সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী
১৯৪৫
(৪)
১৯৬০-৭০ সাল:
১৯৬১ সালে অতুল সেন যিনি এম.পি-ও ছিলেন হঠাৎ বললেন শৈলমারি আশ্রমে তিনি নেতাজিকে দেখেছেন। শৈলমারী আশ্রমের সারদানন্দ জি মহারাজ নাকি নেতাজি। এবার বক্তব্য হলো ৫-৬ বছর আগে যে নেহেরু পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছেন, সুভাষ বসু প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছেন, তিনি হঠাৎ নড়ে চড়ে বসলেন এবং সুরেন্দ্রমোহন ঘোষালকে শৈলমারি পাঠালেন সত্যতা যাচাই-এর জন্য এবং পরবর্তীতে তিনি এসে বললেন, না, সারদানন্দ জি নেতাজী নন। এবার বক্তব্য হলো নেহেরু যদি এতটাই নিশ্চিত হন যে সুভাষ বসু মারা গেছেন তাহলে হঠাৎ সরকারীভাবে সুরেন্দ্রমোহনকে কেন পাঠালেন? তার মানে এটাও কি তাঁর কোনো চাল ছিল, না তিনি এক প্রকার ভয় পেয়েছিলেন? পরবর্তীকালে লীলা রায়-এর সঙ্গে যখন সুভাষ বসুর দেখা হয় তখন তিনি জানান নেহেরু খুব ভালোভাবেই জানেন তিনি মরেননি এবং একপ্রকার তাঁকে অপমানিত করতেই এই সারদানন্দ মহারাজের গল্পটি ফাঁদেন নেতাজীর গতিবিধি যাচাই করতে। বলাই বাহুল্য সারদা দেবী ছিলেন নেতাজির দ্বিতীয় মা, যিনি ছোট থেকে ওনাকে দেখাশুনা করতেন। তাই ইচ্ছে প্রণোদিতভাবে সারদানন্দ নামের সাথে তাঁকে জড়িয়ে তাঁর মাকে নেহেরু অপমান করেছেন। লীলা রায়ের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি নেতাজীকে জিজ্ঞেস করেন, কেন তিনি সর্বসমক্ষে আসছেন না! নেতাজি উত্তরে জানান, তিনি আসলে তাঁর দেশের মানুষেরই অসুবিধা কারণে, কেননা কংগ্রেস আল্যায়েড ফোর্সের সঙ্গে তেমনই চুক্তি করে রেখেছে (আগের অংশে এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে)।
এস এম গোস্বামী বলেন, ১৯৬২ সালে চিন যখন ভারত আক্রমণ করে তখন চিন কোনরকম সীমানা দখল না করেই হঠাৎ সিজ ফায়ার ঘোষণা করে চলে যায়। তাঁর মতে, নেতাজি ইচ্ছা করেই এই আক্রমণ করে ভারতকে বোঝানোর জন্য যে আমেরিকা ও ব্রিটেনের উপর ভরসা না করে এবার সময় এসেছে নিজেদের সামরিক শক্তি উন্নত করার। শুধু তাই নয় দেশবাসী যুদ্ধের সময় খাবারের জন্য যখন হন্যে হয়েছিল নেতাজীর উদ্যোগেই জাপান থেকে চাল আসে এবং ভারত সরকার সেই চাল সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে কিছুটা দুর্ভিক্ষ রুখতে সক্ষম হয়।
১৯৬৬ সালে তাসখন্দ ঘটনা সম্পর্কে আপনারা অনেকেই কম বেশী অবগত, সাম্প্রতিক কালে কিছু ফাইল ডিক্লাসিফাই করেছে সরকার এবং তার উপর ভিত্তি করে তাসখন্দ ফাইলস নামে একটি সিনেমাও বেরোয়। সরকার ফাইল ডিক্লাসিফাই করার পর বহু প্রিন্ট মিডিয়া এই নিয়ে লেখালিখিও করে। ঘটনা হলো লালবাহাদুর শাস্ত্রী রাশিয়া থেকে ফোন করে তাঁর পরিবারকে জানান, তিনি এমন কিছু জিনিস জানতে পেরেছেন যা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে দেবে এবং তিনি ভারতে এসে এই ঘটনা জনসমক্ষে আনবেন। বাড়িতে কথা বলার ৩০ মিনিট পর তাঁর বাড়িতে ফোন আসে যে লালবাহাদুর শাস্ত্রী মারা গেছেন এবং পরবর্তীকালে জানা যায় তিনি নাকি হার্ট এ্যাটাক-এ মারা গেছেন। সেই সময় থেকেই শাস্ত্রী মহাশয়ের বড় ছেলে অনিল শাস্ত্রী বলে আসছেন, তাঁর বাবার মৃত্যু কোনো প্রাকৃতিক মৃত্যু নয় এবং এই নিয়ে সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার, কারণ মৃতদেহ দেশে ফিরলে তাঁরা দেখেন বডি প্রচণ্ড ফুলে গেছে এবং মুখ কালো হয়ে গেছে, তাই তাঁরা মনে করেন তাঁর বাবাকে বিষক্রিয়া করে মারা হয়েছে, কারণ তিনি নেতাজির সঙ্গে দেখা হওয়ার খবর দেশবাসীকে জানাতে চেয়েছিলেন। বারংবার তদন্তের দাবি করা সত্ত্বেও বলাই বাহুল্য কংগ্রেস সরকার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি সেই বিষয়ে। লন্ডনে বসবাসকারী সিদ্ধার্থ সতবাই স্পেকট্রা সল্যুশন বলে একটি কোম্পানিকে কাজে লাগান পরবর্তী কালে, শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে ফটোতে যে ব্যক্তিকে নেতাজি বলে মনে হচ্ছে তিনি আদৌ নেতাজি নাকি সে বিষয়ে তদন্ত করার জন্য। নেইল মিলার নামে একজন ফেস রিকগনিশন স্পেশালিস্ট এই কাজ করেন এবং তিনি জানান ফেসিয়াল ম্যাপিং, হাইট অ্যানালিসিস সহ যাবতীয় পরীক্ষা করে তিনি ৬২ পাতার রিপোর্ট জমা দেন এবং বলেন এই তাসখন্দ ব্যক্তির সাথে নেতাজির সম্পূর্ণ মিল আছে, হয়তো বা উনি স্বয়ং নেতাজিই।
সুতরাং পাঠক এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারছেন যে, ১৯৬০-৭০ সালে নেতাজির কার্যকলাপ এবং এছাড়াও আগের ধারাবাহিকে আমরা জেনেছি এই সময়কালে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে হো চি মিনকে বলেন অ্যামেরিকান সৈন্যদের উপর কীভাবে ড্রাগ বর্ষণ করে স্ট্র্যাটেজিকালি যুদ্ধে এগিয়ে যেতে হবে। শুধু এই দশ বছরে তাঁর কার্যক্রম ছাড়াও আর একটা দিক উঠে আসে যে, নেতাজি কিন্তু ভারতের সম্মুখ রাজনীতিতে না থাকলেও তাঁর প্রভাব চিরকাল ছিল ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতিতে। এবং যতই নেহেরু তাঁর বিরোধিতা করুক, তিনি কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত নেহেরুকে নিজের বন্ধু মনে করতেন এবং সেই কারণেই তিনি তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। পরবর্তী ধারাবাহিকে আমরা ৭০ পরবর্তী নেতাজির কার্যকলাপ এবং অন্যান্য তথ্য নির্ভর বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো এবং চেষ্টা করবো নেতাজীকে নিয়ে তথাকথিত মিথগুলো তথ্য দিয়ে খন্ডন করে প্রকৃত সত্য আপনাদের সামনে তুলে ধরতে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন