কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


সম্রাট ও শবদেহ

 

(একটি কাল্পনিক কথোপকথন)

তাজমহলের শ্বেতপাথরকে ফুঁড়ে এইমাত্র বেরিয়ে এলো একটি বলিষ্ঠ মূর্তি! অন্ধকারে ঠাওর করা যাচ্ছে না, কে এই ব্যক্তিটি? ইনিই কি মহামান্য শাজাহান?

হাল্কা হাওয়া। কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে যমুনা নদী। সু-পুরুষোচিত স্কন্ধ, বলিষ্ঠ মূর্তিটি তাজমহলের চারপাশ ধরে হাঁটতে লাগলেন। একবার সৌধটির চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করে তাঁর মনটা খুশীতে ভরে উঠলো। এবার তিনি বহমান নদীটির তীরে   এসে দাঁড়ালেন। মন ভালো করা হাল্কা জোছনা। তাঁর মাথায় প্রচুর চিন্তা।  প্রতিপক্ষরা সিংহাসন দখলের জন্যে ওৎ পেতে আছে। দেশের চারদিকে গন্ডগোল। মানুষজন তাঁর উপর কি ক্ষেপে আছে? মহামারীতে অসংখ্য লোক মারা যাচ্ছে!  কীভাবে তিনি তাঁর রাজধর্ম রক্ষা করবেন? দেশের সিংহাসন অতীব মূল্যবান!

যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনি অনেক কিছু ভাবছিলেন। এমন সময়ে বলিষ্ঠ মূর্তিটির নজরে এলো একটা জিনিষ নদীতে ভাসতে ভাসতে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে! একটু সামনে আসতেই বোঝা গেল ভাসমান বস্তুটি একটি মৃত মানুষের দেহ! একটা হাওয়ার দাপট! ভাসমান লাশটি নদীতীরে সংলগ্ন একটা  ঝোপের শেকড়ে আটকে গেলো!

আটকে যাওয়া লাশটি কথা বলে উঠলো – ‘আগুন, একটু আগুন!’

রাজকীয় মূর্তিটি সচেতন হলো।

জলে ভেসে থাকা লাশটি নদীতীরে দন্ডায়মান মূর্তিটিকে দেখতে পেলো। প্রশ্ন করলো - ‘আপনিই কি শাজাহান?’

-‘না, মুর্খ! আমি একজন সম্রাট! কী করে তোর মনে হলো আমি একজন বিধর্মীয় রাজপুরুষ?’

লাশটি খুব সাহসের সাথে সসম্ভ্রমে প্রশ্ন করলো - ‘কে তবে আপনি?’

রাজকীয় মানুষটি কোন উত্তর দিলো না। প্রণায়ামের ভঙ্গীতে তিনি লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছিলেন। আজকে তিনি সত্যিই ক্লান্ত। সারাদিন ১৯টা জনসভা গেছে। দেশের নগরে নগরে তিনি প্রজাদের সম্মুখে ভাষণ দিয়েছেন। এখন শরীর ও মনের বিশ্রাম প্রয়োজন। তাই তিনি তাজমহল চত্বরের এই ফাঁকা স্মৃতি সৌধটাই বেছে নিয়েছেন।

নদীতীরে উন্মুক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অক্সিজেন নেয়ার ফলেই মহামান্য লক্ষ করলেন ধীরে ধীরে তাঁর মনস্কতার উন্নয়ণ ঘটছে! ক্লান্ত শরীরটা শান্ত  লাগছে।

নদীতে আটকে থাকা মরা মানুষটি খুব সাহসের সাথে আবার প্রশ্ন করলো -‘মহারাজ! গরীবের অপরাধ নেবেন না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, সত্যি সত্যি আপনি কে?’

শাজাহান সদৃশ্য মানুষটি সগর্বে তাঁর সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন - ‘আমি দেশের একজন সম্রাট! রাতের হাওয়া মগজকে পরিশুদ্ধ করে। জনহীন রাতে এই তাজমহলের চত্বরটা খুবই সুন্দর! তাই এই ফাঁকা জায়গাটায় একটু অক্সিজেন নিতে এসেছি।

তাজমহলের ভেতরে চারপাশের পরিবেশটা সত্যিই খুব সুন্দর। নদীতে ভাসমান লাশটি চমকিত হলো। প্রশ্ন করে বসলো, ‘এখানে এত হাওয়া, এত অক্সিজেন! আর আমি কিনা ঘরে শুয়ে শুয়ে বিনা অক্সিজেনেই মারা গেলাম। কোন হাসপাতালেই কেন আমি ভর্তি হতে পারলাম না?’

সম্রাট তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন- ‘এটা তোর রাজ্যের ষড়যন্ত্র। তারা সম্রাটের  বদনাম চায়। কোষাগার থেকে তোদের সব রাজ্যকে যথেষ্ট পরিমান মুদ্রা দেয়া হয়েছে! কেন তুই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবি না! কী এমন কারণ? একটা  এমনি ভাবে মানুষের লাশ নদীর জলে ভেসে আসবে?’

শবদেহটি বলে উঠলো – ‘মহামান্য হুজুর! অপরাধ নেবেন না! আমি যখন মরে গেলাম, আমার পড়শিরা রাতের অন্ধকারে আমাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আমি হতভাগ্য! আমার খুব ইচ্ছে, কেউ আমার কপালে একটু আগুন ছুঁইয়ে দিক! সদগতির জন্যে পবিত্র আগুনের খুব দরকার!’ কাতর কন্ঠে কেঁদে উঠলো মানুষটি।

সম্রাট দাড়িতে হাত দিয়ে মাথা নাড়লেন। ‘না, না! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! সদগতির জন্যে পবিত্র আগুনের ব্যবস্থা সব জায়গাতেই করা হয়েছে। এলাকা ভিত্তিক শ্মশানগুলোর দায়িত্বে এক একজন করে কমিশনার আছে! সুজলা সুফলা এই দেশে কাঠেরও কোন কমতি নেই। কেন তুই শেষ যাত্রায় তোর কপালে আগুনের পবিত্র ছোঁয়াটুকুও পাবি না?’

শবটি তখনও আটকে আছে তীরবর্তী জলজ ঝোপের ডাল আর শেকড়ে। ভাসমান লাশটি সবিনয়ে উত্তর দিলো – ‘মাননীয় মহারাজ! আমি একটুও ঝুটমুট বলছি না। আমার পরিবারের দুমুঠো খাবার জোগাড়ের সামর্থ্য নেই! আমি অসুখে যখন মরে গেলাম - বিছানায় শুয়ে আমার অসুস্থ মেয়ে আর মরণাপন্ন বউটা মিউ মিউ করে কাঁদছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বস্তী মহল্লায় সবার কাছে খবর পৌঁছে গেল ‘ছুটকির বাপ মারা গেছে’! বস্তীর লোকজন খুব ভালো  মানুষ। আমার মরে যাবার খবর পেয়ে তক্ষুনি ওরা সৎকারের জন্যে আমার ঝুপড়িতে ছুটে এলো। ওরাও খুব গরীব মানুষ। ওদের কাছেও এমন কোনো পয়সা নেই, আমার সৎকারটা বিধিমতো শ্মশানে করাবে। কোথা থেকে তারা জোগাড় করবে শ্মশানের কাঠ? আজকাল শয়ে শয়ে লোক মরছে। শুনেছি,  জায়গায় জায়গায় মরা পোড়ানোর কী লম্বা লম্বা লাইন! আমার পুরো পরিবারটাই অসুস্থ। এজন্যেই ওরা চুপি চুপি রাতের অন্ধকারে আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে  এই নদীর জলে। মহামান্য হুজুর! আমার কপালে কি সামান্য একটু অগ্নি-প্রাপ্তিও নেই? আমার খুব ইচ্ছে, কেউ আমার কপালে একটু আগুন ছুঁইয়ে দিক!’

লোকটার এই দীর্ঘ সংলাপে সম্রাট কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলেন। তাঁর সারাটা দিন  কেটেছে বিভিন্ন আমলা, ভি আই পি আর সিকিউরিটি পরিবৃত হয়ে। সিকিউরিটিরা সবাই প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে, তিনি তাজমহলের চারপাশে একটু মানসিক বিশ্রাম নেবেন। এমন একটা সিক্রেট প্লান আগে থেকেই করা ছিল। এ সময়ে কী একটা ঝঞ্ঝাট এসে জুটলো রে বাপ! একটা  ভাসমান লাশ কথা বলছে! তবুও মাননীয় সম্রাট লোকটির অভিযোগের উত্তর দেয়া তাঁর পরম কর্তব্য মনে করলেন।

সম্রাট বললেন, - ‘তা পয়সার অভাবে তোর সৎকার হচ্ছিল না? তোদের মহল্লার লোকেরা মিউনিসিপ্যালিটি, পঞ্চায়েতের কাছে গেল না কেন?’

মৃতদেহটি বলে উঠলো,- ‘হুজুর! কয়েকজন গেছিল। ওনারা আমার নামের কাগজ চাইছিলেন। আমরা কয়েক পুরুষ ধরে এখানেই আছি। কিন্তু আমাদের পরিবারের কারো কাছে কাগজ নেই’।

নিজের সাদা দাড়িতে সম্রাট এবার হাত বোলালেন। অভিজ্ঞ বিচারকের মতো ভাসমান শবটিকে বললেন - ‘তোর কাছে কাগজ নেই! ও হো! এতক্ষণে আমি  বুঝলাম, আমার সাম্রাজ্যে তো তোর নাগরিকত্ব সন্দেহজনক! এজন্যেই তো আমি সবাইকে বারবার বলছি, সিটিজেনশিপের খাতাটাতাগুলো জলদি তৈরী করতে’।

-‘মহামান্য মহারাজ, এ দেশে আমরা যে বাপ-দাদাদের সময় থেকে আছি। সে অনেক কাল হয়ে গেলো। কিন্তু গরীব মানুষ – কী যেন বললেন, ওসব কাগজপত্র তো আমরা কোনোদিনও দেখি নি!’

-‘তার মানেটা হচ্ছে, তোরা বহিরাগত, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছিস?’

-‘মহারাজ, আমি এই দেশেরই লোক! একটা ঝুপড়ি পট্টিতে থাকি। লকডাউনের  জন্যে অনেক দিন ধরে কোন রুজি রোজগার নেই, কোন কামাই নেই। তার উপরে পরিবার সুদ্ধ সবাই একসাথে অসুখে পড়লাম! আমার কপাল খারাপ - এ জন্যেই মরে যাবার পরে নদীর জলে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে আটকে পড়েছি! মহারাজ, আপনি আমার মা-বাপ!’

-‘তুই যে গুন্ডা বদমাস না, তুই যে অবৈধ মানুষ না, সেটা জানার প্রয়োজন  আছে। তোর জন্যে সব কিছু করা হবে। তবে আগে নিজের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেখা, নাগরিক সার্টিফিকেট দেখা। আমি অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। নিমেষেই তোর সৎকারের সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে’।

এবার মৃতদেহটি ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো- ‘মহারাজ, কৃপা করেন। আমরা লেখা পড়া জানি না। কাগজপত্র আমাদের কাছে কিচ্ছু নেই!’

-‘তুই বহিরাগত! তোদের মতো লোকেরাই বিধর্মী আর সন্ত্রাসবাদী হয়!’ এই কথা বলতে বলতে বলিষ্ঠ মূর্তিটি নদী স্রোতের থেকে মুখ ঘোরালেন।

সম্রাট ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন যমুনার উলটো দিকে। সামনেই জনশূন্য তাজমহল। চারপাশে অপার নির্জনতা! শ্বেত মর্মর সৌধটা আজকের চাঁদনী রাতে আলোয় ঝলমল করছে। তিনি আরো কিছুক্ষণ এই তাজমহলের নির্জনতাটুকু উপভোগ করলেন। নদীর থেকে ভেসে আসা জলীয় হাওয়াটাকে সেই মুহূর্তে তার কাছে খুব সন্দেহজনক মনে হলো। ভাবলেন, তাঁর পার্সোনাল সেক্রেটারিকে খবর  পাঠাবেন। এখানে বেশীক্ষণ থাকা তাঁর পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়। এমনি ভাবতে ভাবতে, দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বাদশা শাজাহান যেমনটা এসেছিলেন, তেমনটাই তিনি তাজমহলের শ্বেতপাথরের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেলেন!

একটা দমকা হাওয়া আর জলের ঢেউ এসে আটকে থাকা শবদেহটিকে মুক্ত করলো। ওটা ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। গাঁয়ের কোন  লোকজন বা ভলান্টিয়ারের দল যদি তার মৃতদেহটি দেখতে পায়, তারা তুলে এনে যদি দেহটিতে আগুন ছোঁয়ায়! কবরস্থ করলেই বা ক্ষতি কি!


1 কমেন্টস্: