নিরুবাবুকে
আপনার জীবনটা খুব সাদাকালো খোপ কাটা খোপ কাটা দাবার বোর্ডের মতো ছিল, নিরুবাবু। সব মিলিয়ে আপনি খুব ইন্টারেস্টিং লোক ছিলেন। তার মানেই ভালো লোক নন ঠিক। মানে, সে অর্থে ভালো লোক নন। তাই আপনাকে নিয়ে গল্প লেখা যায়, সিনেমা করা যায়। সাদাকালো সিনেমা, বা রঙিন।
আপনি যেদিন মারা গেলেন, নিরুবাবু, আপনার মৃতদেহের উপর আছাড়িপিছাড়ি কেঁদেছিলেন যে মহিলা, তিনি আপনার স্ত্রী নন। আপনার স্ত্রী হলে বুকের ওপর পড়ে কাঁদবেন, তা অবশ্য ভাবা যায় না। কারণ তিনি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করা মেয়ে।
যিনি কেঁদেছিলেন, নাটকীয়ভাবে কেঁদেই চলেছিলেন, তিনি আসলে অন্য লোকের স্ত্রী। আপনার বন্ধুপত্নী সুলক্ষণা। যারা নিয়মিত আপনার শেষ কটি দিনে অর্জি মানাতেন, আপনার বাড়ির সোফা চেয়ার টেবিল ক্যাসেট প্লেয়ার বইপত্রের সঙ্গে যাদের একান্ত সম্পর্ক ছিল...
আপনার স্ত্রী তখন গুয়াহাটিতে ছিলেন, চাকরির খাতিরে তিনি দূরে থাকতেন। আপনার স্ত্রী শেষ সময়ে আপনার পাশে ছিলেন না, ছিলেন ওই অন্য লোকের স্ত্রী। অন্য লোকটিও এসেছিলেন, পায়ের কাছে হাঁটু দুমড়ে বসে হাউ হাউ কেঁদেছিলেন, নিরুবাবু। ওর নাম সঞ্জয়... সবাই ওকে চেনে। কনট্রাকটর। আপনার বাড়িতে মদের বোতল নিয়ে রোজ বিকেলে ঢুকত।
আপনার স্ত্রী পরের দিন এসেছিলেন, পরের দিন এসে দেখেছিলেন আপনার মরা মুখ হুবহু আপনার কুড়ি বছর আগেকার বিবাহ রাত্রির মতো সুন্দর। কারণ অতিরিক্ত ফ্ল্যাব, অতিরিক্ত মেদ, শরীরে জমা অতিরিক্ত জল সব মরে শুকিয়ে গিয়েছিল, মৃত্যু সব জলকে শুকিয়ে দেয়... জানতেন না, নিরুবাবু?
আপনার স্ত্রীকে নিয়ে এখন বিস্তর আলোচনা। তিনি মানবী না দানবী! বিপদের সময়ে, অসুখের সময়ে, আপনার স্ত্রী কীভাবে আপনাকে ফেলে চলে গেলেন! তিনি কতটা নিষ্ঠুর। আপনার সন্তানকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আর আজ, যেহেতু ডিভোর্স হয়নি, সুতরাং তিনি ফিরে এসেছেন, আপনার তিনটে ল্যাপটপ, সারাবাড়ির স্তূপীকৃত জিনিসের মধ্যে থেকে খুঁজে পাওয়া চারটে মোবাইল ফোন, দুটো ডিজিট্যাল ক্যামেরা, একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার আর অসংখ্য বইয়ের দখল নেবেন বলে।
আমরা যারা এসব আলোচনা করছি, তারা কেউ জানি না যে, আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে একটিও টাকা নেই। সাকুল্যে দশ হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে রেখে আপনি চক্ষু বুজেছেন, ইয়েবাবু! আপনার স্ত্রী আর কিসের দখল নেবেন? দখল নেবার আছেই বা কী? আপনার ফ্ল্যাটের ই এম আই তো এখনো শোধ হয়নি। সেটা শোধ করলে তবে তো ফ্ল্যাট পুরোপুরি আপনাদের হতো, তাই না? সুতরাং আপনার স্ত্রীর সাকুল্যে সম্বল ওই কয়েকটা বই আর একগাদা গ্যাজেট।
আজ বসন্তোৎসব, তাই চাদ্দিকে হুল্লোড় চলছে। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেল এক গাল রঙ মেখে। রাস্তায় ছোট ছেলেমেয়েরা মাথায় বাঁদুরে রঙ নিয়ে বাঁদর সেজেছে। মদ্যপান হবে আজ। সেই বন্ধু আর বন্ধুর স্ত্রী আপনাকে মিস করবে, যারা এই দিনে আপনার সঙ্গে মাল খেত। তবে এরা অন্য কাউকে ইতিমধ্যে জকিয়ে নিয়েছে।
চাদ্দিকে অরগ্যানাইজড প্যান্ডামোনিয়াম চলছে। আজ কেউ মৃত্যুর কথা ভাববে না, পরস্ত্রীর গালে রঙ দেবার কথা ভাববে। এরই মধ্যে আমি নিরুবাবু, মৃত আপনার কথা ভাবি। আপনার জন্য কেউ কাঁদুক না কাঁদুক, আজ তো আপনার জন্মদিন। মৃত্যুদিনের পরের দিনের জন্মদিন। সেদিন রাজু, আপনার স্ত্রীর ভাই, আপনার কথা বলতে গিয়ে অনেক নিন্দে, অনেক প্রশংসা করেছিল। সব ঘাঁটা কথা। মাথা গুলিয়ে যায় ওসব শুনলে। একটা কথা আর একটা কথাকে এমনভাবে কেটে দেয় যে, শেষ অব্দি পড়ে থাকে শূন্য। তবে দিদির হয়ে সাফাই গাইতে চাওয়া রাজু, আপনার ব্যাপারেও সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাওয়া রাজু, একটা কথা পরিষ্কার বলেছিল, উনি লোকটা অন্যরকম ছিলেন।
তাই বা কম কিসে এই দুনিয়ায়!
আপনার জীবনটা খুব সাদাকালো খোপ কাটা খোপ কাটা দাবার বোর্ডের মতো ছিল, নিরুবাবু। সব মিলিয়ে আপনি খুব ইন্টারেস্টিং লোক ছিলেন। তার মানেই ভালো লোক নন ঠিক। মানে, সে অর্থে ভালো লোক নন। তাই আপনাকে নিয়ে গল্প লেখা যায়, সিনেমা করা যায়। সাদাকালো সিনেমা, বা রঙিন।
আপনি যেদিন মারা গেলেন, নিরুবাবু, আপনার মৃতদেহের উপর আছাড়িপিছাড়ি কেঁদেছিলেন যে মহিলা, তিনি আপনার স্ত্রী নন। আপনার স্ত্রী হলে বুকের ওপর পড়ে কাঁদবেন, তা অবশ্য ভাবা যায় না। কারণ তিনি শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করা মেয়ে।
যিনি কেঁদেছিলেন, নাটকীয়ভাবে কেঁদেই চলেছিলেন, তিনি আসলে অন্য লোকের স্ত্রী। আপনার বন্ধুপত্নী সুলক্ষণা। যারা নিয়মিত আপনার শেষ কটি দিনে অর্জি মানাতেন, আপনার বাড়ির সোফা চেয়ার টেবিল ক্যাসেট প্লেয়ার বইপত্রের সঙ্গে যাদের একান্ত সম্পর্ক ছিল...
আপনার স্ত্রী তখন গুয়াহাটিতে ছিলেন, চাকরির খাতিরে তিনি দূরে থাকতেন। আপনার স্ত্রী শেষ সময়ে আপনার পাশে ছিলেন না, ছিলেন ওই অন্য লোকের স্ত্রী। অন্য লোকটিও এসেছিলেন, পায়ের কাছে হাঁটু দুমড়ে বসে হাউ হাউ কেঁদেছিলেন, নিরুবাবু। ওর নাম সঞ্জয়... সবাই ওকে চেনে। কনট্রাকটর। আপনার বাড়িতে মদের বোতল নিয়ে রোজ বিকেলে ঢুকত।
আপনার স্ত্রী পরের দিন এসেছিলেন, পরের দিন এসে দেখেছিলেন আপনার মরা মুখ হুবহু আপনার কুড়ি বছর আগেকার বিবাহ রাত্রির মতো সুন্দর। কারণ অতিরিক্ত ফ্ল্যাব, অতিরিক্ত মেদ, শরীরে জমা অতিরিক্ত জল সব মরে শুকিয়ে গিয়েছিল, মৃত্যু সব জলকে শুকিয়ে দেয়... জানতেন না, নিরুবাবু?
আপনার স্ত্রীকে নিয়ে এখন বিস্তর আলোচনা। তিনি মানবী না দানবী! বিপদের সময়ে, অসুখের সময়ে, আপনার স্ত্রী কীভাবে আপনাকে ফেলে চলে গেলেন! তিনি কতটা নিষ্ঠুর। আপনার সন্তানকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আর আজ, যেহেতু ডিভোর্স হয়নি, সুতরাং তিনি ফিরে এসেছেন, আপনার তিনটে ল্যাপটপ, সারাবাড়ির স্তূপীকৃত জিনিসের মধ্যে থেকে খুঁজে পাওয়া চারটে মোবাইল ফোন, দুটো ডিজিট্যাল ক্যামেরা, একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার আর অসংখ্য বইয়ের দখল নেবেন বলে।
আমরা যারা এসব আলোচনা করছি, তারা কেউ জানি না যে, আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে একটিও টাকা নেই। সাকুল্যে দশ হাজার টাকা অ্যাকাউন্টে রেখে আপনি চক্ষু বুজেছেন, ইয়েবাবু! আপনার স্ত্রী আর কিসের দখল নেবেন? দখল নেবার আছেই বা কী? আপনার ফ্ল্যাটের ই এম আই তো এখনো শোধ হয়নি। সেটা শোধ করলে তবে তো ফ্ল্যাট পুরোপুরি আপনাদের হতো, তাই না? সুতরাং আপনার স্ত্রীর সাকুল্যে সম্বল ওই কয়েকটা বই আর একগাদা গ্যাজেট।
আজ বসন্তোৎসব, তাই চাদ্দিকে হুল্লোড় চলছে। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেল এক গাল রঙ মেখে। রাস্তায় ছোট ছেলেমেয়েরা মাথায় বাঁদুরে রঙ নিয়ে বাঁদর সেজেছে। মদ্যপান হবে আজ। সেই বন্ধু আর বন্ধুর স্ত্রী আপনাকে মিস করবে, যারা এই দিনে আপনার সঙ্গে মাল খেত। তবে এরা অন্য কাউকে ইতিমধ্যে জকিয়ে নিয়েছে।
চাদ্দিকে অরগ্যানাইজড প্যান্ডামোনিয়াম চলছে। আজ কেউ মৃত্যুর কথা ভাববে না, পরস্ত্রীর গালে রঙ দেবার কথা ভাববে। এরই মধ্যে আমি নিরুবাবু, মৃত আপনার কথা ভাবি। আপনার জন্য কেউ কাঁদুক না কাঁদুক, আজ তো আপনার জন্মদিন। মৃত্যুদিনের পরের দিনের জন্মদিন। সেদিন রাজু, আপনার স্ত্রীর ভাই, আপনার কথা বলতে গিয়ে অনেক নিন্দে, অনেক প্রশংসা করেছিল। সব ঘাঁটা কথা। মাথা গুলিয়ে যায় ওসব শুনলে। একটা কথা আর একটা কথাকে এমনভাবে কেটে দেয় যে, শেষ অব্দি পড়ে থাকে শূন্য। তবে দিদির হয়ে সাফাই গাইতে চাওয়া রাজু, আপনার ব্যাপারেও সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাওয়া রাজু, একটা কথা পরিষ্কার বলেছিল, উনি লোকটা অন্যরকম ছিলেন।
তাই বা কম কিসে এই দুনিয়ায়!
great ... amar onyotomo priyo lekhika
উত্তরমুছুন