লোকজ সংস্কার ও ভগীরথ মিশ্র’র ‘আড়কাঠি’
সচেতন ভাবে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি বাঙালীর অনুরাগ, বিশেষত বিংশ শতাব্দীকেই বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রারম্ভিক পর্ব বলা যেতে পারে। এই পর্বে বাংলা কথা সাহিত্যে লৌকিক উপাদান প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাড়তি সচেতনতা নেই। জীবনের স্বাভাবিক রূপকে ধরতে গিয়ে যতটা পরিমাণ আসা স্বাভাবিক, ততটাই এসেছে লোকঐতিহ্য। পরবর্তী কালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে লোকঐতিহ্য সচেতন ভাবেই উঠে এসেছে। উত্তর-বন্দ্যোপাধ্যায় কালে এই দৃষ্টিভঙ্গি আরো বেশি প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে।
জন্ম সুবাদে ভগীরথ মিশ্র অজ পাড়াগাঁয়ের মানুষ। যে স্কুলে তিনি পড়তেন, তার পাশেই ছিল শাল-অরণ্য স্থিত লোধা শবর পল্লী। গাঁয়ের তিন দিকে ছিল শবর ও কোড়া উপজাতির মানুষ। সরকারী চাকরি করার সময় তাঁর জীবনের বারো আনা কেটে গিয়েছে গ্রামাঞ্চলে। চাকরির ফাঁকে চারপাশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে ঘটেছে অবাধ বিচরণ। পুরুলিয়ার ছৌনাচের দলের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা হয়েছে। এর ফলে তিনি উপলদ্ধি করেছেন, লোক সংস্কৃতির সুবর্ণ ধ্বজাধারী এই মানুষগুলো আজীবনকাল কত বঞ্চিত। শহরের সংস্কৃতিকর্মীরা তাদের মাথার ওপর পা রেখে নিজেদের প্রকট ভাবে দৃশ্যমান করে তুলেছেন। এই সব কিছু নিয়েই লেখা তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আড়কাঠি’।
ভগীরথ মিশ্রের ‘আড়কাঠি’ উপন্যাসে আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে দুটি উপাদানের সন্ধান পাই। প্রথমত জনসমাজের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা একটি প্রাচীন উপজাতির জীবন কাহিনী ও সাংস্কৃতিক সম্পদ; দ্বিতীয়ত আড়কাঠির কার্যকলাপ। এই দুটি উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ আড়কাঠিদের হাতেই এই গরীব, বুভুক্ষু মানুষগুলির নিয়তি অনিবার্য ভাবেই নির্দিষ্ট হয়। এই দুটি উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অনিবার্য পরিণতির দিকটি আলোচনা করা যাক।
যে অঞ্চলটির কথা এই উপন্যাসে পাওয়া যায়, সেই জায়গাতে পৌঁছনো একটু দুষ্কর। বাঁকুড়া শহরের রাণীবাঁধ দিয়ে ঢুকলে সোজা দক্ষিণে বন-জঙ্গল, খুলিয়া-খোঁদল, ডিহি-ডুংরী ধরে হাঁটলে একে একে পড়বে কাটিআম, মৌলা, জামবেড়িয়া, মিঠাআমের জঙ্গল। বাঘমুড়ি, মইষমুড়া পেরিয়ে সে পথ বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের সীমান্তে গিয়ে মিশেছে। সেই পথ ধরে দু-তিন ঘণ্টা হাঁটলেই জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যাবে গজাশিমূল গ্রাম। এই গ্রামের প্রাচীন উপজাতি হলো বসু শবর জাতি। তাদের মতে, তারা সকলের চেয়ে উচ্চ-বর্ণ। বিহারের তামজোড়েও এই জাতি আছে। আসলে তারা পাহাড়িয়া জাতি।
কোনো এক কালে ভুঁইহার-জমিদারদের তাড়া খেয়ে এদের কোনো পূর্বপুরুষ এসে এই গজাশিমূল গাঁয়ে বসবাস করেছিল। প্রচুর শিমূল গাছ ছিল বলে গাঁয়ের এহেন নামকরণ। তারা চাষ করতে জানে না। জঙ্গলই তাদের কাছে বাবা মায়ের সমান। সারাদিন জঙ্গলে শিকার করে। গুঁড়চা-সাট্না ধরে। মৌচাক ভাঙে। ফল পাড়ে, কন্দ-মূল খোঁড়ে। এই সবই তাদের খাদ্য। শাল কাঠের ‘ইশ’ বানায়, গরুর গাড়ির লাঙল, খাটিয়ার পায়া – এই সমস্ত লোকালয়ে বিক্রী করে উপার্জন করে। ছোট ছোট দল জঙ্গলে জঙ্গলে অনেক দূর চলে যায়। দু-দশ দিন এক টানা হাঁটে। ক্ষিদে পেলে গাছের ফল খায়। তেষ্টা পেলে ঝর্ণার জল খায়। গাছের মাথায় চড়ে রাত্তিরে ঘুমোয়।
এহেন একটি প্রাচীন উপজাতির সন্ধান পায় রাজীব, যে বাঁকুড়া কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক। সুনীল তার কলেজের ছাত্র। এই সুনীলই তাকে গজাশিমূলের সন্ধান দেয়। কারণ সুনীল চিরুড়ি স্কুলে সুচাঁদ ভক্তার সঙ্গে পড়ত। রাজীব তাদের লোকজীবন লোকনৃত্যকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে।
ভদ্র লোকেদের ওরা বলে ‘কাঁকড়া’। তাদের বিচিত্র দেব দেবী। বিচিত্র তাদের আরাধনা পদ্ধতি। ফাল্গুন মাসে যখন ঘরে ঘরে ‘মায়ের দয়া’ হয়, তখন তিন রাত নাচ গানের মাধ্যমে ‘নিশি উজাগর’ করে ওরা। পুজোর সঙ্গে ‘নিশি উজাগর’ করলে দেবতা নাকি তুষ্ট হন। প্রথম রাতে হয় শীতলা-বন্দনা। বিচিত্র সুরে গান, বন্য তালে বাজনা, নিজেরাই শীতলা সাজে। কেউ সাজে বাহন গর্দভ, এমন কী রোগ জীবাণুও সাজে কেউ কেউ। নাচ গানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় রোগের ভয়াবহতা।
দ্বিতীয় রাতে হয় ‘শিকার লাচ’। তাদের জীবিকা শিকার করা। জীবিকার পরিণতি হয় উৎসবে। সেই শিকার করার আলাদা উদ্দীপনা থাকে। আনন্দে তারা মেতে ওঠে। নাচে, গায়, ঘর থেকে বেরোবার সময় প্রিয়জনেরা ফরমাশ করে – ‘সব থেকে বড় সাট্নাটি আমার জন্য এনো’। শিকার পর্ব নিয়ে চলে চার ঘণ্টার নৃত্য। ‘চাঙ লাচ’ হয় তৃতীয় দিনে। এক বিশেষ ধরনের গানের সঙ্গে সমবেত নাচ। সঙ্গে বাজনা কেবল চাং আর মাদোল। এর ভাষা স্বতন্ত্র, সুর মৌলিক, নাচগুলোর আঙ্গিকও চেনা ছকের বাইরে। এগুলো তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐশ্বর্য। এছাড়াও আছে বিহা গীত, পরবের গান, আষাঢ়িয়া গান প্রভৃতি।
এই প্রাচীন সংস্কৃতিকে রাজীব প্রচারের আলোয় আনতে চাইলে দশরথ ভক্তা বিলাপ করে। বত্রিশ ঘর বসু-শবরের জাতকে নিজেদের জীবন ধারণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে চায় সে। দশরথ ভক্তা রাজীবকে জানায় যে, তাদের খাদ্যের অভাব নেই। ফল-ফুলারি, ভ্যাঁচ-কেঁদু, ভেলাই-ভুঁড়ুর, কাঁটা-আলু, চুরকা–আলু, পান-আলু, রাখাল-কুদরী, বন কাঁকড়ো -- সে সব এনে তাদের খেতে হয়। জঙ্গলে বড় শিকার, খরগোশ, গুঁড়চা, মালো, খটাস, বন-মুরগী, তিতির, কোয়ের গুঁড়ুর, ঢ্যামনা সাপ, সাট্না, সে সব মেরে খাওয়া চলে। ঢ্যামনা সাপের ছালের অনেক দাম। সাট্নার ছালেরও অনেক দাম। সাট্নার ছাল পুড়িয়ে রাণীবাঁধ কিংবা ফুলকুসমার হাটে বেচে উপার্জন করা যায়। গাছে গাছে ঠেলু আছে। অনেক লোক মিলে তীর কিংবা গুলতি, পাথর, রড ছুঁড়ে তাকে মারতে হয়। এক সময় কাহিল হয়ে পড়লে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। তখন সবাই মিলে তাকে লাঠিপেটা করে মেরে তার মাংস খায়। চামড়া দিয়ে ‘চাং’ছায় তারা।
এছাড়াও অর্বাচীন কালের হাজা-মজা বাঁধের ঠান্ডা থলথলে পুরনো পাঁকের তলায় কালো কুচকুচে কটুর (কচ্ছপ) দল বাস করে। আলের ধারে ধারে বড় বড় ইঁদুর বাস করে, তাদেরকে মেরেও তারা খায়। হরিতকি, বহেড়া, কঁচড়ার বীজ কুড়িয়ে, জঙ্গলের কাঠ কেটে লাঙল বানিয়ে হাটে বিক্রী করে অর্থ উপার্জন করে জীবন নির্বাহ করে।
পরবর্তী ক্ষেত্রে রাজীবের নেতৃত্বে এই সমস্ত ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন লোকনৃত্য দেখাতে যখন তারা রাজী হয় এবং বিভিন্ন শহরে তাদের এই লোকনৃত্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তখন তারা দু’হাত ভরে উপার্জন করে গ্রামে ফিরে আসে। এই আনন্দে কাস্তো মল্লিক, সুচাঁদ ভক্তাকে ‘কানাইশরজীউ’র পুজো করতে বলে। তিনি এই গোষ্ঠীর সব থেকে প্রাচীন দেবতা। গজাশিমূল থেকে দু’দিনের পথ হাঁটলে বেলপাহাড়ী। তার দক্ষিণে একজোড়া পাহাড়। পাহাড়ের গায়েই কেন্দাপাড়া গ্রাম। সেখান থেকে কিছুটা হাঁটলেই কানাইশর পাহাড়। সেখানেই বাবা কানাইশরজীউর অবস্থান। সিঁদুরে চর্চিত শিলারূপী লীলাময়। চারপাশে হাতি ঘোড়ার স্তূপ।
কাস্তো মল্লিক বর্ণিত এই দেবতার কিংবদন্তী অনেকটা এইরকম -- আষাঢ়ের তৃতীয় শনিবার খুব জমজমাট করে কানাইশরজীউর পুজো হয়। বহু মানুষের মনস্কামনা তিনি পূর্ণ করেছেন। পাহাড়ের গুহায়, জঙ্গলে বাবার অসংখ্য ভক্ত ঘুরে বেড়ায়। বাবার ভক্তদের তারা কোনোরূপ উপদ্রব করে না। ভক্তকে ভয় দেখানোর জন্য জনহীন জঙ্গলে ‘আগুন বরণের’ বেশে তিনি হাজির হন। কাস্তো মল্লিক জীবনে একবার তাঁকে দর্শন করেছে। তার মতে, তিনি একেবারে জাত ব্যাঘ্র, জ্বলন্ত অগ্নির মতো তাঁর বর্ণ। কানাইশরজীউর থানে মেয়েদের যাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। যে যাবে তার বছর ঘুরবে না, ওলাওঠা অথবা আগুনবরণের হাতে মৃত্যু হবে তার। ঠাকুরের মূর্তির তলায় এক বিশাল সাপ বাস করে। ঠাকুরের হুকুমে সে নড়ে চড়ে। শিলাটাকেও নড়িয়ে দিতে পারে সে।
এই সমস্ত কাজে রাজীবকে সাহায্য করে ‘ইস্ট ওয়েস্ট ফোক ফাউন্ডেশন’এর পূর্ব ভারতীয় শাখার ডিরেক্টর ‘দ্য ফোক’ পত্রিকার সর্বভারতীয় সম্পাদক মিস ক্যাথিবার্ড। তার সঙ্গে আসে মিঃ জনসন। তাদের কাজ, এই অঞ্চলের টুসু, ভাদু, ঝুমুর, পাতানাচ, কাঠিনাচ প্রভৃতি হারিয়ে যাওয়া ফোকলোরগুলোকে খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করা, এবং যারা সেই ফোকগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের আইডেন্টিফাই করা। তাছাড়া উপযুক্ত ‘এইড’ দিয়ে তাদের ফোকগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা।
অন্যদিকে টাকা, মেডেল, প্রতিপত্তি, সম্মান প্রভৃতি যখন রাজীব সহ সুচাঁদ-রঙীদের অভ্যেসে পরিণত হয়, তখন কোনো ভাবেই সেটাকে হাতছাড়া করতে চায় না তারা। এর জন্য যে কোনো মূল্য দিতে তারা প্রস্তুত হয়। টাকার কাছে তাদের একান্ত নিজস্ব গূহ্য সম্পদ বিকিয়ে যায় - জলকেলি নাচ। সে নাচ তাদের কৌলিক নাচ। সে বড় শুদ্ধ, বড় গূহ্য বস্তু। সে নাচ কেবল কানাইশরের সামনেই দেখানো নিয়ম।
কাস্তো মল্লিক এই জলকেলি নাচের উৎপত্তির ইতিহাস বর্ণনা করে। বসু-শবর জাতের মূল বসতি ছিল তামাজোড় গাঁয়ে। সুবর্ণরেখা নদী ও পাহাড় দ্বারা ঘেরা সেই গ্রামে একবার জন্ম নিয়েছিল স্বয়ং ব্রজরাজ কানাই। এরপর কাস্তো মল্লিকের বর্ণনার সাদৃশ্যে আমরা বৃন্দাবনে কৃষ্ণ ও গোপীদের বস্ত্রহরণ খণ্ডের কথা স্মরণ করতে পারি। যমুনা এখানে সুবর্ণরেখা নদী হয়ে গেছে। কদম গাছ রূপান্তরিত হয়েছে মৌউল গাছে। বৃন্দাবনের গোপিনী এখানে কলঙ্কিনী শবর কন্যা। শবররা কানাইকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে সকলে মিলে প্রচন্ড মারধোর করে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। সেই বছরই তামাজোড় গাঁয়ে নিদারুণ খরা হয়। সুবর্ণরেখা নদী শুকিয়ে যায়। গাছে পাতা ফল কিছুই থাকে না। প্রচুর মানুষ এতে মারা যায়। এইসময় কাস্তো মল্লিকের ঠাকুরদাকে স্বপ্নে ব্রজরাজ কানাই এই খরার কারণ জানায় এবং সুবর্ণরেখা নদীর মউল গাছের তলায় তাঁর পুজো করার কথা জানায়। যদি যুবতীরা জলকেলি নাচ করে আরাধনা করে, তবে ব্রজরাজের শান্তি হবে, বর্ষা হবে, আর ঐ যুবতীরা মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবে।
সাতদিন পর ব্রজরাজ কানাই আবার স্বপ্নে জানায় যে, তিনি তাদের ঘরে কানাই শবর হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। এখন তাঁর বাস পাহাড়ে। তাঁর নতুন নাম কানাইশরজীউ। আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে তাঁকে পুজো করার কথাও জানায়। সেই থেকে সেই রাতে নদীর পাড়ে মেয়েরা জলকেলি নৃত্য করে। সেই নাচের অনেক নিয়ম। গানের ভাষা দৈব ভাষা। সে গানের সুর বেঁধেছিলেন স্বয়ং ব্রজরাজ। এটাই কিংবদন্তী। সুদূর বৃন্দাবনের কাহিনী এত দূরে একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এভাবেই সংস্কৃতি নিরন্তর চলমান খরস্রোতা নদীর মতো।
রাজীবকে এই জনগোষ্ঠী একান্ত আপন মনে করে। তাই তার কাছে দশরথ ভক্তা ব্যাখ্যা করে জলকেলি নাচের স্বরূপ -- আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে গভীর রাতে বহু উপচারে ব্রজরাজের পুজো হয়। পুজোর শেষে সব পুরুষ ওখান থেকে চলে আসে। নদীর পাড়ে থাকে শুধু যুবতী মেয়েরা। তারা নাচতে শুরু করে ব্রজরাজের সম্মুখে। নাচতে নাচতে এক-একটি বস্ত্র ত্যাগ করে। এক সময় পুরোপুরি বস্ত্রহীন হয়ে যায় তারা। ঐ সময় গান ও নাচের অনেক মুদ্রা দেখা যায়। সারা রাত্রি ধরেই সেই নাচ-গান হয়। মেয়েরা ছাড়া কাকপক্ষীতেও সে নাচ দেখতে পায় না, শুনতেও পায় না। শুধু ব্রজরাজই সেই নাচ-গান আস্বাদন করেন। শবর কন্যার নাচে তিনি তুষ্ট হন। জগতের মঙ্গল হয়। আশ্চর্য এক অচেনা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই সম্প্রদায়।
এবার এই উপন্যাসে আড়কাঠির স্বরূপটি উদ্ঘাটন করা যাক। রাণীবাঁধ বাজারে মুক্তেশের চায়ের দোকানে রাজীব ও মিস ক্যাথিবার্ডের পাশাপাশি আমরা পরিচিত হই রংলালের সঙ্গে। রাজীব ক্যাথিবার্ডকে ওর পরিচয় হিসাবে জানায় – ‘ও একজন আড়কাঠি’। অর্থাৎ কুখ্যাত দাস-ব্যবসায়ী। রংলাল হলো তাজা মালের ব্যাপারী। মাল যাচাই করতে সে পাকা জহুরী। পুরুষদের বেলায় পঁয়ত্রিশ আর মেয়েদের পঁচিশ ছাড়ালেই সে আসামে তাদের পাচার করে দেয়, চা বাগানে কাজের আশ্বাস দিয়ে। চা বাগানে কাজের ফলে অফুরন্ত সুখের কথা নির্বিকারে শুনিয়ে যায় এই বোকা মানুষগুলোকে। হতদরিদ্র এই মানুষগুলি তার কথায় সুখের আশায় বুক বাঁধে। রংলালের লাল খাতায় টিপ দেবার ধুম পড়ে যায়। জনে জনে দাদন বিলি করে রংলাল। লাল খাতার বত্রিশটি পাতায় বেঁধে ফেলে পুরো গ্রামটিকে। হাতে নগদ টাকা পেয়ে মুগ্ধ হয় গজাশিমূলের মানুষগুলি। রংলালের অবাধ গতি, অখণ্ড তার আধিপত্য।
মাঝে মাঝে এসে আসামে কাজ করতে যাওয়া মানুষগুলির মুখের কথা শোনায় রংলাল তাদের পরিবারকে। সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার প্রিয়জনের সুখের খবর শোনার জন্য। তাদের লেখা চিঠি, অস্পষ্ট ছবি দেখিয়ে মন জয় করে এই মানুষগুলির। যারা যেতে চায় রংলালের সঙ্গে, তারা তৈরি হতে থাকে। ক্ষার দিয়ে কাপড় কাচে, সাজো মাটি দিয়ে মাথা ঘষে। মাকড়া-পাথরের টুকরো দিয়ে মরা চামড়া তুলে পা চকচকে করে। প্রিয় ফল পাকুড় খেয়ে নেয় আশ মিটিয়ে। জঙ্গলে নিজের প্রিয় জায়গাটিতে গিয়ে বসে বারবার। বড়াম পুজোর থানে গিয়ে জীবনের গোপনতম আকাঙ্ক্ষাটি জানিয়ে আসে। একদিন ‘ঝুঁঝকা পহরে’ রংলালের সঙ্গে পাড়ি দেয় অজানা জীবনের খোঁজে। তারা জানেও না কোন্ পারে তাদের জীবনের সোনারতরী ভিড়তে চলেছে।
এহেন সুখের চমকটা ভাঙে অনেক পরে, যখন আর কিছুই করার থাকে না। সুচাঁদ যায় আসামে। নিজেদের প্রিয় মানুষগুলির সুখকর অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখতে। ফিরে এসে সুচাঁদ দশরথ ভক্তাকে জানায়, দশ বছর আগে চলে যাওয়া তার কন্যা সুবাসী নিরুদ্দেশ। সুফল কোটালের দু পায়ে দগদগে ঘা। সে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। তারা সকলেই মানুষ থেকে জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। সারাদিন গরুর মতো খাটে। দিনের শেষে আধপেটা খায়। ঝুপড়ি ঘরে শুয়ে রোগ শয্যায় লড়াই করে। ঝড়েশ্বরের মেয়ে সাবিত্রী রোজ অসংখ্য মানুষের দৈহিক লালসার নিবৃত্তি ঘটায়। আধপেটা খাবারের টাকা দিয়ে সমস্ত টাকাটাই রংলাল কোম্পানীর থেকে তুলে নেয়। এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। অনেক মেয়েরই কোনো হদিস নেই। রংলাল শুধু আড়কাঠিই নয়, নারীপাচার চক্রের কাজও সে করে।
রংলালের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় এই মানুষগুলির কাছে। হয়তো তারা সচেতন হয়। আবার কখনো পেটের খিদে ও জীবনের তাগিদে এহেন রংলালের বিরোধিতা করতেও তারা ভয় পায়। এই অবস্থায় এই হতদরিদ্র মানুষগুলিকে আর্থিক ও মানসিক ভাবে সাহায্য করে রাজীব। পরিত্রাতার ভূমিকায় সে অবতীর্ণ হয়। সকলে ভীষণ বিশ্বাস করে রাজীবকে। কিন্তু তখনো অনেক চমক বাকি ছিল এই মানুষগুলির জন্য। হয়তো আরো বড় দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল।
বিদেশিনী ক্যাথিবার্ড ও সাহিত্যের অধ্যাপক রাজীব আসলে তথাকথিত ‘লোকসংস্কৃতি-প্রেমী’ ফোক ব্যবসায়ী। ক্যাথিবার্ড ও রাজীব অর্থোপার্জনের স্বার্থে ব্যবহার করে আদিবাসী বসু শবরদের লোকজীবন, লোকনৃত্যকে। বিদেশ ভ্রমণ, সেমিনার, অর্থ, বৈভব, প্রতিপত্তি, রাজীবকে উন্মাদ করে তোলে। এই সমস্ত কিছুর বিনিময়ে তাদের গুহ্য সম্পদ ‘জলকেলি নাচ’কেও সওদা করতে পিছপা হয় না। চার-পাঁচ হাজার থেকে রেট এক লাফে তিরিশ হাজার হয়। দলের ম্যানেজার পায় আট হাজার। বাকিটা রাজীবের। আসামের চা বাগানে আড়কাঠি রংলাল কুলি চালান দিত। তার দাদন থেকে বাঁচাতে গিয়ে রাজীব একদিন লোক-সংস্কৃতি প্রচার সংগঠন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেটি ছিল এই সরল মানুষগুলির জন্য আরো বড় ফাঁদ। রাজীব যখন বাজোরিয়ার সঙ্গে এই দলের সওদা করতে বসে, তখন রাজীব বলে ওঠে – ‘‘এ দলে জনা বারো মেয়ে আছে।... তার মধ্যে একটা ডব্কা ছুঁড়ি আছে, দেখেছেন তো? ওকে দেখলে আপনার বড় বাজারের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে মশাই। ওর এক-একখানা বুকই আঠারো হাজারে বিকোবে।’’
এই রাজীব কি রংলালের থেকেও কোথাও বড় বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠেনি?
‘হায়রে নগরী পাষাণ কারা’
এভাবেই হয়তো মুল্যবোধ বিকিয়ে যায়। রক্ষকই হয়ে ওঠে ভক্ষক। আর এখানেই উপন্যাসটির শ্রেষ্ঠ চমক ও অভিনবত্ব।
সচেতন ভাবে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি বাঙালীর অনুরাগ, বিশেষত বিংশ শতাব্দীকেই বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রারম্ভিক পর্ব বলা যেতে পারে। এই পর্বে বাংলা কথা সাহিত্যে লৌকিক উপাদান প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাড়তি সচেতনতা নেই। জীবনের স্বাভাবিক রূপকে ধরতে গিয়ে যতটা পরিমাণ আসা স্বাভাবিক, ততটাই এসেছে লোকঐতিহ্য। পরবর্তী কালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে লোকঐতিহ্য সচেতন ভাবেই উঠে এসেছে। উত্তর-বন্দ্যোপাধ্যায় কালে এই দৃষ্টিভঙ্গি আরো বেশি প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে।
জন্ম সুবাদে ভগীরথ মিশ্র অজ পাড়াগাঁয়ের মানুষ। যে স্কুলে তিনি পড়তেন, তার পাশেই ছিল শাল-অরণ্য স্থিত লোধা শবর পল্লী। গাঁয়ের তিন দিকে ছিল শবর ও কোড়া উপজাতির মানুষ। সরকারী চাকরি করার সময় তাঁর জীবনের বারো আনা কেটে গিয়েছে গ্রামাঞ্চলে। চাকরির ফাঁকে চারপাশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে ঘটেছে অবাধ বিচরণ। পুরুলিয়ার ছৌনাচের দলের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা হয়েছে। এর ফলে তিনি উপলদ্ধি করেছেন, লোক সংস্কৃতির সুবর্ণ ধ্বজাধারী এই মানুষগুলো আজীবনকাল কত বঞ্চিত। শহরের সংস্কৃতিকর্মীরা তাদের মাথার ওপর পা রেখে নিজেদের প্রকট ভাবে দৃশ্যমান করে তুলেছেন। এই সব কিছু নিয়েই লেখা তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আড়কাঠি’।
ভগীরথ মিশ্রের ‘আড়কাঠি’ উপন্যাসে আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে দুটি উপাদানের সন্ধান পাই। প্রথমত জনসমাজের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা একটি প্রাচীন উপজাতির জীবন কাহিনী ও সাংস্কৃতিক সম্পদ; দ্বিতীয়ত আড়কাঠির কার্যকলাপ। এই দুটি উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ আড়কাঠিদের হাতেই এই গরীব, বুভুক্ষু মানুষগুলির নিয়তি অনিবার্য ভাবেই নির্দিষ্ট হয়। এই দুটি উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অনিবার্য পরিণতির দিকটি আলোচনা করা যাক।
যে অঞ্চলটির কথা এই উপন্যাসে পাওয়া যায়, সেই জায়গাতে পৌঁছনো একটু দুষ্কর। বাঁকুড়া শহরের রাণীবাঁধ দিয়ে ঢুকলে সোজা দক্ষিণে বন-জঙ্গল, খুলিয়া-খোঁদল, ডিহি-ডুংরী ধরে হাঁটলে একে একে পড়বে কাটিআম, মৌলা, জামবেড়িয়া, মিঠাআমের জঙ্গল। বাঘমুড়ি, মইষমুড়া পেরিয়ে সে পথ বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের সীমান্তে গিয়ে মিশেছে। সেই পথ ধরে দু-তিন ঘণ্টা হাঁটলেই জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যাবে গজাশিমূল গ্রাম। এই গ্রামের প্রাচীন উপজাতি হলো বসু শবর জাতি। তাদের মতে, তারা সকলের চেয়ে উচ্চ-বর্ণ। বিহারের তামজোড়েও এই জাতি আছে। আসলে তারা পাহাড়িয়া জাতি।
কোনো এক কালে ভুঁইহার-জমিদারদের তাড়া খেয়ে এদের কোনো পূর্বপুরুষ এসে এই গজাশিমূল গাঁয়ে বসবাস করেছিল। প্রচুর শিমূল গাছ ছিল বলে গাঁয়ের এহেন নামকরণ। তারা চাষ করতে জানে না। জঙ্গলই তাদের কাছে বাবা মায়ের সমান। সারাদিন জঙ্গলে শিকার করে। গুঁড়চা-সাট্না ধরে। মৌচাক ভাঙে। ফল পাড়ে, কন্দ-মূল খোঁড়ে। এই সবই তাদের খাদ্য। শাল কাঠের ‘ইশ’ বানায়, গরুর গাড়ির লাঙল, খাটিয়ার পায়া – এই সমস্ত লোকালয়ে বিক্রী করে উপার্জন করে। ছোট ছোট দল জঙ্গলে জঙ্গলে অনেক দূর চলে যায়। দু-দশ দিন এক টানা হাঁটে। ক্ষিদে পেলে গাছের ফল খায়। তেষ্টা পেলে ঝর্ণার জল খায়। গাছের মাথায় চড়ে রাত্তিরে ঘুমোয়।
এহেন একটি প্রাচীন উপজাতির সন্ধান পায় রাজীব, যে বাঁকুড়া কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক। সুনীল তার কলেজের ছাত্র। এই সুনীলই তাকে গজাশিমূলের সন্ধান দেয়। কারণ সুনীল চিরুড়ি স্কুলে সুচাঁদ ভক্তার সঙ্গে পড়ত। রাজীব তাদের লোকজীবন লোকনৃত্যকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে।
ভদ্র লোকেদের ওরা বলে ‘কাঁকড়া’। তাদের বিচিত্র দেব দেবী। বিচিত্র তাদের আরাধনা পদ্ধতি। ফাল্গুন মাসে যখন ঘরে ঘরে ‘মায়ের দয়া’ হয়, তখন তিন রাত নাচ গানের মাধ্যমে ‘নিশি উজাগর’ করে ওরা। পুজোর সঙ্গে ‘নিশি উজাগর’ করলে দেবতা নাকি তুষ্ট হন। প্রথম রাতে হয় শীতলা-বন্দনা। বিচিত্র সুরে গান, বন্য তালে বাজনা, নিজেরাই শীতলা সাজে। কেউ সাজে বাহন গর্দভ, এমন কী রোগ জীবাণুও সাজে কেউ কেউ। নাচ গানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় রোগের ভয়াবহতা।
দ্বিতীয় রাতে হয় ‘শিকার লাচ’। তাদের জীবিকা শিকার করা। জীবিকার পরিণতি হয় উৎসবে। সেই শিকার করার আলাদা উদ্দীপনা থাকে। আনন্দে তারা মেতে ওঠে। নাচে, গায়, ঘর থেকে বেরোবার সময় প্রিয়জনেরা ফরমাশ করে – ‘সব থেকে বড় সাট্নাটি আমার জন্য এনো’। শিকার পর্ব নিয়ে চলে চার ঘণ্টার নৃত্য। ‘চাঙ লাচ’ হয় তৃতীয় দিনে। এক বিশেষ ধরনের গানের সঙ্গে সমবেত নাচ। সঙ্গে বাজনা কেবল চাং আর মাদোল। এর ভাষা স্বতন্ত্র, সুর মৌলিক, নাচগুলোর আঙ্গিকও চেনা ছকের বাইরে। এগুলো তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐশ্বর্য। এছাড়াও আছে বিহা গীত, পরবের গান, আষাঢ়িয়া গান প্রভৃতি।
এই প্রাচীন সংস্কৃতিকে রাজীব প্রচারের আলোয় আনতে চাইলে দশরথ ভক্তা বিলাপ করে। বত্রিশ ঘর বসু-শবরের জাতকে নিজেদের জীবন ধারণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে চায় সে। দশরথ ভক্তা রাজীবকে জানায় যে, তাদের খাদ্যের অভাব নেই। ফল-ফুলারি, ভ্যাঁচ-কেঁদু, ভেলাই-ভুঁড়ুর, কাঁটা-আলু, চুরকা–আলু, পান-আলু, রাখাল-কুদরী, বন কাঁকড়ো -- সে সব এনে তাদের খেতে হয়। জঙ্গলে বড় শিকার, খরগোশ, গুঁড়চা, মালো, খটাস, বন-মুরগী, তিতির, কোয়ের গুঁড়ুর, ঢ্যামনা সাপ, সাট্না, সে সব মেরে খাওয়া চলে। ঢ্যামনা সাপের ছালের অনেক দাম। সাট্নার ছালেরও অনেক দাম। সাট্নার ছাল পুড়িয়ে রাণীবাঁধ কিংবা ফুলকুসমার হাটে বেচে উপার্জন করা যায়। গাছে গাছে ঠেলু আছে। অনেক লোক মিলে তীর কিংবা গুলতি, পাথর, রড ছুঁড়ে তাকে মারতে হয়। এক সময় কাহিল হয়ে পড়লে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। তখন সবাই মিলে তাকে লাঠিপেটা করে মেরে তার মাংস খায়। চামড়া দিয়ে ‘চাং’ছায় তারা।
এছাড়াও অর্বাচীন কালের হাজা-মজা বাঁধের ঠান্ডা থলথলে পুরনো পাঁকের তলায় কালো কুচকুচে কটুর (কচ্ছপ) দল বাস করে। আলের ধারে ধারে বড় বড় ইঁদুর বাস করে, তাদেরকে মেরেও তারা খায়। হরিতকি, বহেড়া, কঁচড়ার বীজ কুড়িয়ে, জঙ্গলের কাঠ কেটে লাঙল বানিয়ে হাটে বিক্রী করে অর্থ উপার্জন করে জীবন নির্বাহ করে।
পরবর্তী ক্ষেত্রে রাজীবের নেতৃত্বে এই সমস্ত ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন লোকনৃত্য দেখাতে যখন তারা রাজী হয় এবং বিভিন্ন শহরে তাদের এই লোকনৃত্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তখন তারা দু’হাত ভরে উপার্জন করে গ্রামে ফিরে আসে। এই আনন্দে কাস্তো মল্লিক, সুচাঁদ ভক্তাকে ‘কানাইশরজীউ’র পুজো করতে বলে। তিনি এই গোষ্ঠীর সব থেকে প্রাচীন দেবতা। গজাশিমূল থেকে দু’দিনের পথ হাঁটলে বেলপাহাড়ী। তার দক্ষিণে একজোড়া পাহাড়। পাহাড়ের গায়েই কেন্দাপাড়া গ্রাম। সেখান থেকে কিছুটা হাঁটলেই কানাইশর পাহাড়। সেখানেই বাবা কানাইশরজীউর অবস্থান। সিঁদুরে চর্চিত শিলারূপী লীলাময়। চারপাশে হাতি ঘোড়ার স্তূপ।
কাস্তো মল্লিক বর্ণিত এই দেবতার কিংবদন্তী অনেকটা এইরকম -- আষাঢ়ের তৃতীয় শনিবার খুব জমজমাট করে কানাইশরজীউর পুজো হয়। বহু মানুষের মনস্কামনা তিনি পূর্ণ করেছেন। পাহাড়ের গুহায়, জঙ্গলে বাবার অসংখ্য ভক্ত ঘুরে বেড়ায়। বাবার ভক্তদের তারা কোনোরূপ উপদ্রব করে না। ভক্তকে ভয় দেখানোর জন্য জনহীন জঙ্গলে ‘আগুন বরণের’ বেশে তিনি হাজির হন। কাস্তো মল্লিক জীবনে একবার তাঁকে দর্শন করেছে। তার মতে, তিনি একেবারে জাত ব্যাঘ্র, জ্বলন্ত অগ্নির মতো তাঁর বর্ণ। কানাইশরজীউর থানে মেয়েদের যাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। যে যাবে তার বছর ঘুরবে না, ওলাওঠা অথবা আগুনবরণের হাতে মৃত্যু হবে তার। ঠাকুরের মূর্তির তলায় এক বিশাল সাপ বাস করে। ঠাকুরের হুকুমে সে নড়ে চড়ে। শিলাটাকেও নড়িয়ে দিতে পারে সে।
এই সমস্ত কাজে রাজীবকে সাহায্য করে ‘ইস্ট ওয়েস্ট ফোক ফাউন্ডেশন’এর পূর্ব ভারতীয় শাখার ডিরেক্টর ‘দ্য ফোক’ পত্রিকার সর্বভারতীয় সম্পাদক মিস ক্যাথিবার্ড। তার সঙ্গে আসে মিঃ জনসন। তাদের কাজ, এই অঞ্চলের টুসু, ভাদু, ঝুমুর, পাতানাচ, কাঠিনাচ প্রভৃতি হারিয়ে যাওয়া ফোকলোরগুলোকে খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করা, এবং যারা সেই ফোকগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের আইডেন্টিফাই করা। তাছাড়া উপযুক্ত ‘এইড’ দিয়ে তাদের ফোকগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা।
অন্যদিকে টাকা, মেডেল, প্রতিপত্তি, সম্মান প্রভৃতি যখন রাজীব সহ সুচাঁদ-রঙীদের অভ্যেসে পরিণত হয়, তখন কোনো ভাবেই সেটাকে হাতছাড়া করতে চায় না তারা। এর জন্য যে কোনো মূল্য দিতে তারা প্রস্তুত হয়। টাকার কাছে তাদের একান্ত নিজস্ব গূহ্য সম্পদ বিকিয়ে যায় - জলকেলি নাচ। সে নাচ তাদের কৌলিক নাচ। সে বড় শুদ্ধ, বড় গূহ্য বস্তু। সে নাচ কেবল কানাইশরের সামনেই দেখানো নিয়ম।
কাস্তো মল্লিক এই জলকেলি নাচের উৎপত্তির ইতিহাস বর্ণনা করে। বসু-শবর জাতের মূল বসতি ছিল তামাজোড় গাঁয়ে। সুবর্ণরেখা নদী ও পাহাড় দ্বারা ঘেরা সেই গ্রামে একবার জন্ম নিয়েছিল স্বয়ং ব্রজরাজ কানাই। এরপর কাস্তো মল্লিকের বর্ণনার সাদৃশ্যে আমরা বৃন্দাবনে কৃষ্ণ ও গোপীদের বস্ত্রহরণ খণ্ডের কথা স্মরণ করতে পারি। যমুনা এখানে সুবর্ণরেখা নদী হয়ে গেছে। কদম গাছ রূপান্তরিত হয়েছে মৌউল গাছে। বৃন্দাবনের গোপিনী এখানে কলঙ্কিনী শবর কন্যা। শবররা কানাইকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে সকলে মিলে প্রচন্ড মারধোর করে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। সেই বছরই তামাজোড় গাঁয়ে নিদারুণ খরা হয়। সুবর্ণরেখা নদী শুকিয়ে যায়। গাছে পাতা ফল কিছুই থাকে না। প্রচুর মানুষ এতে মারা যায়। এইসময় কাস্তো মল্লিকের ঠাকুরদাকে স্বপ্নে ব্রজরাজ কানাই এই খরার কারণ জানায় এবং সুবর্ণরেখা নদীর মউল গাছের তলায় তাঁর পুজো করার কথা জানায়। যদি যুবতীরা জলকেলি নাচ করে আরাধনা করে, তবে ব্রজরাজের শান্তি হবে, বর্ষা হবে, আর ঐ যুবতীরা মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবে।
সাতদিন পর ব্রজরাজ কানাই আবার স্বপ্নে জানায় যে, তিনি তাদের ঘরে কানাই শবর হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। এখন তাঁর বাস পাহাড়ে। তাঁর নতুন নাম কানাইশরজীউ। আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে তাঁকে পুজো করার কথাও জানায়। সেই থেকে সেই রাতে নদীর পাড়ে মেয়েরা জলকেলি নৃত্য করে। সেই নাচের অনেক নিয়ম। গানের ভাষা দৈব ভাষা। সে গানের সুর বেঁধেছিলেন স্বয়ং ব্রজরাজ। এটাই কিংবদন্তী। সুদূর বৃন্দাবনের কাহিনী এত দূরে একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এভাবেই সংস্কৃতি নিরন্তর চলমান খরস্রোতা নদীর মতো।
রাজীবকে এই জনগোষ্ঠী একান্ত আপন মনে করে। তাই তার কাছে দশরথ ভক্তা ব্যাখ্যা করে জলকেলি নাচের স্বরূপ -- আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে গভীর রাতে বহু উপচারে ব্রজরাজের পুজো হয়। পুজোর শেষে সব পুরুষ ওখান থেকে চলে আসে। নদীর পাড়ে থাকে শুধু যুবতী মেয়েরা। তারা নাচতে শুরু করে ব্রজরাজের সম্মুখে। নাচতে নাচতে এক-একটি বস্ত্র ত্যাগ করে। এক সময় পুরোপুরি বস্ত্রহীন হয়ে যায় তারা। ঐ সময় গান ও নাচের অনেক মুদ্রা দেখা যায়। সারা রাত্রি ধরেই সেই নাচ-গান হয়। মেয়েরা ছাড়া কাকপক্ষীতেও সে নাচ দেখতে পায় না, শুনতেও পায় না। শুধু ব্রজরাজই সেই নাচ-গান আস্বাদন করেন। শবর কন্যার নাচে তিনি তুষ্ট হন। জগতের মঙ্গল হয়। আশ্চর্য এক অচেনা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই সম্প্রদায়।
এবার এই উপন্যাসে আড়কাঠির স্বরূপটি উদ্ঘাটন করা যাক। রাণীবাঁধ বাজারে মুক্তেশের চায়ের দোকানে রাজীব ও মিস ক্যাথিবার্ডের পাশাপাশি আমরা পরিচিত হই রংলালের সঙ্গে। রাজীব ক্যাথিবার্ডকে ওর পরিচয় হিসাবে জানায় – ‘ও একজন আড়কাঠি’। অর্থাৎ কুখ্যাত দাস-ব্যবসায়ী। রংলাল হলো তাজা মালের ব্যাপারী। মাল যাচাই করতে সে পাকা জহুরী। পুরুষদের বেলায় পঁয়ত্রিশ আর মেয়েদের পঁচিশ ছাড়ালেই সে আসামে তাদের পাচার করে দেয়, চা বাগানে কাজের আশ্বাস দিয়ে। চা বাগানে কাজের ফলে অফুরন্ত সুখের কথা নির্বিকারে শুনিয়ে যায় এই বোকা মানুষগুলোকে। হতদরিদ্র এই মানুষগুলি তার কথায় সুখের আশায় বুক বাঁধে। রংলালের লাল খাতায় টিপ দেবার ধুম পড়ে যায়। জনে জনে দাদন বিলি করে রংলাল। লাল খাতার বত্রিশটি পাতায় বেঁধে ফেলে পুরো গ্রামটিকে। হাতে নগদ টাকা পেয়ে মুগ্ধ হয় গজাশিমূলের মানুষগুলি। রংলালের অবাধ গতি, অখণ্ড তার আধিপত্য।
মাঝে মাঝে এসে আসামে কাজ করতে যাওয়া মানুষগুলির মুখের কথা শোনায় রংলাল তাদের পরিবারকে। সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার প্রিয়জনের সুখের খবর শোনার জন্য। তাদের লেখা চিঠি, অস্পষ্ট ছবি দেখিয়ে মন জয় করে এই মানুষগুলির। যারা যেতে চায় রংলালের সঙ্গে, তারা তৈরি হতে থাকে। ক্ষার দিয়ে কাপড় কাচে, সাজো মাটি দিয়ে মাথা ঘষে। মাকড়া-পাথরের টুকরো দিয়ে মরা চামড়া তুলে পা চকচকে করে। প্রিয় ফল পাকুড় খেয়ে নেয় আশ মিটিয়ে। জঙ্গলে নিজের প্রিয় জায়গাটিতে গিয়ে বসে বারবার। বড়াম পুজোর থানে গিয়ে জীবনের গোপনতম আকাঙ্ক্ষাটি জানিয়ে আসে। একদিন ‘ঝুঁঝকা পহরে’ রংলালের সঙ্গে পাড়ি দেয় অজানা জীবনের খোঁজে। তারা জানেও না কোন্ পারে তাদের জীবনের সোনারতরী ভিড়তে চলেছে।
এহেন সুখের চমকটা ভাঙে অনেক পরে, যখন আর কিছুই করার থাকে না। সুচাঁদ যায় আসামে। নিজেদের প্রিয় মানুষগুলির সুখকর অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখতে। ফিরে এসে সুচাঁদ দশরথ ভক্তাকে জানায়, দশ বছর আগে চলে যাওয়া তার কন্যা সুবাসী নিরুদ্দেশ। সুফল কোটালের দু পায়ে দগদগে ঘা। সে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। তারা সকলেই মানুষ থেকে জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। সারাদিন গরুর মতো খাটে। দিনের শেষে আধপেটা খায়। ঝুপড়ি ঘরে শুয়ে রোগ শয্যায় লড়াই করে। ঝড়েশ্বরের মেয়ে সাবিত্রী রোজ অসংখ্য মানুষের দৈহিক লালসার নিবৃত্তি ঘটায়। আধপেটা খাবারের টাকা দিয়ে সমস্ত টাকাটাই রংলাল কোম্পানীর থেকে তুলে নেয়। এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। অনেক মেয়েরই কোনো হদিস নেই। রংলাল শুধু আড়কাঠিই নয়, নারীপাচার চক্রের কাজও সে করে।
রংলালের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় এই মানুষগুলির কাছে। হয়তো তারা সচেতন হয়। আবার কখনো পেটের খিদে ও জীবনের তাগিদে এহেন রংলালের বিরোধিতা করতেও তারা ভয় পায়। এই অবস্থায় এই হতদরিদ্র মানুষগুলিকে আর্থিক ও মানসিক ভাবে সাহায্য করে রাজীব। পরিত্রাতার ভূমিকায় সে অবতীর্ণ হয়। সকলে ভীষণ বিশ্বাস করে রাজীবকে। কিন্তু তখনো অনেক চমক বাকি ছিল এই মানুষগুলির জন্য। হয়তো আরো বড় দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল।
বিদেশিনী ক্যাথিবার্ড ও সাহিত্যের অধ্যাপক রাজীব আসলে তথাকথিত ‘লোকসংস্কৃতি-প্রেমী’ ফোক ব্যবসায়ী। ক্যাথিবার্ড ও রাজীব অর্থোপার্জনের স্বার্থে ব্যবহার করে আদিবাসী বসু শবরদের লোকজীবন, লোকনৃত্যকে। বিদেশ ভ্রমণ, সেমিনার, অর্থ, বৈভব, প্রতিপত্তি, রাজীবকে উন্মাদ করে তোলে। এই সমস্ত কিছুর বিনিময়ে তাদের গুহ্য সম্পদ ‘জলকেলি নাচ’কেও সওদা করতে পিছপা হয় না। চার-পাঁচ হাজার থেকে রেট এক লাফে তিরিশ হাজার হয়। দলের ম্যানেজার পায় আট হাজার। বাকিটা রাজীবের। আসামের চা বাগানে আড়কাঠি রংলাল কুলি চালান দিত। তার দাদন থেকে বাঁচাতে গিয়ে রাজীব একদিন লোক-সংস্কৃতি প্রচার সংগঠন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেটি ছিল এই সরল মানুষগুলির জন্য আরো বড় ফাঁদ। রাজীব যখন বাজোরিয়ার সঙ্গে এই দলের সওদা করতে বসে, তখন রাজীব বলে ওঠে – ‘‘এ দলে জনা বারো মেয়ে আছে।... তার মধ্যে একটা ডব্কা ছুঁড়ি আছে, দেখেছেন তো? ওকে দেখলে আপনার বড় বাজারের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে মশাই। ওর এক-একখানা বুকই আঠারো হাজারে বিকোবে।’’
এই রাজীব কি রংলালের থেকেও কোথাও বড় বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠেনি?
‘হায়রে নগরী পাষাণ কারা’
এভাবেই হয়তো মুল্যবোধ বিকিয়ে যায়। রক্ষকই হয়ে ওঠে ভক্ষক। আর এখানেই উপন্যাসটির শ্রেষ্ঠ চমক ও অভিনবত্ব।
সহায়ক গ্রন্থ
লোকসংস্কৃতির তত্ত্বরূপ ও স্বরূপ সন্ধান : ডঃ তুষার চট্যোপাধ্যায়।
বাংলার লোকসংস্কৃতি : ডঃ ওয়াকিল আহমেদ। ভূমিকা : বাংলার লোকসংস্কৃতির উৎস। পৃ. ৩১। ১৯৭৪ এর সংস্করণ।
বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ : ডঃ বরুণকুমার চক্রবর্তী।
ফুটনোট
‘সাট্না’- গোসাপ
‘গুঁড়চা’- কাঠবেড়ালী জাতীয় প্রাণী
‘ঠেলু’- বাঁদর
‘ঈশ’- লাঙ্গলের ফলা
‘নিশি উজাগর’- রাত্রি জাগরণ
‘মায়ের দয়া’- জল বসন্ত
‘বড়াম পুজা’- পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ইনি পূজিতা। তাঁর স্থান অসংখ্য। কোনো মন্দির বা চালা নেই। গাছতলায় তাঁর পুজো হয়। বড়ামের প্রতীক পাথর খন্ড। কোনো কো্নো পাথরে তাঁর চোখ মুখ আঁকা। পোড়ামাটির হাতি ঘোড়াও তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়। বড়ামের প্রধান সাঁওতাল বা লোধারা। উপাসকদের মতে, বড়াম পশু দেবতা। ‘বড়াম’ মানে সেরা বা আদি। সুতরাং ইনি একশ্রেণীর সমাজে বহুমান্যা ও কুলদেবী জ্ঞানে পূজিতা।
সমৃদ্ধ হলাম ।
উত্তরমুছুনভালো লাগলো।তবে কোনো নারী চরিত্রের বিশেষ ভূমিকা থাকলে বেশি ভালো লাগতো।,🙏
উত্তরমুছুন