ধর্মাধর্ম, নীতিটিতি, নাস্তিকতা-আস্তিকতা, জ্যোতিষটোতিষ — উনি আর আমি
প্রত্যক্ষ
শিক্ষক না হলেও ওঁকে অন্যতম গুরু মানি। কারণ পরম সজ্জনতা আর চরম বৈদগ্ধ্য ওঁকে
বহ্নিমান অগ্নির মত ‘অ্যাসেটিক’ এক দীপ্তি দিয়েছে। তার তেজে
সামনে এলে পুড়তে হয় ইকারুসের মতো। যে কোনো কথা
আর তার/তাদের আন্তঃসম্পর্ক চিরে চিরে উনি তার যে গূঢ়ার্থ বের করেন তার সঙ্গে তুলনা
চলে একমাত্র প্রাচীন গ্রিসের ডায়ালেক্টিক্সের। আমার গর্ব হয় একথা ভেবে যে আমি ওঁর
নির্বাচিত স্পারিং পার্টনার, যদিও এটা আমার ধারণা, ওঁর কিনা জানি না। রাধাকৃষ্ণসম্পর্ক।
প্রাচীন গ্রিসের ডায়ালেক্টিক্স কেন বলছি? একটা
উদাহরণ দি। প্লেটোর ইউথিডিমাস বইয়ে সফিস্টদের সম্পর্কে তীব্র ব্যঙ্গ আছে। একটু
হাল্কা চালে তিনি দেখাচ্ছেন দুই সফিস্ট
ডিয়নিসোডোরাউস আর ইউথিডিমাউস-এর কথা চলছে এক বোকাসোকা পাব্লিক ক্লেসিপ্পাউসের। কথাটা
শুরু করলেন ডিয়নিসোডোরাউস।
তুমি বলছো তোমার একটি কুকুর আছে?
হ্যাঁ, এক শয়তান কুকুর, বললো ক্লেসিপ্পাউস।
আর তার বাচ্চা হয়েছে?
হ্যাঁ, আর সেগুলি ঠিক তারই মতো।
আর কুকুরগুলো তাদের বাপ?
হ্যাঁ, আমি নিশ্চয় দেখেছি তাকে আর বাচ্চাদের মাকে একত্রিত
হতে, সে বললো।
আর সে (কুকুরটি) তোমার নয় কি?
নিশ্চয় সে আমার।
তাহলে সে এক পিতা, আর সে তোমার, অর্থাৎ সে তোমার পিতা, আর
কুকুর বাচ্চাগুলো তোমার ভাই।
এ এক আজব নৈয়ায়িক সিদ্ধান্ত, এরপর ইউথিডিমাউসের কথা যোগ হলে
বিদঘুটে, বদখৎ হয়ে যাবে। যদিও প্লেটোর পক্ষে সফিস্টদের প্রতি বিদ্রূপ সাজে না। কারণ ন্যায়
কী এ প্রসঙ্গে সিফালাউস, পোলিম্যার্কাউস, অ্যাডিমান্টাউস,
গ্লাভকন ইত্যাদির বিচিত্র, ঋদ্ধ সব ন্যায়-সংজ্ঞাকে ডায়ালেক্টিক কুতর্কে বিদ্ধ করে তিনি শেষে এই পর্বতের মূষিক
প্রসব করিয়েছিলেন যে ন্যায় হলো নিজের জন্মাদিষ্ট কর্তব্যের, অর্থাৎ গীতায় কৃষ্ণের
বলা ‘স্বধর্মের’, পালন, যাতে কিনা ‘নিধন’-ও ভালো। ‘পরধর্মো
ভয়াবহঃ’ যে! কিন্তু আমার বক্তব্য হলো এরকম ডায়ালেক্টিক্সীয় সিদ্ধান্তে/অনুসিদ্ধান্তে
আমরা অনেক আসল কথাকে গুলিয়ে দিই না কি?
কথাটা এলো এই কারণে যে উনি কিছু কথা বললেন অমোঘ। তার উত্তরে
আমি ক্লেসিপ্পাউসের মতই খেই হারিয়ে কিছু কথা বললাম। কিন্তু পরে এসে ভেবে দেখি
অস্ফুট যা বলেছি আদতে ভুল নয়। তাই আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে একটি কাল্পনিক প্লেটোনিক
ডায়ালগে সেগুলি দিলাম। উত্তরের বাঁধুনি প্রথমে এত ছিল না। পরে শানানো জবাব। তদবধি কাল্পনিক!
উনি— ও ছেলের বিয়ে দিচ্ছো! হিন্দু মতে?
আমি—হ্যাঁ।
উনি— মেয়েটি
কী, ব্রাহ্মণ?
আমি—হ্যাঁ।
উনি— তবে জাত
মানছো? ধর্মও।
আমি—না। নিজে অসবর্ণ বিয়ে করেছি পঁয়তাল্লিশ বছর
আগে। কন্যা আন্তঃপ্রাদেশিক বিয়ে করেছে। পুত্র ধর্মের গণ্ডি ভাঙলেও আশাহত হতাম না।
কিন্তু হয়নি। ধর্ম অন্য অর্থে মানি। যে ষোলোটি অর্থে পুংলিঙ্গে ধর্মকে বুঝিয়েছেন
হরিচরণ তাদের কয়েকটির অর্থে! কিন্তু তার সঙ্গেই নাস্তিকতা আস্তিকতার যোগ নেই। জাতপাত
আস্তিক ছাড়া কেউ মানতে পারে না। কিন্তু হিন্দুধর্মে সব চলে। নইলে দয়ানন্দ, সাভারকরদের বিধানে অসবর্ণ বিবাহ
মহোৎসাহে দেওয়া যায়! মুন্সিরাম তথা শ্রদ্ধানন্দ তো নিজের কন্যার অসবর্ণ বিবাহ
দিয়েছিলেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে, যেমন বিদ্যাসাগর নিজের পুত্রের সঙ্গে বিয়ে
দিয়েছিলেন বিধবার।
উনি— কিন্তু,
জাতপাতের সঙ্গে ধর্মের আর যোগ নেই! আর ভারতে জাতপাতের গণতান্ত্রিক পুনর্জন্ম হয়েছে। এটা জানতে আর রজনী
কোঠারি লাগে না।
আমি— না। জাতপাতের উৎস ধর্মই। গীতায় কৃষ্ণের উক্তি,
‘চাতুর্বর্ণ্য ময়া সৃষ্টঃ, গুণকর্ম বিভাগসঃ’ ইত্যাদি। জাতপাতের
পুনর্জন্মে এ কাস্ট আর সে কাস্ট নয়, সেটাও অর্ধেক মানি! বেঙ্গল
ম্যাট্রিমনিতে ‘কাস্ট নো বার’ লেখা ছিল। অ- ব্রাহ্মণ, অ-বৈদ্য, অ-কায়স্থ পাত্রী পেলে লুফে নিতাম।
তার চাকরি পেতে সুবিধে হতো। কিন্তু শুচিতা-অশুচিতার অনন্ত হিসাবের রাবণসিঁড়ি
হিসেবে জাতপাত মানি না। এ ব্যাপারে আমি জ্যোতিবা ফুলের অনুসারী। উনি
চাতুর্বর্ণ্যকে দ্বান্দ্বিক দ্বৈবর্ণ্যে নামিয়ে এনেছিলেন, ভাট-সাহুকার-মহাজন
একদিকে আর বাকি দলিতরা আরেকদিকে।
উনি— কিন্তু
জাতপাত মানে না বলে যারা ছেলের পৈতে দেয় না, তারাই আবার ছেলের বিয়েতে মন্ত্র পড়তে,
পড়াতে, পাড়তে পারে?
আমি— কেন পারবে
না? বিবাহের মন্ত্র হিন্দুধর্মে
অসাধারণ। আর তা
ছাড়া অং বং চং-এর বাইরে হিন্দুবিবাহের অনেকটাই
তো সামাজিক আচার, লোকাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু তা বলে উপনয়ন করতে হবে, ছেলেকে দ্বিজ করতে? দ্বিজ শব্দের প্রাথমিক অর্থ দ্বি✓জন্+ড থেকে নিষ্পন্ন হওয়ায় সব ভালো
অভিধানেই তার প্রাথমিক অর্থ সাপ, পাখি, মাছ; যেহেতু তাদের ডিম থেকে সন্তান হয়। একমাত্র মাধ্যমিক অর্থেই তা পৈতে হওয়া বামুনকে বোঝায়। আর মানুষের
বাচ্চাকে খরচা করে নিম্নতর যোনির সাপ, পাখি, মাছ বানাতে হবে কেন? বিয়ের কথা আলাদা। একটি ছেলে একটি মেয়ের সঙ্গে সহবাস
করবে, শব্দটির সংকীর্ণ, প্রসারিত সব অর্থেই। মন্ত্রের গাম্ভীর্য, মাধুর্য এর মধ্যে
অন্য এক একত্বের আয়তন, দ্যোতনা নিয়ে আসে।
উনি— পৈতে
না হলেও সমাজে ব্রাহ্মণ আধিপত্য সরেছে কি? এমনকি এই দলিত জাগরণের যুগেও? কিছুকাল
আগেও ভারতের মোট জনগণের তিন শতাংশের মতো এই জাতিগোষ্ঠি সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকরি বাকরির
বিশাল অংশ জুড়ে থাকতো। এখনও সেই তেজ, রস পুরো
মরেনি। চাকরি বাকরি ছাড়াও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কথা ভুললে চলবে না।
আমি— কিন্তু
ওঁরা তো ব্রাহ্মণ নন! ব্রহ্মবন্ধু! শ্লোকে বলে ‘জন্মণা জায়তে শূদ্রঃ, সংস্কারাৎ দ্বিজোচ্যতে। বেদপাঠাৎ ভবেৎ বিপ্রঃ, ব্রহ্মং
জানাতি য স ব্রাহ্মণঃ’। সেই
নিয়মে এঁরা তো বিপ্রও নন, বৈদিক বিধানেই কেবল ব্রাহ্মণগৃহে জন্মসূত্রে ব্রহ্মবন্ধু। কেবল পৈতে ক’রে বা প’রে সাপ, ব্যাঙ, পাখি, মাছ ইত্যাদির
সমগোত্রীয় হয়েছেন। আমি নাস্তিক, গ্রহ
নক্ষত্র, রাশিটাশি, জ্যোতিষ-টোতিষ মানি
না। এঁদের হঠাৎ ব্রাহ্মণ ভাবতে যাবো কেন? এঁরা তো আসলে, রবীন্দ্রনাথের
ভাষায় শণের দাড়ি পরা যাত্রার নারদ, আসল দেবর্ষি নন।
উনি— আবার
ধারণাবিপর্যয় হয়ে গেল না? নাস্তিকতা-আস্তিকতার সঙ্গে জ্যোতিষ-টোতিষের কার্য-কারণগত সম্পর্ক আছে নাকি? বিদেশে,
এমনকি এদেশেও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা নাস্তিক হয়েও জ্যোতিষ মানেন, আবার অনেকে আছেন যাঁরা আস্তিক হয়েও জ্যোতিষ মানেন না। অনেকে আবার
ঈশ্বরের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদী হয়েও জ্যোতিষ-টোতিষের ক্ষেত্রে নন। তাদের সায়েন্স মনে
করেন।
আমি— হতে
পারে! আমার স্বর্গতা পিতামহী পরম ভক্তিমতী হয়েও জ্যোতিষ-টোতিষের ধার ধারতেন না। তাঁর মুখের কথা ছিল ‘গণৎকার
যদি গণবে ঠিক, দোরে দোরে কেন মাগবে ভিখ’। আবার নিশ্ছিদ্র আস্তিক স্বর্গত পিতা
গুরু-পাণ্ডা-পুরুতের ধার ধারতেন না, বলতেন ‘বড়সাহেবের ঘরে অ্যাক্সেস আছে,
দারোয়ানকে ঘুষ দেবো কেন?’ কিন্তু শৈশব থেকে গনৎকারে গমগম করতো বাড়ি। কিন্তু ঈশ্বর, নিতান্ত তেত্রিশ কোটি দেবতার গোটা পনেরোকে
মানে বা পূজা করে, আর গনৎকারের দোরে ঘোরে এমন মানুষের সংখ্যা, আর নাস্তিক এবং জ্যোতিষ-টোতিষ মানে না এমন
মানুষের সংখ্যা আস্তিক কিন্তু জ্যোতিষ
মানে না এমন মানুষের
সংখ্যা বা নাস্তিক কিন্তু জ্যোতিষ মানে না এমন মানুষের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি নয় কি? আপনাদের কথায় আস্তিকতা আর জ্যোতিষবিশ্বাস আর নাস্তিকতা এবং জ্যোতিষে
অবিশ্বাসের সদর্থক সহসম্বন্ধ তথা পজিটিভ কোরিলেশন উচ্চ মাত্রার। আস্তিকতা আর জ্যোতিষে অবিশ্বাসের এবং নাস্তিকতা আর জ্যোতিষে বিশ্বাসের সহসম্বন্ধ
নঞর্থক না হলেও ক্ষীণ। আসলে এঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই বিশ্বাসগুলো সিম্পটম হিসেবে
আসে না, পরস্পর সংযুক্ত সিনড্রোম হিসেবে আসে।
উনি— আস্তিকতা আর জ্যোতিষবিশ্বাসের কোনো মিলিত সিনড্রোম কতটা জোরালো? এটাও
তুমি কি গুলিয়ে ফেলছো না?
আমি— মনে হয় গোলাচ্ছি না! কিন্তু প্রাচীন গ্রিসে হিপারকাউস (Hipparchus) থেকে শুরু করে ধর্মের ‘stellar cult’-র বা ‘astrolatry’-র কথা, যেমন আমাদের এখানে রাহু-কেতু বিশেষ করে শনির পূজার কথা, যদি নাও তুলি, তাহলেও কোপার্নিকাস, কেপলার এবং গ্যালিলিওর নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতি যেভাবে ফলিত জ্যোতিষের মূল ভিত্তি সূর্যকেন্দ্রিক জগতের তত্ত্বকে অধঃখনিত করেছিলো তাতে ধর্মের অনুমোদন ছাড়া জ্যোতিষের অস্তিত্বই সম্ভব ছিল না। আর তাতে চার্চের সমর্থনের কথা, ইনকুইজিশনের কথা, মনে রাখবেন প্লিজ! আমাদের এখানে ‘ঈশ্বরাসিদ্ধঃ প্রমাণাভাবাৎ’— হিন্দু জ্যোতিষের কোনো বইতে সাংখ্যদর্শনের ধরনে এমন কথা লেখা থাকবে এমন আশা করার মত মূর্খ নই। কিন্তু রাশিচক্রে গোলমাল থাকলে অসংখ্য টিভি চ্যানেলে, তারাপীঠের দেয়ালে দেয়ালে তান্ত্রিকরা শান্তিস্বস্ত্যয়নের, যাগযজ্ঞের, কালীপূজার যে বিধান দেন তার সঙ্গে হিন্দু ধর্মের যোগ গভীর।
আমি— মনে হয় গোলাচ্ছি না! কিন্তু প্রাচীন গ্রিসে হিপারকাউস (Hipparchus) থেকে শুরু করে ধর্মের ‘stellar cult’-র বা ‘astrolatry’-র কথা, যেমন আমাদের এখানে রাহু-কেতু বিশেষ করে শনির পূজার কথা, যদি নাও তুলি, তাহলেও কোপার্নিকাস, কেপলার এবং গ্যালিলিওর নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতি যেভাবে ফলিত জ্যোতিষের মূল ভিত্তি সূর্যকেন্দ্রিক জগতের তত্ত্বকে অধঃখনিত করেছিলো তাতে ধর্মের অনুমোদন ছাড়া জ্যোতিষের অস্তিত্বই সম্ভব ছিল না। আর তাতে চার্চের সমর্থনের কথা, ইনকুইজিশনের কথা, মনে রাখবেন প্লিজ! আমাদের এখানে ‘ঈশ্বরাসিদ্ধঃ প্রমাণাভাবাৎ’— হিন্দু জ্যোতিষের কোনো বইতে সাংখ্যদর্শনের ধরনে এমন কথা লেখা থাকবে এমন আশা করার মত মূর্খ নই। কিন্তু রাশিচক্রে গোলমাল থাকলে অসংখ্য টিভি চ্যানেলে, তারাপীঠের দেয়ালে দেয়ালে তান্ত্রিকরা শান্তিস্বস্ত্যয়নের, যাগযজ্ঞের, কালীপূজার যে বিধান দেন তার সঙ্গে হিন্দু ধর্মের যোগ গভীর।
উনি— তোমার সিনড্রোমের তত্ত্ব ঠিক হলে আস্তিক-জ্যোতিষবিশ্বাসী
মানুষরাই তো বেশি নীতিবাদী হবেন! কারণ পৃথিবীতে নীতির প্রথম পাঠগুলি ধর্ম থেকেই
এসেছে। ধর্ম থেকেই প্রাথমিক বৈধতা পেয়েছে। কিন্তু তুমি তো নাস্তিক
হয়েও হিন্দুবিবাহে রাজি, কিন্তু আবার নীতিবাগীশ।
তুমি কি অসমঞ্জস নও?
আমি— একেবারেই
নয়! বিয়ে তো দিতেই হবে। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টেই হোক আর হিন্দু ম্যারেজ
অ্যাক্টেই হোক, রেজিস্ট্রার ঈশ্বরের নামে শপথ নেওয়াবে। তার চেয়ে মেরুপৃষ্ঠঋষি,
গায়ত্রীচ্ছন্দের আওয়াজে বিয়েটা বেশ আত্মিক আত্মিক শোনাবে। আর এক সময়ে, অন্ততঃ
গ্রিক যুগে, ইউরোপে ধর্মের সঙ্গে নীতির
অন্যোন্যসম্পর্ক অচ্ছেদ্য ছিল না। অ্যারিস্টটেলিয় সংজ্ঞায় ‘virtue’-র ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল ন্যায়ের সঙ্গে। Virtue
কেবল তার ধারককে নয়, সমভাবে তার কাজকেও ভালো করে তোলে (‘virtus
est quae bonum facit habentem et opus eius bonum reddit’)। কিন্তু virtue ন্যায়ের মধ্যে প্রোথিত এই কারণে যে সকলকে তার প্রাপ্য বুঝে দেওয়া তথা
ন্যায় (reddere debitum aliqui) একটি ‘ভালো’। আর
ধর্মের নির্যাস যেখানে ঈশ্বরকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া (reddere honorem debitum
Deo) সেই কারণে ধর্ম পরম virtue। এর থেকেই ধার নিয়ে
অ্যারিস্টটলের খ্রীষ্টীয় শিষ্য অ্যাকোয়াইনাস বলেছিলেন ধর্ম নৈতিক virtue গুলির মধ্যে গরীয়ান (praeminet inter
alias virtutes morales)। কিন্তু এর থেকেই তো বোঝা যায় যে ন্যায়, নীতি,
সদাচরণের ধর্মহীন অস্তিত্ব আছে। আধুনিককালে ধর্ম আর নীতির সম্পর্ক অনেক বেশি
তর্কিত। পল ডিনার (Paul
W. Diener) ধর্ম ও নীতির সম্পর্ক সম্বন্ধে
তাঁর বইতে দেখিয়েছেন তিনটি সম্ভাব্য উপায়ে ধর্ম ও নীতি কিভাবে পরস্পরের সম্মুখীন
হয় আর এক অন্যের মোকাবিলা করে তাকে ভাবা সম্ভব—
·
এরা এত
নিকট হতে পারে যে প্রায় অচ্ছেদ্য।
·
এরা
সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক ক্রিয়াকলাপ হতে পারে, ফলে পুরোপুরি বিচ্ছেদ্য।
·
এরা
পুরোপুরি অচ্ছেদ্য বা বিচ্ছেদ্য না হয়ে ‘relational’
বা বিভিন্নভাবে সম্পর্কসম্বন্ধীয় হতে পারে।
নীতির প্রতি ধর্মীয় অনুধাবনপদ্ধতি প্রথম
বিকল্পটি নেবে। সেকিউলার দৃষ্টিভঙ্গি বাছবে দ্বিতীয়টিকে। আর তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গির
বিকল্পটি দুই আপাতঃ বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির সব চেয়ে ভালো দিকগুলিকে বেছে নেবে (Religion and
Morality: An Introduction, Louisville, Ky.:
Westminster John Knox Press, 1997, p. xi)। আমি কান্টের নৈতিকতা বিষয়ক ‘অটোনমির’ তত্ত্বকে এই তৃতীয় বিকল্পের পক্ষে খাপসই মনে করি। সেখানে আমি
মুক্ত, বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে নিজের প্রবৃত্তি গুলিকে লাগামছাড়া হতে
না দিয়ে তাদের একটি নিয়ম দিই, যেটি কেবল
আমার প্রতি প্রযোজ্য হলেও ইউনিভার্সাল। সেটি এক ধরণের ‘autocracy’। সেটি stoic autarky-র অসদৃশভাবে প্রকৃতিকে নয়,
আমাদের মানবিক স্বাধীনতাকে সামনে আর কেন্দ্রে রাখে।
উনি— তুমি সমগ্র নৈতিকতাকে
ব্যক্তিচিন্তার নড়বড়ে ভিত্তির উপর বসাচ্ছো।
আমি— হতেই পারে! আমার যে বুদ্ধি আমায় নাস্তিক করেছে, রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গে শচীশের ঢঙে বলতে শিখিয়েছে— ঈশ্বর যদি থাকেন তবে আমার এই
বুদ্ধি ঈশ্বরের দেওয়া, এই বুদ্ধি বলছেন ঈশ্বর নেই/ অতএব ঈশ্বর বলছেন ঈশ্বর নেই
(তর্কবাক্যটির চতুষ্পদী হেত্বাভাস সত্ত্বেও) — সেই বুদ্ধিই আমাকে নীতির বোধ দিয়েছে, কাণ্টীয় অটোনমির
অংশ হিসেবে। ধর্মের পথে যাওয়া যাবে না
নীতি খুঁজতে। কারণ মহাপুরুষরা প্রায়ই বলেন, ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং
ব্রজঃ’ (গীতা), অথবা ‘He who is not with Me is
against Me, and he who does not gather with Me scatters’ (Matthew, 12.30), এমনকি বুশ জুনিয়রও বলার
সাহস পেয়েছিলেন যে ‘you’re either with us, or against us’। আর ধার্মিক মানুষরা
প্রায়শঃই গীতায় অর্জুনের ভঙ্গিতে বলবেন—
জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ।
জানাম্যধর্মং ন চ মে নিবৃত্তিঃ।
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন।
যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।
ধর্মীয় নীতিবাদীরা এই শ্লোকে কিছু অনর্থ দেখবেন না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ, আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না। তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সে দিকে চলব (শান্তিনিকেতন, ৮,১২ রবীন্দ্র রচনাবলী)।’ কিন্তু আমরা দেখেছি যে নিজের অটোনমিকে এইভাবে ছেড়ে দিলে মানুষ ‘actor’ থেকে ‘agent’ হয়ে যায়। আলথুসারের (Althusser) ভাষায় ‘subject’ হয়ে যায়, আর হানা অ্যারেণ্ড-এর ভাষায় ‘banality of evil’-এ নির্বিবাদে অংশ নেয় (Hannah Arendt, Origins of Totalitarianism), ‘যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি’ ব’লে। নাৎসিদের Auschwitz-এ অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ, দায়িত্ববান মানুষদের আদিষ্ট কর্তব্যপালন আমরা দেখিনি কি? তাই আমার নীতিতে ধর্মের স্থান নেই, সে অটোনমাস।
ধর্মীয় নীতিবাদীরা এই শ্লোকে কিছু অনর্থ দেখবেন না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এ শ্লোকের মানে এমন নয় যে আমি ধর্মেই থাকি আর অধর্মেই থাকি তুমি আমাকে যেমন চালাচ্ছ, আমি তেমনি চলছি। এর ভাব এই যে, আমার প্রবৃত্তির উপরেই যদি ভার দিই তবে সে আমাকে ধর্মের দিকে নিয়ে যায় না, অধর্ম থেকে নিরস্ত করে না। তাই হে প্রভু, স্থির করেছি তোমাকেই আমি হৃদয়ে রাখব এবং তুমি আমাকে যেদিকে চালাবে সে দিকে চলব (শান্তিনিকেতন, ৮,১২ রবীন্দ্র রচনাবলী)।’ কিন্তু আমরা দেখেছি যে নিজের অটোনমিকে এইভাবে ছেড়ে দিলে মানুষ ‘actor’ থেকে ‘agent’ হয়ে যায়। আলথুসারের (Althusser) ভাষায় ‘subject’ হয়ে যায়, আর হানা অ্যারেণ্ড-এর ভাষায় ‘banality of evil’-এ নির্বিবাদে অংশ নেয় (Hannah Arendt, Origins of Totalitarianism), ‘যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি’ ব’লে। নাৎসিদের Auschwitz-এ অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ, দায়িত্ববান মানুষদের আদিষ্ট কর্তব্যপালন আমরা দেখিনি কি? তাই আমার নীতিতে ধর্মের স্থান নেই, সে অটোনমাস।
আসলে পৃথিবীতে ক্লেসিপ্পাউসরা কমে
আসছে। তাদের সরল বিশ্বাসেও যুক্ত হয়েছে যুক্তি। তাই বাঁচুক। তাতে ধর্ম লাগে না। কথার
পিঠে কত কথা এলো! কিন্তু কথনবিশ্বে আর কিবা হবে? বলুন!
কথনবিশ্বে কিছু না হলেও লেখাটা সময়োপযোগী।
উত্তরমুছুন