ডিজিটাল রেশনকার্ড
কদিন থেকেই বাসন্তী বলছিল, দিদি দোকানে কিন্তু বারবার তোমাদের যেতে বলছে। কী সব নাকি নতুন কার্ড দেবে, তার জন্যে তোমাদের অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবে। আর আমাকে দিয়ে হবে না। তোমাদের গিয়ে দেখা করতে বল্ছে। এই নাও ফোন নম্বর দিয়েছে, যা জিজ্ঞেস করার করে নিও।
--মর্ জ্বালা, এই তো কদিন আগে আঁধার কার্ডের জন্যে সমস্ত ঠিকুজি কুলুজি পাসপোর্টের মতো হাতের ছাপ ছবি, সব কিছু দিয়ে এলাম। দু’দিন পর পর বায়নাক্কা। মানুষের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি? কত পরিচিতি দরকার বাপু – রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, আঁধার কার্ড, ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট -- তা যারা যা করার করেই যাচ্ছে, ধরতে পাচ্ছিস কোথায়? যত হুজ্জোতি আমাদের ওপর। নাও আবার ছুটি নাও একদিন। এমনিতেই তো ছুটির দফারফা। সব ঝুট ঝামেলাতে তোমাকেই ছুটি নিতে হবে। আমার তো আবার একা বোকার সংসার। দশ মিনিটের ব্যাঙ্কের কাজের জন্যে চল্লিশ কিলোমিটার ঠেঙিয়ে যাওয়ার তো উপায় থাকে না। গজ গজ করতে করতে স্কুলে বেরোলো সোহিনী।
কদিন থেকেই চলছিল ঠাণ্ডা-গরমের উৎপাত। সরস্বতী পুজোর পরদিন থেকেই শীত উধাও। গত দুটো বছর কোনোমতে শীতের একটু আছর ছিল। এবার সেটাও নেই। শীত ও সাইনাস পাশাপাশি। শীত হাজির হলে উনিও হাজির। সেই সুবাদে একদিন ছুটি নেওয়া, সঙ্গে রেশন কার্ডের দোকানে হাজিরা দেওয়া, একঢিলে দুই পাখি আর কী! খবর নিয়ে দেখল, কার্ড নাকি ডিজিটাল হবে তারই তোড়জোড় চলছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি ছুটল সোহিনী। পাশাপাশি রেশন দোকানে আর ৮৯৮ ও ৮৯৯, একটি রাস্তার ওপরে আর একটি ভেতরে। সোহিনীর কার্ড ভেতরের ঘুপচিতে। ইতিমধ্যে অনেকে এসে হাজির হয়েছে। প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন। নিজেরাই সিরিয়েলি নাম লিখে রাখছে। দোকানের কর্মীরা তখন এসে উপস্থিত হন নি। এই ন’কোটির রাজ্যে শৃঙ্খলা নেই বলা যাবে না। চট করে লাইন করে কোনো কাজ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে করে ফেলায় জুড়ি নেই এ রাজ্যের মানুষের, আর কোনো রাজ্যে এমন আছে কি না সন্দেহ! সে অটোর লাইনই হোক বা সিনেমার লাইন বা অন্য কিছু। বাজারের মধ্যে রাস্তার ওপরে দোতলা বাড়ি। ব্যারাকের মতো। বেশ পুরনো। তার দুটো তলা জুড়েই রয়েছে দোকান ও গুদাম। নিচতলায় খোপ খোপ আট-দশখানা দোকান। তার মধ্যে কাপড়ের দোকান থেকে ঘরকন্নার সাজ সরঞ্জামের দোকান পর্যন্ত রয়েছে। তার মধ্যে রেশন দোকানগুলো। ভেতরের দিককার দোকান সোহিনীর। বাসন্তী বলেছিল – তোমদের বাপ ঠাকুরদার নাম-টাম জিজ্ঞেস করবে কিন্তু, ভালো করে লিখে নিয়ে যাও। --কেন রে পূর্বপুরুষদের বচ্ছরকার জল দেওয়াবে নাকি, তর্পণ?--বলল সোহিনী। --তোমাকে নিয়ে আর পারি না বাপু, বলতে বলতে হাঁটা দিল বাসন্তী।
ইতিমধ্যে নাম ধরে ধরে লাইন করানো শুরু হয়েছে। দোকানের কর্মীরা এসে পৌঁছেছে। কার্ড সিরিয়াল নম্বরও লেখা হচ্ছে। দু’ধরনের সিরিয়াল করায় লেগে গেল ধুন্ধুমার। একজন আগের সিরিয়ালে লোক দাঁড় করাচ্ছে, আর একজন কার্ড অনুযায়ী। হঠাৎ কোথা থেকে একটি ছেলে এসে বলল, আবার কিসের লাইন? কার্ড অনুযায়ী কেন হবে? আমরা তো নাম লিখিয়েছি। এই মারে কি সেই মারে। লেগে গেল কথার যুদ্ধ।
-- জানিস আমি কে? কার সঙ্গে কথা বলছিস? দু’ভাগ করে রেখে দেব। এক হাঁক দিলে হাজার লোক এসে জড় হবে। দেখবি? প্রাণ নিয়ে এখান থেকে বেরতে পারবি না। যিনি পরে এলেন, একদা নাম লিখিয়ে গেছিলেন। --কাকে কি বলছিস রে হাঁদা! জানিস আমি কে? চিরে রেখে দেব। যে ছেলেটি এতক্ষণ খুব সুষ্ঠুভাবে নাম ধাম লিখছিল সে বলল। মাই গড! এরা কারা, ভাবছিল সোহিনী। কোথা থেকে মেহেন্দি করা দাড়ি একজন এলেন, বেশ দাদা গোছের। সবাই প্রমাদ গুনল। যাক গে। আস্তে আস্তে তিনি আর লাইনে যারা ছিল সবাই মিলে সামাল দিল। সোহিনী আরও কয়েকজন মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব জুড়ে দিল। বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের। সকলেই কাজ কর্ম ছেড়ে এসেছে। আর বাপান্ত করছে। কারণ কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল আটটায়, শুরু হতে হতে প্রায় দশটা হয়েছে। এতেই সকলের ধৈর্য থাকছে না। সবাই ভেবেছিল, তাড়াতাড়ি এসে ফিরে গিয়ে কাজকর্মে যাবে। ওদের বেশির ভাগই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। অথচ একটু সময়মতো শুরু করলেই কিন্তু হতো। বেশি লোকজন তো নয়! এদের মধ্যে একজন মহিলা, মৌসুমি নাম, সে তো দেখা গেল এই দোকানের মালিকের হাঁড়ির খবর সবই জানে। সে তথ্য সরবরাহ করতে লেগে গেল। --যান তো, এই বাড়িটার মালিকেরই তো এই রেশন দোকান। কত দোকান আছে এদের। এদের মানে? --সোহিনী জিজ্ঞেস করল। ওরা চার পাঁচ ভাই। সবাই এক একটা রেশন দোকানের মালিক। এক এক জনের একাধিক রেশন দোকান। কোটিপতি হয়ে গেছে এরা। পড়াশোনা তো তেমন নেই, কিন্তু টাকা দেখ গে! আমার যেখানে থাকি মানে জগতপুরে, ওদের আট দশখানা দোকান। আর এখানে কি লাইন পড়েছে? এটা তো চুনোপুঁটি। ওখানে চারপাঁচ হাজার লোকের লাইন। কী করে রেশন দোকানের মালিকের এত টাকা হয়, কে জানে! শুনেছিল অবশ্য সোহিনী, রেশন দোকান নিয়ে কী সব স্কাম। সে তো চার পাঁচ বছর আগে। এর মধ্যে বেশ সুন্দরী এক মহিলা এসে দাঁড়ালেন গুটি গুটি সোহিনীদের কথাবার্তার মাঝে। সালোয়ার কামিজ পরা। কপাল ছ’আঙুলে। গমের মতো রঙ। তেমন কোনো সাজগোজ নেই। ছোট চুল, বেশ উঁচু করে পনি বাঁধা। বলেন কম, শোনেন বেশি। মৌসুমি কথা বলে যাচ্ছিল ঝর ঝর করে। জিনিসের দাম। কোনো কিছুই বদলায় না। ইত্যাদি রোজকার কথা বার্তার মতো। সবাই যেমন বলে আর কী!
কিন্তু তখন থেকে ও যেন কিছু বলতে চাইছিল। --আর জা্নো তো, চারদিকে কি অবস্থা! আমাদের পাড়ার দুটো ছেলেকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। ওর চোখ ছলছল করে উঠল। --কেন, কী করেছে তারা? --কিছু করেনি গো দিদি। আরে চুল্লু আছে না, চুল্লু! তার একটি কারখানা খুলেছে একেবারে পাড়ার মধ্যে। আমরা গন্ধে একদম থাকতে পারি না গো। বমি উলটে আসে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপিলেরা রয়েছে পাড়ায়। ভয় করে না! মাঝরাত পর্যন্ত কী হুল্লোড়! পাড়ার উঠতি বয়েসি ছেলেপিলেরা কেউ কেউ ওখানে হানা দিচ্ছে শোনা যায়। সবাই খুব ব্যতিব্যস্ত। তাই তো পাড়ার দুটো ছেলে আর আমার ছেলে মিলে বলতে গেছিল। ওই ছেলেগুলোর বয়েস এই উনিশ কুড়ি হবে। ওরা তো বোঝেনি গো এদের কত খ্যেমতা। পুলিশকে পয়সা খাইয়ে বশ করেছে। ছেলেগুলকে ধরে নিয়ে গেছে। আমারটি ছোট, তাই বেঁচেছে। পাঠিয়ে দিয়েছি বোনের কাছে। কিন্তু ওকে দেখে কিন্তু মনে হয়নি সোহিনীর যে, ও খুব শান্তিতে আছে। মেয়েটির ভেতরের দীর্ঘশ্বাস ও শুনতে পাচ্ছিল। সেই ভদ্রমহিলাও কান খাড়া করে শুনছিলেন। সোহিনী ওকে ইশারা করে থামতে বলল। চেনা নেই জানা নেই, কোনো বিপদ এসে হাজির হবে। সরল মেয়েটি যে কত নিরুপায়! বলল, দিনকাল ভালো নয়, থাক্ এসব কথা। --না গো ছেলেদুটোকে খুব পেটাচ্ছে। হাত পা নুলো করে দিয়েছে। ওর মা খুব সাদা মানুষ, কিচ্ছু বোঝে না। চেন নাকি কাউকে? একটু সাহায্য করতে পারবে তেমন কেউ? সোহিনী আর কাকেই বা চেনে! ওকেই বা কেন বলছে এত কথা! চারপাশ তাকিয়ে দেখল, কেউ শুনছে কি না। হঠাৎ সেই ভদ্রমহিলা একটি কাগজের টুকরোয় ফস ফস করে কী লিখে ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন। সোহিনী লেখাটা দেখতে পেল না। কাগজটা দিয়েই হন হন করে বেরিয়ে গেলেন। পেছন ডেকে বলল মৌসুমি, আপনি নাম লেখালেন না?
সোহিনীর রেশন কার্ডটা পুরনো হয়ে যাওয়ায় পুরোটা সেলোটেপ মারা ছিল। সেটা নিয়েও শুরু হলো সমস্যা। ওখানে কার্ড-এ ছাপ দেবে, তাই সেলোটেপ খুলতে হবে। টানা হেঁচড়া করতে লাগল সোহিনী। কি জ্বালা! কখন যে কি আপদ এসে উদয় হয়! দোকানের যে কর্মচারীটি রেশন কার্ডের সিরিয়াল লিখছিল, সে বলল, দিদি আমি ঠিক লোকের কাছে পাঠিয়ে দেব, চিন্তা নেই। ভেতরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে কাজ করছে। সে সোহিনীকে মেয়েটির কাছে পাঠা্লো এবং নির্বিঘ্নে কাজ হয়ে গেলো। সোহিনী যাওয়ার জন্যে উদ্যোগ নিতেই উঁচু গলায় আদেশের সুর শুনলো, আমাকে কুড়িটা টাকা দিয়ে যাবেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, দোকানের সেই ছেলেটি, যে বলেছিল সব ঠিক করে দেবে। কোনো কথা না বলে ওকে বলল, বাইরে এসো। ওর হাতে কুড়িটা টাকা গুঁজে দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে এলো সোহিনী। না হলে হয়তো রেশন কার্ডটাই হাপিস হয়ে যাবে।
ওর চোখের সামনে ছোট্ট সাদা কাগজ ভেসে উঠল, কী লেখা ছিল কে জানে! দরকার তো সবার...। বাইরে বেরিয়ে আসছে, তখন শুনতে পেল ভেতর থেকে ডাকছে, মৌসুমি হালদার! মৌসুমি হালদার!
ডিজিটাল হওয়ার জন্যে মৌসুমি ঘরে ঢুকল।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন