কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৯৮


‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের পাঠক-পাঠিকারা অনেকেই জানেন যে, বিগত তেতাল্লিশ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকা। এবং এই জানুয়ারী মাসেই প্রকাশিত হলো পত্রিকার ১০৮তম সংখ্যা। যাঁদের এ ব্যাপারে সঠিক কিছু জানা নেই, তাঁদের জানাই, ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের (আগে বিহার রাজ্য ছিল) শিল্পনগরী জামশেদপুর থেকে ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম সংখ্যা। দীর্ঘদিন ত্রৈমাসিক রূপে প্রকাশিত হবার পর কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছিল ষাণ্মাসিক রূপে। তারপর ‘কালিমাটি’র একশটি ক্রমিক সংখ্যা  প্রকাশের পর ২০১৫ সাল থেকে বছরে একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তবে এখন আর ‘কালিমাটি’ পত্রিকা সাধারণ সংখ্যা রূপে প্রকাশিত হয় না, বরং তার প্রতিটি সংখ্যাই বিশেষ সংখ্যা। কোনো নির্দিষ্ট বিষয় ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে সংখ্যাগুলির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইতিমধ্যে বিগত সাত বছরে যে সাতটি বিশেষ  বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, তা যথাক্রমে পরকীয়া সংখ্যা, সমকামিতা ও রূপান্তরকামিতা সংখ্যা, অতিপ্রাকৃত সংখ্যা, মৃত্যুচেতনা সংখ্যা, সৃষ্টি সংখ্যা, ভূত সংখ্যা এবং মহামারী সংখ্যা। আর এ বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে প্রকাশিত হলো ভন্ডামি সংখ্যা। সঠিক জানা নেই, এর আগে ভন্ডামি বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলায় কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল কিনা! তবে বিষয়টি যে নিতান্তই প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রসঙ্গত জানাই, ‘কালিমাটি’র ভন্ডামি সংখ্যাকে সমৃদ্ধ করেছেন বিশিষ্ট গবেষক- প্রাবন্ধিক এবং গল্পকাররা। জীবন ও জগতের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা বিষয়টি পর্যালোচনা করেছেন এবং তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন। অনুমান করা যেতে পারে, মানবসভ্যতার সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই সভ্যতার পাশাপাশি অংকুরিত হয়েছিল ভন্ডামির ভাবনা। তারপর সভ্যতা বিকাশের ক্রমধারায় ভন্ডামিরও ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এবং আজ এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পৌঁছে একথা বলা সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমান মানবসভ্যতা এবং মানবজীবনে ভন্ডামি ছড়িয়ে ও জড়িয়ে আছে সংপৃক্তভাবে। ব্যতিক্রমী কিছু মানুষের কথা অবশ্যই শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখা আমাদের কর্তব্য, নতুবা প্রায় প্রতিটি মানুষই এই দোষে দুষ্ট। বিশেষত এই দুষ্টতা ক্রিয়াশীল থাকে মানুষের চেতনে, অচেতনে অথবা অবচেতনে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ ওয়াকিবহালও থাকে না যে, তারা তাদের ব্যক্তি পরিচয়ে, অস্তিত্বে, আচরণে ও ব্যবহারে কীভাবে লালন করে চলেছে ভন্ডামিকে।

এই প্রসঙ্গে আরও জানাই, যাঁরা ‘কালিমাটি’ পত্রিকার এই সংখ্যাটি সংগ্রহ করতে আগ্রহী, তাঁরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। নিচে যোগাযোগের ঠিকানা উল্লেখ করা হলো।

দুঃসময় চলছে এখন পৃথিবীর। অসুস্থ হয়ে পড়েছে বিশ্ব। জানি না, কবে আমরা আবার সুসময়ে ও সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারব। শুধু আন্তরিকভাবে আশা করতে পারি, আমরা এই দুর্যোগ ও সংকট একদিন কাটিয়ে উঠবই। 

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৬ 




ব্রিটেনের পর এবার আমাদের গন্তব্য জার্মানি। ইতালি আর ফ্রান্সের সিনেমা দেখে আপনি যদি জার্মানির ছবি দেখতে বসেন, কখনোই মনে হবে না আপনি অপূর্ব বা সুন্দর সিনেমা দেখছেন। কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন যে নিখুঁত ফিনিশিং কী জিনিষ! কেন জার্মান পার্ফেকশন নিয়ে গোটা পৃথিবীতে এত কথা ছড়িয়ে আছে।  মনে করে দেখুন, গোটা পৃথিবীর ১২টা ক্লাসিক নিয়ে যেদিন আলোচনা করেছিলাম, জার্মানির ‘মেট্রোপোলিস’ নিয়ে লিখেছিলাম। সেই সিনেমার সেট কীভাবে বানানো হত আর প্রতি শট্‌ নিখুঁত করার জন্য তার মানুষজনের সঙ্গে  কীরকম ব্যবহার করা হত – সেটা মনে পড়ছে? টি এস এলিয়টের এক ছোট্ট  কবিতা মনে পড়ে গেল, ‘মর্নিং অ্যাট দ্য উইন্ডো’ – ‘They are rattling  breakfast plates in basement kitchens/ And along the trampled edges of the street/ I am aware of the damp souls of housemaids/ Sprouting despondently at area gates.’ সকালের একদম নিখুঁত ছবি, তাই না? আজ আমরা জার্মান সিনেমার এই পার্ফেকশন নিয়ে এগোব।

আরেকটা কথা। আমরা এর আগেও বারবার একটা টার্ম ব্যবহার করেছি – জার্মান এক্সপ্রেসনিজম। আজ আলোচনা শুরুর আগে সিনেমার প্রেক্ষিতে সেটার ইতিহাস একটু ঘেঁটে নেব। এক্সপ্রেসনিস্ট শিল্প আন্দোলন (যা বাস্তবের থেকে প্রাধান্য দিত মানসিক জগৎকে) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই আস্তে আস্তে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন জার্মানি, ইতালি আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি একদিকে হয়ে গেল (সঙ্গে তুর্কীও এসে জুটল) আর উল্টোদিকে বাকি ইউরোপ ও আমেরিকা, তখন গোটা বিশ্বের সঙ্গে জার্মানির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময় জার্মানিতে বিদেশি সিনেমা দেখানো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এক্সপ্রেসনিস্ট আন্দোলন নিজস্ব সিনেমার মধ্যে দিয়ে জার্মানিতে গন্ডীবদ্ধ হয়ে পড়ে। এইসব সিনেমার চিত্রায়ন হত বেয়াড়া কিছু থিম নিয়ে যা সাধারণ নয়, ক্যামেরার কাজ অন্যরকম ও অ্যাঙ্গল জ্যামিতির  হিসেবে অদ্ভুত, এবং এইসব ছবিতে অবাস্তব ভয়, সাসপেন্স বা থ্রিলার দেখানো  হত যা পরবর্তীকালে যোগাযোগ স্বাভাবিক হবার পর হলিউড লুফে নিয়েছিল। এটা ঘটনা যে জার্মান নির্বাক সিনেমা সমসাময়িক হলিউড সিনেমার চেয়ে টেকনিকের দিকে খানিকটা এগিয়ে ছিল। কিন্তু এক্সপ্রেসনিজমের শুরুর দিকের সিনেমায় কিছু খামতি ছিল যা পরবর্তীকালে মুর্নাউ বা ফ্রিজ ল্যাং বা কার্ল ফ্রয়েড বদলে নেন।  এবং সেই স্টাইল হিচকক্‌ থেকে শুরু করে অরসন ওয়েলেস, অনেকেই ব্যবহার করেন। 

এবার তাহলে কিছু জার্মান ছবি বাছা যাক। প্রথমে ১৫টা ছবি বেছে নিই যা দেখলে আপনি জার্মানির ইতিহাস বা বর্তমান সিনেমা সম্বন্ধে খানিকটা আঁচ পাবেন। এই বাছাইয়ের প্রথম চারটে ছবিই কিন্তু জার্মান এক্সপ্রেসনিস্ট সিনেমা। রবার্ট ভিনের ‘দ্য ক্যাবিনেট অব ডঃ ক্যালিগারি’ (১৯২০), মুর্নাউ-এর ‘নসফেরাতু’ (১৯২২), ফ্রিজ ল্যাং-এর ‘মেট্রোপোলিস’(১৯২৭) ও ‘এম’  (১৯৩১), উইকির ‘দ্য ব্রিজ’ (১৯৫৯), হার্জগের ‘আগুয়ার, র‍্যাথ অব গড (১৯৭২), ফাসবিন্ডারের ‘আলিঃ ফিয়ার ইটস দ্য সোল’ (১৯৭৪), স্লোনডর্ফের ‘দ্য টিন ড্রাম’ (১৯৭৯), পিটারসেনের ‘দ্য বোট’ (১৯৮১), ভেন্ডাসের ‘উইংস অব ডিজায়ার’ (১৯৮৭), ক্যারোলিন লিঙ্কের ‘নোহ্যয়ার ইন আফ্রিকা’ (২০০১), ফন দোনার্সমার্কের ‘দ্য লাইভস অব আদার্স’ (২০০৬), রুজোউইদস্কির ‘দ্য কাউন্টারফেটার্স’ (২০০৭), মাইকেল হানেকার ‘দ্য হোয়াইট রিবন’ (২০০৯) এবং পেজোল্ডের ‘বারবারা’ (২০১২)। এগুলোর ভেতর আজ আমরা এই ছ’টা ছবি নিয়ে বিশদ আলোচনা করবঃ ‘নসফেরাতু’ (১৯২২), ‘এম’ (১৯৩১), ‘দ্য টিন ড্রাম’ (১৯৭৯), ‘দ্য বোট’ (১৯৮১), ‘লাইভস অব আদার্স’ (২০০৬) ও ‘দ্য হোয়াইট রিবন’ (২০০৯)।


‘নসফেরাতুঃ দ্য সিম্ফনি অব হরর’ আমি প্রথম দেখি ২০০৪ সালে। নির্বাক ছবি।  সেই সময় থেকে, এই বই দেখার পর, ইচ্ছে হত এই সিনেমা নিয়ে কিছু লিখি। কারণ ডারউইনের ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ থিয়োরি যদি কোন সিনেমার  ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, সেটা এই সিনেমা। ঠিক একশ বছর আগের এই ছবি ব্রিটিশ লেখক ব্রাম স্টোকারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’ (১৮৯৭) অবলম্বনে তৈরি। অবশ্য ড্রাকুলা নিয়ে এটা প্রথম সিনেমা নয়, প্রথম সিনেমা ছিল হাঙ্গেরির ‘ড্রাকুলা জ ডেথ’ (১৯২১)। কিন্তু সেই সিনেমা জনপ্রিয় হয়নি, এবং আশ্চর্যভাবে তার একটাও কপি আজ আর নেই। পরের বছর ফ্রেডেরিক উইলহেল্ম মুর্নাউ ‘নসফেরাতু’ তৈরি করেন। মুশকিল হল, তিনি ড্রাকুলা উপন্যাসের স্বত্ব কিনতে  পারেন নি। তাই খুব কম বাজেটে জার্মানির প্রেক্ষাপটে কাউন্ট ড্রাকুলা নাম বদলে কাউন্ট অর্লফ করে এবং বেশ কিছু সিন বদলে দিয়ে এই সিনেমা তৈরি করেন। তদ্দিনে স্টোকার আর বেঁচে নেই। কিন্তু তার বিধবা বৌ কোর্টে এই সিনেমার বিরুদ্ধে নালিশ ঠোকেন। এবং কোর্ট নির্দেশ দেয় এই সিনেমার সমস্ত কপি পুড়িয়ে ফেলা হোক। সেটাই হয়। কিন্তু রিলিজের পর কোন এক সিনেমা প্রেমিকের উৎসাহে একটা কপি তার সংগ্রহে রয়ে গেছিল। সেটাই উদ্ধারের পর ১৯৩৭ সালে আবার এই সিনেমা আমেরিকায় দেখান হয়। এবং প্রথম দর্শনেই বাজিমাৎ। তুমুল হিট। এরপর মুর্নাউ-এর নাম বাদ দিয়ে এই সিনেমার এক রিমেক ১৯৭৯ সালে রিলিজ হয়। তারপর একে একে অন্যান্য রিমেক। জনপ্রিয় ভয়ের এই ছবি সারা পৃথিবীর প্রথম ১০০ ছবির ভেতর জায়গা করে নেয়।

থিম বলব না, কারণ ড্রাকুলা ছবির থিম বাচ্চারাও জানে। কিন্তু নসফেরাতু প্রথম  দিকের এক্সপ্রেসনিস্ট সিনেমার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এর সেট ডিজাইন থেকে  শুরু করে ক্যামেরার অ্যাঙ্গল, আউটডোর বা ইন্ডোর শট, কফিন নিয়ে মিছিল, পারিপার্শ্বিক তৈরি করা, ক্যামেরার হঠাৎ স্টপ-শট এবং প্রকৃতির ছবি – এই   সমস্ত কিছু অদ্ভুত ও অনবদ্য। হ্যাঁ, এখন এই সিনেমা দেখলে হয়ত আর ভয় লাগবে না, কিন্তু চিত্রায়ন ও কলাকারিত্ব এখনো চমক জাগায়। এবং জার্মানির ইহুদিবিদ্বেষ আমরা মোটামুটি সবাই জানি। এই সিনেমাতেও কিন্তু সেটা প্রচ্ছন্নভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কাউন্ট অর্লকের ছূঁচলো নাক, বড় বড় নখ, লম্বা সরু চেহারা আর টাক, এগুলো ইহুদিদের লক্ষণ। অনেকটা ইঁদুরের মত, যা ইহুদিদের চটানোর জন্য বলা হত।

এই ছবির পরেই আমি বাছলাম ফ্রিজ ল্যাং-এর ‘এম’ যা এক্সপ্রেসনিস্ট আন্দোলনের আরেক উদাহরণ। আরেক ক্লাসিক জার্মান ছবি। ল্যাং-এর প্রথম  সবাক চলচ্চিত্র। এই সিনেমা এক মনস্তাত্বিক সাসপেন্স থ্রিলার। বার্লিনের রাস্তায় এক সিরিয়াল কিলার, যে বাচ্চাদের খুন করছে, তাকে নিয়ে ছবি। এবং সে ধরা পড়ার পর তার বিচার। নসফেরাতু বা মেট্রোপোলিসের তুলনায় এর থিম অন্য রকম।

‘এম’ পৃথিবীর প্রথম সিরিয়াল কিলারের ওপরে বানানো ছায়াছবি। মুখ্য চরিত্রে  পিটার ল বোধহয় জীবনের সেরা অভিনয় এখানে উপহার দিয়ে গেছেন। এবং এই সিনেমা অদ্ভুত রকমভাবে ওপেন এন্ডেড। একজন মনস্তাত্বিক রুগি, সে একের পর এক বাচ্চাদের মেরে ফেলেছে, তাকে কি আদৌ মৃত্যুদন্ড দেওয়া উচিৎ এবং দিলেও কি সেইসব বাচ্চারা আর ফিরে আসবে? এই প্রশ্ন নিয়ে সিনেমা শেষ। বিচার শেষ হবার আগেই। ক্যামেরার কাজ অনবদ্য। ট্র্যাকিং শটের মাধ্যমে লং শট, প্রায় নব্বই বছর আগে, ভাবা যায়! এছাড়াও ল-এর মুখে শিস হিসেবে মাঝে মাঝেই এক লেইটমোটিফের ব্যবহার, যা সঙ্গীতের ছোট্ট এক অংশবিশেষ, আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ১ ঘন্টা ৫০ মিনিটের এই সিনেমা দেখলে আক্ষরিক অর্থেই মনে হবে সিরিয়াল কিলিং ব্যাপারটা মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। অবশ্য এটাও বলতে চাই, যদিও সেটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, ল্যাং-এর ‘মেট্রোপোলিস’ আর ‘এম’ দেখে মনে হয় ভদ্রলোক নাৎসিদের মনে প্রাণে ঘেন্না করতেন।     

ভোলকার স্লোনডর্ফের ‘দ্য টিন ড্রাম’ বাছলাম অন্য বেশ কয়েকটা কারণের বাইরেও আরেক কারণে। এই উপন্যাসের লেখক গুন্টার গ্রাস আমার অন্যতম প্রিয় এক লেখক বলে। আসলে গোটা পৃথিবীতে হাতে গোনা যে কজনের ম্যাজিক-রিয়েলিজম নিয়ে লেখা পছন্দ করি, গ্রাস তার ভেতর একজন। এবং ১৯৫৯-এর সেই বই, যা থেকে পরবর্তীকালে ১৯৭৯-র এই সিনেমা, সেই জাদু বাস্তবতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ১৯৯৯ সালে গ্রাস যখন সাহিত্যে নোবেল  প্রাইজ পেয়েছিলেন, তখন তার স্তুতি করতে গিয়ে সুইডিশ নোবেল কমিটি লিখেছিল, গুন্টার হচ্ছেন সেই লেখক ‘whose frolicsome black fables portray the forgotten face of history’। যাইহোক, এই সিনেমায় ফিরি। নাৎসি জার্মানির আবহে এই ছবি সম্পর্কের এক জটিল ক্যানভাস। অস্কার এক তিন বছরের বাচ্চা ছেলে। তার দাদুর সময় থেকেই তাদের বংশের জন্মপঞ্জী নিয়ে বেশ গন্ডগোল ছিল। যেমন অস্কারের বাবা কে, সেটা তার মা অ্যাগনেস-ও সঠিক জানে না। আলফ্রেড বা জান, এদের ভেতর কোন একজন। সমাজের এই রকম অনেক জটিল ধাঁধাঁ আর নোংরামো দেখে অস্কার তার তিন বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নেয় সে আর বড় হবে না। এবং তার মায়ের উপহার দেওয়া এক টিনের ড্রাম নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকে। তার বৃদ্ধি সত্যিই থেমে যায়। এবং সে এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী হয়। কেউ তার ড্রাম কেড়ে নিতে চাইলে সে এত জোর চেঁচাতে পারত যে আশেপাশের সব কাচ ভেঙে যেত। এখান থেকে সিনেমা নিজের মত গড়িয়ে চলে। অস্কারের বয়স বাড়ে কিন্তু তার বৃদ্ধি হয় না। সে একে একে ভালবাসার সম্পর্কে জড়ায় এবং তারা মারা যায়। অস্কারের মা-ও মারা যায়। একসময় অস্কার আবার সিদ্ধান্ত নেয় যে সে আবার বড় হবে। এরপর কোন একজন ঘোষণা করে যে অস্কার সত্যিই আবার বড় হচ্ছে। এবং তারপরেই অস্কার অনুভব করে, তার চেঁচানোর সেই ক্ষমতা আর নেই। অসাধারণ ম্যাজিক রিয়েলিজম।

এক পুরনো ফাটা টিনের ড্রামকে বিরক্তি প্রকাশের মোটিফ হিসেবে রেখে সম্পর্কের জটিল মোড়কে ভেঙে পড়া সামাজিক কাঠামোর একের পর এক স্পষ্ট দৃশ্যায়ন। সেই থিমের নিরিখে প্রায় ২ ঘন্টা ৪০ মিনিটের এই ছবিকে অল টাইম ফেভারিট জার্মান ছবির লিস্টে বেছে নিতে কোন দ্বিমত থাকা উচিৎ নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মনস্তাত্বিক দোটানা সত্বেও কীভাবে কিছু মানুষ দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই নিয়ে ওলফ্‌গ্যাং পিটারসেনের ছবি ‘দ্য বো’  (জার্মান ভাষায় Das Boot)। একই নামের ১৯৭৩ সালের জার্মান উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবি। আড়াই ঘন্টার সিনেমা।

১৯৪১ সাল। জার্মান সাবমেরিন U-96 বন্দর ছেড়ে আটলান্টিকের উদ্দেশ্যে ভেসে যায়। সেই সাবমেরিনের সদস্যদের ভেতর যারা প্রবীন, তারা যুদ্ধের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ কিন্তু যারা বয়সে নবীন, তারা যুদ্ধের বিষয়ে উৎসাহী। আটলান্টিকে তাদের সঙ্গে একবার ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান আর একবার ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধ হয়। সাবমেরিনের ক্ষতি হয়। কাজ শেষ করে তারা যখন ক্রিসমাস পালন করতে বন্দরের দিকে আবার ফিরে আসছে, তখন আদেশ আসে দেশে ফেরা চলবে না, তাদের সোজা যেতে হবে ইতালি। যাত্রাপথে তারা স্পেনের এক বন্দরে রাত কাটায়, জ্বালানী-টর্পেডো-অন্যান্য জিনিষপত্র ভরে নিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে যেতে শুরু করে। কিন্তু জিব্রাল্টারের কাছে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান তাদের ওপর হামলা করে সাবমেরিনের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। সেখান থেকে কোনমতে ভাঙা সাবমেরিন নিয়ে তারা রাতের অন্ধকারে আবার জার্মানির বন্দরে ফিরে আসে। ঠিক তখনি মিত্রশক্তির বিমানবাহিনী বোম মেরে গোটা বন্দর উড়িয়ে দেয়। সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন ও বেশিরভাগ কর্মী মারা যায়। সাবমেরিন আস্তে আস্তে জলে ডুবে যায়।

এই সিনেমাকে আমি যুদ্ধের ছবি হিসেবে দশে দশ দেব। এমন এক যুদ্ধের সিনেমা যেখানে টানটান উত্তেজনা আর ঘরে ফিরতে না পারা যোদ্ধাদের মানসিক দোটানা পাশাপাশি ফুটে উঠেছে। ক্যামেরার কাজও বেশ ভাল। কিন্তু ইতিহাসের দলিল হিসেবে এই সিনেমাকে রাখা যাবে না কারণ ১৯৪১-এর শেষভাগে ব্রিটিশ বিমান বাহিনী জার্মানির কোন বন্দর বোম মেরে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল – এই তথ্য পুরো মনগড়া।       

বার্লিনের পাঁচিল ভাঙার আগে পূর্ব জার্মানির পুলিস গোপনে কীভাবে পূর্ব জার্মানির বাছাই করা কিছু লোকজনের গতিবিধির ওপর নজর রাখত, সেই নিয়ে ফ্লোরিয়ান ফন দোনার্সমার্কের ‘দ্য লাইভস অব আদার্স’। সিনেমা শুরু হচ্ছে  ১৯৮৪ সালের পূর্ব জার্মানিতে। এক স্তাসি পুলিস, এক বিখ্যাত নাট্যকারের গতিবিধির ওপর গোপনে নজর রাখার ভার পায়। সে নাট্যকারের ফ্ল্যাটে গিয়ে গোপন মাইক্রোফোন বসিয়ে আসে। এবং কিছুদিন পর বুঝতে পারে, নাট্যকারের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে, যেহেতু তার প্রেমিকার ওপর এক মন্ত্রীর কুনজর রয়েছে। সে একদিন নিজের পরিচয় গোপন রেখে নাট্যকারের প্রেমিকাকে পরামর্শ দিয়ে আসে মন্ত্রীর থেকে দূরে থাকতে। এরপর পূর্ব জার্মানির বৈষম্য নিয়ে সেই নাট্যকার পশ্চিম জার্মানির এক পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লেখে। সেই প্রবন্ধ মন্ত্রীর চোখে পড়ে। সে পুলিস দিয়ে সেই ফ্ল্যাট সার্চ করায়, যে  টাইপরাইটারে লেখা হয়েছিল, সেই টাইপরাইটার খুঁজে বের করার জন্য। পুলিসের ভয়ে নাট্যকারের প্রেমিকা টাইপরাইটার কোথায় আছে সেটা বলে দেয় এবং এক ট্রাকের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করে। এদিকে পুলিস এসে সেই টাইপরাইটার কোথাও খুঁজে পায় না। যদিও তারা নাট্যকারকে জেলে পুরে দেয়। ১৯৮৯ সালে বার্লিনের পাঁচিল ভেঙে ফেলার পর সেই স্তাসি পুলিস আর তার সহকর্মীরা কাজ ছেড়ে চলে যায়। সেই নাট্যকারও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। কয়েক বছর পর সেই নাট্যকার এক অনুষ্ঠানে সেই মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে যে তার ওপর নজর রাখা হয়নি কেন? উত্তরে মন্ত্রী জানায় যে স্তাসি পুলিস প্রথম থেকেই তার ওপর নজর রেখেছিল। নাট্যকার নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে গোপন মাইক্রোফোন খুঁজে পায় এবং বুঝতে পারে যে সেই স্তাসি পুলিস-ই তার ফ্ল্যাট থেকে টাইপরাইটার সরিয়ে তার উপকার করেছিল। অবশ্য তদ্দিনে সেই স্তাসি পুলিশ অন্য এক শহরে পোস্টম্যানের চাকরি নিয়ে চলে গেছে। নাট্যকার তার পরবর্ত্তী বই সেই স্তাসি পুলিসকে উৎসর্গ করে।

তথাকথিত স্পাই বা গুপ্তচর সিনেমার বাইরে এসে এই ছবি এমন কিছু দর্শন রেখেছে, যা মানুষের মনের কাছাকাছি। প্রথমত, এর প্লট একদম উলের মত যত্ন করে বোনা, যেখানে মানুষের চাপা চিন্তাভাবনা আর কামনা হঠাৎ হঠাৎ সারফেসে ভেসে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, যে সমাজ নিপীড়ন করতে ভালবাসে, সেখানে নিজের ইচ্ছেগুলোও যে বোঝা হয়ে ওঠে, সেটা স্পষ্ট দেখান হয়েছে। এছাড়াও, মানসিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন কোন এক চরিত্রকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাতে পারে, সেটাও এই সিনেমা দেখিয়েছে। এবং পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের চেতনাকে কীভাবে বাজি রাখতে হয়, সেই কথাও তুলে ধরেছে ১৩৭  মিনিটের এই ছবি।

হ্যাঁ, যে কথাটা না বললে এই ছবির আলোচনা পুরো হবে না, তা হল – এই ছবির মুখ্য চরিত্র উলরিখ মুহে বাস্তব জীবনে বিয়ের ছ’বছর পর জানতে পারেন যে তার স্ত্রী এদ্দিন এক গোপন স্তাসি এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিল।

মাইকেল হানেকার ‘দ্য হোয়াইট রিবন’ এক বিতর্কিত মাস্টারপিস। বিতর্কিত, কারণ হানেকা শক্ত থিম নিয়ে কাজ করতেই ভালবাসেন এবং তাঁর সিনেমা ঠিক কী বার্তা দিতে চায়, সেই নিয়ে দর্শকও মাঝে মাঝে ধাঁধাঁয় পড়ে যান। এবং হানেকার ছবিতে নিষিদ্ধ কিছু ব্যাপার থাকবেই। যেমন এই ছবিতে - নিষিদ্ধ যৌনতা, পেডোফিলিয়া, হিংসা, খুন, অনেক কিছু আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে জার্মানির কোন এক গ্রাম দেখান হয়েছে। সেই গ্রামে রাজত্ব করেন এক ভূস্বামী, এক ডাক্তার আর এক চার্চ আধিকারিক। তিনজনেই অর্থ ও ক্ষমতাবশে আর অন্যদের কঠিন শাস্তি দেবার সুবাদে গ্রামের মাথা। হঠাৎ সেই গ্রামে একে একে ক্ষতিকারক কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করে। দুটো গাছের মাঝে বাঁধা এক দড়িতে আটকে ডাক্তারের দুর্ঘটনা ঘটে। ভূস্বামীর ছেলে হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পরের দিন তাকে যখন এক কাঠচেরাই মিলের মধ্যে পাওয়া যায়, তার সারা গায়ের বেতের দগদগে ঘা। এরপর কিছু পরিবার গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। ছবি শেষ হচ্ছে ১৯১৪-র যুদ্ধ শুরুর আবহে। তখনো গোটা গ্রামে হৈচৈ, কিন্তু সেইসব বিক্ষিপ্ত হিংসার কোন কূলকিনারা হয়নি।    

তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ছবির নাম ‘হোয়াইট রিবন’ কেন? সাদা রিবনের বো  তৈরি করে আমরা যে কোন ধরনের হিংসার বিরোধীতা করি। এটা এক ধরনের বিশুদ্ধতা বা নিখাদ অনুভূতির প্রতীক। ফলে সাদা রিবন আর বাচ্চারা যেন ঝকঝকে নিষ্পাপ সমাজের উপস্থাপক, এভাবেই দেখা হয়। কিন্তু এই সিনেমায় হানেকা-র কাছে সেটার অস্তিত্ব নেই। আর নেই বলেই দর্শকের কাছে অক্সিমোরন হিসেবে এই নাম তুলে দেওয়া হয়েছে। ১৪৪ মিনিটের এই সাদা-কালো ছবির আরেক তারিফ করার মত দিক হল, এর সিনেমাটোগ্রাফি। ছবির বেশিরভাগ শুটিং হয়েছে অন্ধকার ফ্রেমে। সামনে বড়জোর মোমবাতি, লম্ফ বা টর্চ। এমনকি খামারবাড়ি পুড়ে যাবার লেলিহান আগুনের দৃশ্যেও চারপাশে জমাট অন্ধকার। সঠিক আলো-আঁধারির খেলা দেখানোর জন্য এখানে ক্যামেরাম্যান নতুন এক টেকনিক তৈরি করেছিলেন – সিনে রিফ্লেক্ট লাইটিং সিস্টেম। ফলে প্রত্যেক ফ্রেমে হিংসার টোন একটু করে কমিয়ে উৎকন্ঠা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এবং ছবিতে শেষ অব্ধি যে ধারণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হল, ছবি  যেন দর্শকের মাথায় শেষ হয় – পর্দায় নয়।

কোন কোন সমালোচক এই সিনেমাকে নাৎসি হিংসার শুরুর দিকের দলিল হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। কিন্তু আমার ছোট বুদ্ধিতে আমি সেটার বিরোধীতা করি। কারণ সেটা সত্যি হলে ধরে নিতে হবে আমাদের সবার মনেই নাৎসি হিংসার বীজ লুকিয়ে আছে। এই ছবি আসলে এক ভূতের সিনেমা, যেখানে কোন ভূত নেই। কারণ সেই ভূত আমাদের মত এক বা একাধিক  অচেনা মানুষ, আর তাকে ভয় পায় আমাদেরই মনের শঙ্কা ও উৎকন্ঠা।

শেষ করার আগে এক ছোট্ট পয়েন্ট নিয়ে দু’এক কথা বলি। আমি এর আগের বিভিন্ন পর্বে যখন ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন বা ব্রিটেনের সিনেমা নিয়ে লিখেছি, তখন বলেছি যে ৫০ ও ৬০-এর দশকে নব্য-বাস্তবতা ছড়িয়ে পড়ার হাত ধরেই এইসব দেশের সিনেমায় স্বর্ণযুগ এসেছিল। কিন্তু জার্মানির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অন্তত ১৯৭০ সাল অব্ধি গোটা পৃথিবী জার্মানির জন্য দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। ফলে এই সময় জার্মান সিনেমার বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি।   

(ক্রমশ)

 

 


শিবাংশু দে

 

নিম-সময়ের জর্নাল




 

শিল্পযাপন, অহমিকা ও সৃজন কবিয়াল

----------------------------------------------------

এমন এক একটা সময় আসে, যখন মানুষ ঠাহর করতে পারে না, সে ইতিহাসের ঠিক কোন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমাদের সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী বর্গ, অর্থাৎ পেশাদার রাজনীতিকরা, যাই করেন তাকে 'ঐতিহাসিক' বিশেষণে দাগিয়ে দেন। সেই সব সিদ্ধান্তের পিছনে কোন সর্বনাশ লুকিয়ে আছে তার কোনও পরওয়া না করেই। সেই বিক্রমাদিত্যের যুগ হোক বা আজকের অন্য এক 'আদিত্যে'র আমল, সবই তো ‘স্বর্ণযুগ’। কিন্তু রামা কৈবর্ত বা হাশিম শেখের আদত অবস্থা একই থাকে। বহিরঙ্গের ঠুনকো বদলটিকে যদি ধরে নেওয়া হয় এহ বাহ্য। আমাদের মতো একান্তভাবে গুরুত্বহীন, তাৎপর্যহীন মানুষদের প্রাণযাপন বা শিল্পযাপন কি আদৌ কোনও অর্থ রাখে? তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম গরম করা কি নিতান্ত সময়ের অপব্যবহার?

আমাদের দেশে 'ধর্ম' আবহমান কাল ধরেই ছিলো একটা সংস্কৃতি যাপন। সারাদিন খেটে খাওয়া মানুষ হয়তো দিন শেষে ক্লান্ত মনটাকে গুছিয়ে নিতে কীর্তন গাইলো অথবা জলসায় আলিম-ফাজিল মানুষদের থেকে কিছু সদালোচনা শুনলো। অথবা কোনও পরবের দিন নতুন জামা, খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে ব্রাহ্মণ বা শেখ-সৈয়দদের থেকে শোনা অবোধ্য, জটিল প্রপঞ্চগুলি। যা শুধু শোনার জন্য। বোঝা নিষ্প্রয়োজন। মানলেও হয়। না মানলেও তা কখনও 'বোঝা' হয়ে উঠতো না। এই সব প্রসঙ্গের বাইরে ‘ধর্ম’ মানে তো স্রেফ শালগ্রামশিলা। এক কোণে রাখা চন্দন-সিঁদুর-বেলপাতার বুড়ি ছুঁয়ে থাকা পাশপোর্ট।  পরপারের হিসেবনিকেশ করতে লাগে।

কিছুদিন ধরে এদেশে 'ধর্ম' একটা প্রাণযাপন হয়ে উঠছে। যেন কপালের উপরে উল্কি দিয়ে আঁকা একটা কয়েদির নম্বর। অনন্ত সম্ভাবনাময় মানুষের সব পরিচয়কে ছাপিয়ে, সব সাফল্য-ব্যর্থতা, অর্জন তুচ্ছ করে ঐ নম্বরটিই তার যেন তার একমাত্র পরিচয়। একটা ভোটার কার্ড। তার অন্তিম পারানির কড়ি। শিল্প, সৃজনশীলতা, ক্ষুধা, পরিতৃপ্তি, সার্থকতা, যুদ্ধযাপন, সব কিছুই  চুলোয় ​​​​​​​যাক। ‘শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার’। 'ধর্ম' ই তখন কালান্তক যম। মানুষকে স্রেফ 'ভোটার' বানানোর যন্ত্র। মানুষের ধর্ম, মনুষ্যত্বের অন্তর্জলী, মন্দিরে মন্দিরে শুরু হয়ে যায়। যেটুকু  বিবেক বা শিল্পচেতনা এখনও বেঁচে আছে ভিতরে কোথাও, তা কীভাবে মিলবে এই বিষাক্ত অপ্রত্যয় অপচয়ে??

আমাদের দেশগাঁয়ে জনা দুয়েক লোক'কে জজেও মানে। তাঁদের একজন বলেছিলেন 'খালিপেটে ধম্মো হয় না।' আরেকজন স্বভাবসিদ্ধ চারুভাষে একটা কথা বলেছিলেন অনেকটাই একরকম। সেটা ঠিক কা'কে বলেছিলেন, তার একাধিক দাবিদারের নাম আমার মতো মূর্খের কাছেই একাধিক আছে। প্রমথ বিশী, অমিয় চক্কোত্তি বা সিতুমিঞা, যে কেউ হতে পারেন। তা কথাটা ছিলো, এঁদের মধ্যে কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, শিল্প কা'কে বলে বা মানুষের সৃজনশীলতার শিকড়টি কোথায়? এরকমই কিছু একটা হবে। কবি তখন উদাসচোখে জানালা দিয়ে একটা কুয়োতলার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রশ্নকর্তা যখন দ্বিতীয়বার জিগ্যেস করলেন তখন কবি সেই দিকে নির্দেশ করে বললেন, ঐ দ্যাখো শিল্প। তিনি বুঝতে না পেরে একটু থতোমতো। তখন কবি বললেন, দেখতে পাচ্ছো ঐ লোকটি বালতি করে জল নিয়ে যাচ্ছে। তা'তো দেখাই যাচ্ছে। তারপর ভরা বালতিটা থেকে জল যে উপচে পড়ছে সেটা দেখতে পাচ্ছো? হ্যাঁ, তাও পাচ্ছি। ঐ উপচে পড়া জলটিই সৃজনশীলতা। মানুষের সব সৃষ্টি ওখান থেকেই আসে। এযুগের 'রাজনীতি' বাজিকরদের জলপাত্র ভরা শুধু বিষ। সেটাই তাদের একমাত্র অর্জন। ক্ষমতার দখলের নির্ভুল চাবিকাঠি। নির্লজ্জ দাপটে তাদের অহমিকার গরল ছলকে পড়ে। মানুষের বেঁচে থাকার ফসলগুলি জ্বালিয়ে দেয়। 'শিল্প'? ওরে শিল্প কোথায় পাবি?

একটি মাতৃসঙ্গীত আছে। "সারাদিন মা ঘুরেফিরে, দাঁড়িয়ে জীবননদীতীরে, হিসাবনিকাশ করে শেষে, তোর চরণই সার জানিলাম।" এটা ভক্তের অনুভূতি। আমাদের মতো বহু মানুষেরই এসব নসিব হয়নি এখনও। আর হয়তো হবেও না। কিন্তু অবিকল এই ভাবটা'র সামনে এসে দাঁড়াই, যখন কবির একটা গান প্রথম থেকে শেষ, শেষ থেকে প্রথম, পড়ি, গা'ই, বিড়বিড় করি। শিল্প কী, সৃজনশীলতা কী, জীবন লইয়া কী করিব? কিছু সদর্থক দিকনির্দেশ  এক টুকরো কবিতাটি আমাদের এনে দেয়। এই যে সারা চরাচর জুড়ে এতোজন মিলে নিজেদের ধ্যানধারণা, অভিজ্ঞতা, মনন, বিশ্বাস নিয়ে নানা রকম আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে কিন্তু প্রত্যেকেই প্রত্যেকের থেকে কিছু লাভ করছেন। যাঁরা গ্রহণে ইচ্ছুক, তাঁরা সম্পন্ন হবেন। যাঁদের আত্মগরিমা অধিক, তাঁরা যদি গ্রহণে অনিচ্ছুক হ'ন, তবে বঞ্চিত হবেন। এটা শুধু আমার বিশ্বাসই নয়, প্রত্যয়ও বটে।

আমরা সবাই গানটি শুনেছি। কিছুটা সমান্তরাল পাওয়া যাবে জীবনানন্দের 'বোধ' কবিতায়।

 

তোমারি     ঝরনাতলার নির্জনে

মাটির এই   কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে॥

রবি ওই        অস্তে নামে শৈলতলে,

বলাকা       কোন্ গগনে উড়ে চলে--

আমি এই    করুণ ধারার কলকলে

নীরবে        কান পেতে রই আনমনে

তোমারি     ঝরনাতলার নির্জনে ॥

দিনে মোর   যা প্রয়োজন বেড়াই তারি খোঁজ করে,

মেটে বা      নাই মেটে তা ভাবব না আর তার তরে

সারাদিন      অনেক ঘুরে দিনের শেষে

এসেছি       সকল চাওয়ার বাহির-দেশে,

নেব আজ    অসীম ধারার তীরে এসে

প্রয়োজন     ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে

তোমারি     ঝরনাতলার নির্জনে  

আবহমান কাল ধরে মানুষের শারীর অস্তিত্ব বা জীবনকল্পকে আমাদের দেশে মাটির কলসের সঙ্গে তুলনা করা চলে আসছে। এই কলসটি নিতান্ত ভঙ্গুর, যে কোন সময়েই তার শেষ মূহূর্ত চলে আসতে  পারে। কিন্তু যতক্ষণ তা অভগ্ন  রয়েছে, তা'কে ঝরনাতলায় নিয়ে গিয়ে শুধু পরিপূর্ণ করে রাখাই শেষকথা নয়। সতত আমাদের লক্ষ্য থাকে তা যেন উপচিয়ে পড়ে। সেটাই আমাদের সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠ পাঠ। আপাতসরল শব্দমালার প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে গভীর ব্যঞ্জনা বিকীর্ণ হতে থাকে। এ ​​​​​​​কোনও বাংলাপরীক্ষা খাতায় ‘ব্যাখ্যা লিখহ’ গোছের ঘষা ইয়ার্কি নয়। শেষ চার লাইন, 'সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে, এসেছি সকল চাওয়ার বাহিরদেশে...' তুমুল ঘোরাঘুরিময় জীবন আমাদের, যেখানে আমরা  শুধু চেয়ে যাচ্ছি, দেহি, দেহি। এভাবে কোথায় পৌঁছোনো ​​​​​​​যায় দিনের শেষে? সে তো সকল চাওয়ার 'বাহিরদেশ'। আমাদের  সব বহির্মুখী পার্থিব চাওয়া সেখানেই শেষ। আর কোনও প্রয়োজন জেগে ​​​​​​​থাকে ​​​​​​​না ​​​​​​​তার ​​​​​​​পর। না ধর্ম, না জিরাফ।

অন্য কবিকে উত্যক্ত করে যায় তাঁর মুদ্রাদোষ।

 

"...সব কাজ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,

সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয় …"

এই অনুভূতির ​​​​​​​এই ​​​​​​​স্তরে আমাদের  দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়  দুটি পদের শব্দমালা,

"...নেব আজ অসীম ধারার তীরে এসে

প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে..."

প্রয়োজন ছাপানো যে ধন, তাই আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের শিল্পসত্ত্বা। একজন বলছেন 'খালি'পেটে ধম্মো হয় না। এই খালিপেট শুধু শরীরে নয়, মনেও। শরীরের পেট দুবেলা পূর্ণ হলেও 'ধম্মো' আসে না। তার জন্য মনের পেটটাও ভরে থাকা দরকার। প্রত্যেক মানুষের শেষ 'ধম্মো'ই তো সৃজনশীলতা। ‘পূর্ণপ্রাণে চাবার যাহা, রিক্ত হাতে চাসনে তারে’। মানুষ ভরে ওঠে নিজের শ্রমে, রিক্ত হয় তুচ্ছ অহমিকায়। একজন শিল্পী'র মন হাজারদুয়ারি। হাজারদিক থেকে সেখানে রোদ, জল, অক্সিজেন, ক্লোরোফিল এসে ভাসিয়ে দিয়ে যায়। তাই তাঁরা সৃষ্টি করতে পারেন। ভবিষ্যতের মানচিত্র এঁকে দিয়ে যা'ন। আমাদের মতো নিষ্ফল অহমিকার পোকা'দের জন্য রয়েছে 'ধর্মে'র সংকীর্ণ ছিদ্র। আলোহীন, মেধাহীন নরকগহ্বর। হয়তো এজন্যই আজ এদেশে বিধাতা ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নসিব করেন না।

সব জানালা খুলে দাও, আরো আলো আসুক... মৃত্যুর আগে কবি গোয়্যেথের শেষ কথা। আমরা না হয় সব শেষ হয়ে যাবার আগেই এ কথা বলা শুরু করে দিই। নিজের স্বার্থে, সবার স্বার্থে।


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

প্রসঙ্গ : তরুণ মজুমদার ৫




 

‘ভালোবাসার বাড়ি’

সেই ২০০৬-এ ‘ভালবাসার অনেক নাম’-এর এক যুগ পর, ২০১৮-য় স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে নন্দনে যাই তরুণ মজুমদারের ছবি দেখতে।

ছবি শুরুর অল্পক্ষণের মধ্যেই মনে-প্রাণে দোলা লাগিয়ে দেয় দুই বোনের গান আর নাচঃ ‘ফাগুন তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান’! কিছুক্ষণের ব্যবধানে এল ভাগ্যের প্রথম আঘাতঃ প্রৌঢ় বাবার পাটকলে কেরানীর চাকরিটি গেলো, প্লাস্টিকের দাপটে পাট এখন লুপ্ত প্রজাতির দলে। ছোটবোন সঙ্গে-সঙ্গে বলে, “তাহ’লে কাল থেকে আর ইস্কুল যাব না। মাইনের খরচটা তো বাঁচবে!” তাই শুনে বড়বোন বুলি (বল্লরী) বোনের হাতে তুলে দেয় বিজ্ঞাপনের কাগজ, যা ছোট গিয়ে দেয় পাড়ার সহৃদয় চায়ের দোকানের মালিকের হাতে, ‘এখানে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের গান  শেখানো হয়।’ এর পরেই প্রেক্ষাগৃহ মুখর করে ‘নূপুর বেজে যায় রিনি রিনি’! চোখের পাতা ভিজতে শুরু করেছে। এই জন্যেই তো তরুণবাবুর ছবি দেখতে আসা! নূপুরনিক্কণ শেষ হতেই ‘ওগো নদী আপন বেগে’। পাড়ার বখাটে ছোকরার দলও এসে জোটে, জানলা / দরজা দিয়ে উঁকি মারে, তাদের নেতা একটু চ্যাংড়ামি করে সিনেমা দেখার প্রস্তাবও টিকিটসহ জানলা দিয়ে ছুঁড়ে মারে। পরে অবশ্য বুলি এবং চা-কাকুর কঠোর শাসনে সে পাড়া ছাড়তে বাধ্য হয়!

ইতিমধ্যে বুলির অবস্থাপন্ন বান্ধবী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বুলির চাকরীর জন্যে। প্রথমে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা (সিনেমার গানের অডিশন দেবার পর লম্পট পরিচালক / প্রযোজকের কুপ্রস্তাব) হয়, তারপর ‘ভারত মাতা’ ভ্রমণ সংস্থায় কাজ। সেখানেই আমরা দেখি বুলিরই মতো হতভাগ্য কিন্তু প্রাণচঞ্চল স্বভাবকবি সহকর্মী (সে কি ১৯৮০র দশকে ‘দাদার কীর্তি’র ছন্দোবাণী ক্লাবের কেউ?), যার মানসিকভাবে  পীড়িত মা বুলির মধ্যে খুঁজে পান তাঁর প্রয়াত মেয়েকে। বুলি তাঁকে শোনায় সেই মেয়েরই গানের খাতা থেকে ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’। কানে বাজছে ‘প্রিয়তম হে জাগো জাগো জাগো’, আর ক্যামেরা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দেওয়ালে টাঙানো কবিগুরুর ছবির সামনে। তরুণবাবু, আপনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ-ধন্য, এ নিয়ে আমার সেই ‘দাদার কীর্তি’ থেকেই কোন সংশয় ছিলো না।

তরুণবাবুর ছবি আর প্রেমের পথে (তুচ্ছ) বাধা আসবে না? বুলির বাবা আর তাঁর বাল্যবন্ধু মিলে মেয়ের সম্বন্ধ করেছেন এক দাবিহীন কিন্তু উচ্চবিত্ত পরিবারে। ছেলে আবার বেশ পশ্চিমী ভাবধারার। কাজেই সে কি আর ভালো হতে পারে (মনে করুন ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘আগমন’! ব্যতিক্রম বোধহয় একমাত্র ‘আপন আমার আপন’?)? সে যাকগে, তরুণবাবুর পৃথিবীতে ছোকরা স্রেফ হাওয়ায় উড়ে যাবে (‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’)। হবে মধুরেণ সমাপয়েৎ। ‘আলো’ বা ‘নিমন্ত্রণ’-এর মত নির্মম এই ছবি নয়।

কয়েকটি কথা তরুণবাবু, গানের দিদিমণিদের কাছে কিন্তু শুধু ছোট মেয়েরাই নয়,  ছোট ছেলেরাও গান শিখতে পারতো! আর ‘বাজিল কাহার বীণা’র মাঝখানে যন্ত্রানুসঙ্গ ‘আলো’র ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ কে মনে করায় ঠিকই, কিন্তু এখানে মন ঠিক সেই ভাবে আন্দোলিত হয় না। ওটা বাদ দিলে ক্ষতি হতো না।

এত সুন্দর ইচ্ছাপূরণের গল্পে কিন্তু রূঢ় বাস্তব এসেছে – পাট-বনাম-প্লাস্টিক, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সামনে অনটনের অন্ধকার, কাজের জন্যে মেয়েদের  লাম্পট্যের মুখোমুখি হওয়া, ঘরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মাকে রেখে ছেলের চাকরী টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা, পাড়ার ছেলেদের ‘সিন্ডিকেটে’ জড়িয়ে পড়া – সবই। কিন্তু সদয় বিধাতা (এক্ষেত্রে কাহিনীকার) শেষ অবধি মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে জয়ী হতে দেননি। যে ছেলে বুলিকে সিনেমা দেখার প্রস্তাব দিয়ে পাড়া থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, সেই ফিরে আসে সদর্পে। বিনা পয়সায় বেঁধে দেয় বুলির বিয়ের প্যান্ডেল। আর বুলির পাতানো কাকা বুলির ভালোবাসা আর তার অন্তরের বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে ভেঙে দেন নিজের আনা ধনীর বাড়ির সম্বন্ধ। সবশেষে বুলি তার ক্ষুব্ধ বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে বিত্তশালীর অনুকম্পার পেছনে থাকে কতখানি অবজ্ঞা আর অসম্মান।

আমার চাকরীজীবনের প্রথম কয়েক বছর কেটেছে শ্যামাপ্রসাদ (সান্ধ্য) কলেজে। সেখানে বাংলা বিভাগের এক সহকর্মী কলেজের পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, “মাথার ওপর মহীরূহের মতো এখনো আছেন রবীন্দ্রনাথ।” নতুন করে ‘ভালোবাসার বাড়ি’ তা মনে করিয়ে দিল!

তরুণবাবু, আপনি সমালোচিত হয়েছেন এই ছবির জন্যে। কেন আপনি বদলে নিচ্ছেন না নিজেকে? কেন আপনার পৃথিবী এতটা সহজ!

বদলাবেন না আপনি। সেদিন নন্দনের ভীড় দেখে বুঝেছি আমার একার নয়, অনেকেরই আপনাকে বড্ড বেশী প্রয়োজন। প্রয়াত গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের একটি গানের লাইন তুলে বলি, আমাদের জীবন-মরুর অভিশাপে একটু সবুজ ছুঁইয়ে দিতে আর যে কেউ নেই!

কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করলাম বড় পর্দায় দেখা তরুণ মজুমদারের ছবির বর্ণনা। সাম্প্রতিক অসুস্থতার পর তিনি আরোগ্য লাভ করেছেন। কামনা করি, তিনি সুস্থ থেকে আরও ছবি করুন।

 

 


অচিন্ত্য দাস

 

(মসীচিত্র)

 

সবুজ উপবন ও রাজপথ




নিউ ইয়র্ক যে এক বিরাট মহানগর তাহা সকলেই জানে। তবে মহানগর বলিলে কম বলা হয়। একটির বদলে পাঁচটি মহা লাগাইলে উপযুক্ত হইতে পারে। কারণ এই নগরে পাঁচ-পাঁচটি বৃহৎ আকারের উপনগর রহিয়াছে – কুইনস্, ব্রঙ্কস্, ম্যানহাটন,স্টাটেন আইল্যান্ড এবং ব্রুকলিন। ব্রুকলিনের আটত্রিশ নম্বর রাস্তা হইতে ছাব্বিশ নম্বর রাস্তার দিকে চলিতে থাকিলে দক্ষিণ হস্তে পার্ক বা উদ্যান জাতীয় বিস্তৃত এক অঞ্চল নজরে পড়িবে এবং তাহার পর একটি অদ্ভুত দর্শন তোরণ দেখা যাইবে। অদ্ভুত বলিতেছি কারণ ইহার আকৃতি ও নকশা বা এককথায় যাহাকে স্থাপত্য বলা হইয়া থাকে তাহা সচরাচর চোখে পড়ে না, অন্তত আমি দেখি নাই। সাধারণ পিঙ্গল আভাযুক্ত প্রস্তরে নির্মিত প্রবেশদ্বারটিতে অতিশয় গম্ভীর ভাবের সহিত খানিক শান্ত ও সমাহিত ভাব মিশিয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ দেখিলে অবশ্য চোখ সহিয়া যায়। কিন্তু ভিতরে যে দিকে সূর্যালোক পড়ে নাই, সেদিক হইতে তোরণটি কৃষ্ণবর্ণের এবং অন্যরকম দেখাইতেছিল। মনে হইল ইহাতে কেমন যেন একটি অজানা ভয় মিশ্রিত ভাব রহিয়াছে। লেখা রহিয়াছে – ‘আফটার দ্য এন্ড’ যাহার বাংলা করিলে হইবে ‘শেষের পরে’। মনে মনে দু-একবার বলিবার পর মনে হইল ইহা অপেক্ষা ‘সমাপ্তির পরে’ ঠিক শোনাইতেছে। ওই তোরণ সোজা-বাংলায় ‘যমের দুয়ার’ ছাড়া আর কিছুই নহে। এই স্থানটির নাম গ্রীন-উড। মনে মনে বাংলা করিলাম – সবুজ উপবন। ইহা একটি সমাধি-ক্ষেত্র।   

তোরণ পার হইয়া সত্যি কথা বলিতে মুগ্ধ হইয়া যাইলাম। যেন ফ্রেমে বাঁধানো একটি সুন্দর ছবির ভিতরে প্রবেশ করিয়াছি। পিচের রাস্তা আঁকিয়া বাঁকিয়া সবুজ মাঠের মধ্য দিয়া এদিকে ওদিকে নান ভাগে বিভক্ত হইয়া চলিয়া গিয়াছে। বহু সংখ্যক বৃক্ষ রহিয়াছে – দু-একটি বৃক্ষ এখনও এই শীতের বাতাস উপেক্ষা করিয়া বহুবর্ণ পত্রের শেষ প্রদর্শনী ধরিয়া রাখিয়াছে। অধিকাংশ বৃক্ষ অবশ্য পত্রপুষ্পহীন, ডালপালা মেলিয়া বসন্তের অপেক্ষায় রহিয়াছে। স্থানটি ঠিক সমতল নহে। কোথাও ঢালু আবার কোথাও স্বল্প উচ্চতার টিলা। আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশে শতশত সমাধি-প্রস্তর প্রথিত। সমাধি ফলকও রহিয়াছে বহু। এই সবুজ উপবন অনেকখানি এলাকা লইয়া – এদিক হইতে ওদিক যাইতে বহু সময় লাগিয়া যাইবে। আশেপাশে যাহা ছিল তাহাই দেখিতে লাগিলাম। সমাধি ফলক (এপিটাফ) গুলি যেন আমাকে আকর্ষণ করিতেছিল। অবাক হইয়া দেখিলাম এইদিকের সমাধিগুলি উনবিংশ শতকের। ১৮৩০ হইতে ১৮৯০এর মধ্যে মৃত্যু হইয়াছে এমন মানুষের ফলকই বেশি রহিয়াছে। মাইকেল মধুসূদনের বিখ্যাত পংক্তি মনে পড়িল – দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল…। মনে হইল ইহারাও যেন আমাকে শব্দহীন ভাষায় ডাকিয়া বলিতেছে – দাঁড়াও পথিকবর, দূরদেশে জন্ম তব জানি, তবু তিষ্ঠ ক্ষণকাল…

একদিন ইহারা সকলে বাঁচিয়া ছিল। পাথরে তাহাদের নাম এবং কাহারো ক্ষেত্রে তাহাদের জীবনী কয়েকটি লাইনে বাঁধা রহিয়াছে। কেহ সৈন্যদলে কাজ করিত, কেহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করিয়াছে। কোনো সুখী-সংসার হইতে সন্তানসন্ততিরা তাহাদের পিতা ও মাতাকে একই স্থানে সমাধিস্থ করিয়া লিখিয়াছে ‘মৃত্যুর পরেও একসঙ্গে…’। উপবনে একটি জলাশয় দেখিলাম। স্বচ্ছ  নিবিড় জল। দু-একটি রাজহাঁস অলস ভাবে ভাসিতেছে। ইহারা কী জানে এই  জলাশয়ের চারিদিকের প্রস্তর ফলকগুলি কী কারণে নির্মিত? শুনিলাম এই উপবনের সরোবরে নাকি অনেক জলচর পাখি দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু এই  শীতের দিনে তাহারা উষ্ণতার খোঁজে দক্ষিণপানে চলিয়া যায়। জলাশয়ের তীরে অনেকগুলি সমাধি রহিয়াছে, এইগুলি নিশ্চয় ধনী ব্যক্তিদিগের কারণ সমাধিগুলি এক-একটি নিরেট কক্ষের ন্যায়। বেশি জমি লাগিয়াছে, পাথরের মূল্যও নিশ্চয় অধিক পড়িয়াছে। ইঁহারা জলাশয়ের কিনারা কেন বাছিয়া লহিয়াছেন তাহা জানা নাই। কী দেখিতেছেন? তাঁহারা কী জল ভালবাসিতেন, নাকি সরোবরে ছিপ ফেলিয়া মাছ ধরিবার নেশায় সারাবেলা জলের ধারে কাটাইতেন! এরূপ এটি সমাধি-কক্ষের সামনে দেখিলাম দুটি পাথরের কুকুর রহিয়াছে। আজ তাহারা কেহই নাই, শুধু সমাধিস্থ মানুষটির তাহাদের প্রতি ভালোবাসা এবং তাহাদের প্রভুভক্তি পাথরের অবয়বে আজও জীবন্ত রহিয়াছে। এতদিনের ব্যবধানে এই দূরদেশের পথিকের কাছে তাহা কেমন অনায়াসে পৌঁছিয়া যাইল।

পথপার্শ্বে একটি আবক্ষ মূর্তি দেখিয়া আগাইয়া যাইলাম। মহাশয়ের নাম ডি এম বেনেট। এপিটাফে লেখা রহিয়াছে যে ইনি উনিশ শতকে সামাজিক কুসংস্কার দূর করিবার কাজে লিপ্ত ছিলেন। উপরে লিখিত আছে যে এই প্রস্তর-সমাধির ব্যায়ভার বহন করিয়াছে ইঁহার সহস্রাধিক গুণমুগ্ধ শিষ্যগণ।

দেখিতে দেখিতে বেলা হইল, সাড়ে-দশটা বাজিয়া গিয়াছে। শীতের বাতাস তেমনই বহিতেছে, এই দেশের রৌদ্র তেজহীন এবং ইহাতে আমাদের দেশের শীতের রৌদ্রের মতো আরামদায়ক উষ্ণতা নাই।

একস্থানে দেখিলাম একটি পরীর মূর্তি, পাশে একটি বালিকা। কালের প্রকোপে মূর্তির মসৃণ ভাব চলিয়া গিয়াছে, তবু গড়ন ভারি চমৎকার। নিকটে যাইয়া দেখিলাম ইহা মাতা ও কন্যার সমাধি। মাতার মৃত্যু ১৮৬৭তে এবং তাহার মাত্র ছয় মাসের ভিতর তাহার বাইশ বছরের কন্যা এডিথ মারা গিয়াছিল। এই সমাধির সামনে দাঁড়াইয়া মুহূর্তে মনে হইল কোনো অদৃশ্য যন্ত্রী যেন এই হিমেল  নির্জন প্রভাতে তোড়ি রাগিনীতে আলাপ করিতেছেন। তীব্র মধ্যম – কোমল ধৈবত – শুদ্ধ নিষাদ লইয়া এমন আশ্চর্য মীড় দিতেছেন যে চরাচর জুড়িয়া অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা নামিয়া আসিতেছে। ছবি তুলিবার সময় মনে হইল সে বিষণ্ণতা ক্রমশ আমাকে ছাইয়া ফেলিতেছে।

বিষণ্ণতার ভার আর সহিল না। কালক্ষেপ না করিয়া সবুজ উপবনের  মানুষজনদের পিছনে ফেলিয়া নিকটতম দ্বার দিয়া বাহির হইয়া বড় রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। ব্যস্ত শহর। রাজপথে সোঁ সোঁ করিয়া গাড়ি, বাস, ট্রাক চলিতেছে। ফুটপাথের লোকজন কাজের তাড়ায় হনহন করিয়া হাঁটিতেছে। ফোন বাহির করিলাম এবং গুগুল ম্যাপ দেখিয়া আবাসনে ফিরিবার সংক্ষিপ্ততম পথটি ধরিলাম। পথটি বেশ অপরিষ্কার – ফুটপাথে প্লাসটিকের পাত্র, বোতল ইতস্তত পড়িয়া আছে। কাগজ, খাবারের অংশ, পিচবোর্ডের বাক্সের ভগ্নাবশেষ চোখে পড়িতেছে। কৃষ্ণাঙ্গ এক যুবক খানিক দৃষ্টিকটু ভাবে তাহার সঙ্গিনীকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়াইয়া রাস্তা পার হইয়া গেল। দুইটি হাইস্কুলের কিশোর একটি প্লাসটিকের বোতলে ফুটবলের মত কিক মারিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল ট্রাফিক বাতি অমান্য করিয়া। পাশে একটি ওয়ার্কশপ, ইহাদের পাতালরেলের কামরা সারাই করিবার স্থান। তিনটি কর্মচারী কী একটি রসিকতায় হো হো করিয়া উচ্চস্বরে হাসিয়া উঠিল। একটি ছোট কমদামী রেস্তোঁরা জাতীয় দোকান হইতে কফির গন্ধ আসিতেছে। এক নেশারু বৃদ্ধ টলমল করিয়া সে দোকানের দরজা ধড়াম করিয়া ঠেলিয়া ঢুকিয়া পড়িল।

সবুজ উপবনে যাহা দেখিলাম তাহার টাটকা স্মৃতি তখনও মনে আসা যাওয়া করিতেছে। আর ফোনের ভিতর তো ডজন খানেক আলোকচিত্র ইলেক্ট্রনিক সংকেতে সঞ্চিত থাকিবে। যখন খুশি দেখা যাইতে পারে। যাহা হউক, দেখিবার মতো একটি জায়গা দেখিলাম বটে। তবু সেই ছবির মতো সুন্দর সবুজ উপবন অপেক্ষা এই অপরিচ্ছন্ন পথ, আদব-কায়দার তোয়াক্কা না করা মানুষগুলি – আমাকে নিশ্চিতভাবে অধিক আকর্ষণ করিতেছিল। মনে মনে বুঝিতে পারিলাম জল ও অক্সিজেনের ন্যায় বাঁচিয়া থাকিবার জন্য এই আকর্ষণটুকু ভীষণ ভীষণ প্রয়োজনীয়।  


অম্লান বোস

 

ঘষা কাচের জানলা দিয়ে





আয়োজনটা শুরু হয়েছিল মাঝরাত্তির থেকেই - যখন ঝুমঝুম রাতের কোলে সবাই দুরন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কয়েক ঘন্টার জন্য নিশ্চিন্তে বিরতির রেখা টেনেছে। তখনই, অন্ধকারে সবার চোখের আড়ালে, স্তূপের ওপর স্তূপ সাজিয়ে নিজের খুশীমতই কাজলকালো আর হাল্কা ধোঁয়াটে ওড়নাতে সারা আকাশটাকেই বদলে দিল প্রকৃতি জননী। তার ফলাফল হল - ঠিক যে মুহূর্তে আমি ফুটি ফুটি ভোরের নরম আলোর সঙ্গে ছুটির অলস আমেজ গায়ে মুড়ে চায়ের পটটা নিয়ে ইউ  টিউবের রথে রবিশংকরের গুণকলির ঝালার সংগে উধাও হবার চেস্টায়, তখনই পৃথিবী ভাসিয়ে নামলো রূপোর ছুঁচ! নিমেষে আকাশ, বাতাস, গাছপালা, উল্টোদিকের দোতলা বাড়ি, আমার টবের চারাগুলোর উঁকিঝুঁকি আর বাহারী পাতার ঝিরঝিরানি, সবকিছুই ঐ পর্দার আড়ালে নিরুদ্দেশ। মহাকাশের যুগান্তের বেদনা বাঁধ ভেঙ্গে ঝরঝরিয়ে আমার চোখের সামনে দিয়ে দুরন্ত স্রোতে সামনের নালাতে ঘূর্ণীর তোড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দেখছি, দেখছি আর ভাবছি। ঐ ঘূর্ণির অতলস্পর্শী টান অদম্য আকর্ষণে কখন যে আমার মনটাকেও মনের অতলে তলিয়ে নিয়ে আছাড় মারলো কয়েকটা বছরের পর্দার পেছনে, বুঝতেই পারলাম না। নিজের অজান্তেই পৌঁছে গেলাম ৪০-৫০ বছর আগের এই আগস্টেরই কাকভোরের শিরশিরানি মুহূর্তে - ঘুমঘুম ভোরের আবছা অন্ধকারে ভবিষ্যতের জ্বলজ্বলে আশা সারি দিয়ে চোখের সামনে নাচছে। জামশেদপুর এ্যাথলেটিক ক্লাবের মাষ্টার দাদাদের উত্তেজনাময় নেতৃত্বে তেরঙ্গা ঝান্ডা নিয়ে ছায়া ছায়া  কাকডাকা ভোরে কেমন বুক ফুলিয়ে কুচকাওয়াজ! পি রোড, কিউ রোড়ের গাছের ঘেরাটোপ ধরে লাইন করে এন রোড দিয়ে গড়িয়ে নেমে, আলোছায়ার মোড়া অহংকারী খরকাই নদীর পাড় ছুঁয়ে জে এ সি ক্লাবের ফুটবল মাঠে ফিরে আসা। পতাকা উত্তোলন, জাতীয়সঙ্গীত, মুগুরখেলা, পিরামিড, দৌড়ঝাঁপ এবং ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম প্রদর্শনী, তারপর প্রধান অতিথির স্বাধীনতা সংগ্রামের কথকতা। গত তিন চার সপ্তাহ আগে থেকেই প্রচন্ড তোলপাড়, প্রথমসারিতে ঐ বিশাল তিনরঙ্গা  পতাকাটা কে ধরবে, ড্রাম আর বিউগলের দলে কারা? উফ… কী শিহরণ, কী উদ্দীপনা - মনে পড়লে এখনও বুকটা ফেঁপে ওঠে, রক্তে লাগে দোলা। আমরা স্বাধীন, দেশ নাকি স্বাধীন, মানেটা যদিও ঠিক ধরতে পারতাম না তখন, তবু বুকের অন্দরমহলে উপছে পড়া চাপটা কিন্তু ব্যাকুল করতো আমাকে। রোজ কাগজে গান্ধী, সুভাষ, জওহর, বল্লভভাই, বিধানের সাদা খদ্দরের টুপি পরা ছবি আর ভবিষ্যতের আশার বাণীর স্বর্ণালোকে ঝলমলে বক্তৃতা। তখন যেদিকে তাকাই তিনরঙের বন্যা। কাগজে, গাড়িতে, রাস্তাঘাটে, ল্যাম্পপোস্টে এমন কী সন্দেশেও দেখেছি ঐ তিনরঙের স্তর, নাম তার ‘জয়হিন্দ সন্দেশ’। ঐ ‘জয়হিন্দ’ শব্দটাতে প্রচন্ড অহঙ্কার ঝরে পড়তে দেখেছি বড়দের মধ্যে, কেউ কেউ আবার নেতাজীর ঢঙে কপালে হাত ঠেকিয়ে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে পড়তেন। জানলাম আমার দেশ, আমার মাটি, আমার ভারত কী - জয়তু ভারতবর্ষ আমার। বন্দেমাতরম, মা তুঝে সেলাম, আমি তোমায় ভালবাসি।

দেশ প্রায় পঞ্চাশ বছরের উথালপাথাল ঢেউ ভেঙ্গে এগিয়েছে অনেকটা রাস্তা, ফুলবিছানো, কাঁটাবেঁধানো পথ পার হয়ে, ঝড় ঝাপটা সামলিয়ে এগিয়ে চলেছি, কিন্তু আমরা বোধহয় বজ্রগম্ভীর বুক ফুলিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপানো সেই মন্ত্রটাই গেছি ভুলে, যে মন্ত্রের টানে একসময়ে লক্ষকোটি মানুষ একযোগে, একই লক্ষ্যের দিকে ছুটেছে - সেই বীজমন্ত্র আজ উধাও। সেরকম বীরদর্পে উদাত্ত, জলদগম্ভীর আত্মবিশ্বাসে অটল কন্ঠস্বরের আহ্বানই বা কোথায়? কোথায় গেল আবছা ভোরের শঙ্খধ্বনি আর ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা’, ‘হও ধরমেতে ধীর’, ‘চল কোদাল চালাই’, ‘ধনধান্যে পুস্পে ভরা’ গানের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার?

কার ছায়া আমায় ছুঁয়ে যে যায়

কাঁপে হৃদয় তাই রে,

গুণগুণিয়ে গাই রে…

কথাগুলো মনে পড়ার কারণ - গত সোমবারেই ছিল ১৭ই অগাস্ট, প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র সুকর্ণ, পঞ্চশীলের ইন্দোনেশীয়ার স্বাধীনতা দিন। কাজের আর  পদমর্যাদার খাতিরে এদেশীয়দের সঙ্গে একযোগে সামিল হয়েছিলাম উৎসবে, তাই আরও কাছের থেকে দেখলাম দেশকে শ্রদ্ধা জানাবার প্রণালী। এতবছর পরেও জাতীয় দূরদর্শনে মাসের প্রথম থেকেই লাল সাদার (পতাকার রং) প্রবল আবির্ভাব, প্রতিটি গাড়ির ভেতরে বা বাইরে ছোট ছোট পতাকা, সাতদিন আগে থেকেই কাজের মেয়ে আর নিশিরক্ষীদের বাড়ি বাড়ি বেন্ডারা (পতাকা) তোলার মুখর তাগিদ - হোক না সে বিদেশী রাস্তাঘাটে, আকাশছোঁয়া উদ্ধত অফিসবাড়ির মাথায়, ওভারব্রিজ আর টোলরোডের ধারে ধারে, হোটেল, দোকান, রেস্টুরেন্টে, ক্লাবে, স্কুল কলেজে ঐ লাল সাদা আর ‘দীর্ঘায়ূ’র প্লাবন (হ্যাঁ বাহাসা ইন্দোনেশীয়াতে একই মানে - দীর্ঘায়ূ)। চাঞ্চল্য পাড়ায় পাড়ায়, ওদের সমাজ  উন্নয়ণের দপ্তরগুলোতেও। আমাদের পাড়ায় সেদিন আবার সরকারী নিদানে ৫০০টা চাল নুন তেলের প্যাকেট সুন্দরভাবে গোছা বেঁধে বিলি করা হল, আশেপাশের গ্রামবাসীদের সঙ্গে খেলাধূলো, পুরস্কারের ট্রফি, মসজিদের ফান্ডে যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য করা - সবই চললো নিয়মমত, কোথাও উৎসাহের ভাঁটা বা অশান্তির ছিটেফোঁটাও দেখলাম নাশ। পতাকা তোলার ব্যাপারটাও রাজসিক। যেভাবে একজন অমাত্য প্রোক্লেমেশানটা পড়ে পঞ্চশীলের নীতি ঘোষণা করে বা তিনজন সৈনিক পা মিলিয়ে এসে নীতিগত শৃঙ্খলার সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে আলগোছে পতাকা নিয়ে আসে, সেটা চোখজুডানো দৃশ্য। পতাকা তোলার সময় সমবেত প্রতিটি মানুষের ডানহাত যেভাবে অনিবার্য আবেগে কপালে ঠেকানো থাকে ঋজু শরীরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এতে ছেলেবেলা থেকেই ঐ ধীরে ধীরে আকাশ  ফুঁড়ে উঠতে থাকা দুরঙা ঝান্ডাটিকে মাথায় করে রাখার শিক্ষার প্রবৃত্তি আপনা থেকেই রক্তের মধ্য মিশে যায়। যাঁরা আমার থেকে বেশী জানেন বা বোঝেন, তাঁরা এই ব্যাখ্যাটা অবশ্য সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলিত নিয়মানুবর্তিতার চাপের সঙ্গেই জড়াবেন জানি। দেখলাম এই ৫৩ বছরের উত্থান পতনেও এই দেশাত্মবোধে ভাঁটা পড়েনি একটুও। বরং গত বছরের চরম অর্থনৈতিক অধ:পতনে আর অন্ধকার রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্হিতির ঘূর্ণিঝড়েও অটুট আছে। বাইরের কৃত্রিম চাপে সেটা কি এত দীর্ঘস্হায়ী হওয়া সম্ভব?

নেতাদের জন্যেই হোক বা নিজেদের বিভ্রান্তমনের তাগিদেই হো, আমরা এদের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক দুদিন আগে আমাদের রক্তস্রোতে অর্জিত স্মরণীয় দিনটাকে আবেগ দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে বোধহয় ভুলে গেছি। আমাদের কচিকাঁচাগুলোকে হয়তো আমরা মা-বাবা, কাকা, জ্যেঠা, মামারা আবার  একমুখো করে তুলতে পারি। যখন সুমাত্রার মেডান শহরে ভারতীয় দূতাবাসে প্রথমবার আমাদের প্রাণের রঙ তিনটিকে অন্যদেশের আকাশে সগর্বে তরঙ্গায়িত হতে দেখেছিলাম, সেই মুহূর্তে আমার বুকে সুনামির অসহ্য চাপটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু চোখ ফাটিয়ে বাষ্প হয়ে বেরিয়ে এসেছিল - হয়তো সেই সুদূর ছোটবেলার চাপা স্রোতটাই উত্তাল, উদ্দাম হয়ে উঠেছিল তখন। এখন কম্পিউটার, ইন্স্টাগ্রাম আর মঙ্গলগ্রহ বিজয়ের যুগের কঠিন আবর্তের আবেস্টনীতে দেশের মাটি বা পতাকা নিয়ে একটু ভাবাবেগ অনুপ্রাণিত করতে পারলে জোয়ারটা ছোটদের মধ্যে ভবিষ্যতে ফুলে ফেঁপে উঠবেই। আমরা তো বৈদ্যুতিন মিডিয়ামের খুবই ভক্ত। এই হাতে পাওয়া সহজ পথটা বেয়ে জাকার্তার আমরা ক’জন কি একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি বিশ্ব জোড়া ভারতীয় প্রাণগুলিকে একটা সূতোয় বাঁধতে? ‘জয়হিন্দ’ বজ্রধ্বনি দিয়েই শেষ করা যাক না প্রত্যেকটি ই-মেইল, মেসেজ বা নিজস্ব মেসেঞ্জারের বয়ান। পারব না আমরা  সেই বিস্মৃত যৌবনের বন্যাটা বিজ্ঞানের ছাঁচে ফেলে সারা পৃথিবীর ঈর্ষাভরা শ্রদ্ধা আদায় করতে? জাকার্তা থেকেই শুরু হোক না মালা গাঁথার কাজটা!

আমাদের সব চাহিদা আর আবদার তো মায়ের কাছেই। সেই সিংহবাহিনী মা’ই তো আবার এসে গেলেন শরত আলোর সোনার পথে, শিউলী ঝরা গন্ধ বেয়ে আমাদের জীবন আলোয় ভরাতে। মা’কেই বলি আমাদের পথ দেখাতে। দূরে, বহুদূরে যে জ্বলজ্বলে ভবিষ্যতটা ঝলসাচ্ছে, ওটা তো স্হির, নিষ্কম্প অনড় - আমরাই শুধু দোলাচলে অস্হির। আমাদের জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ঐ নিষ্কম্প শিখ। দরকার শুধু দুশো কোটি হাত আর একশো কোটি হৃদয়কে এক  ধাতুতে গালিয়ে নিয়ে এক উদগ্র কামনার বারুদের আত্মপ্রকাশ, এবং অবশ্যই  ‘হম হোঙ্গে কামিয়াব’!  

 

 

 

 


মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ৪




আমি যে শহরে থাকি তার নাম প্লিমাউথ (Plymouth)। বস্টন শহর থেকে  চল্লিশ মাইল দক্ষিণে। বন্ধু বান্ধবের বাড়ি যেতে গেলে প্রায় ঘন্টাখানেক গাড়ি চালাতে হয়। বন্ধুরা বলে আমার বাড়ি আসতে গেলে নাকি তাদের ভিসা করাতে হয়। অতলান্তিকের ধার ঘেঁষে বস্টনের এতটা দক্ষিণে বাড়ি কেনার কারণ হল আমার কর্মস্থল আরও দক্ষিণে। অতলান্তিক আর কেপ কড ক্যানালের মোড়ের মাথায় আমার কলেজ। আমার আপিস ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে কেবল নীল আর নীল। কোথায় যে সাগর গিয়ে আকাশে মিশেছে তা ঠাহর করা মুশকিল। বলাই বাহুল্য...

আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন

আজ ঐ চোখে সাগরের নীল

আমি তাই কি কাজ পাই কি

বুঝি এইবার চাকরি অমিল!

তা প্লিমাউথ থেকে বস্টন যে শুধু ভিসা করিয়ে গাড়ি চেপে যাওয়া যায় তা নয়, ট্রেনের ব্যবস্থাও আছে। সেটির নাম কমিউটার রেল। শহরতলীর সঙ্গে বস্টনের যোগাযোগ করার সরকারি ব্যবস্থা। ঋজু যখন হাইস্কুলে পড়ত তখন কাকভোরে উঠে দুটো ট্রেন বদল করে বস্টনে ইস্কুলে যেত। যেহেতু আমার রওনা হবার দিন ছিল একটা বৃহস্পতিবার, তাই ঠিক হলো যে পামেলা আমাকে মিটিংয়ের ফাঁকে লটবহর সমেত,  প্লিমাউথ কমিউটার রেল স্টেশনে নামিয়ে দেবে আর আমি সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু করবো।

এইবারের যাত্রায় লটবহর ব্যাপারটা খুব হিসেবে কষে গোছাতে হল। একটা ছোট চাকাওয়ালা সুটকেস যেটা বেলের পানার মতো হড়হড়িয়ে গড়াবে। তার ভেতরে রয়েছে জিনস, শার্ট, জ্যাকেট, কয়েকটা বেয়াইবাড়ি স্পেশাল সালোয়ার কামিজ, প্রসাধনী টুকিটাকি, কুটুমবাড়ির উপহার সামগ্রী ইত্যাদি প্রভৃতি। পিঠে একটা ব্যাকপ্যাকে রয়েছে পাখি দেখার দূরবীন, জলের বোতল, ইলেকট্রিক কেটলি, চা পাতা, বিস্কুট, ফ্লাস্ক মগ, ফার্স্ট এড বাক্স। আর কাঁধে ক্রস করে ঝোলানো ছোট বটুয়ায় রয়েছে টাকা, ক্রেডিট কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বাড়ির চাবি, লিপস্টিক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর বঙ্গ জীবনের অঙ্গ, এক টিউব সুরভিত এন্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলীন। এমনভাবে জিনিসপত্র বাঁধা ছাঁদা হলো যাতে আমি একাই তিব্বতি শেরপাদের মতো মালপত্র নিয়ে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারি। পামেলা কম্যুটার রেলে  তুলতে এসে আমাকে টিকিটের খুচরো ধার দিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, “খুব আনন্দ করে ঘুরে এস Banz। তবে কোথাও যদি একটুও বেগরবাই  দেখো তাহলে সোজা প্লেন ধরে ফিরে এস। তোমার ওই First girl syndrome  বিপদে পড়লে  একটু ভুলে যেও!”

“কোনো চিন্তা করিস না রে। আমার সঙ্গে মাথায় ছাতা ধরে থাকেন ছত্রধর। তুই কলকাতার আরো বড় বিপদ ঠিকঠাক সামলে আয়। গরমের ছুটির শেষে আবার দেখা হবে”।

পামেলা হাসতে চেষ্টা করল বটে, কিন্তু ওর চোখে ছায়া ফেলেছে চিন্তার মেঘ।

কম্যুটার রেলের জানালা দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে শহরের পর শহর। ওঠানামা  করছে মানুষজন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম যে এদের ভেতর কেউই হয়তো প্রশান্ত মহাসাগরে তীরে যাবে বলে আজ বাড়ি থেকে বেরোয়ন! বস্টনের সাউথ স্টেশনে যখন নামলাম তখনও লেক-শোর লিমিটেড ছাড়তে ঘন্টাখানেক দেরি। কয়েকটা খাবার দোকান খোলা রয়েছে। অতিমারীর প্রকোপে সাউথ স্টেশন অনেকটাই ম্রিয়মান। ভেবেছিলাম হালকা স্যান্ডউইচ গোছের কিছু প্যাক করে সঙ্গে নেবো। ট্রেন সিরাকিউস পৌঁছবে রাত পৌনে দশটা নাগাদ। কিন্তু একটা পাকিস্তানী দোকানে চিকেন বাটার মশালা আর জিরা রাইস দেখে মন্দ মেয়ে হতেই হলো! দেখলাম দোকানি যত্ন করে তার সঙ্গে একটু শশা টমেটোর স্যালাড দিয়ে দিলেন। এছাড়া চায়ের সঙ্গে খাবার মতো নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট  সঙ্গে নিয়ে নিলাম। বেয়াই বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে অত  রাতে পৌঁছে আর কিছু খাবো না। তাই বেশ একটা পেটচুক্তি খাবার ব্যাবস্থা করে উঠে পড়লাম লেক-শোর লিমিটেডে। যাত্রা হলো শুরু।

ট্রেনের কামরায় উঠে দেখলাম যে ট্রেন প্রায় ফাঁকা। সাউথ স্টেশন থেকেই ট্রেন ছাড়ে বলে এই সুবিধেটা রয়েছে। পরের স্টেশনগুলি থেকে প্রচুর মানুষ উঠবে। কন্ডাক্টার ভদ্রমহিলা জানালেন যে আমি এই বগিতে যে কোনো সিটে বসতে পারি। আমার ধর্মসঙ্কট শুরু হলো। হড়হড় গড়ানো সুটকেস, ব্যাকপ্যাক, বটুয়া, চিকেন বাটার মশালা, জিরা রাইস, নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট নিয়ে আমি ফাঁকা বগির বিভিন্ন জানালার ধারের সিটে বসে বুঝতে চেষ্টা করলাম যে কোন সিটে বসলে বাইরেটা সবচেয়ে ভালো দেখা যাবে। মিনিট সাতেক পরে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বগির একেবারে সামনে, ডানদিকের জানালার ধারের সিট বাছাই হলো। এই সিটের সব ভালো... লম্বা করে পা মেলে বসা যায়, পাশের জানালাটি সবচেয়ে প্রশস্ত, সামনের সিটে কোনো প্রেমিকযুগল সারাক্ষণ চুমু খাবে না বা ঝগড়া করবে না, কোনো বেয়াদব ছানা বিকট ব্যবহার করে পার পেয়ে যাবে না ... কিন্তু অসুবিধে একটাই। এই সিটের সামনে বা পাশে কোনো টেবিল নেই। তাই চুমু, ঝগড়া বা বিকট বেয়াদবির থেকে রেহাই পেলেও  চিকেন বাটার মশালা, জিরা রাইস খাবার এটি উপযুক্ত স্থান নয়। চা, নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট খাবার জন্য তো নয়ই!

ট্রেন চলেছে শহরের পর শহর ছাড়িয়ে। ফ্রামিংহাম, স্প্রিংফিল্ড, পিটসফিল্ড, হান্টিংটন... নতুন নতুন যাত্রী উঠছে আমার বগিতে। তাদের চুমু, ঝগড়া, বেয়াদব ছানারা রয়েছে অন্তরালে।  আমার চোখে কেবল ট্রেনের জানলা পেরিয়ে পাল্টে যাওয়া শহর এবং শহরতলি... আমার মননে সেই একা যাওয়া...

 

যাদের যাওয়ার কথা হয়েছিল,

তারা কেউ একবাক্যে বলেনি,

‘যেতে পারি’।

 

তাদের সকলেরই কেমন যেন,

কেমন যেন দোনামোনা ভাব।

শেষপর্যন্ত জানা গেল,

একজন ছাড়া কেউই যায়নি।

 

যে গিয়েছিল,

সে কেন গিয়েছিল?

সেটাও ভাল বোঝা যাচ্ছে না,

তার বাজার করা আছে, রেশন তোলা আছে,

সপ্তাহে দুদিন গানের ইস্কুল আছে।

কখনও কখনও তার অম্বলের কষ্ট হয়।

 

এখন শোনা যাচ্ছে, সে আর ফিরবে না।

গানের ইস্কুলে এর মধ্যে তার নাম কাটা গেছে,

সাবেকি সংসারের হেঁশেলে দুবেলা দুমুঠো অন্ন বাঁচছে।

সে যে একদিন ছিল,

সে যে একদিন সব কিছুর মধ্যে ছিল

সে কথা দুদিন পরে কেউ খেয়াল রাখবে না।

এবং সেই জন্যেই বোধহয়।

সে গিয়েছিল, সে একাই গিয়েছিল।'

আমি আমার মালপত্র গুছিয়ে রেখেছি মাথার ওপরের তাকে। পায়ের কাছে একটা ঠোঙার থেকে হাতছানি দিচ্ছে গরম গরম চিকেন বাটার মশালা, জিরা রাইস  আর শশা টমেটোর স্যালাড। নাঃ, আর বিলম্ব নয়... আর বিলম্ব না, না... আর বিলম্ব নয়! সমস্ত বগিতে বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, পিজা এবং কোল্ড কাট  স্যান্ডউইচকে কাঁচকলা দেখিয়ে ভেসে বেড়াতে লাগলো চিকেন বাটার মশালা আর জিরা রাইসের স্বপ্নালু আলিঙ্গন। আমি খুব সন্তর্পণে কোলের ওপরে কাগজের ন্যাপকিন পেতে, আমার হালকা রঙের জামা আর কালো জিনসের  প্যান্টকে বাটার মশালা মুক্ত রেখে প্লাস্টিকের চামচে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম।

ট্রেন চলেছে আলবানি, শেনেকটাডি হয়ে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ে, মাঝে মাঝে মেঘ সরে রোদ ওঠে। ঝর্ণার জলের পাশে বসে থাকে ধৈর্য্যশীল বক। সন্ধ্যে নামে অচেনা প্রান্তরে। প্রাণটা এই সময় চা- চা করছিলো। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে  চিকেন বাটার মশালা আর  জিরা রাইস হজম হয়ে গ্যাছে অনেকক্ষণ হল।  ঠোঙার ভেতরে নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট হাতছানি দিচ্ছে। ভাবলাম পাশের ক্যাফে কার থেকে এক কাপ চা কেনা যাক। ক্যাফেতে চা কফি বিক্রি করছেন একজন হাসিখুশি বয়স্কা  মহিলা। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন

‘What can I do for you sweetheart?’

‘Could I please have a small black hot tea?’

একটি বাক্যেই  সাইজ, চায়ের প্রকৃতি ও উষ্ণতার আভাস দেওয়া গেল। উনি একটা মোটা সহিষ্ণু কাগজের  ঢাকনা দেওয়া কাপে ফুটন্ত জলে একটা টি ব্যাগ চুবিয়ে দাম বুঝে নিলেন। আমি ওনার কাছে আর একটা ছোট কাপে একটু দুধ চাইলাম আর এক প্যাকেট চিনি আর একটা ছোট প্লাস্টিকের চামচ। ওনার কাউন্টারে অন্য খরিদ্দারের ভিড়। তাই ওখানে আর না দাঁড়িয়ে গরম চায়ের কাপ, দুধের ছোট কাপ, চামচ আর চিনি হাতে চলন্ত ট্রেনে লটর পটর করতে করতে সিটের দিকে এগোতে এগোতে মনে পড়ল যে আমার পছন্দ করা চুমু-ঝগড়া-বেয়াদবি বিহীন আসনে কোনো টেবিল নেই! যাইহোক... বাবা রামদেবের মত কসরত করে চায়ের সামগ্রী কোলে করে বসলাম। দুটি পায়ের ফাঁকে ব্যালেন্স করে গরম চায়ের কাপের ঢাকনা খুলে সেটি ডান উরুর ওপরে রেখে, খুব অল্প দুধ ঢেলে, যেই না চিনির কাগজের প্যাকেট ছিঁড়ে চিনি ঢালতে যাবো, অমনি ট্রেনটা একটা বেমক্কা বাঁক নিলো আর আমার small black hot tea বিকট বেয়াদবের মতো আমার হাতে, পেটে এবং জানুতে ছলকে পড়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি ঘটনা ঘটালো। মোটা জিনসের আবরণীতে নিম্নাঙ্গ খানিকটা রক্ষা পেলেও দুটো হাতে ফুটন্ত চা যার একবার পড়েছে সে জানে তার বিষজ্বালা। আমি কোনো শব্দ না করে চায়ের কাপটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সঙ্গে যত ন্যাপকিন ছিল তাই দিয়ে হাত, জামা, প্যান্ট মুছলাম। যন্ত্রণায় মুখচোখ দিয়ে হলকা বেরোচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। হাত দুটো খুব জ্বলছিল। প্রথমেই মনে হলো যে হাতে ফোস্কা পড়ে গেলে অতটা পথ সেই Nissan Rogue SUV চালাবো-টা কি করে? ঝটপট বটুয়া খুলে বের করলাম সেই বঙ্গ জীবনের অঙ্গ,  এক টিউব সুরভিত এন্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলীন। খুব মোটা করে দুই হাতে লাগাতেই ধীরে ধীরে জ্বালাটা কমতে লাগলো। ধন্বন্তরী আর বলেছে কাকে!

খানিক বাদে মেঝে থেকে সেই বেয়াদব চায়ের কাপটি তুলে নিয়ে ভাবুক ভাবুক মুখ করে নোনতা প্যাটিস আর মিষ্টি টার্ট সহযোগে চা খেয়ে ফেললাম। ব্যাস। রাতের খাওয়া শেষ! রাত পৌনে দশটা নাগাদ ট্রেন ঢুকলো সিরাকিউস স্টেশনে। জিনিসপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমেই দেখি ঋজু। তৃষ্ণার শান্তি... কতদিন বাদে... কতদিন বাদে দেখা হল! ঋজু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমার জিনিসপত্রগুলো নিল, জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো মা?” “ভালো আছি রে... খুউউব ভালো”।

আমার বেয়াই কার পার্কে অপেক্ষা করছে। আমি আর ঋজু গাড়ির কাছে গেলাম। আমার হালকা রঙের জামায় আর কালো প্যান্টে ছোপ ছোপ small black hot teaয়ের স্মৃতি... দুহাতে খাবলা খাবলা সুরভিত এন্টিসেপ্টিক ক্রিম... একগাল হেসে শুধোলাম, “Hello Vikram, How are you?”

 

(ক্রমশ)