জলের গান
ছলাৎ ছলাৎ ছল। প্রথম এ শব্দ শুনি সাত কি আট বছর বয়সে। মামাবাড়ি কুমিল্লার হাওড় অঞ্চলে। বছরের ছ’মাসই সেখানে নৌকা চলে। তো, যাচ্ছি ছৈয়া নৌকায়। শুনলাম জলের গান। কেমন যেন ছলাৎ-ছল, ছলাৎ-ছল! কার সঙ্গে ছল, কে জানে! সঙ্গে ছিল শাপলা-শালুক আর কচুড়িপানার বাড়াবাড়ি আনাগোনা। খানিক দূরেই দেখি, একেবেঁকে সাপ যাচ্ছে। প্রায় মাথা খারাপ হবার যোগাড় আর কি! তখন তো আর ডিসকভারি চ্যানেল ছিল না। আমার জীবনে সেটাই ডিসকভারি। বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি। অফুরন্ত দুরন্তপনার সুযোগ। বিলে হাঁটু জল। বিলে বিলে ঘুরছি সমবয়সী ভাইবোনদের সঙ্গে। বিল থেকে শামুক-ঝিনুক তুলে আনছি। ডলি মাসির হাঁসগুলোর জন্য। চার-পাঁচদিন ঝিনুক ভাঙার পর একটা মুক্তো পেয়েছিলাম। গোলাপী। জামার পকেটে যত্নে ছিল বেশ কয়েক দিন। কিন্তু এতো কিছুর পরেও জলে নামতে সাহস হয়নি। সাঁতার জানি না যে!
তাই উপায় বেরোলো। এবার থেকে হাফইয়ারলি পরীক্ষার পর ছুটিতেও মামাবাড়ি আসতে হবে। তখন তো পুকুর প্রায় শুকনো। পাড় থেকে দশ-পনেরো হাত এমনিই যাওয়া যায়। সেই সুযোগে সারা দুপুর দাপাদাপি। ‘বাইয়্যা রে বাইয়্যা... কি রে বাইয়্যা, মাইছ্যা ডা কি? কাঁচকি মাছ? দিবি নি? ধরতে পারলে নে...! বলেই ডুব জলে। তারপর তাকে ধরার জন্য হুড়োহুড়ি - সেই জলেই। এরকম কত খেলা খেলেছি। কখন সূর্যটা পশ্চিমে হেলেছে, কে জানে! দাদু ছিপ হাতে তেড়ে আসত। কিন্তু আমরা কি আর শুনতাম!
পূর্ণিমা রাতে বিপ্লব মামাকে যেন ভূতে পেত। মামা ডেকে তুলত আমাদের সকলকে। বড়রা তখন নাক ডাকছে। নৌকায় ওঠে বসেছি আমি, তাপস, শ্যামল, নিকসন, বলাই মামা। জাল ফেলা হচ্ছে চাঁদের আলোয়। ছোট ছোট খইয়্যা-শিং, পুঁটি জালে আটকেছে। সকালে সেই মাছভাজায় এক থালা ভাত সাবড়ে দিতাম! কী তার স্বাদ!
একবার জলে ভূত দেখেছিলাম। দাদাবাড়ি গিয়েছি। গ্রীষ্মকালেই। আমি, বিজলি পিসি, রেখা দিদি, কাজলী-মিলন-সবাই মিলে স্নান করতে নেমেছি। হঠাৎ, বিজলি পিসি পুকুর থেকে হুড়মুড় করে পাড়ে ওঠে গেল। হলো কী? কী আবার? পিসি পাইন্যা ভূত দেখেছে। পাড়ে বসেই বিস্তারিত বয়ান। আমরাও দেখতে চাইলাম। কেউ দেখা পেল না। আমি তো তখন থেকেই গল্প বানাই। নামলাম আবার জলে। ডুব দিয়ে চোখ খুলে তাকালাম। ভেসে উঠলাম। আবার পাড়ে। এইবার আমিও দেখেছি। সবুজ রঙের একটা ভূত! নিচে একটা গাছের মতো কিসে যেন ঝুলে ছিল! বর্ণনাটা বিজলি মাসির চেয়ে ভালো ছিল। তাই সেদিনের হিরো আমিই।
একবার মহরমের মেলায় বিশ টাকায় কিনেছিলাম একটা লঞ্চ। সেটায় কেরোসিন তেল ভরে বারান্দায় পানি আটকে - সেখানে দিলাম ছেড়ে। যেন এইমাত্র আবিষ্কার করলাম জলের যান। পড়ি মড়ি করে চলে এলো সবাই আমার লঞ্চ দেখতে। সারাদিন সেই লঞ্চে মালামাল পার করছি। সঙ্গে টুনু আপুর পুতুলগুলোকেও বাপের বাড়ি পাঠাতে হচ্ছে সেই লঞ্চেই। পরের বছর অন্যরাও একেকটা লঞ্চের মালিক বনে গেল।
আস্তে আস্তে জলের গান আমার ভেতরে বাড়তেই লাগল।
৯৭ সালের মে মাস। ছুটির পর ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ এক ফোঁটা হাতে পড়ল। রীতিমতো শিহরণ লাগল। যেন প্রেমিকের প্রথম স্পর্শ! গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে! তারপর নামল ঝমঝমিয়ে। ভিজে বাড়ি গেছি। হেঁটে হেঁটে। সারা শরীর কাঁপছে। আনন্দে-আহ্লাদে শরীর মন কাঁপছে।
সেবার খুব বৃষ্টি হয়েছিল। হয়তো আমার দুটো বয়সের সন্ধিকাল বলেই! একটা বৃষ্টিও মিস করিনি। কখনো ভিজতে না পারলেও মুখে ঝাপটা দিয়েছি জলের। শীলাবৃষ্টিতে বালতি ভরে ফেলেছি শিলায়। একটার পর একটা খেয়েই যাচ্ছি। সে কি উত্তেজনা! ব্যাঙের ঘ্যঙর ঘ্যঙ শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত।
সমুদ্রে সঙ্গে প্রেম আরও অনেক পরে। বলতে গেলে বড়বেলায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে।
বাসে ওঠেই মন ভীষণ খারাপ। কেন এলাম! ধূর ছাই! মন পুড়ছে তাঁর জন্য। তাঁকে ঢাকায় রেখে এলাম। বাস পৌঁছল ভোরে। বাস কক্সবাজার পৌছবার পরই হঠাৎ জানালা দিয়ে সাদা সাদা আঁকা বাকা রেখা চোখে পড়ল। বন্ধুরা বলল, দেখো সমুদ্র! শরীর ঝমঝমিয়ে উঠল। আরেকবার। জীবনে ঢেউ দেখিনি। এতো শুভ্র-সাদা! ছুটে যেতে ইচ্ছে করল। ব্যাগটা কোনো মতে হোটেলে রেখেই সমুদ্রে অবগাহন। মনে আছে, ঢেউগুলো যখন একটার পর একটা বাড়ি খাচ্ছিল আমার পায়ে, আমি উত্তেজনায় চিৎকার করছিলাম। এতো সুন্দর কি সহ্য করা যায়! লবণ, রোদ, বালু - সব পেছনে ফেলে মেতেছি সমুদ্রে। তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি। লাবণী পয়েন্ট, এক নম্বর পয়েন্ট সব পেছনে। হঠাৎ হাটুজল থেকে কোমর জলে পড়ে গেলাম। দু’পা এগোতেই বুক পর্যন্ত ডুবে গেছি। ঢেউ তেমন একটা নেই সেখানে। কোনো মানুষও চোখে পড়ছে না। সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা তখন। বুঝলাম, সামনে এগোলে জল আরও বাড়বে। আর জলের প্রেমিকা আমি, জলকে জীবনে ভয় পাইনি। তাই সাঁতার শিখতে ইচ্ছে করেনি কখনো। মরণ এলে, মরব। তা বলে, জলের হাত থেকে বাঁচতে সাঁতরে বাঁচতে হবে, এটা মনে আসেনি কখনো। তাই এইবার পেছানোর কথাই মনে এলো। আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়লাম। তারপর তীরে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। সমুদ্র কি আমায় টেনে নিতে চেয়েছিল? না হলে এতো কাছ থেকে ডুবতে হবে কেন? পরে ঘটনাটা অন্যদের বললে, স্থানীয় রাখাইন আদিবাসীরা বলেছিল, এখানে গভীর একটা চোরাবালি আছে।
তবু ভালোবাসা একবিন্দু কমেনি। সেবার আরও একদিন সমুদ্রের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম আমরা। স্যার রাজি হয়নি। ফেরার পথে কেঁদেছি আর স্যারের মৃত্যুকামনা করেছি। বলেছি, তিনি যেন ডুবেই মরেন। এমনই ছেলেমানুষি!
পরে আরও অনেকবার গেছি। হেঁটেছি। জল ছুঁয়েছি। বালির ভেতর থেকে হাতড়ে তারামাছ আবিষ্কার করেছি। কিন্তু জলকে ভয় পাওয়া হয়ে ওঠেনি।
আরেকবার কেঁদেছিলাম সমুদ্রের জন্য। সেবার সেন্টমার্টিন গেছি। ঢাকা থেকে বিকেলে চট্টগ্রাম। রাতের বাসে টেকনাফ। সকালে সেন্টমার্টিন। সেখানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা। বারবিকিউ, নুড়ি কুড়ানো। পরদিন ছেড়াদ্বীপ অভিযান। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন বৃদ্ধাও ছিলেন। কপালের ফের! কেন, সেটা বলছি। ছেড়াদ্বীপে হেঁটে যাওয়া যায়। একটা রাস্তা আছে সেন্টমার্টিন থেকে যাওয়ার। সেটা জোয়ারে ডুবে যায়। ভাটার সময় জেগে ওঠে। কিন্তু আমরা যেতে যেতে ভাটার সময় শুরু হয়েছে। দুঃখ হলো খুব। সমুদ্রের বুকের ভেতর হাঁটা হলো না। ট্রলারে গেলাম। ট্রলার দ্বীপ অবধি পৌছোয় না। পনেরো-বিশ হাত দূরে প্রবালে আটকে যায়। সেখান থেকে নৌকায় যেতে হয় তীরে। বিপত্তি বাধলো। নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বৃদ্ধারা নামতে চাচ্ছেন না নৌকায়। তাঁদের রেখে যাওয়াও যাচ্ছে না। একজন তো বিদ্রোহ করে জলে ঝাঁপ দিলেন। ভাগ্যিস সাঁতার জানতেন! তিনি ঘুরে এলেন দ্বীপ পর্যন্ত। আমি এবং কয়েকজন নেমেছিলাম ট্রলার থেকে নৌকায়। তারপর প্রবাল দ্বীপের জলে পা রেখেছিলাম। এ কী! মনে হলো, বড় বড় চীনামাটির প্লেট, তার ওপরে কার্পেট বিছানো! কেঁপে কেঁপে উঠছি আনন্দে। এদিকে ঢেউ বাড়ছে। জোয়ার বাড়ছে। ফিরে যেতে হবে। বৃদ্ধারা সূরা ফাতিহা পড়া শুরু করেছেন। লাইফ বোর্ড বেধে নিয়েছেন গায়ে। অগত্যা ট্রলারে উঠলাম। সেন্টমার্টিন যাওয়া পর্যন্ত সারা পথ কাঁদলাম। আর ছেড়াদ্বীপকে বলে এলাম, “এই চোখের জলের দিব্যি, আমি আসবোই তোমার কাছে। তোমাকে পুরোপুরি দেখা হলো না যে! কিন্তু আজও যাওয়া হয়নি। শুনেছি, ছেড়াদ্বীপ ডুবে যেতে পারে। অপেক্ষা করছি, তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। জলের গান শুনতে।
ছলাৎ ছলাৎ ছল। প্রথম এ শব্দ শুনি সাত কি আট বছর বয়সে। মামাবাড়ি কুমিল্লার হাওড় অঞ্চলে। বছরের ছ’মাসই সেখানে নৌকা চলে। তো, যাচ্ছি ছৈয়া নৌকায়। শুনলাম জলের গান। কেমন যেন ছলাৎ-ছল, ছলাৎ-ছল! কার সঙ্গে ছল, কে জানে! সঙ্গে ছিল শাপলা-শালুক আর কচুড়িপানার বাড়াবাড়ি আনাগোনা। খানিক দূরেই দেখি, একেবেঁকে সাপ যাচ্ছে। প্রায় মাথা খারাপ হবার যোগাড় আর কি! তখন তো আর ডিসকভারি চ্যানেল ছিল না। আমার জীবনে সেটাই ডিসকভারি। বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি। অফুরন্ত দুরন্তপনার সুযোগ। বিলে হাঁটু জল। বিলে বিলে ঘুরছি সমবয়সী ভাইবোনদের সঙ্গে। বিল থেকে শামুক-ঝিনুক তুলে আনছি। ডলি মাসির হাঁসগুলোর জন্য। চার-পাঁচদিন ঝিনুক ভাঙার পর একটা মুক্তো পেয়েছিলাম। গোলাপী। জামার পকেটে যত্নে ছিল বেশ কয়েক দিন। কিন্তু এতো কিছুর পরেও জলে নামতে সাহস হয়নি। সাঁতার জানি না যে!
তাই উপায় বেরোলো। এবার থেকে হাফইয়ারলি পরীক্ষার পর ছুটিতেও মামাবাড়ি আসতে হবে। তখন তো পুকুর প্রায় শুকনো। পাড় থেকে দশ-পনেরো হাত এমনিই যাওয়া যায়। সেই সুযোগে সারা দুপুর দাপাদাপি। ‘বাইয়্যা রে বাইয়্যা... কি রে বাইয়্যা, মাইছ্যা ডা কি? কাঁচকি মাছ? দিবি নি? ধরতে পারলে নে...! বলেই ডুব জলে। তারপর তাকে ধরার জন্য হুড়োহুড়ি - সেই জলেই। এরকম কত খেলা খেলেছি। কখন সূর্যটা পশ্চিমে হেলেছে, কে জানে! দাদু ছিপ হাতে তেড়ে আসত। কিন্তু আমরা কি আর শুনতাম!
পূর্ণিমা রাতে বিপ্লব মামাকে যেন ভূতে পেত। মামা ডেকে তুলত আমাদের সকলকে। বড়রা তখন নাক ডাকছে। নৌকায় ওঠে বসেছি আমি, তাপস, শ্যামল, নিকসন, বলাই মামা। জাল ফেলা হচ্ছে চাঁদের আলোয়। ছোট ছোট খইয়্যা-শিং, পুঁটি জালে আটকেছে। সকালে সেই মাছভাজায় এক থালা ভাত সাবড়ে দিতাম! কী তার স্বাদ!
একবার জলে ভূত দেখেছিলাম। দাদাবাড়ি গিয়েছি। গ্রীষ্মকালেই। আমি, বিজলি পিসি, রেখা দিদি, কাজলী-মিলন-সবাই মিলে স্নান করতে নেমেছি। হঠাৎ, বিজলি পিসি পুকুর থেকে হুড়মুড় করে পাড়ে ওঠে গেল। হলো কী? কী আবার? পিসি পাইন্যা ভূত দেখেছে। পাড়ে বসেই বিস্তারিত বয়ান। আমরাও দেখতে চাইলাম। কেউ দেখা পেল না। আমি তো তখন থেকেই গল্প বানাই। নামলাম আবার জলে। ডুব দিয়ে চোখ খুলে তাকালাম। ভেসে উঠলাম। আবার পাড়ে। এইবার আমিও দেখেছি। সবুজ রঙের একটা ভূত! নিচে একটা গাছের মতো কিসে যেন ঝুলে ছিল! বর্ণনাটা বিজলি মাসির চেয়ে ভালো ছিল। তাই সেদিনের হিরো আমিই।
একবার মহরমের মেলায় বিশ টাকায় কিনেছিলাম একটা লঞ্চ। সেটায় কেরোসিন তেল ভরে বারান্দায় পানি আটকে - সেখানে দিলাম ছেড়ে। যেন এইমাত্র আবিষ্কার করলাম জলের যান। পড়ি মড়ি করে চলে এলো সবাই আমার লঞ্চ দেখতে। সারাদিন সেই লঞ্চে মালামাল পার করছি। সঙ্গে টুনু আপুর পুতুলগুলোকেও বাপের বাড়ি পাঠাতে হচ্ছে সেই লঞ্চেই। পরের বছর অন্যরাও একেকটা লঞ্চের মালিক বনে গেল।
আস্তে আস্তে জলের গান আমার ভেতরে বাড়তেই লাগল।
৯৭ সালের মে মাস। ছুটির পর ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ এক ফোঁটা হাতে পড়ল। রীতিমতো শিহরণ লাগল। যেন প্রেমিকের প্রথম স্পর্শ! গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে! তারপর নামল ঝমঝমিয়ে। ভিজে বাড়ি গেছি। হেঁটে হেঁটে। সারা শরীর কাঁপছে। আনন্দে-আহ্লাদে শরীর মন কাঁপছে।
সেবার খুব বৃষ্টি হয়েছিল। হয়তো আমার দুটো বয়সের সন্ধিকাল বলেই! একটা বৃষ্টিও মিস করিনি। কখনো ভিজতে না পারলেও মুখে ঝাপটা দিয়েছি জলের। শীলাবৃষ্টিতে বালতি ভরে ফেলেছি শিলায়। একটার পর একটা খেয়েই যাচ্ছি। সে কি উত্তেজনা! ব্যাঙের ঘ্যঙর ঘ্যঙ শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত।
সমুদ্রে সঙ্গে প্রেম আরও অনেক পরে। বলতে গেলে বড়বেলায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে।
বাসে ওঠেই মন ভীষণ খারাপ। কেন এলাম! ধূর ছাই! মন পুড়ছে তাঁর জন্য। তাঁকে ঢাকায় রেখে এলাম। বাস পৌঁছল ভোরে। বাস কক্সবাজার পৌছবার পরই হঠাৎ জানালা দিয়ে সাদা সাদা আঁকা বাকা রেখা চোখে পড়ল। বন্ধুরা বলল, দেখো সমুদ্র! শরীর ঝমঝমিয়ে উঠল। আরেকবার। জীবনে ঢেউ দেখিনি। এতো শুভ্র-সাদা! ছুটে যেতে ইচ্ছে করল। ব্যাগটা কোনো মতে হোটেলে রেখেই সমুদ্রে অবগাহন। মনে আছে, ঢেউগুলো যখন একটার পর একটা বাড়ি খাচ্ছিল আমার পায়ে, আমি উত্তেজনায় চিৎকার করছিলাম। এতো সুন্দর কি সহ্য করা যায়! লবণ, রোদ, বালু - সব পেছনে ফেলে মেতেছি সমুদ্রে। তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি। লাবণী পয়েন্ট, এক নম্বর পয়েন্ট সব পেছনে। হঠাৎ হাটুজল থেকে কোমর জলে পড়ে গেলাম। দু’পা এগোতেই বুক পর্যন্ত ডুবে গেছি। ঢেউ তেমন একটা নেই সেখানে। কোনো মানুষও চোখে পড়ছে না। সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা তখন। বুঝলাম, সামনে এগোলে জল আরও বাড়বে। আর জলের প্রেমিকা আমি, জলকে জীবনে ভয় পাইনি। তাই সাঁতার শিখতে ইচ্ছে করেনি কখনো। মরণ এলে, মরব। তা বলে, জলের হাত থেকে বাঁচতে সাঁতরে বাঁচতে হবে, এটা মনে আসেনি কখনো। তাই এইবার পেছানোর কথাই মনে এলো। আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়লাম। তারপর তীরে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। সমুদ্র কি আমায় টেনে নিতে চেয়েছিল? না হলে এতো কাছ থেকে ডুবতে হবে কেন? পরে ঘটনাটা অন্যদের বললে, স্থানীয় রাখাইন আদিবাসীরা বলেছিল, এখানে গভীর একটা চোরাবালি আছে।
তবু ভালোবাসা একবিন্দু কমেনি। সেবার আরও একদিন সমুদ্রের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম আমরা। স্যার রাজি হয়নি। ফেরার পথে কেঁদেছি আর স্যারের মৃত্যুকামনা করেছি। বলেছি, তিনি যেন ডুবেই মরেন। এমনই ছেলেমানুষি!
পরে আরও অনেকবার গেছি। হেঁটেছি। জল ছুঁয়েছি। বালির ভেতর থেকে হাতড়ে তারামাছ আবিষ্কার করেছি। কিন্তু জলকে ভয় পাওয়া হয়ে ওঠেনি।
আরেকবার কেঁদেছিলাম সমুদ্রের জন্য। সেবার সেন্টমার্টিন গেছি। ঢাকা থেকে বিকেলে চট্টগ্রাম। রাতের বাসে টেকনাফ। সকালে সেন্টমার্টিন। সেখানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা। বারবিকিউ, নুড়ি কুড়ানো। পরদিন ছেড়াদ্বীপ অভিযান। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন বৃদ্ধাও ছিলেন। কপালের ফের! কেন, সেটা বলছি। ছেড়াদ্বীপে হেঁটে যাওয়া যায়। একটা রাস্তা আছে সেন্টমার্টিন থেকে যাওয়ার। সেটা জোয়ারে ডুবে যায়। ভাটার সময় জেগে ওঠে। কিন্তু আমরা যেতে যেতে ভাটার সময় শুরু হয়েছে। দুঃখ হলো খুব। সমুদ্রের বুকের ভেতর হাঁটা হলো না। ট্রলারে গেলাম। ট্রলার দ্বীপ অবধি পৌছোয় না। পনেরো-বিশ হাত দূরে প্রবালে আটকে যায়। সেখান থেকে নৌকায় যেতে হয় তীরে। বিপত্তি বাধলো। নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বৃদ্ধারা নামতে চাচ্ছেন না নৌকায়। তাঁদের রেখে যাওয়াও যাচ্ছে না। একজন তো বিদ্রোহ করে জলে ঝাঁপ দিলেন। ভাগ্যিস সাঁতার জানতেন! তিনি ঘুরে এলেন দ্বীপ পর্যন্ত। আমি এবং কয়েকজন নেমেছিলাম ট্রলার থেকে নৌকায়। তারপর প্রবাল দ্বীপের জলে পা রেখেছিলাম। এ কী! মনে হলো, বড় বড় চীনামাটির প্লেট, তার ওপরে কার্পেট বিছানো! কেঁপে কেঁপে উঠছি আনন্দে। এদিকে ঢেউ বাড়ছে। জোয়ার বাড়ছে। ফিরে যেতে হবে। বৃদ্ধারা সূরা ফাতিহা পড়া শুরু করেছেন। লাইফ বোর্ড বেধে নিয়েছেন গায়ে। অগত্যা ট্রলারে উঠলাম। সেন্টমার্টিন যাওয়া পর্যন্ত সারা পথ কাঁদলাম। আর ছেড়াদ্বীপকে বলে এলাম, “এই চোখের জলের দিব্যি, আমি আসবোই তোমার কাছে। তোমাকে পুরোপুরি দেখা হলো না যে! কিন্তু আজও যাওয়া হয়নি। শুনেছি, ছেড়াদ্বীপ ডুবে যেতে পারে। অপেক্ষা করছি, তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। জলের গান শুনতে।
কেমন লাগল জানাবেন
উত্তরমুছুনভারি সুন্দর গদ্য । লেখাটা গল্প নয়, রম্যরচনা নয়, ব্যক্তিগত গদ্যও নয় অথচ পরিচ্ছন্ন ও ঝরঝরে লেখার গুনে পাঠক এক নিঃশ্বাসে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলেন । সমুদ্রকে ভালোবাসার আকুতি, 'সমুদ্রের বুকের ভেতর না হাটতে পারার' আক্ষেপ যেন পাঠককেও ছুয়ে যায় । খুব ভালো লেখা । পাঠকের অভিনন্দন লাভ করবে - আমার সংশয় নেই । এই বাক্যটা নয়া থাকলেই ভালো হতো ভারি সুন্দর গদ্য । লেখাটা গল্প নয়, রম্যরচনা নয়, ব্যক্তিগত গদ্যও নয় অথচ পরিচ্ছন্ন ও ঝরঝরে লেখার গুনে পাঠক এক নিঃশ্বাসে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলেন । সমুদ্রকে ভালোবাসার আকুতি, 'সমুদ্রের বুকের ভেতর নয়া হাটতে পারার' আক্ষেপ যেন পাঠককেও ছুয়ে যায় । খুব ভালো লেখা । পাঠকের অভিনন্দন লাভ করবে - আমার সংশয় নেই । এই বাক্যটা নয়া লিখলেই ভালো হ'ত "স্যারের মৃত্যুকামনা করেছি। বলেছি, তিনি যেন ডুবেই মরেন" । লেখিকা বলেছেন 'ছেলে মানুষি'। তবুও কারো মৃত্যু কামনা ? সাহিত্য ভাষা েই ছেলে মানুষি অনুমোদন করে নয়া বলেই আমার বিশ্বাস ।
মুছুনআমি প্রথম আপনার লেখা পড়ি। স্মৃিতকথা। প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম, নতুনটা কখন আসবে। কোন ভাল কিছু খাবার পর, যেমন তার স্বাদ লেগে থাকে, আজও সেই লেখা তেমনি অনুভূতিেত আছে। স্বয়ং আপনি যখন লেখা সম্পর্কে বললেন, সেটাই পরম পাওয়া। আমি নতুন করে প্রেরণা পেলাম। ধন্যবাদ দাদা।
মুছুনসেটায় কেরোসিন তেল ভরে বারান্দায় পানি ------------- সব জায়গায় "জল" লিখে, এই জায়গায় পানি শব্দটা ছন্দপতন ঘটিয়েছে ।
উত্তরমুছুনহয় সব পানি বা জল ব্যবহার করতে হত ।
লেখিকার লেখার হাত ভালো, তবে সমতা রক্ষা করা সব জায়গায় ঠিক হয় নি ।
যে জলে/ পানিতে নামে, তার এমনিতেই সাঁতার জানা উচিত ।
সাঁতার না জেনে জলকে ভালোবাসা যায়, এটা ঠিক, কিন্তু ডুব সাঁতার দেওয়া যায় কি?
এসব ছাড়া------------- অনুভূতি টা লেখায় প্রকাশ হয়েছে দারুণ ভাবে ।
লিখুন, আমরা আরও পড়ি ।
লিখতে লিখতে- সব ঠিক হয়ে যাবে
ধন্যবাদ দাদা। এতো সিরিয়াস ভাবে কেও নতুনদের লেখা পরে না। আর পরলেও মুখ গোমড়া করে শুধু ভালো বলে। আপনি যত্ন নিয়ে পড়েছেন, তাই ধন্যবাদ। আর আপনার কথাগুলো মনে রাখব।
মুছুনআর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি :- এই লেখায়, যেটা প্লাস পয়েন্ট- সেটা হলো ক্রিয়াপদের একঘেঁয়েমী বাক্যে নেই ।
উত্তরমুছুনএটা খুব ভালো
Amra ghore boli jol,; bairr boli pani. Chamotkar golpo. Jolpanir mato suswadu.
উত্তরমুছুনdhonnobad dada
মুছুন