কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

অভিজিৎ মিত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


কুকুর, ছাগল আর মুরগিগুলোর পৌষাড়ে গল্প

 

এবার থেকে প্রতি বৃহস্পতি আর রবি সমস্ত দোকান বাজার বন্ধ থাকবে। বাকী দিনগুলো বেলা বারোটা অব্ধি খোলা। প্রশাসনের নতুন নির্দেশ। এর আগের যে নির্দেশ ছিল, সপ্তায় তিনদিন রাস্তার বামদিকের দোকান বন্ধ আর অন্য তিনদিন ডানদিকের দোকান বন্ধ, সেই নিয়ে প্রচুর হৈ-চৈ। সভা, সমাবেশ, ধর্না, বিক্ষোভ। কারণ এবছর আর কেউ বাম নেই, সবাই বলছে ডান হয়ে গেছে। সবাই রাস্তার  ডানদিকে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে আর ‘ওয়েল ডান ওয়েল ডান’ বলে হাততালি দিচ্ছে। এতে করোনা তো আটকবেই না, উল্টে আরো বেড়ে যাবে – এটা প্রশাসন বিলক্ষণ বুঝেছিল। তাই নির্দেশ বদল। কিন্তু এই নতুন নির্দেশে প্রশাসন আরো  কয়েকটা শর্ত চালাকি করে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যেটা সাধারণ মানুষ এখনো বুঝতে পারেনি। প্রথমত, প্রতি বৃহস্পতি আর রবি শহরের প্রতি রাস্তায়, প্রতি গলিতে ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। রাস্তায় একমাত্র পুলিশ অথবা বিশ্বস্ত কুকুর ঘুরবে। ইচ্ছে হলে গান গাইবে। দ্বিতীয়ত, ঐদিন ভোরবেলা সমস্ত মাছওয়ালা, মুরগিওয়ালা আর ছাগলওয়ালাদের ডেকে পাঠিয়ে পুলিশ মেপে দেখবে যে কারো দোকানে যদি কোন মাছের ওজন ১ কিলোর কম, মুরগির ওজন ২ কিলোর কম আর ছাগলের ওজন ৫ কিলোর কম হয়, সেগুলো রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হবে। ওপরের মহল থেকে স্পষ্ট নির্দেশিকা আছে, নধর মুরগি, নধর ছাগল আর গভীর জলের পাকামাছ ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ব্যবসা করা যাবে না। তৃতীয়ত, কেউ যদি ফাঁদ পেতে ঐসব চরে বেড়ানো ছাগল-মুরগি ধরে নিজের বাড়িতে ঢুকিয়ে নেয়, তাহলে পেট ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্টে তার ৭ বছর জেল হবে।

পৌষমাসের শেষ দিন। উত্তুরে হাওয়া। ভোরবেলা বৃষ্টি হয়ে রাস্তার দুদিকের ড্রেন ভেসে গেছে। এই ঠান্ডায় গোটা শহর যখন ভাবছে এবার চা খেয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য ছাদে উঠবে, তখনি ভেসে এল সেই অদ্ভুত কোরাস। আস্তে আস্তে সারা শহর, সব গলি ছেয়ে গেল সেইসব শব্দে। রাস্তার দুদিকের ড্রেনের উপচে পড়া জলে ছলাক ছলাক লাফিয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে প্রচুর ছোট ছোট মাছ। রাস্তার ওপরে খাঁচামুক্ত অনেক মুরগির কঁকর-কঁ কঁকর-কঁ আর রাস্তাজোড়া দুপাশের গাছের আশেপাশে লাগামহীন কচি ছাগলের ম্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা। কুকুরগুলো এরকম দৃশ্য জীবনে দেখেনি। কী করবে বুঝতে না পেরে ওরাও কোরাস গেয়ে উঠল।

আজ বৃহস্পতি। সারা শহরে ১৪৪ ধারা। নিচে রাস্তায় নামা যাবে না। অগত্যা গোটা শহর বাড়ির দরজায় খিল তুলে ছাদ থেকে আকাশের ঘুড়ি থেকে দেখছে ছাগলগুলো কীভাবে উঠোনের পাশের সাধের ফুলগাছগুলো মুড়িয়ে খেয়ে যাচ্ছে  আর মুরগিগুলো ফেলে দেওয়া ভাত আর মুড়ির টুকরো খুঁটতে খুঁটতে পাল্লা দিয়ে রাস্তা ভর্তি সাদা ডিম পাড়ছে। মাছেরা লাফিয়ে রাস্তায় উঠছে আবার ড্রেনে নেমে যাচ্ছে। খানিক দূরে চৌরাস্তায় পুলিশ গান বাজাচ্ছে – ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে / পাগল আমার মন জেগে ওঠে’।

এরকম অপার্থিব দৃশ্য দেখে আমার হঠাৎ কিছু দিতে ইচ্ছে হল। দৌড়ে গিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে ২০২০ সালের একটা ফুরফুরে কাগজের মাস্ক এনে ছাদ থেকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। সেটা চড়কির মত ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় নামতে লাগল। একটা মুখোশ। পাগলা হাওয়ায় নামছে। রাস্তাজোড়া এতগুলো মুখের মাঝে একটাও মুখ খুঁজে পাবে না?

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন