কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

কালিমাটি অনলাইন / ১৩

সম্পাদকীয়



‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা জানেন যে, এই সংখ্যাটি পত্রিকার দ্বিতীয় বছরের প্রথম সংখ্যা রূপে প্রকাশিত হলো। গত এক বছরে প্রতি মাসে নিয়মিত ভাবে পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রতিটি সংখ্যাকে তার আগের সংখ্যা থেকে আরও সমৃদ্ধ এবং মননশীল করে তোলার প্রয়াসে আমরা সাধ্যমতো যত্নবান ছিলাম। তা সত্ত্বেও সব লেখা সবার কাছে সমান ভাবে হয়তো সমাদৃত হয়নি। এবং এছাড়াও আর কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে থাকতে পারে। আমরা দ্বিতীয় বছরে এ ব্যাপারে আরও সতর্ক ও সচেতন থাকার চেষ্টা করব। সেইসঙ্গে আশা করব, প্রিয় পাঠক-পাঠিকারাও আমাদের এ ব্যাপারে আন্তরিক সহযোগিতা করবেন।

গত এক বছরে মাত্র ১২টি সংখ্যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী যে বিপুল সংখ্যক পাঠক-পাঠিকাদের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমাদের যথার্থই বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছে। ‘কালিমাটি অনলাইন’এর দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ মুহূর্তে আমরা লক্ষ্য করছি, ইতিমধ্যে প্রায় ৪৭ হাজার বার (৪৬৯৮৫) এই ব্লগজিন ‘দর্শক’রা খুলে দেখেছেন। ইতিমধ্যে বিশ্বের যে সব দেশের ‘দর্শক’রা দেখেছেন, তার একটি তালিকা এখানে উপস্থাপন করছি, যাতে পাঠক-পাঠিকারা এই ব্লগজিনের পাঠ-বিশ্ব সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। দেশের নামগুলি যথাক্রমে – ভারত, বাংলাদেশ, ইউনাইটেড স্টেট্‌স অফ আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম, সাউথ কোরীয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস, কানাডা, চেক রিপাব্লিক, আয়ারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, সৌদি আরবিয়া, রোমানিয়া, উগান্ডা, সাউথ আফ্রিকা, তাইওয়ান, রাশিয়া, চীন, নেদারল্যান্ডস, পোলান্ড, ওমান, পাকিস্তান, বাহারিন, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, মালদ্বীপ, জাপান, ফিনল্যান্ড, লিবিয়া, ইউক্রেন, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত, নরওয়ে, বেলজিয়াম, সাইপ্রাস, ভূটান, ব্রুনেই, ইজরায়েল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, বাহমাস, বসনিয়া, আফগানিস্তান, ইজিপ্ট, আলজেরিয়া, ডেনমার্ক, ইরাক, স্পেন, শ্রীলঙ্কা, হংকং, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কেনিয়া, ভিয়েতনাম। অর্থাৎ মোট ৫৯টি দেশে বসবাসকারী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। এছাড়া সমুদ্রপথে যাত্রাকালীন অনেকেই যে এই ব্লগজিন খুলে দেখেছেন, তা আমাদের কাছে রক্ষিত মানচিত্রে উল্লেখিত আছে। সুতরাং আমরা আশাবাদী হতেই পারি, আগামী কয়েক বছরে ‘কালিমাটি অনলাইন’ পৌঁছে যাবে বিশ্বের আরও অনেক দেশে। এবং সেইসঙ্গে আমরা নিশ্চিত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনুরাগী কবি, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, নিবন্ধলেখক ও শিল্পীরা তাঁদের উৎকৃষ্ট সৃষ্টি ও নির্মাণ পাঠিয়ে ‘কালিমাটি অনলাইন’কে আরও মননশীল ও সমৃদ্ধ করে তুলবেন।

দ্বিতীয় বছরের প্রথম সংখ্যা প্রকাশের এই আনন্দঘন মুহূর্তেও কিন্তু আমাদের মন বিষণ্ন হয়ে আছে গভীর শোক ও বেদনায়। গত ৫ই মার্চ আমরা হারিয়েছি আমাদের অতি আপনজন এবং সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার নতুন ধারার প্রবর্তক কবি স্বদেশ সেনকে। তাঁর এই চলে যাওয়াটা যে ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের কাছে এবং একইসঙ্গে বাংলা কবিতার জগতে কী সাংঘাতিক শূন্যতা সৃস্টি করেছে, তা কোনো ভাবেই কোনো ভাষাতেই ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। আমরা সত্যি সত্যিই অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছি। স্বদেশদা বিগত দু’তিন বছর ধরে খুবই অসুস্থ ছিলেন। তিনি কিডনির অসুস্থতায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর ঘরেই চিকিৎসা চলছিল। প্রথমদিকে দিনে তিনবার এবং শেষদিকে দিনে চারবার তাঁর ডায়ালিসিস করা হচ্ছিল। ক্রমশই কমে আসছিল তাঁর চলার ক্ষমতা, পড়াশোনা করার জন্য পর্যাপ্ত দৃষ্টিশক্তি। কবিতা আর লিখতে পারছিলেন না। অথচ কবিতা-ভাবনা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। নিতান্তই আত্মপ্রচারবিমুখ কবি ছিলেন তিনি। তাঁর লিখিত কবিতার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। মাত্র তিনটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’, ‘মাটিতে দুধের কাপ’ এবং ‘ছায়ায় আসিও’। এছাড়া সম্পাদিত কবিতা সংকলন ‘স্বদেশ সেনের স্বদেশ’-এ সংকলিত হয়েছে এই তিনটি কবিতা সংকলনের বেশ কিছু কবিতা এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ও অগ্রন্থিত অনেক কবিতা। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, মাত্র এই তিনটি কবিতা সংকলনে তিনি জন্ম দিয়েছেন বাংলা কবিতার এক নতুন ধারা, এক নতুন কবিতা-ভাবনা, এক নতুন কবিতার আঙ্গিক ও ভাষা। না, এই অনন্য কবি-প্রতিভার জন্য তিনি প্রকৃত প্রাপ্য কোনো সম্মান পাননি। কোনো উপযুক্ত সংবর্ধনা পাননি। কোনো বৃহৎ সাহিত্য পত্রিকা গোষ্ঠীর দাক্ষিণ্য ও আনুকূল্য তিনি পানন; অবশ্য তিনি তা চানওনি। শুধুমাত্র বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর উদ্যোগে তাঁকে ‘বিভা চট্টোপাধ্যায় স্মারক পুরস্কার’এ সম্মানিত করা হয়। তবে তিনি বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে সংবর্ধিত হয়েছেন কয়েকবার। আসলে তাঁর যাবতীয় কবিতা প্রকাশিত হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনেই। লিটল ম্যাগাজিনেই ছিল তাঁর ‘প্রাণের আরাম’।

প্রসঙ্গত জানাই, ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের একটি সংখ্যা আমরা ‘স্বদেশ সেন সংখ্যা’ রূপে প্রকাশের পরিকল্পনা করেছি। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবেদন, আপনারা এই সংখ্যার জন্য লেখা পাঠাতে পারেন। এই প্রসঙ্গে আরও জানাই, গত ২০১২ সালে ‘কালিমাটি’ পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা একটি ওয়েবসাইট শুরু করেছি ‘সংকলিত স্বদেশ সেন’। স্বদেশ সেনের লেখা কবিতা ও গদ্য, তাঁর সাক্ষাৎকার, ছবি, তাঁর ওপর লেখা বিভিন্ন জনের আলোচনা ইত্যাদি সব কিছুই সংগৃহিত আছে। আপনারা লগ অন করতে পারেন : www.swadeshsenkalimati.weebly.com

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kalimationline100@gmail.com / kajalsen1952@gmail.com
প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :
0657-2757506 / 09835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India

<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১) অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

কবিতার বিপদভূমি : পারহাম শাহরজের্দি
অনুবাদ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


[পারহাম শাহরজের্দি (জ. ১৯৮০, তেহরান), প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক। বর্তমানে প্যারিসে থাকেন। সমসাময়িক ফার্সি কবিতার বহু সংকলন সম্পাদনা করেছেন। অনুবাদ করেছেন। ফার্সি ‘নতুন কবিতা’ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে হাতে আসে ওঁর একটি দুরন্ত লেখা। পারহাম নিজে কবি নন, বা কবিতা লেখেন না বলেই হয়তো এরকম সপাটে বলে ফেলতে পেরেছেন কথাগুলো। যা ফার্সি কবিতার প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ‘কবিতা’ বিষয়ে ওঁর যে চিন্তা সোজা-সাপটা উঠে এসেছে এখানে, তা’ বিশ্বকবিতার পরীক্ষামূলক মুক্তধারারই প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর যে কোনো মানচিত্রে ব’সে এ লেখা পড়তে পারেন কবিতার একজন আবিষ্কারক। অথবা কবিতার একজন বিপ্লবী। অবশ্যই যদি তিনি ‘নতুন জিভের মতো অল্প লালা ভাষাটা’ চান। আজকের ইরানে, যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, কবি-সাহিত্যিকরা রাজনৈতিক ব্যাপারে যেখানে প্রত্যক্ষ সমালোচনা করতে পারেন না; ১৯৭৯-এর ইসলামিক রেভোলিউশনের পর একনায়কতান্ত্রিক শাসকের ক্ষমতা দখল; সাহিত্যে শিল্পে সরকারের নিয়ন্ত্রণ; প্রকাশনা ব্যবস্থা, কবিতা, সাহিত্য, শিল্প, ফিল্ম, রেডিও, টিভি, গ্যালারি এক্সিবিশন, মিউজিয়াম, ইন্টারনেট সর্বত্র অত্যাধিক মাত্রায় সেন্সরশিপ, রাষ্ট্র যেখানে প্রত্যেকটা মুহূর্তে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, না পারলে তোমার বিরুদ্ধে যাবে, যেখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে লেখালিখি করা, শিল্প চর্চা করাটাই বিরাট ঝুঁকির প্রশ্ন — সেই রিস্কডমে দাঁড়িয়ে, বিপদনগরের কথা, কবিতার বিপদের কথা বলেছে এই গদ্য। কবিতার মুক্তির কথাও।

প্রবন্ধটি ‘Sens Public Revue électronique internationale’-এ ২০০৯-এ প্রকাশিত। চোদ্দ অনুচ্ছেদের প্রবন্ধটির সাতটি অনুচ্ছেদের (১-৬ এবং ৮) অনুবাদ করেছি আমি, বাংলায়। যে অংশটুকু করিনি, সেখানে মূলত আবদোলরেজায়েই-এর (ফার্সি কবি, ১৯৮৮-’৮৯ সাল নাগাদ ফার্সি কবিতায় যে ‘নিউ পোয়েট্রি’ মুভমেন্ট হয়েছিল, তার অন্যতম একজন) কবিতা নিয়ে কথা বলেছেন পারহাম। প্রসঙ্গত, ‘I live in Riskdom’ এই নামে আলি আবদোলরেজায়েই-এর একটি কবিতার বই আছে (মূল বইটি ফার্সিতে লেখা, ইংরেজি অনুবাদ আবোল ফ্রাওশান-এর), পারহাম ওঁর এই নিবন্ধে আবদোলরেজায়েই-এর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই কবিতা, কবিতার ভাষা, সমসাময়িক ইরানি সাহিত্য ইত্যাদি আরো নানান অনুষঙ্গ ছুঁয়ে গেছেন। লেখাটিতে যে কবিতাগুলো পারহাম উদ্ধৃত করেছেন সেগুলো সবকটিই আবদোলরেজায়েই-এর কবিতা। বাংলায় রূপান্তর আমার।

‘রিস্ক অফ পোয়েট্রি’ এমন এক গদ্য যা একই বিষয়ের ওপর ফরাসী, ইংরেজি এবং ফার্সি — এই তিনটি ভাষায় লেখা তিনটি আলাদা টেক্সট। ফরাসী টেক্সটটির নাম ছিল ‘Risquer la Poésie’, ইংরেজি টেক্সট ‘Risk of Poetry’। মজার বিষয় হলো, এখানে প্রতিটি ভাষা (ফরাসী, ইংরেজি, ফার্সি) তার নিজের ভাষাটির সন্ধান করেছে, একটি ভাষা আরেকটি ভাষাকে হুবহু অনুবাদের চেষ্টাই করেনি। একটি টেক্সট আরেকটি টেক্সটের ভাষায় কথা বলেনি। যদিও Sens Public পত্রিকা এই তিনটি টেক্সটের মধ্যে বেশ কিছু trace-কে retain করেছে, ফলে তিনটি টেক্সটের মধ্যে সম্পূর্ণ না হলেও অনেকটাই অনুরূপতা পাওয়া যায়। তবুও এই ট্রিলজিতে একটা টেক্সটের সাথে আরেকটা টেক্সটে বেশ কিছু জায়গায় এখনও অনেক মিউটিলেশন ঘটে রয়েছে। আর এখানেই এই ট্রিলজি ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে ওঠে, এবং ঝুঁকি সে নেয়ও। এবং বিপদে ফেলে। আমি এখানে যে অংশের অনুবাদ করেছি, ফরাসী এবং ইংরেজি টেক্সট দুটির সাথে মিলিয়ে সেখানে চেষ্টা করেছি বাংলা অনুবাদে সামঞ্জস্য রাখতে। ফরাসী টেক্সটে যে অংশটি ছিল, কিন্তু ইংরেজিতে সেটা না থাকলে বাংলায় তাকে রেখেছি। আবার উলটো দিক থেকেও একই। অতি সামান্য কিছু জায়গায় কয়েকটি পার্সোনাল রেফারেন্স যা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে, রাখিনি। —অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়]

কবিতার বিপদভূমি



অবলিটারেচার — অথবা সেলিব্রিটির মৃত্যু


সাহিত্য? অক্ষর? সাক্ষর, অক্ষর-মানুষ? চলুন সাহিত্য ভোলা যাক এবারে, এগোনো যাক অসাহিত্যের দিকে, সাহিত্যমৃত্যুর (অবলিটারেচার) দিকে, পুরনোটাকে সরিয়ে নতুন ক’রে গ’ড়ে তোলা যাক একে নতুন সাহিত্যের পক্ষে। কারণ এই সাহিত্য ভীষণ শিষ্ট, মার্জিত এবং সূক্ষ্ম ও অলিখিত একটা আচরণবিধি দিয়ে সাহিত্যকে বিশুদ্ধ আর গোছানো পরিপাটি সুবিন্যস্ত ক’রে রেখে দেয়। যা ভীষণ প্রতিক্রিয়াশীল। স্থবির একটা বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি ভাববো সেই স্থবির বিনোদন নিয়ে? নিশ্চল সাহিত্য নিয়ে? স্রোতহীন জলে সাহিত্যের পরিতৃপ্তি নিয়ে কি ভাববো আমরা? না। এই সাহিত্য শেষ হয়ে গেছে। শেষ ক’রে দিচ্ছে এই সাহিত্য সবকিছুকে।

ইরানি সাহিত্যের এই পরিপাটি ও সুবিন্যস্ত লেখকগণ একটা প্রচলিত ব্যবস্থার আদেশ (নীতি-নৈতিকতার আদেশ, ধর্মীয় আদেশ, রাজনৈতিক আদেশ) পালনে সুপারদর্শী। যাতে তাদের ফার্সি সাহিত্য আরো পশ্চাদমুখী হয়, আরো আরো পেছনে পিছিয়ে যায়।

ইরানি সাহিত্যের প্রচল ধারা এর পেছনে ধাওয়া করতে করতে নিজেই এখন একটা প্রোটেক্টেড জোন হয়ে উঠেছে — লিটেরারি প্রোটেক্টরেট। আর এই সাহিত্যের সেই লেখকেরা এ ব্যবস্থার সাথে সহাবস্থান করতে করতে, এটাকে মেনে নিতে নিতে হয়ে উঠেছে আইন বলবৎকারী। একজন কেউ নেই যে এই রক্ষণশীলতাকে আঘাত করবে, যে এই সুপরিপাটি ছিমছাম সুবিন্যস্ত সীমার বাইরে ভাষাটাকে নিয়ে যাবে। তার মানে তুমি যদি লাইনটা অতিক্রম না করো — থেমে যাচ্ছো তুমি।

আদেশ এবং ভয় একটা বিন্দুতে এসে মেলে : তুমি সীমা লঙ্ঘনে ভয় পাছো, তুমি ভয় পাচ্ছো অপরিপাটি বিশৃঙ্খল হতে, তুমি এই প্রচল ব্যবস্থার আদেশনামার ধ্বংসস্তূপ মেরামতে ভয় পাচ্ছো, ভয় পাচ্ছো ভীষণ আলাদা হয়ে যেতে, পরিবর্তনকে ভয় পাচ্ছো, অচেনা অজানাকে ভয় তোমার, ঝুঁকি নিতে আর ঝুঁকিকে বিপজ্জনক করে তুলতে ভয়, ভয়কেই তোমার ভয়।

যেন এখানে বিধিবদ্ধ প্রবন্ধ, বইয়ের পৃষ্ঠার সংখ্যাঙ্কিতকরণ আর চিত্তবিভ্রম ছাড়া ‘সাহিত্য’ ব’লে আগে কক্ষনো কিছু ছিলই না। এই ঘোরলাগাটাকে ভাঙতেই হবে, ভাঙতেই হবে।


পৃথিবীর ভাষা, কবিতার ভাষা, ঝুঁকির ভাষা

লেখা হয় দুনিয়ার ভিত্তিপ্রস্তরটাকে নাড়া দেবার জন্যে। ভাষা এই পৃথিবীর ভিতটাকে নির্মাণ করেছে এবং করছে। এই ভিতটাকে এক হাত নিতে, সমস্ত পরিস্থিতি ও কার্যক্রমের সাজানো বিন্যাসটাকে হারাতে, এই সাজানো বিন্যাসের ধারাটাকে ভাঙতে, আমরা দুনিয়ার ভিত্তিপ্রস্তরেই হাত দেব।

বিপদ শুরু হয় তখনই যখন কবি উঠে দাঁড়ায়, দৈনন্দিন ভাষার বিরুদ্ধে, যোগাযোগের ভাষা ও কথোপকথনের ভাষার বিরুদ্ধে, ভাষার সাধারণ ব্যবহারের বিরুদ্ধে, যখন সে অবিচলিত দৃঢ় উঠে দাঁড়ায় চলতি দুনিয়ার বিরুদ্ধে। কবিতার ভাষা রোজকার অভ্যেসের ভাষা নয়, সংবাদ পরিবেশন নয়, রিপোর্ট লেখার মতো জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রতিবেদন বা বিবরণ লেখা নয়, জ্ঞানগর্ভ কোনো কিছু নয়, শিক্ষাদানও করে না, পুনরাবৃত্তি নয়, বারবার একই জিনিস ঘটে যাওয়াও নয়।

প্রচল ধারা সবসময় তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, সবসময় সে থেকে যেতে চায়, সেজন্যেই সে জনপ্রিয়তার রাস্তা অনুসরণ করে, আমরা কি হাঁটব জনপ্রিয় রাস্তায়?

ব্যাকরণ, ফার্সিতে একে বলা হয় ‘Dasture zabaan’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘the order of tongue’. অর্ডার? এমন একটা জিভ যে হাতকে আদেশ করছে? কে দিচ্ছে আদেশ? কিসের আদেশ? ব্যাকরণ তো একটা মরাল কনস্ট্রাক্ট একটা নৈতিক কাঠামো, কি করা যাবে আর কি করা যাবে না— আগে থেকে ঠিক ক’রে দেওয়া এরকম একটা তালিকা থেকে যা ভবিষ্যতের ভাষাকে নির্ধারণ করে। কিন্তু কবিতা আর কবি থাকেন সেই আদেশ ও আদেশের ভাষাকে বিচ্ছিন্ন করতে, তাকে দুনিয়া থেকেই সরাতে, ভাষার একটা নতুন বাঁক সৃষ্টির জন্য। তবুও, বিপজ্জনক কবির জন্য ভাষা শুধু একটা উপায় বা কোনো মাধ্যমমাত্র নয়, ভাষা তার কাছে পুরোটা, এবং তার কাজের মূল লক্ষ্যবস্তু।


সাহিত্যে শূচিতা— পবিত্র বা শুদ্ধ সাহিত্য


শূচিতা এবং পবিত্রতা এমন একটা জিনিস যে, সে যখন হাত তোলে তখন সারা দুনিয়াকেই তার হাতের নিচে নিয়ে আসে। শব্দকে নিয়ে আসে তার আদেশের নিচে। কখনো কখনো হয়তো একটা প্রশ্নের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এই পূত পবিত্রতা। ...কিন্তু তার অসীম পবিত্রতার ফলে সে কখনোই প্রশ্নের সামনে আসে না। অর্থাৎ এর’ম জিনিস রয়েছে যা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলা হয় না। কবিতা কিন্তু যা কিছুকে ইন্টিমেট করে, ইনক্লুড করে — ব্যতিক্রমহীনভাবে তাকে কবিতার প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়। এখান থেকেই শুরু হয় কবিতার ঝুঁকির জায়গা, রিস্ক অফ পোয়েট্রি।

সামাজিক প্রতিষ্ঠান কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণ করতে চায়, কিম্বা সে এমন কবিতা চায় যার সংজ্ঞা নিরূপিত করা আছে। কিন্তু কবিতা কোনো জ্ঞানগর্ভ কিছু নয়, এর কোনো নৈতিক মাপকাঠি নেই। যা দেখেছি তা’ লেখার জন্যে কবিতা লেখা হয় না। কি আছে তা বলার জন্য নয়, কি নেই তা বলার জন্য লেখা হয় কবিতা।

এবারে অল্প সময়ের জন্য একদলীয় শাসনতন্ত্রের বাস্তবে ফিরে আসা যাক, যে কোনো প্রশ্নই যেখানে ঝুঁকিপ্রবণ ব’লে বিবেচিত হতে পারে। ডেকে আনতে পারে জেল, অত্যাচার, বিচার এবং প্রাণদণ্ড দিয়ে যেখানে রাষ্ট্র নিজেই আততায়ী—‘‘এই লোকটা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার পক্ষে একটা বিপজ্জনক লোক’’—‘‘ডেঞ্জেরাস এলিমেন্ট ফর ন্যাশনাল সিকিওরিটি।’’



‘আমি’ বিপদনগরে থাকি

কেউ একজন বললো : আমি বিপদনগরে থাকি, সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে বিপদের মুখেই ফেললো। কেউ একজন তার দেশের বিপদসঙ্কুল হয়ে ওঠার কথা লিখলো আর তৎক্ষণাৎ বিপদের প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিল আরেকটা বিপদকে। কি হলো এতে? (কি ঘটছে?) যখন আমরা বিপদের কথা বলি, কেউ একজন আমাদের সাথে, আমাদের মধ্যে, আমাদেরকে ছাড়াই কথা বলতে শুরু করে দেয়। একটা স্বর আসে কোত্থেকে : বিপদের জন্যেই লেখা, বিপজ্জনকভাবে বাঁচার জন্যে, লেখা থেকে লেখ্যান্তরে যাওয়ার জন্যে, এই বিপদভূমিতে ঘুরে বেড়াবার জন্যেই লেখা। একটা (লেখা) আরেকটাকে (লেখাকে) পাশে নিয়ে চলে। শমন, পরোয়ানা, ঝুঁকি, শমনের বিপদ; টান মেরে ছিঁড়ে ফেলা অংশে দাঁড়িয়ে আছে ওই সেই অপরজন।

খুব কাছ থেকে দেখলে — বিপদের মধ্যে বাঁচা, ঝুঁকির মধ্যে টিকে থাকা, ঝুঁকির কথা। আমি বিপদনগরে থাকি, পড়ুন : আমি শমনের মধ্যে থাকি। এইখানেই আমরা লেখার অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের সাথে মোকাবিলা করছি। ঝুঁকিটা হলো থাকা এবং না-থাকার। লেখালিখির ঝুঁকি, লেখালিখি থেমে যাবার, বন্ধ হয়ে যাবার ঝুঁকি। অন্যভাবে বলা যায়, ঝুঁকি হলো নিশ্চয়তার অভাব। বিপদ এই বিপদ ওই... তো? বিপদ এমন একটা অবস্থা যা deferral (or dropping) of obliteration, ধ্বংস স্থগিত রাখা একট মুহূর্ত। একটা pause, একটা বিরামচিহ্ন। বিপদের আগে অলিখিতকে অলেখাকে রাস্তা ক’রে দিতে হবে। পরোয়ানা আসার আগে ওকেই টেনে নিতে হবে পেছনে। বিপদনগরে থাকা মানে, শমন আসার আগের থেমে থাকা মুহূর্তটায় বাঁচা। যে মুহূর্তে তুমি লিখবে সেটাই ঝুঁকির মুহূর্ত। আমি বিপদনগরে থাকি, আর তারপর? হয় তুমি বিপদকে চেয়ার থেকে ফেলবে, অথবা সে তোমাকে হারাবে। তুমি হয় দীর্ঘায়িত করবে বিপদকে নয়তো শেষ করবে, অথবা সে এসে তোমাকে শেষ ক’রে দিয়ে যাবে। বিপদটাকে শেষ করলে পরোয়ানাও থাকবে না।

বিপদনগর : যখন পরোয়ানা, শমন তার মূল উৎসবিন্দুর কাছে পৌঁছে যায়। আই লিভ ইন রিস্ক্‌ডম্‌। এই একই অভিজ্ঞতার সামনাসামনি হচ্ছি আমরা। ...একটা বিচার চলছে, যা জীবনকে, লেখার জীবনকে, এবং কবির জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলছে। এই অভিজ্ঞতার, এই বিপদের, এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার আর কোনো বাহ্যরূপ নেই। ঝুঁকি, লেখালিখি নিয়ে বাঁচাটাই ঝুঁকি। টেক্সটের (লেখার) মুখোমুখি হওয়াটাও, রাস্তায় একটা অচেনা কারোর দিকে পা বাড়ানোটাই ঝুঁকির। কেউ একজন এমন একটা কিছু লিখেছে যা অন্য কেউ লেখেনি, অন্য কেউই লেখেনি, একজন একটা অজানা কিছু লিখেছে, আনরেকগ্‌নাইজ্‌ড্‌ কিছু, অনাহূত কোনো শব্দ, আগে লেখা হয়নি এমন একটা লাইন বা এমন জাক্সটাপোজিশন যা পূর্বে অপরীক্ষিত, আনফ্যাব্রিকেটেড কোনো ফর্ম বা কো্নো অদেখা ইমেজ, ব্যস্‌, কেউ লিখলো এটা তো ফেলে দাও তাকে ওদের গোলমালে, সংঘর্ষে, বিবাদে। সেই লোকটা কি আর ফিরে আসবে তারপরে? লিখবে কি সেই লোকটা আর? ওরা লিখতে দেবে একটা লোককে? বিপদ কি বিপদসীমার মধ্যেই সীমিত থাকবে?

আমি বিপদনগরে থাকি : ফিরে এসো আর এসে লেখো। তোমার টেক্সটকে তোমার অভিজ্ঞতাগুলো দাও। ফিরে এসে জীবনকে বিপদের প্রসঙ্গে এনে রাখো, লেখার লাইনের ওপর। বিপদ একবার এবং একটিমাত্রবারই আসতে পারে। যা পরোয়ানার পেছনে আছে, ছুঁয়ে আছে প্রান্তসীমা। তাই, লেখার আপতন বিন্দু এই সূক্ষ্ম টাচলাইন। শমন, পরোয়ানা লেখা হয় বিপদের এই টাচলাইনের ওপরেই।

এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয় যে একটা কবিতার শিরোনাম হলো ‘না ভয়’ (Fear Not), আর এর প্রথম লাইনটাই শুরু হয় একটা অপরিহার্য ক্রিয়াপদ দিয়ে। এইখান থেকেই শুরু হয় লিটারেচার।

‘‘আমি একটা দরজা খোলার চেষ্টা করছি
অন্য একটা কথা বলার জন্য
কোনো অন্য কাউকে
আগে কক্ষনো বলতে পারিনি যে কথাটা’’
একটা দরজা খোলা হয়, এবং কথা শুরু হয় তার থেকে। একটা দরজা, এই শব্দটা, এই শব্দটাই। একটা দরজা, কথা বলে এবং শব্দ (word) উচ্চারণ করে এবং অন্য একজন হয়ে ওঠে। অন্য একজনের সাথে কথা বলে। অন্য আরেকটা দরজা সেটা অন্য আরেকজন।

পরিবর্তন এবং ক্রমপরিবর্তন শুরু হয় এই টেক্সট থেকে। এইখান থেকে, একটা বিপ্লব আকৃতি পেতে থাকে, গ’ড়ে উঠতে থাকে এই টেক্সটে।

কবিতায় একটা নতুন বিপ্লবকে আসন দেওয়া এর মানে কী?



পোয়েট্রি অফ মাদার টাং


মা যদি জিভ হয় আর আমরা যদি তার মধ্যে থাকি তাহলে মা কোথায়? আমরাই বা কোথায়? কোথায় আমরা? মায়ের কোন্‌ জায়গায় আছি আমরা? কোথায়, আমাদের ভাষা? আমরা নির্বাসনে, বহু বহু দূরে, আমাদের ছেদবিন্দুটা কী? ‘মা’ হলো দূরত্ব, ব্যবধান। তাহলে ব্যবধান কী? কে এই দূরত্ব? ব্যবধান হলো অন্যের উপস্থিতি। এখানে এবং সেখানের দূরত্ব, আমি এখানে, ওখানে তুমি, আমাদের মাঝখানে ব্যবধান। দূরত্ব নিয়ে এই সেই সবথেকে ভালো লেখা লাইন—
‘‘পৃথিবীর এই দিকে তোমার যদি সন্তান থাকে
সে সন্তান পৃথিবীর ঐদিকেও’’
আত্মদমনের রাস্তা খুঁজতে থাকা কবিতার এই শুরুটা হঠাৎ গিয়ে পড়ে এরকম একটা শেষে—
‘‘পৃথিবীর এই দিকে যদি তোমার মা
সে মা পৃথিবীর ঐদিকেও’’
মা জিভ, মা শরীর, জিভ আর শরীর ব’লে কিছু নেই। মা-ও নেই। মায়ের জিভ মায়ের শরীর আলাদা। মায়ের শরীর থেকে পৃথক হওয়া দিয়ে শুরু আমাদের নির্বাসনের। জন্মের মুহূর্তেই মায়ের শরীর থেকে নেগেশন শেখে শিশু। সমস্ত হঠাৎ জন্ম থেকে, আমরা নির্বাসনে, ব্যবধানে, এখন কথক হয়েছি, অতীত দূরত্বের গল্প বলছি, হাত থেকে সব হারিয়েছি আর তাই লেখার শক্তির কাছে সাহায্য প্রার্থনা, হারিয়ে যাওয়াগুলোকে ডেকে আনতে, খুঁজে আনতে ওগুলোকে, এটাই আনন্দ। এবং মায়ের শরীরের জায়গায়, তার বিকল্পে মায়ের জেণ্ডার ও সেক্সুয়ালিটিকে আমরা বিনিময় করছি শব্দের (word) সাথে, শব্দের জেণ্ডার, সেক্সুয়ালিটি থেকে নন্‌-সেক্সুয়ালিটির দিকে, এবং অবশেষে, শব্দকে একটা জেণ্ডার দিই, শব্দ দিয়ে শব্দের মা বানাই একটা।


দ্রুত, দূরে, দেরি

কাউকে ডাকার জন্য দ্রুততম জায়গাটা কোথায়, যেখানে একটা ডাক (call) ক্ষিপ্রতম গতিতে পৌঁছে যাবে একজনের কাছে এবং ফিরেও আসবে তার কন্ঠস্বর?

দুজন মানুষের একটা নির্দিষ্ট সীমায়িত দূরত্বের মধ্যে ডাক শোনা যায়, দূরত্ব অসীম হয় যখন, শব্দ (word) এবং কথা (speech), অক্ষর (syllable) এবং ধ্বনি (sound) পৌঁছতে ভিন্ন ভিন্ন সময় নিয়ে নেয়, যখন কণ্ঠস্বর, ডাক, গলার আওয়াজ আর শোনা যায় না। তখন দূরত্বের মাঝখানের স্রোত ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেয় কথা—

‘‘মা এটা ছিল আমার মুখের দ্রুততম উচ্চারিত শব্দ
আমি স্রোতে দূরে ভেসে যাওয়ায়
যা বিলম্বিত হয়েছে এখন’’
এখানে একটা স্মৃতি আছে, ভুলে যাওয়া আছে একটা, তারপর আবার মনে পড়া। দূরত্বের জন্যই দূরত্বের মাঝখানে ঢুকে যাওয়া আর সামনের কাউকে ডেকে ফেলা, তক্ষুনি। কখনো কখনো এটা হয়, যখন এই তাৎক্ষণিকতায়, সাহিত্য ভালো লাগার স্বাদ দেয়।


নর্মোপ্যাথি অথবা ডিজিজ অফ স্ট্যাণ্ডার্ড

‘‘আমি প্রথম যখন এলাম, চলে যাচ্ছিলাম
কিন্তু সহস্রতমটিও হারালো
সাইকেল একটা দেবার কথা ছিল বটে
বাবা মাতাল নদীতে আর কুড়ি নম্বরও সে পেল না পরীক্ষায়
সেই সাইকেল যেটা তিনি কখনোই কিনে দেননি
অনেক বছর বাদে ঝাড় খেলাম বিচ্ছিরি
দেখলাম আমার মা ঠাকুমা হয়ে যাচ্ছে
ছেলে তিনে পা দিল
গুনতে গুনতে চলেছে সে মায়ের প্রতিশ্রুতিগুলি
ঠাকুমা হেঁটে যাচ্ছেন তাঁর সদিচ্ছার পাশে পাশে
শেষবেষ কুড়ি সে পেল আর তখন গ্রীষ্মকাল তখন ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো
সারাটা আকাশ যখন ঢেকে গেল কাক
ওয়াহ্‌, কী দুর্ধর্ষ সেই একশো কাকের কা কা কা কা কা কা কা—’’
অথবা,
‘‘ভবিষ্যতের অনুকূলে কিছু রাখব কিনা ভেবে
যখন নিশ্চিত নই
অপেক্ষাকৃতর চুলে রাখার জন্য কোনো হাত
প্রসন্ন ভঙ্গিতে ভাঁজ করিনি আমি’’
অথবা
‘‘যাত্রা করো সেই যাওয়ার দিকে যে দিকটায় আমি গেছিলাম ওটা না কিন্তু নইলে পেছনে প’ড়ে যাবে’’
স্থানচ্যুতি, বাক্যের নির্মাণ নিয়ে খেলা, বাক্যাংশের সোয়্যাপিং, ওয়ার্ড জাম্প, কবিতাগুলোতে এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট। প্রথমদিকে পাঠকের মনে হবে কিছু একটা যেন নেই, কিছু একটা নেই জায়গা মতো, কি একটা এখানে থাকার কথা ছিল, কিন্তু নেই, কী সেটা? এখানে সিনট্যাক্‌স্‌, শব্দের স্বরমাত্রা (টোন) তার পুরনো কাঠামো থেকে সরে এসেছে। ক্লাসিক্যাল স্ট্রাকচার, সাধারণ কম্বিনেশন, প্রথানুগ ইমেজ পরিত্যাগ করা হয়েছে। পরিত্যাগ করার এই গুণ পাঠককে চালিত করে, যখন শব্দ চলতে থাকে, পাঠককেও নিয়ে যায় সাথে।

সমাজ সবসময় প্রমিতকরণ (standardization) করে, এবং পিঠে একটা এ্যাপ্রুভাল স্ট্যাম্প মেরে দেয়। পরিচিতি এবং স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এটা চাওয়া হয়। সমাজ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়; মিডিয়া, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টিভি— সেই প্রমিতকৃতটির বিজ্ঞাপন করে, একটা সাম্রাজ্য গ’ড়ে তোলে সেই মাপকাঠির এবং সবাই (সবাই?) কোনো ফলপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে বাঁচতে সচেষ্ট হয় — এটা হয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। এমন কি কবি-লেখকও সেই নির্দিষ্ট মানের সাথে সংগতিপূর্ণ ক’রে তোলেন নিজেদের। কেননা তাঁরা সমর্থন খোঁজেন, অনুমোদন চান। কেননা তাঁরা সমাজের পেছনে পেছনে দৌড়ন। কিন্তু একজন বিপজ্জনক কবি এই প্রমিতকরণ থেকে দূরে সরে থাকে। সমাজকে অনুসরণ করা তাঁর কাজ নয়। হয়তো সমাজকেই নিজের পেছনে নিয়ে আসাটা তাঁর কাজ।

তাই আমরা ব্যাকরণকে (ফার্সিতে যাকে বলে অর্ডার অফ টাং) ম্যানিপুলেট করছি। ভাষার অর্ডারকে ম্যানিপুলেট করছি পৃথিবীর অর্ডারকে ম্যানিপুলেট করব ব’লে। পৃথিবীর সত্যটাকে পাল্টাবার জন্যে, ঠিক যেভাবে পৃথিবীর বদলে একটা বাক্যকে স্থান দিই কবিতায়। চূড়ান্ত সত্য ব’লে আর কিচ্ছু নেই। একটাই সত্য আছে এখন পৃথিবীতে, কাব্যের সত্য, সেটাই তার স্বধর্ম।

‘‘সত্যিটাকে নিয়ে লোকটা এমন খেলাই খেললো
যখন মরলো
সেটাও মিথ্যে হয়ে গেল’’
প্রতিটি অবস্থার একটা অতীত আছে। শিল্প-কলার স্ট্যাণ্ডার্ডগুলো আসলে আর্ট মিউজিয়াম তৈরি করে। মিউজিয়াম এমন একটা জায়গা যেখানে আর্টিস্টিক ভ্যালুগুলো প্রদর্শিত হয়। দর্শকেরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন যে, তাঁরা এমন জিনিস দেখছেন যার পেছনে স্ট্যাম্প (স্ট্যাম্প অফ এ্যাপ্রুভাল) মারা আছে। কারণ সেই জিনিসগুলো সময়োত্তীর্ণ (টাইম অনারড্‌) এবং উৎকর্ষতার নিরিখেও উত্তীর্ণ, এবং সেজন্য ‘শৈল্পিক মূল্য’ ধারণের যোগ্যতা সম্পন্ন। কবিতাতেও মিউজিয়ামগুলো শুকিয়ে যাওয়া শব্দ দিয়ে তৈরি মৃত পশুর সংরক্ষিত শুকনো চামড়ার আকার ধারণ করে— জীবনের ছোঁয়া না থাকা ঐ চামড়ার মধ্যে পশুটা যেভাবে থাকে, সেইভাবে কবিতার জীবন থাকে সেখানে।

পোয়েট্রি অফ রিস্ক সমর্থন, অনুমোদন, স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতিটাকেই মুছে ফ্যালে। পোয়েট্রি অফ রিস্ক ঠিক ‘এটাও চলে’ টাইপের নয়, আগে যেটা চলেছে বা কোন্‌টা চললে স্বীকৃতির স্ট্যাম্প পাবে — এসবের সাথে বিপদে ফেলার কবিতার, ঝুঁকি নেওয়ার কবিতার কোনো সাদৃশ্য নেই। পোয়েট্রি অফ রিস্ক, তার নিজের মতোই, বিপদে ফ্যালে।

‘‘আরে তুমিই যদি সেই প্রতিশ্রুতি তবে আমি স্থির আছি কেন?
ছুটেও যাব তো আমি যাব ছুটে দৌড়ে আবার হ্যাঁ আবার আমি কি
আগে থেকেই স্থির আমি কি আগেই কখন হয়েছি?’’
পোয়েট্রি অফ রিস্ক চেনা-চলার ছন্দ এবং রাস্তা এবং বহু ব্যবহৃত পথ থেকে দূরত্বে রাখে নিজেকে, পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত যে কোনো ধাঁচ থেকে ব্যবধানে রাখে।
‘‘যবে থেকে স্মরণ করতে পারি
আমার চলার পথে ওরা যে রাস্তা রেখেছে
আমি তা ভুলতে শিখেছি’’

০২) অমিতাভ প্রহরাজ

নতুন নতুন পায়রাগুলি, এক মহাঢিঁচক্যাঁউ ককটেল (কবি-বেবী-নতুন কবিতা-বারীন-সিঙ্গলহ্যান্ড)


 

http://baby.postach.io/chalo-singlehand

(উপরোক্ত লিংকটি আমার প্রথম কীতাব ‘চলো, সিঙ্গলহ্যান্ড’ অবধি নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে অন্যত্র। ফলতঃ “ব্যাকগ্রাউন্ড একটু প্রয়োজন” জাতীয় গুরুগোমড়া বাক্য দিয়ে অন্য খতিয়ান দাখিলের ট্রাই নেওয়া গেল। কিছুই না, একটি নির্মাণের নেপথ্য কাহিনী ও সেই সূত্রে সদ্য পুরনো হওয়া বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে মেধাবী কবিতা তোলপাড় ‘নতুন কবিতা’কে ফিরে দেখা। বলা যায়, এক অদ্ভুত ইন-দ্য-মিন-টাইমের বিবরণ।)

ব্যাকগ্রাউন্ড একটু প্রয়োজন। না, এ বস্তু পড়ার জন্য নয়। একটা সময় জানার জন্য। একটি নতুন বাংলা পিরিয়ডে আমাদের এ্যাটেন্ডেন্স কী জাতীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিল জানার জন্য। সময়টা ২০০০-২০০৫। তার আগে একটু পিছিয়ে যাওয়া প্রয়োজন... যেখান থেকে শূন্য পাওয়া একটি দুর্দান্ত গল্প শুরু হয়...

১৯৯৬-৯৭ সাল নাগাদ জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে দুটি ছেলে, একজন সিভিল আর আরেকজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে এসেছিল। একে অপরের অপরিচিত। ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন একজনের কবিতা লেখা ডায়েরী হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়জন সেটি বেওয়ারিশ অবস্থায় পায় কমন রুমে। পাতা উলটে দেখে, একটি কবিতা ‘রোদ্দুরকে লেখা একটি চিঠি’। এবং পড়া মাত্র দ্বিতীয়জন বুঝতে পারে -- যাক, যথার্থ স্যাঙাৎ এখানে হাজির। দ্বিতীয়জন সদ্য বেশ রোমাঞ্চকর জীবন কাটিয়ে এসেছে, যাতে কবিতা লিখে মার্ক্সবাদ, কবিতা লিখে প্রোপোজ, কবিতা লিখে প্রেম, কবিতা লিখে আওয়াজখাদক, মায় প্রেমিকার আত্মহত্যা অবধি ঘটে গেছে কলেজে আসার আগে। ফলে ভেতরে ভুরভুর করছে, গুড়গুড় করছে, সুড়সুড় করছে, ফুরফুর করছে কবিতা। কিন্তু কবিতা কি একেলা হয়? এই টেনশান প্রবল তো ছিলই। সেই বেওয়ারিশ ডায়েরী পড়ে তার সব টেনশান কেটে যায়, মায় বুঝতে পারে আগামী চার বছর এসপার ওসপার করে ফেলার জন্য সলিড পার্টনার কাম পাঙ্গাবরদার সে পেয়ে গেছে। এবার পৃথিবীকে দেখে নেওয়া যাবে। শার্লক পেয়ে গেছে পোয়ারোর এ্যাড্রেস। ডায়েরীমালিক কে, খোঁজ করতে করতে জানতে পারে, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের সুবিখ্যাত র‍্যাগিং পিরিয়ডে সে নাকি যে শুনতে চেয়েছে, অম্লানবদনে তাকে নিজের কবিতা শুনিয়েছে 'হস্টেলখোরাক' হওয়ার চাহিদায় ননস্টপ তুমুল জোগান দিয়ে। ফলে কলেজরীতি অনুযায়ী তার নবনাম বা নিকনেম হয়েছে ‘কবি’। দুটি হস্টেলে ভাগ করে থাকে ফার্স্ট ইয়ার। হস্টেল ওয়ান আর হস্টেল টু। হস্টেল ওয়ানের ব্যাকউইংগস-এ থাকে ডায়েরীমালিক সন্ধানী আর হস্টেল ওয়ানেই ফ্রন্ট উইংগসে থাকে ডায়েরীমালিক ‘কবি’। কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ হয় ডায়েরী পাওয়ার দুদিন পরে। একটি শনিবার বিকেলে। জলশহরে তখন জানু-ফেব্রু জাতীয় সময়। ক্যাম্পাস একটি বিশাল অনির্বচন। গাছে গাছাক্কার, হস্টেলের পেছনে ফিতের মতো একটা নদী, নাম রুকরুকা। পাশে ঘোর চা বাগান, ডেংগুয়াঝাড়। সকালে কাঞ্চনপাহাড় দেখা যায়। মেন গেটের পাশে এন এইচ থার্টি ওয়ান এ। যেখানে দুপাশে ছোট ছোট ঝুপড়ি দোকান, বাংলা মদের। পাকা দোকান, পান বিড়ি সিগারেট, এস টি ডি, জেরক্স। পঞ্চাশ পয়সা ঘন্টা রেটে ভাড়া পাওয়া যায় সাইকেল, যা দিয়ে সামান্য এগোলেই পরপর দুটি ধাবা, বাচ্চু আর শঙ্কু, যেখানে চব্বিশ ঘন্টা রাম বীয়ারের সাপ্লাই। তো এমন একটি এলাকায় দ্বিতীয়জন, যে উত্তর কলকাতার ভাষায় বেশ পাখোয়াজ ছেলে, বাংলা খেয়ে লায়েকনবাব হয়ে দেখা করে কবির সাথে সেই ডায়েরী হাতে নিয়ে। বলারও প্রয়োজন পড়ে না 'আমিও লিখি'। শোনা আর শোনানোতেই তুলকালাম হয়ে যায় এমন যে, পরের দিনই দুজনে নিজেদের লেখার খাতা বগলদাবা করে সোজা চলে আসে হাইওয়েতে আর বাস ধরে এক্কেবারে পাহাড়ের মধ্যে। যেখানে একটি সেতু ও সেতুর তলায় তিস্তা নিজের খরস্রোতা ভার্জিনিটি নিয়ে। তর সয় না, হুড়মুড় করে নেমে যায় তিস্তার ধারে। দুইবন্ধু ঘটে গেছে তখন। একজন শান্ত আর আশ্চর্য উদাস। আরেকজন সদা কলকলায়মান অতিশয় দামাল। একজন সেবকের তিস্তাধারের অপূর্ব নুড়ি নিয়ে হাতে নাড়াচাড়া করে আর আরেকজন নদীতে নেমে প্রমাণ করার চেষ্টা করে, সে কতো ভয়ডরহীন। খুব জরুরী দেওয়া নেওয়াগুলো ওখানেই হয়ে যায়, মানে কার জীবনে কত দুঃখ, কার কী কী জীবনদুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা, কার কী কী বহুমূল্য সিক্রেট, ব্যর্থ প্রেম, অবৈধ সেক্স ইত্যাদি। এবং তারপরেই রঙ্গমঞ্চ হয়ে দুজনেরই রঙ্গে রঙ্গে মঞ্চে মঞ্চে নেমে আসে লেখা, কবিতা। একটি বড় চৌকো আকারের ডায়েরী আর আরেকটি লালকালো কাগজে মলাট দেওয়া হাতে বাঁধা গোলাপী কাগজের খাতা (দ্বিতীয়জনের প্রাক্তন প্রেমিকা যা তৈরি করে দিয়েছিল নিজে হাতে) নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করে এই দুজনকে ভুলে গিয়ে। চৌকো ডায়েরীতে ছিল ‘রোদ্দুরকে লেখা একটি চিঠি’, ‘শাওন’ ইত্যাদি, আর গোলাপী পাতার খাতায় ছিল ‘রঙ্গমা সিরিজ’,’গাছতলা, যাই’ ইত্যাদি...

সন্ধ্যে হয় হয়, যখন ওরা ক্যাম্পাসে ঢোকে। ততক্ষণে শ্রদ্ধা শেখা হয়ে গেছে দুই বন্ধুর একে অপরকে। এবং জানা হয়ে গেছে জীবনের যে অংশকে আজীবন বলে, তার মালিকানা কার হাতে থাকবে। এবং সেই মালিককে তৈরি করার অনন্ত প্রক্রিয়া বা রেওয়াজ কতদূর অন্তরঙ্গ। একে অপরের কাছে নাড়া বেঁধে ফিরেছে দুই বন্ধু। বলতে গেলে তখনই এই বইটির অদৃশ্য এমব্রায়ো ঘটেছিল। তিস্তার ধারে নুড়িপাথরগুলির সাথেও যে কথা বলছিল, তার নাম ছিল কলেজে ‘কবি’, ইন্দ্রনীল ঘোষ। আর যে তিস্তায় নেমে বেপরোয়ানেসের শো অফ করছিল তার নাম ছিল কলেজে ‘বেবী’, অমিতাভ প্রহরাজ। যে তার ন’বছর বাদে প্রথম বই এটি, ‘চলো, সিঙ্গলহ্যান্ড’ প্রকাশ করে উৎসর্গপত্রে "যাকে বলে ইন্দ্রনীল, তাকে" লিখে...

মনে হতে পারে, যেন এ্যাডোব ফোটোশপের ইতিহাস বলতে গিয়ে আলতামিরা থেকে শুরু করছি। কিন্তু কারণ আছে। কারণ লুকিয়ে আছে আমার উৎসর্গপত্রের কমায়, "যাকে বলে ইন্দ্রনীল, তাকে"। আমার গঠনপর্বের বউনিই হতো না ইন্দ্রনীল না থাকলে। বলাটা শিখতেই পারতাম না। জলপাইগুড়ির চার বছরের শুরুতেই আমরা একে অপরকে এক অলৌকিক মন্ত্রগুপ্তি শিখিয়ে দিয়েছিলাম, ‘কি বলা’ নয় আমাদের প্রেম ভালোবাসা সব ওই ‘বলা’টার সাথে। কী আশ্চর্য না, ঠিক সেই মুহূর্তে বাকি বাংলায় বারীন ঘোষাল নামক এক অপূর্ব ভিলেন গড়ে তুলছেন আবাংলা-বাহিরবাংলা জুড়ে প্রথম এক কবিতার সার্থক বিরাদরি, আর নানা রকম সমস্তকে সেলাই করছেন ‘বিষয়হীন কবিতা’ নামে এক তোলপাড়ের সুতো দিয়ে (অপূর্ব শব্দটির চেয়ে সার্থক প্রয়োগ আর পাইনি এই কবিমাস্তানের সম্বন্ধে, যিনি সিগনেচার ফাটিয়েছিলেন "পুব আর ফুরোয় না বলে")। কবি আর বেবী তখনো ও জগতের সাথে অপরিচিত। তখনো একজন জয়মুগ্ধ আর আরেকজন শাক্ত। তবু সেই তোলপাড়ের এসেন্স, ‘কি বলা’ নয়, ‘বলা’টাই আসল, আমাদের মাথার জরায়ু দখল করে নিয়েছে। এটাই কি সময়ের নিজস্ব টেলিপ্যাথি বা পি এন পি সি, যা নিরন্তর আমাদের কানের কাছে করে? ভাবতে অবাক লাগে, আজ যে বিষয়হীন কবিতার প্রকান্ড বিস্তার প্রতিষ্ঠান-অপ্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে, একসময় তার জন্য কী তুমুল বিদ্রুপই না বরাদ্দ ছিল! অমন কবিতা বা লেখা নিয়ে টিটকিরি আমার বা ইন্দ্রর গা সওয়া ছিল। পাত্তার প-এরও প্রশ্ন ওঠে না। অবশ্য ততদিনে জলশহর কবিতাট্রেকের জন্য গুরুসঙ্গ বা গাইডের হেপাজতে তুলে দিয়েছে আমাদের। নীলাদ্রি বাগচী, দেবাশিষ কুন্ডু। লেখার ম্যাজিক জগতে আমরা এই দুজন এরকানের (‘এরকা’, এক বিস্ময় পত্রিকা) হাত ধরে ঢুকছি। একজন দেখাচ্ছে এই ম্যাজিকের গভীরতা আর আরেকজন প্রতিদিন একটু একটু করে দেখাচ্ছে এই ম্যাজিকের অসীম দৈর্ঘ্য প্রস্থ। আর মাঝরাত্রে নীলাদ্রিদার স্কুটার, ঘোরদুপুরে দেবাদার সাইকেল, রাতজাগানিয়া কবিতা, দিনভর্তি কবিতার পর কবিতা, প্রেম-বন্ধু-বিচ্ছেদ-ভাঙন-হুল্লোড়-কসমকস-সেক্স-দীনবাজার-রুকরুকা-মদ-মর্মর সহযোগে তৈরি হচ্ছে যাপন। শঙ্খচূড়ের মতো বাংলা ভাষার সুবিশাল কবিতা লিগাসী, তার চেরা জিভের দু’প্রান্ত থেকে দুজন ঢুকে যাচ্ছি শীতল সুড়ঙ্গে, খাজুরাহো দেখার মতো অপলক দেখছি তার বিষদাঁত, স্ট্যালাকটাইটস স্ট্যালাগমাইটস-এর মতো জেগে থাকা অন্যান্য দাঁতের শোভা দেখছি, দেখছি সেই লিগ্যাসির বিষথলি, দেখছি তাজমহলের খোলস খুলে রেখে মুমতাজ মিশে যাচ্ছে হাওয়ায়, আরো কত কী... তখনো প্রথা-অপ্রথার দাম্পত্য কলহ জানি না কিছুই, বড় মেজো সেজো কবি নয়, কাকুতেই বেশি অভ্যস্ত। নীলাদ্রিদার মতো আক্ষরিক নির্বিচার কবিতা খাদক আমাকে কবি নয়, কবিতা দেখায়। এখন বুঝি যে কী সাংঘাতিক লাক পেয়েছিলাম আমরা যে, গঠন পিরিয়ডে আমাদের দুজন গাইড কখনো সিক্স লেন-এইট লেন-ওয়ান ওয়ে দেখায় নি, দেখিয়েছিল বিশুদ্ধ রাস্তা, যার ভাগ নেই। ফরিদ খাঁর বাঘ মেরে তৈরি করা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মতো আদিম। জলশহরের উষ্ণতায় কোনো উঁচু নিচু ছিল না।

তেমনই আরেক অবিশ্বাস্য লাক হলো, কবি আর বেবী একে অপরের সাপেক্ষে কি ভীষণ আলাদা ছিল। একজনের রেফারেন্স থেকে দেখলে অন্যজন বিশুদ্ধ ইউনিক। এই বোধ যে ইন্দ্র যা বা যেরকম বা যেদিক দিয়ে লেখে, ভাবে, সেদিক দিয়ে তো আমি কখনোই ভাবিনি। আমার এরকমটাতো-ভেবে-দেখিনি-কখনো ভাবনাগুলির অমনিবাস ছিল ইন্দ্র। এটা কোনো আলাদাবোধ নয়, এটা পদে পদে ইনফিনিটির অস্তিত্ব মালুম করায়। লেখার জগতে সম্ভাবনা যে ইনফাইনাইট তা বোঝার জন্য কোনো স্পেশাল পেপার নিতে হয়নি। হাতে কলমে বুঝতাম প্রতি মুহূর্তে একে অপরকে দেখে। এবং এর ফলে সমান্তরালভাবে যে জিনিস নিয়ে বাংলা লেখাভুবন তোলপাড় হচ্ছিল, সেগুলির হদিশ না রেখেও অজান্তেই তা অনুভব করছিলাম আমরা। যেমন ‘ভাবনাই কবিতা’, ‘বিষয়হীন কবিতা’, ‘স্বকীয়তাই কবিতা’, ‘কবিতা উদ্দেশ্যশূন্য’, ‘নিজস্ব ভাষার প্রয়োজনীয়তা’, ‘নকলের অপ্রয়োজনীয়তা’, সর্বোপরি ‘নিজস্ব চেতনা টপকানো জগত তৈরি করা, -- এগুলি আমরা একে অপরের সাহায্যে হাতে কলমে খুঁজে পাচ্ছিলাম, প্রায় আবিষ্কারের মতো। এখানে খুব জরুরী বলা যে, এটা কোনো আতম্ভরিতা নয় বা এমন কোন দাবী নয় যে, আমরা দুজন মহাজিনিয়াস নিজে নিজেই পরীক্ষামূলক লেখার এই ধাপগুলি বানিয়ে ফেলেছি। হয় কি, সময়ের মধ্যে একটা তরঙ্গপ্রবাহ উঠলে তা সময়ে ডুবে থাকা সকলকেই নাড়িয়ে যায়, জানতে হোক কি অজান্তে। বারীন ঘোষাল, কবিতা ক্যাম্পাস মিলে নতুন কবিতার যে অভূতপূর্ব তরঙ্গপ্রবাহ শুরু করেছিলেন, সেই কাঁপন আমরা অজান্তেই আপন করে নিয়েছিলাম। কারণ নতুন কবিতা কোনো শূন্য থেকে আবিষ্কার ছিল না। ছিল একটা তীব্র নীড, যে নীড বারীন ঘোষালের ল্যাবে পাকড়াও হয়েছিল, ব্যাটাকে-ধরেছি হয়েছিল, সেই নীডের ধাক্কা সকলের মনের বারান্দায় রেলিং ভাঙচুর করেছিল।

এখান থেকে নতুন কবিতা অংশে চলে যাবো জাম্পকাটে। মাঝখানে দুজনের রুকরুকা, স্বপন রায়ের ডুরে কমনরুম ও সেই সূত্রে ক্যাম্পাস-কৌরব জগতের সাথে পরিচয়, তারপর আমার কলকাতা, মেস, অনির্বাণ-দেবাঞ্জন-অর্ঘ্য-অরূপ একসাথে, সামান্য আগে বৈখরী ভাষ্য, জীবনের ফুটপাথ প্রধান অংশ, রাতজাগা অংশ, নৃশংস নেশাংস ও কীর্তি তস্য মহাকীর্তি স্থাপন অংশ, লিভ টুগেদারাংশ... এসব আরেক মহা-আখ্যান, অনেকের কিছুটা জানা, কিছু এদিক ওদিক। ওসব নিয়ে অন্য বড় আমোদিনী লেখা হবে, যাপন নির্মাণের আখ্যান, অন্য কোনখানে। আমি সোজা চলে আসবো নতুন কবিতায়। কারণ ওই পরিপ্রেক্ষিতটা মেলে ধরা আমার উদ্দেশ্য। বাচ্চারা যারা নতুন কবিতার ইতিহাস, ডকুমেন্টেশান নিয়ে আগ্রহী, তাদের জন্য অসংখ্য প্রবন্ধ হীরে মাণিকের মতো কবিতা ক্যাম্পাস, কৌরব, নতুন কবিতা, ভিন্নমুখ, কুরুক্ষেত্র ইত্যাদি পত্রিকায় পাবে। আমি বলছি এক প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের কথা। যুদ্ধক্ষেত্রর ভেতর থেকে সাব মেশিনগান চালাতে চালাতে আঁখো দেখি, সামিল হুই, হাল।

তো যা বলছিলাম। যখন সরাসরি নতুন কবিতার জেহাদের মধ্যে এসে পড়লাম তখন বিন্দুমাত্র অচেনা লাগেনি কোনোকিছু। কো্নো ইস্তেহার, কর্মসূচীর অস্তিত্বের প্রয়োজনবোধ হয়নি। প্রয়োজনবোধ হয়নি কবিতার ক্লাসের বা কোনো ইজম ঠেসে তোষক বানানোর জীবনযাপনের জন্য। সবই ছিল চেনা, মেনে নেওয়া অংশ, মেনে না নেওয়া অংশ, সবই খুব স্বাভাবিক, এমনই-তো-হওয়ার-কথা জাতীয় এ্যাটিটিউড ছিল, উন্নাসিকতা নয়। বলতে গেলে যখন সরাসরি বারীন ঘোষাল-স্বপন রায়-রঞ্জন মৈত্র-প্রণব পাল-অলোক বিশ্বাস-ধীমান চক্রবর্তীর এই ভুবনে এসে পড়লাম তখন কোনো বিলেতবোধ হয়নি, উলটে মনে হয়েছিল দেশের বাড়ি ফিরেছি বহুদিন বাদে। আসলে অবাকশিল্প, চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে, আমি আর ইন্দ্রনীল নিরবিচ্ছিন্নভাবে একে অপরকে সাপ্লাই করে গেছি বা যাচ্ছি। তাই আলাদা করে অবাকবোধের কোনো প্রয়োজনীয়তা জাগেনি। মুগ্ধবোধ ও তার উষ্ণতাই ছিল যথেষ্ট। জলশহর আমাদের দুটো বড় দামী নি-শব্দ শিখিয়েছিল ‘নির্বিচার’ আর ‘নিজস্বতা’। নির্বিচার কেমন? না কলেজে লোপামুদ্রার গাওয়া ‘বেণীমাধব’ বার বার চালিয়ে শুনেছি, এঞ্জয়ও করেছি। বা ব্রততীর ‘আমিই সেই মেয়ে’, পুরোদমে উপভোগ করেছি। কিন্তু না ইন্দ্রনীল না আমি, কেউ কখনো ভাবার প্রয়োজনবোধ করিনি আমাদের লেখায় কি আবৃত্তিযোগ্যতা আছে কি নেই, রাখবো কি রাখবো না। কারণ ওটি বিশুদ্ধ অপ্রাসঙ্গিক, মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র কারণ নেই। দুজনেই এন্তার ছন্দে লিখেছি, নাছন্দে লিখেছি এবং খুব স্বাভাবিক ভাবে ও বিষয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজনবোধ করিনি। সাত মাত্রা না সাত দশমিক তিন রেকারিং মাত্রা, এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক করা যে বৃহৎ গান্ডুমি, তা দুজনে অবলীলায় হৃদয়ঙ্গম করে গেছি। পরে যখন ছন্দের অপ্রয়োজনীয়তাটি বেশি মূল্যবান আমাদের রাস্তায় তা বুঝেছি ও নেট প্র্যাক্টিসে নেমেছি, তখনো একটি প্রবণতা চতুর্দিকে প্রকট। প্রবণতাটি হলো, দেখো আমি ছন্দে জিনিয়াস, চাইলেই লিখে দেব বাঘা কবিদের মতো ছন্দে, মারকাটারি মর যানা প্রেমের গন্ধে, চাইলেই আর্টেজীয় কূপের মতো উপচে দিতে পারি তোমাদের তুখোড় কবিতা দিয়ে, এই সব পারি কিন্তু করি না, এবার বুঝেছ আমি কে? হুঁ হুঁ বাবা আমি গজু বসু, আমার মাথা শসার মতো ঠান্ডা। এই যে প্রবণতা, আমি চাইলে তোমার হীরোকে হারিয়ে দিতে পারি, তবু আমি কমন ম্যানের রোলে এ্যাক্টিং করি, এটির প্রতি রিপালসান কাজ করতো বড়। হাস্যকর লাগতো। বরং সরাসরি নতুন কবিতার হৃদয়ে এসে পড়ার পর অনেক জরুরী লেগেছিল নিজস্ব প্র্যাক্টিস তৈরি করা... যে প্র্যাক্টিস পরিশ্রম স্বপন রায়ের মেঘান্তারার স্বর্গীয় কবিতাদের মধ্যে আছে তাকে প্রতিবিন্দু অবধি সন্ধানের চেষ্টা করছিলাম, কুয়াশা কেবিন, ডুরে কমনরুম পড়ে ধাপগুলো স্টাডি করছিলাম, ভাবছিলাম ‘সুবর্ণরেখা রানওয়ে’ থেকে ‘সেভেন বেলোর বাড়ি’ যাওয়ার রাস্তাটা কীভাবে তৈরি হয়েছে, কীরকম ভাবে মোড় ঘুরেছে ‘ভাষাবদলের কবিতা’ বা ‘রূপসা পিয়ানো’। আর এর সাথে ছিল বারীন ঘোষালের একেকটা গদ্য লেখা নিয়ে নুনুতে এ্যাসিড বাল্ব মারার মতো... যা পড়তাম, পড়ে অবধারিত রাগতাম আর সারাক্ষণ রাস্তায় অফিসে একটা মানস বারীন ঘোষাল নিয়ে ঘুরতাম, যাকে আমি পদে পদে দুরন্ত যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি, কেন ওনার ছাব্বিশ দফা প্রতারণা মানি না। বোতলে বন্ডেল গেটের বাংলা জল মিশিয়ে খেতে খেতে বালীগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে বাঘা যতীন ফিরছি মাঝরাতে একা, সারা রাস্তায় বারীন ঘোষালকে নানান জুডো ক্যারাটের প্যাঁচে পর্যুদস্ত করছি, কারণ উনি সেভেন বেলোর বাড়ির মুখবন্ধে কেন বলেছেন, "সুবর্ণরেখা রানওয়ের সময় রঞ্জন তার প্রতিকবিতার স্তরটি পেরোচ্ছিল"। উত্তেজিত কথোপকথন চলছে হাঁটার সাথে, যুক্তি-প্রতিযুক্তি, আর ফুটপাথের মহিলা তার বাচ্চাটিকে বলছে "পাগলা হ্যায় রে। পাস মত যা, কাট দেগা"...। সুবর্ণরেখা মুগ্ধ আমি রঞ্জনদাকে চিঠি লিখতে গিয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করছি এমন সব বাক্য আমাকে কে লিখিয়ে নিল... ফাঁকা ঘরে কাল্পনিক বারীন ঘোষালকে আমি কাট কাট গলায় বলছি "আপনার অতিচেতনার কথা একটা বাল। আমি আপনার সামনেই প্রমাণ করতে পারি" (তখনো বারীনদা 'আপনি', কারণ মুখোমুখি কথা তো মাত্র কয়েকবার), বলে খাতা খুলে একের পর এক যুক্তি শানিয়ে নেওয়া, লিখে লিখে দেখানো আর আমার ঘরের মেঝেতে মাঝে মাঝে পত্রমোচী কোরেক্স গাছ থেকে ঝরে পড়ছে এক একটা খালি কোরেক্স বোতল, উড়ে যাচ্ছে আট প্যাকেট চ্যান্সেলার। এবং আমি জানি খানিকক্ষণ বাদে চাটু-দেবা আসবে, বা আমি ইন্দ্রকে ফোন করবো আর আমার কোনো এক শিহরণ জাগানো চিন্তাবিষ্কার বলে আরেকপ্রস্থ তর্ক শুরু করবো। জহর সেনমজুমদার নাকি বারীন ঘোষালকে গুরুবাদ দোষে অভিযুক্ত করে বাংলার কবিদের বিপথে চালনার দায় চাপিয়েছেন। জহরদা, আপনার সাথে কাটানো দুরন্ত সন্ধ্যাগুলি, গরফায়, মনে পড়ে। আপনাকে বিনীতভাবে বলি বারীনদার গুরুদেবত্ব এখানেই যে, ওনার থেকে রাস্তার হদিস তারাই পেয়েছে যারা ওনাকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে নিরবিচ্ছিন্ন খিস্তি মারতে পেরেছে নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। "তোকে শালা মানবো না, তুই কে? দেখ আমিও নতুন পথ বাৎলাতে পারি" বলে যে সার্থকভাবে নিজের ঝাঁট জ্বালিয়েছে, সেইই অজান্তে নিজের রাস্তা খোঁজার স্পার্ক পেয়ে গেছে। সেদিক দিয়ে আপনিও। মানুষ খাট-বালিশ-বিছানা- চাদরের মধ্যে মহাভুল খোঁজে না, খোঁজে পিকাসোর পেইন্টিং বা সার্তের জীবনদর্শনের মধ্যে।

(এই প্রসঙ্গে ঋত্বিকের বার্গমান নিয়ে একটা ইন্টারভিউ থেকে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। "বার্গম্যানকে জোচ্চোর বলেছি। বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়... প্যাগান ফিলোজফিকে আনার জন্য ইমোশানাল সারচার্জ, গুরুদেব তৈরি... এই যে গুল - এগুলো কী? What is this 'Seventh Seal'? Terrific জোচ্চোর বলেছি এই জন্য যে - জোচ্চোর তো যাকে তাকে বলা যায় না। জোচ্চোর কাকে বলবে? One of the supreme brains, one of the supreme technicians, যে জেনেশুনে বদমায়েশি করছে। গাধাদের কাছ থেকে তো এটা আশা করা যায় না - যে জোচ্চুরি করতে জানে না। if he doesn't know the truth he cannot cheat. So knowing fully well he is cheating. Do you follow me?)

বারীনস্তুতি নয়, এই কথাগুলো বলা প্রয়োজন, জানা প্রয়োজন 'নতুন কবিতা' বাংলা লেখাজগতের সবচেয়ে মেধাবী মুভমেন্টটির মোডাস অপারেন্ডিকে বুঝতে হলে। বারীন ঘোষাল গুরুদেব নয়, অগুরুদেব। যে তোমার চিন্তাভাবনায় চ্যালেঞ্জের অগুরু মাখিয়ে দেবে, যাতে তার থেকে তুমি স্পষ্ট মৃতদেহের গন্ধ পাও আর হৃদয় নয়, মেধা নয়, খাস তোমার প্রাণের, অস্তিত্বের আঁতে লাগে। আর খোদ প্রাণ লাফিয়ে উঠে নতুন রাস্তা খুঁজে তার কলার চেপে ধরে "কোন বাঁড়া বলে আমি মরদেহ??"। সোনারি ওয়েস্টের আট নম্বর বাড়িতে প্যান-ফ্রায়েড কৌমার্য নিয়ে মহুয়া ঢুকে যায়।

এভাবেই আমরা ঢুকেছিলাম নতুন কবিতায়। অনেকে জিজ্ঞেস করে "বেবীদা, তুমি নতুন কবিতা 'করতে'?" বলি, "কখনোই না, আমি এস এফ আই করতাম"... এর কারণ অনেকের ধারণা নতুন কবিতা বোধহয় একটা কলেজ বা লার্ণিং প্রোগ্রাম, যার থেকে ডিসটিংশান সহকারে অমিতাভ প্রহরাজ, ইন্দ্রনীল ঘোষ, অনুপম মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, দেবাঞ্জন দাস প্রমুখ পাস করে বেরিয়েছে। তাদেরকে ব্যাপারটা বোঝাই। আসলে বোঝার এই সঙ্কটটা হয় কারণ আমাদের শঙ্খচূড় বাংলা কবিতার লিগ্যাসী দেখিয়েছিল মুভমেন্ট দু প্রকার, এক) বিশেষ যাপন নির্ভর দুই) বিশেষ এ্যাজেন্ডা নির্ভর। নতুন কবিতা এই দুইটির কোনো একটিও নয়। এর কো্নো গন্তব্য ছিল না, কোনো ম্যানিফেস্টো নয়, বিশেষ জীবনযাপন নয় এবং সবার উপরে বিন্দুমাত্র জার্গন বা লেবেলিং নয়। যে জার্গন বা লেবেলিং-এর অভ্যেস এখন কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায়, তা নিখাদই মধ্যমেধার ফলে উদ্ভূত আধবোঝার ফল। নতুন কবিতা ছিল একটা সময় ও সেই সময়ে সবচেয়ে অব্যর্থ ও প্রয়োজনীয় চর্চার নাম। চর্যা নয়। সময়ের বৌ হলো ঘটনা, আর রাখেল হলো সঙ্কট। তো এই সঙ্কটের সাথে ইন্টুপিন্টু চালাতে গেলে বৌকে এক্কেবারে না জানিয়ে, কিছু চর্চা বা প্র্যাকটিসের প্রয়োজন পড়ে। আমরা অমোঘ পুনরাবৃত্তির সঙ্কটে পড়েছিলাম। এতদিন অবধি একে টক্কর নেওয়ার তরিকা ছিল ক্লাসিক বা ধ্রুপদী জাতের মধ্যে তাকে ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দেওয়া। দিলেই সমস্যা শেষ। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি যুগে এসে ধ্রুপদের জিনা হারাম হয়ে উঠলো আর সে আত্মহত্যা করলো। কারণ ঘটনার পপুলেশান বাড়তে বাড়তে বার্স্ট করে গেল, আর কোনটা ইনফর্মেশান বা তথ্য, কোনটা এক্সপিরিয়েন্স বা অভিজ্ঞতা আর কোনটা রিয়ালাইজেশান বা বোধ, সব গুলিয়ে একাকার হয়ে গেল। ভিক্টোরিয়ার দুপুর রোদে প্রেমিকার প্রথম স্তনস্পর্শ করলো প্রেমিক, এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা, সেটা হয়ে গেল ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ম্যামারি গ্ল্যান্ডের এপিথেলিয়াল লেয়ারের ওপর কতটা প্রেসার অপ্টিমাম এক্সাইটমেন্ট আনবে পিটুইটারিতে!! একটা ইনফর্মেশান। ফলে এই ঘোর অনাচারে দীর্ঘবিলাসী ধ্রুপদের কোনো স্থান নেই। তাহলে এই অমোঘ পুনরাবৃত্তির সঙ্কট আটকানোর একটাই উপায় বেরোলো, নিরবিচ্ছিন্ন ও নিরঙ্কুশ নতুন উৎপাদন। এইখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, 'উৎপাদন' এই ক্রিয়াটিই হলো মূখ্য। উৎপাদিত দ্রব্য নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ‘নতুন কবিতা’ মুভমেন্টের নামকরণে এই গন্ডগোলটা থেকে গেছে বলে পরে প্রচুর কনফিউসান তৈরি হয়েছিল। আসলে হওয়া উচিত ‘নতুনভাবে কবিতা’ মুভমেন্ট। এই ‘ভাবে’টাকে যে যার প্রয়োজনীয়তা মতো চিহ্নিত করেছিল। মানে ধরা যাক a b c d e f g h I j k, এই দশরকম পুনরাবৃত্তি বা মনোটনি আক্রান্ত ছিল সেই সময়ের কবিতা। এবার দশটিকেই আমূল ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে তার কোনো মানে নেই। কেউ a,b,g,h,I,k কে এ্যাড্রেস করবে ঠিক করলো, কেউ মনে করলো d,e,f,g,h,I থেকে মুক্তি পাওয়াটাই প্রধান লক্ষ্য। এভাবেই যে যার প্রয়োজন তৈরি করেছিল। এবং এর কোনো লিখিত থাম্বরুল ছিল না। কয়েকটা কমন অস্বস্তি ছিল, যেগুলোকে বারীন ঘোষাল কবিতাধারার মুক্তি নাম দিয়ে পয়েন্ট আউট করেছিলেন। এই যা।

গোড়ার কথায় ফিরি... তো এভাবেই আমরা নিজেদের মতো করে নতুন কবিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলাম, আর সম্পর্কে নেমেছিলাম... কোথাও কোনো বইতে লেখা ছিল না, কোনো স্যার বলে দেননি, কিন্তু কি অদ্ভূত ইন্দ্রনীল, আমি, অনির্বাণ, দেবাঞ্জন, আমরা ধীরে ধীরে ক্রিয়াপদ কমাতে লাগলাম, বিশেষণ-ক্রিয়াবিশেষণ বন্ধ করে দিলাম, উপমা রূপক অলঙ্কার এড়িয়ে গেলাম, 'মতো' 'যেন' ব্যানড করলাম, গল্প হটিয়ে দিলাম ইত্যাদি... একদিনে না, আত্তীকরণের মতো এসেছিল এই প্রসেস... এবং এই প্র্যাকটিস চললো বছরের পর বছর, প্রায় আট ন বছর ধরে... কারও পদস্থলন হলে অন্যজন তার ভুল দেখিয়ে দিত... বাইরে থেকে মনে হবে যেন কন্ডিশন্স এ্যাপ্লাই কবিতা বা ইচ্ছে করে কবিতাকে প্রতিবন্ধী করা। কিন্তু বাস্তবে এটা একটা প্র্যাকটিস, শচীনের অফে একটাও শট না খেলে সেঞ্চুরি। একটা কনফিডেন্স জন্মানো নিজের মধ্যে, যাতে সম্ভাবনা অসীম এই জিনিসটি হাতে কলমে ফীল করতে পারি।

এই হাতে-কলমে ছিল একটা জবরদস্ত হাতিয়ার। কলেজ থেকে নতুন কবিতা হয়ে যে জোনটায় পা রাখতে যাচ্ছিলাম তা হলো এক নতুন চিন্তাপদ্ধতি, স্বকীয় থট প্রসেস তৈরি করা লেখা সম্বন্ধীয়। তার জন্য প্রয়োজন পুরনো থট প্রসেসদকে হাতে কলমে বাতিল দেখানো। উপলব্ধি করা, উপলব্ধ দেখানো আর উপলব্ধি দেখানো। এদের মধ্যে প্রথমটি সময়ের অতিকায় প্রয়োজন থেকে জন্ম নিয়েছিল, দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল আর তৃতীয়টিই ছিল বোধকে, মেধাকে চ্যালেঞ্জ। বুঝতে পারছিলাম, কবিতার শুরু শেষ বলে কিছু হয় না। কি হয় তা নিয়ে বিস্তর মতবাদ ছিল, কেউ পৃথিবীর সব কবিতা একসাথে মিলে একটাই মহাকবিতা, কেউ কবিতার প্রতিটি পরমাণুই কবিতা, কেউ কবিতা আত্মা, ইত্যাদি। এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না, এগুলির অপশান তো ইনফিনিটি, মানে শুরু ও শেষ না থাকা মানে কবিতা কীরকম হতে পারে, তা তো অসীম সম্ভাবনা। বাংলা কবিতার অ'পূর্ব' ভিলেনটি এ্যাসিড বাল্ব ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আর আমি "চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা" বলতে উদগ্রীব ছিলাম... তো ফিরে গেলাম সেই স্যাঙাৎ-এর কাছে। কাকে বলে ইন্দ্রনীল? ইন্দ্রনীল তো আমাকেই বলে, ওর কবিতা যত। আমার অলিখিতপূর্ব অলিখিতভবিষ্যৎ লেখাগুলিই তো ও লিখছে। আমার অভাবিতপূর্ব ও অভাবিতভবিষ্যৎই তো ওর... এখান থেকেই স্পার্ক, কবিতার শুরু ও শেষ নেই প্রমাণ করার সহজ উপায় তো শেষকে অশুরু বা শুরুকে অশেষ বলে দেখানো... এবং তার ফল এই ‘চলো, সিঙ্গলহ্যান্ড’ যার উৎসর্গপত্রে "যাকে বলে ইন্দ্রনীল, তাকে"...

পুনশ্চঃ ‘নতুন কবিতা’ থেকে তো বেরিয়ে এসেছি বহুদিন, কিন্তু ‘নতুনভাবে কবিতা’য় মগ্ন আছি চিরকাল... নতুন কবিতা আমার হাত চিন্তা ভাবনা গড়েছে যাতে আমি ভেবে ফেলেছি ‘নতুনভাবে কবিতা’, এক নেভারএন্ডিং প্রসেস... ওই চর্চা সময়কার সেন্সরগুলিও তুলে নিয়েছি এক এক করে... নতুনভাবে ব্যবহারের জন্য... গতবছর ভালোপাহাড়ে পেলাম, পড়লাম সব্যসাচীর ‘পসিবিলিটি টিসিবলিপ’... পাহাড়ের মতো ‘জীয়ো’ বেরোল বুক থেকে... এই তো নতুনভাবে... আমার চেয়েও নতুনভাবে...

০৩) অন্তরা চৌধুরী

লোকজ সংস্কার ও ভগীরথ মিশ্র’র ‘আড়কাঠি’



সচেতন ভাবে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি বাঙালীর অনুরাগ, বিশেষত বিংশ শতাব্দীকেই বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রারম্ভিক পর্ব বলা যেতে পারে। এই পর্বে বাংলা কথা সাহিত্যে লৌকিক উপাদান প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাড়তি সচেতনতা নেই। জীবনের স্বাভাবিক রূপকে ধরতে গিয়ে যতটা পরিমাণ আসা স্বাভাবিক, ততটাই এসেছে লোকঐতিহ্য। পরবর্তী কালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে লোকঐতিহ্য সচেতন ভাবেই উঠে এসেছে। উত্তর-বন্দ্যোপাধ্যায় কালে এই দৃষ্টিভঙ্গি আরো বেশি প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে।

জন্ম সুবাদে ভগীরথ মিশ্র অজ পাড়াগাঁয়ের মানুষ। যে স্কুলে তিনি পড়তেন, তার পাশেই ছিল শাল-অরণ্য স্থিত লোধা শবর পল্লী। গাঁয়ের তিন দিকে ছিল শবর ও কোড়া উপজাতির মানুষ। সরকারী চাকরি করার সময় তাঁর জীবনের বারো আনা কেটে গিয়েছে গ্রামাঞ্চলে। চাকরির ফাঁকে চারপাশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে ঘটেছে অবাধ বিচরণ। পুরুলিয়ার ছৌনাচের দলের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা হয়েছে। এর ফলে তিনি উপলদ্ধি করেছেন, লোক সংস্কৃতির সুবর্ণ ধ্বজাধারী এই মানুষগুলো আজীবনকাল কত বঞ্চিত। শহরের সংস্কৃতিকর্মীরা তাদের মাথার ওপর পা রেখে নিজেদের প্রকট ভাবে দৃশ্যমান করে তুলেছেন। এই সব কিছু নিয়েই লেখা তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আড়কাঠি’।

ভগীরথ মিশ্রের ‘আড়কাঠি’ উপন্যাসে আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে দুটি উপাদানের সন্ধান পাই। প্রথমত জনসমাজের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা একটি প্রাচীন উপজাতির জীবন কাহিনী ও সাংস্কৃতিক সম্পদ; দ্বিতীয়ত আড়কাঠির কার্যকলাপ। এই দুটি উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ আড়কাঠিদের হাতেই এই গরীব, বুভুক্ষু মানুষগুলির নিয়তি অনিবার্য ভাবেই নির্দিষ্ট হয়। এই দুটি উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অনিবার্য পরিণতির দিকটি আলোচনা করা যাক।

যে অঞ্চলটির কথা এই উপন্যাসে পাওয়া যায়, সেই জায়গাতে পৌঁছনো একটু দুষ্কর। বাঁকুড়া শহরের রাণীবাঁধ দিয়ে ঢুকলে সোজা দক্ষিণে বন-জঙ্গল, খুলিয়া-খোঁদল, ডিহি-ডুংরী ধরে হাঁটলে একে একে পড়বে কাটিআম, মৌলা, জামবেড়িয়া, মিঠাআমের জঙ্গল। বাঘমুড়ি, মইষমুড়া পেরিয়ে সে পথ বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের সীমান্তে গিয়ে মিশেছে। সেই পথ ধরে দু-তিন ঘণ্টা হাঁটলেই জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যাবে গজাশিমূল গ্রাম। এই গ্রামের প্রাচীন উপজাতি হলো বসু শবর জাতি। তাদের মতে, তারা সকলের চেয়ে উচ্চ-বর্ণ। বিহারের তামজোড়েও এই জাতি আছে। আসলে তারা পাহাড়িয়া জাতি।

কোনো এক কালে ভুঁইহার-জমিদারদের তাড়া খেয়ে এদের কোনো পূর্বপুরুষ এসে এই গজাশিমূল গাঁয়ে বসবাস করেছিল। প্রচুর শিমূল গাছ ছিল বলে গাঁয়ের এহেন নামকরণ। তারা চাষ করতে জানে না। জঙ্গলই তাদের কাছে বাবা মায়ের সমান। সারাদিন জঙ্গলে শিকার করে। গুঁড়চা-সাট্‌না ধরে। মৌচাক ভাঙে। ফল পাড়ে, কন্দ-মূল খোঁড়ে। এই সবই তাদের খাদ্য। শাল কাঠের ‘ইশ’ বানায়, গরুর গাড়ির লাঙল, খাটিয়ার পায়া – এই সমস্ত লোকালয়ে বিক্রী করে উপার্জন করে। ছোট ছোট দল জঙ্গলে জঙ্গলে অনেক দূর চলে যায়। দু-দশ দিন এক টানা হাঁটে। ক্ষিদে পেলে গাছের ফল খায়। তেষ্টা পেলে ঝর্ণার জল খায়। গাছের মাথায় চড়ে রাত্তিরে ঘুমোয়।

এহেন একটি প্রাচীন উপজাতির সন্ধান পায় রাজীব, যে বাঁকুড়া কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক। সুনীল তার কলেজের ছাত্র। এই সুনীলই তাকে গজাশিমূলের সন্ধান দেয়। কারণ সুনীল চিরুড়ি স্কুলে সুচাঁদ ভক্তার সঙ্গে পড়ত। রাজীব তাদের লোকজীবন লোকনৃত্যকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে।

ভদ্র লোকেদের ওরা বলে ‘কাঁকড়া’। তাদের বিচিত্র দেব দেবী। বিচিত্র তাদের আরাধনা পদ্ধতি। ফাল্গুন মাসে যখন ঘরে ঘরে ‘মায়ের দয়া’ হয়, তখন তিন রাত নাচ গানের মাধ্যমে ‘নিশি উজাগর’ করে ওরা। পুজোর সঙ্গে ‘নিশি উজাগর’ করলে দেবতা নাকি তুষ্ট হন। প্রথম রাতে হয় শীতলা-বন্দনা। বিচিত্র সুরে গান, বন্য তালে বাজনা, নিজেরাই শীতলা সাজে। কেউ সাজে বাহন গর্দভ, এমন কী রোগ জীবাণুও সাজে কেউ কেউ। নাচ গানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় রোগের ভয়াবহতা।

দ্বিতীয় রাতে হয় ‘শিকার লাচ’। তাদের জীবিকা শিকার করা। জীবিকার পরিণতি হয় উৎসবে। সেই শিকার করার আলাদা উদ্দীপনা থাকে। আনন্দে তারা মেতে ওঠে। নাচে, গায়, ঘর থেকে বেরোবার সময় প্রিয়জনেরা ফরমাশ করে – ‘সব থেকে বড় সাট্‌নাটি আমার জন্য এনো’। শিকার পর্ব নিয়ে চলে চার ঘণ্টার নৃত্য। ‘চাঙ লাচ’ হয় তৃতীয় দিনে। এক বিশেষ ধরনের গানের সঙ্গে সমবেত নাচ। সঙ্গে বাজনা কেবল চাং আর মাদোল। এর ভাষা স্বতন্ত্র, সুর মৌলিক, নাচগুলোর আঙ্গিকও চেনা ছকের বাইরে। এগুলো তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐশ্বর্য। এছাড়াও আছে বিহা গীত, পরবের গান, আষাঢ়িয়া গান প্রভৃতি।

এই প্রাচীন সংস্কৃতিকে রাজীব প্রচারের আলোয় আনতে চাইলে দশরথ ভক্তা বিলাপ করে। বত্রিশ ঘর বসু-শবরের জাতকে নিজেদের জীবন ধারণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে চায় সে। দশরথ ভক্তা রাজীবকে জানায় যে, তাদের খাদ্যের অভাব নেই। ফল-ফুলারি, ভ্যাঁচ-কেঁদু, ভেলাই-ভুঁড়ুর, কাঁটা-আলু, চুরকা–আলু, পান-আলু, রাখাল-কুদরী, বন কাঁকড়ো -- সে সব এনে তাদের খেতে হয়। জঙ্গলে বড় শিকার, খরগোশ, গুঁড়চা, মালো, খটাস, বন-মুরগী, তিতির, কোয়ের গুঁড়ুর, ঢ্যামনা সাপ, সাট্‌না, সে সব মেরে খাওয়া চলে। ঢ্যামনা সাপের ছালের অনেক দাম। সাট্‌নার ছালেরও অনেক দাম। সাট্‌নার ছাল পুড়িয়ে রাণীবাঁধ কিংবা ফুলকুসমার হাটে বেচে উপার্জন করা যায়। গাছে গাছে ঠেলু আছে। অনেক লোক মিলে তীর কিংবা গুলতি, পাথর, রড ছুঁড়ে তাকে মারতে হয়। এক সময় কাহিল হয়ে পড়লে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। তখন সবাই মিলে তাকে লাঠিপেটা করে মেরে তার মাংস খায়। চামড়া দিয়ে ‘চাং’ছায় তারা।

এছাড়াও অর্বাচীন কালের হাজা-মজা বাঁধের ঠান্ডা থলথলে পুরনো পাঁকের তলায় কালো কুচকুচে কটুর (কচ্ছপ) দল বাস করে। আলের ধারে ধারে বড় বড় ইঁদুর বাস করে, তাদেরকে মেরেও তারা খায়। হরিতকি, বহেড়া, কঁচড়ার বীজ কুড়িয়ে, জঙ্গলের কাঠ কেটে লাঙল বানিয়ে হাটে বিক্রী করে অর্থ উপার্জন করে জীবন নির্বাহ করে।

পরবর্তী ক্ষেত্রে রাজীবের নেতৃত্বে এই সমস্ত ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন লোকনৃত্য দেখাতে যখন তারা রাজী হয় এবং বিভিন্ন শহরে তাদের এই লোকনৃত্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তখন তারা দু’হাত ভরে উপার্জন করে গ্রামে ফিরে আসে। এই আনন্দে কাস্তো মল্লিক, সুচাঁদ ভক্তাকে ‘কানাইশরজীউ’র পুজো করতে বলে। তিনি এই গোষ্ঠীর সব থেকে প্রাচীন দেবতা। গজাশিমূল থেকে দু’দিনের পথ হাঁটলে বেলপাহাড়ী। তার দক্ষিণে একজোড়া পাহাড়। পাহাড়ের গায়েই কেন্দাপাড়া গ্রাম। সেখান থেকে কিছুটা হাঁটলেই কানাইশর পাহাড়। সেখানেই বাবা কানাইশরজীউর অবস্থান। সিঁদুরে চর্চিত শিলারূপী লীলাময়। চারপাশে হাতি ঘোড়ার স্তূপ।

কাস্তো মল্লিক বর্ণিত এই দেবতার কিংবদন্তী অনেকটা এইরকম -- আষাঢ়ের তৃতীয় শনিবার খুব জমজমাট করে কানাইশরজীউর পুজো হয়। বহু মানুষের মনস্কামনা তিনি পূর্ণ করেছেন। পাহাড়ের গুহায়, জঙ্গলে বাবার অসংখ্য ভক্ত ঘুরে বেড়ায়। বাবার ভক্তদের তারা কোনোরূপ উপদ্রব করে না। ভক্তকে ভয় দেখানোর জন্য জনহীন জঙ্গলে ‘আগুন বরণের’ বেশে তিনি হাজির হন। কাস্তো মল্লিক জীবনে একবার তাঁকে দর্শন করেছে। তার মতে, তিনি একেবারে জাত ব্যাঘ্র, জ্বলন্ত অগ্নির মতো তাঁর বর্ণ। কানাইশরজীউর থানে মেয়েদের যাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। যে যাবে তার বছর ঘুরবে না, ওলাওঠা অথবা আগুনবরণের হাতে মৃত্যু হবে তার। ঠাকুরের মূর্তির তলায় এক বিশাল সাপ বাস করে। ঠাকুরের হুকুমে সে নড়ে চড়ে। শিলাটাকেও নড়িয়ে দিতে পারে সে।

এই সমস্ত কাজে রাজীবকে সাহায্য করে ‘ইস্ট ওয়েস্ট ফোক ফাউন্ডেশন’এর পূর্ব ভারতীয় শাখার ডিরেক্টর ‘দ্য ফোক’ পত্রিকার সর্বভারতীয় সম্পাদক মিস ক্যাথিবার্ড। তার সঙ্গে আসে মিঃ জনসন। তাদের কাজ, এই অঞ্চলের টুসু, ভাদু, ঝুমুর, পাতানাচ, কাঠিনাচ প্রভৃতি হারিয়ে যাওয়া ফোকলোরগুলোকে খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করা, এবং যারা সেই ফোকগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের আইডেন্টিফাই করা। তাছাড়া উপযুক্ত ‘এইড’ দিয়ে তাদের ফোকগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা।

অন্যদিকে টাকা, মেডেল, প্রতিপত্তি, সম্মান প্রভৃতি যখন রাজীব সহ সুচাঁদ-রঙীদের অভ্যেসে পরিণত হয়, তখন কোনো ভাবেই সেটাকে হাতছাড়া করতে চায় না তারা। এর জন্য যে কোনো মূল্য দিতে তারা প্রস্তুত হয়। টাকার কাছে তাদের একান্ত নিজস্ব গূহ্য সম্পদ বিকিয়ে যায় - জলকেলি নাচ। সে নাচ তাদের কৌলিক নাচ। সে বড় শুদ্ধ, বড় গূহ্য বস্তু। সে নাচ কেবল কানাইশরের সামনেই দেখানো নিয়ম।

কাস্তো মল্লিক এই জলকেলি নাচের উৎপত্তির ইতিহাস বর্ণনা করে। বসু-শবর জাতের মূল বসতি ছিল তামাজোড় গাঁয়ে। সুবর্ণরেখা নদী ও পাহাড় দ্বারা ঘেরা সেই গ্রামে একবার জন্ম নিয়েছিল স্বয়ং ব্রজরাজ কানাই। এরপর কাস্তো মল্লিকের বর্ণনার সাদৃশ্যে আমরা বৃন্দাবনে কৃষ্ণ ও গোপীদের বস্ত্রহরণ খণ্ডের কথা স্মরণ করতে পারি। যমুনা এখানে সুবর্ণরেখা নদী হয়ে গেছে। কদম গাছ রূপান্তরিত হয়েছে মৌউল গাছে। বৃন্দাবনের গোপিনী এখানে কলঙ্কিনী শবর কন্যা। শবররা কানাইকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে সকলে মিলে প্রচন্ড মারধোর করে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। সেই বছরই তামাজোড় গাঁয়ে নিদারুণ খরা হয়। সুবর্ণরেখা নদী শুকিয়ে যায়। গাছে পাতা ফল কিছুই থাকে না। প্রচুর মানুষ এতে মারা যায়। এইসময় কাস্তো মল্লিকের ঠাকুরদাকে স্বপ্নে ব্রজরাজ কানাই এই খরার কারণ জানায় এবং সুবর্ণরেখা নদীর মউল গাছের তলায় তাঁর পুজো করার কথা জানায়। যদি যুবতীরা জলকেলি নাচ করে আরাধনা করে, তবে ব্রজরাজের শান্তি হবে, বর্ষা হবে, আর ঐ যুবতীরা মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবে।

সাতদিন পর ব্রজরাজ কানাই আবার স্বপ্নে জানায় যে, তিনি তাদের ঘরে কানাই শবর হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। এখন তাঁর বাস পাহাড়ে। তাঁর নতুন নাম কানাইশরজীউ। আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে তাঁকে পুজো করার কথাও জানায়। সেই থেকে সেই রাতে নদীর পাড়ে মেয়েরা জলকেলি নৃত্য করে। সেই নাচের অনেক নিয়ম। গানের ভাষা দৈব ভাষা। সে গানের সুর বেঁধেছিলেন স্বয়ং ব্রজরাজ। এটাই কিংবদন্তী। সুদূর বৃন্দাবনের কাহিনী এত দূরে একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এভাবেই সংস্কৃতি নিরন্তর চলমান খরস্রোতা নদীর মতো।

রাজীবকে এই জনগোষ্ঠী একান্ত আপন মনে করে। তাই তার কাছে দশরথ ভক্তা ব্যাখ্যা করে জলকেলি নাচের স্বরূপ -- আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে গভীর রাতে বহু উপচারে ব্রজরাজের পুজো হয়। পুজোর শেষে সব পুরুষ ওখান থেকে চলে আসে। নদীর পাড়ে থাকে শুধু যুবতী মেয়েরা। তারা নাচতে শুরু করে ব্রজরাজের সম্মুখে। নাচতে নাচতে এক-একটি বস্ত্র ত্যাগ করে। এক সময় পুরোপুরি বস্ত্রহীন হয়ে যায় তারা। ঐ সময় গান ও নাচের অনেক মুদ্রা দেখা যায়। সারা রাত্রি ধরেই সেই নাচ-গান হয়। মেয়েরা ছাড়া কাকপক্ষীতেও সে নাচ দেখতে পায় না, শুনতেও পায় না। শুধু ব্রজরাজই সেই নাচ-গান আস্বাদন করেন। শবর কন্যার নাচে তিনি তুষ্ট হন। জগতের মঙ্গল হয়। আশ্চর্য এক অচেনা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই সম্প্রদায়।

এবার এই উপন্যাসে আড়কাঠির স্বরূপটি উদ্ঘাটন করা যাক। রাণীবাঁধ বাজারে মুক্তেশের চায়ের দোকানে রাজীব ও মিস ক্যাথিবার্ডের পাশাপাশি আমরা পরিচিত হই রংলালের সঙ্গে। রাজীব ক্যাথিবার্ডকে ওর পরিচয় হিসাবে জানায় – ‘ও একজন আড়কাঠি’। অর্থাৎ কুখ্যাত দাস-ব্যবসায়ী। রংলাল হলো তাজা মালের ব্যাপারী। মাল যাচাই করতে সে পাকা জহুরী। পুরুষদের বেলায় পঁয়ত্রিশ আর মেয়েদের পঁচিশ ছাড়ালেই সে আসামে তাদের পাচার করে দেয়, চা বাগানে কাজের আশ্বাস দিয়ে। চা বাগানে কাজের ফলে অফুরন্ত সুখের কথা নির্বিকারে শুনিয়ে যায় এই বোকা মানুষগুলোকে। হতদরিদ্র এই মানুষগুলি তার কথায় সুখের আশায় বুক বাঁধে। রংলালের লাল খাতায় টিপ দেবার ধুম পড়ে যায়। জনে জনে দাদন বিলি করে রংলাল। লাল খাতার বত্রিশটি পাতায় বেঁধে ফেলে পুরো গ্রামটিকে। হাতে নগদ টাকা পেয়ে মুগ্ধ হয় গজাশিমূলের মানুষগুলি। রংলালের অবাধ গতি, অখণ্ড তার আধিপত্য।

মাঝে মাঝে এসে আসামে কাজ করতে যাওয়া মানুষগুলির মুখের কথা শোনায় রংলাল তাদের পরিবারকে। সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার প্রিয়জনের সুখের খবর শোনার জন্য। তাদের লেখা চিঠি, অস্পষ্ট ছবি দেখিয়ে মন জয় করে এই মানুষগুলির। যারা যেতে চায় রংলালের সঙ্গে, তারা তৈরি হতে থাকে। ক্ষার দিয়ে কাপড় কাচে, সাজো মাটি দিয়ে মাথা ঘষে। মাকড়া-পাথরের টুকরো দিয়ে মরা চামড়া তুলে পা চকচকে করে। প্রিয় ফল পাকুড় খেয়ে নেয় আশ মিটিয়ে। জঙ্গলে নিজের প্রিয় জায়গাটিতে গিয়ে বসে বারবার। বড়াম পুজোর থানে গিয়ে জীবনের গোপনতম আকাঙ্ক্ষাটি জানিয়ে আসে। একদিন ‘ঝুঁঝকা পহরে’ রংলালের সঙ্গে পাড়ি দেয় অজানা জীবনের খোঁজে। তারা জানেও না কোন্‌ পারে তাদের জীবনের সোনারতরী ভিড়তে চলেছে।

এহেন সুখের চমকটা ভাঙে অনেক পরে, যখন আর কিছুই করার থাকে না। সুচাঁদ যায় আসামে। নিজেদের প্রিয় মানুষগুলির সুখকর অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখতে। ফিরে এসে সুচাঁদ দশরথ ভক্তাকে জানায়, দশ বছর আগে চলে যাওয়া তার কন্যা সুবাসী নিরুদ্দেশ। সুফল কোটালের দু পায়ে দগদগে ঘা। সে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। তারা সকলেই মানুষ থেকে জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। সারাদিন গরুর মতো খাটে। দিনের শেষে আধপেটা খায়। ঝুপড়ি ঘরে শুয়ে রোগ শয্যায় লড়াই করে। ঝড়েশ্বরের মেয়ে সাবিত্রী রোজ অসংখ্য মানুষের দৈহিক লালসার নিবৃত্তি ঘটায়। আধপেটা খাবারের টাকা দিয়ে সমস্ত টাকাটাই রংলাল কোম্পানীর থেকে তুলে নেয়। এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। অনেক মেয়েরই কোনো হদিস নেই। রংলাল শুধু আড়কাঠিই নয়, নারীপাচার চক্রের কাজও সে করে।

রংলালের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় এই মানুষগুলির কাছে। হয়তো তারা সচেতন হয়। আবার কখনো পেটের খিদে ও জীবনের তাগিদে এহেন রংলালের বিরোধিতা করতেও তারা ভয় পায়। এই অবস্থায় এই হতদরিদ্র মানুষগুলিকে আর্থিক ও মানসিক ভাবে সাহায্য করে রাজীব। পরিত্রাতার ভূমিকায় সে অবতীর্ণ হয়। সকলে ভীষণ বিশ্বাস করে রাজীবকে। কিন্তু তখনো অনেক চমক বাকি ছিল এই মানুষগুলির জন্য। হয়তো আরো বড় দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল।

বিদেশিনী ক্যাথিবার্ড ও সাহিত্যের অধ্যাপক রাজীব আসলে তথাকথিত ‘লোকসংস্কৃতি-প্রেমী’ ফোক ব্যবসায়ী। ক্যাথিবার্ড ও রাজীব অর্থোপার্জনের স্বার্থে ব্যবহার করে আদিবাসী বসু শবরদের লোকজীবন, লোকনৃত্যকে। বিদেশ ভ্রমণ, সেমিনার, অর্থ, বৈভব, প্রতিপত্তি, রাজীবকে উন্মাদ করে তোলে। এই সমস্ত কিছুর বিনিময়ে তাদের গুহ্য সম্পদ ‘জলকেলি নাচ’কেও সওদা করতে পিছপা হয় না। চার-পাঁচ হাজার থেকে রেট এক লাফে তিরিশ হাজার হয়। দলের ম্যানেজার পায় আট হাজার। বাকিটা রাজীবের। আসামের চা বাগানে আড়কাঠি রংলাল কুলি চালান দিত। তার দাদন থেকে বাঁচাতে গিয়ে রাজীব একদিন লোক-সংস্কৃতি প্রচার সংগঠন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেটি ছিল এই সরল মানুষগুলির জন্য আরো বড় ফাঁদ। রাজীব যখন বাজোরিয়ার সঙ্গে এই দলের সওদা করতে বসে, তখন রাজীব বলে ওঠে – ‘‘এ দলে জনা বারো মেয়ে আছে।... তার মধ্যে একটা ডব্‌কা ছুঁড়ি আছে, দেখেছেন তো? ওকে দেখলে আপনার বড় বাজারের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে মশাই। ওর এক-একখানা বুকই আঠারো হাজারে বিকোবে।’’

এই রাজীব কি রংলালের থেকেও কোথাও বড় বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠেনি?

‘হায়রে নগরী পাষাণ কারা’

এভাবেই হয়তো মুল্যবোধ বিকিয়ে যায়। রক্ষকই হয়ে ওঠে ভক্ষক। আর এখানেই উপন্যাসটির শ্রেষ্ঠ চমক ও অভিনবত্ব।

সহায়ক গ্রন্থ
লোকসংস্কৃতির তত্ত্বরূপ ও স্বরূপ সন্ধান : ডঃ তুষার চট্যোপাধ্যায়।
বাংলার লোকসংস্কৃতি : ডঃ ওয়াকিল আহমেদ। ভূমিকা : বাংলার লোকসংস্কৃতির উৎস। পৃ. ৩১। ১৯৭৪ এর সংস্করণ।
বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ : ডঃ বরুণকুমার চক্রবর্তী।

ফুটনোট

‘সাট্‌না’- গোসাপ
‘গুঁড়চা’- কাঠবেড়ালী জাতীয় প্রাণী
‘ঠেলু’- বাঁদর
‘ঈশ’- লাঙ্গলের ফলা
‘নিশি উজাগর’- রাত্রি জাগরণ
‘মায়ের দয়া’- জল বসন্ত
‘বড়াম পুজা’- পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ইনি পূজিতা। তাঁর স্থান অসংখ্য। কোনো মন্দির বা চালা নেই। গাছতলায় তাঁর পুজো হয়। বড়ামের প্রতীক পাথর খন্ড। কোনো কো্নো পাথরে তাঁর চোখ মুখ আঁকা। পোড়ামাটির হাতি ঘোড়াও তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়। বড়ামের প্রধান সাঁওতাল বা লোধারা। উপাসকদের মতে, বড়াম পশু দেবতা। ‘বড়াম’ মানে সেরা বা আদি। সুতরাং ইনি একশ্রেণীর সমাজে বহুমান্যা ও কুলদেবী জ্ঞানে পূজিতা।

০৪) অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

ছাতা


একদল ছাতা আজ রাস্তায়। এরকম দৃশ্যের সাথে শহরের জুন মাস খুব পরিচিত। কিন্তু আজ কোনো মানুষ নেই। কোনো মোমবাতি নেই।

আমাদের ছাতা দুটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বিকেল থেকে। একটি যুবকছাতা। আরেকটি সেই আদিম দাদুর ছাতা। দাদু বলতেন - “ছাতার হৃদয় আছে। আন্তরিকতা আছে। তাই সে চাইলেই অনেক মানুষকে ঠাঁই দিতে পারে অই সামান্য এরিয়ায়।” আমরা ভাবি, ছাতা পোষ মানে। মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে, আমাদের ইচ্ছেমতো। কিন্তু ভুলে যাই - ক্রীতদাসেরাই একদিন বিপ্লব আনে।

ছাতা আড়াল করে রোদ-বৃষ্টি-আকাশ। তৈরি করে একটি ব্যক্তিগত ছাদ। মানুষ-ছাতা-পথ এই বদ্বীপের সৃষ্টি হয়। অথচ ছাতা হারালে কান্না পায় না। ভেসে ওঠে নতুন ছাতার চিত্রকল্প। সেও একইভাবে শিখে নেয় মানুষ-আগলানো। আগলে রাখার কোনো রবিবার নেই। তাই ওরা অপেক্ষা করে শীতকালের। ওরা ভুলে যেতে চায় শ্রাবণ।



ছাতারও ব্যর্থতা থাকে। ছাতা হাতেও ভিজতে হয় আপাদমস্তক। ছেলেটি মেয়েটিকে ডেকে সাড়া না পেলে, মেঘ কালো হয়। ছাতা উপুড় হয়ে নৌকা হয়ে যায় তখন। ভাসতে থাকে মানুষ বৃষ্টিতে। কান্না মোছাতে পারে না। শুধু জলের দাগে এঁকে দেয় বাড়ি ফেরার ম্যাপ। দরজা পেরোলেই জীবনফেরৎ ছেলেটি ভুলে যায় ছাতাকে। জ্বর আসে রাতে। এইভাবেই একদিন কাশির সিরাপের বদলে বিক্রি হয়ে যায় জুলাই মাসের বিকেল এবং আধভেজা ছাতাটি।

ছাতা ফুটো হলে খোঁজ পড়ে হারুর। হারু ছাতা সারিয়ে বাঁচিয়ে রাখে আরও দুটো আইবুড়ো ছুঁচকে। তাই কে সি পালের মতো সেও ছাতার অসুখ কামনা করে। হারুদের নিজস্ব ছাতা থাকে না। আর এই না-থাকা জড়ো হয়ে জন্ম দেয় - একটা বিশাল ছাতা। যার নিচে ফুর্তি হয় নিউ ইয়ারে। মদ উড়ে গিয়ে লাগে তার গায়ে। নেশা হয়।

ছাতা বিপ্লব ভুলে যায়। কাক হয়ে উড়তে থাকে ট্রামলাইনের উপর দিয়ে।

০৫) তুষ্টি ভট্টাচার্য

আলো, অন্ধকার ও ছায়া


আলো আর অন্ধকারের মধ্যে ছায়াটুকুই দেখি। দেখি ছায়ার রূপ, তার চলন, তার ক্রমশ বদলে যাওয়ার গতি প্রকৃতি। ছায়ার বড় হয়ে ওঠাও কি দেখি না? বড় হতে হতে আকাশকে কেমন ছেয়ে ফেলছে, কত দ্রুত বদলাচ্ছে তার আকার! আলো বলে চলেছে, আমি আছি বলেই ছায়া আছে। অন্ধকার বলে – ছায়া আমারই আবিষ্কার! দ্বন্দ্ব দেখেছ? কেমন দেওয়াল বেয়ে বেয়ে উঠছে! আমি নিশ্চুপ দর্শক। তুমি বা তোমরাও তাই।

নদীকে চেন? চিনবে বইকি! আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে নদীর নাম তো অনেক। কখনও গঙ্গা, কখনও মেঘনা, যমুনা, খঞ্জনা। নদীর আড়ভাঙ্গা দেখেছে খুব কম জন। এক মুখ থেকে আর এক মুখে কেমন করে যেন সে বদলে যায়! এক বাঁক থেকে আরও এক বাঁকে হারিয়ে যেতে থাকে, অথচ হারায় না। নদীর তো ছায়া পড়ে না। ছায়াহীন, কায়াহীন তার শরীরে অশরীরী জলছাপ লেগে থাকে।

অন্ধকার কী যেন বলছে... কান পেতে শোনো... সে কি একাকীত্বে ভোগে? একলা যদি হয় সে তাহলে তার ছায়া এসে কেন ভিড় করে পলাশ বনে? অন্ধকার জানে তার আত্মপরিচয়। সেই জানে তার স্বরূপ। কতটা কান পাতলে তবে তার পায়ের শব্দ শোনা যাবে, জানে আলো।




আলো তো নিজেই একাই একশ হয়ে আছে এই ক্ষণকালের জীবনে! তার অনেক মোসাহেব, তার অনেক ফ্যান ফলোয়ার। রাজার আসনে বসে অন্ধকার আর ছায়াকে পাত্তা দেবে কেন সে? রোজ সূর্য ওঠে, রোজ সূর্য অস্ত যায়... আলো এসে চলে যায়, অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে। অথচ এই সরল সত্যটাকে আলো অস্বীকার করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। অন্ধকার মুখ গুঁজে থাকে অভিমানে। আর ছায়া দ্বিধায় দোলে, কার সে কার? আলোর না আঁধারের!

নদী কি বলে শুনেছ কখনও? ওই যে উঁচু পাহাড় থেকে দুরন্ত কিশোরীর মতো নেমে আসছে খলবল করে, একটু বাদেই কেমন মন্দ্র সাজে সাজবে সে! এক মানুষীর পরিণতি পেয়ে হয়ে উঠবে ধীর স্থির মৃত্যুগামী। এক জীবনে নদী অনেক কথা বলে, তারও বেশি বহন করে চলে মুখ বুজে। সে মৃত্যুগামী কিন্তু মরণশীল নয়। মাটির নিচেও তার বয়ে চলা অবিরাম। ফল্গুস্রোতের ছুটি হয় না, অমরত্ব লাভ তার নিয়তি।

আলোর উল্লাস, অন্ধকারের একাকীত্ব, ছায়ার বিভ্রম যদি মিলে মিশে যায় কোনো একদিন, হাড়ের উল্লাসে বেজে উঠবে নদী। এক অজানা ভাষার কুলকুল শুনব, বুঝে কিম্বা না বুঝে অকারণ হাততালি দিয়ে উঠবে চরবাসী। রাতের আকাশে তারাগুলো একইভাবে টিমটিম করবে, জোনাকিরাও সেই পথে হেঁটে চলেছে, দেখব আমরা।

০৬) অনিল শেঠ

স্মরণের সরণিতে – ১


অনিল শেঠ 


[এই স্মৃতিকাহিনীর লেখক শ্রীঅনিল শেঠের জন্ম ১৯২৮ সালে। তাঁর শৈশব কাটে জামশেদপুরে। সেখানে স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করে তিনি যান কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। বিজ্ঞানে স্নাতক হবার সঙ্গে সঙ্গে বিগত শতকের চল্লিশের দশকের কলকাতায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন দাঙ্গা, দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার সেই সব ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন আর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর ঝুলিতে জমা হয় বিচিত্র ও বর্ণময় সব অভিজ্ঞতা। গণনাট্যের প্রসারে তিনি সফর করেন অবিভক্ত বাঙলাদেশের নানা স্থানে। পরে তিনি জামশেদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম শাখা। তারপর শহরের নানা বিদ্যায়তনে শিক্ষকতার পেশায় অতিবাহিত হয় তাঁর জীবনের অনেকগুলি বছর। বিজ্ঞান-প্রদর্শনী, সায়েন্স ক্লাব ইত্যাদি নানা অভিনব কর্মধারার মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রূপে। বর্তমানে সেই পেশা থেকে অবসর নিয়েও এই বর্ষীয়ান শিক্ষাব্রতী আজও নানা ধরনের সৃষ্টিশীল মননে ও চর্চায় নিযুক্ত। তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণময় জীবন-খাতার পাতা থেকে কিছু আকর্ষণীয় কাহিনী আমরা মাঝে মাঝে এখানে পরিবেশন করবো। এবার তার প্রথম পর্ব।] 



 আগুনের সঙ্গে লড়াই 

তখন প্রায় বারো বছর বয়স আমার, চাইবাসায় কাকার বাড়িতে বেড়াতে গেছি আমার বাবার সঙ্গে। জায়গাটার নাম সেনটোলা। বাড়ির খুব কাছেই ছিল বিরাট এক পুকুর – টলটলে জল তার, বেড়া দিয়ে ঘেরা। এখানে আমার দিন কাটছিল খুবই একঘেয়ে ভাবে, তখন ভাবতেও পারিনি যে, একটি মনে রাখার মতো ঘটনা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

সেদিনটা ছিল তপ্ত, আকাশ ছিল পরিষ্কার, কিন্তু এক কোণা থেকে ঘন ধোঁয়া উঠছিল। সে-সময় রেল চলতো স্টীম ইঞ্জিনে, আর জায়গাটা ছিল যেহেতু রেল লাইনের খুব কাছে, আমি ভেবেছিলাম যে, কোনো ইঞ্জিন থেকেই ধোঁয়াটা বের হচ্ছে।

অচিরেই আশেপাশে একটা আলোড়ন শুরু হলো। জোর চ্যাঁচামিচি সহকারে লোকজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করলো। প্রতিবেশিদের একটি ছেলে আমাকে চেঁচিয়ে বলল, “রেলের স্লিপার ইয়ার্ডে আগুন লেগে গেছে” – একথা বলে সে তার দৌড় থামালো না। কিছু না ভেবেই আমি সেই ছুটন্ত ভিড়ে যোগ দিলাম। বাবা ধারে কাছে ছিলেন না, তাই আমি বিনা বাধায় চলে গেলাম সেই জনতার সঙ্গে।

তাড়াতাড়ি আমি পৌঁছে গেলাম ঘটনাস্থলে। ইতিমধ্যেই ভালো মতো একটা ভিড় জমে গেছে সেখানে। রেল ইয়ার্ডটার সব দিক ছিল উঁচু পাঁচিলে ঘেরা, তাই কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু ইয়ার্ডের মধ্যে থেকে যে ঘন ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠছিল, সেটাই দেখা যাচ্ছিল।

চারপাশে শুধু লোকজনের চিৎকার, সবদিকে ছোটাছুটি আর উচ্চস্বরে কথাবার্তা চলছিল। তারা বালতির জন্য চেঁচাচ্ছিল। চারপাশে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা। কাছাকাছি যে সব বাড়ি ছিল, সেখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা বালতি জোগাড় হয়ে গেল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কিছু তৎপর লোকজন পুকুর পর্যন্ত সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ও তাদের হাতে হাতে বালতিগুলো পুকুরের জলে ভর্তি হয়ে পৌঁছে যেতে থাকলো রেল ইয়ার্ডের দেওয়াল পর্যন্ত।



রেল-চত্বরের মধ্যেই ঐ পাঁচিলের একধারেই ছিল একটা টিনের চালা। কিছু লোক দেওয়ালের খাঁজের সাহায্য নিয়ে প্রথমে পাঁচিলের ওপর এবং সেখান থেকে টিনের চালার ওপর উঠে পড়তে পেরেছিল। একদল লোক সারিবদ্ধ লোকজনের কাছ থেকে জলভরা বালতি নিয়ে এসে পৌঁছে দিচ্ছিল, যারা দেওয়ালের ওপর আর টিনের চালার ওপর ছিল তাদের কাছে। আমিও জুটে গেলাম তাদের সঙ্গে। এতে আমি উৎফুল্ল বোধ করছিলাম, কারণ এই উদ্ধার বাহিনীর বড়রা আমাকে একটা ছোটছেলে ভেবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলেন না, বরং আমাকে দলেরই একজন মনে করছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন ঐ বড়দের সমমর্যাদার একটা স্থান পেয়ে গেছি।

দেওয়াল পর্যন্ত জলভরা বালতি বয়ে আনার ভূমিকাটি আমার অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কোনো সচেতন চেষ্টা ছাড়াই আমি দেওয়ালের ওপর, তারপর টিনের চালার ওপর চলে এলাম। সেই জ্বলন্ত চত্বরটি আমি একেবারে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। সে কী দৃশ্য! সেখানে বেশ কয়েক থাকে রাখা ছিল রেলের স্লিপারগুলো। ঊর্ধমুখি লেলিহান অগ্নিশিখায় তার বেশিরভাগগুলোই পুড়ছিল। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে উঠছিল আগুনের ফুলকি, যেন ঐ আগুনের হল্কা তৈরি করছিল ধোঁয়ার কালো ধূসর জমিনের ওপর লাল আর হলুদ জ্বলন্ত বিন্দুর নকশা। ঐ চত্বরের মধ্যে জীবন্ত কিছুই ছিল না। একটা বিরাট এলাকা জুড়ে শুধু আগুন আর অগ্নিশিখা! অগ্নিশিখার উত্তাপ আমি টিনের চালার ওপর থেকেই অনুভব করছিলাম। প্রজ্বলন্ত সেই চত্বরের বিধ্বংসী ও ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে আমি বিহ্বল হয়ে গেছিলাম।

কিছুক্ষণ পরে আমার যেন আবছা ভাবে কানে এলো, আমাকে কারা চিৎকার করে ডাকছে। লোকজনের সেই ক্রমবর্দ্ধমান চিৎকার সহসা আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে আমার পরিপার্শ্বের মধ্যে ফিরিয়ে আনলো। আমি দেখলাম যে, আমি ঐ টিনের চালার প্রস্থের অর্ধেকেরও বেশি এগিয়ে এসেছি ও সেখানে আমি একা। বাকিদের প্রায় সকলেই পিছিয়ে গিয়ে জমা হয়েছে সেই চালার দেওয়াল-ঘেঁষা কিনারাটায়। তারা চেঁচিয়ে বলছিল যে, আগুন চালাঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে আর আমার তখনই পিছিয়ে আসা উচিৎ। আমি বিপদটা বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু পায়ে হেঁটে আসা আমার পক্ষে ছিল খুবই কঠিন। চালাটার ছিল চত্বরের দিকে খাড়া ঢাল আর সেটাও ততক্ষণে জল ঢালার ফলে হয়ে উঠেছে খুবই পিছল। সেই ছাদের খাড়া ঢাল বেয়ে পিছলে জ্বলন্ত চত্বরের মধ্যে গিয়ে পড়ার সবরকম সম্ভাবনাই ছিল। আমি বসে বসেই চালা বেয়ে ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টায় নিজের শরীরটাকে টেনে তুলতে লাগলাম। সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে হাতে হাতে এক মানবশৃঙ্খল তৈরি করেছিল, যার সাহায্যে চালার অপর প্রান্তে আমাকে টেনে তোলা হলো। প্রত্যেকেই আপশোস করছিল যে, আগুনকে বাগে আনার আর কোনো উপায়ই নেই, আর আমাদের অবিলম্বে ছাদ থেকে নেমে আসা উচিৎ।

আমি মাটিতে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ সাইরেন শোনা গেল ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে। এটা ছিল প্রায় ৬৫ কিঃ মিঃ দূরের জামশেদপুর থেকে দমকল বাহিনী আসার সংকেত। তারা এসেই ভিড়কে দূরে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কাজে। পুরো দলটির একযোগে কাজ, তাদের দৃঢ় ও প্রত্যয়ী চলেফেরা আর তাদের প্রতিজ্ঞা-উদ্বুদ্ধ মুখের দিকে আমি সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

আমার সেই বীর নায়কদের তৎপরতা আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখেছিলাম প্রশংসা, সমীহ আর সম্ভ্রমের সঙ্গে।

০৭) স্বপন রায়

পাহাড়ি রায়ের চিয়া



নদী নয়, আড় ভাঙাবার কায়দা. আমি ঝুঁকে দেখছিলাম... রাজা বললো, দাদা জ্যাদা ঝুঁকিয়ে মত্‌ খাড়ি হ্যায়... আমি সরে আসি, নদীকে ভালোবাসলে চাকরির বিকল্প তৈরি হয়, রাজা জানে? আবার ভাবি জেনে কী হবে, কী হবে আমার যে আমি মেঘ-কুয়াশাকে ভাবছি ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের আবছা লভ্যাংশ, মানুষ সেই অসরন্ত কুয়াশাতুর মেঘে আমার লেন্সে ক্রমশ এক চরম আদরে গলে যাচ্ছে! আর একটা মানুষ ভাবছে, চা পেলে মন্দ হতো না! সেই মানুষটা আমি, পাহাড়ি!

অনেক পরে, একেবারে নদীর টাকরায় বসে সে আমাকে বললো, আপনাকে দেখে মনে হয় না যে, আপনি তুলতে পারেন!

-মানে?

-কী রোগা আপনি! তবু কী অনায়াসে তুললেন আমায়...

নদী আড় ভাঙাবার পরেই রাজার কথায় ফিরে আসছিলাম শেয়ার জিপের দিকে, বিকেলের টাচ আর সুচিত্রা সেনের “...টাচ করবে না”র রাগিনীভাঙা জেদ এই বাঁকটায় ছেঁকে দিচ্ছিল মেঘাদৃতা কুয়াশাকে। সে হাসলো। শেয়ার জীপের সহযাত্রিনী। শিলিগুড়ির সিকিম ন্যাশনালাইজড বাসস্ট্যান্ড থেকে আমার পাশে এই নাহাসিফুরনো মেয়েটি, নাম রাত্রি। জোড়থাং যাচ্ছে, তারপর সোমবারিয়া। আর আমি ভারসে। রাস্তা একই, সোমবারিয়াতে আমারো থাকার কথা এক, দুদিন। তো এ সবই মামুলি কথায় আমাদের সময় অবিরত এগোচ্ছিলো। জোড়থাং-এর কিছুটা আগে ধস নামায় এখন আমরা থেমে আছি...

সিকিমে এসে, বারবার এসে আমি কিছু শব্দসমষ্টি জাগাতে পেরেছি! ভাবিত সবুজ, বাঁকপ্রতি সুরেলা পাইন, পালকাঙ্গি, গ্রীবায়ন,মিছরিবিষাদ আলো... ভারসের মাথায় বসে এ সব ভাবছিলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনো দেখা দিচ্ছে, কখনো বা মেঘের আড়ালে। আপাততঃ এখানে কেউ নেই, আমি একা। দারুণ লাগছে, হাওয়াতে বেশুমার সান্দ্রতা। কাল বৃষ্টি হয়েছিলো, কালই আমি সোমবারিয়া থেকে বাসে হিলে আর হিলে থেকে চার কিলোমিটার ট্রেক করে ভারসের মাথায়। সারা রাস্তা জুড়ে ছিলো অপরিমেয় রডোডেন্ড্রনের উদার মুদারা, বৃষ্টি হঠাৎ করে এসে মাঝে মাঝে হরকতের চূড়ান্ত। আর আমি একাকী এক আজনবী তারানায় প্যাঁচ দিতে দিতে উঠে এসেছি, যেমন আমি করে থাকি পাহাড়ে। একা আসি, হাঁটি, দেখতে থাকি কী ভাবে সম্ভব হয় শীতের চাদরে রাখা এই ফুলেল রসায়ন! সারেগামায় জড়ানো শিখরপিপাসা আমায় ভাঙতে ভাঙতে গড়ে দেয়, আমার রুকস্যাকে লেপ্টে যায় আবার কারো ডেকে ওঠা, কোনো মুখের হাসিতে রাখা ঝুলবারান্দার চাউনি, আমি উঠতে থাকি তবু। আর রাত্রি গাঢ় হয়ে ওঠে সোমবারিয়ার শিহরটানা বাঁকে। আমি কী আর বলতাম, আমার তিরিশ বছরের শরীরে রাত্রি মুছে যাচ্ছে যখন?

আমি ভারসের এই ভোরে এ সব ভাবছি, হঠাতই আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি মারে! কিন্তু রাত্রি কোথায়, ও কি আসবে? সেদিন জীপ ধসের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিল, হঠাতই আমি রাত্রিকে বলেছিলাম, নেমে আসুন! আমরা বসেছিলাম পাথরের ওপর, আর আমি রাত্রির শরীরে দেখলাম, আবার দেখতে পেলাম কিছুক্ষণ আগে দেখা সেই আড় ভাঙা নদীটিকে, নদীর ভেতরে যে সব জলস্বছতা থাকে পিচ্ছিল হয়ে, চিকণ শ্যাওলা হয়ে, আমি দেখলাম রাত্রির আনাচে কানাচে এ রকমই কিছু বহতা। যেন ওর অনেক সময় আছে সারাক্ষণ আকাশ বুকে নেওয়ার, বুকে! রাত্রি নড়ে বসলো, আমি তো সে ভাবে কিছু বলিনি, শুধু মুহূর্তের দেখা ওখানে পড়লেই কি এরকম হয়! সিক্সথ সেন্স! আমরা কথা বলতে থাকি, মেঘের স্পঞ্জে শুষে নেওয়া কথায় জড়িয়ে যায় আমার কাজের কথা, রাত্রির শান্তিনিকেতন, ওর মিশনারি স্কুলের চাকরি নিয়ে সোমবারিয়া যাওয়া, আমার পরিবার, ওর মায়ের মৃত্যু... সন্ধ্যা আব্জে ধরে আমাদের, কিন্তু তার আগে আমরা নেমে এসেছিলাম নদীর কাছে... ধসের জন্য আরো কিছুক্ষণ দেরী হতে পারে এটা জেনেই অবশ্য... সেই নদীর ধারে জল অব্দি যাওয়ার আগে ছিল পিচ্ছিল পাথরের অংশ... রাত্রি পড়ে যাচ্ছিল... আমি ওকে ধরে ফেলি... রাত্রি বলে, থাক, জল জলের জায়গায় থাক... আমি মৃদু হেসে ওকে বলি, ডু ইউ ট্রাস্ট মি? ওর মুখ তখনো পড়ন্ত অবস্থায় আমার বুকের কাছে... কিছু বলে না... আমি তুলে নিই ওকে... আর নদীর টাকরায় বসে সে আমাকে বলে, আপনাকে দেখে মনে হয় না যে আপনি এত অনায়াসে তুলতে পারেন!



ভারসের সকালে আমি রাত্রিকে নিয়ে জোড়থাং অব্দি হাঁটার কথা ভাবতে থাকি, সেদিন সন্ধ্যা আব্জে ধরার কারণেই আমরা প্রায় ছুটতে ছুটতে উঠে এসে দেখেছিলাম জীপ নেই। চলে গেছে। আমরা দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকাই, হেসে ফেলি। হাঁটতে আরম্ভ করি দূরের জোড়থাং-এর দিকে, আলো জ্বলছে ওই তো!

আমি রাত্রির হাত ধরে নিই একসময়, আমাদের দু’জনেরই কিছু গান ছিল, কাজে লেগে যায়।

সেই রাতে আমি আর রাত্রি জোড়থাং-এ থেকে যাই, আলাদা ঘরে, আমাদের সত্যিই কোনো তাড়া ছিল না। কত সময় নিয়ে আমরা এক স্থানীয় রেস্তোঁরায় চীনে খাবার খেয়েছিলাম। হোটেলে এসে বিদায় নিয়েছিলাম গভীর চোখে তাকিয়ে, না চুমু খাইনি!

সোমবারিয়ায় কিছু একটা আছে, দুটো বাঁকে রাখা ছোট্ট জনপদ। এখানে সবাই গুনগুন করে, আজ সকালে দশটা নাগাদ এখানে পৌঁছেছি। রাত্রি স্থানীয় একটি মেয়ের কাছে ওর স্কুলের খোঁজ নিল নেমেই। আমি তখনো জীপের ভেতরে। একটু পরেই রাত্রি আমায় বললো, ভালো খবর আছে, স্কুলের পক্ষ থেকে এই মেয়েটির বাড়িতেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে... সেখানে আপনারও ঘরের ব্যবস্থা হয়ে যাবে...। আমি নেমে এলাম, লাগেজ নামতে হবে। সেই মেয়েটি গাড়ির ড্রাইভারকে বললো, আর একটু এগিয়ে যেতে... রাত্রি উঠে গেল... আমি আর সেই অনতি একুশ মেয়েটি হাঁটতে থাকলাম... মেরা নাম তিলমায়া... আপকা? বললাম... তিলমায়া হাসলো, আপ ক্যা বয়ফ্রেন্ড হ্যায় দিদিকা?... এবার আমি হাসলাম।

“দিল হি ছোটা সা, ছোটি সি আশা...”। আর একটি মেয়ে... মেরা বহেন লিলি... লিলি গুনগুনিয়েই হাসলো... তিলমায়া বললো, লিলি ঘর দিখা দেও দিদিকা... ইয়ে হমারে স্কুল কা নয়া ম্যাডামজী হ্যায়... আউর ইয়ে বলে হাসলো... লিলি কী বুঝলো কে জানে... গান বদলে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে, “প্যার হুয়া চুপকে সে...”

বিকেলে হঠাতই বৃষ্টি হয়ে গেল। থামার পরে আমরা বেরিয়ে এলাম, তিলমায়া দরজার কাছে ছিল। বললো, ক্যায়া দিদি ঘুমনে? রাত্রি হেসে মাথা নাড়লো, আমি ভেবেছিলাম তিলমায়াও গেয়ে উঠবে... গাইলো না, কিন্তু হাসিতে কী ভাবে যেন কিছু গান এরা রেখে দেয়... আমরা বেরিয়ে এসে হাঁটতে আরম্ভ করলাম বাজারের দিকে...

সেদিন রাতে তিলমায়া আর লিলিদের তিনতলা বাড়ির দোতলার ঝুলবারান্দায় আমি রাত্রিকে চুমু খাই। তার আগে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে সেই শিহরটানা বাঁক এসেছিলো, কেউ ছিল না সেখানে, একটা বন্ধ দোকানঘরের চিলতে বারান্দা ছাড়া... বৃষ্টি আবার... আমরা দৌড়ে ওই বারান্দায় এসে দাঁড়াই... কথা বলতে থাকি... ঠাণ্ডা প্রবল হয়... কাঁপতে থাকা রাত্রিকে আমি আরো কাছে টেনে নিই... এবার শুধু নদী বা জলের আভাস নয়, আমি দেখি বৃষ্টি ওর শ্বাসাঘাতি শরীরে অকাতর হয়ে উঠছে, আমার ফেরারী প্রকৃতি যেন ঝরে পড়ার তাগিদেই এমন বৃষ্টিগন্ধা! রাত্রি আমার বুকের পাটা থেকে উঁকি মেরে বলে, তুমি আমি যা করছি এটাই তো ভালোবাসা... তোমার মধ্যে কী আছে জানি না... বাট আই এম ইন লভ উইথ ইউ...


আমি ওকে আরো কাছে টেনে নিই... রাত্রি অস্পষ্ট হয়ে বলে, আমি তোমায় ঠকাতে পারবো না... আমার লিউকোমিয়া আছে... বছরখানেক আগে আমার ভাইয়ের বোনম্যারো আমাকে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে... আই ডোন্নো হোয়েদার আই এম গোইং টু সারভাইভ অর নট... বাইরে বৃষ্টি আরো ছড়িয়ে পড়ে... আমি ওকে বলি, আমরা এখন বেঁচে আছি... কিন্তু দাঁড়িয়ে আছি কেন? চলো, বৃষ্টি ডাকছে যে!

আর রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি ওর দিকে গভীরভাবে তাকাই... কাছে টানি... চুমু খাই... ও বলে, তুমি কাল ভারসে যাচ্ছো... আমি পরশু যাবো... রবিবার... একসাথে দেখবো কাঞ্চনজঙ্ঘা।

আজ রাত্রি আসবে... একা নয়, একজন গাইড ওকে পৌঁছে দেবে... আসতে আসতে দেড়টা দুটো। আমি আকাশের দিকে তাকাই, রোদ উঠেছে, হাসছে সব কিছু...

--দাদা চিয়া!

চমকে উঠি। চা নিয়ে এসেছে ওয়েট্রেস... ল্যাপটপে টাইপ করা অক্ষরগুলো ঝাপসা দেখাচ্ছে... আমি চা নিয়ে হাসি... সিকিমি মেয়েরা এত হাসতে হাসতে চা দেয় কেন? মনে পড়লো আজ বিকেলে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছে সিকিমে... আমি ভারসে যাচ্ছিলাম... জোড়থাং-এ কাঁপুনি টের পেলাম ভালো মতোই... প্রথমে বুঝতে পারিনি... তারপর যা হয়... জীপ থেমে গেলো... দৌড়োদৌড়ি। ভাগ্যিস জোড়থাং পৌঁছে গিয়েছিলাম... এই হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে ভাবলাম লিখে ফেলি একটা গল্প, লেখার অনুরোধ আছে, ভালো পয়সাও দেবে... তো লিখছিলাম... এদের জেনারেটর থাকায় এবার টিভি চালিয়ে দিলাম খবর শোনার জন্য... এতো সাঙ্ঘাতিক... নর্থ সিকিম পুরো ধসে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে... মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে... চারিদিকে হাহাকার... কান্না... শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িও কাঁপছে... আমার অনেক পরিচিত প্রিয়জনেরা ওখানে থাকে, আর সিকিমের প্রত্যন্তে ছড়িয়ে রয়েছে আমার বন্ধুরা। মন খারাপ হয়ে গেলো... সিকিম আমার প্রিয় জায়গা... কতবার যে এসেছি...

--দাদা চিয়া’কা কাপ লে যাঁউ?

সেই মেয়েটি... ওর চোখ টিভির দিকে...

--ঘর কাহাঁ তুমহারা?

মেয়েটি চাপাস্বরে বললো, নর্থ সিক্কিম... তারপর চায়ের কাপ তুলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।

আমার তখনই মনে হলো, পৃথিবীতে কোনো গল্প নেই!

মনে হলো, গল্পের আগে ভাঙা টুকরো সব অপরিনতিগুলো পড়ে আছে, গল্পের উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই আর।

মেয়েটা এই অবস্থাতেও হাসার চেষ্টা করলো... আমি জানি না কী ভাবে... তবে আমি জানি ল্যাপটপের ডিলিট বাটন’টা কোথায়...

শোওয়ার আগে বাটন প্রেস করে ডিলিট করে দিলাম গল্পটা...

০৮) প্রদীপ চক্রবর্তী


মশক-রা


মশককুলের সহিত আমার সম্পর্ক জন্মাবধি। মানে, আমার জন্মাবধি। এই দীর্ঘ সহাবস্থানের কারণে উহাদের সহিত আমার একপ্রকার সখ্যতা স্থাপিত হইয়াছে, যাহা আমি আমার অত্যন্ত নিকটজনদিগকেও বুঝাইতে ব্যর্থ হইয়াছি। সে যাহাই হউক, এইরূপ বহু ব্যর্থতার বোঝা বুকে বহিয়া বাঙালি বড় হয়, বুড়া হয়। ব্যর্থতার ব্যথাটি থাকিয়া যায় acidityর মতো।

আমার স্ত্রী ধর্মভীরু এবং প্রভূত মায়া-মমতার অধিকারিণী। কিন্তু মশককুলের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র মমত্ববোধ নাই। দেখিলেই ক্ষেপিয়া যান। এবং উহাদের হত্যা করিতে উদ্যত হন। তখন তাঁহার সুন্দর মুখখানি যে কোনো খুনির খোমার ন্যায় প্রতিভাত হয়। মশককুলের প্রতি আমার আশকারা তাঁহাকে আরও ক্ষিপ্ত করিয়া তোলে। এবং তুমুল চিৎকার করিয়া মশক নিধনে উদ্যত হন। তাঁহার যুদ্ধ ভেরির এই আওয়াজ মশককুল শুনিতে পায় কিনা তাহা প্রাণীবিজ্ঞানীদের বিচার্য বিষয়, কিন্তু আমার প্রতিবেশীগণকে যে তাঁহাদের জানালায় সকৌতুহল আসিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য করে তাহা আমি স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়াছি।

যুদ্ধের বিবরণ দিবার পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রটির বর্ণনা আবশ্যিক। আমি জানালার দিকে পিছন করিয়া আমার প্রিয় খাটটিতে আসীন। সম্মুখবর্তী দেওয়ালে টিভির পর্দায় কুটকচালি দেখিতে মগ্ন আমি, আর মশককুল তাহাদের কর্মে। অর্থাৎ, আমার রক্তপানে। টিভির হাই ডেসিবেল তর্কাতর্কি সত্বেও মশককুলের পানোন্মত্ত কোরাস শুনিতে অসুবিধা হইতেছে না। উহাদের হুল আমার কাছে এতকালের অভ্যাসে সুড়সুড়ির ন্যায় মোলায়েম ও উপভোগ্য বোধ হয়। ইহাতে আরও একটি সুবিধা এই হইয়াছে যে, নিয়মিত সুগার টেস্টের জন্য যিনি রক্ত সংগ্রহের জন্য আসিয়া থাকেন, তাঁহার কর্মটি খুবই সহজ ও মসৃণ হইয়া গিয়াছে। ত্বকের উপর অসংখ্য ছিদ্র (মশক কুলের সৌজন্যে, বলা বাহুল্য) থাকায় সূচ ফুটাইবার প্রায় প্রয়োজনই হইতেছে না। যে কোনো একটি ছিদ্রের উপর তাঁহার টিউবটি চাপিয়া ধরিলেই ঝরনা ধারার মতো রক্ত বাহির হইতেছে। যুদ্ধের কথায় ফিরিয়া আসি।



রন্ধনকার্য শেষ না হওয়া অবধি পাকশালা হইতে আমার উদ্দেশে ব্রাহ্মণীর চিৎকার শুনিতে পাই, “হাত-পা নাড়াইতে থাকো, ধ্যানস্থ হইয়া বসিয়া থাকিও না, ডেঙ্গু হইয়া মরিবে”। আদেশানুসার হাত নাড়াইয়া সস্নেহে আলতো করিয়া উহাদের উড়াইয়া দিই। আমার স্নেহময় ভঙ্গি দেখিয়া গৃহিণী আরও ক্ষিপ্ত হইয়া উঠেন। সামান্য মশা মারিবার ক্ষমতাও নাই বলিয়া হাত মুছিতে মুছিতে আসিয়া আমার মুখোমুখি বসেন। এক্কেবারে নড়িবে না, চাপা হুঙ্কার। তীক্ষ্ণ চক্ষুতে মশাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছেন এবং সুযোগ বুঝিয়া হাত চালাইতেছেন। তাঁহার হাত লক্ষ্যবস্তুতে যত না আঘাত করিতেছে, উহার শতগুণ আঘাত আমার শরীরের বিভিন্ন স্হানে নামিয়া আসিতেছে। কিন্তু নড়িবার উপায় নাই। “একদম নড়িবে না, স্হির বসিয়া থাকিবে”। আমার এহেন পরিস্থিতিতেও এই ভাবিয়া অবাক হইতেছিলাম যে, মশা মারিতে এত জোরে চড় মারা কি জরুরি? ইহা তো মশা মারিতে কামান দাগা! অকস্মাৎ এই কুচুটে ব্রাহ্মণের মস্তিষ্কে প্রশ্ন জাগিলো - স্ত্রীর ঐরুপ সহিংস আক্রমণের আসল লক্ষ্য কে বা কাহারা?
উত্তর পাইতে বিলম্ব হয় নাই।

মর্নিংওয়াক হইতে ফিরিবার সময় বান্ধব সমিতির ক্ষুদ্র মাঠটিতে বসিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম লই। সেইদিন নীরেনবাবুও আসিয়া পাশে বসিলেন। নিকটতম প্রতিবেশী হইলেও ঘনিষ্ঠতা ছিলো না। কেমন আছেন, কি গরমটাই না পড়িয়াছে জাতীয় খেজুরি আলাপেই সীমিত ছিলো সম্পর্ক। বরং আমার স্ত্রীর সহিত নীরেন-স্ত্রীর সম্পর্ক গাঢ়তর ছিলো। একেবারে গায়ে পড়িয়া আসিয়া কথা বলায় কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ হইলো।


রাজনৈতিক ও আবহাওয়া বিষয়ক কথা হইলো। শুনিলাম। শুনিবার ভাণ করিলাম। একাকীত্ব খুঁজিতে ছিলাম। কী বিপদ!
ইহা আপনি ঠিক করিতেছেন না -
কী করিলাম? বিমূঢ়তা কাটাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম।
প্লীজ ডোণ্ট মাইন্ড, মদ্যপান আমরাও করিয়া থাকি, কিন্তু আপনার মতো পেঁচো মাতাল হইতে কাহাকেও দেখি নাই।
শুনিয়া আমার বাক্‌রোধ হইয়া গেলো।
বৌদির মতো নরমসরম মানুষ, মধ্যরাত্রে, আপনার জ্ঞান ফিরাইবার জন্য শেষপর্যন্ত অবিরাম চড় বর্ষণ করিয়া গেলেন, তখনও আপনি নট নড়নচড়ন! কী পরিমাণ মদ্যপান... আপনি আমার শ্রদ্ধেয়...
আমার কর্ণকুহরে কিছুই ঢুকিতেছে না। এইক্ষণে আমি বোধহয় সত্যই জ্ঞান হারাইতেছি।

মধুর সঙ্গীত ভাসিয়া আসিল। দূর হইতে নিকটতর। আমার চেতনা ফিরিলো। উহারা আসিতেছে। মাঠটিতে ঝোপঝাড় বিদ্যমান। আমার গন্ধে আকৃষ্ট হইয়া আসিতেছে। একটি দুটি করিয়া। শরীরের অনাবৃত অংশ কৃষ্ণবর্ণের ডট চিহ্নে ভরিয়া যাইতেছে। আইস, আইস, বাছা সকল!

০৯) নন্দিতা ভট্টাচার্য


ডিজিটাল রেশনকার্ড



কদিন থেকেই বাসন্তী বলছিল, দিদি দোকানে কিন্তু বারবার তোমাদের যেতে বলছে। কী সব নাকি নতুন কার্ড দেবে, তার জন্যে তোমাদের অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবে। আর আমাকে দিয়ে হবে না। তোমাদের গিয়ে দেখা করতে বল্‌ছে। এই নাও ফোন নম্বর দিয়েছে, যা জিজ্ঞেস করার করে নিও।

--মর্‌ জ্বালা, এই তো কদিন আগে আঁধার কার্ডের জন্যে সমস্ত ঠিকুজি কুলুজি পাসপোর্টের মতো হাতের ছাপ ছবি, সব কিছু দিয়ে এলাম। দু’দিন পর পর বায়নাক্কা। মানুষের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি? কত পরিচিতি দরকার বাপু – রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, আঁধার কার্ড, ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট -- তা যারা যা করার করেই যাচ্ছে, ধরতে পাচ্ছিস কোথায়? যত হুজ্জোতি আমাদের ওপর। নাও আবার ছুটি নাও একদিন। এমনিতেই তো ছুটির দফারফা। সব ঝুট ঝামেলাতে তোমাকেই ছুটি নিতে হবে। আমার তো আবার একা বোকার সংসার। দশ মিনিটের ব্যাঙ্কের কাজের জন্যে চল্লিশ কিলোমিটার ঠেঙিয়ে যাওয়ার তো উপায় থাকে না। গজ গজ করতে করতে স্কুলে বেরোলো সোহিনী।

কদিন থেকেই চলছিল ঠাণ্ডা-গরমের উৎপাত। সরস্বতী পুজোর পরদিন থেকেই শীত উধাও। গত দুটো বছর কোনোমতে শীতের একটু আছর ছিল। এবার সেটাও নেই। শীত ও সাইনাস পাশাপাশি। শীত হাজির হলে উনিও হাজির। সেই সুবাদে একদিন ছুটি নেওয়া, সঙ্গে রেশন কার্ডের দোকানে হাজিরা দেওয়া, একঢিলে দুই পাখি আর কী! খবর নিয়ে দেখল, কার্ড নাকি ডিজিটাল হবে তারই তোড়জোড় চলছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি ছুটল সোহিনী। পাশাপাশি রেশন দোকানে আর ৮৯৮ ও ৮৯৯, একটি রাস্তার ওপরে আর একটি ভেতরে। সোহিনীর কার্ড ভেতরের ঘুপচিতে। ইতিমধ্যে অনেকে এসে হাজির হয়েছে। প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন। নিজেরাই সিরিয়েলি নাম লিখে রাখছে। দোকানের কর্মীরা তখন এসে উপস্থিত হন নি। এই ন’কোটির রাজ্যে শৃঙ্খলা নেই বলা যাবে না। চট করে লাইন করে কোনো কাজ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে করে ফেলায় জুড়ি নেই এ রাজ্যের মানুষের, আর কোনো রাজ্যে এমন আছে কি না সন্দেহ! সে অটোর লাইনই হোক বা সিনেমার লাইন বা অন্য কিছু। বাজারের মধ্যে রাস্তার ওপরে দোতলা বাড়ি। ব্যারাকের মতো। বেশ পুরনো। তার দুটো তলা জুড়েই রয়েছে দোকান ও গুদাম। নিচতলায় খোপ খোপ আট-দশখানা দোকান। তার মধ্যে কাপড়ের দোকান থেকে ঘরকন্নার সাজ সরঞ্জামের দোকান পর্যন্ত রয়েছে। তার মধ্যে রেশন দোকানগুলো। ভেতরের দিককার দোকান সোহিনীর। বাসন্তী বলেছিল – তোমদের বাপ ঠাকুরদার নাম-টাম জিজ্ঞেস করবে কিন্তু, ভালো করে লিখে নিয়ে যাও। --কেন রে পূর্বপুরুষদের বচ্ছরকার জল দেওয়াবে নাকি, তর্পণ?--বলল সোহিনী। --তোমাকে নিয়ে আর পারি না বাপু, বলতে বলতে হাঁটা দিল বাসন্তী।


ইতিমধ্যে নাম ধরে ধরে লাইন করানো শুরু হয়েছে। দোকানের কর্মীরা এসে পৌঁছেছে। কার্ড সিরিয়াল নম্বরও লেখা হচ্ছে। দু’ধরনের সিরিয়াল করায় লেগে গেল ধুন্ধুমার। একজন আগের সিরিয়ালে লোক দাঁড় করাচ্ছে, আর একজন কার্ড অনুযায়ী। হঠাৎ কোথা থেকে একটি ছেলে এসে বলল, আবার কিসের লাইন? কার্ড অনুযায়ী কেন হবে? আমরা তো নাম লিখিয়েছি। এই মারে কি সেই মারে। লেগে গেল কথার যুদ্ধ।

-- জানিস আমি কে? কার সঙ্গে কথা বলছিস? দু’ভাগ করে রেখে দেব। এক হাঁক দিলে হাজার লোক এসে জড় হবে। দেখবি? প্রাণ নিয়ে এখান থেকে বেরতে পারবি না। যিনি পরে এলেন, একদা নাম লিখিয়ে গেছিলেন। --কাকে কি বলছিস রে হাঁদা! জানিস আমি কে? চিরে রেখে দেব। যে ছেলেটি এতক্ষণ খুব সুষ্ঠুভাবে নাম ধাম লিখছিল সে বলল। মাই গড! এরা কারা, ভাবছিল সোহিনী। কোথা থেকে মেহেন্দি করা দাড়ি একজন এলেন, বেশ দাদা গোছের। সবাই প্রমাদ গুনল। যাক গে। আস্তে আস্তে তিনি আর লাইনে যারা ছিল সবাই মিলে সামাল দিল। সোহিনী আরও কয়েকজন মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব জুড়ে দিল। বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের। সকলেই কাজ কর্ম ছেড়ে এসেছে। আর বাপান্ত করছে। কারণ কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল আটটায়, শুরু হতে হতে প্রায় দশটা হয়েছে। এতেই সকলের ধৈর্য থাকছে না। সবাই ভেবেছিল, তাড়াতাড়ি এসে ফিরে গিয়ে কাজকর্মে যাবে। ওদের বেশির ভাগই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। অথচ একটু সময়মতো শুরু করলেই কিন্তু হতো। বেশি লোকজন তো নয়! এদের মধ্যে একজন মহিলা, মৌসুমি নাম, সে তো দেখা গেল এই দোকানের মালিকের হাঁড়ির খবর সবই জানে। সে তথ্য সরবরাহ করতে লেগে গেল। --যান তো, এই বাড়িটার মালিকেরই তো এই রেশন দোকান। কত দোকান আছে এদের। এদের মানে? --সোহিনী জিজ্ঞেস করল। ওরা চার পাঁচ ভাই। সবাই এক একটা রেশন দোকানের মালিক। এক এক জনের একাধিক রেশন দোকান। কোটিপতি হয়ে গেছে এরা। পড়াশোনা তো তেমন নেই, কিন্তু টাকা দেখ গে! আমার যেখানে থাকি মানে জগতপুরে, ওদের আট দশখানা দোকান। আর এখানে কি লাইন পড়েছে? এটা তো চুনোপুঁটি। ওখানে চারপাঁচ হাজার লোকের লাইন। কী করে রেশন দোকানের মালিকের এত টাকা হয়, কে জানে! শুনেছিল অবশ্য সোহিনী, রেশন দোকান নিয়ে কী সব স্কাম। সে তো চার পাঁচ বছর আগে। এর মধ্যে বেশ সুন্দরী এক মহিলা এসে দাঁড়ালেন গুটি গুটি সোহিনীদের কথাবার্তার মাঝে। সালোয়ার কামিজ পরা। কপাল ছ’আঙুলে। গমের মতো রঙ। তেমন কোনো সাজগোজ নেই। ছোট চুল, বেশ উঁচু করে পনি বাঁধা। বলেন কম, শোনেন বেশি। মৌসুমি কথা বলে যাচ্ছিল ঝর ঝর করে। জিনিসের দাম। কোনো কিছুই বদলায় না। ইত্যাদি রোজকার কথা বার্তার মতো। সবাই যেমন বলে আর কী!


কিন্তু তখন থেকে ও যেন কিছু বলতে চাইছিল। --আর জা্নো তো, চারদিকে কি অবস্থা! আমাদের পাড়ার দুটো ছেলেকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। ওর চোখ ছলছল করে উঠল। --কেন, কী করেছে তারা? --কিছু করেনি গো দিদি। আরে চুল্লু আছে না, চুল্লু! তার একটি কারখানা খুলেছে একেবারে পাড়ার মধ্যে। আমরা গন্ধে একদম থাকতে পারি না গো। বমি উলটে আসে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপিলেরা রয়েছে পাড়ায়। ভয় করে না! মাঝরাত পর্যন্ত কী হুল্লোড়! পাড়ার উঠতি বয়েসি ছেলেপিলেরা কেউ কেউ ওখানে হানা দিচ্ছে শোনা যায়। সবাই খুব ব্যতিব্যস্ত। তাই তো পাড়ার দুটো ছেলে আর আমার ছেলে মিলে বলতে গেছিল। ওই ছেলেগুলোর বয়েস এই উনিশ কুড়ি হবে। ওরা তো বোঝেনি গো এদের কত খ্যেমতা। পুলিশকে পয়সা খাইয়ে বশ করেছে। ছেলেগুলকে ধরে নিয়ে গেছে। আমারটি ছোট, তাই বেঁচেছে। পাঠিয়ে দিয়েছি বোনের কাছে। কিন্তু ওকে দেখে কিন্তু মনে হয়নি সোহিনীর যে, ও খুব শান্তিতে আছে। মেয়েটির ভেতরের দীর্ঘশ্বাস ও শুনতে পাচ্ছিল। সেই ভদ্রমহিলাও কান খাড়া করে শুনছিলেন। সোহিনী ওকে ইশারা করে থামতে বলল। চেনা নেই জানা নেই, কোনো বিপদ এসে হাজির হবে। সরল মেয়েটি যে কত নিরুপায়! বলল, দিনকাল ভালো নয়, থাক্‌ এসব কথা। --না গো ছেলেদুটোকে খুব পেটাচ্ছে। হাত পা নুলো করে দিয়েছে। ওর মা খুব সাদা মানুষ, কিচ্ছু বোঝে না। চেন নাকি কাউকে? একটু সাহায্য করতে পারবে তেমন কেউ? সোহিনী আর কাকেই বা চেনে! ওকেই বা কেন বলছে এত কথা! চারপাশ তাকিয়ে দেখল, কেউ শুনছে কি না। হঠাৎ সেই ভদ্রমহিলা একটি কাগজের টুকরোয় ফস ফস করে কী লিখে ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন। সোহিনী লেখাটা দেখতে পেল না। কাগজটা দিয়েই হন হন করে বেরিয়ে গেলেন। পেছন ডেকে বলল মৌসুমি, আপনি নাম লেখালেন না?

সোহিনীর রেশন কার্ডটা পুরনো হয়ে যাওয়ায় পুরোটা সেলোটেপ মারা ছিল। সেটা নিয়েও শুরু হলো সমস্যা। ওখানে কার্ড-এ ছাপ দেবে, তাই সেলোটেপ খুলতে হবে। টানা হেঁচড়া করতে লাগল সোহিনী। কি জ্বালা! কখন যে কি আপদ এসে উদয় হয়! দোকানের যে কর্মচারীটি রেশন কার্ডের সিরিয়াল লিখছিল, সে বলল, দিদি আমি ঠিক লোকের কাছে পাঠিয়ে দেব, চিন্তা নেই। ভেতরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে কাজ করছে। সে সোহিনীকে মেয়েটির কাছে পাঠা্লো এবং নির্বিঘ্নে কাজ হয়ে গেলো। সোহিনী যাওয়ার জন্যে উদ্যোগ নিতেই উঁচু গলায় আদেশের সুর শুনলো, আমাকে কুড়িটা টাকা দিয়ে যাবেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, দোকানের সেই ছেলেটি, যে বলেছিল সব ঠিক করে দেবে। কোনো কথা না বলে ওকে বলল, বাইরে এসো। ওর হাতে কুড়িটা টাকা গুঁজে দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে এলো সোহিনী। না হলে হয়তো রেশন কার্ডটাই হাপিস হয়ে যাবে।

ওর চোখের সামনে ছোট্ট সাদা কাগজ ভেসে উঠল, কী লেখা ছিল কে জানে! দরকার তো সবার...। বাইরে বেরিয়ে আসছে, তখন শুনতে পেল ভেতর থেকে ডাকছে, মৌসুমি হালদার! মৌসুমি হালদার!

ডিজিটাল হওয়ার জন্যে মৌসুমি ঘরে ঢুকল।