কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

১৪) লিপিকা ঘোষ

খোঁজ


চা-এর কাপ হাতে জানালার ধারে আনমনা রাহি। রাহি ইদানীং খুব গম্ভীর থাকে। রঙ্গন আর রাহির সম্পর্কটা ঠিক কী কারণে চুরমার হলো, কখনও কাউকে বলেনি ওরা। রঙ্গন এখন ঘোর সংসারী। সেদিন অফিস ফিরতি দেখা। রঙ্গনের চোখে সেই ঝলক নেই। চোখে চোখ রাখলাম কিছুক্ষণ। খেলায় হেরে গেল! পলক ফেলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “রাহি এখন কোথায়”? “আমার কাছেই”। “চলি”। “এসো”।

রাহি চুপ বসে আছে। “গ্রামে যাবি না”? তাকালো আমার দিকে। “যাব। একটা এন.জি.ও-র টীম আসবে। ওদের সঙ্গে বের হব”। রাহি এখনও দূর দূরান্ত গ্রামে জন স্বাস্থ্য সচেতনতার কাজ করে চলেছে। রাহির ম্লান হাসিতে সকালের রোদ্দুর লাগল।

নাটুদের গ্রাম থেকে আমি নেবিল আর বিডস সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। কোনো উড়ন্ত গালিচার জিন নয়, নাটুই ফিরিয়ে এনে ভর্তি করেছিল। নাটুদের গ্রাম -- যেখানে বাগদাদের কোনো শতাব্দী পেরনো কার্পেটের সন্ধানে গেছিল বিডস মানে বিদিশা। সঙ্গে আমি আর নেবিল। এলোপাথাড়ি জনরোষের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলাম আমরা। নেবিল সাংঘাতিক আহত হয়েছিল। আমার মাথায় শক্ত কিছুর আঘাত। তারপর আর কিছু মনে নেই। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে দেখি নেবিলকে বাঁচাতে গিয়ে বিডসও চূড়ান্ত আহত।

বসার ঘরে নেবিল আর বিডস নিচু গলায় কথা বলছে। নেবিল বিদেশী। বিডসকে বিয়ে করে এখন ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বদেশী ভাষা রপ্ত করেছে। নেবিল এক আশ্চর্য মানুষ। আবার ও ফিরে গেছিল নাটুদের গ্রামে। সেই সব শক্ত চোয়াল আর টাঙ্গি বল্লম হাতে মানুষদের গ্রামে। যে গ্রামে তখনও রোশনাই ঢোকেনি। যে গ্রামে তখনও জমাট বাঁধা রোষ।

নেবিল প্রচুর খাদ্য, জামাকাপড়, ওষুধ নিয়ে গেছিল। অনেক জনরোষ সামলেছে। একটা এন.জি.ওকে নিয়ে ও অনেক কাজ করেছে ওখানে। এখন অবশ্য সে গ্রামে কোনো রোষ নেই। প্রতিবাদ নেই। ভোট এলো ভোট গেল। নেতা নেত্রীরা যায় আসে। রোশনাই ঢুকেছে। খানা খন্দ রাস্তাগুলো মোরাম। মেইন রোড পিচ ঢালা। ট্রেকার বাস চলাচল। গ্রামের মানুষ শহরের রোশনাই দেখতে আসে। শহর থেকে চুঁইয়ে পড়া বিষাক্ত রোশনাই নিয়ে গ্রামে ফেরে। গ্রামের মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে সারাক্ষণ টিভি চলছে। সামনে বসা হাড়গোর সার মানুষগুলোর চোখ মুখে কী এক বিকৃত লালসার উল্লাস! চায়ের দোকানগুলোর ঠিক পেছনেই দেশি মদের এন্তার কারবার। গ্রামের মানুষের আর কোনো অভাব নেই, প্রতিবাদ নেই। আসলে অভাব অভিযোগ আছে কী নেই, তাই আর জানা নেই কারও। শুধু পাগল আনোয়ার মিঞা থেকে থেকে আকাশের দিকে মুখ করে গাল পাড়ে। ওর তের বছরের নাতনি রেপড্‌ হয়ে মরে পড়েছিল ক্ষেতের ধারে। কে ধরা পড়ল, কোথায় কেস উঠল, কী বা সাজা হলো, মিঞা তার কিছুই জানে না। নাটুদের সেই ভেতর-গ্রামে এখন আর রোষ নেই, রোশনাই আছে।

নেবিলের ঝকঝকে হাসি আর অসম্ভব সৌজন্যবোধ মুগ্ধ করে আমাকে। বিডস যথারীতি পুরনো সব আশ্চর্য জিনিসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় এখনও। এবার যাবে কর্ণসুবর্ণ, গৌড়ের রাজধানী। শশাঙ্ক যা’র রাজা। সেখানে নাকি কোনো এক ভাঙ্গা কলসীর গায়ে অদ্ভুত আশ্চর্য নকশা কাটা। সেটাই উদ্ধার করতে যাবে। সঙ্গে আমাকেও টেনে নিয়ে যাওয়া চাই ওর। শশাঙ্ক। রাজার কথা ভাবি। স্বাধীন রাজা এ বঙ্গভূমির!

কিন্তু আমি কেন যাব? ঐ ভাঙ্গা কলসীর নকশায় আমার কী কাজ! শশাঙ্ক লোকটাকে নিয়ে খুব কৌতূহল আমার। খুব বেশি তথ্য আমার গোচরে নেই। কেমন ছিল লোকটাকে দেখতে?

নাটু হর্ণ দিচ্ছে। নেবিল আর বিডস গিয়ে গাড়িতে উঠল। আমি নাটুর পাশের সিটে। রাহি দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ। ভাঙ্গা কলসীর নকশায় মিলবে কি সেই লোকটা’র ছবি? কেমন দেখতে ছিল লোকটাকে...


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন