ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ১৬
কোডি শহর যেমন ইয়েলোস্টোনের পূবদিকের গেট থেকে ঘন্টাখানেকের পথ, গার্ডিনার তেমন নয়। ইয়েলোস্টোনের উত্তরের গেটের একেবারে গা ঘেঁষা শহর হলো গার্ডিনার। ওয়াশবার্ন পাহাড়ের ধার ঘেঁষে চলেছে বাজ। পাশ দিয়ে বইছে ইয়েলোস্টোনে নদী । ম্যামথ হট স্প্রিংস পেরোলেই ওয়ায়োমিং পেরিয়ে নতুন রাজ্য মন্টানা। ওয়ায়োমিং শব্দের অর্থ বিস্তীর্ণ তৃণভূমি (The large prairie place) আর মন্টানা শব্দের অর্থ পার্বত্য অঞ্চল ।এই দেশে মন্টানাকে আরও অনেক নামে ডাকা হয় যেমন "Big Sky Country", "The Treasure State", "Land of the Shining Mountains", অথবা "The Last Best Place." নামেই বর্ণিত এই রাজ্যের চোখজুড়োনো রূপ ।
জনসন গার্ডিনার নামে এক চামড়া আর পশম ব্যবসায়ীর নামাঙ্কিত এই শহর। গার্ডিনার ১৮২০ -৩০ দশকে এই অঞ্চলে বিভার এবং উদ্বিড়াল শিকার করতেন এবং তার চামড়া আর পশম বিক্রি করতেন আমেরিকান ফার কোম্পানিকে।এই গার্ডিনারকে আরিকারা প্রজাতির নেটিভ আমেরিকানরা বন্দি করে, খুলির চামড়াসহ চুল চেঁছে (scalping) নিয়ে, তাকে জ্যান্ত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল। এটা ছিল তাদের প্রতিশোধ। অরিকারারা বলত রক্ত প্রতিশোধ ( Blood revenge )। এর কয়েকবছর আগে গার্ডিনার ঠিক এক ভাবে দুজন আরিকারাকে হত্যা করেছিলেন।
নেটিভ আমেরিকানরা বলত 'জীবন কি? জীবন হলো রাতের অন্ধকারে জোনাকির রোশনাই, প্রচণ্ড শীতে বাইসনের নিশ্বাসের ওম, এই বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে একটা ছোট্ট ছায়া যেটা ঘাসের ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে সূর্যাস্তে হারিয়ে যায়।'
রুজভেল্ট আর্চ পেরিয়ে গার্ডিনার শহরে ঢুকতেই একটা পেট্রল পাম্প আর তার লাগোয়া একটা সাবওয়ে স্যান্ডউইচের দোকান। সেই সকালে ব্রেকফাস্টের পরে আর কিছু খাওয়া হয়নি। বাজকে খাইয়ে দাইয়ে আমি যথারীতি একটা টমেটো, লেটুস, পেঁয়াজ আর হানি মাস্টার্ড দেওয়া টুনা স্যান্ডউইচ অর্ডার করলাম। সেটিকে দুভাগে কেটে প্যাক করে দিতে বললাম। এক ভাগ এখন, বাকি ভাগে ডিনার। ঋজু বলেছিলো আমি যেন ডিনার প্যাক করে নিয়ে লামার ভ্যালিতে চলে যাই সূর্যাস্তের সময়। সে নাকি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা । আমিও তেমনটাই ঠাউরেছি ... তাই অমন স্যান্ডুইচ প্যাকের পরিকল্পনা । হোটেলের পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম গত কয়েকদিনের ভ্রমণকালীন অসামান্য সঞ্চয়ের কথা। এ হল সারাজীবনের সঞ্চয় ।
'শেষবার নামার আগে সমস্ত জিনিসপত্রগুলি
তালিকা
মিলিয়ে নিতে হবে। এবার ভ্রমণকালে
প্রচুর
সংগ্রহ হ’লো, মিনে-করা আগ্রার ফুলদানি,
জরির
চপ্পল, দ্রুতগামী মেল ট্রেনে সচকিত
ভ্রূ-পল্লব,
কী-কী ফেলে গেলে বাড়ি ফিরে দুঃখ হবে?
যে
আমগাছের ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসা অসম্ভব
তা-ও
বুঝি অজানিত হোল্ড-অলে বাঁধা হয়েছিলো,
আমগাছের
ছায়ার ওজন জানা নেই, তাই রেলে
বুকিং
সম্ভব নয়, ভ্রূ-ভঙ্গির কুলি ভাড়া নেই।
মিলিয়ে
নামতে হবে বাড়ি ফিরে জরির চপ্পল,
ভ্রূ-পল্লব,
আমের ছায়ার পাশে আগ্রার ফুলদানি।'
বিকেল নাগাদ চা বিস্কুট খেয়ে, দূরবীন, হাফ স্যান্ডুইচ আর ফ্লাস্কে চা নিয়ে চললাম লামার ভ্যালি। লামার হলো ইয়েলোস্টোনের শাখানদী। আবসরোকা পর্বতমালায় এ নদীর জন্ম। তারপর উত্তর পশ্চিম পানে প্রায় ৪০ মাইল বয়ে টাওয়ার জংশনে এসে সে ইয়েলোস্টোন নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। এই নদীতে নাকি কিলবিল করে ট্রাউট আর কাট থ্রোট মাছ। আর সেই মাছ ধরতে দূরদূরান্ত থেকে আসে বহু মানুষ। এই নদী যার নামে তার পুরো নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত খুলে আসার জোগাড়! Lucius Quintus Cincinnatus Lamar! ভদ্রলোক এই এলাকার চিফ সেক্রেটারি গোছের আমলা ছিলেন। ভাগ্যি ভালো নদীর ওপর শুধু পদবীটুকুই চাপিয়েছেন।
বাজের সঙ্গে আবার ফিরতি পথে গেলাম ম্যামথ হট স্প্রিংস। সেখান থেকে পূবপানে গ্র্যান্ড লুপ রোড ধরে ২০ মাইল আর তার পরে US-212 E এলেই বাঁ দিকে গোত্তা মেরে ৫ মাইল গেলেই লামার ভ্যালি। বাজের মনে হলো এ পথ মুখস্থ। কত সব আশ্চর্য্য জায়গা চোখে পড়ল ... লাভা ক্রিক, গার্ডিনার নদী, অক্সবো ক্রিক, ফ্যানটম লেক, ফ্লোটিং আইল্যান্ড লেক, এল্ক ক্রিক, লস্ট ক্রিক। কোথাও পাহাড়, কোথাও নদী, কোথাও হ্রদ, কোথাও তৃণভূমি, কোথাও শস্যক্ষেত। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে সূর্যাস্ত হয়ে গেলে হোটেলে ফিরে যাবো। গতকালের অভিজ্ঞতার কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত আমি। এক মায়াবী পথ ধরে চলেছি, দেখি এক বিশাল প্রান্তর দিয়ে বয়ে চলেছে লামার নদী। দুইপাশে ঘাসবন আর সেজব্রাশের ঝোপ। নদীর তীরে মাছশিকারী পাখিদের অপেক্ষা। আকাশে এক অপূর্ব গোধূলির আলো ...
'এ নদীও ধলেশ্বরী নয় যেন- এ আকাশ নয় আজিকার:
ফণীমনসার
বনে মনসা রয়েছে না কি?- আছে ; মনে হয়,
এ
নদী কি কালীদহ নয়? আহা, ঐ ঘাটে এলানো খোঁপার
সনকার
মুখ আমি দেখি না কি? বিষণ্ন মলিন ক্লান্ত কি যে
সত্য
সব; -তোমার এ স্বপ্ন সত্য, মনসা বলিয়া গেল নিজে।'
পথে কত যে বাইসন দেখলাম তা আর গুনে শেষ করা যায় না। তারা এই প্রান্তরে নিশ্চিন্ত মনে রয়েছে। ন্যাশনাল পার্কে কেউ তাদের আর বন্দুকের নিশানা করতে পারবে না। মা-ন্যাওটা বাছুরগুলি সোনালী রঙের আর বেশ চঞ্চল।এছাড়া দেখলাম অনেকগুলি প্রঙ্গহর্ন যারা কিনা ভেড়া আর হরিণের থেকে অন্যতর প্রাণী। পুরুষ প্রঙ্গহর্নের মাথার শিঙ কাঁটা চামচে মত বাঁকানো। তারা পথের ধারে দাঁড়িয়ে বেশ উৎসুক হয়ে বাজকে দেখছিলো। মেয়েগুলি কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে ঘাস খাচ্ছিলো।
সূর্যাস্তের সময় হয়ে আসছে। আমি বাজকে নদীর ধারে ঘাসজমি ঘেঁষে দাঁড় করলাম। মিঠে বাতাস বইছে। আমি এখন সূর্যমুখী… তবে আলো নরম হয়ে এসেছে তাই তার তাপে, তার স্পর্শে বড় আর একটা সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়ছে ঘাসের ওপর। আমি কোলে ন্যাপকিন পেতে হাফ স্যান্ডুইচ হাতে চেয়ে রয়েছি। খুব কম গাড়ি চলছে এখন এই রাস্তায়। আমার খানিক দূরেই একটা বাইসন মুখ নীচু করে ঘাস খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে তাকাচ্ছে। তার পিঠে কয়েকটি পাখি বসে রয়েছে। আর অন্য কয়েকটি পাখি তার ওপড়ানো ঘাসমাটিতে খাবার খুঁজে চলেছে।আকাশে একটা নরম কমলাভ ডিমের কুসুম পাহাড়ের পেছনে লুকিয়ে পড়ার আগে নদীর জলে মুখ দেখতে এসেছে। আমার হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে... তীরের পাখিগুলি পাখা মেলছে ঘরে ফেরার তাগিদে। একাকী বাইসনের তেমন কোনো তাগিদ নেই। সে আত্মনিমগ্ন। সোনালী আর কমলায় মাখামাখি হয়ে নদীর জল স্পর্শ করে যাচ্ছে তীরবর্তী পাথরগুলি। তার শব্দ আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে...
'এই
জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে
আমার দেহ — বুলায়ে দিয়েছে চুল — চোখের উপরে
তার
শান — স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, — আবেগের ভরে
ঠোঁটে
এসে চুমা দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;
এই
জল ভালো লাগে; — নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে
ফিঙ্গা
যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে — বনের ভিতর
বার
বার উড়ে যায়, — তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে
আমার
দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে'
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন