কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

০৬) অনিল শেঠ

স্মরণের সরণিতে – ১


অনিল শেঠ 


[এই স্মৃতিকাহিনীর লেখক শ্রীঅনিল শেঠের জন্ম ১৯২৮ সালে। তাঁর শৈশব কাটে জামশেদপুরে। সেখানে স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করে তিনি যান কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। বিজ্ঞানে স্নাতক হবার সঙ্গে সঙ্গে বিগত শতকের চল্লিশের দশকের কলকাতায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন দাঙ্গা, দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার সেই সব ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন আর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর ঝুলিতে জমা হয় বিচিত্র ও বর্ণময় সব অভিজ্ঞতা। গণনাট্যের প্রসারে তিনি সফর করেন অবিভক্ত বাঙলাদেশের নানা স্থানে। পরে তিনি জামশেদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম শাখা। তারপর শহরের নানা বিদ্যায়তনে শিক্ষকতার পেশায় অতিবাহিত হয় তাঁর জীবনের অনেকগুলি বছর। বিজ্ঞান-প্রদর্শনী, সায়েন্স ক্লাব ইত্যাদি নানা অভিনব কর্মধারার মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রূপে। বর্তমানে সেই পেশা থেকে অবসর নিয়েও এই বর্ষীয়ান শিক্ষাব্রতী আজও নানা ধরনের সৃষ্টিশীল মননে ও চর্চায় নিযুক্ত। তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণময় জীবন-খাতার পাতা থেকে কিছু আকর্ষণীয় কাহিনী আমরা মাঝে মাঝে এখানে পরিবেশন করবো। এবার তার প্রথম পর্ব।] 



 আগুনের সঙ্গে লড়াই 

তখন প্রায় বারো বছর বয়স আমার, চাইবাসায় কাকার বাড়িতে বেড়াতে গেছি আমার বাবার সঙ্গে। জায়গাটার নাম সেনটোলা। বাড়ির খুব কাছেই ছিল বিরাট এক পুকুর – টলটলে জল তার, বেড়া দিয়ে ঘেরা। এখানে আমার দিন কাটছিল খুবই একঘেয়ে ভাবে, তখন ভাবতেও পারিনি যে, একটি মনে রাখার মতো ঘটনা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

সেদিনটা ছিল তপ্ত, আকাশ ছিল পরিষ্কার, কিন্তু এক কোণা থেকে ঘন ধোঁয়া উঠছিল। সে-সময় রেল চলতো স্টীম ইঞ্জিনে, আর জায়গাটা ছিল যেহেতু রেল লাইনের খুব কাছে, আমি ভেবেছিলাম যে, কোনো ইঞ্জিন থেকেই ধোঁয়াটা বের হচ্ছে।

অচিরেই আশেপাশে একটা আলোড়ন শুরু হলো। জোর চ্যাঁচামিচি সহকারে লোকজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করলো। প্রতিবেশিদের একটি ছেলে আমাকে চেঁচিয়ে বলল, “রেলের স্লিপার ইয়ার্ডে আগুন লেগে গেছে” – একথা বলে সে তার দৌড় থামালো না। কিছু না ভেবেই আমি সেই ছুটন্ত ভিড়ে যোগ দিলাম। বাবা ধারে কাছে ছিলেন না, তাই আমি বিনা বাধায় চলে গেলাম সেই জনতার সঙ্গে।

তাড়াতাড়ি আমি পৌঁছে গেলাম ঘটনাস্থলে। ইতিমধ্যেই ভালো মতো একটা ভিড় জমে গেছে সেখানে। রেল ইয়ার্ডটার সব দিক ছিল উঁচু পাঁচিলে ঘেরা, তাই কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু ইয়ার্ডের মধ্যে থেকে যে ঘন ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠছিল, সেটাই দেখা যাচ্ছিল।

চারপাশে শুধু লোকজনের চিৎকার, সবদিকে ছোটাছুটি আর উচ্চস্বরে কথাবার্তা চলছিল। তারা বালতির জন্য চেঁচাচ্ছিল। চারপাশে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা। কাছাকাছি যে সব বাড়ি ছিল, সেখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা বালতি জোগাড় হয়ে গেল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কিছু তৎপর লোকজন পুকুর পর্যন্ত সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ও তাদের হাতে হাতে বালতিগুলো পুকুরের জলে ভর্তি হয়ে পৌঁছে যেতে থাকলো রেল ইয়ার্ডের দেওয়াল পর্যন্ত।



রেল-চত্বরের মধ্যেই ঐ পাঁচিলের একধারেই ছিল একটা টিনের চালা। কিছু লোক দেওয়ালের খাঁজের সাহায্য নিয়ে প্রথমে পাঁচিলের ওপর এবং সেখান থেকে টিনের চালার ওপর উঠে পড়তে পেরেছিল। একদল লোক সারিবদ্ধ লোকজনের কাছ থেকে জলভরা বালতি নিয়ে এসে পৌঁছে দিচ্ছিল, যারা দেওয়ালের ওপর আর টিনের চালার ওপর ছিল তাদের কাছে। আমিও জুটে গেলাম তাদের সঙ্গে। এতে আমি উৎফুল্ল বোধ করছিলাম, কারণ এই উদ্ধার বাহিনীর বড়রা আমাকে একটা ছোটছেলে ভেবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলেন না, বরং আমাকে দলেরই একজন মনে করছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন ঐ বড়দের সমমর্যাদার একটা স্থান পেয়ে গেছি।

দেওয়াল পর্যন্ত জলভরা বালতি বয়ে আনার ভূমিকাটি আমার অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কোনো সচেতন চেষ্টা ছাড়াই আমি দেওয়ালের ওপর, তারপর টিনের চালার ওপর চলে এলাম। সেই জ্বলন্ত চত্বরটি আমি একেবারে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। সে কী দৃশ্য! সেখানে বেশ কয়েক থাকে রাখা ছিল রেলের স্লিপারগুলো। ঊর্ধমুখি লেলিহান অগ্নিশিখায় তার বেশিরভাগগুলোই পুড়ছিল। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে উঠছিল আগুনের ফুলকি, যেন ঐ আগুনের হল্কা তৈরি করছিল ধোঁয়ার কালো ধূসর জমিনের ওপর লাল আর হলুদ জ্বলন্ত বিন্দুর নকশা। ঐ চত্বরের মধ্যে জীবন্ত কিছুই ছিল না। একটা বিরাট এলাকা জুড়ে শুধু আগুন আর অগ্নিশিখা! অগ্নিশিখার উত্তাপ আমি টিনের চালার ওপর থেকেই অনুভব করছিলাম। প্রজ্বলন্ত সেই চত্বরের বিধ্বংসী ও ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে আমি বিহ্বল হয়ে গেছিলাম।

কিছুক্ষণ পরে আমার যেন আবছা ভাবে কানে এলো, আমাকে কারা চিৎকার করে ডাকছে। লোকজনের সেই ক্রমবর্দ্ধমান চিৎকার সহসা আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে আমার পরিপার্শ্বের মধ্যে ফিরিয়ে আনলো। আমি দেখলাম যে, আমি ঐ টিনের চালার প্রস্থের অর্ধেকেরও বেশি এগিয়ে এসেছি ও সেখানে আমি একা। বাকিদের প্রায় সকলেই পিছিয়ে গিয়ে জমা হয়েছে সেই চালার দেওয়াল-ঘেঁষা কিনারাটায়। তারা চেঁচিয়ে বলছিল যে, আগুন চালাঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে আর আমার তখনই পিছিয়ে আসা উচিৎ। আমি বিপদটা বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু পায়ে হেঁটে আসা আমার পক্ষে ছিল খুবই কঠিন। চালাটার ছিল চত্বরের দিকে খাড়া ঢাল আর সেটাও ততক্ষণে জল ঢালার ফলে হয়ে উঠেছে খুবই পিছল। সেই ছাদের খাড়া ঢাল বেয়ে পিছলে জ্বলন্ত চত্বরের মধ্যে গিয়ে পড়ার সবরকম সম্ভাবনাই ছিল। আমি বসে বসেই চালা বেয়ে ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টায় নিজের শরীরটাকে টেনে তুলতে লাগলাম। সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে হাতে হাতে এক মানবশৃঙ্খল তৈরি করেছিল, যার সাহায্যে চালার অপর প্রান্তে আমাকে টেনে তোলা হলো। প্রত্যেকেই আপশোস করছিল যে, আগুনকে বাগে আনার আর কোনো উপায়ই নেই, আর আমাদের অবিলম্বে ছাদ থেকে নেমে আসা উচিৎ।

আমি মাটিতে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ সাইরেন শোনা গেল ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে। এটা ছিল প্রায় ৬৫ কিঃ মিঃ দূরের জামশেদপুর থেকে দমকল বাহিনী আসার সংকেত। তারা এসেই ভিড়কে দূরে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কাজে। পুরো দলটির একযোগে কাজ, তাদের দৃঢ় ও প্রত্যয়ী চলেফেরা আর তাদের প্রতিজ্ঞা-উদ্বুদ্ধ মুখের দিকে আমি সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

আমার সেই বীর নায়কদের তৎপরতা আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখেছিলাম প্রশংসা, সমীহ আর সম্ভ্রমের সঙ্গে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন