বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত : কিম
কি–দুক ও অদিতি ফাল্গুনী
বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের ধারা শুরু হয়েছে সেই মধ্যযুগ থেকে। বিচিত্র পথ পাড়ি দিয়ে এখনও অনুবাদ চলছে এবং প্রতিনিয়ত অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হচ্ছে। প্রধানত সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এই যাত্রা শুরু হয়েছিলো। পর্যায়ক্রমে ফারসি, হিন্দি, আরবি তারপর বিপুল আয়তনে ও পরিসরে ইংরেজি, এরপর ফরাসি, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দূরপ্রাচ্যদেশীয় ভাষা এবং বলা যায় পুরো পৃথিবীর নানান ভাষা থেকেই বাংলায় অনুবাদ কর্ম চলেছে। সম্প্রতি অনুবাদ সাহিত্যের বর্ণাঢ্য ধারায় নতুন এক দেশ নতুন মাত্রা নিয়ে যুক্ত হয়েছে অদিতি ফাল্গুনীর মাধ্যমে। বিখ্যাত কোরিয় চিত্রপরিচালক কি ম কি–দুক এর ভুবনখ্যাত চলচ্চিত্র 'বসন্ত,গ্রীষ্ম, শরৎ,শীত... এবং বসন্ত' (‘স্প্রিং, সামার,অটাম,উইন্টার... অ্যান্ড স্প্রিং') এর চিত্রনাট্য ইংরেজি ভাষা থেকে অদিতি ফাল্গুনী বাংলায় রূপান্তর করেছেন। সরাসরি কোরিয় ভাষা থেকে না হলেও এতে বাংলা সাহিত্যে সঞ্চারিত হয়েছে কোরিয় সৌরভ।
অদিতির যাত্রা শুরু হয়েছিলো গল্পকার হিসাবে প্রায় কৈশোরে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি নিজেকে নিজেই অতিক্রম করেছেন, বহুমাত্রিক করেছেন। সৃজনশীল সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি মননশীল সাহিত্য ধারাতেও সমান সৃষ্টিশীল এবং প্রসিদ্ধ। বহুবিচিত্র লেখালেখির মধ্যে অদিতির অনুবাদকর্ম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কবিতা রচিত হওয়ার পর সেই কবিতাটি একান্তভাবে কবিরই। কিন্তু একটি গানের বাণী রচিত হওয়ার পর এতে যখন সুর আরোপিত হয় তখন এতে সুরকারেরও অধিকার তৈরি হয়। একই কথা প্রযোজ্য অনুবাদের ক্ষেত্রেও। অনূদিত সাহিত্য কেবল মূল লেখকের না, এটি একই সাথে অনুবাদকেরও। অদিতির অনুবাদ অদিতিরই সাহিত্য। কারণ তাঁর অনুবাদ আক্ষরিক নয়। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করছি কবি চন্দ্রাবতীর কথা। তাঁর অনূদিত 'রামায়ণ' কার্যত হয়ে উঠেছিলো 'সীতায়ণ'। অদিতি ফাল্গুনীর অনূদিত জেন বৌদ্ধ–দর্শনের গভীর বাণী সংবলিত 'বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁরই। অদিতি ফাল্গুনীর এই অনূদিত গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত পরিসরে রয়েছে কিম কি–দুক-এর পরিচিতি। পরের অধ্যায়ে আছে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, যার নাম দিয়েছেন তিনি ‘আখ্যানরেখা’। নামকরণেও দেখা মেলে অদিতির স্বকীয়তা। তারপরের অধ্যায়ে রয়েছে দুটি সাক্ষাৎকার। এরপর রয়েছে কিম কি–দুক-এর অন্য আরেকটি চলচ্চিত্রের রিভিউ। সবশেষে পরিশিষ্ট অংশে আছে এই চলচ্চিত্রকারের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি কবিতা।
প্রথম অধ্যায়টি
সংক্ষিপ্ত হলেও কিম কি– দুক এর সম্পূর্ণ পরিচয়ই এখানে আছে। কারণ অদিতির বয়াণ নির্মেদ এবং যথাযথ। দ্বিতীয় অধ্যায়টি
উপলক্ষ্য করেই এই গ্রন্থটির সূত্রপাত। এই অধ্যায়টিও সংক্ষিপ্ত। এবং একটিও অপ্রয়োজনীয় শব্দ নেই এই আখ্যানরেখায়। সত্যি বলতে কী আমার খুব আফসোস হচ্ছে কেন আরও আগে অদিতি এই চিত্রনাট্য অনুবাদ
করেননি এই ভেবে। বেশ কয়েকবার দেখা, নানান প্রতীকচিহ্ন সংবলিত এই চলচ্চিত্রের কিছু কিছু জায়গায় খানিকটা দুর্বোধ্যতা
এবং দ্ব্যর্থতা আমার রয়েই গিয়েছিলো। এই অনুবাদ আমার
সব অস্পষ্টতা দূর করে দিলো। নির্দ্বিধায় বলা যায় এই অনুবাদটি
পড়ার পরে বাংলা ভাষাভাষী অনেক পাঠক নতুন করে এই চলচ্চিত্রটি দেখতে আগ্রহী হবেন। বৌদ্ধ, জেন, শিন্টো ধর্ম ও
দর্শনে অদিতির গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। 'গৌতম বুদ্ধ' নামে তাঁর একটি মৌলিক
গ্রন্থ রয়েছে। অসংখ্য অনূদিত জেন গল্প আছে তাঁর। সম্প্রতি 'বুদ্ধ অথবা কার্ল মার্কস' শিরোনামে অদিতির একটি গ্রন্থ
প্রকাশিত হয়েছে। এটিও তাঁর অনূদিত গ্রন্থ এবং বিষয় হিসাবে এটি চমকপ্রদ এবং নতুন। সুতরাং বলা যায়
এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবন কাহিনি কেন্দ্র করে রচিত ‘বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যটি
অদিতির ফরমায়েশি সাহিত্যকর্ম নয়। এটি তিনি ভালোবেসেই অনুবাদ করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠকের সম্মুখে নতুন একটি
দ্বার খুলে দিয়েছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবন চক্র এখানে চিত্রিত হয়েছে চার ঋতুচক্রকে কেন্দ্র করে।
অদিতি ফাল্গুনী |
কিম কি–দুক নিজেই স্বীকার করেছেন যে তাঁর চলচ্চিত্রে লোকেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি অপার্থিব সৌন্দর্যমণ্ডিত হ্রদের উপর নির্মিত ভাসমান বৌদ্ধবিহার এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে চিত্রায়িত এই চলচ্চিত্রের নান্দনিক এবং প্রাকৃতিক অনন্য সেলুলয়েডের ভাষিক আমেজের সাক্ষাৎ মিলবে অদিতির অনুবাদে। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত বৌদ্ধধর্ম এবং প্রাচ্য দেশীয় বিভিন্ন প্রতীক ও ইঙ্গিতের অর্থ স্পষ্টীকরণে অদিতির লেখক হিসাবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। এর পরের অধ্যায়ে রয়েছে যথাক্রমে 'ইন্ডিওয়্যার' পত্রিকায় প্রকাশিত রায়ান মোট্টেশিয়ার্ডকে দেয়া কিম কি–দুক-এর সাক্ষাৎকার এবং কিম জ্যে–হিউনকে দেয়া কিমের অন্য আরেকটি সাক্ষাৎকার। দুইটি সাক্ষাৎকারই সংক্ষিপ্ত আয়তনের। কিন্তু এখানে পাওয়া যাবে কিম কি–দুক-এর চলচ্চিত্রের পূর্বাপর। রায়ান মোট্টেশিয়ার্ড-এর নেয়া সাক্ষাৎকারটি 'বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে এবং কিম জ্যে–হিউনের সাক্ষাৎকারটি কিম কি–দুক-এর চলচ্চিত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে। রায়ানের বয়ানে কিম কি–দুক বলছেন –“আমি মনে করি যে কত মানুষ ‘বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' দেখেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো কারা এটা দেখেছে। আমার কথা হলো বরং কম মানুষ এই সিনেমাটি দেখুক, তবে দেখে যেন তারা এটা বোঝে।” লেখক হিসাবে অদিতি ফাল্গুনীরও লক্ষ্য ঠিক এমনই এবং শিল্পের প্রশ্নে তিনিও আপোষহীন। আরেক জায়গায় কিম বলছেন — “'বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' সিনেমায় আমি ক্ষমা ও সহনশীলতার উপশমকারী গুণের দিকটিই দেখাতে চেয়েছি।”
এই সাক্ষাৎকার পাঠে চলচ্চিত্রটির উদ্দেশ্য পাঠক এবং দর্শকের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং বৌদ্ধদর্শন হৃদয়ঙ্গম সহজতর হবে। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারে কিম পরিচালিত বাইশটি সিনেমার মধ্যে 'ক্রোকোডাইল', 'সামারিটান গার্ল', 'থ্রি আয়্ রন', ‘পিয়েটা', 'স্টপ', 'প্যান্ডোরা', 'কল অফ গড', 'ব্যাড বয়' সহ অপরাপর সিনেমা নিয়েও কিম কথা বলেছেন। এখানেই জানা যায় কিম নিজেই তাঁর সিনেমাগুলোর অর্থলগ্নীকারী। সে কারণে অন্যান্য পরিচালকের চেয়ে কিমের স্বাধীনতাও ছিলো কিছুটা বেশি। সাক্ষাৎকারের প্রায় শেষে এসে কিম বলেছেন – “আমি আমার ছবিতে কোনো মিথ্যা কথা বলতে চাই না। প্রতিবারই যখন আমি একটি নতুন সিনেমা রিলিজ করি, আমি যেন একটু হলেও নিজের উত্তরণ ঘটাই।” চলচ্চিত্রের পাশাপাশি এভাবে চলচ্চিত্রকারকেও পাঠকের চেনা হয়ে উঠে।
মাহমুদা পারভীন |
সর্বশেষ সিনেমা ‘রেইন, স্নো, ক্লাউড অ্যান্ড ফগ' এর কাজ কিম শেষ করে যেতে পারেননি। লাটভিয়ায় এই সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ মাত্র ৫৯ বছর বয়সে কিম কি–দুক অকালে প্রয়াত হন। ফলে এই সিনেমাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
সর্বশেষ অধ্যায়ে কিম কি–দুককে নিয়ে রচিত, পিয়াস মজিদ এর ‘শুভ পৃথিবী’ নামে একটি কবিতা সংযুক্ত হয়েছে। কিমের ‘'বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত... এবং বসন্ত' চলচ্চিত্রকে উপলক্ষ্য করে রচিত হয়েছে এই কবিতা। কবিতার সংযুক্তি গ্রন্থটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
একটি চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন রচনার সুসমন্বয়ে নির্মিত এই গ্রন্থে এর ফলে সম্পূর্ণ কিম কি-দুক-এর সাক্ষাৎ মেলে। আর গ্রন্থটি সার্থক ও সুখপাঠ্য হওয়ার ক্ষেত্রে অনুবাদক অদিতি ফাল্গুনীর ভূমিকা অসামান্য।
‘বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ,শীত... এবং বসন্ত' বইটির প্রকাশক 'ঐতিহ্য', ঢাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য একশত পঞ্চাশ টাকা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৩। বইটি অনলাইন শপেও পাওয়া যাবে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন