কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

অঞ্জন আচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


যে গল্পের শেষ আছে


দিন শেষে প্রতিদিনের মতো আজও বসল সে মুখোমুখি। ছেলেটি বলতে শুরু করে—জানো, আজকের ঘটনাটি একটু অন্যরকম। ঘটনা, আমাদের এই আন্দুল স্টেশনেই। তখন রাত সোয়া আটটা বাজে হয়তো। কিছুক্ষণ আগেই পাঁশকুড়া লোকালটি পার হয়ে গেল বগিতে শব্দ ভর্তি করে। শান্ত প্ল্যাটফর্মে আমাদের সঙ্গে নামল এক সাধারণ তরুণ। ট্রেন থেকে নেমে কোণের কাঠের বেঞ্চটিতে গিয়ে বসে। ভাবলেশহীন ভঙ্গি। এদিক-ওদিক তাকায়। কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই চোখে। হয়তো কেউ নিতে আসতে পারে। ঠিক মিনিট পাঁচেক পর এক তরুণী আসে। এসে, ছেলেটির পাশে গিয়ে বসে। পাশের বেঞ্চে আমি বসা। ইদানীং হাওড়া থেকে আসার পর ওই সময়টায় বেশ ক্লান্ত লাগে, সে তো তুমি জানোই। তাই চুপচাপ বসে থাকি একা। ভালো লাগে। একসময় দেখি, ছেলেটি তার দুই কনুই ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর রেখে মুখ চাপা দেয়। শরীর কাঁপতে থাকে। গোঙানোর শব্দ আসে কানে। হঠাৎ এমন দৃশ্য পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত হই বৈকি! পাশে থাকা মেয়েটি বিব্রত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামলে নিতে চায়। দূরে বসে দেখে যাই সব। প্ল্যাটফর্মে থাকা কয়েকজন ফিসফাস শুরু করে— ‘শিওর, লাভ কেইস।’

আমরা ছেলেটিকে কাঁদতে দেখলাম। একটা শক্তসমর্থ ছেলে কী করে হু হু করে কাঁদে, তা দেখলাম বাক্যহীন চোখে। ছেলেটির সঙ্গে থাকা মেয়েটি আমার মুখচেনা। আমরা ডেইলি প্যাসেঞ্জার। কোনোদিন কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। হঠাৎ আমাকে ডেকে সহযোগিতা চাইলেন। বললেন, ‘দাদা, একটু শুনবেন প্লিজ?’

পুরো ঘটনাটি মেয়েটির মুখে শুনলাম— ‘ওর নাম পার্থিব বণিক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে পড়ি, বাংলায়। যার সঙ্গে ওর এত দিনের প্রেম ছিল, আজ তার বিয়ে।’

আমি কোনো কথা বলি না। চুপ করে শুনে যাই।

—সম্পূর্ণাও আমাদের ক্লাসমেট। আমরা কেউই এই গোপন ভাঙনের খবর জানতাম না। বরং তাদের বিয়ের দিন গুনছিলাম। দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে, আমরা তত বেশি রসিকতামুখর হয়ে উঠতে থাকি। যেন আমাদের বন্ধুমহলে আলোচনার আর কোনো বিষয়ই নেই।

আমি নিশ্চুপ শ্রোতা, মুখে কুলুপ আঁটা।

—দুপুরে হুট করে পার্থিবের কল পেলাম। জানালো, আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমাকে দেখেই হঠাৎ এ পরিস্থিতি! যখন তাকে কাঁদতে দেখি, তখন বেশ খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়ি। ভাবি, কোনো নিকট আত্মীয় বিয়োগ হলো কি না? হ্যাঁ, বিয়োগ তো বটেই, আত্মীয়ও।

একটা লম্বা শ্বাসের মধ্য দিয়ে কথাটা শেষ হয়।

জানো, মেয়েটির বন্ধু সম্পর্কে এসব কথা শুনে আমার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। হয়তো ভাবছ, এত প্রাণহীন আমি কবে থেকে হলাম? তবে মেয়েটির কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গল্পটি তোমাকে শোনাব বলে মন কেমন করছিল। আচ্ছা, মানুষ কেন কাঁদে? তার হয়তো অনেক বিশ্লেষণ থাকতে পারে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও হয়তো আছে। আমরা কেউই সেসব কারণ খুঁজতে যাই না। মোটাদাগে বলতে গেলে, প্ল্যাটফর্মের ছেলেটিকে কাঁদতে দেখে উপরে উপরে সমব্যথী হই। তাকে শক্ত হতে বলি। আর যতবারই শক্ত হওয়ার কথা ওঠে, ততবারই ভেঙে ভেঙে যেতে থাকে ছেলেটি। সমাজের ট্যাবু জানো তো, ছেলেদের এভাবে প্রকাশ্যে কাঁদতে নেই। তাই কান্না থামাতেই হোক, আর ট্যাবুর কারণেই হোক, আমাদের মধ্যে একজন প্রেমিকাটির সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করি। ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করি। ছেলেটি তার প্রেমিকার মোবাইল নম্বরটি আমাকে দেয়। কল করা হয়। অপর পাশে তখন বিয়ের হই-হুল্লোড়। সেই শব্দের ভিড়েই প্রেমিকাটি কথা বলে যায়। মিনিট দশেকের মতো কথা চলে স্বপ্ন ও বাস্তবতা নিয়ে।

 —তারপর?

—জানো, ছেলেটির বিরুদ্ধে মেয়েটির অভিযোগের অন্ত নেই! ছেলেটির কী কী গুণ বা বৈশিষ্ট্য নেই, কেন তার সঙ্গে বাকিটা জীবন পার করা আদৌ সম্ভব নয়, তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে গেল তার সাবেক প্রেমিকাটি। বুঝলাম, যেন একরকম হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে মেয়েটি। অনুভব করলাম, ঘটনার শুরু একদিনে ঘটেনি, একদিনে ঘটেও না। যে তার ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যের সামনে ছোট করে, অপমানিত করে, বুঝতে হবে শ্রদ্ধার সুতোটি ছিঁড়ে গেছে কবেই। যে ঘুড়িটি আপাতচোখে উড়ছে, ওটা আসলে ভোকাট্টা; ঘৃণার বাতাসে দোল খাচ্ছে।

 —তারপর কী হলো?

—সম্পর্ক তো আর রূপকথার শেষ লাইন নয়! এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ছোট-বড়-মাঝারি নানা আকারের স্বপ্ন। ওই স্বপ্নগুলো দেখা হয় যৌথ প্রযোজনায়। আর এর মধ্যে একজন সেই প্রত্যক্ষ প্রতিবিম্ব থেকে সরে গেলে, পুরো আয়নাটাই যে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।

 —তারপর?

—এ কথা তো মানবে, কেউ যখন ‘নাই’ দিয়ে কাউকে বিচার করতে শুরু করে, ধরে নিতে হবে সেই সম্পর্কের অবশিষ্ট বলে কিছু নেই। কে না জানে, গ্রহণ করতে হয় ‘আছে’ দিয়ে; ‘নাই’ তো অসীম।

 —তারপর কী হলো?

—তুমি জানো না, আজ বলি। আমি এমন একজনকে জীবনে দেখেছি, যে ভালোবাসতে বাসতে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গিনীটি যখন তাকে ছেড়ে যায়, সে মরতে বসেছিল। বসে বসে কেবল ভাবতো, কী করে মরলে কষ্ট একটু কম অনুভব হবে। অথচ তার বন্ধু-পরিজন, আত্মীয়স্বজন সবাই ছিল। হয়তো, তাদের গুরুত্ব ছিল তার কাছে লঘু। খুব কাছ থেকে দেখেছি— কীভাবে একজন মানুষ হাজারো মানুষের ভিড়ে একাকী হয়ে যায়, বাঁচার জন্য একটিমাত্র অবলম্বনে ব্যক্তিগত হয়ে বাঁচে।

 —তারপর?

—সে-ই ভালো বলতে পারে যে যাপন করেছে এমন জীবন। হয়তো সে কারণেই, সমষ্টিতে থেকেও যখন সে কেবল ব্যক্তিগত হয়ে যায়, তখন নিজেকে বড় পরাজিত ভাবতে থাকে। কিন্তু আমরা তখন উপলব্ধি করতে পারি না, কিংবা অনুভব করতে চাইও না— সময় হচ্ছে জগতের সবচেয়ে বড় উপশমকারী মলম; শেষ অবধি পাশে থাকা বন্ধু।

 —তারপর কী হলো?

—আজ যে ছেলেটিকে কাঁদতে দেখলাম, এমন করে হয়তো অগণিত ছেলেমেয়ে কেঁদেছে কিংবা কাঁদবে, প্রকাশ্যে নয়তো নীরবে। হয়তো আজকের মতো তার সঙ্গীটিও তাকে ছেড়ে গেছে নয়তো যাবে ‘নাই’-এর সংজ্ঞা দিয়ে। মানুষমাত্রই স্বপ্ন হারানোর বেদনায় কাতর এক অসহায় প্রাণী। চোখের সামনে তিলতিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নকে যখন সে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে দেখে, তখন সে-ও তার সঙ্গে ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে।

 —তারপর?

—তখন সে স্বপ্ন হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। কেউ কেউ সঙ্গীকে আঘাত করে, না-হয় নিজেকে হত্যা করে। আমি মনে করি, এমন ঘটনায় আত্মহত্যার পেছনেও কাজ করে সেই আঘাত দেওয়ার অভিপ্রায়। ভালোবাসার মানুষটির এতটুকু কষ্ট কোনো দিনই হতে দেব না ভেবে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল একদিন, তা যেন কথার কর্পূর হয়ে উবে যায় কোথায়।

 —তারপর কী হলো?

—এতকাল এত এত সব ভাঙন দেখতে দেখতে শিখে গেছি, যে অট্টালিকা গড়ে ওঠে যত দ্রুত, ভাঙনের শঙ্কা তার তত আসন্ন। তারপরেও কথা থাকে; কিছু কথা তো থাকেই। যে যাবার সে যাবেই, নানা অজুহাত দেখিয়ে সে যাবে। যে থাকার সে থাকেই, নানা অজুহাতে সে থাকে। যেমন করে তুমি গেছো, যেমন করে নীলিমা আমার সংসার জুড়ে আছে।

কলিংবেলের শব্দে সংবিত ফিরে পায় দীপেন। বিলুকে নিয়ে নিশ্চয়ই প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে ফিরেছে নীলিমা। মানিব্যাগের ভাঁজে রাখা অনুসূয়ার পাসপোর্ট সাইজ ছবিটি দ্রুত লুকিয়ে ফেলে সে। দরজা খুলতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় দীপেন।

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন