথা আলোচনা প্রায়োগিক দিক সহ। কোনো একতরফা ফান্ডাবিতরণ নয়, বরং অংশগ্রহণকারীরা নিজেই কীভাবে এর সঙ্গে যুক্ত অজান্তে বা
তাঁরা নিজেরাই কি পরিমান
বিস্তীর্ণ খনি অঞ্চল তৈরি
করছেন এবং সামান্য বেখেয়ালে চলে যাচ্ছেন খনন না
করে, তারই সরাসরি আলোচনা।
সাথে সাথে নিজেদের ভুলগুলোও বলা যাতে তার থেকে বোঝানো যায় কেমন একটা ব্যাপক
ক্রাইসিসে আক্রান্ত আমরা সবাই।