কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৪৫ 


প্রচলিত একটি ধাঁধা এবং সেই ধাঁধার সমাধান, আমরা প্রায় সবাই জানি কিন্তু তাসত্ত্বেও যেহেতু আমরা একে অন্যকে ততটা বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে করি না, তাই সুযোগ পেলেই নিজেকে যথেষ্ট চালাক প্রতিপন্ন করার জন্য সাদা কাগজে কলম দিয়ে একটা ছোট সরলরেখা টেনে বা মেঝেতে চক দিয়ে অনুরূপ রেখা টেনে প্রশ্ন করি, বলুন তো এই রেখাটির বিন্দুমাত্র অঙ্গহানি না করে কীভাবে রেখাটিকে ছোট করা যায়? যাকে প্রশ্নটা করা হলো, তিনি যদি মোটামুটি অভিনয়কলা রপ্ত করে থাকেন, তাহলে প্রথমটা না জানার ভান করে বিস্ময় প্রকাশ করবেন তাই তো, তাই তো, এটা কী করে সম্ভব! তারপর কিছুক্ষণ বগল চুলকে সমাধান বের করার  ভঙ্গিতে বলবেন, ধরে ফেলেছি ধরে ফেলেছি, আমাকে ঠকানো এত সহজ নয়! আর উত্তরকর্তা যদি নিতান্তই কাঠখোট্টা খিটখিটে হন, তাহলে তিনি বিনা ভূমিকায় বলবেন, বুঝলেন নিজেকে এত চালাক মনে করবেন না, এই ধাঁধার সমাধান আমি আমার বাপ ঠাকুরর্দার আগেই করেছি

হ্যাঁ, আমরা মোটামুটি সবাই জানি যে, নির্দিষ্ট সরলরেখাটিকে ছোট করতে হলে তার অঙ্গহানি আদৌ না করে বা তাকে স্পর্শমাত্র না করে, তার পাশে যদি দৈর্ঘ্যে বড় অনুরূপ একটি সরলরেখা টানা যায়, তাহলেই পূর্বের সরলরেখাটি তুলনামূলক ভাবে ছোট হয়ে যায় আসলে কথাটা হচ্ছে, আইনস্টাইন সাহেব আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার করার পরই আমাদের জীবন ও জগতের অনেক অনেক হিসেব বদলে গেছে আমরা নতুন দৃষ্টিকোণে বস্তু ও বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করতে শিখেছি এবং সেটা আমাদের সবার পক্ষে খুবই পজিটিভ ব্যাপার কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমরা অনেকেই যথেষ্ট জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও পাপকাজটা কিন্তু যথারীতি করে চলেছি মানে ঐ যে বলে না জ্ঞানপাপী! আর তাই কাউকে ছোট’ করার দরকার হলে, নিজেকে   আদৌ তার তুলনায় বড়’ করার চেষ্টা করছি না; বরং নিজে আরও ছোট হয়ে  পাদানিতে নেমে তাকে ছোট করার পণ্ডশ্রম করছি। জীবনের এটা একটা আশ্চর্য  ছেলেখেলা। আর এই সূত্রেই আমরা প্রতিদিন বাড়িয়ে চলেছি আমাদের শত্রুসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছি আঞ্চলিকতা, প্রদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা পরস্পরকে হেয় করার প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হচ্ছি নিত্যদিন হিংসার উন্মত্ততায় মানবজীবনকে করে তুলছি সন্ত্রস্ত ক্ষমতাদখলের দম্ভে কোন্রসাতলে যে হারিয়ে যাচ্ছি আমরা!

তুলনামূলক বিচার, তুলনামূলক আলোচনা সমালোচনা বা তুলনামূলক কর্মপ্রয়াস খুবই জরুরি আমাদের সবার জীবনে আর সেইসঙ্গে প্রয়োজন সুস্থ প্রতিযোগিতাও  কিন্তু তার জন্য কখনই অপরের অঙ্গহানি বা ক্ষতি করা মেনে নেওয়া যায় না বস্তুতপক্ষে যথার্থ মনুষ্যত্বের বিকাশ না হলে সব সৃজন এবং সৃষ্টিই মাঠে মারা যায় সত্য ঢাকা পড়ে থাকে অসত্যের কুঝ্বটিকায় বা ধাঁধায়  

এখন বাংলা ক্যালেন্ডারে জ্যৈষ্ঠমাস এবং ইংরেজি ক্যালেন্ডারে মে মাস দুর্জয় গরম চলেছে জামশেদপুরে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণে – ‘নাই রস নাই... আর তারই মধ্যে প্রকাশিত হলোকালিমাটি অনলাইনব্লগজিনের ৪৫তম সংখ্যা সবার ভালোর জন্য বলি, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া এই বিচ্ছিরি গরমে কেউ বাড়ির বাইরে পা দেবেন না বরং বাড়িতে বসেকালিমাটির নিবিড় পাঠে নিমগ্ন থাকুন


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

ধর্মাধর্ম, নীতিটিতি, নাস্তিকতা-আস্তিকতা, জ্যোতিষটোতিষ — উনি আর আমি  



প্রত্যক্ষ শিক্ষক না হলেও ওঁকে অন্যতম গুরু মানি। কারণ পরম সজ্জনতা আর চরম বৈদগ্ধ্য ওঁকে বহ্নিমান অগ্নির মত ‘অ্যাসেটিক’ এক দীপ্তি দিয়েছে তার  তেজে সামনে এলে পুড়তে হয় ইকারুসের মতো। যে কোনো কথা আর তার/তাদের আন্তঃসম্পর্ক চিরে চিরে উনি তার যে গূঢ়ার্থ বের করেন তার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র প্রাচীন গ্রিসের ডায়ালেক্টিক্সের। আমার গর্ব হয় একথা ভেবে যে আমি ওঁর নির্বাচিত স্পারিং পার্টনার, যদিও এটা আমার ধারণা, ওঁর কিনা জানি নারাধাকৃষ্ণসম্পর্ক।

 প্রাচীন গ্রিসের ডায়ালেক্টিক্স কেন বলছি? একটা উদাহরণ দি। প্লেটোর ইউথিডিমাস  বইয়ে  সফিস্টদের সম্পর্কে তীব্র ব্যঙ্গ আছে। একটু হাল্কা চালে তিনি দেখাচ্ছেন দুই সফিস্ট ডিয়নিসোডোরাউস আর ইউথিডিমাউস-এর কথা চলছে এক বোকাসোকা পাব্লিক ক্লেসিপ্পাউসের। কথাটা শুরু করলেন ডিয়নিসোডোরাউস 

তুমি বলছো তোমার একটি কুকুর আছে?
হ্যাঁ, এক শয়তান কুকুর, বললো ক্লেসিপ্পাউস। 
আর তার বাচ্চা হয়েছে?
হ্যাঁ, আর সেগুলি ঠিক তারই মতো।
আর কুকুরগুলো তাদের বাপ?
হ্যাঁ, আমি নিশ্চয় দেখেছি তাকে আর বাচ্চাদের মাকে একত্রিত হতে, সে বললো।
আর সে (কুকুরটি) তোমার নয় কি?
নিশ্চয় সে আমার।
তাহলে সে এক পিতা, আর সে তোমার, অর্থাৎ সে তোমার পিতা, আর কুকুর বাচ্চাগুলো তোমার ভাই।

এ এক আজব নৈয়ায়িক সিদ্ধান্ত, এরপর ইউথিডিমাউসের কথা যোগ হলে বিদঘুটে, বদখৎ হয়ে যাবে। যদিও প্লেটোর পক্ষে সফিস্টদের প্রতি বিদ্রূপ সাজে না। কারণ ন্যায় কী এ প্রসঙ্গে  সিফালাউস, পোলিম্যার্কাউস, অ্যাডিমান্টাউস, গ্লাভকন ইত্যাদির বিচিত্র, ঋদ্ধ সব ন্যায়-সংজ্ঞাকে ডায়ালেক্টিক কুতর্কে বিদ্ধ করে তিনি শেষে এই পর্বতের মূষিক প্রসব করিয়েছিলেন যে ন্যায় হলো নিজের জন্মাদিষ্ট কর্তব্যের, অর্থাৎ গীতায় কৃষ্ণের বলা স্বধর্মের, পালন, যাতে কিনা ‘নিধন’-ও ভালো। ‘পরধর্মো ভয়াবহঃ’ যে! কিন্তু আমার বক্তব্য হলো এরকম ডায়ালেক্টিক্সীয় সিদ্ধান্তে/অনুসিদ্ধান্তে আমরা অনেক আসল কথাকে গুলিয়ে দিই না কি?  

কথাটা এলো এই কারণে যে উনি কিছু কথা বললেন অমোঘ। তার উত্তরে আমি ক্লেসিপ্পাউসের মতই খেই হারিয়ে কিছু কথা বললাম। কিন্তু পরে এসে ভেবে দেখি অস্ফুট যা বলেছি আদতে ভুল নয়। তাই আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে একটি কাল্পনিক প্লেটোনিক ডায়ালগে সেগুলি দিলাম। উত্তরের বাঁধুনি প্রথমে এত ছিল না। পরে শানানো জবাব। তদবধি কাল্পনিক! 

উনি— ও ছেলের বিয়ে দিচ্ছো! হিন্দু মতে? 
আমি—হ্যাঁ।
উনিমেয়েটি কী, ব্রাহ্মণ?
আমিহ্যাঁ।
উনিতবে জাত মানছো? ধর্মও    
আমিনা নিজে অসবর্ণ বিয়ে করেছি পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। কন্যা আন্তঃপ্রাদেশিক বিয়ে করেছে। পুত্র ধর্মের গণ্ডি ভাঙলেও আশাহত হতাম না। কিন্তু হয়নি। ধর্ম অন্য অর্থে মানি। যে ষোলোটি অর্থে পুংলিঙ্গে ধর্মকে বুঝিয়েছেন হরিচরণ তাদের কয়েকটির অর্থে!  কিন্তু তার সঙ্গেই নাস্তিকতা আস্তিকতার যোগ নেইজাতপাত আস্তিক ছাড়া কেউ মানতে  পারে না।  কিন্তু হিন্দুধর্মে সব চলে।  নইলে দয়ানন্দ, সাভারকরদের বিধানে অসবর্ণ বিবাহ মহোৎসাহে দেওয়া যায়! মুন্সিরাম তথা শ্রদ্ধানন্দ তো নিজের কন্যার অসবর্ণ বিবাহ দিয়েছিলেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে, যেমন বিদ্যাসাগর নিজের পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন বিধবার। 
উনিকিন্তু, জাতপাতের সঙ্গে ধর্মের আর যোগ নেই! আর ভারতে জাতপাতের গণতান্ত্রিক পুনর্জন্ম  হয়েছে এটা জানতে আর রজনী কোঠারি লাগে না।
আমিনা জাতপাতের উৎস ধর্মইগীতায় কৃষ্ণের উক্তি, ‘চাতুর্বর্ণ্য ময়া সৃষ্টঃ, গুণকর্ম  বিভাগসঃ’ ইত্যাদি। জাতপাতের পুনর্জন্মে এ কাস্ট আর সে কাস্ট নয়, সেটাও অর্ধেক  মানি! বেঙ্গল ম্যাট্রিমনিতে ‘কাস্ট নো বার’ লেখা ছিল। অ- ব্রাহ্মণ, -বৈদ্য, অ-কায়স্থ পাত্রী পেলে লুফে নিতাম। তার চাকরি পেতে সুবিধে হতো। কিন্তু শুচিতা-অশুচিতার অনন্ত হিসাবের রাবণসিঁড়ি হিসেবে জাতপাত মানি না। এ ব্যাপারে আমি জ্যোতিবা ফুলের অনুসারী। উনি চাতুর্বর্ণ্যকে দ্বান্দ্বিক দ্বৈবর্ণ্যে নামিয়ে এনেছিলেন, ভাট-সাহুকার-মহাজন একদিকে আর বাকি দলিতরা আরেকদিকে।
উনিকিন্তু জাতপাত মানে না বলে যারা ছেলের পৈতে দেয় না, তারাই আবার ছেলের বিয়েতে মন্ত্র পড়তে, পড়াতে, পাড়তে পারে? 

আমিকেন পারবে না? বিবাহের মন্ত্র হিন্দুধর্মে অসাধারণ আর তা ছাড়া অং বং চং-এর  বাইরে হিন্দুবিবাহের অনেকটাই তো সামাজিক আচার, লোকাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু তা বলে উপনয়ন করতে  হবে, ছেলেকে দ্বিজ করতে? দ্বিজ শব্দের প্রাথমিক অর্থ দ্বিজন্+ড থেকে নিষ্পন্ন হওয়ায় সব ভালো অভিধানেই তার প্রাথমিক অর্থ সাপ, পাখি, মাছ; যেহেতু তাদের ডিম থেকে সন্তান হয় একমাত্র মাধ্যমিক অর্থেই তা পৈতে হওয়া বামুনকে বোঝায়। আর মানুষের বাচ্চাকে খরচা করে নিম্নতর যোনির সাপ, পাখি, মাছ বানাতে হবে কেন? বিয়ের  কথা আলাদা। একটি ছেলে একটি মেয়ের সঙ্গে সহবাস করবে, শব্দটির সংকীর্ণ, প্রসারিত সব অর্থেই। মন্ত্রের গাম্ভীর্য, মাধুর্য এর মধ্যে অন্য এক একত্বের আয়তন, দ্যোতনা নিয়ে আসে।      
উনিপৈতে না হলেও সমাজে ব্রাহ্মণ আধিপত্য সরেছে কি? এমনকি এই দলিত জাগরণের যুগেও? কিছুকাল আগেও ভারতের মোট জনগণের তিন শতাংশের মতো এই জাতিগোষ্ঠি সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকরি বাকরির বিশাল অংশ জুড়ে থাকতো। এখনও সেই তেজ, রস পুরো  মরেনি। চাকরি বাকরি ছাড়াও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কথা ভুললে চলবে না।
আমিকিন্তু ওঁরা তো ব্রাহ্মণ নন! ব্রহ্মবন্ধু! শ্লোকে বলে ‘জন্মণা জায়তে শূদ্রঃ, সংস্কারাৎ  দ্বিজোচ্যতে। বেদপাঠাৎ ভবেৎ বিপ্রঃ, ব্রহ্মং জানাতি য স ব্রাহ্মণঃ সেই নিয়মে এঁরা তো বিপ্রও নন, বৈদিক বিধানেই কেবল ব্রাহ্মণগৃহে জন্মসূত্রে ব্রহ্মবন্ধু কেবল পৈতে ক’রে বা প’রে সাপ, ব্যাঙ, পাখি, মাছ ইত্যাদির সমগোত্রীয় হয়েছেন। আমি নাস্তিক,  গ্রহ নক্ষত্র, রাশিটাশি, জ্যোতিষ-টোতিষ মানি না। এঁদের হঠাৎ ব্রাহ্মণ ভাবতে যাবো কেন? এঁরা তো আসলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শণের দাড়ি পরা যাত্রার নারদ, আসল দেবর্ষি নন। 

উনিআবার ধারণাবিপর্যয় হয়ে গেল না? নাস্তিকতা-আস্তিকতার সঙ্গে জ্যোতিষ-টোতিষের কার্য-কারণগত সম্পর্ক আছে নাকি? বিদেশে, এমনকি এদেশেও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নাস্তিক হয়েও জ্যোতিষ মানেন, আবার অনেকে আছেন যাঁরা আস্তিক হয়েও জ্যোতিষ মানেন না। অনেকে আবার ঈশ্বরের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদী হয়েও জ্যোতিষ-টোতিষের ক্ষেত্রে নন। তাদের সায়েন্স মনে করেন।
আমিহতে পারে! আমার স্বর্গতা পিতামহী পরম ভক্তিমতী হয়েও জ্যোতিষ-টোতিষের ধার ধারতেন না। তাঁর মুখের কথা ছিল ‘গণৎকার যদি গণবে ঠিক, দোরে দোরে কেন মাগবে ভিখ’।  আবার নিশ্ছিদ্র আস্তিক স্বর্গত পিতা গুরু-পাণ্ডা-পুরুতের ধার ধারতেন না, বলতেন ‘বড়সাহেবের ঘরে অ্যাক্সেস আছে, দারোয়ানকে ঘুষ দেবো কেন?’ কিন্তু শৈশব থেকে গনৎকারে গমগম করতো বাড়ি। কিন্তু ঈশ্বর, নিতান্ত তেত্রিশ কোটি দেবতার গোটা পনেরোকে মানে বা পূজা করে, আর গনৎকারের দোরে ঘোরে এমন মানুষের সংখ্যা, আর নাস্তিক এবং জ্যোতিষ-টোতিষ মানে না এমন মানুষের সংখ্যা আস্তিক কিন্তু জ্যোতিষ মানে না এমন মানুষের সংখ্যা বা নাস্তিক কিন্তু জ্যোতিষ মানে না এমন মানুষের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি নয় কি? আপনাদের কথায় আস্তিকতা আর জ্যোতিষবিশ্বাস আর নাস্তিকতা এবং জ্যোতিষে অবিশ্বাসের সদর্থক সহসম্বন্ধ তথা পজিটিভ কোরিলেশন উচ্চ মাত্রার। আস্তিকতা আর জ্যোতিষে অবিশ্বাসের এবং নাস্তিকতা আর জ্যোতিষে বিশ্বাসের সহসম্বন্ধ নঞর্থক না হলেও ক্ষীণ। আসলে এঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই বিশ্বাসগুলো সিম্পটম হিসেবে আসে না, পরস্পর সংযুক্ত সিনড্রোম হিসেবে আসে।
উনি আস্তিকতা আর জ্যোতিষবিশ্বাসের কোনো মিলিত সিনড্রোম কতটা জোরালো? এটাও তুমি কি গুলিয়ে ফেলছো না? 


আমিমনে হয় গোলাচ্ছি না! কিন্তু প্রাচীন গ্রিসে হিপারকাউস (Hipparchus) থেকে শুরু করে ধর্মের ‘stellar cult’-র বা ‘astrolatry’-র কথা, যেমন আমাদের এখানে রাহু-কেতু বিশেষ করে শনির পূজার কথা, যদি নাও তুলি, তাহলেও কোপার্নিকাস, কেপলার এবং গ্যালিলিওর নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতি যেভাবে ফলিত জ্যোতিষের মূল ভিত্তি সূর্যকেন্দ্রিক জগতের তত্ত্বকে অধঃখনিত করেছিলো তাতে ধর্মের অনুমোদন ছাড়া জ্যোতিষের অস্তিত্বই সম্ভব ছিল নাআর তাতে চার্চের সমর্থনের কথা, ইনকুইজিশনের কথা, মনে রাখবেন প্লিজ!  আমাদের এখানে ‘ঈশ্বরাসিদ্ধঃ প্রমাণাভাবাৎ’ হিন্দু  জ্যোতিষের কোনো বইতে সাংখ্যদর্শনের ধরনে এমন কথা লেখা থাকবে এমন আশা করার মত মূর্খ নই।  কিন্তু রাশিচক্রে গোলমাল থাকলে অসংখ্য টিভি চ্যানেলে, তারাপীঠের দেয়ালে দেয়ালে তান্ত্রিকরা শান্তিস্বস্ত্যয়নের, যাগযজ্ঞের, কালীপূজার যে বিধান দেন তার  সঙ্গে হিন্দু ধর্মের যোগ গভীর।        
                  
উনিতোমার সিনড্রোমের তত্ত্ব ঠিক হলে আস্তিক-জ্যোতিষবিশ্বাসী মানুষরাই তো বেশি নীতিবাদী হবেন! কারণ পৃথিবীতে নীতির প্রথম পাঠগুলি ধর্ম থেকেই এসেছে। ধর্ম থেকেই প্রাথমিক বৈধতা পেয়েছে। কিন্তু তুমি তো নাস্তিক হয়েও হিন্দুবিবাহে রাজি, কিন্তু আবার  নীতিবাগীশ। তুমি কি অসমঞ্জস নও?
আমিএকেবারেই নয়! বিয়ে তো দিতেই হবে। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টেই হোক আর হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টেই হোক, রেজিস্ট্রার ঈশ্বরের নামে শপথ নেওয়াবে। তার চেয়ে মেরুপৃষ্ঠঋষি, গায়ত্রীচ্ছন্দের আওয়াজে বিয়েটা বেশ আত্মিক আত্মিক শোনাবে। আর এক সময়ে, অন্ততঃ গ্রিক যুগে, ইউরোপে ধর্মের সঙ্গে নীতির অন্যোন্যসম্পর্ক অচ্ছেদ্য ছিল না অ্যারিস্টটেলিয় সংজ্ঞায় ‘virtue’-র ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল ন্যায়ের সঙ্গে। Virtue কেবল তার ধারককে নয়, সমভাবে তার কাজকেও ভালো করে তোলে (‘virtus est quae bonum facit habentem et opus eius bonum reddit’) কিন্তু virtue ন্যায়ের মধ্যে প্রোথিত এই কারণে যে সকলকে তার প্রাপ্য বুঝে দেওয়া তথা ন্যায় (reddere  debitum aliqui) একটি ভালো আর ধর্মের নির্যাস যেখানে ঈশ্বরকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া (reddere honorem debitum Deo) সেই কারণে ধর্ম পরম virtue এর থেকেই ধার নিয়ে  অ্যারিস্টটলের খ্রীষ্টীয় শিষ্য অ্যাকোয়াইনাস বলেছিলেন ধর্ম নৈতিক virtue গুলির মধ্যে গরীয়ান (praeminet inter alias virtutes morales)কিন্তু এর থেকেই তো বোঝা যায় যে ন্যায়, নীতি, সদাচরণের ধর্মহীন অস্তিত্ব আছে। আধুনিককালে ধর্ম আর নীতির সম্পর্ক অনেক বেশি তর্কিত। পল ডিনার  (Paul W. Diener) ধর্ম ও নীতির সম্পর্ক সম্বন্ধে তাঁর বইতে দেখিয়েছেন তিনটি সম্ভাব্য উপায়ে ধর্ম ও নীতি কিভাবে পরস্পরের সম্মুখীন হয় আর এক অন্যের মোকাবিলা করে তাকে ভাবা সম্ভব—
·        এরা এত নিকট হতে পারে যে প্রায় অচ্ছেদ্য।
·        এরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক ক্রিয়াকলাপ হতে পারে, ফলে পুরোপুরি বিচ্ছেদ্য।
·        এরা পুরোপুরি অচ্ছেদ্য বা বিচ্ছেদ্য না হয়ে ‘relational’ বা বিভিন্নভাবে সম্পর্কসম্বন্ধীয় হতে পারে।

নীতির প্রতি ধর্মীয় অনুধাবনপদ্ধতি প্রথম বিকল্পটি নেবে। সেকিউলার দৃষ্টিভঙ্গি বাছবে দ্বিতীয়টিকে। আর তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিকল্পটি দুই আপাতঃ বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির সব চেয়ে ভালো দিকগুলিকে বেছে নেবে (Religion and Morality: An Introduction, Louisville, Ky.: Westminster John Knox Press, 1997, p. xi) আমি কান্টের নৈতিকতা বিষয়ক ‘অটোনমির’ তত্ত্বকে এই  তৃতীয় বিকল্পের পক্ষে খাপসই মনে করি। সেখানে আমি মুক্ত, বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে নিজের প্রবৃত্তি গুলিকে লাগামছাড়া হতে না দিয়ে তাদের একটি  নিয়ম দিই, যেটি কেবল আমার প্রতি প্রযোজ্য হলেও ইউনিভার্সালসেটি এক ধরণের ‘autocracy’ সেটি stoic autarky-র অসদৃশভাবে প্রকৃতিকে নয়, আমাদের মানবিক স্বাধীনতাকে সামনে আর কেন্দ্রে রাখে।  
উনি— তুমি সমগ্র নৈতিকতাকে ব্যক্তিচিন্তার নড়বড়ে ভিত্তির উপর বসাচ্ছো।               
আমি— হতেই পারে! আমার যে বুদ্ধি আমায় নাস্তিক করেছে, রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গে শচীশের ঢঙে বলতে শিখিয়েছে ঈশ্বর যদি থাকেন তবে আমার এই বুদ্ধি ঈশ্বরের দেওয়া, এই বুদ্ধি বলছেন ঈশ্বর নেই/ অতএব ঈশ্বর বলছেন ঈশ্বর নেই (তর্কবাক্যটির চতুষ্পদী হেত্বাভাস সত্ত্বেও) — সেই বুদ্ধিই আমাকে নীতির বোধ দিয়েছে, কাণ্টীয় অটোনমির অংশ হিসেবে। ধর্মের  পথে যাওয়া যাবে না নীতি খুঁজতে। কারণ মহাপুরুষরা প্রায়ই বলেন, ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজঃ’ (গীতা), অথবা He who is not with Me is against Me, and he who does not gather with Me scatters’ (Matthew, 12.30), এমনকি বুশ জুনিয়রও বলার সাহস পেয়েছিলেন যে ‘you’re either with us, or against us’ আর ধার্মিক মানুষরা প্রায়শঃই গীতায় অর্জুনের ভঙ্গিতে বলবেন—

জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ।   
জানাম্যধর্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ। 
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন
যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি। 

ধর্মীয় নীতিবাদীরা এই শ্লোকে কিছু অনর্থ দেখবেন না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ, আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না। তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সে দিকে চলব (শান্তিনিকেতন, ৮,১২ রবীন্দ্র রচনাবলী)।’ কিন্তু আমরা দেখেছি যে নিজের অটোনমিকে এইভাবে ছেড়ে দিলে মানুষ ‘actor’ থেকে ‘agent’ হয়ে যায় আলথুসারের (Althusser) ভাষায় ‘subject’ হয়ে যায়, আর হানা অ্যারেণ্ড-এর ভাষায় ‘banality of evil’-এ নির্বিবাদে অংশ নেয় (Hannah Arendt,  Origins of Totalitarianism), ‘যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি’ ব’লে নাৎসিদের Auschwitz-এ অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ, দায়িত্ববান মানুষদের আদিষ্ট কর্তব্যপালন আমরা দেখিনি কি?    তাই আমার নীতিতে ধর্মের স্থান নেই, সে অটোনমাস।

আসলে পৃথিবীতে ক্লেসিপ্পাউসরা কমে আসছে। তাদের সরল বিশ্বাসেও যুক্ত হয়েছে যুক্তি। তাই বাঁচুক। তাতে ধর্ম লাগে না। কথার পিঠে কত কথা এলো! কিন্তু কথনবিশ্বে আর কিবা হবে? বলুন!           

         

          

শিবাংশু দে

আমাদের ভাঙা কুঞ্জবন




এককালে প্রবাসী বাঙালিদের কিছু চারিত্র্য ছিলো হয়তো এখনও আছে তবে অন্যরকম বিশেষত যাঁরা সেকালে বড়সড় পদের অধিকারী, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাহেবগিরি করতেন, সেরকম জবরদস্ত টাইপ বাঙালিরা এর সঙ্গে ছিলেন সর্বশক্তিমান ধরনের ডাক্তার বা আইনজীবীর দল দিল্লি বা  হায়দরাবাদ, বম্বে বা কটক, ম্যাড্রাস বা দেহরাদুন, পাটনা বা পুনে, কোথায় ছিলেন না তাঁরা? একালের মানুষদের সহজভাবে বোঝাতে গেলে বলা যায় বিধান রায়, কমল মিত্র সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিবিধ অনুপানের পাঞ্চ মিশিয়ে তৈরি হতেন সেই সব রাশভারি মানুষেরা বাংলার বাইরে বাঙালির ভাবমূর্তি তাঁরাই ধরে রাখতেন পুরা হিম্মত সে আজ যে সর্বত্র বাঙালিদের টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নেওয়ার সর্বভারতীয় 'ষড়যন্ত্র' চোখে পড়ে সেসব তাঁদের আমলে কেউ করার সাহস করতো না এরকম শেষ বিখ্যাত বাঙালি, যাঁর সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি অবাঙালিদের কাছে এরকম awesome ছিলো, তিনি  কিন্তু বাঙালিদের নিজভূমে বহু মানুষের কাছে  রীতিমতো নিন্দিত হতেন সময়ে অসময়ে হ্যাঁ, তিনি জ্যোতিবাবু 'দলে' আদেশে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হলেও তিনি যে প্রধানমন্ত্রিত্ব অস্বীকার করেছিলেন, তা দেশের বাকি অংশের মানুষের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো মনে পড়ে আমার পাটনার অফিসে তখন একমাত্র 'বঙ্গালি' হিসেবে বহু মানুষের সশ্রদ্ধ, বিস্মিত অভিনন্দন আমার কাছে পৌঁছেছিলো সেই উষ্ণতা কখনও ভোলা যায় না এই বিস্ময়ের পুনরাবৃত্তি দেখেছি শ্রীনগরের ট্যাক্সিচালক, হায়দরাবাদের দর্জি অথবা বম্বের লোক্যাল ট্রেনের সহযাত্রীদের মধ্যে আজকে যখন দেখি সারাদেশে বিপুল পরিমাণ মানুষের মনে 'বাঙালি' মানে ক্ষীণপ্রাণ, কলহপ্রবণ, আলস্যপ্রিয় কিছু মানুষের ভাবমূর্তি, যারা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি, বোমাবাজি করা ছাড়া আর কিছুতে রুচি রাখে না কষ্ট হয় অবশ্য এই ছবিটি দু'চার দশক ধরেই পাবলিক খায় কিন্তু হল অফ ফেমে সাম্প্রতিক যোগ হয়েছে নিপুণভাবে তোয়ালে মুড়ে পাপের টাকাকে বাঙালিরাও আদিগঙ্গায় ধোয়া 'মায়ে' চরণের ফুলের মতো পবিত্র করে দিতে পারছে পিসি সোরকারের ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়ার মতো' সেই ম্যাজিক নিয়ে শাবাশির অন্তহীন ঢেউ বঙ্গসংস্কৃতিতে পাপের টাকা চিরকালই ছিলো কিন্তু তার বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষের সচেতন-অবচেতন প্রতিরোধ প্রয়াস বাকি দেশে বাঙালিদের 'সততা' বিষয়ে একটা ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছিলো চারপুরুষের প্রবাসী বাঙালি হিসেবে তা নিয়ে শ্লাঘাও বোধ করতুম কিন্তু সেই মূর্খতা থেকে বাঙালি আজ মুক্ত মাটি সোনার মাটি

যাকগে এখন প্রশ্ন হলো লেখাটির শীর্ষকের সঙ্গে এই সব প্রসঙ্গের সম্পর্ক কোথায়? আসলে সকালবেলা একটা গান শুনে ঘুম ভেঙেছিলো, আজ "কে আবার বাজায় বাঁশি, ভাঙা কুঞ্জবনে" আমার এক প্রিয় শিল্পী শিখা বসুর কণ্ঠে লোকপ্রিয় এই গানটির যে শৈলীটি তিনি গাইছিলেন সেটি অপেক্ষাকৃত  চেনা ফর্ম্যাট, যেমন সুচিত্রা মিত্র বা কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের থেকে আলাদা কিন্তু অতুলপ্রসাদের সীমায়িত ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা এই রত্নটি বহুযুগের ওপার থেকে একটি সন্ধ্যা ফিরিয়ে নিয়ে এলো একজন মানুষের সূত্রে একজন সেকালের বাঙালি আমি তখন নিতান্তই স্কুল পড়ুয়া  বালক

দুজনকে নিয়ে একটা আড্ডা জমেছিলো সেই সন্ধ্যায় আমার পিতৃদেব শহরের অন্যান্য সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষদের তাঁদের একজন দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল এবং অন্যজন ডাঃ কালীকিংকর সেনগুপ্ত ডাঃ কালীকিংকর সেনগুপ্ত পেশায় ছিলেন একজন প্রবীণ চিকিৎসক, কিন্তু নেশায় ছিলেন একজন কবি, প্রাবন্ধিক, সারস্বত সাধক সেকালে তাঁর সম্বন্ধে অনেকেই জানতেন একজন শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তি হিসেবে তবে তিনি মোকাম কলকাতার মানুষ আর অন্যজন দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন সেকালের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে একজন অতি পরিচিত, প্রমুখ ব্যক্তিত্ব তাঁর ব্যক্তিপরিচয় সম্বন্ধে তিনি বলতেন যে, তাঁর বাবার নামে  লখনউতে একটি রাজপথ আছে, কিন্তু সেখানে তিনি থাকেন না তিনি থাকেন তাঁর মায়ের সঙ্গে মানে তাঁর মায়ের নামে রাস্তাটি তত চওড়া না হলেও সেখানেই তাঁরা স্বচ্ছন্দ  সেই সরোজিনী দেবী মার্গেই ছিলো তাঁদের ভদ্রাসন  সেই বিরলকেশ, শালপ্রাংশু মানুষটি প্রথম জীবনে অতুলপ্রসাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সঙ্গী ছিলেন কবির প্রতি শ্রদ্ধাবশে সেকালে লখনউ শহরে  বিভিন্ন সেবামূলক কাজকর্মে নিয়োজিত 'অতুল সেবাদলে' কর্ণধার ছিলেন পড়াশোনা করেছিলেন দেশের প্রথম কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র রুড়কি'তে স্বাধীনতার আগে থেকেই অবিভক্ত উত্তর প্রদেশ পূর্ত বিভাগের মুখ্য অধিকর্তা ছিলেন বিংশ শতকের শুরুতে তিনি গ্ল্যাসগো ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনেক ডিগ্রি হাসিল করেন একজন দুঁদে উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা হিসেবে বাঘ গরুকে একঘাটে জল খাওয়াতেন (লখনউয়ের লোকেদের কাছে শুনেছি)  তাঁরই ছোটভাই পাহাড়ি সান্যাল ছিলেন ম্যরিস কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র লখনউয়ের ম্যরিস কলেজ (ভারতের প্রথম সঙ্গীত কলেজ) স্থাপনার পিছনে যাঁরা  সক্রিয় ছিলেনএই সান্যাল পরিবার তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য তাঁর কথাবার্তার মধ্যে ধূর্জটিপ্রসাদ, রতনজনকার, ফ্যয়েজ খান, দিলীপকুমার বা রবীন্দ্রলাল রায় অনায়াসে আসা যাওয়া করতেন রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, এমন কি জবাহরলালের সঙ্গে ভারি গুম্ফ ভরাট কণ্ঠস্বর, আশি পেরোনো একজন ব্যক্তিত্বের পরাকাষ্ঠা

সেদিন আড্ডার তেমন কোনও বিষয় ছিলো না কিন্তু অতুলপ্রসাদকে নিয়ে দ্বিজুবাবুর ( দুটো নাম ছিলো তাঁর সম্বোধন পদে; দ্বিজুবাবু আর সান্যালসাহব) স্মৃতিচারণ গানই ছিলো মুখ্য আলোচ্য এই গানের সূত্রেই তিনি আমার মা'কে বিশেষ স্নেহ করতেন কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরেই তিনি মা'কে আদেশ করলেন গান শোনাতে আমার মনে আছে মা যখন 'কে আবার বাজায় বাঁশি' গাইছিলেন তখন কালীকিংকর মুগ্ধ হয়ে তারিফ করছিলেন কিন্তু দ্বিজুবাবু চুপ করে শুনছিলেন গান সারা হলে তিনি মাকে বললেন যে, গান তাঁর খুব ভালো লেগেছে, কিন্তু এত উঁচু স্কেলে বেশি গাইলে গলার ক্ষতি হতে পারে টিম্বার নষ্ট হবার ঝুঁকি আছে ওনার ব্যক্তিত্ব এমন জাঁদরেল ছিলো যে তার উপর কথা বলার মতো কেউ আসরে ছিলো না তিনি সব তর্কের শেষ কথা বলার জন্যই যেন জন্মেছিলেন কিন্তু যেই তিনি থামলেন, কালীকিংকর মাকে বললেন, আমি ডাক্তার হিসেবে তোমাকে বলছি তুমি তোমার স্কেল পাল্টাবে না তোমার গলায় এই স্কেলটি খুব মানাচ্ছে, কোনও ক্ষতি হবে না সভাস্থ সবাই হেসে উঠলেন দ্বিজুবাবুও

মনে আছে দ্বিজুবাবু সেই সভায় কয়েকটি আলটপকা মন্তব্য করেছিলেন সেকালের গ্রাম্ভারি মানুষদের মতো তাঁর কিছু নিজস্ব সীমাবদ্ধ ভাবনা ছিলো  সামন্ততান্ত্রিক কৌণিকতা তার একটি অংশ একটি মজার মন্তব্য করেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ নাকি লাগামছাড়া অনেক অনেক লেখার জন্য ( গানগুণমানের ক্ষেত্রে নানা সময় আপোস করেছিলেন কিন্তু অতুলপ্রসাদ কখনও আপোস করেননি বালক বয়েসেও এই উক্তিটি আমার 'কুছ হজম নহি হুয়া' কিন্তু সভায় শহরের  যে  মুখ্য ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা প্রবীণ মানুষটির প্রতি সাবেক প্রবাসী বাঙালিয়ানার সৌজন্যবোধে কোনও তর্কের অবতারণা করেননি আরও কয়েক বছর পরে হলে এই শর্মা হয়তো 'এক হাত দেখে নিতো'  

আসলে 'গান' ব্যাপারটা নিয়ে তাঁর কিছু সহজাত অধিকার ছিলো সাবেক লখনউয়ের বনেদি সাংগীতিক বোধ, সঙ্গে নিজস্ব তইয়ারি এবং দীর্ঘকাল বিদেশবাসে সেদেশের সঙ্গীত নিয়ে চর্চা তাঁকে একটা অন্য ধরনের পরিণতি  দিয়েছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীতে গায়কের স্বাধীনতা বা রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং অতুলপ্রসাদীর সুরপ্রয়োগের স্ট্রাকচার, মঞ্জু গুপ্ত কৃষ্ণা চট্টোর গায়নশৈলী, অতুলপ্রসাদীতে  সুরের শুদ্ধতা বিষয়ে তাঁর মতামত ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো সব আলোচনারই উপভোগ্য অংশটি ছিলো তাঁর স্বকণ্ঠে গীত গানের টুকরোগুলি



সেই অশীতিপর সুররসিক মানুষটির আসর জমানোর বৈঠকী দক্ষতা ছিলো অনস্বীকার্যকণ্ঠস্বর ছিলো মেঘমন্দ্র 'কে আবার বাজায় বাঁশি'তে সংলাপধর্মী বাণী, যেমন 'হয় তুমি থামাও বাঁশি, নয় আমায় লওগো আসি' কীভাবে উচ্চারণ করতে হবে, তার কিছু প্রয়োগ গেয়ে শুনিয়েছিলেন, মনে আছে সেই ভঙ্গি হয়তো বাংলাগানে প্রয়োগের ব্যাপারে আমাদের আপত্তি থাকতে পারে কারণ সেগুলি মূল হিন্দি সুরের কাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোত কিন্তু তারও একটা পৃথক ফ্লেবার আছে তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা উদাহরণ দেখেছিলুম আমাদের ক্লাবে ( সবুজ কল্যাণ সঙ্ঘঅত্যন্ত বিশৃঙ্খল ছেলেছোকরাদের চ্যাংড়ামি আর হইচইয়ের মধ্যে  গভীর কণ্ঠস্বরে 'এতো হাসি আছে জগতে তোমার' গেয়ে সবাইকে স্তব্ধ করে  দিয়েছিলেন ভৈরবিতে বাঁধা এই গানটির প্যাথোস অতুলপ্রসাদের অনেক গানের মধ্যেও অনন্য এই গানটির পিছনে একটি ছোট্টো গল্প আছে একদিন বিকেলবেলা আদালত থেকে ফেরার পথে অতুলপ্রসাদ রাস্তার মোড়ে তাঁর জুড়িগাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেন, গাড়ির জানালা দিয়ে  একজন মহিলা হাত বাড়িয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন অবগুণ্ঠনের ফাঁক দিয়ে একপলক তাঁর মুখটি দেখেই অতুলপ্রসাদ স্তম্ভিত হয়ে যা' সেই মহিলা একসময় ছিলেন লখনউয়ের সঙ্গীতজগতের একছত্র অধীশ্বরী বিখ্যাত বাইজি ধনেজনে প্রাসাদে ঘেরা তাঁর ভুবন অতুলপ্রসাদ দেখেছেন বহুবার মহিলাও সেনসাহবকে চিনতেন ভালোভাবে গাড়ির মধ্যে তাঁকে বসে থাকতে দেখে তিনি পলকের মধ্যে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন গাড়ি থেকে নেমে অতুলপ্রসাদ খুঁজলেন তাঁকে কিন্তু পেলেন না বিষণ্ন কবি সেদিন বাড়ি ফিরেই এই গানটি বাঁধলেন এই সব গল্পকথা আমরা কিছুই জানতুম না তখন কিন্তু অসহিষ্ণু অনগ্রসর শ্রোতাসমূহের কলরবকে  গানটির বিষাদমুখ সুরের টানে মৌনতায় ঢেকে ফেলার জন্য একজন গায়কের যে এলেম লাগে তা কিছু অনুভব করেছিলুম সেদিন বাহ্যিকভাবে একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্বের মনের গভীরে যে একটি কোমলতম, সংবেদী রোমান্টিক শিল্পীসত্ত্বা এভাবে লুকিয়ে থাকে তা বুঝতে অবশ্য সময় লেগেছিলো অনেক 'বলিহারি বিধি, বলিহারি যাই তোরে' এই আর্ত ধুয়োটি যেভাবে বারবার ঘুরে আসে এই গানে তাকে ধরা কী অতো সহজ? এই মানসিক গড়ন, মনোজগতের ব্যপ্তিটিই ছিলো সেকালের বাঙালির ট্রেডমার্ক আবার এখন যেটা বেমানান লাগে সেটি ছিলো তাঁর চিন্তার রক্ষণশীলতা লখনউতে সঙ্গীত অনুষ্ঠানে দেখেছি তাঁর নির্দেশনায় শিল্পীরা গান শোনাচ্ছেন মহিলারা অকারণে অতি অবগুণ্ঠিত আবৃত যদিও তার সঙ্গে গানের কোনও যোগ নেই তবু কৈশোরে এই লৌকিকতাটি রাবীন্দ্রিক রুচিবোধের নিরিখে প্রতিবন্ধক বোধ হয়েছিলো তিনি যখন মাঝে মাঝে জামশেদপুরে আসতেনআমার মাকে ডেকে কিছু কিছু অতুলপ্রসাদী গান তাঁর নিজস্ব ধরনে শিখিয়ে যেতেন মাকে স্নেহ করতেন খুব বাবাকেও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিলো অসীম আর গল্পকথা ফুরোতো না কখনও নিষ্ঠাবান বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ গোটা শ্রীশ্রী চণ্ডী শ্রীমদ্ভগতগীতা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে আবৃত্তি করতে পারতেন অধ্যাত্মবোধের এই নৈষ্ঠিকতা হয়তো ব্যক্তি আমার কাছে তেমন তাৎপর্য রাখে না কিন্তু গীতা হোক বা গেওর্গি লুকাচ, বাঙালির সেরিব্রাল জগতে কেউই অপাংক্তেয় ছিলেন না কেউ না কেউ তো বাঙালির নিষ্ঠা আকর্ষণ করেই নিতেন আজ সব চুলোয় গেছে বাঙালির বাসরঘরের রন্ধ্রপথে অবিরত 'গো'সাপের হানা আমাদেরও কি সেই সব সেকেলে বাঙালিকে অনুসরণ করে 'ঘরেতে পরবাসী থাকিতে আর পারিনে' গাইতে গাইতে 'গো'লোক যাত্রা করতে হবেকে জানে?