কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১১১

এবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বিভিন্ন বৃহৎ মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য বই। সাধারণ মানের বই থেকে উচ্চমানের বই। লঘু বিষয়ক বই থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বা সিরিয়াস বিষয়ক বই। সব বই সংগ্রহ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ তার সাধ ও সাধ্যমতো বই সংগ্রহ করে। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের মধ্যে যেহেতু প্রায়শই অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, তাই সাধ থাকলেও সাধ্য না থাকার দরুন অনেক কিছ থেকেই বঞ্চিত থেকে যায়। আর তাই যারা প্রকৃত পাঠক-পাঠিকা এবং যথার্থ জ্ঞানপিপাসু, তারা তাদের প্রয়োজনীয় ও পাঠ্য সব বই সংগ্রহ করতে না পেরে অতৃপ্ত থাকে। আর আমাদের মতো মধ্যবিত্ত জীবনের এটাই বাস্তব চিত্রনাট্য।

আসলে কিছু কিছু বই সন্ধানী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে এতটাই অপরিহার্য বলে মনে হয়, সেই বই সংগ্রহ করার জন্য তারা সাধ্যের বাইরে যেতে বাধ্য হয়। এরকম বেশ কিছু বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যা এবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সম্পাদকীয় কলমে বেশি শব্দ লেখার যেহেতু কোনো সুযোগ নেই, তাই আমি শুধুমাত্র একটি বইয়ের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। বইটি প্রকাশিত হয়েছে আমারই সম্পাদনায় ‘চিন্তা প্রকাশনী’ থেকে। কবি-ঔপন্যাসিক-প্রবন্ধিক রবীন্দ্র গুহর লেখা একটি বই, শিরোনাম ‘বাংলা কবিতায় রীতির বিপরীত রীতি’। আমি মনে করি, যারা বাংলা কবিতা চর্চা করেন, তার নিরন্তর বাঁকবদল সম্পর্কে অবহিত হতে চান এবং নতুন আঙ্গিক ও ভাবনায় কবিতা নির্মাণের প্রয়াস করেন, তাঁদের সবার জন্য এই বইটি অত্যন্ত জরুরি এবং অবশ্য পাঠ্য। আমি এই প্রাসঙ্গিকতায় আমারই লেখা বইটির ভূমিকা থেকে কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করছি –

“বাংলা কবিতার বর্তমান ধারা বা চেহারা ঠিক কেমন, তা এক কথায় বলা সম্ভব নয়। আসলে পরিবর্তিত সময়ের ধারাবাহিকতায় কোনো ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতিও যে সরলরেখায় বা একরৈখিক মাত্রায় পরিবর্তিত হবে, তা তো নয়!  যখন থেকে ‘মিডিয়া চলে গেল আধিপত্যবাদীদের হাতে, তখন থেকেই পতন শুরু হলো আধুনিকতার। এবং এই আধুনিকতার ভাঙনের ফলে কবিদের এতদিনের স্থিতাবস্থায় গন্ডগো্লের সূচনা হলো। তাঁরা অনুধাবন করলেন, গতানুগতিকতায় আর কবিতাচর্চা সম্ভব নয়। যাবতীয় সাজানো শৈলী, আঙ্গিক, ভাবনা কালপ্রবাহে তছনছ হয়ে যেতে বসেছে। শব্দের মর্মার্থ, প্রতীক, রূপকচিহ্ন,  কিংবদন্তি আগের মতো আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। কবিরা নিজেরাই নিজেদের প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়লেন। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি হলেন। উপলব্ধি করলেন, কবিতার প্রচলিত প্যাটার্ন ও স্ট্রাকচারে আর নতুন কবিতা সৃজন করা আদৌ সম্ভব নয়। অথচ নিজেদের পালটে ফেলাও এক কঠিন ও জটিল ব্যাপার। বিশেষত ঘেরাটোপ থেকে নিজেদের বের করে আনা আরও কঠিন। কবিতার ভূ-সম্পত্তির টানাটানিতে তাঁরা হলেন বিভ্রান্ত। বুঝতে পারলেন, এবার তাঁরা বাতিলের তালিকায় ক্রমশ অনুপ্রবেশ করছেন।

কিন্তু যাঁরা এই ঘূর্ণিস্রোতের প্রবাহে ভেসে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন, শুরু করলেন নতুন খোঁজ ও তল্লাসী, তাঁরাই প্রচলিত রীতির বিপরীত রীতিতে আস্থা রাখলেন, নতুন সৃজনের সাধনায় নিমগ্ন হলেন। তাঁরা চাইলেন চলতি ভাষাশব্দের চমক তথা উপাদানের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি। চালু প্যাটার্নকে সরাসরি বাতিল করলেন। অল্টারনেটিভ অস্তিত্বের অনুসন্ধানে প্রয়াসী হলেন। স্বাভাবিক কারণেই ঘটল কেন্দ্রিক ঠাঁইবদল। পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াল কিছুটা  কেয়াটিক। কবিদের মধ্যে শুরু হলো নানারকম দ্বন্দ্ব, হতাশা, নেগেটিভ লংমার্চ। আবির্ভার ঘটল বিভিন্ন ভুল পদ্ধতির ও ভুল ভাবনার। কিন্তু কবিতা হয়ে উঠল সর্বজনীন। যাঁরা দুর্গম পথের পথিক হলেন, নতুন পর্যায়ে কবিতার সূচনা  করলেন, তাঁদের নিয়ে শুরু হলো বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা। কে আদৌ ঠিক বা বেঠিক, তা নিয়ে শুরু হলো কাটাছেঁড়া।

রীতির বিপরীত রীতির এই অবস্থানকে অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও কবি রবীন্দ্র গুহ। তাঁর দীর্ঘদিনের নিবিড় সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্যসৃজন বাংলা সাহিত্যকে নিরলসভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছে। তিনি অত্যন্ত সততার সঙ্গে অনুধাবন করেছেন, পরিবর্তিত কালখন্ডে  পরিবর্তিত সাহিত্যের বিভিন্ন বাঁকবদল। এবং শুধুমাত্র অনুধাবন করেননি, বরং নিজের সৃষ্টিতেও তা্র সুনিপুণ প্রয়োগ করেছেন। বিশেষত কর্মসূত্রে দেশের  বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের ফলশ্রুতিতে তিনি ওয়াকিবহাল হয়েছেন বহির্বঙ্গের সাহিত্যসৃজন সম্পর্কে। মূল বাংলার বাইরে যে কী ব্যাপকভাবে বাংলা গদ্য ও কবিতার কায়াবদল ঘটে চলেছে, কীভাবে রীতির বিপরীত রীতিতে খুলে যাচ্ছে বাংলা গদ্য ও কবিতার নতুন নতুন দিগন্ত, তা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং নিজেও সেই দিগন্ত রচনার শরিক হয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন।

রবীন্দ্র গুহর বিভিন্ন রচনা পড়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, কীভাবে এই নতুন বাংলা গদ্যসাহিত্য ও কবিতার ক্ষেত্রে পালাবদল ঘটে চলেছে। এই নতুন ধারায় পোয়েটিক জাস্টিসকে অস্বীকার করা হলো। আর পোয়েটিক জাস্টিসকে অমান্য করা মানেই ইনটেলেকচুয়ালিজমের বিরোধীতা। প্রশ্ন উঠল অনেক। কিন্তু আন্দোলন অব্যাহত থাকল। এতদিনের ব্রাত্য, দেশজ, প্রান্তিক ভূমিপুত্ররা উঠে এলো বাংলা সাহিত্যে। বহির্বঙ্গের অহংকারী যুবক-যুবতীরা হাত উঁচু করল। ভাষার ঘেরাটোপ ভাঙতে শুরু করল। শোনা গেল বহুস্বরীয় কন্ঠ। কবিতায় আমদানী হলো ‘আনকমন উপাদান। কবিতার স্ট্রাকচার বা গঠনতন্ত্র নিয়ে চর্চা   শুরু হলো ডাউন-টাউনে, গ্রামে-গঞ্জে, বৃহৎবাংলায়। প্রশ্ন উঠল, শব্দের অর্থ শুধুমাত্র ভেতরে নয়, তার বাইরেটাও কেন দেখা হবে না? আমরা কেন গোঁড়ামিমুক্ত, মালিন্যমুক্ত হব না? ইচ্ছার অরবিটারী ফোর্সকে কেন মনের মধ্য চাড়িয়ে দেওয়া হবে না? একরৈখিকতা থেকে কবে আমরা বহুমাত্রিকতায় উপনীত হব?

রবীন্দ্র গুহ মনে করেন, ক্রিয়েটিভ ব্যাপারটা সবার রক্তের মধ্যে থাকে। তিনি আরও মনে করেন, কবিতার আয়ু বাড়ছে এবং তার ছায়াতেই আমরা বসবাস করছি। আমাদের ম্যারাথন দৌড় চলছে। খন্ডিত অনিশ্চিত ভাবনাকে কে কীভাবে প্রকাশ করবে, তা নির্ভর করে তার সামাজিক অবস্থান ও ইনার ডিভাইসেসের ওপর। কোনো কবিতা উপাদানের জন্য বিপরীত রীতির আখ্যা পায়, আবার কোনোটা পায় অ্যান্টি ওয়ার্ডের আখ্যা। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, আধুনিকতার পরের  স্টেশন যদি উত্তর আধুনিকতা হয়, তাহলে উত্তর আধুনিকতার পরের স্টেশন কী? ফিউচার ট্রুথ? তাহলে তখন পোয়েটিক জাস্টিস বলতে কী বোঝানো হবে?”

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ফেব্রুয়ারী সংখ্যা আমরা প্রকাশ করতে পারিনি কিছু অসুবিধার কারণে। মার্চ সংখ্যা প্রকাশ করা হলো। এবং এই সংখ্যার সঙ্গেই পত্রিকা দশ বছর পূর্ণ করে এগারো বছরে পা দিল। এখন প্রকৃতির নিয়মে বসন্তকাল চলছে। সবাইকে আমাদের বাসন্তী শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব 

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী - ২৮




শেষ পর্বে বলেছি এবার থেকে আবার ইউরোপ ভ্রমণ শুরু করব। এই পর্বে আমাদের গন্তব্য  স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ। অর্থাৎ সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ড। এর মধ্যে আইসল্যান্ড ও গ্রীনল্যান্ডের ছবি নিয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই, তাই বাকী চারটে দেশ নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। মনে রাখবেন, পৃথিবীর সেরা ২০ জন পরিচালকের নাম যদি তালিকাবদ্ধ করা হয়, তাহলে এই নর্ডিক অংশ থেকে অন্তত দু’জনের নাম উঠে আসবে।

সেই ভাইকিং রাজাদের সময় থেকে এই অঞ্চল বিখ্যাত এখানকার দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ প্রজাতির জন্য আর এখানকার খুব ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য। এখানকার ভাইকিং রাজা ‘ব্লু-টুথ’ প্রথম এই সমস্ত কন্‌কনে ঠান্ডা অঞ্চলকে একত্রে এনে সমুদ্রের এপাড়ে ওপাড়ে পুরো এলাকায় রাজ্যপাট বিস্তার করেছিলেন। ওনার স্মৃতির উদ্দেশ্যেই কিন্তু আমাদের মোবাইল বা ল্যাপটপে শর্ট রেঞ্জ তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ‘ব্লু-টুথ’ বলা হয়। এখানে অবশ্য ভূগোলের এখনো খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। দক্ষিণদিকে বাল্টিক সাগরের কাছে কিছু  অংশে তাপমাত্রা ৩০/৩৫ ডিগ্রি হলেও নর্ডিক অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গাতেই তাপমাত্রা মাইনাসে থাকে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারী মাসের ঘন তুষারপাতে। যাইহোক, সিনেমায় ফিরি।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা এই লেখা শুরু করব সুইডেনের ইঙ্গমার বার্গম্যানকে (১৯১৮-২০০৭) দিয়ে, তারপর ডেনমার্কের কার্ল ড্রেয়ার এবং এই পুরো নর্ডিক অঞ্চলের আরো বেশ কিছু বিখ্যাত পরিচালক। গোটা অংশ আমরা দু’পর্বে ভাগ করে পর্যালোচনা করব। কিন্তু সবার শুরুতেই আমি প্রতীক বা চিহ্ন দিয়ে বানানো ছবির ভাষা কি একটু ঝালিয়ে নেব? কারণ সেটা বার্গম্যান থেকে শুরু করে আরো  কয়েকজনের ছবি বুঝতে গেলে কাজে আসবে। সাহিত্য থেকে শুরু করে সিনেমায় যাই, তাহলে স্ক্রিপ্ট ব্যাপারটা বুঝতে আপনাদের সুবিধে হবে।

প্রথমে আমাদের সবার চেনা এক কবিতা দিয়ে শুরু করি (জীবনানন্দ) – ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে / সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে / অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে / সেখানে ছিলাম আমি আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে / আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’। এটা স্ক্রিপ্ট নয় - এটা বর্ণনা। কিন্তু এই ভাষা চিহ্নের ভাষা, প্রতীকের ভাষা। ডিটেলিংয়ে হাঁটা বা ঘোরার বর্ণনার পেছনে যেখানে অগুনতি জীবনের মাঝে ভালবাসা খোঁজার উদ্দেশ্য রয়েছে। এবার আরেকটু এগিয়ে জন স্টেনবেক-এর ‘দ্য পার্ল’ উপন্যাসের শেষ অনুচ্ছেদ তুলে ধরি – ‘And the pearl settled into the lovely green water and dropped towards the bottom. The waving branches of the algae called to it and beckoned to it. The lights on its surface were green and lovely. It settled down to the sand bottom among fern-like plants. Above, the surface of the water was a green mirror. And the pearl lay on the floor of the sea. A crab scampering over the bottom raised a little cloud of sand, and when it settled, the pearl was gone’। মুক্তোর আড়ালে এ ভাষাও প্রতীকের ভাষা। মানুষের লোভ ও লোভমুক্তির। কিন্তু দেখুন, চোখের সামনে যেন পুরো একটা লং সিন ভেসে উঠছে, তাই না? এখান থেকে সোজা এক সিনেমায় আসুন। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। বৃষ্টির জলে ভিজে দুর্গার অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে শুরু করে দুর্গার চলে যাওয়া এবং হরিহরের বাড়ি এসে পৌঁছনো অব্ধি। বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন অন্যভাবে,  কিন্তু সত্যজিৎ সেটা ভাঙলেন মোট ১৪টা সিনে। ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইতে এর উল্লেখ পাবেন। এই ১৪টা সিন সত্যজিৎ রায় পুরোটাই মেঘে ঢাকা দিনে শুটিং করেছিলেন। প্রত্যেক শট অন্তত দু’বার শুট হয়েছিল, এবং পুরোটা করতে তিন দিন সময় লেগেছিল। এই নয় যে এই সময় আকাশে সূর্য ওঠেনি, কিন্তু দুর্গার রোগে ভুগে চলে যাওয়ার ভারাক্রান্ত বিষয়টা ক্যামেরায় ফুটিয়ে তোলার জন্য উনি শুধু মেঘলা দিন ব্যবহার করেছিলেন। আবার প্রতীক, এবং প্রতিবার এইসব প্রতীক যেন এক ভিন্ন ভাষা ফুটিয়ে তুলছে। সত্যজিৎ রায় ওনার বইতে এই অংশ নির্মাণ, ভাষা ও স্টাইল অধ্যায়ে রেখেছেন। কাকতালীয় ভাবে, সিডনি  লুমেটের ‘Making Movies’ বইয়ের প্রথম দুটো অধ্যায় স্ক্রিন-প্লে এবং স্টাইল নিয়ে। আমি যেটা এতক্ষণ  ধরে বোঝাতে চাইছি, তা হল, একদম প্রাথমিকভাবে স্ক্রিন-প্লে এবং স্টাইল সিনেমা থেকে সিনেমার ভাষা আলাদা করে দেয় এবং পরিচালকদের স্বাতন্ত্র্য বুঝিয়ে দেয়। তারপর তো ক্যামেরা, সেট সাজানোর খুঁটিনাটি, অভিনয়, মিউজিক, এডিটিং... সব একে একে আসবে।

আর আমরা আজ ইঙ্গমার বার্গম্যানকে নিয়ে শুরু করব এখান থেকেই। সুইডেনের সিনেমার কথা উঠলের শতকরা ৯০% লোক শুধু বার্গম্যানকেই চেনেন। কারণ ওনার ছবিতে মনস্তত্তের অদ্ভুত খেলার পাশাপাশি  ওনার অনবদ্য স্টাইল এবং আরো বড় কথা, এখনো অব্ধি সুইডেনের যে ৩টে সিনেমা অস্কার পেয়েছে, সেগুলো ওনার। কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন, সিনেমা কী? সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, সিনেমা হল সেলুলয়েডে  ফুটিয়ে তোলা জীবনের গল্প। আমি এখান থেকে আরো একধাপ এগোব। সিনেমা আসলে কোন এক গল্প, হয় মূর্ত অথবা বিমূর্ত, এবং সফল সিনেমা আমাদের মনে কোন এক ছাপ রেখে যায়। সেই ছাপ হয় আমাদের মনে অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, অথবা অনুভূতির সঙ্গে টাইম-স্পেস ফারাকে কিছু ধারণাও এনে দেয় অথবা অনুভূতি ও ধারণার সাথে সাথে আমাদের এক আয়নার সামনে বসিয়ে নিজেদের ও সমাজের  একাংশের ব্যাপারে কিছু ভাবতে শেখায়। সিনেমা ভেদে এগুলো এক ডিগ্রি এক ডিগ্রি করে বেড়ে চলে। আবার একজন ইঞ্জিনীয়ার যেমন ‘কী হয়েছে’ বোঝার থেকে ‘কীভাবে হয়েছে’ বুঝতে বেশি আগ্রহ খুঁজে  পান, তেমনি একজন চিত্র পরিচালক গল্পটা জেনে বুঝে যাবার পর ‘কীভাবে’ দর্শকদের সামনে তুলে ধরবেন, সেই নিয়ে কূলকিনারা খুঁজতে বসেন। ওই ‘কীভাবে’র ভেতর লুকিয়ে থাকেন আস্ত এক পরিচালক।

আমার বিচারে বার্গম্যান পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পরিচালক (বিতর্ক থাকতেই পারে, তাই বলেছি ‘আমার বিচারে’)। ১৯৪৪ থেকে ২০০৩, এই সময়ের মধ্যে মোট ৪৯ টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, যার মধ্যে এগুলোর নাম করতেই হয় – সামার উইথ মনিকা (১৯৫৩), দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭), দ্য ভার্জিন স্প্রিং (১৯৬০), থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), দ্য সাইলেন্স (১৯৬৩), পারসোনা (১৯৬৬), শেম (১৯৬৮), ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পার্স (১৯৭২), সিন্‌স ফ্রম আ ম্যারেজ (১৯৭৪), অটাম সোনাটা (১৯৭৮) এবং ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেক্সান্ডার (১৯৮২)। এই যতগুলো ছবির নাম বললাম, এর সিংহভাগ ছবি যৌন মনস্তাত্তিক ও বেশিরভাগ ছবিতেই বার্গম্যানের প্রিয় অভিনেতা/অভিনেত্রী ম্যাক্স ভন সিডো বা লিভ উলম্যান বা ইনগ্রিড থুলিন অভিনয় করেছেন। এর আগে আমি কোন এক পর্বে লিভ উলম্যানকে নিয়ে যখন আলোচনা করেছিলাম, তখন ‘পারসোনা’ নিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু যেদিন পৃথিবীর সেরা ১২ ছবি নিয়ে কলম ধরেছিলাম বা ম্যাক্স ভন সিডো-কে আলোচনায় এনেছিলাম, ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ উল্লেখ করলেও কিছুই লিখিনি। সুতরাং আজ এই ছবি নিয়েই আমরা বার্গম্যানকে ফিরে দেখব।

এক মধ্যযুগীয় অকুতোভয় নাইটের ভূমিকায় ম্যাক্স ভন সিডো। ক্রুসেডের পর সে ব্যক্তিরূপী মৃত্যুর সঙ্গে এই আশা নিয়ে দাবা খেলতে বসে যে যতক্ষণ খেলা চলবে, মৃত্যু তাকে ছুঁতে পারবে না। খেলা এগোতে  থাকে, সিনেমাও। প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে দেখা যায় মৃত্যুর চেয়ে কেউ বড় নয়, সেই নাইট-ও নয়। শেষ দৃশ্যে পুরো স্ক্রিন জুড়ে মৃত্যুর নাচ ছড়িয়ে পড়ে। নাম মাহাত্ম্য? শুরুতে ও শেষে – ‘and when the Lamb opened the seventh seal, there was silence in heaven about the space of half an hour’। কার নিস্তব্ধতা? ভগবানের? এই সিনেমায় আসলে বার্গম্যানের এক প্রশ্ন ছিল, আদৌ কি ভগবান আছে? নাকি শুধুই মৃত্যু?

মাত্র ৩৫ দিনে পুরো সেভেন্থ সিল শুটিং হয়েছিল। স্টুডিও-র পাশের পাহাড়ি জঙ্গলে। মজার ব্যাপার, বার্গম্যান যখন পেটের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন এর স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। এই ছবি প্রকাশ হবার পর আমেরিকা ও ইউরোপের কাগজগুলো একে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিল... piercing… extraordinary… prodigious… eloquent… imaginative… beautiful… rewarding… কিন্তু আপনারা জানেন আমার এক বদ-স্বভাব আছে। আমি নিজে যতক্ষণ কাটা-ছেঁড়া না করি, আমি কোন বিশেষণে বিশ্বাস করি না। তাহলে শুরু হোক।

আলোচনার শুরুর অংশ হবে পরিচালকের স্টাইল নিয়ে। এই ছবির প্রতি সিন এতটাই সহজ যে মনে হবে যেন মধ্যযুগীয় চার্চে উপদেশ শোনানো হচ্ছে। কিন্তু তারপরেই দেখা যাবে এক নাইটের দাঁতচাপা লড়াই, প্রতি মিনিটে মৃত্যুর উপস্থিতি এবং ভগবানের কোথাও না থাকা। ফলে প্রতি সিনে বিশ্বাসের সঙ্গে যেন তর্ক শুরু। এবং এই তর্ক শুরু হচ্ছে তখন, যখন পৃথিবী নিউক্লিয়ার শক্তি পেয়ে গেছে। তাহলে কি এই ছবি মানুষের অবশ্যম্ভাবী নিয়তির আড়ালে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ ধ্বনি? অর্থাৎ এই ছবি প্রতীকী ছবি, এর ভাষা  চিহ্নের ভাষা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই ছবি নাটুকে কারণ বার্গম্যানের এক নাটক থেকেই এই ছবি  নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যে ভাষায় উনি পুরোটা দেখিয়েছেন, যেমন শুরু থেকে শেষ অব্ধি কালো গাউন পরা মৃত্যু, প্লেগ, সেটা দেখে যে কেউ জিজ্ঞেস করবেই ‘জীবনের অর্থ কি?’ ‘এত মৃত্যুর মধ্যেও ভগবান চুপ কেন?’ ‘তাহলে মৃত্যুর পরে কী?’ এবং অবশেষে দর্শকের শেষ প্রশ্ন হবে ‘সত্যির সংজ্ঞা কী?’

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপর আসবে গানার ফিশারের ক্যামেরার কাজ। বেছে বেছে কোথাও কোথাও আলো ফোকাস করা, কোথাও আলো ফ্ল্যাট করে দেওয়া। এই আলো আঁধারির বাঁকারেখা বিমূর্ত ও টাইমফ্রেমহীন হয়ে যায়। এর মাঝে পরিচালক দুই ছোট্ট চরিত্র জফ আর মিয়া-কে নিয়ে এসেছেন শিল্পের ধারক হিসেবে, বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে। জফ ডুবে আছে তার শিল্প নিয়ে। সে বিশ্বাস করে ‘world of angels and devils cannot be understood by common people’। অসাধারণ। মৃত্যুই নিয়তি, কিন্তু  আধুনিক নাইট সিডো তাকে বাধা দিচ্ছে এবং কেউ কেউ বিশ্বাস করছে শিল্প সবাই বোঝে না, পাপ-পুণ্য সবাই বোঝে না, ভূত-ভগবান সবার জন্য না। এই বিমূর্ততার জন্যই এই ছবিকে আমি অন্তত কোন টাইমফ্রেমে বেঁধে রাখতে পারব না। যে কোন স্পেসে, যে কোন সময়ে এই ছবি প্রাসঙ্গিক। ভাবুন তো, কিছুদিন আগেই তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রকৃতির খেয়ালে ভূমিকম্পের যে অবাধ ধ্বংসলীলা, তার পাশে ‘দ্য সেভেন্থ সিল’! যুক্তি আর বিশ্বাসের যুদ্ধ। একে ক্লাসিক না বললে অন্য কোন্‌ ছবিকে বলব?

সুইডেনের ছবিতে বার্গম্যানকে বাদ দিলে আরো যে কয়েকজন পরিচালকের নাম করতে হয়, তারা হলেন – বো ওয়াইডারবার্গ, জন ত্রোয়েল, সেন নিকভিস্ট ও রুবেন আস্টলান্ড। ওয়াইডারবার্গের ছবির মধ্যে র‍্যাভেন’স এন্ড (১৯৬৩), আডালেন ৩১ (১৯৬৯) ও অল থিংস ফেয়ার (১৯৯৫) মনে রাখার মত। ত্রোয়েলের বাছাই ছবি দ্য ইমিগ্রান্টস (১৯৭১), দ্য নিউ ল্যান্ড (১৯৭২) এবং ফ্লাইট অব দ্য ঈগল (১৯৮২)। সেন নিকভিস্ট ছিলেন বার্গম্যানের ক্যামেরাম্যান। ওনার নিজের অনবদ্য সিনেমা বলতে দ্য অক্স (১৯৯১)। এবং আস্টলান্ডের উল্লেখযোগ্য ছবি ফোস মাজার (২০১৪) এবং দ্য স্কোয়ার (২০১৭)। এগুলোর ভেতর আমরা একটা পুরনো ও একটা নতুন ছবি বেছে নেব।

জন ত্রোয়েলের ‘দ্য ইমিগ্রান্টস’ ১৯১ মিনিটের এক দীর্ঘ সিনেমা, মুখ্য চরিত্রে সেই ম্যাক্স ভন সিডো ও লিভ উলম্যান, এই ছবি বাস্তবের এক চাবুক – বার্গম্যানের সূক্ষ্মতার ঠিক উল্টোদিকে।

সুইডেনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নিলসন নামক কৃষক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকে। কিন্তু সুইডেনের খারাপ আবহাওয়ায় তাদের চাষবাস খুব খারাপ হয়, খিদে সহ্য করতে না পেরে তাদের এক ছেলে মারা যায়, তারা আরো কিছু ওঠানামার পর আমেরিকায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই যাত্রায় তাদের সাথে এসে যুক্ত হয় আরো কয়েকটি গরীব পরিবার। যাবার পথে তাদের দুর্দশা নিয়েই ‘দ্য ইমিগ্রান্টস’। এই ছবিকে গ্রাম্য আমেরিকা আস্তে আস্তে কীভাবে তৈরি হয়েছে, তার এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে দেখা  হয়। যদিও ক্যামেরার কাজ নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায় কিন্তু সিডো এবং উলম্যানের অভিনয় অকুন্ঠ প্রশংসা পেয়েছিল। বিখ্যাত সমালোচক রজার এবার্ট এই সিনেমাকে মাস্টারপিস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

পরের ছবি আস্টলান্ডের ‘দ্য স্কোয়ার’। আড়াই ঘন্টার ছবি। স্টকহোমের এক বিখ্যাত মিউজিয়ামের কিউরেটর ক্রিস্টিয়ান। ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা নিয়ে জর্জরিত। নিজের মিউজিয়ামে এক নতুন আর্ট প্রদর্শনীর অ্যাড করার জন্য সে একটা টিম নিয়ে আসে যাদের কাজ হবে ‘স্কোয়ার’ নামক সেই আর্ট প্রদর্শনীকে বিতর্কিতভাবে তুলে ধরা যাতে তা আরো প্রচারের আলোয় আসে। কিন্তু সেই ইউ-টিউব অ্যাড এত বাজে ভাবে ছড়ায় যে সবাই ক্রিস্টিয়ানের নিন্দে করে এবং মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ তাকে সবার সামনে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে।

নিঃসন্দেহে ব্ল্যাক কমেডি। এখনকার শিল্প ও তার মধ্যে মিশে থাকা বিতর্ক নিয়ে এক সুররিয়েল স্যাটায়ার। ক্যামেরার কাজ বেশ ভাল। এবং ডিনারের দৃশ্যে ওলেগের বাঁদরের মত সাহসী আচরণ এই ছবিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। আমার মনে হয়েছে এই ছবিতে পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন যে মনের আশা আর বাস্তবের ফল আলাদা হয়, আর যখন সেটা হয়, তখন কতটা ঘা মারতে পারে। হ্যাঁ, ছবির দৈর্ঘ্য আমার একটু বেশি বলে মনে হয়েছে। অনায়াসেই আরেকটু কাঁচি চালানো যেত।

সুইডেনের পাশাপাশি আজ ফিনল্যান্ডের ছবিও এক ঝলক দেখে নেব। অবশ্য ফিনল্যান্ডের সিনেমার ইতিহাস তেমন পুরনো কিছু নয়, ১৯৭৩ সাল থেকে এখানকার ছবি নিয়মিত অস্কার বিভাগের জন্য  পাঠানো শুরু হয়। এখানকার এক বরিষ্ঠ পরিচালক হলেন আকি কৌরিসমাকি। ওনার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো – শ্যাডোজ ইন প্যারাডাইস (১৯৮৬), ড্রিফটিং ক্লাউডস (১৯৯৬), দ্য ম্যান উইদাউট এ পাস্ট (২০০২) এবং দ্য আদার সাইড অব হোপ (২০১৭)। আশার বিষয়, এখন ফিনল্যান্ডের অনেক তরুণ  পরিচালক ছবি পরিচালনার কাজে এগিয়ে আসছেন।

আমরা আপাতত কৌরিসমাকির ‘দ্য ম্যান উইদাউট এ পাস্ট’ নিয়ে আলোচনা করব। দেড় ঘন্টার একটু বেশি নিয়ে এই ছবি। ফিনল্যান্ড ট্রিলজির দু’নম্বর ছবি। এক মাঝবয়সী লোক ট্রেনে চেপে হেলসিঙ্কি স্টেশনে আসে, সেখান থেকে এক পার্কে গিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কিছু লুটেরা ছিন্তাইবাজের হাতে এত মার খায় যে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে পেয়ে কোনোমতে আবার স্টেশনে আসে, বাথরুমে ঢোকে, আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর তার জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। কিন্তু আর কিছুই সে মনে করতে পারে না – সে কে, কোথা থেকে এসে এসেছে, কোথায় যেতে চায়, কিছুই না। এক লেকের ধারে তার স্থান হয় গৃহহীন কিছু লোকের মাঝে। উদ্ধারকারী টিম তাকে কিছু জামাকাপড় দেয়। টিনের কন্টেনার দিয়ে সে নিজের জন্য কোনোমতে একটা ঘর বানায়। উদ্ধারকারী টিমের একটি মেয়ে ইরমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সে আবার নিজের মত এক কাজ খুঁজে নেয়।

হাসির ছবি। যারা নিজেদের বংশগরিমা, আভিজাত্য নিয়ে বেশি বড়াই করে, ধরাকে সড়া জ্ঞান করে, তাদের প্রতি স্যাটায়ার। কিন্তু সেই স্যাটায়ার বেহিসেবী নয়, মাত্রার মধ্যে। সর্বহারাদের মধ্যে আদান প্রদানও মন ভরিয়ে দেয়। ফিনল্যান্ডের নামকরা অভিনেতা মার্কু পেলতোলার অভিনয় এই ছবির বড় পাওনা। এবং হাসির সংলাপ ঠিকঠাক। যেমন এই অংশটাঃ M: I went to Moon yesterday; Irma: I see, how was it?; M: Peaceful; Irma: Meet anyone? M: Not really, it was a Sunday. আমার যেটা ভাল লেগেছে, সেটা হল এই ছবির নির্মাণ। হাসির ছবির এক নির্দিষ্ট টোন থাকে, সেখান থেকে  এদিক ওদিক হলে ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিচালক সেই হিসেবে নিখুঁত।

স্ক্যান্ডিনেভিয়া আজ এই অব্ধি। সামনের পর্বে ডেনমার্ক ও নরওয়ের ছবি নিয়ে আলোচনা হবে।

(ক্রমশ) 

 


মাহমুদা পারভীন

 

বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত : কিম কিদুক ও অদিতি ফাল্গুনী




বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের ধারা শুরু হয়েছে সেই মধ্যযুগ থেকে বিচিত্র পথ পাড়ি দিয়ে এখনও অনুবাদ চলছে এবং প্রতিনিয়ত অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রধানত সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায়  রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এই যাত্রা শুরু হয়েছিলোপর্যায়ক্রমে ফারসি, হিন্দি, আরবি তারপর বিপুল আয়তনে ও পরিসরে ইংরেজি, এরপর ফরাসি, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দূরপ্রাচ্যদেশীয় ভাষা এবং বলা যায় পুরো পৃথিবীর নানান ভাষা থেকেই বাংলায় অনুবাদ কর্ম চলেছেসম্প্রতি অনুবাদ সাহিত্যের বর্ণাঢ্য ধারায় নতুন এক দেশ নতুন মাত্রা নিয়ে যুক্ত হয়েছে অদিতি ফাল্গুনীর মাধ্যমেবিখ্যাত কোরিয় চিত্রপরিচালক কি ম কিদুক এর ভুবনখ্যাত চলচ্চিত্র 'বসন্ত,গ্রীষ্ম, শরৎ,শীত... এবং বসন্ত' (‘স্প্রিং, সামার,অটাম,উইন্টার... অ্যান্ড স্প্রিং') এর  চিত্রনাট্য ইংরেজি ভাষা থেকে অদিতি ফাল্গুনী বাংলায় রূপান্তর করেছেনসরাসরি কোরিয় ভাষা থেকে  না হলেও এতে বাংলা সাহিত্যে সঞ্চারিত হয়েছে কোরিয় সৌরভ

অদিতির যাত্রা শুরু হয়েছিলো গল্পকার হিসাবে প্রায় কৈশোরে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি নিজেকে নিজেই অতিক্রম করেছেন, বহুমাত্রিক করেছেনসৃজনশীল সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি মননশীল সাহিত্য ধারাতেও সমান সৃষ্টিশীল এবং প্রসিদ্ধবহুবিচিত্র লেখালেখির মধ্যে অদিতির অনুবাদকর্ম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেকবিতা রচিত হওয়ার পর সেই কবিতাটি একান্তভাবে কবিরইকিন্তু একটি গানের বাণী রচিত হওয়ার পর এতে যখন সুর আরোপিত হয় তখন এতে সুরকারেরও অধিকার তৈরি হয় একই কথা প্রযোজ্য অনুবাদের ক্ষেত্রেও অনূদিত সাহিত্য কেবল মূল লেখকের না, এটি একই সাথে অনুবাদকেরও অদিতির অনুবাদ অদিতিরই সাহিত্যকারণ তাঁর অনুবাদ আক্ষরিক নয় এই প্রসঙ্গে স্মরণ করছি কবি চন্দ্রাবতীর কথাতাঁর অনূদিত 'রামায়ণ' কার্যত হয়ে উঠেছিলো 'সীতায়ণ'অদিতি ফাল্গুনীর অনূদিত জেন বৌদ্ধ–দর্শনের গভীর বাণী সংবলিত 'বসন্ত, গ্রীষ্ম,  শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরই অদিতি ফাল্গুনীর এই অনূদিত গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত পরিসরে রয়েছে কিম কিদুক-এর পরিচিতিপরের অধ্যায়ে আছে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, যার নাম দিয়েছেন তিনিআখ্যানরেখা নামকরণেও দেখা মেলে অদিতির স্বকীয়তাতারপরের অধ্যায়ে রয়েছে দুটি সাক্ষাৎকারএরপর রয়েছে কিম কিদুক-এর অন্য আরেকটি চলচ্চিত্রের রিভিউসবশেষে পরিশিষ্ট অংশে আছে এই চলচ্চিত্রকারের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি কবিতা

প্রথম অধ্যায়টি সংক্ষিপ্ত হলেও কিম কিদুক এর সম্পূর্ণ পরিচয়ই এখানে আছেকারণ অদিতির বয়াণ নির্মেদ এবং যথাযথদ্বিতীয় অধ্যায়টি উপলক্ষ্য করেই এই গ্রন্থটির সূত্রপাতএই অধ্যায়টিও সংক্ষিপ্তএবং একটিও অপ্রয়োজনীয় শব্দ নেই এই আখ্যানরেখায় সত্যি বলতে কী আমার খুব  আফসোস হচ্ছে কেন আরও আগে অদিতি এই চিত্রনাট্য অনুবাদ করেননি এই ভেবেবেশ কয়েকবার দেখা, নানান প্রতীকচিহ্ন সংবলিত এই চলচ্চিত্রের কিছু কিছু জায়গায় খানিকটা দুর্বোধ্যতা এবং দ্ব্যর্থতা  আমার রয়েই গিয়েছিলোএই অনুবাদ আমার সব অস্পষ্টতা দূর করে দিলো নির্দ্বিধায় বলা যায় এই অনুবাদটি পড়ার পরে বাংলা ভাষাভাষী অনেক পাঠক নতুন করে এই চলচ্চিত্রটি দেখতে আগ্রহী হবেনবৌদ্ধ, জেন, শিন্টো ধর্ম ও দর্শনে অদিতির গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। 'গৌতম বুদ্ধ' নামে তাঁর একটি মৌলিক গ্রন্থ রয়েছেঅসংখ্য অনূদিত জেন গল্প আছে তাঁরসম্প্রতি 'বুদ্ধ অথবা কার্ল মার্কস' শিরোনামে অদিতির একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছেএটিও তাঁর অনূদিত গ্রন্থ এবং বিষয় হিসাবে এটি চমকপ্রদ এবং নতুনসুতরাং বলা যায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবন কাহিনি কেন্দ্র করে রচিতবসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যটি অদিতির ফরমায়েশি সাহিত্যকর্ম নয় এটি তিনি ভালোবেসেই  অনুবাদ করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠকের সম্মুখে নতুন একটি দ্বার খুলে দিয়েছেনবৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবন চক্র এখানে চিত্রিত হয়েছে চার ঋতুচক্রকে কেন্দ্র করে

অদিতি ফাল্গুনী 

কিম কিদুক  নিজেই স্বীকার করেছেন যে তাঁর চলচ্চিত্রে লোকেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়একটি অপার্থিব সৌন্দর্যমণ্ডিত হ্রদের উপর নির্মিত ভাসমান বৌদ্ধবিহার এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে চিত্রায়িত এই চলচ্চিত্রের নান্দনিক এবং প্রাকৃতিক অনন্য সেলুলয়েডের ভাষিক আমেজের সাক্ষাৎ মিলবে অদিতির অনুবাদে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত বৌদ্ধধর্ম এবং প্রাচ্য দেশীয় বিভিন্ন প্রতীক ও ইঙ্গিতের অর্থ স্পষ্টীকরণে অদিতির লেখক  হিসাবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়এর পরের অধ্যায়ে রয়েছে যথাক্রমে  'ইন্ডিওয়্যার' পত্রিকায় প্রকাশিত রায়ান মোট্টেশিয়ার্ডকে দেয়া কিম কিদুক-এর সাক্ষাৎকার এবং কিম  জ্যে–হিউনকে দেয়া কিমের অন্য আরেকটি সাক্ষাৎকার দুইটি সাক্ষাৎকারই সংক্ষিপ্ত  আয়তনের কিন্তু এখানে পাওয়া যাবে কিম কি–দুক-এর চলচ্চিত্রের পূর্বাপররায়ান মোট্টেশিয়ার্ড-এর নেয়া  সাক্ষাৎকারটি 'বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে এবং কিম জ্যেহিউনের সাক্ষাৎকারটি কিম কিদুক-এর চলচ্চিত্রের আদ্যোপান্ত নিয়েরায়ানের বয়ানে কিম কিদুক বলছেন –“আমি মনে করি যে কত মানুষ বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' দেখেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো কারা এটা দেখেছেআমার কথা হলো বরং কম মানুষ এই সিনেমাটি দেখুক, তবে দেখে যেন তারা এটা বোঝেলেখক হিসাবে অদিতি ফাল্গুনীরও লক্ষ্য ঠিক এমনই এবং শিল্পের প্রশ্নে তিনিও আপোষহীনআরেক জায়গায় কিম বলছেন — “'বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' সিনেমায় আমি ক্ষমা ও সহনশীলতার উপশমকারী গুণের দিকটিই দেখাতে চেয়েছি।”

এই সাক্ষাৎকার পাঠে চলচ্চিত্রটির উদ্দেশ্য পাঠক এবং দর্শকের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং বৌদ্ধদর্শন হৃদয়ঙ্গম সহজতর হবেদ্বিতীয় সাক্ষাৎকারে কিম পরিচালিত বাইশটি সিনেমার মধ্যে 'ক্রোকোডাইল', 'সামারিটান গার্ল', 'থ্রি আয়্ রন', ‘পিয়েটা', 'স্টপ', 'প্যান্ডোরা', 'কল অফ গড', 'ব্যাড বয়' সহ অপরাপর সিনেমা নিয়েও কিম কথা বলেছেনএখানেই জানা যায় কিম নিজেই তাঁর সিনেমাগুলোর অর্থলগ্নীকারী সে কারণে অন্যান্য পরিচালকের চেয়ে কিমের স্বাধীনতাও ছিলো কিছুটা বেশিসাক্ষাৎকারের প্রায় শেষে এসে কিম বলেছেন – “আমি আমার ছবিতে কোনো মিথ্যা কথা বলতে চাই নাপ্রতিবারই যখন আমি একটি নতুন সিনেমা রিলিজ করি, আমি যেন একটু হলেও নিজের উত্তরণ ঘটাইচলচ্চিত্রের পাশাপাশি এভাবে চলচ্চিত্রকারকেও পাঠকের চেনা হয়ে উঠে

মাহমুদা পারভীন
চার নাম্বার অধ্যায়ের নাম ভেনিস রিভিউ' কিম কিদুক-এর শেষ ছবিঈশ্বরের আহবান' (কল অফ  গড) কে  উদ্দেশ্য করে এই অধ্যায়ে রিভিউ লিখেছেন স্টেফানি বার্বারিঅনুবাদক অদিতি ফাল্গুনীর মুন্সিয়ানায় এই অধ্যায়টিও সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে অদিতি একজন কবিমাখন মসৃণ'-এর মতো  অনুপ্রাস এবং 'তুরীয় অনুভূতি' কিংবা 'তপ্ত–লোহিত' শব্দবন্ধের মাধ্যমে কাব্যের গীতলতা তাঁর গদ্যেও ফুটে উঠেছে

সর্বশেষ সিনেমারেইন, স্নো, ক্লাউড অ্যান্ড ফগ' এর কাজ কিম শেষ করে যেতে পারেননিলাটভিয়ায় এই সিনেমার  শ্যুটিংয়ের সময় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ মাত্র ৫৯ বছর বয়সে কিম কিদুক অকালে প্রয়াত হনফলে এই সিনেমাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়

সর্বশেষ অধ্যায়ে কিম কিদুককে নিয়ে রচিত, পিয়াস মজিদ এর শুভ পৃথিবীনামে একটি কবিতা সংযুক্ত হয়েছেকিমের ‘'বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' চলচ্চিত্রকে উপলক্ষ্য করে রচিত  হয়েছে এই কবিতাকবিতার সংযুক্তি গ্রন্থটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে

একটি চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন রচনার সুসমন্বয়ে নির্মিত এই গ্রন্থে এর ফলে সম্পূর্ণ কিম কি-দুক-এর সাক্ষাৎ মেলেআর গ্রন্থটি সার্থক ও সুখপাঠ্য হওয়ার ক্ষেত্রে অনুবাদক অদিতি ফাল্গুনীর  ভূমিকা অসামান্য

বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ,শীত... এবং বসন্ত' বইটির প্রকাশক 'ঐতিহ্য', ঢাকা প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ মূল্য একশত পঞ্চাশ টাকাপ্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বইটি অনলাইন শপেও পাওয়া যাবে

 

 

 

 

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল

            

(দ্বিতীয় পর্ব)

 

উত্তরা-পূরবী-ঊজ্জ্বলা

 

ঊজ্জ্বলা




মা’র স্মৃতিচারণের খাতা থেকে জানতে পারলাম যে ১৮ই জুলাই ১৯৬০-এ আমাকে ‘সখের চোর  দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্ভবত এটিই আমার ‘দেখা’ প্রথম বাংলা ছবি, যদিও আমার কিছুই মনে  নেই! প্রেক্ষাগৃহ হয়তো কালিঘাট অঞ্চলে অধুনালুপ্ত ঊজ্জ্বলা, যেখানে উত্তরা ও পূরবীর সঙ্গে ছবিটি ঐ বছরের ৩০শে জুন মুক্তি পায়। সাম্প্রতিক ছবিটি আমার শ্যালকের কল্যাণে কম্পিউটারে দেখেছি। ইংরেজী ভাষায় কৌতুক রচনার সম্রাট পি জি উডহাউসের A Gentleman of Leisure (বিকল্প নাম The Intrusion of Jimmy) উপন্যাসের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি রূপান্তর। মুখ্য চরিত্রে উত্তমকুমার যথারীতি মুগ্ধ করেছেন। নায়িকা (বাসবী নন্দী)-র সঙ্গে তাঁর পরিণয়ের পথে দুই বাধা হিসেবে, নায়িকার বাবা (কমল মিত্র) আর নায়িকার ভগ্নীপতি (ছবি বিশ্বাস) তো দুজনেই তুখোড় অভিনেতা। এছাড়া সখের চোর উত্তমের পাশাপাশি পেশাদার চোর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপভোগ্য অভিনয় করেছেন।

বাবা ভারতীয় সৈন্যদলে থাকার জন্য ১৯৫৯ থেকেই আমাদের বাসস্থান ছিল বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের মধ্যে। এখান থেকে সবচেয়ে কাছে ছিল ভবানীপুর-কালিঘাট। আর সেখানকার বাংলা ছবির পাড়ায় রবিবার সকালে দেখানো হতো, পূর্ণ আর বসুশ্রীতে, ইংরেজী ছবি, ঊজ্জ্বলায় সাধারণত দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। ব্যতিক্রম-হিসেবে ঊজ্জ্বলা এক রবিবার আনে আমার দেখা প্রথম Western: ১৯৫৮ সালের The Lone Ranger and the Lost City of Gold । ‘লোন রেঞ্জার-এর কমিক্স বাড়িতে প্রচুর  ছিল, দাদা সেগুলোর থেকে ছবি দেখিয়ে আমায় গল্প বলতেন। তিনিই ছবিটি দেখতে আমায় নিয়ে যান, আমার বয়স তখন ৫ বা ৬। মনে আছে পর্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোন রেঞ্জারের সাদা ঘোড়া ‘সিলভার’  আর নেপথ্যে দরাজ গলায় গান হচ্ছে, “Hi yo Silver Away!” তারপর লোন রেঞ্জার সিলভারের পিঠে চেপে ধাওয়া করেছে আততায়ীদের, বার করেছে তার রূপোর বুলেট-ভরা রিভলভার, দাদা বলছেন, “দেখ, দেখ, লোন রেঞ্জার বন্দুক বার করেছে!” তার পরেই রিভলভারের নল দিয়ে ধোঁয়া আর “দুম!” কাহিনির মূল প্রতিপক্ষ এক মহিলা, যিনি স্বর্ণনগরের খোঁজে নিজের দলের লোককেও পেছন থেকে pickaxe ছুঁড়ে নির্দ্বিধায় খুন করেন! সবশেষে লোন রেঞ্জার আর তার লাল-মানুষ বন্ধু টোন্টো আবিস্কার করবে সোনার শহর! এক চমকপ্রদ দৃশ্য!

১৯৬৭-র আগস্টে ঊজ্জ্বলায় মা’র সঙ্গে দেখি বাংলা ছবির তিন কৌতুক-তারকা ভানু-জহর-হরিধন  অভিনীত মিস প্রিয়ম্বদা। তরুণকুমারের প্রেমিকা লিলি চক্রবর্তী। তাঁদের মধ্যে অন্তরায় মেয়ের মামা হরিধন। মামাকে রাজী করাতে লিলির গৃহশিক্ষিকা ‘মিস প্রিয়ম্বদা সেজে আসেন ভানু। হায়, ‘প্রিয়ম্বদা’ নিজেই প্রেমে পড়ে যান লিলির বান্ধবী দীপিকা দাসের! আর মামা হরিধন প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন ‘প্রিয়ম্বদা’-র! শেষে, ‘প্রিয়ম্বদা’ তাঁকে বিয়ে করবে, এই আশ্বাস পেয়ে মামা ভাগ্নীর  বিয়েতে মত দেন। জোড়া বিয়ের দিন গাঁটছড়া-বাঁধা ‘প্রিয়ম্বদা’-র দিকে পেছন ফিরে মামা যখন ভক্তিভরে ঠাকুর প্রণাম করছেন, সেই সুযোগে গাঁটছড়া খুলে চম্পট দেন ভানু, আর স্থানীয় ছেলেদের একজন (নাকি জহর রায়? ঠিক মনে নেই!) মামার গাঁটছড়ায় বেঁধে দেয় একটি তরুণ কদলী! উদভ্রান্ত মামাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আর তরুণ-লিলির বিয়ে হয়ে যায়। ছবিটি কিন্তু তেমন দর্শকানুকূল্য পায়নি। যেদিন দেখতে যাই, হয় সেদিনই, বা অব্যবহিত পরে প্রিয়ম্বদা-কে তুলে নিয়ে, নতুন ছবি আনার আগে কিছুদিনের জন্য দেখলুম আনা হবে, সেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, ১৯৫৮ সালের পুরনো ছবি।

ঐ ১৯৬৭তেই দেখেছি সেই ঊজ্জ্বলায় ‘৮০তে আসিও না’। আমার দেখা বাংলা হাসির ছবির মধ্যে  বোধহয় এটিকেই আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বলব (জানুয়ারীতে মুক্তি পায়)। বৃদ্ধ পিতামহ ভানু এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পুকুরের জলে পড়ে গিয়ে তাঁর যৌবন ফিরে পাবেন, যার ফল তাঁর পরিবারের পক্ষে হবে দর্শকের পক্ষে দম-ফাটা হাসির খোরাক। ভানুর দুই পুত্রের চরিত্রে কমল মিত্র এবং অসিতবরণ, ভানুর বিমূঢ় স্ত্রী রুমা গুহঠাকুরতা। এছাড়া আছেন জহর রায়, রবি ঘোষ, তরুণকুমার, শ্যাম লাহা প্রমুখ। অবশ্য শেষে দেখব সবটাই সংসারে অবহেলিত, পূত্রবধূ / নাতিদের দুর্ব্যবহারের শিকার ভানুর স্বপ্ন!১৯৬৭ সাল নাগাদ আমার ইস্কুল সেন্ট লরেন্সে আমাদের থেকে উঁচু ক্লাসে পড়া এবং এখন প্রয়াত রমাপ্রসাদ বণিক ইস্কুলে সাড়া ফেলে দেন ‘পান্না ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় ক’রে। মার্ক টোয়েনের ‘টম সয়ার’ উপন্যাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত এই দারুণ ছবিটিতে ডাকাত অঘোর সর্দারের  ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত শম্ভু মিত্র। দশ বছর বয়েসে তাঁকে ওই চেহারায় এত ভয়ঙ্কর লেগেছিল যে পরে অন্য অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখে বিশ্বাস হয়নি যে তিনিই সেই খুনে ডাকাত! ছবিটি দেখি ঊজ্জ্বলায়। এরপর, বোধহয় ১৯৬৮-তে ইস্কুল থেকেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি  দেখানোর ব্যবস্থা হয়। তখন ওটি দ্বিতীয়বার দেখি।

১৯৭১-এ প্রথম বাংলা ছবি ঊজ্জ্বলায় ‘ধন্যি মেয়ে’, এবং জয়া ভাদুড়ীর চেয়েও নজর কেড়ে মুগ্ধ করেছিলেন হাসির চরিত্রের ভূমিকায় উত্তমকুমার! ফুটবল-পাগল বড় ভাই, ঘুমে মহাদেব এবং হবু-বেয়ানের (যদিও শেষ অবধি বগলা-রূপী ভাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে হবে মনসা-রূপী জয়া ভাদুড়ীর সঙ্গে!) সঙ্গে খেলতে-খেলতে মারবেন শট, খাট থেকে ছিটকে পড়বেন স্ত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, আর তারপর স্বামীর প্রশ্নের – “তুমি পড়লে কি করে?” – উত্তর দিতে লজ্জাবোধ করবেন। উত্তমকুমারের টিমের কাছে এক ডজন গোল খেয়ে হাড়ভাঙা গ্রামের ক্ষিপ্ত জমিদার ন্যাংটেশ্বর চৌধুরীর ছেলে (রূপায়ণে জহর রায়) বন্দুক উঁচিয়ে বগলার বিয়ে দেবেন ভাগ্নী (বা ভাইঝি) মনসার সঙ্গে, বিয়েতে তোতলা পুরোহিত রবি ঘোষ (তিনি ম্যাচের রেফারীও ছিলেন) মন্ত্রের লং-প্লে রেকর্ড বাজাতে গিয়ে ভুল করে যেদিকে বিয়ের মন্ত্র আছে, তার বদলে উল্টোদিকের শ্রাদ্ধের মন্ত্র বাজাবেন, এই জবরদস্তী বিয়েকে ভাসুর উত্তমকুমার আখ্যা দেবেন “অফসাইডে গোল!” – এককথায় অনবদ্য!

আর একটি বিশেষ ‘এপিসোড’ চিনতে পেরে মজা পেয়েছিলাম। মনে করুন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের  অসুস্থতার জন্যে বাড়ীতে ডেকে আনা হয়েছে ডাক্তাররূপী তরুণকুমারকে। রুগীর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পর মাঝে-মাঝেই দরজা খুলে ডাক্তার চাইছেন হাতুড়ী, করাত, শাবল। ক্ষেপে গিয়ে উত্তমকুমার হুংকার ছাড়লেন, “বৌটাকে কেটে ফেলবে নাকি!” প্রত্যুত্তরে ডাক্তার, “আরে দূর মশাই! ওসব চাইছি আমার ব্যাগটার জন্যে! কিছুতেই খুলতে পারছি না যে!” এতো পূজাবার্ষিকীতে পড়া শিবরাম চক্রবর্তীর ‘রাম-ডাক্তারের ব্যায়রাম’! তাছাড়া এ ছবিতে আছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! এতে অবশ্য উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দী দেখিনি!

আমার মা ছিলেন শ্রীঅরবিন্দের ভাবধারার অনুগামিনী। এর জন্যে একাধিকবার তিনি গেছেন পণ্ডিচেরীর আশ্রমে। ১৯৬৯ সালে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অতএব ৭১-এর অক্টোবরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মহাবিপ্লবী অরবিন্দ’ তো ঊজ্জ্বলায় দেখতেই হবে! ছবিটি দর্শকানুকুল্য পায়নি, এবং  বোধহয় শেষ দিনেই দেখতে যাওয়া হয়েছিল। ঢোকার সময় উৎসাহিত হলাম দেখে যে সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! তাঁর কণ্ঠে ছিল একাধিক গান, ‘বন্দে মাতরম’, রবীন্দ্রসঙ্গীত, এবং সুনীলবরণের লেখা দেশাত্মবোধক গান। কিন্তু ছবিটি মনে ধরেনি কারুরই, কারণ পরিবারের ঝোঁক ছিল ঋষির  আধ্ম্যাতিক জীবনের দিকে, আর ছবিটি, বাণিজ্যিক কারণেই, জোর দিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা নিয়ে। সেখানে, বাঈজী শমিতা বিশ্বাসকে স্বদেশী আন্দোলেনের সঙ্গে যুক্ত করা, তার জন্যে অত্যাচারী পুলিস অফিসার শেখর চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তার লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হওয়া, এসব ঠিক মনে ধরে নি, আর এসব দেখিয়েও ছবিটি বাজার পায়নি।

সত্তরের দশকে, মা’র উৎসাহেই ঊজ্জ্বলায় দেখেছিলাম প্রাক-উত্তম যুগের ছবি ‘শেষ উত্তর’, অভিনয়ে প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, যমুনা বড়ুয়া, অহীন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ। কানন দেবীর ভক্ত হিসেবে তাঁর অভিনয় ও স্বকণ্ঠে গান (ছোটবেলা থেকে রেকর্ডে শোনা ‘তুফান মেল’, ‘লাগুক দোলা’, আর আমার কাছে সর্বোপরি ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে এঁকে থাকো কারও ছবি’) খুব ভালো লেগেছিল। এর  বাড়া নজর কেড়েছিলেন এক আপাত উগ্র-আধুনিকা অথচ অন্তরে আত্মত্যাগী, হৃদয়বতী মহিলার ভূমিকায় যমুনা বড়ুয়া।

সম্ভবত ১৯৭৬-এ মধ্য কলকাতা ছেড়ে লবণ হ্রদ / বিধান নগরে বাড়ি বদলাবার আগেই ঊজ্জ্বলায় রবীন্দ্রজয়ন্তীর মাসে আমার এক পিসতুতো বোনের সঙ্গে দেখেছিলাম ১৯৫৭ সালের ‘কাবুলিওয়ালা’, নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস এবং পরিচালনায় তপন সিংহ।

উত্তরা




১৯৮০তে হাতিবাগান-শ্যামবাজারে অধুনালুপ্ত উত্তরায় দেখেছিলাম তপন সিংহের ‘বাঞ্ছারামের বাগান’।  সম্পূর্ণ নতুন ধরণের, অভিনব গল্প, আর মনোজ মিত্রের অবিস্মরণীয় অভিনয় নাম-ভূমিকায়! অবাক এবং বিরক্ত হয়েছিলাম যখন শুনলাম যে এই ছবিতে অভিনয়ের জন্যে পুরষ্কার পেয়েছেন ন’কড়ি-ছ’কড়িরূপী দীপঙ্কর দে! আর খুব কষ্ট হয়েছিল যখন জানলাম যে উক্ত দু’টি চরিত্র করার কথা ছিল উত্তমকুমারের! উত্তম-মনোজের যুগলবন্দী বাংলা ছবিতে ইতিহাস সৃষ্টি করত! তবে মাধবী দেবী বড্ড মোটা দাগের ভাঁড়ামি করেছিলেন, যা রবি ঘোষ, নির্মলকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়দের পাশে বেশ বিসদৃশ লেগেছিল।

পূরবী




১৯৮৯-তে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, এবং তখন আমারই মতো অধ্যাপনা-রত, স্বপন শীলের সঙ্গে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে পূরবী সিনেমায় দেখি সতীদাহ নিয়ে ছবি ‘অন্তর্জলি যাত্রা’। ছবির অভিনবত্ব, বাংলা সিনেমায় শত্রুঘ্ন সিংহের উপস্থিতি। তা’তে অবশ্য, বন্ধুবরের ভাষায়, অন্তর্জলি জলাঞ্জলিতে পরিণত হওয়া আটকায়নি! মিনারে ‘সতী’ দেখে এর আগের পর্বে যা লিখেছিলাম তাঁর পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হচ্ছিঃ সতীদাহের মতো জ্বলন্ত বিষয় নিয়ে দুই ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ ছবির পরিচালক যে কীভাবে দুটি দেখার অযোগ্য ছবি বানালেন তা সত্যিই সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের উদ্রেক করে!

আজ এই পর্যন্ত। এর পরের পর্বে শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা।

 

(ক্রমশ)