‘মহেকা করেঙ্গে...’
দেখতে পাচ্ছি! ফুল্লকুসুমিত রজনীগন্ধা গন্ধরাজ জুঁই... গাদাগুচ্ছের স্টিক মালা। বেকার গাঁটের কড়ি নষ্ট করেছে। ধন্যবাদ বন্ধুবর্গকে! এতোখানি করারও কোনো দরকার ছিল? কারণ খানিক অনুমান করছি অবশ্য। লজ্জা পাচ্ছি বড্ড। খুব ছড়িয়েছি।
আমি এককালের পাতি স্টুডেন্ট একটা পাতি কম্পানিতে পাতি পোস্টে দাসত্ব করেছি। উচ্চাশা, এম্বিশন-টিশন ধাতে ছিল না। দলবাজী করিনি, পলিটিক্স করিনি, নেতাগিরি করিনি, পরোপকারও সচেতনভাবে করিনি। মোটের ওপরে বুঝেছি, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো উদোম ঝক্কির। দু’যুগ আগে ডব্ডবে চোখে মৈত্রেয়ী বলছিলো, “আমি জানি স্বপনদা, তুমি চেষ্টা করলেই পারো... আমার জন্যে আমাদের জন্য... এইটুকু!” সিনেমা-মার্কা বোগাস সেন্টু এক্কেবারে। নিরেস সাদাসাপটা বলেছিলাম, “আমার দ্বারা হবে না। ওয়েট কোরো না, তোমার বাবার ডিসিশন মেনে নাও।” বিয়ের নেমন্তন্নে গিফট দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছিলাম। দাঁত পিষে মৈত্রেয়ী গালি দিয়েছিলো “বজ্জাত!” দু’একজন উট্কো সহানুভূতি জানিয়েছিলো, “জেনেরাস!”
আমি একা। ভাইবোনেরা মাঝে সাঝে মোবাইলে খবর নেয়। “বেশ তো আছিস্ রাজার হালে।” ওরা নিজেরা কেউকেটা, আবার কেতাবাজ ছেলেমেয়ে বৌমা-জামাইদের অহঙ্কারী বাপ-শ্বশুর। পৈতৃক বাড়ি-বেচা টাকার অংশে ওয়ানরুম ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম নিরিবিলিতে। বাকিটা থুপে দিলাম ব্যাঙ্কে। স্বপাক; রান্নাটা পারি, ভালোওবাসি। ঠিকে মাসি অর্ধেকদিন কামাই। একদিন দুম্ করে ছাড়িয়ে দিয়ে আরেকজনকে রাখলাম। সমস্যা কমলো না, মেনে নিলাম। আমি মেনে নিই। কেউ দৌড়ে সিঁড়ি চড়লে সাবধানে পাশে সরে যাই। যাও, যার তাড়া! অন্যের সাফল্য শুনলে চাপা চাপা দুঃখ বা হিংসে (পরশ্রীকাতরতা কিনা জানি না) হয়, কিন্তু অভিনন্দনটা জানিয়ে দিই।
এসব আমার গল্প। আমার মতো নিষ্কম্মার ঢেঁকির। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিতে হলো রোগের ধাক্কায়। আমার সংবর্ধনায় পুলকেশবাবু পড়লেন, “স্বপনদা’র মতো নিবিবার্দী লোক বিরল। সাতেপাঁচে নেই, নিজের কাজটুকু নিঁখুতভাবে উৎরে দিতেন। সাহায্য চাইলে বিমুখ করেননি কাউকে, আবার যেচে উপদেশ দেওয়ায় তাঁর অরুচি। সরল, ঋষির মতো এরকম মানুষ আজকাল আর কোথায়? ওঁর স্বভাবের সৌন্দর্য চিরকাল আমাদের মনে বিরাজ করবে।” আরে ক্কেলো! থামো ভাই! বলে কী? জুনিয়ার দেবাদিত্য গাইলো... “রহে না রহে হম্ মহেকা করেঙ্গে...।” ভালো গলা, কুমার শানু-টাইপ। তবে গানটা মেয়েলী। আমার চোখ ভিজে ভিজে। উপহারের পর্বত ঘাড়ে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরলাম। কাজের মেয়ে পলা লোভ দিল, “ও কাকু, কত কী পেয়েচো গো!” “যা, নিবি তো নিয়ে যা, যেটা ইচ্ছে... আমার আর...!” বলেছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের রোগ আমার! অনেক গচ্চা। কী লাভ? টেক্সাসে যাওয়ার আগে বড়দা একদিন ড্রাইভার নিয়ে এসেছিল, “ওদেশে ভালো ট্রীটমেন্ট আছে, যাবি নাকি?” ‘নাকি’ শুনে হাসি পাচ্ছিল, তাই হাসলাম। বড়দা ভুরু কুঁচকে উঠে গেল। ফিস্ফিস করে বললাম, “চিন্তা কোরো না। আজকাল সরকারি হাসপাতালেও ভালো চিকিৎসা হয়।” পুনেতে প্রকান্ড ফ্ল্যাট কিনেছে অধীরদা। দিদি ফোনে কেঁদে কেটে একশা। সান্ত্বনা দিলাম, “আরে, অতো ভেব না।” কোত্থেকে খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেছিল মৈত্রেয়ী। ফল-টল, হরলিক্স এনেছিল। ওর বর ব্যাঙ্কের জোনাল ম্যানেজার। হায়দরাবাদে পোস্টিং। যাওয়ার আগে বলল, “সাবধানে থেকো।” তারপর ফোঁস্ করে নিশ্বাস ফেললো। আমি হাসলাম। কী, ডিসিশন ঠিক ছিল না মৈত্রেয়ী?
হাসপাতালে দিনরাতের হিসেব থাকে নাকি? পাশের বেডে কী হচ্ছে না হচ্ছে কে দেখে? মাঝে মাঝে ডাক্তার বিরক্ত করেছে, “চোখ খুলুন। হাতটা তুলুন। ইন্জেকশন দেব। বলুন কোথায় কষ্ট?” হঠাৎ ভক্ভক্ পেচ্ছাপের গন্ধ পচা পুঁজরক্তের গন্ধ ছাপিয়ে হসপিটাল ফিনাইলের গন্ধ। কতদিন ছিলাম গুনে দেখিনি। কে এসেছিল বা আদৌ কেউ এসেছিল কিনা, জানতে চাইনি। তবে জ্ঞান থাকলে দেবাদিত্যের গানের কথাগুলো... নেশার মতো।
--দু’রাত্তির ধরে হাসপাতালের মর্গে। এই কাঁঠালপাকা গরমে জ্যান্তরাই পচে উঠছে...!
--ভাগ্নে আসবে শুনেছিলাম। মুখাগ্নি করবে? কোথায়? ছোটভাইও তো দুগার্পুর না আসানসোলে...?
--সব ধান্দাবাজ। ওসব ছাড়ো। শ্মশান অবধি পৌঁছাতে হবে... সোজা চুল্লি।
আমার সহকর্মীদের নাকে মোটা করে রুমাল পেঁচানো।
দেখতে পাচ্ছি! ফুল্লকুসুমিত রজনীগন্ধা গন্ধরাজ জুঁই... গাদাগুচ্ছের স্টিক মালা। বেকার গাঁটের কড়ি নষ্ট করেছে। ধন্যবাদ বন্ধুবর্গকে! এতোখানি করারও কোনো দরকার ছিল? কারণ খানিক অনুমান করছি অবশ্য। লজ্জা পাচ্ছি বড্ড। খুব ছড়িয়েছি।
আমি এককালের পাতি স্টুডেন্ট একটা পাতি কম্পানিতে পাতি পোস্টে দাসত্ব করেছি। উচ্চাশা, এম্বিশন-টিশন ধাতে ছিল না। দলবাজী করিনি, পলিটিক্স করিনি, নেতাগিরি করিনি, পরোপকারও সচেতনভাবে করিনি। মোটের ওপরে বুঝেছি, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো উদোম ঝক্কির। দু’যুগ আগে ডব্ডবে চোখে মৈত্রেয়ী বলছিলো, “আমি জানি স্বপনদা, তুমি চেষ্টা করলেই পারো... আমার জন্যে আমাদের জন্য... এইটুকু!” সিনেমা-মার্কা বোগাস সেন্টু এক্কেবারে। নিরেস সাদাসাপটা বলেছিলাম, “আমার দ্বারা হবে না। ওয়েট কোরো না, তোমার বাবার ডিসিশন মেনে নাও।” বিয়ের নেমন্তন্নে গিফট দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছিলাম। দাঁত পিষে মৈত্রেয়ী গালি দিয়েছিলো “বজ্জাত!” দু’একজন উট্কো সহানুভূতি জানিয়েছিলো, “জেনেরাস!”
আমি একা। ভাইবোনেরা মাঝে সাঝে মোবাইলে খবর নেয়। “বেশ তো আছিস্ রাজার হালে।” ওরা নিজেরা কেউকেটা, আবার কেতাবাজ ছেলেমেয়ে বৌমা-জামাইদের অহঙ্কারী বাপ-শ্বশুর। পৈতৃক বাড়ি-বেচা টাকার অংশে ওয়ানরুম ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম নিরিবিলিতে। বাকিটা থুপে দিলাম ব্যাঙ্কে। স্বপাক; রান্নাটা পারি, ভালোওবাসি। ঠিকে মাসি অর্ধেকদিন কামাই। একদিন দুম্ করে ছাড়িয়ে দিয়ে আরেকজনকে রাখলাম। সমস্যা কমলো না, মেনে নিলাম। আমি মেনে নিই। কেউ দৌড়ে সিঁড়ি চড়লে সাবধানে পাশে সরে যাই। যাও, যার তাড়া! অন্যের সাফল্য শুনলে চাপা চাপা দুঃখ বা হিংসে (পরশ্রীকাতরতা কিনা জানি না) হয়, কিন্তু অভিনন্দনটা জানিয়ে দিই।
এসব আমার গল্প। আমার মতো নিষ্কম্মার ঢেঁকির। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিতে হলো রোগের ধাক্কায়। আমার সংবর্ধনায় পুলকেশবাবু পড়লেন, “স্বপনদা’র মতো নিবিবার্দী লোক বিরল। সাতেপাঁচে নেই, নিজের কাজটুকু নিঁখুতভাবে উৎরে দিতেন। সাহায্য চাইলে বিমুখ করেননি কাউকে, আবার যেচে উপদেশ দেওয়ায় তাঁর অরুচি। সরল, ঋষির মতো এরকম মানুষ আজকাল আর কোথায়? ওঁর স্বভাবের সৌন্দর্য চিরকাল আমাদের মনে বিরাজ করবে।” আরে ক্কেলো! থামো ভাই! বলে কী? জুনিয়ার দেবাদিত্য গাইলো... “রহে না রহে হম্ মহেকা করেঙ্গে...।” ভালো গলা, কুমার শানু-টাইপ। তবে গানটা মেয়েলী। আমার চোখ ভিজে ভিজে। উপহারের পর্বত ঘাড়ে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরলাম। কাজের মেয়ে পলা লোভ দিল, “ও কাকু, কত কী পেয়েচো গো!” “যা, নিবি তো নিয়ে যা, যেটা ইচ্ছে... আমার আর...!” বলেছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের রোগ আমার! অনেক গচ্চা। কী লাভ? টেক্সাসে যাওয়ার আগে বড়দা একদিন ড্রাইভার নিয়ে এসেছিল, “ওদেশে ভালো ট্রীটমেন্ট আছে, যাবি নাকি?” ‘নাকি’ শুনে হাসি পাচ্ছিল, তাই হাসলাম। বড়দা ভুরু কুঁচকে উঠে গেল। ফিস্ফিস করে বললাম, “চিন্তা কোরো না। আজকাল সরকারি হাসপাতালেও ভালো চিকিৎসা হয়।” পুনেতে প্রকান্ড ফ্ল্যাট কিনেছে অধীরদা। দিদি ফোনে কেঁদে কেটে একশা। সান্ত্বনা দিলাম, “আরে, অতো ভেব না।” কোত্থেকে খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেছিল মৈত্রেয়ী। ফল-টল, হরলিক্স এনেছিল। ওর বর ব্যাঙ্কের জোনাল ম্যানেজার। হায়দরাবাদে পোস্টিং। যাওয়ার আগে বলল, “সাবধানে থেকো।” তারপর ফোঁস্ করে নিশ্বাস ফেললো। আমি হাসলাম। কী, ডিসিশন ঠিক ছিল না মৈত্রেয়ী?
হাসপাতালে দিনরাতের হিসেব থাকে নাকি? পাশের বেডে কী হচ্ছে না হচ্ছে কে দেখে? মাঝে মাঝে ডাক্তার বিরক্ত করেছে, “চোখ খুলুন। হাতটা তুলুন। ইন্জেকশন দেব। বলুন কোথায় কষ্ট?” হঠাৎ ভক্ভক্ পেচ্ছাপের গন্ধ পচা পুঁজরক্তের গন্ধ ছাপিয়ে হসপিটাল ফিনাইলের গন্ধ। কতদিন ছিলাম গুনে দেখিনি। কে এসেছিল বা আদৌ কেউ এসেছিল কিনা, জানতে চাইনি। তবে জ্ঞান থাকলে দেবাদিত্যের গানের কথাগুলো... নেশার মতো।
--দু’রাত্তির ধরে হাসপাতালের মর্গে। এই কাঁঠালপাকা গরমে জ্যান্তরাই পচে উঠছে...!
--ভাগ্নে আসবে শুনেছিলাম। মুখাগ্নি করবে? কোথায়? ছোটভাইও তো দুগার্পুর না আসানসোলে...?
--সব ধান্দাবাজ। ওসব ছাড়ো। শ্মশান অবধি পৌঁছাতে হবে... সোজা চুল্লি।
আমার সহকর্মীদের নাকে মোটা করে রুমাল পেঁচানো।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন