কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

কালিমাটি অনলাইন / ১৪




সম্পাদকীয়



বেশ কিছুদিন আগে সাহিত্যের একটি বিতর্ক সভায় আমন্ত্রিত বক্তা রূপে উপস্থিত ছিলাম। বিতর্কের বিষয় ছিল – ‘ইদানীং কি বাংলা সাহিত্যের বইয়ের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে?’ এটা যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে আমাদের যাবতীয় সাহিত্য উদ্যোগ এবং উদ্দীপনা ছিল মুদ্রিত বই ও পত্র-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। তখনও ইন্টারনেটের সঙ্গে আমাদের আদৌ কোনো পরিচয় হয়নি। আর তাই স্বভাবিক কারণেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কোনো পত্র-পত্রিকা বা বই পড়ার কোনো সুযোগও ছিল না। অথচ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা কেন যে সেই মুদ্রণের একচেটিয়া রাজত্বকালে বাংলা সাহিত্যের বইয়ের বাজারের মন্দা সম্পর্কে আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন, তা সত্যিই বিতর্কেরই বিষয়! আমার যাঁরা সহবক্তা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই ব্যাপারে সহমত ছিলেন যে, বাংলা বই আগের মতো এখন আর কেউ পড়ে না। এবং এই না পড়ার পক্ষে দুটি যুক্তি তাঁরা উপস্থাপিত করেছিলেন। প্রথমত, এখনকার সাহিত্যিকদের কলম আগেকার সাহিত্যিকদের মতো শক্তিশালী নয়। দ্বিতীয়ত, এখনকার ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষা মাধ্যমে পড়াশোনা করছে না।


এই বিতর্ক সভায় আমরা যারা এই ভাবনার বিরোধীপক্ষ ছিলাম, তারা দ্বিতীয় যুক্তিকে স্বীকার করে নিলেও প্রথম যুক্তির তীব্র বিরোধীতা করেছিলাম। আমার নিজেরও সরাসরি বক্তব্য ছিল যে, যে যুগের কথা বলা হচ্ছে, সে যুগের প্রায় অনেকেই তুমুল সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, এতে কোনো দ্বিমত নেই। তাঁরা যা সৃষ্টি করে গেছেন, তা কোনো কালসীমায় আবদ্ধ থাকতে পারে না, যুগের পর যুগ তাঁদের লেখা বই পড়া হবে, আর তাই বইয়ের নতুন নতুন সংস্করণও মুদ্রিত ও প্রকাশিত হবে। সেইসঙ্গে সমকালীন সাহিত্যিকদের সাহিত্য প্রতিভাও যে কোনো অংশেই কম নয়, এই সত্যও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁরা যথেষ্ঠ ক্ষমতাবান কলমের অধিকারী। তাঁরাও লিখছেন এবং লিখে যাবেন, তাঁদের বই মুদ্রিত ও প্রকাশিত হচ্ছে এবং হতেও থাকবে। অর্থাৎ এই যুক্তিতে বাংলা বইয়ের বাজারের সঙ্কুচিত হবার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। বিশেষত আমরা প্রতি বছরই দেখছি, বাংলাদেশে এবং এদেশের পশ্চিমবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে বিশাল সব বইমেলার আয়োজন হচ্ছে। অসংখ্য নতুন বইয়ের মুদ্রণ ও পুরনো বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে সেইসব বই। এবং শুধুমাত্র তো বাণিজ্যিক প্রকাশনাই নয়, লিটল ম্যাগাজিনের বিপুল আয়োজনও আছে তার পাশাপাশি। সুতরাং আশঙ্কার তেমন কোনো কারণ নেই। আর বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির সুবর্ণ সময়ে আমরা এই ধরনের দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয়ই বা কেন দেব! তবে দ্বিতীয় যে যুক্তিটি রাখা হয়েছিল, বাংলা ভাষা মাধ্যমে পঠন-পাঠন হচ্ছে না বর্তমান প্রজন্মের, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এবং সেজন্য কিছুটা চিন্তিত হতেই হয়। সত্যিই তো, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যদি বাংলা ভাষাটাই ঠিকঠাক না শেখে, তাহলে তারা বাংলা বই পড়বে কীভাবে?


কিন্তু তত্ত্বের সঙ্গে তথ্যের একটা অসংগতিও লক্ষ্য করছি আমরা সাম্প্রতিক সময়ে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ইন্টারনেট অনুপ্রবেশ করার পর ই-পত্রিকা এবং ই-বই যেভাবে প্রতিদিনই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ও আমাদের পাঠমুখিন করে তুলেছে, তাতে অন্তত বাংলা সাহিত্যের কোনো সংকট নজরে পড়ছে না। তবে যাঁরা বাংলা বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁরাই সঠিক ভাবে বলতে পারবেন, বাংলা ই-বই ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য মুদ্রিত বইয়ের কোনো সংকট ঘনিয়ে এসেছে কিনা! আমরা অবশ্য সম সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি প্রকাশনাকেই সাদরে গ্রহণ করেছি আমাদের জীবনে। যেমন আমরা আমাদের প্রকাশনী থেকে একই সঙ্গে প্রকাশ করছি মুদ্রিত পত্রিকা ‘কালিমাটি’ এবং ইন্টারনেট পত্রিকা ‘কালিমাটি অনলাইন’। আমাদের ‘কালিমাটি প্রকাশনী’ থেকে ইতিমধ্যে ২৮টি মুদ্রিত বই প্রকাশ করেছি, আবার অদূর ভবিষ্যতে ই-বই প্রকাশেরও পরিকল্পনা করেছি। বিশেষত বর্তমান প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ে বাংলা ভাষা মাধ্যমে তাদের ‘অ্যাকাডেমিক’ পড়াশোনা না করা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্য পড়ার জন্য বাংলা ভাষা আগ্রহের সঙ্গে আত্মস্থ করেছে এবং নিজেরাও কবিতা ও গদ্য নির্মাণ করছে। সুতরাং আমরা আশাবাদী এবং আমরা স্বপ্নবিলাসী।


প্রকাশিত হলো ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ১৪তম সংখ্যা। প্রসঙ্গত আবার জানাই, ‘কালিমাটি অনলাইন’ একটি সংখ্যা আমরা ‘স্বদেশ সেন সংখ্যা’ রূপে প্রকাশের পরিকল্পনা করেছি। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবেদন, আপনারা এই সংখ্যার জন্য লেখা পাঠাতে পারেন। এই প্রসঙ্গে আরও জানাই, গত ২০১২ সালে ‘কালিমাটি’ পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা একটি ওয়েবসাইট শুরু করেছি ‘সংকলিত স্বদেশ সেন’। স্বদেশ সেনের লেখা কবিতা ও গদ্য, তাঁর সাক্ষাৎকার, ছবি, তাঁর ওপর লেখা বিভিন্ন জনের আলোচনা ইত্যাদি সব কিছুই সংগৃহীত আছে। আপনাদের লেখা প্রস্তুতির জন্য এই ওয়েবসাইটটি উপযোগী হতে পারে। আপনারা লগ অন করতে পারেন : www.swadeshsenkalimati.weebly.com


এই সংখ্যার ‘স্লাইড শো’তে যে পাঁচটি ছবি আছে, তা কোনো সিরিজের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এখানে শিল্পী একটি নারী জীবনকে সময়ের সামঞ্জস্যে সাজিয়েছেন। যেমন প্রথম ছবিটির শিরোনাম Alone(একাকীত্ব), দ্বিতীয় ছবি Echo (প্রতিধ্বনি), তৃতীয় ছবি Widow (বৈধব্য), চতুর্থ Soul mate (আত্মজন) এবং পঞ্চম ছবির শিরোনাম Incomplete (অসম্পূর্ণতা)। অর্থাৎ নারী জীবনের একাকীত্ব, অসংলগ্নতা, প্রাপ্তি, মৃত্যুবোধ, বাঁচার আকাঙ্ক্ষা, বিভিন্ন টানাপোড়েন ইত্যাদি মিলেমিশে ছড়িয়ে আছে এই ছবিগুলিতে। এই অনন্য ছবিগুলির শিল্পী রূপক। রূপককে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kalimationline100@gmail.com / kajalsen1952@gmail.com

প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :

0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India








































<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১) সন্দীপ দত্ত


লিটল ম্যাগাজিনের শতবর্ষ


‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে (দেশ, মে ১৯৫৩) বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘সবুজপত্র’ বাংলা ভাষার প্রথম ‘লিটল ম্যাগাজিন’। এই কথাকে যদি মান্যতা দিতে হয়, তবে এই বছর প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’র (প্রথম প্রকাশ ২৫শে বৈশাখ ১৩২১, ইংরেজি মে ১৯১৪) একশ বছর হলো এবং সেই হিসেবে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনেরও শতবর্ষ।

বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাস যাত্রা ১৯৬ বছর আগে শুরু হয়েছিল। উনিশ শতকে ১৮১৮র ‘দিগদর্শন’ থেকে ১৮৯৯র ‘উদ্বোধন’ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি ছোট বড় পত্রিকার সন্নিবেশ। বিশ শতকের সূচনা ঘটল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশে। এই সময়ের পত্র পত্রিকার দিকে তাকালে দেখব, পত্রিকাগুলি নানা বিচিত্রধর্মী – সংবাদধর্মী কিংবা ধর্ম, সাহিত্য বিষয়ক। চরিত্রে সজ্জায় প্রায় একই। ‘সবুজপত্র’ গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ – প্রায় এককযাত্রা। সমকালের পত্রিকাগুলির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেইসব পত্রিকাগুলি নিছকই চলযাত্রা বিশেষ ছিল। অনেকটা মালগাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতোই। কোনো প্রত্যয় নেই, কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই। ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্র’ সাময়িকপত্রের জগতে নিয়ে এলো নতুন ভাবনার কথা। বিজ্ঞাপনবিহীন সাদা এ্যান্টিক কাগজে ছাপা পত্রিকাটি চলিত গদ্য সাহিত্যকে বরণ করে নিল সাদরে। ফর্মাবিরল, চিত্র ও বিজ্ঞাপনবিহীন ‘সবুজপত্র’কে লিটল ম্যাগাজিন বলার যুক্তি কি, তা আমরা আলোচনা করে নেব। প্রথমত, ‘সবুজপত্র’ মননশীল, চিন্তনঋদ্ধ পত্রিকা। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী ও নবীন লেখক অন্বেষণ। তৃতীয়ত, চলিত গদ্য আন্দোলন প্রবর্তন করে সমকালের গদ্যরীতির বদল। চতুর্থত, রবীন্দ্রনাথের মতো প্রাতিষ্ঠানিক লেখকেরও গদ্যরীতি বদলে দেওয়া। পঞ্চমত, সমকালের প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখাকে প্রাধান্য না দেওয়া। ষষ্ঠত, গতানুগতিকতার চিরায়ত রীতিকে পালটে দেওয়া। সপ্তমত, বিজ্ঞাপন ভারাক্রান্ত নয়। অষ্টমত, বিষয় বৈচিত্র। নবমত, পত্রিকাকে চলতে হয়েছে কোনো বাণিজ্যিক ভাবনাকে থোরাই কেয়ার করে। দশমত, বিশ্বসাহিত্য ভাবনা উপেক্ষিত নয়।

এই দশদিশি নিরিখে বলা যায়, ‘সবুজপত্র’র মধ্যে লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষণগুলি স্পষ্ট। ‘সবুজপত্র’র পর একশ বছরে বহু গুরুত্বপূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। ‘কল্লোল’, ‘পরিচয়’, ‘পূর্বাশা’, ‘কবিতা’, ‘চতুরঙ্গ’ ইত্যাদি হয়ে ‘উত্তরসূরী’, ‘একক’, ‘নিরুক্ত’, ‘প্রগতি’, ‘শতভিষা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘কবিপত্র’, ‘কবিতা পরিচয়’। তারপর ছ’য়ের দশকের হাংরি, শাস্ত্রবিরোধী, ধ্বংসকালীন, প্রকল্পনা প্রভৃতি ইস্তেহার ভিত্তিক সাহিত্য আন্দোলন। সেইসঙ্গে সারস্বত প্রকাশনায় কবিকন্ঠ, সুন্দরম, এবং, দর্শক, নান্দীমুখ, অমৃতলোক, কালিমাটি, খনন, মায়ামেঘ, একা এবং কয়েকজন, দিগঙ্গন, সাহিত্য, জনপদপ্রয়াস, জিগীষা, বিজ্ঞাপনপর্ব, নাইনথ কলম, ফিনিক্স, আজকের যোধন, পূর্বা, ঐক্য, ঐক্যতান, বোবাযুদ্ধ, প্রথমত, গ্রাফিত্তি, হান্‌ড্রেড মাইলস, তাঁতঘর, একুশ শতক, একুশের চর্যা, বর্তিকা, আলোচনাচক্র, কবিতীর্থ, কোরক, এবং মুশায়েরা, চর্চা, অনুবর্তন, দলছুট, অনুভাব, উজাগর – কত শত লিটল ম্যাগাজিনের চলমান যাত্রাপথ – কত আত্মত্যাগে, কত নিষ্ঠায়, কত পরিশ্রমে এই কাজ প্রতিনিয়ত করে যাওয়া। বহুরৈখিকতার প্রকাশ -- সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবাদ, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, মানবাধিকার, প্রকৃতি-পরিবেশ, নারীবাদ, যৌনতা, জীবন-যাপন, চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত, আবৃত্তি, অনুবাদচর্চা, আঞ্চলিক ইতিহাস – শত শত ভাবনার স্রোতে দীপ্যমান লিটল ম্যাগাজিন চির সবুজপত্র। সজীবতাই তার ধর্ম। শতবর্ষের যাত্রাপথের গৌরব নিয়ে তার পথ চলা – চলার পথ খোঁজা। এ খোঁজার কোনো শেষ নেই!

০২) আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ


হাইডগোরের চিন্তাজগত : কবিতা কীভাবে সৃষ্টির দরোজা উন্মোচন করে


মার্টিন হাইডেগারের সারা জীবনের দর্শন -- প্লেটোর সেই যুক্তি নির্ভর ও নিশ্চয়তা-সন্ধানী জ্ঞানের জালে আটকা পড়া পশ্চিমা দর্শনের ভ্রান্ত পদ্ধতির বাইরে, বিয়িং(Being)এর স্বরূপ আবিষ্কারের সাথে সাথে, নতুন ভাষার এক গোপন দরোজা উন্মোচনের (uncovering) দর্শন। তিনি প্লেটোর ধারার দার্শনিক যেমন দেকার্ত, কান্ট, নিটসের পাগল করা সত্য-খোঁজার পরিবর্তে- সত্যর অর্থ আসলে যুক্তি তর্ক করে কোনোকিছু পাওয়া নয় বরং সত্য বলতে তিনি সত্তার (Being) এক রকম প্রকাশ - যার মাধ্যমে একটি গোপন 'উন্মোচনকে' আবিষ্কার করা যায় - এ বিশ্বাসে চিন্তা করেছেন। তাঁর সেই ম্যাগনাম ওপাস - ‘বিয়িং অ্যাণ্ড টাইম’এ আসলে আমাদের সেই ‘আমি’কে পৃথিবীর সব কিছুর সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যা মনে করি সেখানে এই বিচ্ছিন্ন ‘আমি’ নয়, সমস্ত পৃথিবীর ‘আমি’ মানে সবার 'আমি'। কারণ তিনি বলেছেন ‘Being with’ মানে আমার পৃথিবী আমারই সত্তার(পরম!) অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই সবারই সাথে আমার ‘আমি’কে এলিনিয়েটেড, ব্যাধিগ্রস্ত একা হয়ে চলার কোনো কায়দা নাই। দর্শন আমার বিষয় নয়, কিন্তু এই দার্শনিকের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে, কারণ তিনিই প্রথম(কবি ও দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দের পরে) কবিতার যাদুময় অপার সম্ভাবনার ভাষার প্রতি আস্থা রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দার্শনিকের ভাষা সীমাবদ্ধ, এই ভাষা দিয়ে 'Being’কে আর ব্যাখা করা সম্ভব নয়। কেননা, কবিতার অবাধ, শক্তিশালি, সম্ভাবনাময় ভাষা দিয়ে ‘সত্তা’কে যেভাবে উন্মোচন করা যায়, দর্শনের ভাষা দিয়ে তা করা যায় না।

পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দার্শনিক আলোচনাই প্লাটোর সেই ‘সত্য’ খোঁজার জন্য অস্থির। এই পদ্ধতিতে আমরা সাধারণত একটি হাইপোথিসিস দিয়ে কাজ করা শুরু করি, তারপর অনেকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ, অ-প্রমাণ বাছ বিচারের মধ্য দিয়ে সত্য আবিষ্কারের দিকে যাই। হাইডেগারের মতে এই পচা সিস্টেমটাই দীর্ঘদিন ধরে জ্ঞান বিজ্ঞান তথা অভিজ্ঞতা আহরণের বিভিন্ন জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এর কোনো পরিবর্তন নেই। হাইডেগার এ বিষয়টি অস্বীকার করেন না, বরং তিনি এই সিস্টেমটাকে সন্দেহ করেন। তিনি গুরুত্ব দেন হৃদয় দিয়ে বোঝার ব্যাপারটিকে, তিনি গুরুত্ব দেন বিয়িং-এর মাঝে ‘থাকা’ প্রকৃত গুপ্তধন খোঁজার। তিনি মনে করেন, যখন আমরা বস্তুর বস্তুত্বকে শুধু প্রমাণ করার চেষ্টা করি, এর সত্য বলতে চাই, তখনই আমরা এর সাথে জড়িত অন্য সব সত্তার কথা ভুলে যাই।

তিনি এইসব কাজে বিরক্ত হয়ে কবিতার ভাষার দিকে চোখ রাখেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, কবির প্রথম কাজ হলো পৃথিবীর লুকানো সত্তার উন্মোচন, বস্তু আর বস্তুর সাথে জড়িত অন্যান্য সব বস্তুর সম্পর্ক আবিষ্কার। হাইডেগার মনে করেন, আমরা যুক্তি তর্কের বেড়াজালে আটকে থেকে আমাদের সামনে থাকা রহস্য-দরোজাটিকে এড়িয়ে গিয়েই প্রথম ভুলটি করে বসি। এভাবে দর্শনের একটি সহজ তৈরি-পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, যেখানে মনে করা হয় সব কিছুর সহজ উত্তর দেওয়া আছে। মানুষের কাজ হলো শুধু ক্রস আর টিক চিহ্ন দিয়ে পাতা ভরে রাখা। তারপর বইটাকে বন্ধ করে ফেলা। কিন্তু কবিরা কোনো বই বন্ধ করে না। আমাদের বুঝতে হবে - এই কোটি কোটি মানুষের পৃথিবীতে প্রতিটি ব্যক্তি ভিন্নভাবে অস্তিত্ব সর্ম্পকিত কাজে জড়িয়ে পড়ে। সেখানে শুধুমাত্র একটি পাওয়া সত্য -- বস্তু সম্পর্কে বা মানুষ সম্পর্কে সব কিছু বলা শেষ করে দিতে পারে না। আসলে ‘হাইডেগেরিয় আনকভারিং’এর মাধ্যমে কবিরা আরও বেশি করে সৃষ্টিসত্তার কাছে আসতে পারে। প্লেটো শেখানো যান্ত্রিক সত্য খোঁজার মাধ্যমে নয়।


কবিতা যেভাবে সৃষ্টির দরোজা উন্মোচন করে

তাঁর ‘চিন্তা’ সম্পকির্ত আলোচনায় হাইডেগার আসবাবপত্রের একজন শিক্ষানবিশের উদাহরণ আনেন। শুধুমাত্র চর্চার কারণে এই শিক্ষানবিশ মিস্ত্রি আসবাবপত্র তৈরি করে না অথবা কাজটি জানার জন্য সে মিস্ত্রি হয় না। একজন সত্যিকারের মিস্ত্রি বনে গিয়ে প্রথমে কাঠের মর্ম উপলদ্ধি করে, এর সত্তাকে বোঝার চেষ্টা করে। কবিতার জগতটাও ঠিক তাই। পৃথিবী আর সত্তা - সেই বনে থাকা কাঠের মতো যাকে পেড়ে আনা হয় -- একেবারে তাজা নতুন গাছ থেকে। তার প্রতিটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন মনোযোগ দাবী করে। যদি মিস্ত্রি প্রতিটি অংশকে এক মনে করে, তাহলে সে হয়তো একটি কাজ চালানোর মতো টেবিল চেয়ার তৈরি করে। কিন্ত তাকে কাঠে থাকা বনের সেই ‘রহস্য’ বা ‘সৌন্দর্যকে’ বাদ দিতে হয়। যে রূপ বনে ঘুমিয়ে থাকে তার সাথে বোঝাপড়ার জন্য সত্তাকে নিবিড়ভাবে জানার দরকার পড়ে, খালি কাজের ধান্দা করলে চলবে না। উন্মোচন চায় মিস্ত্রি বনে যাক, বনে গিয়ে এর রূপ রস গন্ধ বুঝুক। শুধু কাটাকাটি হলে বিষয়টি একটি মেকানিক্যাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এটি একটি সম্পর্ক, প্রাণের সাথে বনের কাঠের। যদি না হয়, তাহলে এই ক্রাফ্ট(শিল্প) হয়ে পড়বে একটি যান্ত্রিক কাজ মাত্র। একটি কাঠের টুকরোকে বুঝতে হলে মিস্ত্রিকে স্পর্শকাতর হতে হয়, তখনই তার গোপন দরোজা খোলার অভিজ্ঞতাটি ঘটে। একইভাবে পৃথিবীর সকল অস্তিত্বকে কবিতা সাড়া দেয় তার স্পর্শকাতর, নমনীয় ভাষা দিয়ে। কবি যুক্তি নির্ভর, প্রমাণ নির্ভর ‘সত্য’ খোঁজার পরিবর্তে বস্তুকে তথা তার চারপাশকে প্রাণ দিয়ে উপলব্ধ করার চেষ্টা করে। পৃথিবীর প্রতিভাবান কবিরা তাই করেন।

হাইডেগারের চিন্তায় ভাষার কাজ হলো যা কিছু অব্যক্ত, গুপ্ত ও সম্ভাবনাময় - তাকে ভাষা দেওয়া। তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে আবার ভাষার একটি সমস্যাও আছে। প্রথমত ভাষা প্রতিদিনের কাজ করতে সহায়তা করে। আবার সে সত্তার গভীর, স্বাভাবিক সত্যকেও প্রকাশ করে। আমরা আমাদের অস্তিত্বকে বোঝার জন্য যে ভাষা ব্যবহার করি, ঠিক সেই ভাষাতেই আবার একজন নরসুন্দেরর সাথে কথাও বলি। সুবিধা হলো, যারা শুধু কথা বলতে শিখেছে তারাও কখনো কখনো পৃথিবীর অনেক কিছুর ওপর আলোকপাত করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সাধারণ ভাষা সহজভাবে ব্যবহার করে বক্তা আর শ্রোতার সিদ্ধান্তকে হালকা করে ফেলা হয়। তখন কবিতা এই সমস্যা দূর করতে পারে। এটি সাধারণ বোঝার ভাষা আর দূরের রহস্যময় ভাষা বোঝার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। আমাদেরকে বুঝতে হবে কবিতার ভাষা গড়ে ওঠে ‘আনকমন’ কথা দিয়ে। ভাষার রহস্য ঘুমিয়ে থাকে এই ‘আনকমন কথাতেই’। এই সূত্রে হাইডেগারের পছন্দের কবি হলেন হোলডারলিন। কারণ এই কবি তাঁর কবিতায় ‘আনকমন কথা’ ব্যবহার করেছেন, যা প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা।

হাইডেগার আমাদেরকে নিয়ে যান সেখানে যেখানে আমরা তদন্ত আর কবিতার ভাষার মধ্যে পার্থক্য রচনা করতে পারি। তিনি মনে করেন, দর্শন কোনো অসাড় ক্ষেত্র নয়। হাইডেগার অনুসন্ধানের ভাষাও ত্যাগ করেন না। তিনি শুধু সত্তার গোপন দরোজাটি খোলার জন্য একটি নতুন ভাষা-পদ্ধতি আবিষ্কারের ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, আমরা সব জায়গাতেই দার্শনিক প্লেটোর এই সত্য-মিথ্যা জাহিরের সীমাবদ্ধ কেজো ভাষা ব্যবহার করি। প্লেটোর পদ্ধতি আমাদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, একটি যান্ত্রিক চক্রে বেঁধে ফেলে। কিন্ত অন্য দিকে কবিতার ভাষা যেহেতু ‘আনকমন’ কথাকে ধরে রাখে, সেখানে ভাষা এই যুক্তি তর্কের কাঠামো ত্যাগ করে সত্তার আরও গভীরে যায়। তাই ভাষা হয় আরও গভীর। ভাষা ‘আনকভার’ করে আমাদের সত্তার গোপান স্তর।


ছায়া: পোয়েটিক আনকাভারিং ইন হাইডেগার। বেন রজার্স।

০৩) অন্তরা চৌধুরী

মহাজীবনের চিত্রনে ‘পার্থিব’




শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’ এক মহাজীবনের আবহ সঙ্গীত। গভীরতর জীবনবোধ ও জীবন দর্শনই এই উপন্যাসের মূল কথা। এই উপন্যাসে শীর্ষেন্দু সমকালকে কখনো গতানুগতিকতার সঙ্গে কখনো বিচিত্র চরিত্র চিত্রনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। মহাজীবনের বিশ্বাসের ভূমি, একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবোধের সমস্যা এই উপন্যাসের আকর হয়ে উঠেছে। গভীর মনন ও সহানুভূতিশীল লেখক সত্তাকে সম্পূর্ণ বিকশিত করে শাশ্বত এই জীবনের অন্বেষণ করেছেন।

এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি কম বেশি প্রত্যেকেই জীবনের মানে খুঁজে পেতে চেয়েছে। অন্তহীন তাদের অন্বেষণ। এই উপন্যাসে দুই ধরনের চরিত্র আছে - গ্রাম্য ও শহুরে। বিভিন্ন কাহিনী ও উপকাহিনীর আঙ্গিকে চরিত্রগুলি বিবর্তিত হয়েছে। জীবনের কাছে চাওয়া অথচ না পাওয়ার অনির্দেশ্য বেদনাবোধ, কিছু কিছু চরিত্রের বহুমুখি মানসিক জটিলতা উপন্যাসটিকে চালিত করেছে। এই প্রসঙ্গে চরিত্রগুলির ব্যাপ্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের স্বরূপটি উদ্ঘাটন করা যেতে পারে।

উপন্যাসের শুরু হয়েছে এক অজ পাড়াগাঁয়ে, যেখানে বৃদ্ধ বিষ্ণুপদ তার ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে তার মেজ ছেলের অর্ধসমাপ্ত পাকা বাড়িটির দিকে আগ্রহ ও প্রত্যাশা নিয়ে চেয়ে থাকে। একদিকে বিষ্ণুপদর তিন পুত্র কৃষ্ণজীবন, রামজীবন, বামাচরণ এবং কন্যা বীণাপানি ও তার স্বামী নিমাই গ্রাম জীবনের দ্যোতক। অন্যদিকে মেট্রোপলিশড শহুরে শিক্ষিত চরিত্র হেমাঙ্গ, চারুশীলা, চয়ন, ঝুমকি, অনু, মনীশ, অপর্ণা, অনীষ, আপা ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও বহু চরিত্রের কোলাহলে মুখর এই উপন্যাস।

গ্রামীণ জীবনের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে বৃদ্ধ বিষ্ণুপদকে কেন্দ্র করে। পৈতৃক কিছু জমিজমা ও বাড়িকে কেন্দ্র করে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার ছেলেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ও মারামারি করে। কিন্তু কোনো ঘটনাই খুব বেশি প্রভাবিত করে না বিষ্ণুপদকে। উপন্যাসে সে অনেকটা নিরাসক্ত নির্বিকার। সমস্ত ঘটনার সাক্ষী এই পৌনে একশ বছরের বৃদ্ধ। তার সহধর্মিনী নয়নতারা তার সঙ্গে পঞ্চাশ বছর ধরে সহাবস্থান করছে। চোখের সামনে চরম অন্যায় দেখা সত্বেও বাবা হয়েও সে যথেষ্ট শাসন করতে অপারগ তার সন্তানদের।

বিষ্ণুপদ যেন বড় বেশি ভাবুক ও দার্শনিক। সে যেন বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য। সে হতদরিদ্র হলেও দর্শন ভাবনায় ভাবিত হয়ে এই জগৎ ও জীবনের তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করে। তাই সে আতাগাছের তলায় গিয়ে বসে থাকে। গ্রাম্য কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন এই বৃদ্ধ কালঘড়ি স্বপ্নে দেখে ভাবে, তার মৃত্যু আসন্ন। জীবনের শেষ কটা দিনে সারা জীবনের না মেটা সাধ মিটিয়ে নিতে চায়। রসনায় চায় পরিতৃপ্তি। বিষ্ণুপদ একজন মাটি ছুঁয়ে থাকা মানুষ। স্মৃতিমেদুর এই বৃদ্ধ বাবাকে কৃষ্ণজীবন দেশের বাড়ি থেকে একটা মধুকুলকুলি আমের পল্লব এনে দেয়। সেই আমপল্লব হাতে পেয়ে তার অপার্থিব হাসি আনন্দ অবাক করেছিল কৃষ্ণজীবনকে। দেশের বাড়িতে হয়তো অদ্ভুত কিছুই নেই। কিন্তু এখানেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন মাটির টান আর নাড়ির টান কী জিনিস!


এই উপন্যাসে সব থেকে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো কৃষ্ণজীবন, যে শহুরে শিক্ষিত হলেও তার শেকড় পোঁতা থাকে গ্রামের মর্মমূলে। এক একটা মানুষকে সারাজীবন ধরে নিজস্ব একটা যন্ত্রণার ভাষা খুঁজে ফিরতে হয়। কৃষ্ণজীবন সেই ভাষার সন্ধান পেয়েছে কিনা বলা শক্ত। মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই। একটা ওয়েল এস্টাব্লিজড জীবন পেতে হলে যা যা দরকার, তার সব কিছুই কৃষ্ণজীবনের ঝুলিতে ছিল।

ছোটবেলা থেকেই সে ভালো ছাত্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। কেরিয়ার গড়তে গিয়ে সে নিজের ভাই-বোনদের প্রতি কর্তব্যেও অবহেলা করেছে। বাবা-মাকেও প্রথম জীবনে বাড়তি যত্ন কিছু করেনি। চৈতন্যের উদয় হয় অনেক পরে। বড় বড় ডিগ্রী, মোটা মাইনের চাকরি, যোগ্য জীবনসঙ্গিনী, সন্তান, প্রতিপত্তি, সম্মান - এই সব কিছু থেকেও অনেক বেশি কিছু ছিল কৃষ্ণজীবনের সংগ্রহে - জাতীয় অধ্যাপক হওয়া থেকে বিদেশী টাকা, খেতাব সব কিছু। একটা মানুষ তার জীবনে যা কিছু চায়, তার সবটুকু থাকা সত্বেও কেন কৃষ্ণজীবন কিছুতেই সুখী হতে পারল না? জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার সেই মানুষটিরও সব কিছু থাকা সত্ত্বেও সে লাশকাটা ঘরে কেন শুয়ে ছিল, তার কোনো উত্তর আমরা আজও পাইনি। একই ভাবে কৃষ্ণজীবনের অসুখী হবার কারণও আমাদের অজানা। একমাত্র ছোটছেলে দোলন ছাড়া আর কারও সঙ্গেই তার সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়নি। এমন কী নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও নয়।

স্ত্রী রিয়ার সঙ্গেও কৃষ্ণজীবনের মানসিক সেতুবন্ধন তৈরি হয় না। রিয়ার কাছে টাকার মূল্য জীবনের চেয়েও বেশি। টাকা না পাওয়ার ক্রোধে সে তার স্বামীকে মারতেও পিছপা হয় না। মেট্রোপলিশড শহুরে শিক্ষিত মানুষের অবক্ষয়িত বিবর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। কৃষ্ণজীবন গ্রাম-শহর দ্বান্দ্বিকতার শিকার। পাষাণকারী এই নগরীর উদাসীনতার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে ওঠে। কী অসহ্য তার যন্ত্রণা। এই পৃথিবীর মানুষের মগ্ন চৈতন্যকে সে সজাগ করে তুলতে চায়। এই পৃথিবী মহাকাশ সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত, ধারণা যাতে মানুষকে স্পর্শ করে তার জন্যই সে বই লিখছিল। কিন্তু সাফল্য পেয়েছিল কতটুকু? এই পৃথিবী তাকে অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পৃথিবীর জন্য কীই বা করতে পারল! সারাজীবন ধরে সে বুঝতেই পারেনি, আসলে সে কী চায়?

একটা সময় মাটির টান ও নাড়ির টানকে উপলব্ধি করে ফিরে গেছে নিজের গ্রামে। পাকাবাড়ি করে দিয়েছে বাবা-মা ও ভাইয়ের জন্য। জীবনের যাবতীয় দর্শনের সন্ধান সে পেয়েছিল তার বাবার কাছে। তাই বিষ্ণুপদর মৃত্যুতে কৃষ্ণজীবনের মনে বিষণ্নতার বড় করুণ রং লাগিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বিষ্ণুপদর মৃত্যুর পর খালের নোংরা জলে স্নান করে যখন উঠে আসছে কৃষ্ণপদ, তখন তার বুক পাথরের মতো জমে গেছে, উষ্ণ রক্তপ্রবাহ যেন থেমে গেছে - “ব্রাহ্মমুহূর্তের বৈরাগ্যের রং চারদিকে। জীবন ও মৃত্যুর অর্থহীনতার মাঝখানে কি মহান এই পার্থিব জীবন। ক্ষণস্থায়ী, অথচ কত বর্ণময়।”

গ্রামীন জীবনে আবর্তিত হয়েছে নিমাই এবং নটী বিণাপানির চরিত্র। নিমাই ধর্মভীরু ও সৎ। কিন্তু শুধু এইটুকু নিয়েই যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না, তার জন্য আরও অনেক কিছু প্রয়োজন, তা বিণাপানি বুঝিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সমাজের কদর্যতা যে কী ভীষণ বীভৎস, তার পরিচয় পাওয়া যায় এই সম্পর্কের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্বল আত্মবিশ্বাস ও সততা। সেইটুকুকে সম্বল করেই নিমাই নিজের পায়ে দাঁড়ায়। স্ত্রীর অন্নে প্রতিপালিত এবং আত্মবঞ্চিত নিমাই নিজেই নিজের অবস্থা ফেরায়। স্বামী হিসাবে স্ত্রীকে যাবতীয় অসম্মান ও ধরা পড়ার হাত থেকেও বাঁচায়।

বাস্তুহীন, গৃহচ্যুত বীণাপানি নিমাইকে ত্যাগ করে একা লড়াই করে বাঁচতে চায়। কিন্তু নানা রকম প্রতিকূলতা ও একাকীত্ব তাকে গ্রাস করে। কিন্তু ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয় এবং শুভবোধ যে এখনো পৃথিবীতে আছে, তার পরিচয় বীণাপানির শেষ পর্যন্ত নিমাইয়ের কাছে ফিরে আসার মধ্যে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক ক্রান্তিকালের শিল্পী। তিনি অস্থির কিন্তু অনিকেত নন। দুঃখ ক্লান্ত কিন্তু দুঃখ রিক্ত নন-
“ঘরেও নহে পারেও নহে
যে জন আছে মাঝখানে”
অন্যদিকে বামাচরণ ধূর্ত ও লোভী, তার সঙ্গে বেশ কিছুটা বোকাও। শ্রীহীন রুক্ষ এই মানুষটা সারাজীবন ধরে নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থেকে গেল। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া ও বাবা-মাকে গালিগালাজ থেকে শুরু করে যাবতীয় অপকর্মে তার জুড়ি মেলা ভার।

আবার রামজীবন অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে শুধু বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে বলে। এই উপার্জনে তার কোনো আত্মগ্লানি নেই। কারও কাছে কোনো প্রত্যাশাও নেই। আছে শুধু বাবা-মায়ের প্রতি অপরিসীম ভক্তি। এও এক অদ্ভুত জীবন দর্শন। অন্তরের টানের কাছে সমস্ত সৎ ও অসৎ তুচ্ছ হয়ে যায়। একপিঠে আলো অপর পিঠে অন্ধকার। তার বৃদ্ধ বাবাকে সে তার সামর্থ্য মতো সেবা করেছে। প্রবল আর্থিক অনটন সত্ত্বেও বাবাকে জন্মদিনে কেক খাইয়েছে। খাইয়েছে ক্ষীরও - শুধু বাবার মুখে সেই অপার্থিব হাসি দেখার জন্য।

এই উপন্যাসে পটল ও গোপাল -- এই দুই ভাইয়ের মেলবন্ধনের একটি অপরূপ ছবি পাওয়া যায়। গোপাল কথা বলতে পারে না। তার যাবতীয় অস্ফুট কথা ও ইঙ্গিত বুঝতে পারে এক মাত্র পটল। সে তার ছোট ভাইটিকে খুব ভালোবাসে। সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। পটল জীবনে বড় হতে চায় তার জেঠু কৃষ্ণজীবনের মতো। কৃষ্ণজীবন তার কাছে আদর্শ। জেঠুর বড় হয়ে ওঠার সংগ্রামময় জীবনের কাহিনী সে শোনে তার দাদুর কাছ থেকে।

সংসারের যাবতীয় অশান্তি ঐটুকু ছেলের মনের গভীরে প্রবেশ করে। আগে সে অসহিষ্ণু ছিল, এখন সংসারের অবস্থা সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে। তার এক মাত্র বন্ধু পটল। সে মুখে কিছু না বললেও দাদার সমব্যথী। গ্রাম্য এই দুটি বালক চরিত্রকে বড় যত্ন সহকারে এঁকেছেন শীর্ষেন্দু। সাধারণ মানুষের ছোটখাটো সুখ-দুঃখের কাহিনী রচিত হতে থাকে পাড়াগাঁয়ে দ্বীপজ্বালা আধো আলো ছায়া, শান্ত নিরালা গৃহকোণে।

শহুরে চরিত্রগুলির মধ্যে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার দ্বান্দ্বিক রূপটি ফুটে উঠেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাওয়া, পাওয়া, রুচি, জীবনযাত্রার ধরন সবই পাল্টাতে থাকে। এরকম একটি চরিত্র হেমাঙ্গ। সে কোলাহলমুখর জীবন পছন্দ করে না। তাই বাড়ির যৌথ পরিবার ছেড়ে এসে সে আশ্রয় নেয় একটি নির্জন বাড়িতে। চাটার্ড একাউন্টে চাকুরিরত হেমাঙ্গ হাতে টাকা পেলেই জীবনকে আরও বেশি স্বচ্ছন্দ করার উপকরণ কিনতে থাকে। যেমন এসি, ফ্রীজ, মিক্সি, মাইক্রোওয়েভ প্রভৃতি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তার পছন্দের বেড়াতে যাবার স্থান হলো বড় বড় শপিং মল।

প্রবাসী সুন্দরী রশ্মির সঙ্গে সে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু কোনো ভাবেই শেষ পর্যন্ত রশ্মিকে বিয়ে করতে পারে না। বিয়ে করে ঝুমকিকে-
“বড় শক্ত বুঝা
যারে বলে ভালোবাসা
তারে বলে পুজা।”
কিন্তু শহরের যন্ত্রণাদীর্ণ জীবন ছেড়ে হেমাঙ্গ বাঁচতে চায় প্রকৃতি মায়ের কোলে। তাই সে নদীর ধারে বাড়ি নেয়। সেখানে সময় পেলেই সে চলে যায়। অন্যদিকে তার সুন্দরী শিক্ষিত দিদি চারুশীলা প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী। তথাকথিত উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি চারুশীলা বিলাস ব্যসনে ব্যস্ত।

তরুণ সমাজের এক দুঃসাহসী চরিত্র আপা যে কোনো চোখ রাঙানোকে ভয় পায় না। অপরিসীম তার সাহস, অনিঃশেষ তার আগ্রহ-
‘আঠার বছর বয়স কি ভয়ঙ্কর’
অন্যদিকে বুবকা, অপর্ণা, মনীষ, অনু, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির ধারক ও বাহক। অনু কিছুটা আল্ট্রা মডার্ণ। বাবার বয়সী কৃষ্ণজীবন হয় তার বয়ফ্রেন্ড। কৃষ্ণজীবনও যেন কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এই মেয়েটির সাহচর্যে।

আত্মভীরু চরিত্র চয়ন। সে মৃগী রোগে আক্রান্ত। ভীষণ ভাবে পরনির্ভরশীল। যখন তখন সে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। দাদার আশ্রয়ে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে এক অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসবাস করে। এইজন্য তার ভাগ্যে জোটে দাদা-বৌদির অপমান ও বঞ্চনা। মা মারা যাবার পর তার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। ভাড়াটিয়া অনিন্দিতাকে কেন্দ্র করে তার দুর্নাম ছড়ায়। এই অবস্থায় সে সাহচর্য ও ভরসা পায় চারুশীলার কাছে। আত্মবিশ্বাসহীন অসহায় এই চরিত্রটি পাঠকেরও সহানুভূতি আদায় করে।

অসংখ্য চরিত্রের উত্থান পতনের কাহিনীকে গোলাকার বৃত্তে মিলিয়ে দিয়ে শুভবোধের দিকেই যাত্রা করেছেন শীর্ষেন্দু। উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করে যে জীবনদর্শন উঠে এসেছে, তা মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়। নিজের মুখোমুখি নিজেকে বসিয়ে দেয় - সেখানে থাকে না কোনো বনলতা সেন। উপলদ্ধি করতে শেখায় এই মহাজীবনকে। তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। জীবন মহান ও মূল্যবান; প্রতিটি মুহূর্ত এমন ভাবে বাঁচতে শেখায়, যেন এই মুহূর্তটাই জীবনের শেষ মুহূর্ত। তাই সেই মূল্যবান মুহূর্তকে উপভোগ করতে শেখায়। এই জীবন অবহেলার নয়। এই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতি মুহূর্তে শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়।

জীবনকে আরও গভীর আরও সত্য রূপে অনুভব করার জন্যই কৃষ্ণজীবন প্রকৃতির সান্নিধ্য চেয়েছে। প্রকৃতি ও অধ্যাত্ম চেতনার পটভূমি উপন্যাসের মধ্যে থাকলেও কোনো রচনাই জীবন সচেতনতা হারায় না। নগর সভ্যতা মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও দিতে পারেনি শান্তি। প্রাত্যহিকতার ইঁদুর দৌড় থেকে মুক্তির জন্য মানুষ ছুটে যায় সেই গ্রামেই, যেখান থেকে তার যাত্রা পথ শুরু হয়েছিল। ছোটখাটো ঘটনা, আপাত তুচ্ছ সৌন্দর্যের ভেতর থেকে লেখক আনন্দময় এক অনন্ত জীবনের আশ্বাস পান। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ধূলির আসনে বসি’ ধ্যান দৃষ্টিতে ভূমার উপলদ্ধি।
“তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা”

০৪) সোনালি বেগম

‘অজন্তা’র সুবর্ণজয়ন্তী ও শতবর্ষের জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র



দিল্লির বাংলা পত্রিকার ইতিহাসে ‘অজন্তা’ ১৯৬২ সালে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে প্রাচীর পত্রিকা হিসেবে। দিল্লীর করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ-এর প্রাণপুরুষ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, যিনি ‘বটুকদা’ নামে ঘনিষ্ঠ মহলে সুপরিচিত, তিনিই এই প্রাচীর পত্রিকাটির নামকরণ করেন ‘অজন্তা’।

১৯৬৫-তে প্রদীপ বন্দ্যোপাধায়ের উৎসাহে এবং বিশ্বপতি ঘোষের উদ্যোগে দিল্লির প্রাচীনতম বাংলা ছাপাখানা আই. এম. এইচ. থেকে প্রথম বাৎসরিক পত্রিকা হিসাবে ‘অজন্তা’ মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন হীরেন চৌধুরী। এরপর ষান্মাসিক এবং বর্তমানে চতুর্মাসিক ‘অজন্তা’ আজও দিল্লি থেকে প্রকাশিত নিয়মিত বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকা। এই ঋদ্ধিমান পত্রিকায় বহু বিশিষ্ট কবি, লেখক লিখেছেন। যেমন নীরদচন্দ্র চৌধুরী, রানি চন্দ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ইন্দিরা গোস্বামী, শিশিরকুমার দাশ, পবিত্র সরকার, নীলরতন সেন, নবেন্দু সেন, রবীন্দ্র গুহ, সুমিতা চক্রবর্তী, জয়ন্তী চটোপাধ্যায়, চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী, কবিরুল ইসলাম, রাম বসু, শামসুর রহমান। এছাড়া আরও অনেক প্রবীণ ও নবীন ব্যক্তিত্ব। অজস্র মননশীল রচনায় ‘অজন্তা’ আলোকিত হয়েছে এবং এখনো আলোকিত হয়ে চলেছে। টানা দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত ‘অজন্তা’-র আর একটি কাজ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেটা হলো, ‘অজন্তা’ গত ২৪ বছর ধরে বার্ষিক সেমিনারের আয়োজন করে চলেছে। সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে এই আলোচনাসভায়। যেমন বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ইত্যাদি ইত্যাদি। ২০১১ সালের সেমিনারের বিষয় ছিল ‘লিটল ম্যাগাজিন’।


বর্তমানে ‘অজন্তা’র সম্পাদকমন্ডলীতে আছেন নবেন্দু সেন, বাণী গাঙ্গুলী, গোপা দে, স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়, অতনু সরকার, রমেন রায়, বিপ্রজিৎ পাল, রবীন চন্দ, মনোজিত মিত্র। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ নবেন্দু সেন-এর সম্পাদনায় ‘অজন্তা’-র কবিতা সংকলন, গদ্য সংকলন ও প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যা দিল্লি তথা বাংলাভাষাপ্রেমী সকল মানুষের কাছেই আদরণীয় এবং গর্বের বিষয়।

‘অজন্তা’-র যিনি নামকরণ করেছিলেন, সেই জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র-র এখন জন্মশতবর্ষ চলছে। ‘অজন্তা’-র পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে তাঁর কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়ছে। এই স্বল্পপরিসরের নিবন্ধে এই প্রসঙ্গে আমি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, আমাদের প্রিয় ‘বটুকদা’কে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর সম্পর্কে দু’একটি কথা আলোচনা করি।

আমরা সুরস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে বাংলার তথা ভারতের সংস্কৃ্তিতে সার্থক একজন রবীন্দ্র-অনুসারী হিসেবে পাই। রবীন্দ্রনাথ যেমন শুধুই সুরস্রষ্টা ছিলেন না, জ্যোতিরিন্দ্রও তাই। কবিতা ছাড়াও নিবন্ধ-প্রবন্ধ, আলোচনা প্রভৃতি সাহিত্যের কয়েকটি দিকে তিনি শাখা বিস্তার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিমন্ডলে যেমন সংগীত একটা প্রধান নিয়ামক ছিল, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রেরও তাই। তাঁর পিতা যোগেন্দ্রনাথ পাখওয়াজ বাজাতেন। জ্যোতিরিন্দ্র নিজেও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালিমপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর সুর এবং গানে বিভিন্ন প্রাদেশিক লোকগান ও পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল সংগীতের আত্মীকরণ লক্ষ্য করা যায়। কথা, সুর ও ভাবের যে ত্রিবেণী সংগম আমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পেয়ে থাকি, সেই ত্রিবেণী সংগম জ্যোতিরিন্দ্রের মধ্যেও দেদীপ্যমান ছিল। রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে জ্যোতিরিন্দ্র-র মধ্যেই বেশি করে এবং সার্থকরূপে ‘অপেরা’ বা ‘গীতিনাট্যে’র আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তাঁর মধ্যেই তথাকথিত গণসঙ্গীতের ধারাটির প্রথম একটি রূপ স্পষ্টরূপে ধরা দিয়েছিল।


চল্লিশের দশকে কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র রচনা করেন কয়েকটি অপেরাধর্মী কম্পোজিশন : ‘নবজীবনের গান’, ‘ঝঞ্ঝার গান’, ‘পাহাড় নদী ও মানুষের গান’ ও ‘গাজন’। কবির ভাষায় : “এলো ১৯৪৩ সাল, বাংলার ১৩৫০। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে, বিশেষ করে শহর কলকাতায়, মহামন্বন্তরের করাল ছায়া চারদিক অন্ধকার করে দিল ।... চৌরঙ্গী, কালীঘাট, লেক মার্কেটের মোড়, বালিগঞ্জ... ওদিকে শেয়ালদা, শ্যামবাজার মোড়। সর্বত্র এক দৃশ্য -- শত সহস্র কঙ্কাল। ‘ফেন দাও ফেন দাও’ বলে চিৎকার করছে।... গরু-ছাগলের খাদ্য নিয়ে মানুষে-মানুষে কাড়াকাড়ি। ডাস্টবিনের পচা এঁটোকাঁটা নিয়ে কুকুরে-মানুষে মারামারি।... এর প্রচণ্ড অভিঘাত আমার গোটা অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিল।... সুর আর কথা মনের বেদনা ও যন্ত্রণার উৎস মুখ থেকে ঝরনার মতো বেরিয়ে এলো। শুরু হলো নবজীবনের গান”। ‘নবজীবনের গান’ অপেরা বা গীতিনাট্যের কুশীলব ছিল মন্বন্তর-আক্রান্ত কলকাতার বিভিন্ন নাগরিকবৃন্দ ও দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের দল।

দিল্লির শ্রীরাম ভারতীয় কলাকেন্দ্রের সংগীত পরিচালক রূপে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র হিন্দি ও সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন কাব্য অবলম্বনে রচনা করেন অনেকগুলি গীতিনাট্য, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘রামলীলা’। সুরকার জ্যোতিরিন্দ্রর প্রতিভার প্রকাশ এর চেয়ে বেশি বোধহয় আর কোনো রচনায় হয়নি। শুধু সংস্কৃত ও হিন্দি সাহিত্যের বিভিন্ন রচনায় তিনি সুর দিয়েছেন তা নয়, সমসাময়িক বিভিন্ন কবির রচনাতেও তিনি সুরারোপ করেছিলেন। দিল্লির করোলবাগ বঙ্গীয় সংসদ প্রযোজিত পরশুরামের ‘লম্বকর্ণ পালা’ নাটকটিতে অসাধারণ সুরারোপ করেন তিনি। তিনি বেশ কিছু উন্নত মানের চলচ্চিত্রেও সংগীত পরিচালনা করে গেছেন, যেমন, ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘কোমল গান্ধার’ প্রভৃতি। এছাড়া সংগীত পরিচালনা করেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ‘আমার লেনিন’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রেও।

কবি, সংগীতজ্ঞ, গীতিকার, সংগীত-নির্দেশক জ্যোতিরিন্দ্রের সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন, তাঁরাই পেয়েছেন অবিশ্বাস্য এক নির্মল প্রতিভার ছোঁয়া, সেইসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও গণসংস্কৃতির প্রতি একনিষ্ঠ ও প্রগাঢ় বিশ্বাসের আলো। গণনাট্যের সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে তিনি ছিলেন একজন উজ্জ্বল সৃষ্টিশীলতার প্রতীক, মানুষ যাঁর ওপরে আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল। তাঁর রচিত কবিতা ও গান একসময় কেবলমাত্র বাঙালিদের কাছেই নয়, সমগ্র ভারাতবাসীর হৃদয় হরণ করেছিল।

০৫) অনিল শেঠ


স্মরণের সরণিতে – ২


[এই স্মৃতিকাহিনীর লেখক শ্রীঅনিল শেঠের জন্ম ১৯২৮ সালে। তাঁর শৈশব কাটে জামশেদপুরে, সেখানে স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করে তিনি যান কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। বিজ্ঞানে স্নাতক হবার সঙ্গে সঙ্গে বিগত শতকের চল্লিশের দশকের কলকাতায় তিনি প্রত্যক্ষ করেন দাঙ্গা, দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার সেই সব ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন আর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর ঝুলিতে জমা হয় বিচিত্র ও বর্ণময় সব অভিজ্ঞতা। গণনাট্যের প্রসারে তিনি সফর করেন অবিভক্ত বাঙলাদেশের নানা স্থানে। পরে তিনি জামশেদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম শাখা। তারপর শহরের নানা বিদ্যায়তনে শিক্ষকতার পেশায় অতিবাহিত হয় তাঁর জীবনের অনেকগুলি বছর। বিজ্ঞান-প্রদর্শনী, সায়েন্স ক্লাব ইত্যাদি নানা অভিনব কর্মধারার মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরূপে। বর্তমানে সেই পেশা থেকে অবসর নিয়েও এই বর্ষীয়ান শিক্ষাব্রতী আজও নানা ধরনের সৃষ্টিশীল মননে ও চর্চায় নিযুক্ত। তাঁর দীর্ঘ ও বর্ণময় জীবন-খাতার পাতা থেকে কিছু আকর্ষণীয় কাহিনী আমরা মাঝে মাঝে এখানে পরিবেশন করব। প্রথম পর্ব আগেই প্রকাশিত হয়েছে, এবার তার দ্বিতীয় পর্ব।]


তালাইপাট

জামশেদপুর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সিংভূমের হলুদপুকুরের কাছে ব্যাসল্ট শিলায় তৈরি এক ছোট পাহাড় তালাইপাট। সেখানে একটি গুহা আছে, যা ভেতর দিকে গভীর এবং এর একটি মুখ রয়েছে পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি। এটি ছিল একটি বাঘের গুহা ও পাহাড়ের নিচের দিকে কোথাও এর আরেকটি প্রবেশমুখ ছিল। ওপরের মুখটি খোলা থাকায় বায়ু চলাচলে সহায়তা হতো। ওপরের সেই খোলা মুখটির কাছের পাথরগুলো ছিল খুব মসৃণ। লোকের বিশ্বাস ছিল, বহু শতাব্দী ধরে ঐ পথে যাতায়াত করত শেয়ালেরা, যারা ঐ গুহায় বিশ্রাম নিত এবং সেটাই ঐ মসৃণতার কারণ।

আমি এই জায়গাটিতে যাই ১৯৪৩ সালে, তখন আমি নবম মানের ছাত্র। সে-সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। বোমা পড়েছে কলকাতায়। বিপুল সংখ্যায় লোকজন চলে যাচ্ছে শহর ছেড়ে, পালিয়ে যাচ্ছে দূরের কোনো গ্রামের উদ্দেশ্যে। জামশেদপুরেও সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলগুলো দখল করেছে মিলিটারি। পুরো শহরটা বিমান আক্রমণরোধী বেলুন-ব্যারেজ আর গভীর ট্রেঞ্চে ভর্তি। রাতে চলছে নিষ্প্রদীপ, আর দিনের বেলায় ঘন ঘন ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করে শহরের ওপর পর্দা তৈরি করা হচ্ছে। বাবা ছাড়া আমাদের বাড়ির সবাই চলে এসেছি হলুদপুকুরে, সেখানে আমাদের কিছু জমি-জমা ছিল। এই সময়ই আমি এই তালাইপাট সম্পর্কে জানতে পারি।

এক সঙ্গীকে নিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে আমি ওই গুহামুখে পৌঁছেছিলাম। ঐ খোলা মুখের ভেতর দিয়ে আমি প্রায় ন’দশ ফুট পর্যন্ত নেমেছিলাম। সেই গভীর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আরও নিচে নামা সম্ভব ছিল না। আমার সঙ্গীও ওপর থেকে আমাকে ক্রমাগত তাগিদ দিচ্ছিল ফিরে যাবার জন্য। গুহার গভীরতা থেকে ভেসে আসা দুর্গন্ধ সেখানে মাংসাশী জানোয়ারের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এখন অবশ্য জামশেদপুরের আশেপাশে পাহাড়গুলোতে বাঘ নেই, যদিও হাতি আর অন্য কিছু বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়।

আমার সঙ্গী বলেছিল, সে আর একটি মজার জিনিস দেখাবে – একটি ‘গান গাওয়া পাথর’! আমরা আর একটি খাড়াই বেয়ে উঠলাম। সেখানে দেখতে পেলাম, গভীর এক খাতের ওপর বসানো রয়েছে বড় সড় এক পাথরের টুকরো। পাথরের আকৃতি অনেকটা গোলাকার, শুধু ওপরের অংশটি প্রায় চ্যাপটা। আমরা যখন ছোট একটা পাথরের টুকরো দিয়ে ঐ শিলাখন্ডে আঘাত করলাম, একটা সুরেলা আওয়াজ বেরিয়ে এলো। কি আশ্চর্য ব্যাপার! আমি পরে জানতে পারি যে, ছোটনাগপুর গেজেটে ব্রিটিশ সরকার এই পাথরটিকে ‘সিংভূমের গান গাওয়া শিলা’ বলে উল্লেখ করেছিল। একথাও শুনেছিলাম যে, কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম থেকে একটি দল এসে এই শিলাখন্ডটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে গেছে।



এইসব স্থানগুলিকে সংরক্ষণ করে এগুলিকে পর্যটনস্থল হিসেবে গড়ে তোলা উচিৎ। অনুসন্ধানের জন্য অভিযানও সংগঠিত করা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর এতগুলি বছর পার হয়ে গেলেও কিছুই করা হয়নি। এইসব ছোট ছোট আশ্চর্যগুলি চিরায়ত আশ্চর্যগুলির সোচ্চার ঢক্কানিনাদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।

[মূল ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : অলক বসু চৌধুরী]

০৬) ইন্দ্রনীল ঘোষ

ইউরিনালের হোমো ভুত



-- কী যা তা বকছিস? ভুতে বিচি টেপে?

-- সিরিয়াসলি টেপে। ইনফ্যাক্ট টিপতে টিপতে ব্যথা ক'রে দিয়েছে।

-- ভরদুপুরে গাঁজা খেয়েছিস?

দেবা রেগেমেগে ফোন রেখে দেয়। কিছুক্ষণ মোবাইলটার দিকে থতমত তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবি, যাচ্চলে, কোথায় আমার কথা বিশ্বাস করল না ব'লে, আমারই রাগ করা উচিত, তা না উলটে নিজেই গোঁসা দেখিয়ে ফোন কেটে দিল। অদ্ভুত! শালা, নিজের বিচি হলে বুঝতে, সারাক্ষণ যন্ত্রণায় ঢিপঢিপ। সর্টসটা একটু নামিয়ে, হাত বোলাই। বেচারা এখনও গোলাপি।

বাড়ির বাথরুমে কোমডটায় জল পাস করছিল না, আদ্ধেক দিনই বিশ্রী কাণ্ড। শেষে প্লাম্বার বাবুলালকে ডেকে কাজটা দিই। সে অমনি, হ্যাঁ হচ্ছে, এই তো হলো ব'লে, যেটুকু ছিল সেটুকুও ভেঙে উপড়ে, দোকানে গেল, কয়েকটা জিনিস দরকার, এক্ষুনি আসছি। ও মা, তারপর, এক-ঘণ্টা কাটে দু'-ঘণ্টা কাটে -- বাবুলাল বেপাত্তা। শেষমেশ ফোন করায় জানতে পারলাম, দেশ থেকে খবর এসেছে, মায়ের নাকি যায় যায় অবস্থা, বাবুলাল স্টেশনে, এক সপ্তা'র মধ্যেই ফিরে আসবে।

হায় রে! কোথায় এক সপ্তা'! সেই যে গেল, আজ নয় নয় ক'রেও পঁয়তাল্লিশ দিন! এমনকি মোবাইলটাও সুইচড অফ। অন্য কোনও প্লাম্বারও পাচ্ছি না। বাথরুমের ভগ্নস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে যখন দুর্দান্ত গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে বাবুলালকে, তখনই মনে হয়, আহারে, আমার তো তবু বাথরুমের ওপর দিয়ে গ্যাছে, ও বেচারার যে মা নিয়ে টানাটানি! কী করব বুঝতে না পেরে কান্না পায়। এ' পরিস্থিতিতে কান্নাটাই একমাত্র উপায়, আমার ভাঙা বাথরুম আর বাবুলালের ভাঙা মা, দু' ক্ষেত্রেই মানানসই।



মেন গেটের ডানদিকে একটা পরিত্যক্ত বাথরুম ছিল – ইন্ডিয়ান স্টাইল পায়খানা, আর পাশে স্নান পেচ্ছাপ করার মতো একটু স্পেস। বাড়ির মালিক সম্ভবত লেবারদের বা বাইরের থেকে আসা উটকো লোকের কথা ভেবে এটা বানিয়েছিলেন। মূল বাড়ির থেকে আলাদা। এতদিন কাজে না লাগায় স্টোর-রুম হয়ে পড়েছিল। এখন অগত্যা সেখানে জ’মে থাকা নানারকম শিশি বোতল, প্যাকেট, কাঠের তক্তা সরিয়ে সেটাকেই কাজে লাগানোর বন্দোবস্ত করলাম। বাল্বও লাগালাম একটা। তারপর সেখানেই স্নান-টান সেরে দিব্য অফিস গেলাম। ফিরে এসে হাত-পা ধুতে যাব, সেই শুরু হলো গণ্ডগোল। সবে হাতে জলের মগটা তুলেছি, বাল্বটা গেল কেটে। ওইভাবেই, কোনোরকমে হাত-পা ধুয়ে, আবার দোকান, আবার বাল্ব। কী আশ্চর্য, লাগানো মাত্র ফিউজড! যাচ্চলে! লাইনে কোনও একটা গড়বড় হচ্ছে না কি? কাল ইলেকট্রিসিয়ান ডাকতে হবে। এই ভাবতে ভাবতে হিসি করার জন্য অন্ধকারেই নুনুটা বার করেছি সবে, সাথে সাথেই কে যেন সজোরে বিচিদুটো টিপে দিল। যন্ত্রণায় চিৎকার ক’রে উঠলাম প্রায় – বাবা গো!

– লাগল?

যাঃ শালা এটা আবার কে বলল?

আমি এদিক ওদিক তাকাই। যেটুকু আলো আসছে, বাইরে থেকে, তাতে কোনও মানুষ লুকিয়ে থাকলে তো দেখতে পাওয়ার কথা। তবু আমি পকেট থেকে দেশলাইটা বার ক’রে জ্বালাই, বাথরুমের বাইরেটাও দেখি। নাহ, কোত্থাও কেউ নেই। পেচ্ছাপ মাথায় উঠে গেছে। নুনুর হাত ধোওয়ার সাহসটাও হলো না।



এই গেল প্রথম প্রস্থ। দ্বিতীয় ধাক্কা খেলাম রাতে, মদ খাওয়ার সময়। তিন পেগ পেটে ঢালার পর সাহস আর মুত দুটো একসাথে পেয়ে বসল। মনকে বোঝালাম, ধুর, কেউ হয়তো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কারও সাথে কথা বলছিল, কী বেকার চিন্তা করছি এত! বোঝালাম বটে, কিন্তু আশপাশের বাড়িগুলোর আলো ততক্ষণে নিভে গেছে, মেন গেটের কাছে যেতেই, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার ওই ইউরিনালটা দেখে হার্ট-বিট তড়াক ক’রে স্ট্যান্ড-আপ। কোনোক্রমে দৌড়ে, এক হ্যাঁচকায় প্যান্টের চেন খুলে শুরু। আহ... সেই কখন থেকে হয়নি। মনের আনন্দে তিন পেগ মুতে চলেছি, আচমকা যেন একটা খসখসে হাত কেউ বিচিতে বোলাতে শুরু করল। ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটছে? চোখ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করি, তখনই...

– খুব লেগেছে?

বাবাগো মাগো করতে করতে ঘরে। প্যান্টের চেনটাও বন্ধ করা হয় না। দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে, খিল লাগিয়ে, আরেকবার ভালো ক’রে দেখি, লাগানোটা ঠিকঠাক হলো কি না।

সে রাতে ঘুম আসতে চায় না কিছুতেই। অনেকটা মদ পেটে ঢেলে কোনও রকমে। সকাল ওই দশটা নাগাদ চোখ খুলতেই দেবাকে ফোন। এর আগে ও বেশ কিছু সমস্যাতে আমায় খুব হেল্প করেছিল। শালা ও এবার ডিচ করল।

– আমি তোকে ডিচ করিনি।

– আমি তো বলিনি অলোক যে, তুই আমায় ডিচ করেছিস!

– কিন্তু আমার নাম নিয়ে গল্প লেখা, সেটা ফেসবুকে দেওয়া, এর কী মানে হয়? তুই গে-রাইটস নিয়ে মুভ করছিস কর, খামোখা আমায় জড়াচ্ছিস কেন? আমার ফ্যামিলি আছে। এটা বোঝ।

– কী অদ্ভুত, আমার গল্পে ক্যারেকটারের নাম অলোক হলে লোকজন তোকে সন্দেহ করবে!

– করতেও তো পারে। স্কুলে সবাই জানতো, তোর সাথে আমার রিলেশন নিয়ে। তাছাড়া যদি স্রেফ একটা নামের দরকার হয়, অলোক কেন? অনির্বাণ রাখ, অখিল রাখ, অসীম রাখ। অলোক কেন?

– এই নামটা আমায় একটা ফিল দেয়। অলোক আমার জীবনের প্রথম কিস। জীবনে প্রথম ব্লো-জব দিয়েছি আমি অলোককে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখে সেই গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। গন্ধটাকে ছুঁয়েছি, আদর করেছি। তুই বুঝিস না?

– আমার যে গিল্টি ফিল হয়। যখন দেখি, তুই এই সব নিয়ে কথা বলছিস, এর সমর্থনে নানা মানুষের সাথে তর্ক করছিস, ঝক্কি সামলাচ্ছিস, মিছিলে নামছিস, আর আমি নিশ্চিন্তে বউ মেয়ে নিয়ে সংসার করছি, আমার যে গিল্টি ফিল হয় তোর জন্য, এটা তুই কেন বুঝিস না?

ঘড়ির কাঁটা বেকার ছেলের মতো ঘুরে বেড়ায়। আমার দাঁত মাজা মুখ ধোওয়া কিছুই হয় না। কী যে করি, কাকে যে বলি... বাবুলালকে ফোন লাগাই কয়েকবার, যথারীতি সুইচড-অফ। এক সময় জেদ চেপে বসে – যা হবে দেখা যাবে, এরকম ভয় পেয়ে কোনও লাভই নেই, সামলাতে হবে বিষয়টাকে। তোয়ালে ব্রাশ নিয়ে আমি বাথরুমের দিকে এগোই।



দাঁত মাজতে মাজতে মনে পড়ল, আরে, দিনের বেলা তো কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কাল অফিস যাওয়ার আগে এই বাথরুমেই তো স্নান সারলাম, কই কোনও ঝামেলা তো হয়নি! কথাটা ভেবে বেশ ফূর্তি আসে মনে। যাক অন্ধকার নামার আগে অবধি আমি সেফ। সবে তো বারোটা, সন্ধে হতে এখনও ছ’ ঘণ্টা। ততক্ষণ নো টেনশন। তারপর না হয় একটা কিছু ভাবা যাবে। আনন্দে সার্ট প্যান্ট খুলে, এক বালতি ঠাণ্ডা জল, স্নান শুরু করি। সব টেনশন ধুয়ে যাও ভাই, ছ’ ঘণ্টার একটা ফ্রেস বিরতি পাওয়া গেছে।

ঠিক দু’ মগ জল ঢালার সাথে সাথেই, গলাটা আবার, আজ একটু অভিমানে, ভাববাচ্যে,

– আমায় দেখে ভয় পাওয়ার কী কারণ?

যাচ্চলে! দিনের বেলাতেও! থতমত খেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,

– দেখতে আর কোথায় পেলাম? দেখতে পাচ্ছি না বলেই তো ভয়।

– যা কিছু দেখা যায় না, সব কিছুকেই ভয় পাওয়া হয় কি?

শালা, ভাববাচ্য দেখো, শ্বশুর-ভাদ্রবউ না কি? একটু গম্ভীর হয়ে বলি,

– তুমি কে?

– ভূত।

– ভূত?

আমার গলা শুকিয়ে যায়। কী বলব খুঁজে পাই না। আর ঠিক তখনই পেন্ডুলামের মতো, নুনুটা দু’দিকে দুলতে শুরু করে। কেউ যেন আঙুল দিয়ে দোলাচ্ছে। মানে? ভূতে নুনুও দোলায়?

– আমি কি কিছু করেছি? ভয় দেখিয়েছি? আমি এলেই ওর'ম পালিয়ে যাওয়ার কী মানে?

ভয় আর যৌন অনুভূতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে এরকম পরীক্ষা বেচারা নুনুটিকে কখনও দিতে হয়নি। সে কনফিউজড হয়ে কিছুক্ষণ ভাবে, কী করবে। তারপর ধুত্তেরি ব’লে লম্বা হতে শুরু করে। ভূত কোনও কথা বলে না। এটা ভালো। কথা না বললে, ভূত যে আছে, সেটা ভাবার কোনও দায়ও আমার থাকে না। আমি খোলা মনে শিরশিরানি খেতে থাকি। লোম খাড়া হয়। নুনু শক্ত হতে হতে, একসময় মাল প’ড়ে যায়। দেখি মগখানা নিজে নিজেই জল ভরল, উড়ে এসে ধুয়ে দিল। তারপর তোয়ালের খুঁটটা মাথা বাড়িয়ে মুছে গেল। এতসব কিছু হয়ে যাওয়ার পর ভূত মুখ খোলে।

– কাল খুব লেগেছিল না?

– না। ঠিকাছে।

– আসলে অনেক বছর কারও টিপি না তো। কাল তাই তোমারটা দেখে উত্তেজনা সামলাতে পারিনি। একটু বেশি জোরে হয়ে গেছিল। সরি।

ভূত বিচিতে হাত বোলায়।

– বললাম তো ঠিকাছে।

– তোমার সাইজটা দারুণ।

আমি সৌজন্যের হাসি হাসলাম। প্রশংসা করলে এরকম হাসি হাসাটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। প্রায় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো হাসার পরেই মজা লাগে। শালা, ভূতকে জানাচ্ছি সৌজন্য, তাও কি না, নুনুর প্রশংসায়!



এই ভাবে ভয়টা কেটে যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে। রোজ স্নানের আগে ভূত আমায় মাস্টারবেট করিয়ে দেয়, ছুটির দিন ছাদে তেল মালিশ ক’রে দেয়। আমরা একটু একটু ক’রে একে অন্যকে জানতে থাকি। ভূতের ভালো স্বভাব হলো, কাজের সময় সে কথা বলে না, কাজ শেষ হলে তার গল্প। ফলে আমিও ভয় ভুলে যৌন অনুভূতিতে মন দিতে পারি, নারী-পুরুষের ভাবনা মনে আসে না, একটা পুরুষ ভূত নুঙ্কু টিপছে ভেবে গা ঘিনঘিন করতে হয় না।

– তুমি হোমো, এটা কবে বুঝলে?

আমার প্রশ্নে ভূত হাসে।

– এতে হাসার কী হলো?

– যারা হোমো নয়, তাদের অনেককেই দেখেছি এই প্রশ্নটা করতে। বোঝাবুঝির আবার কী থাকে গো? ছোটবেলায় তো ছেলে-মেয়ে দু’দলের জন্যই আমাদের নুঙ্কু অপেক্ষা করে, তারপর বড় হতে হতে নানা ঘটনা-টটনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমরা দুয়ের মধ্যে কোনও একটার ওপর বেশি ঝুঁকে পড়ি। আমি ছেলেবেলায়, মানে ওই তেরো চোদ্দ বছর বয়েসে, তো মেয়েদের সাথেও চুম্মাচাটি করেছি, ওই হয় না, মামাতো জাঠতুতো ভাইবোনে... ওইরকম। আবার আরও ছোটবেলার কথা মনে আছে, ওই ধরো চার-পাঁচ, বাবুদা কোলে নিলেই দারুণ লাগতো, ওর ঘামের গন্ধ ভীষণ টানতো আমাকে, কাছে কাছে ঘুরতাম।



“The conception which we gather from this long known anatomical fact is the original predisposition to bisexuality, which in the course of development has changed to monosexuality, leaving slight remnants of the stunted sex.

It was natural to transfer this conception to the psychic sphere and to conceive the inversion in its aberrations as an expression of psychic hermaphroditism.”

Innate bisexuality... পড়েছিলাম। ফ্রয়েড। কিন্তু সে তো বহু পুরনো মত। তারপর তো অনেকেই বলেছেন, সমকামিতা জন্মগত ব্যাপার। নানা স্টাডি, রিসার্চ পেপার আছে এর ওপর। এমনকি L.G.B.T এক্টিভিস্টদের অধিকাংশ এই দ্বিতীয় মতকেই মানেন। ভূত যা বলছে, তা তো দেখতে গেলে, সেসবের উলটো। কে জানে? এই নিয়ে কোনও শেষ কথা হয়তো এখনও বলা যায় না। আমাদের জীবন নানা আলোর ম্যাজিক। মাথা, জিন – আমরা অনেকটাই তৈরি হয়ে আসি জন্মের আগে, নির্ধারিত হয়ে আসি। জন্মের পর সে’ সবের সাথে যখন পরিবেশ এসে মেশে, সবসময় ঠিক ক’রে বলা যায় কি, কে কাকে গড়ছে, ভাঙছে? ভূত নিজেই তো একটু আগে বলছিল, চার-পাঁচ বছরে ছেলেদের ঘামের গন্ধ টানতো ওকে। এমনও তো হতে পারে যে, জন্মগতভাবে সে সমকামী। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সমাজে বাকি সমবয়েসিদের দেখে শুনে সেও মেয়ের সাথে প্রেম সেক্স ট্রায় করে, কিন্তু শেষ অবধি টান না পেয়ে আবার ফিরে আসে তার মূল প্রকৃতিতে।



এ’ কনফিউসনের কোনও সোজা উত্তর নেই। আমি কথা ঘোরাই।

– কাজ কী করতে?

– চায়ের দোকান ছিল।

– কোথায়?

– হাওড়া স্টেশনে। প্রথমে পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে ঠেলা নিয়ে বসতাম। তারপর নতুন প্লাটফর্মগুলো হওয়ার পর ওদিকটায় উঠে যাই।

– তা আমার ইউরিনালে এসে উঠলে কোত্থেকে?

– মরার পর থেকেই আমি একটা ইউরিনাল খুঁজছিলাম, ভিড়-ভাড় নয়, একটু ফাঁকা, যেখানে আরামসে থাকা যাবে, মাঝে মধ্যে দু’এক জন এলে তাদের সাথে মস্তি করা যাবে।

– তুমি তো বড়ো আজব হে! ভূতেরা তো শুনেছি বেলগাছ, পোড়ো বাড়ি এইসবে থাকে। ইউরিনালে থাকে, এর’ম ভূতের কথা তো বাপের জন্মে শুনিনি!

ভূত একটু অভিমানের সুরে বলে,

– তুমি শোনোনি এমন অনেক কিছুই হয়। হাওড়া স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে যে ইউরিনালটা আছে, সেটাতে গেছ কখনও?

আমি একটু অবাক হই,

– হ্যাঁ গেছি হয়তো। কেন?

– দেওয়াল দিয়ে দু’ভাগ করা ইউরিনালটা। ভেতরেরটাতে যেও কখনও, রাত সাড়ে নটা, দশটার পর। তুমি জানো না, ভাবতেও পারো না, এমন অনেক কিছু দেখতে পাবে।

– কী?

– চোষা, লাগানো সব... খুল্লামখুল্লা... অন্য সময়ও চলে, তবে চোর-ছ্যাঁচোড় পুলিশের ঝামেলা আছে ব’লে একটু সামলে সুমলে, রাতের দিকটায় একদম ওপ্পেন...

কী মারাত্মক! বলে কী! এ’ তো এইডসের উৎসব!

– কন্ডোম লাগায় না?

– ধুর। ওসব জায়গায় আবার কেউ কন্ডোম টন্ডোম লাগায় না কি? রোজ রাতে বাড়ি ফেরার আগে যেতাম। একবার তো এক রাতে টানা আট জনের সাথে। সবাই গোল ক’রে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, মধ্যে আমি একে একে চুষে দিচ্ছি। গেটের কাছে আবার একজন নজরও রেখেছে বাইরে, যাতে হঠাৎ কেউ এলে সিগন্যাল দেয়। সাতজনের চুষে দিলাম, আর শেষে যে গেটে ছিল, সে ঢোকালো... প্যান্ট-ট্যান্ট টেনে হিঁচড়ে, সে কী কাণ্ড। উহ...!

ভূতের আনন্দ দেখে আমি থ। কী বলব, ভেবে পাই না। ও ব’লে চলে,

– একবার বোধহয় কেউ একটা কন্ডোমের মেশিন লাগিয়ে গেছিল, ইউরিনালের দেওয়ালে, ওই হয় না, এক টাকা দিলেই কন্ডোম বেরোবে। কিন্তু কোনোদিনও সেটা দিয়ে কোনও কিছু বের হতে দেখিনি। আমরা করার সময় ওই মেশিনটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। পরলে যদি ফুল পুণ্য হয়, তাকালে অন্তত কিছুটা তো হবে। কি?

ভূত হাসতে থাকে।

– অত ভেব না গো, অত ভেব না। শুধু হাওড়া স্টেশন একা নয়, এরকম হাজার হাজার ইউরিনাল, পার্ক, সিনেমা-হল আছে, যেখানে কন্ডোম না পরেই সব কাজ চলে। আমাদের তো তবু ওই কন্ডোমের মেশিনটা দেখার সুযোগ ছিল। ওদের সেটাও থাকে না।



“The arrest of four people on charges of homosexuality and running an online gay club in northern India has triggered criticism by NGOs and the United Nations’ AIDS body, UNAIDS.

Police in Lucknow, the capital of Uttar Pradesh state, said the young men arrested last week had dozens of members in their secret Internet club.

Homosexuality is illegal in India but is prevalent undercover. Many night clubs in New Delhi and other cities even host secret gay and lesbian nights. But if convicted, homosexuals face at least 10 years in jail.

UNAIDS says making homosexuals criminals increases the stigma and discrimination they face, hindering the battle against HIV/AIDS.

...

“We’re concerned at the arrest of a number of men who have sex with men in Lucknow,” Denis Broun, UNAIDS India coordinator, told Reuters on Wednesday, adding there was a need to repeal “archaic” 19th century laws banning homosexuality.

“Criminalisation of people most at risk of HIV infection may increase stigma and discrimination, ultimately fuelling the AIDS epidemic.”

India has 5.1 million people with HIV/AIDS but UNAIDS and non-government organisations (NGOs) say the numbers are much more. The country is second only to South Africa in the number of HIV cases. ...”

পুরনো কাগজগুলো বিক্রির জন্য নামিয়েছিলাম। প্রায় কিলোখানেক কাগজ জ’মে ছিল স্টোর রুমে। বিদায় করলাম। আজ রোববার। আমার তেল-মালিশের দিন। অথচ সকাল থেকে ভূতের দেখা নেই। ভাবছিলাম। আর সাথে সাথেই গলা।

– কী করছ?

– এই... স্টোর রুমটা হাল্কা করছিলাম।

ভূতের কোনও সাড়া-শব্দ পাই না। হঠাৎ মনে হয়, সে আমার হাতটা ধ’রে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, দিব্য বুঝতে পারছি।

– কী ব্যাপার বল তো?

– আজ আমার জন্মদিন, গিফট দাও।

আমি হাসি।

– আরে গ্রেট। হ্যাপি বার্থ-ডে

– গিফট?

– কী নেবে বল?

ভূতের কোন্‌ জিনিস প্রয়োজনে লাগে, সেটা টের পাওয়া আমার পক্ষে একটু চাপের।

– একটা জিনিস চাইবো, রাগ করবে না তো?

– না না, বল।

– কেক কাটব...

ভূতের গলাটা খুবই আদুরে হয়ে যায় শব্দ দুটো বলার সময়। ‘কাটব’-তে একটা লম্বা ঝোঁক দেয় সে। আমি হেসে বলি,

– একদম। পাক্কা। আজ সন্ধেয় পার্টি।



সন্ধেবেলা সাকচি থেকে দু বোতল ওয়াইন তুললাম। তারপর কেক। কিনে বিল মেটাতে যাব, দেখি কেকের সাথে মোমবাতি ফ্রি। দোকানদার ছেলেটি জিগ্যেস করল, “কত বয়েস?”

এই রে! সেটা তো জানি না। তাছাড়া ভূতের বয়েস কীভাবে মাপা হয়? তার মারা যাওয়ার দিন থেকে, না মানুষ হিসেবে জন্মেছিলো যেদিন সেদিন থেকে; এটাও তো জানি না। পড়লাম মহা ধাঁধায়। শেষে ফ্রি আর নেওয়া হলো না। তার পরিবর্তে মুদির দোকান, এক প্যাকেট ছোট মোম।

আয়োজন দেখে, ভূত খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। বারবার নানা কথায় জানাচ্ছিল। আর আমি ম্যাজিক দেখছিলাম। চাকু শূন্যে উঠে কেক কেটে ফেলল, মোমবাতি নিভে গেল, তারপর এক পিস কেক যখন হাওয়ায় আমার মুখের কাছে ভেসে আসছে, জন্মদিনের নয়, জাদুর মজাতে হাততালি দিতে দিতে বললাম - হ্যাপি বার্থ-ডে।



ঘরে সাদা আলোগুলো বন্ধ ক’রে টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বালানো। এই আলোয় ওয়াইন খেতে আমার ভালো লাগে। ওয়াইনের রঙ, দানা দানা ঝরতে থাকা সেডিমেন্ট, সবটাই নেশার অংশ মনে হয়। ভূতকে বলি, “মদ খাওয়ার সময়, তুমি আমার পিছনে ব’সো”। ভূত বলল,

– কেন?

– দ্যাখো কিছু মনে ক’রো না। তোমার সাথে কথা বলতে, তোমার আওয়াজ শুনতে আমার ভালোই লাগে। কিন্তু মদ খেতে খেতে ওই শূন্যে গ্লাস উঠে যাওয়া দেখলে, আমার নেশাই হবে না। একটা ভিস্যুয়াল ইরিটেশন হতে থাকবে ক্রমাগত।

ভূতের কি অভিমান হলো? বললো,

– আমি ভূত না হলেও তোমার সেটা হতো।

– মানে?

– মানে, আমি যখন ধরো বেঁচে ছিলাম, তখনও অনেকে এর’ম বলত, কী মেয়েলি হাবভাব কর তুমি, চোখে নেওয়া যায় না... এইরকম কত কথা।

– আরে চটছো কেন? আমি তো সেভাবে কিছু বলিনি!

– না না। ঠিকাছে। আমি পেছনেই বসছি।

ভূত কোনও কথা বলে না এরপর। সেটা অবশ্য যে খুব খারাপ লাগছিল, তা না। ভূত তো আর মানুষ নয়, দৈর্ঘ্য প্রস্থ আয়তন কিচ্ছু নেই, তাই তার ভালো-মন্দ লাগা নিয়ে সবসময় অতো না ভাবলেও চলে। আমি মদ চালাতে থাকি। প্রথম গ্লাস শেষ হওয়ার পর ভূত নিজের থেকেই কথা বলে, গলার স্বরে নেশাটা ধরেছে।

– তুমি খুব ভালো, জানো?

– কেন? তোমায় পিছনে বসতে বললাম ব’লে?

– আরে না না। সেটা বাদ দাও। ছোটবেলায় একবার এক বন্ধুর জন্মদিনে কেক কাটা দেখেছিলাম, আমাদের সবার নেমতন্ন ছিল ওইদিন ওদের বাড়িতে। খুব মজা হয়েছিল। সেই থেকে ভীষণ ইচ্ছে করত আমার জন্মদিনেও কখনও ওর’ম কেক কাটা মোম নেভানো হবে। কিন্তু কোনোদিনও হয়নি। সুমিত একবার বলেছিল, ঘটা ক’রে এবার তোর জন্মদিন করব দেখিস। কিন্তু তারপর আর হয়নি।

– সুমিত?

– আমার প্রথম...

– বয়ফ্রেন্ড?

– হুম। বলতে পারো। ও অবশ্য বলত, ওর নাকি মেয়েদের দিকেই টান। আমাকে বন্ধু ভাবে খালি। অথচ করার সময় সব করত। মাঝে মাঝে খুব রাগ হতো, জানো? ভাবতাম ধুর, এমন একজনের সাথে সম্পর্ক রাখার কী মানে হয়, যে সম্পর্কটাকে মানতেই চায় না। আবার পরে ভাবতাম, আমি তো সম্পর্কটা টের পাচ্ছি, সেটাকে ভালোবাসছি, বড় করছি, এটাই আমার কাছে সব। আসলে খুব টানতো ও আমাকে।

– তা জন্মদিন পালন হলো না কেন?

– আমার বিয়ে হয়ে গেল তার আগেই। বিয়ের পর ওর সাথে বেশি কথা হতো না আর।

– বিয়ে!

গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে চমকাই।

– তুমি হোমো, সেটা বোঝা জানার পরেও বিয়ে করেছিলে?

ভূত একটু ঘাবড়ে যায়।

– আমি চাইনি। আমি মানা করেছিলাম। সত্যি। বাড়ির লোকজন কীভাবে সুমিতের ব্যাপারটা জেনে গেছিল। সবাই খুপ চাপ দিচ্ছিল। মা বলল, সবাই বিয়ে করে, প্রথম প্রথম সবারই একটু অসুবিধে হয়, তারপর মানিয়ে নেয়। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কী করব। সুমিতও শুনছিলাম, কোনো একটা মেয়েকে প্রপোজ করেছে, বিয়ে করবে। ভাবলাম, হয়তো মায়ের কথাই ঠিক, এটাই স্বাভাবিক। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম তো রাতে বুঝতেই পারতাম না কী করব, কোনও সাড় পেতাম না। তারপর ধীরে ধীরে কিছু বছর বাদে একটা মেয়েও হলো। সে বড় হলো। কিন্তু কোনোদিনই যে স্বাভাবিকের কথা মা বলেছিল, সেটা পেলাম না। আড়ষ্ট লাগত বউয়ের পাশে শুতে। চেষ্টা করতাম যাতে ওর ভালো লাগে। কিন্তু পারতাম না। সাড় পেতাম না। আর বারবার মনে হতো, আমার এই না পারা, এই চেষ্টা, যেন মাধবী ধ’রে ফেলছে। লজ্জায় শেষ হয়ে যেতাম রোজ।

– মেয়েটা তাহলে হলো কী ক’রে?

– জানি না। কখন কীভাবে কী যে হয়ে যায়! সব জা’গায় তো আলো পড়ে না গো।

– থামো। বড় বড় কথা ব’লো না। দু’ দুটো মানুষের জীবন নষ্ট করেছ। ছিঃ...

আমার বকুনিতে কেঁদে ফেলে ভূত। শরীরহীন তার গোঙানির আওয়াজ মিউজিকের মতো ঝুলতে থাকে আমার আলো-অন্ধকার ঘরে। হঠাৎ কেমন যেন, চারপাশের সমস্ত, এই ঘর রাত ওয়াইনের বোতল, এমনকি নিজের থাকাটুকুও অশরীরী হয়ে যায়।

– আমি তো সবকিছু সামলাতেই চেয়েছিলাম, সবকিছু। অথচ কী ক’রে যে ছোটর থেকে আমার প্রত্যেকটা কাজ মানুষের কাছে ভুল হয়ে যায়, আমি জানি না। সুমিত বলত, ভারতে এসব হয় না, ফরেনে হয়। মা বলত, এ’দেশে বিয়ে না করলে, জ্ঞাতিগুষ্টি পাড়া-পড়শি সবাই আড়ালে হাসি ঠাট্টা করবে। ভাবতাম, দেশ ব’লে কথা, সে কি আর ভুল হতে পারে? আমিই ভুল... আমিই...

Ayisha-sultan Begim whom my father and hers, i.e. my uncle, SI. Ahmad Mirza had betrothed to me, came (this year) to Khujand^ and I took her in the month of Sha'ban. Though I was not ill-disposed towards her, yet, this being my first marriage, out of modesty and bashfulness, I used to see her once in lo, 15 or 20 days. Later on when even my first inclination did not last, my bashfulness increased. Then my mother Khanim used to send me, once a month or every 40 days, with driving and driving, dunning and worrying.

In those leisurely days I discovered in myself a strange inclination, nay! As the verse says, ‘I maddened and afflicted myself’ for a boy in the camp-bazar, his very name, Baburi, fitting in. Up till then I had had no inclination for any-one, indeed of love and desire, either by hear-say or experience, I had not heard, I had not talked. At that time I composed Persian couplets, one or two at a time; this is one of them:

“May none be as I, humbled and wretched and love-sick;

No beloved as thou art to me, cruel and careless.”

From time to time Baburi used to come to my presence but out of modesty and bashfulness, I could never look straight at him; how then could I make conversation (ikhtildt) and recital (hikdyat) ? In my joy and agitation I could not thank him (for coming); how was it possible for me to reproach him with going away? What power had I to command the duty of service to myself? One day, during that time of desire and passion when I was going with companions along a lane and suddenly met him face to face, I got into such a state of confusion that I almost went right off. To look straight at him or to put words together was impossible. With a hundred torments and shames, I went on. A (Persian) couplet of Muhammad Salih's came into my mind:

“I am abashed with shame when I see my friend;

My companions look at me, I look the other way.”

[Babur-nama / translated by: Annette Susannah Beveridge / Page: 120]

ভূতের ফোঁপানি আর বন্ধ হয় না। পাশে শুয়ে একা একা ফুঁপিয়েই চলে। আমি বলি,

– ওঠো, আর কাঁদতে হবে না। আমার ভুল হয়েছে। সরি।

ও আমার ঊরুতে হাত রাখে।

– তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। আরেকটা উপকার ক’রে দেবে? এটাই শেষ। এরপর আর কোনোদিনও কিছু চাইব না। এটা হলেই, আমি মুক্তি পাব, তারপর এই ভূত ছেড়ে... দেশ ছেড়ে... কি মজা! ভুল নেই, লজ্জা নেই... জন্মদিন আর মৃত্যুদিনের মধ্যে বারবার ডিগবাজি নেই। করে দেবে?

– কী?

– আমায় একবারটি চুষতে দেবে?

– ব্লো-জব?

আমি থতমত খাই।

– কতদিন... কতদিন করিনি তুমি জানো না। জীবনের শেষ তিরিশ বছর, গোটাটাই খাঁ খাঁ... কেউ নেই... জানো? ইউরিনালেও বয়েস বেশি ব’লে আদ্ধেকের ওপর ছেলে নাক সিঁটকে চ’লে যায়। করতে দিত না, ধরতে দিত না। আমি পাগলের মতো ভুল ক’রে বেড়াতাম, বউয়ের সাথে মেয়ের সাথে ইউরিনালের ওই ছেলেগুলোর সাথে দেশের সাথে, ভুল ক’রে বেড়াতাম, তবু কাউকে পেতাম না, যারটা একটু চুষে দিই। দেবে?

স্কুল কলেজে যাওয়ার সময় ট্রেনে বাসে, হঠাৎ প্যান্টে হাত, টিপছে... এ’ অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই। অধিকাংশই বয়স্ক। হেটেরোসেক্সুয়ালদের মতো যে কোনো বয়েসে মেয়েদের পিছনে নুনু লাগিয়ে দেওয়ার মতো নয়। অস্বস্তি হতো। আবার এটাও ভাবতাম, একজন মানুষ যৌন-জীবনে কতটা অসহায় হলে এখানে এসে পৌঁছোয়! মায়া হতো। আমার কোনও ক্ষতি তো ও করছে না, করুক না, ওর যদি একটু ভালো লাগে, করুক।

একবার খুব মজা হয়েছিল। অমিত আর আমি জামশেদপুর থেকে হাওড়া যাচ্ছি। ট্রেনে। গেটে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ হিজড়ে। আমার কাছে আসতেই, আমি টাকা পয়সা কিচ্ছু না দিয়ে, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগলাম। ব্যাস। হয়ে গেল। আমায় আর টাকা দিতে হলো না। পরিবর্তে হিজড়েটি আমার প্যান্টের জিপারের কাছে টিপতে টিপতে গেটে দাঁড়ানো বাকিদের থেকে উসুলি নিতে থাকল। এই দৃশ্যে অমিতের হলো থতমত অবস্থা। সে হাঁ ক’রে একবার আমার মুখের দিকে একবার আমার জিপারের দিকে। এতটাই অবাক যে, কারও প্যান্টের জিপারে ওরকম চোখ গোল গোল ক’রে তাকিয়ে থাকাটা যে মোটেও সভ্য-ভদ্রোচিত নয়, সেটা তার মাথা থেকে গায়েব।



যাই হোক। ওই সময়গুলোতে একটা কথা বারবার মনে হতো, এ-ও এক ধরনের ভিক্ষে। যৌন-ভিক্ষে। সব দেশের ভিক্ষে তো এক হয় না!

পরবর্তীকালে অর্ঘ্যর (দত্ত বক্সী) এক ফেসবুক আপডেটে এই যৌন-ভিক্ষে শব্দটা প্রথম পড়ি। ভীষণ ভালো লেগেছিল।



– মরলে কীভাবে?

ভূত চুপ ক’রে থাকে। কিছুক্ষণ পর জবাব দেয়।

– ছাড়ো না। কী হবে?

আমার ভয় হয়, AIDS কেস নয়তো? একটু জোর করি এবার। বেশ কিছুটা সময় পর বলতে শুরু করে সে।

– ডিসেম্বর মাস ছিল, আমি তাই তাড়াতাড়ি দোকানের পাট মিটিয়ে, ঝাঁপ নামিয়ে বাড়ির জন্য রওনা দিই। প্লাটফর্ম ফাঁকা প্রায়। ঠাণ্ডাটাও যেন একটু বেশি পড়েছিল ওই দিন। রোজকার অভ্যাস মতো, যাওয়ার আগে একবার ইউরিনালে ঢুঁ মারি। বেশি লোক ছিল না। মাত্র তিনজন। তাদের মধ্যে একজন দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে ইশারাও করছে। ভাবলাম, আহা আজ কী ভাগ্য, কতদিন বাদে কেউ আমায় ইশারা দিল! আমিও কাজে লেগে গেলাম। এতটা ডুবে গেছিলাম, খেয়ালও করিনি, কখন আরও কিছু লোক এসে দাঁড়িয়েছে আমার পিছনে। এত রাতে ওখানে যারা আসে, তারা সবাই-ই প্রায় হোমো, তাই খুব বেশি দেখার দরকারও পড়ে না। লোকটার হয়ে-টয়ে যাওয়ার পরে থুতু ফেলে, মুখ ধুতে যাব, ওমা দেখি যে ছেলে চারটে দাঁড়িয়ে আছে, আমারই পাড়ার, কাকা কাকা বলে। লজ্জায় ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসি। কীভাবে মুখ দেখাবো বুঝতে পারি না। তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাব ভাবছি, ঠিক তখনই ওরা বেরিয়ে আসে। বলে, কি কাকা আমাদেরটা না ক’রে দিয়েই চ’লে যাচ্ছ? লজ্জায় মাথা হেঁট ক’রে দাঁড়িয়ে থাকি। কী করব, কী বলব, কিছুই ভেবে পাই না। মাথার ভেতরটা প্লাটফর্মগুলোর মতোই ফাঁকা আর ঠাণ্ডা হয়ে আসতে থাকে। ওরা বলে, আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন, কাকা-ভাইপোতেও তো হয়, না-কি? তারপর প্রায় জোর ক’রে আমায় ট্রেনে ওঠায়। খুব যে খারাপ ব্যবহার করছিল তা নয়। কিন্তু আমার ভীষণ ভয় করছিল, যদি কিছু হয়, সোরগোল করে পাড়ায় গিয়ে! ওরা সের’ম কিচ্ছু করল না কিন্তু। চুপচাপ আমায় নিয়ে ক্লাবে গেল। আমি বললাম, ক্লাবে কেন? তাতে ওরা জানালো, ক্লাবে এখন কেউ নেই। তারপর ওদের মধ্যে একজন চাবি দিয়ে দরজা খুলল ক্লাব ঘরের।

– তারপর?

– আমার প্যান্ট খুলে উইকেট ঢোকাতে লাগলো পিছন দিয়ে। রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করছি দেখে একজন ধমক দিল। আরেকজন বলল, আরে শুধু পোঁদে ঢোকালে কি কাকার শান্তি হয়, কাকার মুখে চাই, মুখে। সবাই হাসতে লাগল ওর কথায়, আর সাথে সাথেই একটা উইকেট মুখে ঢুকিয়ে চাপ দিতে লাগল।

– থাক, আর বলতে হবে না।

– আমার দাঁত ভেঙে গেছিল, জানো? সেটা দেখেও ওরা থামেনি। আমার মাথাতেও মেরেছিল।

– থাক, বললাম তো!



কিছুক্ষণ চুপচাপ। ওয়াইন-এর বোতলটা শেষ হয়ে গেছিল। আমি শুয়ে পড়ি। ভূত প্যান্ট খুলে দেয়। জাঙিয়া নামায়। তারপর নুঙ্কুটা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করতে করতে মুখের মধ্যে পোরে। একটা অদ্ভুত সাকসান যেন ওপর নিচ করছে লিঙ্গ বরাবর। শিহরণ বাড়তে থাকে। ভূতকে যদি দেখতে পেতাম এই মুহূর্তে! একটা হাত ওর চুলে রাখতে ইচ্ছে করছিল। আমি হাতটা শূন্যে বাড়িয়ে রাখি। এটা আমার যৌন সম্পূর্ণতা, ভূতের মাথায় এ' হাত হয়তো কোনোদিনও পৌঁছবে না, হয়তো ভূতের কোনও শরীরই নেই, তবু...

একসময় মাল প'ড়ে যায়। উত্তেজনা কমে। ভূতের সাড়া পাই না। উধাও হয়েছে। মনে মনে হাসি - আমার বীর্যপাতে এক আত্মার মুক্তি হলো আজ, এ-ও কি এক ধরনের জন্ম-দেওয়া নয়? হাসতে হাসতে জাঙিয়াটা টেনে ওঠাই। কিন্তু এ' কি! আমার লিঙ্গ ছোট হচ্ছে না কেন? যাচ্চলে! নেড়েচেড়ে দেখি, নাহ, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, কোনও রকম কোনও উত্তেজনা তো নেই! অথচ সাইজ এখনও আট ইঞ্চি! মোটা। মুক্ত হয়ে ভূত কি তবে আমার লিঙ্গে গিয়ে ঢুকলো?



সেই থেকে, সেই রাত থেকে আমার যা-তা অবস্থা। জাঙিয়া পরতে পারি না, প্যান্ট পরতে পারি না, শুধু লুঙ্গি। তাও সে যেন লুঙ্গি ফুঁড়ে মাথা বার ক'রে আছে, এক প্রতিবাদের মতো। যেন এক্ষুনি তার আগায় একটা পতাকা লাগিয়ে দিলেই স্বাধীন হয়ে যাবে সব-কিছু। দেবা এসেছিল, আমার বাকি বন্ধুরাও। পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজন সবাই এসে দেখে গেছে। কেউ কেউ অধিক কৌতূহলে টিপেও দিয়েছে। আমার লিঙ্গ যে-কে-সেই। ডাক্তার ওষুধ কতো কী! কাল থেকে বোধহয় আমায় হসপিটালাইজড করা হবে। শুনেছি, দেশের বড় বড় ডাক্তাররা জড়ো হবেন সেখানে। আমায় নিয়ে একটা সেমিনার হবে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। এরকম অদ্ভুত ঘটনা এর আগে কেউ দেখেনি। দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার। কত সহজে নর্মাল থেকে এব-নর্মাল হয়ে যাওয়া যায়!

এক স্বাভাবিক ভূতের অস্বাভাবিক যৌন-প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমার লিঙ্গ।

০৭) তুষ্টি ভট্টাচার্য


কাগজফুল


বোগেনভিলিয়া না বলে কাগজফুল বললে বেশি ভালো লাগে। ওর রঙিন কিম্বা সাদা পাতলা পাতলা পাতাগুলো পালকের মতো ভাসতে থাকে, হাসতে থাকে হাওয়ায়। একটু হাওয়া দিলে কাগজফুল চলে যেতে পারে বাগান থেকে জানালায়। ঝড় উঠলে পাশের পানা পুকুরটায় ওদের পাতলা কাগজ-লাশ ভাসতে থাকে। আর তেমন শুকনো খটখটে, বা রোদ ঝলমলে দিনে ওরা গাছের গায়ে আহ্লাদে লটরপটর করতেই থাকে, করতেই থাকে।

বোগেনভিলিয়ার পাতা যথারীতি সবুজ থেকে আরও সবুজ হয়ে ওঠে। তরতর করে বেড়ে ওঠে ডালপালা। গুল্ম থেকে গাছ, গাছ থেকে বৃক্ষ – অবশ্যম্ভাবী এই পরিবর্তনের মাঝে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। বোগেনভিলিয়া কি সম্পূর্ণ বৃক্ষ হতে পারে? একটু ঝুঁকে পড়া নমনীয়তা তার জন্মগত দোষ। বড় হতে হতে বৃক্ষের দৈর্ঘ্য পেলেও এলিট ক্লাসের আভিজাত্য পায় না।

কাগজফুল তো মিথ্যে ফুল। না সে পাতার সবুজ পেয়েছে, না ফুলের সৌরভ। মৌমাছির দল গুনগুন করে না তার কাছে। মধু নেই তার কোষে। তার গর্ভ নেই, বীজ বোনার সখ তাকে মানায় না। রঙিন-পাতা সুখই তার সম্বল। তার ঝিরঝিরে সুখে অবশ্য এ জন্য কোনো বাদ সাধেনি। হাওয়ায়, রোদে সে দিব্যি ফুরফুরে থাকে, মনের আনন্দে মশগুল সে। শুধু বৃষ্টি এলে বড় বিপর্যস্ত হয় কাগজফুল। ভিজে নেতিয়ে মৃতপ্রায় পাতা-ফুল ঝরে পড়ে দলা দলা হয়ে। আবার রোদ উঠলে নতুন কিশলয়, নতুন রূপ পায় কাগজের ফুল।


বৃষ্টিতে মহাসুখি কাগজফুল গাছের পাতা। ঢাল ঢাল ঘন সবুজ পাতায় কী বাহার তখন! চকচক করে জ্বলে ওঠে পাতার চোখ। শরীর বাঁধ মানে না, ডাক দেয়, খুঁজে ফেরে তারই কোনো দোসরকে। পাতায় পাতায় গড়ে ওঠে প্রেম-বাহার। জলে ধ্যাবড়ানো কাগজফুল হিংসেয় জ্বলে। তার নিজের রূপ দেখে কান্না আসে হু হু করে। আকুল হয়ে রোদ চায়, আরও আরও রোদ চায়।

অবশেষে বৃষ্টিদিন শেষে রোদ আসে। কাগজফুল পূর্ণতা পায়। সেই মিথ্যে ফুলের ভেতরে জেগে ওঠে সত্যিকারের ফুল। তারার মতো সেই ফুলকে আগলে রাখে পাতা-ফুল মায়ের মতো । ছায়া দেয়, ওম দেয় নিজের বুকের। কোনো এক নিভৃত দিনে অলি এসে বসে সেই ফুলে, গুনগুন করে, পরাগ মাখা পা নিয়ে উড়ে যায় অন্য কোনো তারা ফুলে। সেদিন কাগজফুলের হাসি আর ধরে না! সেদিনই কাগজফুল সত্যিকারের ফুল হয়ে যায় মনে মনে।

০৮) সুচিত্রা সরকার

জলের গান





ছলাৎ ছলাৎ ছল। প্রথম এ শব্দ শুনি সাত কি আট বছর বয়সে। মামাবাড়ি কুমিল্লার হাওড় অঞ্চলে। বছরের ছ’মাসই সেখানে নৌকা চলে। তো, যাচ্ছি ছৈয়া নৌকায়। শুনলাম জলের গান। কেমন যেন ছলাৎ-ছল, ছলাৎ-ছল! কার সঙ্গে ছল, কে জানে! সঙ্গে ছিল শাপলা-শালুক আর কচুড়িপানার বাড়াবাড়ি আনাগোনা। খানিক দূরেই দেখি, একেবেঁকে সাপ যাচ্ছে। প্রায় মাথা খারাপ হবার যোগাড় আর কি! তখন তো আর ডিসকভারি চ্যানেল ছিল না। আমার জীবনে সেটাই ডিসকভারি। বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি। অফুরন্ত দুরন্তপনার সুযোগ। বিলে হাঁটু জল। বিলে বিলে ঘুরছি সমবয়সী ভাইবোনদের সঙ্গে। বিল থেকে শামুক-ঝিনুক তুলে আনছি। ডলি মাসির হাঁসগুলোর জন্য। চার-পাঁচদিন ঝিনুক ভাঙার পর একটা মুক্তো পেয়েছিলাম। গোলাপী। জামার পকেটে যত্নে ছিল বেশ কয়েক দিন। কিন্তু এতো কিছুর পরেও জলে নামতে সাহস হয়নি। সাঁতার জানি না যে!

তাই উপায় বেরোলো। এবার থেকে হাফইয়ারলি পরীক্ষার পর ছুটিতেও মামাবাড়ি আসতে হবে। তখন তো পুকুর প্রায় শুকনো। পাড় থেকে দশ-পনেরো হাত এমনিই যাওয়া যায়। সেই সুযোগে সারা দুপুর দাপাদাপি। ‘বাইয়্যা রে বাইয়্যা... কি রে বাইয়্যা, মাইছ্যা ডা কি? কাঁচকি মাছ? দিবি নি? ধরতে পারলে নে...! বলেই ডুব জলে। তারপর তাকে ধরার জন্য হুড়োহুড়ি - সেই জলেই। এরকম কত খেলা খেলেছি। কখন সূর্যটা পশ্চিমে হেলেছে, কে জানে! দাদু ছিপ হাতে তেড়ে আসত। কিন্তু আমরা কি আর শুনতাম!



পূর্ণিমা রাতে বিপ্লব মামাকে যেন ভূতে পেত। মামা ডেকে তুলত আমাদের সকলকে। বড়রা তখন নাক ডাকছে। নৌকায় ওঠে বসেছি আমি, তাপস, শ্যামল, নিকসন, বলাই মামা। জাল ফেলা হচ্ছে চাঁদের আলোয়। ছোট ছোট খইয়্যা-শিং, পুঁটি জালে আটকেছে। সকালে সেই মাছভাজায় এক থালা ভাত সাবড়ে দিতাম! কী তার স্বাদ!
একবার জলে ভূত দেখেছিলাম। দাদাবাড়ি গিয়েছি। গ্রীষ্মকালেই। আমি, বিজলি পিসি, রেখা দিদি, কাজলী-মিলন-সবাই মিলে স্নান করতে নেমেছি। হঠাৎ, বিজলি পিসি পুকুর থেকে হুড়মুড় করে পাড়ে ওঠে গেল। হলো কী? কী আবার? পিসি পাইন্যা ভূত দেখেছে। পাড়ে বসেই বিস্তারিত বয়ান। আমরাও দেখতে চাইলাম। কেউ দেখা পেল না। আমি তো তখন থেকেই গল্প বানাই। নামলাম আবার জলে। ডুব দিয়ে চোখ খুলে তাকালাম। ভেসে উঠলাম। আবার পাড়ে। এইবার আমিও দেখেছি। সবুজ রঙের একটা ভূত! নিচে একটা গাছের মতো কিসে যেন ঝুলে ছিল! বর্ণনাটা বিজলি মাসির চেয়ে ভালো ছিল। তাই সেদিনের হিরো আমিই।

একবার মহরমের মেলায় বিশ টাকায় কিনেছিলাম একটা লঞ্চ। সেটায় কেরোসিন তেল ভরে বারান্দায় পানি আটকে - সেখানে দিলাম ছেড়ে। যেন এইমাত্র আবিষ্কার করলাম জলের যান। পড়ি মড়ি করে চলে এলো সবাই আমার লঞ্চ দেখতে। সারাদিন সেই লঞ্চে মালামাল পার করছি। সঙ্গে টুনু আপুর পুতুলগুলোকেও বাপের বাড়ি পাঠাতে হচ্ছে সেই লঞ্চেই। পরের বছর অন্যরাও একেকটা লঞ্চের মালিক বনে গেল।
আস্তে আস্তে জলের গান আমার ভেতরে বাড়তেই লাগল।

৯৭ সালের মে মাস। ছুটির পর ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ এক ফোঁটা হাতে পড়ল। রীতিমতো শিহরণ লাগল। যেন প্রেমিকের প্রথম স্পর্শ! গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে! তারপর নামল ঝমঝমিয়ে। ভিজে বাড়ি গেছি। হেঁটে হেঁটে। সারা শরীর কাঁপছে। আনন্দে-আহ্লাদে শরীর মন কাঁপছে।

সেবার খুব বৃষ্টি হয়েছিল। হয়তো আমার দুটো বয়সের সন্ধিকাল বলেই! একটা বৃষ্টিও মিস করিনি। কখনো ভিজতে না পারলেও মুখে ঝাপটা দিয়েছি জলের। শীলাবৃষ্টিতে বালতি ভরে ফেলেছি শিলায়। একটার পর একটা খেয়েই যাচ্ছি। সে কি উত্তেজনা! ব্যাঙের ঘ্যঙর ঘ্যঙ শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত।


সমুদ্রে সঙ্গে প্রেম আরও অনেক পরে। বলতে গেলে বড়বেলায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে।

বাসে ওঠেই মন ভীষণ খারাপ। কেন এলাম! ধূর ছাই! মন পুড়ছে তাঁর জন্য। তাঁকে ঢাকায় রেখে এলাম। বাস পৌঁছল ভোরে। বাস কক্সবাজার পৌছবার পরই হঠাৎ জানালা দিয়ে সাদা সাদা আঁকা বাকা রেখা চোখে পড়ল। বন্ধুরা বলল, দেখো সমুদ্র! শরীর ঝমঝমিয়ে উঠল। আরেকবার। জীবনে ঢেউ দেখিনি। এতো শুভ্র-সাদা! ছুটে যেতে ইচ্ছে করল। ব্যাগটা কোনো মতে হোটেলে রেখেই সমুদ্রে অবগাহন। মনে আছে, ঢেউগুলো যখন একটার পর একটা বাড়ি খাচ্ছিল আমার পায়ে, আমি উত্তেজনায় চিৎকার করছিলাম। এতো সুন্দর কি সহ্য করা যায়! লবণ, রোদ, বালু - সব পেছনে ফেলে মেতেছি সমুদ্রে। তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি। লাবণী পয়েন্ট, এক নম্বর পয়েন্ট সব পেছনে। হঠাৎ হাটুজল থেকে কোমর জলে পড়ে গেলাম। দু’পা এগোতেই বুক পর্যন্ত ডুবে গেছি। ঢেউ তেমন একটা নেই সেখানে। কোনো মানুষও চোখে পড়ছে না। সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা তখন। বুঝলাম, সামনে এগোলে জল আরও বাড়বে। আর জলের প্রেমিকা আমি, জলকে জীবনে ভয় পাইনি। তাই সাঁতার শিখতে ইচ্ছে করেনি কখনো। মরণ এলে, মরব। তা বলে, জলের হাত থেকে বাঁচতে সাঁতরে বাঁচতে হবে, এটা মনে আসেনি কখনো। তাই এইবার পেছানোর কথাই মনে এলো। আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়লাম। তারপর তীরে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। সমুদ্র কি আমায় টেনে নিতে চেয়েছিল? না হলে এতো কাছ থেকে ডুবতে হবে কেন? পরে ঘটনাটা অন্যদের বললে, স্থানীয় রাখাইন আদিবাসীরা বলেছিল, এখানে গভীর একটা চোরাবালি আছে।

তবু ভালোবাসা একবিন্দু কমেনি। সেবার আরও একদিন সমুদ্রের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম আমরা। স্যার রাজি হয়নি। ফেরার পথে কেঁদেছি আর স্যারের মৃত্যুকামনা করেছি। বলেছি, তিনি যেন ডুবেই মরেন। এমনই ছেলেমানুষি!

পরে আরও অনেকবার গেছি। হেঁটেছি। জল ছুঁয়েছি। বালির ভেতর থেকে হাতড়ে তারামাছ আবিষ্কার করেছি। কিন্তু জলকে ভয় পাওয়া হয়ে ওঠেনি।

আরেকবার কেঁদেছিলাম সমুদ্রের জন্য। সেবার সেন্টমার্টিন গেছি। ঢাকা থেকে বিকেলে চট্টগ্রাম। রাতের বাসে টেকনাফ। সকালে সেন্টমার্টিন। সেখানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা। বারবিকিউ, নুড়ি কুড়ানো। পরদিন ছেড়াদ্বীপ অভিযান। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন বৃদ্ধাও ছিলেন। কপালের ফের! কেন, সেটা বলছি। ছেড়াদ্বীপে হেঁটে যাওয়া যায়। একটা রাস্তা আছে সেন্টমার্টিন থেকে যাওয়ার। সেটা জোয়ারে ডুবে যায়। ভাটার সময় জেগে ওঠে। কিন্তু আমরা যেতে যেতে ভাটার সময় শুরু হয়েছে। দুঃখ হলো খুব। সমুদ্রের বুকের ভেতর হাঁটা হলো না। ট্রলারে গেলাম। ট্রলার দ্বীপ অবধি পৌছোয় না। পনেরো-বিশ হাত দূরে প্রবালে আটকে যায়। সেখান থেকে নৌকায় যেতে হয় তীরে। বিপত্তি বাধলো। নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বৃদ্ধারা নামতে চাচ্ছেন না নৌকায়। তাঁদের রেখে যাওয়াও যাচ্ছে না। একজন তো বিদ্রোহ করে জলে ঝাঁপ দিলেন। ভাগ্যিস সাঁতার জানতেন! তিনি ঘুরে এলেন দ্বীপ পর্যন্ত। আমি এবং কয়েকজন নেমেছিলাম ট্রলার থেকে নৌকায়। তারপর প্রবাল দ্বীপের জলে পা রেখেছিলাম। এ কী! মনে হলো, বড় বড় চীনামাটির প্লেট, তার ওপরে কার্পেট বিছানো! কেঁপে কেঁপে উঠছি আনন্দে। এদিকে ঢেউ বাড়ছে। জোয়ার বাড়ছে। ফিরে যেতে হবে। বৃদ্ধারা সূরা ফাতিহা পড়া শুরু করেছেন। লাইফ বোর্ড বেধে নিয়েছেন গায়ে। অগত্যা ট্রলারে উঠলাম। সেন্টমার্টিন যাওয়া পর্যন্ত সারা পথ কাঁদলাম। আর ছেড়াদ্বীপকে বলে এলাম, “এই চোখের জলের দিব্যি, আমি আসবোই তোমার কাছে। তোমাকে পুরোপুরি দেখা হলো না যে! কিন্তু আজও যাওয়া হয়নি। শুনেছি, ছেড়াদ্বীপ ডুবে যেতে পারে। অপেক্ষা করছি, তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। জলের গান শুনতে।

<<< চারানা আটানা >>>


০১) অমিতাভ প্রামাণিক



চারানা আটানা



১০)
নববর্ষ ১৪২১


জানালায় চুপি চুপি উঁকি মারছে নতুন বছরের রোদ। অভিমানী গলায় গান গাইছে – কখন বসন্ত গেল এবার হলো না গান। সুনীলদা লিখে গেছেন, কেউ কথা রাখেনি। সত্যিই রাখে না কেউ। যে মর্যাদা প্রত্যাশিত, তার ধারে কাছে পাচ্ছে না এবারের নতুন বছর।

অথচ বছরে তো একবারই আসে সে। গরমটা এবারও বেশ, কিন্তু কোনোবার কম হয়? হ্যাঁ, দোকানে দোকানে গণেশকে সোজা করে রাখা হয়েছে, ধূপধূনোও যে পায়নি, তা নয়। ধারবাকি অন্যান্য বারের মতো এবারেও যথাসম্ভব মিটিয়ে নেওয়া হয়েছে। হালখাতার বন্দোবস্তও উঠে যায়নি একেবারেই। মোবাইল ফোনের কল্যাণে ক্যালেন্ডারের হ্যাপা এখন অনেক কমে গেছে। মা দুর্গা, মা কালী, মা লক্ষ্মীর ফটোর চেয়ে রাগিনী এসেমেস টু-র পোস্টার অনেকে বেশি করে চাইছে দেওয়ালে ঝোলাতে। সময়ের সঙ্গে রুচি তো অল্পবিস্তর পাল্টাবেই! আগের মতো গপগপিয়ে ডজন ডজন লুচি খেতে কি চায় এখনকার পোলারা?


বসন্ত চলে গেল। চুপিসাড়ে। সে চলে গেল, বলে গেল না – টাইপ। আমের বাগানে অলির গুঞ্জরণ ছিল, কেউ খেয়াল করেনি। আম তো এমনি এমনি ফলে না! তার জন্যে অলিকে বারবার ফিরে আসতে হয়।

অথচ আমাদের অর্থাৎ আম আদমিদের ভাগ্যাকাশে কী আম নাচছে, তার জন্যে সেজে উঠেছে গোটা দেশ। অনেক লেখাজোখা হয়েছে এ নিয়ে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের দাবীতে লড়ছে সবকটি দল। তাদের প্রার্থীতালিকায় অবশ্য সেই একই মুখ। মানে গতকাল যারা দুর্নীতির অভিযোগে দায়ী ছিল, আজ তারাই সচ্চরিত্র প্রশাসক হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে – রোটি-কাপড়া-মকান জোগাবে দেশের মানুষকে। বারবার ফিরে আসা অলির দল না তো কী? স্টেজে উঠলে পাগলা দাশুর মতোই বলতে হবে – আবার সে এসেছে ফিরিয়া!

নববর্ষ নিয়ে তাই নতুন কিছু লেখার নেই। হ্যাঁ, টিভিতে কিছু প্রোগ্রাম হবে। লালপাড় সাদা শাড়িতে কিছু সুবেশা তরুণী নাচবে – এসো হে বৈশাখ এসো এসো-র সঙ্গে। ট্রাফিক সিগন্যালে বাজবে – নব আনন্দে জাগো আজি নব রবিকিরণে। মধ্যাহ্নের প্রবল গরমে হাঁসফাস করতে থাকা আধহাত জিভ বের করা কুকুরটা ছায়ায় বসে থাকবে, তাকে দেখে বোঝা যাবে – ‘প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে’ কী বস্তু। দীর্ঘ দগ্ধ দিনের দারুণ অগ্নিবাণ নিয়ে সে প্রতি বছরই আসে, এবারও তার ব্যত্যয় হবে না। 


এবার আকাশ বাতাস মুখরিত ভোটরঙ্গে। আগের সংখ্যায় এর কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরেছিলাম গদ্যে। কিন্তু এই অনির্বচনীয় কান্ডটি – পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ৮৪ কোটি লোকের ভোটদানের মাধ্যমে কেন্দ্রে সরকার গড়ার পেছনে যে সুবৃহৎ আলাপ-আলোচনা – তা দাবি করে অন্তত কয়েক লাইন ছড়া। তা থেকে আপনাদের বঞ্চিত করলে আমি মহাপাতক হব না?

এ নিয়ে মহাকাব্য লেখা যায়। তবে গরমে কিনা মাথার ঠিক নেই, তাই মাত্র কয়েক স্তবকে এর কিছু ছাপ থাক।

এ যে ঘোর কলি! ফুঁসছে নাগিনী
ঢালবে কোথায় বিষ তাহার!
প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে
রাস্তায় হাঁটে ইস্তাহার।

বটগাছতলে মন্দির হবে,
দাদারা বাঁধিয়ে দিলেক শান –
দিদিরা বলল, পেঁয়াজি পেয়েচো?
সামনে এখন ইলেকশান!

পুলিশমন্ত্রী কমিশনারকে
বললে, ভরুন ফ্রেশ টোটা
বন্দুকে সব। এ বাজারে হিট
সুপাঠ্য ম্যানিফেস্টো তার।

সবাই নাচছে উদ্দাম নাচ!
একজনই ছিল যাও বা ধীর,
বেফাঁস একটা কোশ্চেন করে
তকমা পেয়েছে মাওবাদীর!

শীত চলে গেছে। গরম বাড়ছে।
বাড়ে মখমলি গদির ওম –
পরবে কি লোকে গান্ধীর টুপি?
না কি ওতে হবে মোদির হোম?

কাল দিয়েছিলে কচুপোড়া খেতে,
দেবে নাকি তবে আজ মা ওল?
মায়াদিদি নাকি ডোনেশনে তার
কেনাবেচা করে তাজমহল!

আমসত্ত্বটা বাঁদরে খেয়েছে
পড়ে আছে শুধু বয়াম মা’র!
শাড়ি ও পাদুকা রাখবেন বলে
দিল্লীটা চাই জয়-আম্মার!

হানাহানি ছেড়ে শান্তির বারি
ছিটাই, হৃদয়ে দি বুলায়ে?
যাদবাধিপতি কৃষ্ণের কাজ
কে করবে, লালু? কি মুলায়েম?

নীতীশ-নবীন কর্মঠ লোক
গদিতে বিহার উড়িষ্যায়।
বোঝে না দাদা না দিদি হবে সেফ
তাই উঠে পড়ে দু’রিকশায়!

এরা যে কী খেয়ে দেশ চালাবেন
পাচ্ছে না রাজজোটক থৈ –
ডিশে আছে তিন মূলি কা পরাঠা
একটু আচার, ও টকদই!

এসব খেয়ে কি দেশ চলে ভায়া?
তাই নেওয়া হাত পা টিপিয়ে –
সারাদেশ জুড়ে কচিকাঁচা পার্টি,
দলিত-গলিত বা সিপিয়েম!

বেদ ঝাড়ে কেউ, কেউ আম্বেদ,
কেউ কোট করে অমর্ত্য –
দু-পাঁচটা সীট কোনোমতে পেলে
আউটসাইড সমর্থন!

পিএম বলবে, আর জ্বালিও না,
রাখবো কোথায় এলবো, বোন?
বোন গোঁসাঘরে খিল দেবে, চেয়ে
আরও কিছু পোস্ট, রেলভবন।

মা বলবে ডেকে, তুই গোমুখ্যু,
বৃথাই ঝামেলা পোয়ালি, সন –
দরকার ছিল পাগলের সাথে
জোট বেধে এই কোয়ালিশন?

তামিল-তেলুগু-মাল্লুরা নাচে
বাংলা-মরাঠী-হিন্দী আর
গুজরাতি-পঞ্জাবী ও ওড়িশি –
ইনক্রেডিব্‌ল্‌ ইন্ডিয়া!

তামাশা দারুণ, আমাশাও বাড়ে
গরমে, তাই তো শোক সবার –
এ ভোটরঙ্গে, সবার সঙ্গে
চলো ভোট দিই, লোকসভার।

এ লেখা যখন আপনারা পড়ছেন, তখন বেশ কিছু অঞ্চলে ভোট হয়ে গেছে। বেশ কিছু অঞ্চলে ভোট হওয়া বাকিও। আপনার পছন্দের প্রার্থীকে আপনার মূল্যবান ভোটটি দিতে ভুলবেন না। হ্যাঁ, এবারে পছন্দের প্রার্থীর তালিকায় ‘নান অফ দি অ্যাবাভ’ও আছে।

স্বাধীনতার পর সাতষট্টি বছর হতে চলল। এখনও ভোটের ইস্তাহারে ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর প্রতিশ্রুতিকেও হাস্যকর মনে হয়। কেউ কথা রাখেনি। কেউ কথা রাখে না। আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা আমাদের নিজেকেই করে নিতে হয়। অবহেলিত হয় আমাদের যৌথ প্রয়াস, আমাদের সমাজ, আমাদের রাজ্য, আমাদের দেশ। বারোভূতে লুটেপুটে খাওয়ার জন্যেই যেন এদের সৃষ্টি।

এ বিষয়ে কিছু বলার মতো যথেষ্ট প্রজ্ঞা আমার নেই। ছেলেমেয়েদের গায়ে একটা নতুন সুতির জামা উঠুক এই পয়লা বৈশাখে, একটু মিষ্টিমুখ হোক, ছুটিতে একটু দার্জিলিং-নৈনিতাল-সিমলা হোক। এটুকুই।

সবাইকে নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।

<<< অণুরঙ্গ >>>


০১) সুভাষ ঘোষ


দিয়া



মূল কাহিনী - শোভা দে                 নাট্যরূপ - সুভাষ ঘোষ

বি.জে.পার্ক মর্ণিং ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশান, সল্ট লেক, কলকাতা পরিবেশিত শ্রুতিনাটক (২০০৬)

(চরিত্র : বুড়িমা – আধা বাংলা জানা, হিন্দি-ভাষী,  বয়স ষাট বৎসরবাবু – বছর চল্লিশের বাঙালি।) 
                      
[ছোট মফঃস্বল সহর, ঘিঞ্জি পরিবেশ, বাজারের বাইরে -- চলাপথের পাশে। নানা                                                                                                                                                হকারের  ফিরি করার আওয়াজ, নানা শব্দ, মানুষের গুঞ্জন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়। শুধু বুডিমার গলা শোনা যায় -- দূর থেকে হাঁক দিচ্ছে -- শব্দ ক্ষীণ থেকে স্পষ্ট হয়--]


বুড়িমা- দিয়া লিবে, দিয়াআআআআআ! মিট্টি কা দিয়াআআ! সস্তাওয়ালে মিট্টি কা দিয়া। দিয়া লিবে, দিয়াআআআআআ--  
বাবু বাঃ বুড়িমা! এবারও তোমার সঙ্গে দেখা হলোকেমন আছো?
    বুড়িমা- হাপনাকেতো পহচানলাম না  
বাবু না,না, আমাকে তোমার চেনার কথা নয়, আমি তো এখানে থাকি নাআজ কয়েক বৎসর ধরে দেওয়ালীতে এখানে বেড়াতে আসি। তোমাকে দেখে মনে হলো আগেও দেখেছিতুমি আমার অনেক দিনের চেনা
বুড়িমা-তো দিয়া খরিদেন্! রূপয়া মে পাঁচ--
বাবু আরে আমি প্রদীপ নিয়ে কী করব? আমার কি এখানে বাড়ি?
বুড়িমা-তো ফির আতে কাহে হো? হর সাল কেনো আসেন? কুথায় আসেন?
বাবু আমার এক আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে আসি - জায়গাটা আমার খুব ভালো                                                                                   লাগে।
বুড়িমা-তো উয়াদের বাড়িতে রোশনাই জ্বালাইবেন লেন বাবু, বিস পচ্চিশ টাকার দিয়া লিয়ে যান - ভালো দিয়া আছে - তেল শুষবে না। ভালো মাটির দিয়া।
বাবু ওরা বড়লোক, মাটির দিয়া জ্বালায় না
বুড়িমা-কিয়া আমীর, কিয়া ফকির, আজকাল কোইভি মাটির দিয়া জ্বালাতে চায় না                                                                                                  বাবু! সোবাই টুনি জ্বালায় ইলেট্রী বত্তি জ্বালায়
বাবুসব জেনেও তো তুমি মাটির প্রদীপই বিক্রি করছ!
বুড়িমা-বাবুজী, বুতাম দাবিয়ে মিট্টি কা দিয়া জ্বোলে নাপ্যারসে, ইক ইকটা কোরে জ্বালতে হোয় - দিয়ার রোশনাই দিল্ আলো কোরে বাবুজী। বাকী সোব তো চোখে ভিল্কি দিখায় - দিয়া জ্বোলে, তেল পুড়ে - মায়ের বুকে প্যার পয়দা হোয় - আঁখ সচ্চা দিখতে শিখে - ইন্সানের মোনের হিন্সা জ্বোলতে জ্বোলতে রাখ হয়ে যায় - ছাই হোয়ে যায়
বাবুহাঃ,হাঃ,হাঃ,হাঃ - বুড়িমা তুমি তো বেশ ভা্লো ভালো কথা বল - তোমার কথা শুনতে আমার বেশ ভালোই লাগছে - কিন্তু এবার তো আমাকে যেতে হবে।
বুড়িমা-(স্বগতোক্তি) যানে তো সবকো পড়েগা - আজ ইয়া কল
বাবু আরে না, না, ঠিক আছে - এখুনি যাচ্ছি না; অমন করে হাত ধরে আটকাতে হবে না। আচ্ছা বেশ, যাওয়ার আগে বিশ পঁচিশ না পারি, পাঁচ দশ টাকার  দিয়া আমি নিশ্চয়ই কিনে নিয়ে যাব।                                                                        
বুড়িমা-না না দিয়া লিবার কোথা বোলছি না বাবুজী; ইকটা কোথা পুছবো বাবুজী?
বাবুবল না, এত দ্বিধা কেন? কী এমন কথা?
বুড়িমা-(খুব আস্তে) তুমার কাছে মুবাইল আছে?
বাবু(মৃদু হেসে) এই জানার জন্য এত দ্বিধা! আছে আমার কাছে মোবাইল আছেকিন্তু, মানে... তোমার কী দরকার বল তো?  
বুড়িমা-না না, হামি লিব না - হামি লিব না। মতলব তুমাকে সাওধান কোরে দিচ্ছি। ই জগহ বহোত খতর্নক্ আছে - চোর-চোট্টা - বদমাশ সোব ঘুরে বেড়ায় - মওকা মিলতে হী চুরাই লিবে - সম্ভালকে রখনা --
বাবু ও, তাই বলো; ঠিক আছে, এবার আমি যাই - দাও আমাকে পাঁচ টাকার প্রদীপ দাও – একি, আবার কী হলো, আরে আরে! আবার হাত জড়িয়ে ধরছ  কেন - আহা, আমাকে তো যেতে হবে -- কিনা!
বুড়িমা-বাবুজী, তুমার মুবাইলটা হামাকে দিবে?
বাবু মানে! এই যে বললে তুমি নেবে না! কী করবে তুমি আমার মোবাইলটা দিয়ে?                                                                                              
বুড়িমা-না, লিব না - হাতে লিয়ে ইট্টু দেখবো - ফির তুমাকে ওয়াপস্ কোরে দিব।
বাবু তাই বল, শখ হয়েছে - ঠিক আছে, এই নাও, দেখ।
বুড়িমা-সোন্দর, বহোত সোন্দর, বহোত বঢ়িয়া, কিতনা শানদার - ওনেক দাম আছে, তাই না বাবুজী?
বাবু উমম্, তা একটু পয়সা তো লাগবেই - যন্ত্র তো; তবে তোমার প্রদীপগুলোও                                                                                                                            সুন্দর, যখন আলো দেয় তখন আরও সুন্দর লাগে 
বুড়িমা-ক্যা বোলে? ইয়ে মিট্টি কা দিয়ে? কৌন পুছতা হ্যায় আজকাল! সভী কো মুবাইল চাহিয়ে ...লো, তুমহারা মুবাইল লো বাবুজী।
বাবু থ্যাঙ্ক য়ু বুড়িমা, দাও দাও আমায় প্রদীপ দাও এই দ্যাখো আবার হাত ধরে আটকাচ্ছো কেন ? কী মুশকিল - আরে তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
বুড়িমা-বাবুজী হামাকে ইক্টা মুবাইল লাগিয়ে দিবে?
বাবু বুঝলাম না।
বুড়িমা-তুমার মুবাইলে বাত কোরতে দিবে? হামি কথা বুলবো-
বাবু(অট্টহাস্যে) তুমি কথা বলবে? কার সঙ্গে কথা বলবে? স্বামীর সঙ্গে?
বুড়িমা-(অট্টহাস্যে) উ তো ভাগল বা মুঝে ছোড়কে ভাগ গয়ে।
বাবু(ব্যথিত) তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে?  
বুড়িমা-(অট্টহাস্যে)মোরে ভূত হোয়ে গেছে - হাঃ,হাঃ,হাঃ,হাঃ (ব্যথিত) আনেক দিন আনেক দিন বিছড় গেছে - ইয়াদ ভী নহী হ্যায় খ্যার ছোড়ো উওসব বাঁতে দো ন বাবুজী একবার বাত করনে!                                                                                                                                                                                                                                                                           
বাবুকার সঙ্গে কথা বলবে তা তো বল - ছেলের সঙ্গে? ছেলে আছে তো?
বুড়িমা-হাঁ হাঁ বাবুজী হামার ছেলে আছে। ভালো আছে -                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                 কিন্তু উয়ার মা নাই।মা মর গয়ী
                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                    বাবু-কী যে হেঁয়ালি করে কথা বল! তোমার ছেলে আছে বলছ, আবার বলছ ওর   মা নেই - কী ব্যাপার বল তো?
বুড়িমা-(কান্নার স্বরে) হামি উর কাছে মোরে গেছি বাবুজী-
বাবুএ ভাবে বলছ কেন? সন্তানের কাছে মা কখনো মরে?
বুড়িমা-গরীব মা ছেলের কাছে মোরে যায় বাবুজী - ছেলে গরীব মাকে চায় না।
বাবু(হেসে) বুঝেছি, ছেলের ওপর তোমার রাগ হয়েছে।
বুড়িমা-(আর্তস্বরে)না না, বেটার উপোর হামার কৌন রাগ নাই - উ ভালো আছে,  ভালো থাক। ভটভটিয়া চোড়ে ঘুরে বেড়াক - হামি গরীব মা, হামি নিজেই মোরে যেতে চাইলম।
বাবুকেন ছেলে তোমাকে দেখে না? খেতে পরতে দেয় না?
বুড়িমা-হামি নিজেই ছেলের ঘোরে খাবা ছেড়ে দিলম বাবুজী - উর পোয়সা হোয়েছে, মাকে নোকরাণী সমঝতে লেগেছে - উর খানা তো হারামির খানার বরাবর।
বাবু তোমার কষ্ট হয় না? এই বুড়ো বয়সে?
বুড়িমা-হোয় তো জরুর পর ইমান তো বেচতে পারি না! জোখন সোয়ামী  মোরলো তোখন গতোরে খেটে বাচ্চাকে বোড়ো কোরেছি বাবুজী - (কান্নার স্বরে) আজ বুঢ্ঢী হোয়েছি আর গরীব বোলে আপুন পেটের ছ্যেলে হামার গায়ে হাথ দিবে-?(একদম ভেঙ্গে পড়ে) তুমরা হোবে মাকে ইজ্জত না দাও বাবুজী, হামি দিই - মা পুকার হামার কাছে বহোত ইজ্জতদার আওয়াজ বাবুজী! মেরী ভি মা থী, ঔর ম্যায় ভী মা হুঁঔর মা হী রহুঙ্গী ।
বাবু কিন্তু এ ভাবে প্রদীপের দোকান দিয়ে তুমি বাঁচতে পারবে?
বুড়িমা-দুকান! দুকান কোথায় দেখলে বাবুজী? দুকান তো ক্যই সাল পহলে খত্ম হো চুকা বাবু বাবুজী - এক ফটা হুয়া বোরী মে পড়া হুয়া হ্যায় মেরী সারী সামান।
বাবু কিন্তু তোমার তো বেশ বড় সড় মাটির জিনিসের দোকান ছিল- 
বুড়িমা-(দুঃখের হাসি) হাঁ ছিল, দুকান ছিল, তোখন হামিও ছিলাম - এখোন দুকান নাই - হামি ভী থাওকবো না।
বাবু কিন্তু কেন এমন হলো?
বুড়িমা-দুনিয়া বদলে যাচ্ছে বাবুজী। লোক বেড়ে যাচ্ছে - গাড়ী, রিক্সা, ঠেলা, টেম্পো, -এই ছোট বাজারে ভিড় হোয়ে গেলো, ঔর কি হলো - পেটের জন্য মানষের লোড়াই ভী বহোত বেড়ে গেলো-। কি জানো বাবুজী, কভী কভী  লোগ হামার মিট্টির দিয়া পায়ে মাড়িয়ে ভেঙ্গে দিয়ে যেত - বোলছি না জানবুঝকে ভাংছে - যাওয়া আসার রাস্তা নাই তো বুঢ়ীর দুকানের উপর দিয়ে যাও-(হেসে) বুঢ়ীর তো লোড়াই করার ছমতা নাই, মোরতে হোয় তো বুড়ীই মোরুক।
বাবুতুমি কিছু বল না?
বুড়িমা-কাখে বোলব? ভগোয়ান শুঞ্ছে না, তো ইন্সান কি শুওনবে? হামার মারকুট্টা  ছেলে দুকান হাটায়ে টুনির দুকান লাগালো, বাজীর দুকান লাগালো, পিলাষ্টিকের দুকান লাগালো-
বাবু হ্যাঁ, এখন মানুষের অভাব এত বেড়ে গেছে, যে যে ভাবে পারে
বুড়িমা-আভাব হর দিন ছিল বাবুজী - হামার বিশওয়াস রামজীকে টাইম মে ভী ছিল। জোন্টা বেড়েছে, সেটা হলো ইন্সানিয়তের আভাব - মানষের জন্য মানষের ধীরজের আভাব - বিশওয়াসের আভাব, তমীজের আভাব।
বাবু (বিস্ময়ের সঙ্গে) অবাক লাগছে, অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে করতেও তোমার এই সমাজ-চেতনা; বেদনাবোধ!
বুড়িমা-এ বাবুজী; ক্যা সোচ রহে হো? হামাকে মুবাইল দিবি না?
বাবু ওঃ হো, কথায় কথায় একদম ভুলে গেছি। বল কাকে ফোন করবে বল।... আরে বাবা, তোমার ওই কাগজখানার অবস্থা তো তোমার থেকেও বেহাল - কার নম্বর লেখা এটা--
বুড়িমা-(সহাস্যে) হামার ভাইয়ের লাগা লাগা নম্বর লাগা কিতনে সাল পহলে উও মুঝে নম্বর দিয়া - পর মুঝে মুবাইল কাঁহা সে মিলেগা - তু বহোত আচ্ছা আদমি হ্যায় - লগা লগা লগা দে নম্বর!
বাবু দিচ্ছি রে বাবা! রিং হচ্ছে এই নাও!  
বুড়িমা-হাঁআআ, আওয়াজ দিচ্ছে - আওয়াজ দিচ্ছে - হ্যালো, হ্যালো- (আকুল হয়ে) হ্যালোওওও... (কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে)বাবুজী, উয়ো  ভি শায়দ মুঝসে বাত করনে মে নারাজ হ্যায়-
বাবুনা না, তা কখনো হয়! নিজে তোমাকে নম্বর দিয়েছে - হয়তো গাড়ির আওয়াজে বা হট্টগোলে শুনতে পারছে না।
বুড়িমা-না না বাবুজী, না - ও শুনেছে, হামি বুঝলাম ও শুনেছে - ওর আওয়াজ পেলাম, ও হামার সাথে কথা বলতে নারাজ। হামার কথা শুনলো না-(কান্না মেশানো গলায়) ভাবল, হামি ওর কাছে পয়সা মাঙ্গবো 
বাবু বেশ তো, আমি আর একবার লাগিয়ে দিচ্ছি, তুমি কথা বল - তুমি তোমার কান্নাটা তো থামাও!
বুড়িমা- (চোখে জল, মুখে হাসি) হামি কাঁদি না রে, শায়দ জমা হুয়া পুরানা পানী নিকল আয়া - ফিক্র না করো বাবুজী-। হামার বেটা ভাবল, বুঢ়ী মা পালতে  ওর বোঝ হয়ে যাবে - ও হামাকে পিটালো, পর না হামার হাড্ডি টুটলো, না দিল টুটলো-(কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে) পর আজ হামার মায়ের পেটের ভাই হামার কলিজা টুটিয়ে দিল বাবুজী!
বাবুতোমার মাটির দিয়াগুলিও তো তোমার দিল - ওগুলো যখন লোকে পায়ে মাড়িয়ে ভাঙ্গে, তখন কি তুমি কাঁদ?... বুড়ীমা-
বুড়িমা-বোল বেটা-
বাবুতোমার মেরুদন্ড লোহা দিয়ে তৈরি - কার সাধ্য তোমার মেরুদন্ড ভাঙ্গে!
বুড়িমা-আজ হামার নিজের উপর বিশওয়াস টুটলো রে - হামার কোথা শুনবার জন্য দুনিয়ায় আর কোই নাহী চাহতা
বাবু তাই কখনো হয়, এই তো আমি শুনছি, দুনিয়ায় কত কত মানুষ, কেউ না কেউ তোমার কাছে আসবেই, তোমার কথা শুনবেই।
বুড়িমা-তু তো হামার বেটা আছিস - কি নাম রে তোর?
বাবু আমার নাম কিরণ, কিরণ দত্ত।
বুড়িমা-(উচ্ছ্বসিত হাসি) না, তুই হামার বুধন আছিস, বুধন-  
বাবু তাই সই, আমি তোমার বুধন - দুনিয়ায় তোমার হাজারো বুধনের মধ্যে আমিও এক বুধন। কিন্তু এবার তো আমায় যেতে হবে, অনেক দেরী হয়ে গেল, ওরা ভাববে।
বুড়িমা-হাঁ, যা অব, তোহার ঘরওয়ালে তোহার জন্য ভাব্বে - ফির আওসবি তো?
বাবুকাল সকালেই আমি চলে যাব, আবার পরের বছর আসব - তোমার কথা শুনব – চলি - ওহোঃ, ভুলেই গিয়েছিলাম - দাও আমাকে পাঁচ টাকার দিয়া দাও-
বুড়িমা-হাঁ, হাঁ লিয়ে জা, থৈলা নিকাল - লিয়ে যা-
বাবু আরে আরে, এত দিচ্ছো কেন?
বুড়িমা-এতো মিট্টি কা দিয়া আছে - কিমত কি আছে বল - পর যদি জ্বালাতে পারিস- হাঁ...
বাবু কিন্তু এত কে জ্বালাবে?
বুড়িমা-তুমি জ্বালাবে - সোবাই কি দিয়া জ্বালাতে পারে বাবুজী - সোবার বুকের ভিতর
বাবু উঁহু, বুধন, বাবুজী না, বুধন
বুড়িমা-ও হাঁ হাঁ, বুধন, বুধন
বাবুমনে থাকবে তো-
বুড়িমা-হাঁ হাঁ, মোনে থাকবে, বুধন বুধন।
বাবু ভুলে যাবে না তো?
বুড়িমা-না, না ভুলে যাব না বুধন, হামার বুধন...(ফোঁপাতে শুরু করে)বুধন
বাবু বুড়িমা, বুড়িমা - আবার...!  
(বুড়িমা ফোঁপায়)
বাবু বুড়িমা, তুমি হেরে যাবে? তুমি হেরে গেলে যে মানুষ হেরে যাবে - তুমি যে বজ্র - মনুষ্যত্বের লড়াইয়ে দধীচির হাড় দিয়ে তৈরি বজ্র
বুড়িমা-তাই তো তোখে বলছি লিয়ে যা - আনেক আনেক দিয়া লিয়ে যা - হর জঘহ দিয়া জ্বালা, হর ঘর মে দিয়া জ্বালা - সোবার বুকের মোধ্যে তো মাচিস থাকে না - তুহার মোধ্যে আছে তুই পারবি--
বাবুকিন্তু বুড়িমা, এতগুলো প্রদীপের কত দাম হবে
বুড়িমা-তোহার কাছে কি হামি পোয়সা মাঙ্গলাম! পারলে দিয়া জ্বালা, না পারলে পায়ে দাবিয়ে তোড় দে, তোড় দে - মিট্টি কা দিয়া মিট্টি মে মিলা দে-
বাবু কিন্তু তোমাকেও তো বাঁচতে হবে, খেতে হবে
বুড়িমা-হামার আছে রে - আখির দম তক লোকের কাছে ভিখ মাংবো - দিয়া লো, দিয়া লাও... (হঠাৎ সম্বিত ফেরে) যা, যা তু যা - ঘর যা-(আর কথা না বলে বুড়িমা পথ চলতে শুরু করে) দিয়া লিবে, দিয়াআআআআআ-!  মিট্টিকা দিয়াআআ! সস্তাওয়ালে মিট্টি কা দিয়া। দিয়া লিবে, দিয়াআআআআআ- (আস্তে আস্তে শব্দ দূরে সরে যায়)
বাবু তোমাকে প্রণাম বুড়িমা, মাটির প্রদীপ এত উজ্জ্বল হতে পারে, আগে ভাবিনি
বুড়িমা-দিয়া লিবে, দিয়াআআআআআ-
বাবুঈশ্বর তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুন বুড়িমা, ঘরে ঘরে দিয়া জ্বালাতে পারব কিনা জানি না, কিন্তু আমার প্রাণের প্রদীপ আমি বার বার জ্বালিয়ে নেব তোমার কাছে এসে।
বুড়িমা-দিয়া লিবে, দিয়াআআআআআ-! মিট্টি কা দিয়াআআ সস্তাওয়ালে মিট্টি কা দিয়া। দিয়া লিবে, দিয়াআআআআআ- (আস্তে আস্তে শব্দ দূরে সরে যায়)