একাকীত্ব
আমার ভালো লাগে
একাকীত্ব আমার ভালো লাগে; ভারতের আর পৃথিবীর যে শহরেই গেছি, একা-
একা পথে হাঁটতে আমার ভালো লেগেছে। কতো গ্রাম যে চাকুরিসূত্রে ঘুরেছি; কাজ শেষ হলেই
একা-একা ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রামের পথে। চারিদিকে চাইতে-চাইতে ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন আশিতে
পৌঁছে কেবল স্মৃতিচারণ করি বটে কিন্তু মগজের ভেতরে এক শহরের পথের সঙ্গে আরেক শহর, এক
গ্রামের পথের সঙ্গে আরেক পথ গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু একাকীত্বের বোধে যে আহ্লাদ তা এখনও
উপভোগ করি। স্কুলে পড়ার সময়ে বন্ধু তরুণ শূরের সঙ্গে বহুবার বাড়ি থেকে পালিয়েছি; আমার
মতো তরুণও কম কথা বলত। দুজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাশাপাশি হেঁটেছি কোনো কথা না বলেই; দুজনেই
চারিপাশের মানুষ, পথঘাট, বাজার, প্রকৃতি দেখতে দেখতে সময় কাটিয়েছি। হাংরি আন্দোলনের
সময়েও আমি সকলের সঙ্গে বকবক করে সময় কাটাতে পারিনি। মামলার সময়ে কলকাতার রাস্তায় দুপুর,
সন্ধ্যায়, রাতে একাই ঘুরেছি; প্রায় সকলেই তো আমার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে আর সাক্ষ্য
দিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত ওই আলাদা হওয়াও
ছিল বোধ; একাকীত্বের আনন্দের বোধ।
আমি স্বীকার করি যে আমি ইনট্রোভার্ট, যেমনটা ছিলেন কাফকা, প্রুস্ত,
আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, জে.কে.রাউলিঙ, ডাবলিউ বি ইয়েটস, ইনগ্রিড বার্গম্যান,
অড্রে হেপবার্ন, গ্রেস কেলি, জুলিয়া রবার্টস, মেরিল স্ট্রিপ, ক্লিন্ট ইস্টউড, হ্যারিসন
ফোর্ড, টম হ্যাংকস, আলফ্রেদ হিচকক, স্টিভেন স্পিলবার্গ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। একথা
ঠিক যে ইনট্রোভার্টরা নিজেদের মানসিক স্থিতি সম্পর্কে বেশি আগ্রহী; হয়তো সেকারণে লোকে
মনে করতে পারে যে সে গম্ভীর ও সংযতবাক বা চিন্তাশীল।
অন্যান্য ইনট্রোভার্টদের মতন আমিও পড়তে, লিখতে, ছবি আঁকতে, ভাবতে ভালোবাসি। একা সময়
কাটাতে যতো আনন্দ পাই তা একদল লোকের মাঝে বসে পাই না। কিন্তু ইট্রোভারশান মানে শাইনেস
নয়। ইনট্রোভারশান হল পক্ষপাত বা অনুরক্তি যখন কিনা শাইনেস জন্মায় আতান্তর থেকে। বন্ধুদের
সঙ্গে মদ খাবার জমঘটে বা হ্যাশিশ টেনে চুপচাপ একা বসে থেকেছি, কথা বলার ইচ্ছে হয়নি।
হ্যাশিশের নেশা আপনা থেকেই মনোরম দূরত্ব গড়ে তোলে, একাকীত্ব-বোধের আহ্লাদ গড়ে তোলে।
বোধ কাকে বলে? অভিধানে বলছে বোধ মানে জ্ঞান, বুদ্ধি, অনুভূতি,
উপলব্ধি, সান্ত্বনা, অনুমান, ধারণা। অনুবোধ মানে বোধটির পুনরায় আবির্ভাব। ক্লিন্টন
বি সিলি, যিনি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট’ বইটি লিখেছেন, তাতে ‘বোধ’
কবিতাটির ইংরেজি করেছেন ‘সেনসেশান’; আরেকজন অনুবাদক, ফকরুল আলম, করেছেন ‘ওভারহোয়েলমিং
সেনসেশান’। সেনসেশান কাকে বলে? অভিধান বলছে সেনসেশান মানে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে চেতনা
বা জ্ঞানলাভ, সংবেদন, গভীর আবেগের অভিব্যক্তি। বোধের এতগুলো অভিধায় আমি বেশ কনফিউজড,
আর তার ফলে, আমি যে নির্বোধ তা নিজেকে মনে করিয়ে দেবার জন্য, কৈশোরে বাবার দেয়া চয়েসেস্ট
উপাধিগুলো -- বেল্লিক, ইল্লুতে, নিব্বুধে -- মগজের সঙ্গীতযন্ত্রে আজও বাজিয়ে চলেছি।
এর কারণ, বয়সের ভারে, আমার একাকীত্ববোধ, আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধ
থেকে নিজেকে ছাড়াবার কোনো কারণ দেখি না। জীবনানন্দীয় বোধে আমি পীড়িত-ভারাক্রান্ত নই;
কুড়িজনের একান্নবর্তী পরিবার আর অন্ত্যজ বিহারি ও অতিদরিদ্র মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা
পাড়ায় শৈশব কাটানোর দরুণ জীবনানন্দীয় মধ্যবিত্ত দার্শনিক অ-সুখের সম্ভাবনা গড়ে উঠতে
পারেনি অস্তিত্বে। কিন্তু সেই পাড়াটাই শিখিয়ে
দিয়েছিল কেমন করে একাকীত্বকে এনজয় করতে হয়। নিঃসঙ্গতাকে নয়, একাকীত্বকে।
একাকীত্ববোধ কী? তা নিয়ে কম ভাবিনি; অন্যের নয়, নিজের। ব্যাপারটা
কি অন্যের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অভাব, নাকি মনের স্হায়ী বা সাময়িক অবস্হা? অ্যানিমাল
প্ল্যানেটে দেখি প্রিডেটর প্রাণীরা, যেমন বাঘ বা সিংহ, একাই ঘুরে বেড়ায়; প্রিডেটর বলে,
তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, প্রকৃতি-নির্দেশিত, যৌনগন্ধের ঋতুর কয়েকটা দিন বাদ দিলে। তাহলে
আমার এই একাকীত্ববোধ কি প্রিডেটরের নার্সিসিস্টিক বৈভব, স্বাতন্ত্র্যবোধের উল্লসিত
সুবিকার? একাকীত্ববোধ, সত্তর পেরিয়ে যতটা বুঝেছি, নিঃসঙ্গতার অনুবোধ থেকে ঘামের গন্ধ
পাবার কাতরতার স্তরে আলাদা।
নিঃসঙ্গতার অনুবোধ তাহলে কী? নিঃসঙ্গতা এবং একাকীত্ব যদি একজন
বৃদ্ধের জীবনে একটি যৌবনের কাল থেকেই জমাটবাঁধা স্হিতি হয়ে ওঠে, তাকে কী নামে ডাকব?
বর্তমান কালখণ্ডের একজন বুড়োর যাপনক্ষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রাচীন আর আধুনিক শব্দভাঁড়ারে
নির্ভরযোগ্য অভিধা পাইনি; বোধহয় তৈরি হয়নি এখনও। বুড়ো বয়সের যাপনক্ষয়কে অপরিবর্তনীয়
বৈশিষ্ট্যের বাহক হিসাবে এবং বস্তুজগতের সঙ্গে ভাবুকের লেনদেন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে
তাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হবে। চিন্তার প্রবাহকে সীমিত করে চলেছে শব্দেরা। নিঃসঙ্গতার তাড়নায় একাকীত্বের টুঁটি টিপে তৈরি নিজস্ব
অনুবোধকে কী বলব? যে নিঃসঙ্গতা আমার কাম্য নয়! আমি নিঃসঙ্গ নই। একা থাকতে চাই বলে আড্ডা
দিতে পারি না। বলি বটে বোধহয় এই, বোধহয় ওই, বোধহয় তাই; আদপে বোধ কিছুই হয় না।
নাকতলার ফ্ল্যাট বেচে মুম্বাই চলে আসার পর থেকে আমি যৌবনের বিষণ্ণ
মানসিকতা থেকে মুক্তির বহু উপায় খুঁজেও বেরোতে পারিনি; গোলোকধাঁধা আরও পাকিয়ে ফেলেছি।
কী বলব একে? মফঃসল শহরের উদাসীন রাস্তার ধারে কালভার্টের ওপর বসে মাথায় ওপর সান্ধ্যমশাদের উড়াল
বইবার নিঃসঙ্গতা এটা নয়। সত্তর পেরিয়ে আমি
সেই অবস্হায় চলে এসেছি, যে জেলঘরে একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধ মিলেমিশে গেছে।
আর, এই ক্ষতের পুঁজরক্ত, আমি রসিয়ে তারিয়ে চাটছি।
আমি অস্তিত্ববাদী নই যে আমার এই একাকীত্ববোধকে ‘হিউমান কান্ডিশান’
বলে চালিয়ে দেব; হিন্দু প্যাগান ইনফিডেল পরিবারে জন্মে এবং ক্যাথলিক স্কুলে পড়াশোনা
করেও একাকীত্ববোধের খ্রিষ্টধর্মী ‘হিউমান কান্ডিশান’ সম্ভব বলে মনে হয় না। জাঁ পল সার্ত্রে,
আলবেয়ার কামু, মরিস মার্লো পন্টি, কার্ল জাসপার্স প্রমুখের জীবনদশর্নের সঙ্গে খাপ খায়
না আমার ভাবনাচিন্তা। অস্তিত্ববাদকে মনে হয় খাঁটি খ্রিস্টিয়। অবশ্য, আধুনিকতার প্রভাবে পাশ্চাত্য ভাবধারা যে
চুঁয়ে-চুঁয়ে ব্যক্তিভাবুকের অজান্তেই তার
যাপনে সেঁদিয়ে যাবে না, তা চিন্তা করতে বসলেও,
ওই একাকীত্ববোধ আরও জেঁকে বসছে । ভেবে দেখেছি যে আমার একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধ
কবির, দার্শনিকের, স্বপ্নদ্রষ্টার, সন্ন্যাসীর বোধ নয়; আমি তো প্রচলিত অর্থে কোনোটাই
নই। আমি জাস্ট একজন অ্যাননিমাস, বহুদূরে বসে থাকা প্রিডেটর। বাবাকেও দেখেছি চিরকাল
একা থাকতে ভালোবাসতেন; একা গালে হাত রেখে চেয়ারে বসে থাকতেন, কিংবা একা কোনো একটা আবছা
ফোটোকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সজীব করে তুলতেন।
আমি নিজেকে ভালোবাসি, চিরকাল, সত্তর পেরিয়েও, আমার অনুভূতির মাত্রা
আমায় অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে, সন্ত্রস্ত থাকতে পছন্দ করি; ভাবুক আমির সঙ্গে বাইরের
আমিপোস্টারের অবিরাম বোঝাপড়া খেয়োখেয়ি চলতে থাক।
হিন্দু প্রসঙ্গটা এইজন্য পাড়লুম যে অস্তিত্ববাদীরা ‘গড’ নিয়ে ভাবনাচিন্তা
করে গেছেন। হিন্দু প্যাগান ইনফিডেল পরিবারে জন্ম, এরকম একজন ভাবুককে যদি জিজ্ঞাসা করা
হয় যে গড বা ঈশ্বর ব্যাপারটা কী, তাহলে তিনি সদুত্তর দিতে পারবেন না, কেননা এই ভাবকল্প,
যাকে আটপৌরে ভারতীয় অভিধায় বলা হয় ‘ভগবান’, তার রূপসংজ্ঞা জানা নেই কারোর। হিন্দু বাঙালির
জনমানসে তিনি কখনও পরিবার বিশেষের ইষ্টদেবতা, কখনও বা তিনি পুজোর ঘরে বা ঘরের কুলুঙ্গিতে
রাখা হিন্দুর দেবী-দেবতাদের নিরাকার জগাখিচুড়ি, কিংবা নিরীশ্বরবাদী হলে তাঁর কাছে ওই
শব্দটা ফোঁপরা, অনেকের বাড়িতে আবার সোনা, পিতল, রুপোর গোপাল। ব্রাহ্মরা এই দার্শনিক
ফাঁদ থেকে বেরোবার প্রয়াস করেছিলেন; রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘পিতার বোধ’। হিন্দু প্যাগান
ইনফিডেল পরিবারে যে জন্মেছে তার পক্ষে, সে কারণে, নিজেকে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসাবে
চিহ্ণিত করাটা ঘোলাটে জলে স্বেচ্ছাকৃত হাবুডুবুর ফল। কলকাতায় দেখেছি, অমন পরিবারের
লেখকদের যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি হিন্দু’, তাহলে অনেকে ঘাবড়ে যান, উত্তর দিতে আমতা-আমতা করেন। কেন এরকম
জবড়জং মনস্হিতি তৈরি হয়, তা জরিপ করে আত্মসমীক্ষা করেন না। তাঁদের ‘বোধ’ বোধহয় বোধাতীত।
ভাবকল্প হিসাবে গড বা ঈশ্বর আছেন না নেই, সেসব যুক্তিতক্কোর সঙ্গে
আমার একাকীত্ববোধের সম্পর্ক নেই। এই গদ্যের শিরোনামের এলাকা নিয়ে কথা বলছি। আমার একাকীত্ববোধ
কোনো একটি বিশেষ চাহিদার চাপে তৈরি হয়নি। আমি এই লেখাটা লিখতে বসেছি, শুনতে বোকামি
মনে হলেও, এই আত্মভালোবাসা-বোধের অসহ্য আচ্ছন্নতা বুঝে ওঠার জন্য। ভান করি, কিন্তু কোনো ব্যাপারেই ‘উদাসীন’ আনন্দ
বোধ করি না, অথচ দুঃখে ডুবে থাকার মতো, বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পর, কোনো ঘটনা ঘটেনি বহুকাল যাবত। কেউ যখন জানতে চান,
‘কেমন আছেন’, তখন তার উত্তরে বলি, ‘এক-একজন ডাক্তারের কাছে এক-একটা অঙ্গ জমা রাখতে
হয়েছে’ , মানে, মগজের কথাটা ফাঁস করি না, দেহের কথা দিয়ে চাপা দিই। আসলে আমি সুস্পষ্টভাবে
জানি না আমি কেমন আছি। যিনি অমন প্রশ্ন করেন, তিনি নিজেও বলেন, ‘চলে যাচ্ছ।’ ‘মনখারাপ’
কিংবা ‘মন ভালো নেই’ অভিব্যক্তিগুলোও ফালতু
মনে হয়।
মৃত্যু সম্পর্কে, এই বয়সে যে মানসিক ভীতি অনেকের হয়, তাও আমার
দেখা দেয়নি এখনও। আমার ভীতিটা অসুস্হ হবার, হাসপাতালে ভর্তি হবার। বেশ কয়েকবার আমাকে
হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সময় কাটাতে হয়েছে। এখন মনে হয় একাকীত্ববোধের সঙ্গে নিঃসঙ্গতার অনুবোধের মিশ্রণে
গড়ে-ওঠা অবস্হাটা সহজাত, অন্তর্মুখ, স্বকীয় আত্মজ্ঞানের স্বনির্মিত ডামাডোল-কারাগার,
উন্মাদ প্রেমে আটকে কিশোরের ব্যাখ্যাহীনতার মতন; আমি যেন পুনরুদ্ধারের অযোগ্য কোনও
আত্মপরিসরে হারিয়ে গেছি, আমি চাই না যে আমাকে কেউ খুঁজে পাক। আমি নিজের বানানো স্বপ্রেমের
বেদনাময় জেলখানা থেকে বেরোবার চেষ্টা করি, কয়েকদিনের জন্য বেরোই, আবার একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার
অনুবোধ ঘিরে ধরে আমাকে। অথচ আমি তো নিঃসঙ্গ
নই, সত্তর বছর বয়সী আমার স্ত্রী রয়েছেন আমার সঙ্গে। কিন্তু তিনিও, কি ক্ষমাহীন ট্র্যাজিক
অবস্হা, আক্রান্ত হয়ে রয়েছেন দিনানুদৈনিকের উদাসীনতায়।
ফেসবুকের অধিবাস্তব জগতে তৈরি মানব-সম্পর্কের মাধ্যমে একাকীত্ববোধ
ও নিঃসঙ্গতার অনুবোধ দূর করার প্রয়াস করে দেখেছি; পাঁচহাজার বন্ধুর কেউই তো বাস্তব
নয়, রক্তমাংসের নয়। আর যে মলয় রায়চৌধুরীকে সেখানে উপস্হাপন করি, সে তো আমি নই; সে তো
নির্মিত একটি প্রতিস্ব, যার জন্য মলয় রায়চৌধুরী অবন্তিকা নামে একজন তরুণীর প্রতিস্ব
সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়েছে, যে যুবতী, আমার অভিজ্ঞতায় সংগ্রহ করা বহু যুবতীর প্রতিস্বের
অভ্রকণা। তাছাড়া রক্তমাংসের মানুষ তো রয়েছে আশে-পাশে, কই কোনো রদবদল তো ঘটছে না আমার
ও আমার স্ত্রীর নিজের-নিজের সন্ত্রস্ত আত্মবোধে!
আমার মনে হয়, ব্যক্তির নিঃসঙ্গতার অনুবোধের সঙ্গে একাকীত্ববোধের
পার্থক্য হল যে নিঃসঙ্গতার স্হিতি স্বীকার করে নেয় যে ব্যক্তি এককের চারিপাশে প্রচুর
লোকজন রয়েছেন, কয়েকজন স্বজনও রয়েছেন; মানে সেই স্হিতি সাময়িক, তাকে বদলে ফেলা যায়,
অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে অর্থবহ যোগাযোগের মাধ্যমে। সেকারণে অনেকে বলে থাকেন, “আমাকে
প্লিজ একটু একা থাকতে দিন!” নিঃসঙ্গতার রসায়ন
ব্যক্তিএককের বাইরের। এমনকি, ব্যক্তিএকক নিঃসঙ্গতার প্রচ্ছন্ন জখম উপভোগ করতে পারে;
সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারে। একাকীত্ববোধকে সে আনন্দের অর্থে উপভোগ করতে পারে না, তা আত্মপ্রেমের
ফাঁসির দড়িতে গলা ঢোকাবার দরুণ যন্ত্রণাদায়ক, দূর্দশাসৃষ্টিকারী, হাহাকারময়। গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, এনারা নিঃসঙ্গতার স্বকীয় আনন্দ
গড়ে এনলাইটেনড হয়েছেন; নিজেদের অভিজ্ঞতাকে অন্যান্যদের মাঝে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। নিঃসঙ্গতার ক্ষমতা আছে ব্যক্তিএককের জীবনকে মঙ্গলময়
করে তোলার। স্হায়ী ছিল তাঁদের বোধ।
একজন ভাবুকের একাকীত্ববোধের স্হিতি ব্যক্তিএককের বাইরের নয় বলেই
মনে হয়; তা ব্যক্তিএককের রসায়নে গড়ে ওঠে, এক কালোগহ্বর। একা আলাদা হয়ে বসে থাকার ব্যাপার নয় একাকীত্ববোধ। একাকীত্ববোধ হল ফোঁটায়-ফোঁটায়
সঞ্চারিত উপলব্ধি, বিপত্তিমূলক উপলব্ধি। কৈশোর থেকে ঘটা বাইরের সাময়িক নিঃসঙ্গতাগুলোর
সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, আর সেগুলো স্মৃতিকে খামচে
ঘায়ের মতন রয়ে গেছে, যা মাঝে-মাঝে জ্বালা করে। বাইরের এই জন্য বলছি যে সেসব
নিঃসঙ্গতা ছিল সম্পর্কজনিত। ওই আত্মভঙ্গুর ঘটনাগুলোর কথা আমি মাঝে-মাঝে রোমন্হন করে
কিংবা লিখে নিরাময় খুঁজি, সেগুলো আমার কল্পনা-উপজাত নয়।
প্রথম যে ঘটনাটা আমার মনে আছে তা হল পাঁচ বছর বয়সে আমাকে ইমলিতলার একটা ঘরে শেকল তুলে বিকাল থেকে বন্ধ করে রেখেছিলেন
মা, পাড়ায় কপিলের বাবা আমায় তাড়ি খাইয়ে দিয়েছিলেন; ইমলিতলার অন্যান্য বিহারি বাচ্চাদের
সঙ্গে আমিও কয়েক ঢোঁক খেয়েছিলুম, আর তাড়ির গন্ধে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম। তাড়ি খাবার জন্য
মা শাস্তি দেননি, দিয়েছিলেন যাতে আমি মেজদার মতন চুরি-ডাকাতি-মারপিটের পথে না যাই।
দাদা-মেজদার সঙ্গে তাড়ি আমি ইমলিতলায় বিয়ে কিংবা উৎসব ইত্যাদিতে অনেকবারই খেয়েছি। ইমলিতলায়
বিজলিবাতি ছিল না। অন্ধকার ঘরে রাত দশটা পর্যন্ত একা বসেছিলুম এককোণে। বাবা রাতে কাজ
থেকে ফিরলে শেকল খোলা হয়েছিল। হয়ত এই ঘটনার চাপে আমি ক্রমশ অমিশুকে, হিন্দু-নাস্তিক,
অন্তর্মুখ, অন্তেবাসী, সীমালঙ্ঘনকারী, দ্রোহী হয়ে গিয়ে থাকব। গ্রন্হকীট হয়ে গিয়ে থাকব।
আত্মসন্ত্রস্ত থাকার উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার বীজ পোঁতা হয়ে গিয়ে থাকবে অস্তিত্বের রসায়নে।
১৯৫১ সালে রামমোহন রায় সেমিনারি স্কুলে শাস্তি পেয়ে সারাদিন ঠায়
একা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, স্কুলেরই অফিসঘরে, কেরানিবাবুর দৃষ্টির সামনে, দেয়ালে হেলান
দেবারও অনুমতি ছিল না। স্কুল ছুটি হয়ে যাবার পর বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়েরা চলে গিয়েছিল, সন্ধ্যাও নেমে এসেছিল, শীতের
সন্ধ্যায় অন্ধকারও ঘনিয়ে আসছিল, কেরানিবাবু চলে গিয়েছিলেন, একাই দাঁড়িয়েছিলুম, তারপর
হেডমাস্টার ক্ষেত্রমোহন পোদ্দার স্কুল-সংলগ্ন কোয়ার্টার থেকে এসে বাড়ি যাবার অনুমতি
দিলেন। ব্রাহ্মস্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে পড়ার আগে আইরিশ নানদের পরিচালিত কনভেন্ট
স্কুলে প্রাইমারি স্তর পর্যন্ত পড়েছিলুম; সেখানের নানরা কখনও একা বোধ করতে দেননি, যদিও
ইংরেজিতে সড়গড় হতে বছরখানেক লেগে গিয়েছিল। সেসময়ে, ইংরেজিতে কথা বলতে না পারার নিঃসঙ্গতাবোধ
থেকে থাকবে, যা আমার মনে নেই, কেননা তিনবছর বয়সে কনভেন্টে ভর্তি হয়েছিলুম, সপ্তাহে
একদিন সংলগ্ন চার্চে গিয়ে বাইবেল ক্লাসে হাতজোড় করে অংশ নিতে হতো।
পিছন ফিরে যে মেয়েটিকে আজ
প্রেমিকা বলে চিহ্ণিত করতে পারি, সে, স্কুলেরই সহপাঠিনী, আমি যখন কলেজে ঢুকলুম,
একটা দীর্ঘ চিঠি লিখে উধাও হয়ে গিয়েছিল ওর মায়ের সঙ্গে। প্রেমহীনতার নিঃসঙ্গতায় হয়ে
গিয়েছিলুম বিপর্যস্ত। শৈশবের উদ্বেগ উৎকন্ঠার বীজ অঙ্কুরিত হবার মাটি পেয়ে গিয়েছিল
প্রাক-যৌবনের এই ব্যর্থতাবোধে। এই ঘটনার ফলে, আমার ইনটারমিডিয়েটের (এখনকার উচ্চমাধ্যমিক)
ফলাফল প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। সেই ক্রুদ্ধ স্মৃতি বয়েছি স্নাতকস্তর পর্যন্ত, আরেকটি
যুবতীর সংস্পর্শে আসার আগে অব্দি। কিন্তু প্রথম জনকে ভুলতে পারছিলুম না বলে আকাঙ্ক্ষার
নিঃসঙ্গ আকুলতায় আক্রান্ত হয়েছিলুম। স্কুলের শাস্তিও ছিল অন্যান্য সহপাঠীদের টিটকিরি
থেকে তাকে আড়াল করার প্রয়াসে মারামারির দরুন। সেটিই আমার জীবনে প্রথম ও শেষ মারামারি।
স্কুল আর কলেজের ফাঁকটুকুতে আমি বন্ধু তরুণ
শূরের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে না বলে পালিয়েছি, নিষ্কপর্দক, এক কাপড়ে; পালিয়ে
বেড়াবার সময়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গেও তেমন কথাবার্তা বলতুম না।
কবিতা লেখার অপরাধে, ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হলুম, রাস্তা
দিয়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে গিয়ে পেচ্ছাপ-ভাসা লকআপে পোরা হল,
আর পরের দিন ওই ভাবেই হাতকড়া-দড়িতে কয়েকজন চোর-ডাকাত-খুনির সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে
আদালতে নিয়ে যাওয়া হল। বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সকলেই ছিলেন আমার লেখালিখির সমর্থনকারী,
আমার জন্য তাঁদের উদ্বেগ ছিল স্পষ্ট, তবু একা বোধ করেছিলুম, রাস্তা দিয়ে পরিচিত লোকজনদের
সামনে হাঁটার সময়, অন্ধকার লকআপে সারাটা রাত কাটাবার সময়। কোমরে দড়ি বেঁধে যখন আমায়
প্রাতঃকৃত্য সারতে পাঠানো হল তখন। ইমলিতলার ছোটোলোক পাড়ায় শৈশব কাটিয়ে থাকলেও, আমার
নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি সংবেদনায় ঘটনাটি ছিল একাকীত্ববোধ উৎসারণের জলবিভাজক।
গ্রেপ্তার হলুম বলে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করে দিল অফিস। সহকর্মীরা
আমার সঙ্গ ছেড়ে দিল। ঘিরে ধরল সন্ত্রস্ত নিঃসঙ্গতা। মামলার সময় কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার
ঠাঁই ছিল না। দিনে কোথায় খাবো, রাতে কোথায় শোবো, এই দুশ্চিন্তা থেকে জন্মেছিল দূরত্বের
একান্ত। তখনকার দিনে সাসপেন্ড হলে বেশ কিছুকাল মাইনে আটকে থাকত, তারপর দেয়া হতো কেবল
বেসিক পে। একমাত্র থাকার জায়গা ছিল উত্তরপাড়ায় আমাদের বসতবাড়ির খণ্ডহর, বিজলিবাতিহীন
যে বিশাল বারোটি ভুতুড়ে ঘরের পোড়ো বাড়িতে ঠাকুমা
একা থাকতেন, অত্যন্ত গরিব কয়েকঘর ভাড়াটের সঙ্গে।
দাদা সমীর রায়চৌধুরীও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন একই মামলায়। দাদার গ্রেপ্তার হবার সংবাদে
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গ্রেপ্তারির তিন দিনের মাথায় মারা গেলেন ঠাকুমা। কলেজে পড়ার সময়
দাদা উত্তরপাড়ার বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে থাকতেন; দাদাকে সবচে বেশি ভালোবাসতেন ঠাকুমা,
কেননা বড়জ্যাঠা আর মেজজ্যাঠার ছেলে হয়নি, ঠাকুমার কাছে দাদাই ছিলেন পরিবারের প্রথম
বংশধর। বাড়িতে ঠাকুমার কাছেই সব কিছু খোলাখুলি আলোচনা করতে পারতুম। যখন তাঁকে সবচেয়ে
বেশি প্রয়োজন, তখনই মারা গেলেন তিনি । ‘লস’ শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ কী? মগজের মধ্যে
‘লস’-বোধ, একে কি নিঃসঙ্গতা বলব?
১৯৬৫ সালে যখন জানতে পারলুম যে কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকারী মুচলেকা
লিখে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছেন, আগের প্রজন্মের কয়েকজন কবি আমার বিরুদ্ধে পুলিশের
পক্ষের সাক্ষী হয়েছেন, তখন আক্রান্ত হয়েছিলুম ‘একঘরে’ হয়ে যাওয়ার নিঃসঙ্গতায়। মামলা
চলার সময়ে আদালতঘরের কয়েদি-খাঁচায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াবার সময়গুলোয় বড়ো পরিত্যক্ত বোধ করতুম,
‘ফেরারিত্ব’ বললে মানায়, যদিও অনেকসময়ে বাবা, পিসেমশায়, দাদা ও কয়েকজন বন্ধু আসতেন
কেস ওঠার দিনে। অধিকাংশ কবি ও লেখক আমাকে এড়িয়ে যেতেন; তাঁদের কাছে আমি ছিলুম জলচলহীন।
কফিহাউসে কোনো টেবিলে বসতে গেলে অন্যান্যরা উঠে চলে যেতেন। খালাসিটোলাতে বসে একাই,
এক-আধদিন মদ খাচ্ছি, কেউ ভাবতে পারে? তখনকার দিনে সরকারি দোকানে গাঁজা-চরসের পুরিয়া
সস্তা ছিল - কেবল তা-ই একা ফোঁকা যেতে পারত। ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা থেকে ছাড়ান পাবার
প্রয়াসে সাহায্য করত ফুসফুসে গাঁজা-চরসের ধোঁয়া আর লিভারে মদের প্রলেপ।
আদালত সাজা দিল। এই নিঃসঙ্গতা বুঝিয়ে বলতে পারব না। কাছের বন্ধুরাও,
হাতে গোনা দুতিনজন ছাড়া, সরে গেলেন; ভেন্ন করে দিলেন আমায়, এমনকী তাঁরা বিরোধী হয়ে
উঠলেন। আমার সঙ্গে সম্পর্ক তাঁদের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পক্ষে ক্ষতিকর মনে করতেন
তাঁরা। বন্ধুত্ব হল সবচেয়ে বড়ো মূর্খতা। অথচ মূর্খতা, অজ্ঞানতা, অসতর্কতা, বিভ্রান্তি, বিমূঢ়তা, হতাশা
ছাড়া যাপন পানসে। অন্যদের সঙ্গে বসবাস করতে গেলে চাঞ্চল্য, বিক্ষোভ, অসন্তোষের অনিন্দ্যসুন্দর
মূল্য দিতেই হবে। কবির নিয়তি বলব একে?
হাইকোর্টে মামলা চলাকালীনই, কেস সাবজুডিস থাকা সত্ত্বেও, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় মকদ্দমার পক্ষে ক্ষতিকর সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। ব্যারিস্টার আমাকে তাতিয়েছিলেন ‘কনটেম্পট অব কোর্ট’
নোটিস জারি করাতে, কিন্তু তা ছিল আমার কাছে অকল্পনীয়। তারপর থেকে কাউকে বিশ্বাস করা
কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করে জিতে যাবার পর মামলা থেকে নিষ্কৃতি
পেলুম বটে, কিন্তু ততদিনে লেখকবন্ধুরা প্রায় সবাই পৃথগন্ন করে দিয়ে ছেড়ে চলে গেছেন।
অপূর্ণতাবোধ এবং গভীর নিঃসঙ্গতা ও অন্তর্মুখীনতা ঘিরে ফেলল লেখক মলয় রায়চৌধুরীকে; উদ্বেগ-উৎকন্ঠা
তাদের ডালপালা বিস্তার করে ফেলল। নানারকম ক্লান্তিকর সম্পর্কজালের অসন্মানজনক জটিলতা
আর বিপদাশঙ্কা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া জরুরি হয়ে উঠেছিল। বিপদের প্রশ্ন নেই, তবু অজানা
সর্বনাশের আশঙ্কায় ভুগতুম।
বেনারসনিবাসী চিত্রকর বন্ধু করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের ডাকে, মনমেজাজ
ফেরাতে চলে গেলুম প্রথমে বেনারস, তারপর নেপালের কাঠমাণ্ডুতে, যেখানে গিয়ে একটা বিশাল
কাঠের বাড়িতে হিপি-হিপিনীদের কলোনিতে, নানারকম মাদক, ধেনোমদ আর কাঁচামাংস খেয়ে, সাময়িক
আন্তঃসম্পর্কের মাধ্যমে, নিঃসঙ্গতাকে ভুলে থাকার উপায় বের করে ফেললুম। নেপালের কবি-লেখকরা
আর হিপি-হিপিনীরা ছিল দরাজ। অন্যের অর্থানুকুল্যে যতদিন থাকা যায়, সময় কাটিয়ে, স্বাস্হ্যের
অবনতি ঘটিয়ে, আবার ফিরতে হল সেই কল্পিত সর্বনাশের আসন্ন ঘুর্ণির পাকে। বইপড়া হয়ে উঠল
প্রধান আশ্রয়।
ধাপে-ধাপে এমন নির্জনতায় নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হয়েছিলুম যে মানসিক
ক্লান্তির চাপে লেখালিখিই ছেড়ে গেল। বা বলা যায় যে নিঃসঙ্গতার অনুবোধজনিত স্হিতির বিরুদ্ধে
সংঘর্ষ, যা আমায় কুরে খেয়ে ফেলছিল, তা এড়াবার জন্যই ছেড়ে গেল লেখালিখি। এই সময় আমার
পরিচয় হল মধ্যপ্রদেশের রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আঁকড়ে ধরার
মতন পেলুম একজনকে, আর ১৯৬৮ সালে, মাত্র তিন দিনের তুই-তোকারি পরিচয়ের শেষে, বিয়ে করলুম।
আগের যাবতীয় নিঃসঙ্গতাবোধের গোপন ফোঁপানি থেকে বেরোবার জন্য, শান্তিতে নিরিবিলি পরিবেশে
বসবাসের উদ্দেশে বদলি নিয়ে পাটনা থেকে চলে গেলুম লখনউ। ছেলে আর মেয়ের সঙ্গে বেশ ভালোই
কেটে গেল বহুদিন। চাপা পড়ে রইল উদ্বেগ-উৎকন্ঠাজনিত নিজেকে নিয়ে গড়ে ওঠা সমস্যাগুলো।
পাটনা আর কলকাতায় যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলুম। অফিসের কাজে যেতে হলে হোটেলে উঠতুম, আত্মীয়স্বজন
এবং পূর্বপরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা করতুম না; পশ্চিমবঙ্গের মফঃস্বলে কোনো তরুণ আমায় মলয় রায়চৌধুরী বলে সন্দেহ
করলে হিন্দি-উর্দুর আশ্রয় নিয়ে, আত্মপরিচয় অস্বীকার করে, পাশ কাটিয়ে যেতুম। ট্যুরে
তাই সম্পূর্ণ নাম ব্যবহার করতুম না, এম আর চৌধারি বলে পরিচয় দিতুম। দাড়ি-গোঁফ বাড়িয়ে,
আইডেনটিটি পালটে ফেলেছিলুম। লেখালিখি সম্পর্কে কোনো আগ্রহকে প্রশ্রয় দিতুম না। লেখালিখি
ছেড়ে যাবার দরুন প্রচুর পড়াশোনা করার সুযোগ হবেছিল আর দাদা ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকা প্রকাশ
আরম্ভ করলে সেই পড়াশোনা কাজে দিয়েছিল। নিজেকে
লুকিয়ে ফেলার কারণ মনের গভীরে নিঃসঙ্গতার ভীতি স্হায়ী করে দিয়েছিল উদ্বেগ-উৎকন্ঠাকে।
স্ত্রীকে ট্যুরে সঙ্গে নিয়ে যেতুম শাকিলা নাম দিয়ে, কেননা স্ত্রীও ভালো হিন্দি-উর্দু
বলতে পারে।
লখনউতে মা মারা গেলেন। এই মর্মান্তিক অবস্হায় আমার চেয়ে বয়সে দেড়
দশক ছোটো অবাঙালি একজন অধস্তন মহিলা অফিসার আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিপদ বাড়িয়ে দিলেন।
আমি তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হলুম। কিছুকাল পরে উনি আত্মহত্যা করেছিলেন,
যে ঘটনার জন্য আমার সব সময় মনে হয় যে আমিই দায়ি; এ আরও ভয়ানক অস্বস্তিকর বেদনাময় মনঃস্হিতি।
লখনউয়ের এই নতুন ধরনের বিপজ্জনক অন্তর্মুখীনতা কাটাতে, যা ঠাকুমা ছাড়া কারোর সঙ্গে
আলোচনা করা সম্ভব ছিল না, করিনি কখনও, নিজেকে
নিজে ভয়-পাওয়া এড়াতে, আমি বদলি নিয়ে লখনউ থেকে চলে গেলুম মুম্বাই, সে-শহরের অতিব্যস্ত
ভিড়ে হারিয়ে থাকার অভিপ্রায়ে। মা মারা যাবার পর লেখালিখি আবার ফিরে এলো; মায়ের অনুপস্হিতিকে
কাটিয়ে তোলার উপায় হিসাবে, হয়তো। গ্রন্হকীট হবার কারণে, এবং ট্যুরে প্রচুর অভিজ্ঞতার
দরুণ, মগজে এত কথা জমে গিয়েছিল যে সেগুলো কাগজের পাতা ছাড়া আর কাউকে বলা যেত না; এই প্রক্রিয়াকে বোধহয় সাহিত্যকর্ম বলা
যাবে না। ঠাকুমার আর মায়ের অনুপস্হিতি বিষণ্ণ
করে তুলতো।
তাড়ি খেয়েছিলুম বলে ছোটোবেলায় মা শাস্তি দিয়েছিলেন। নতুনভাবে লেখালিখি
শুরু করে আমি নতুনভাবে প্রচুর মদ আর সিগারেট খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলুম, এবং তা একা
বসে । লখনউ-এর সময় থেকে আমি অনেকের সঙ্গে বসে মদ খাওয়া এনজয় করতে পারি না; মদ্যপান ব্যাপারটা আমার প্রিভেসির
অঙ্গ; তার সঙ্গে লেখালিখির কোনো সম্পর্ক নেই। হয়তো নেশা করার মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের
প্রয়াস ছিল মদ্যপান। সত্তর পেরিয়ে অবশ্য কখনও-সখনও আবসাঁথ ও সিঙ্গল মল্ট ছাড়া আমি খাই
না বিশেষ। তাও ছেলে যখন বিদেশ থেকে আসার সময়ে আনে।
মুম্বাইতে থাকার সময়ে সর্বভারতীয় ট্যুরের সুযোগ পেলুম। ভারতের
প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে ঘোরাঘুরি। মেয়ের বিয়ে
হবার পর সে বিদেশে চলে গিয়েছিল; ছেলে চলে গিয়েছিল হস্টেলে, তারপর বিদেশের চাকরিতে।
অফিসের ট্যুরে আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতুম অনেক সময়ে, যাতে ও বাড়িতে নিঃসঙ্গ বোধ
না করে। চাকুরিসূত্রে, ট্যুরের সূত্রে, হাজার-হাজার মানুষের মাঝে গিয়ে পড়েছি, তবু সর্বনাশের
ঘুমন্ত উদ্বেগ-উৎকন্ঠার বোধ আচমকা উঁকি দিয়েছে কখনও-কখনও। এরকম মনে হয়নি যে আমি এলিয়েনেটেড; যাপনে পার্থক্যবোধ
কাজ করেছে বলে মনে হয় ন। মনে হয়েছে, এবার কিছু একটা নির্ঘাৎ ঘটবে, ভয়ানক কিছু ঘটতে
চলল, যা অপ্রত্যাশিত তা-ই ঘটে গিয়ে আতঙ্কে ঘিরে ফেলবে আমাকে।
নিরাময় হিসাবে দাদার কাছেপিঠে থাকব অনুমান করে মুম্বাই থেকে কলকাতা
অফিসে বদলি নিলুম, বিভাগীয় প্রধান হিসাবে, পশ্চিমবাংলার গ্রামীণ মানুষের জীবনকে কাছ
থেকে জানবার লোভে। কলকাতায় কবি-লেখকদের কয়েকটা জমায়েতে অংশ নিয়ে বুঝতে পারলুম যে আমার
নিজস্ব চিন্তার পরিসরে এই ধরনের জমায়েতগুলো
বিরক্তিকর, আমার পক্ষে বড়ই গোলমেলে, অস্বস্তিকর, মানসিক অশান্তি-সৃষ্টিকারী, মনোযোগ-ভঙ্গকারী,
নিরাশাজনক, মরচে পড়া হাসির মানুষদের জমঘট। আত্মনিরীক্ষায় বসে অবাক হলুম যে এই সমস্ত
জমায়েতগুলোয় অংশ নিয়ে আমি প্রকৃতপক্ষে সর্বনাশের
আশঙ্কা থেকে বেরোতে চেষ্টা করেছি, অথচ সেগুলো আমাকে আরও বেশি নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। ভাবতুম
যে আমি কি শেষে ড্যানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো’ হয়ে গেলুম? বা মার্সেল প্রুস্তের
‘সোয়ান্স ওয়ের’ চরিত্র হয়ে গেলুম? ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’ ফিল্মের টম হ্যাঙ্কস? নানা আত্মআরোপিত
দুশ্চিন্তা এবং নিজেকে গুটিয়ে নেবার প্রক্রিয়ায় দু’বার হৃদরোগে আক্রান্ত হলুম, অ্যানজিওপ্লাস্টি
করাতে হল, এবং চিকিৎসাবিভ্রাটে আমার আরথ্রাইটিস হয়ে গেল, যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাইনি,
এবং যা আমার লেখালিখির অন্তরায় হয়ে দেখা দিল। একমাত্র কেদার ভাদুড়ীকে দেখে সুস্হ বোধ
করতুম, কেননা উনিও আঙুলের সমস্যায় লিখতে পারছিলেন না; একজন যুবককে ডিকটেশান দিতেন;
বলতেন, যদি দরকার পড়ে তাহলে পায়ের আঙুলে ডটপেন ধরে লিখবেন।
গুটিয়ে নিয়ে আরও সামাজিকতা-বহির্ভূত হয়ে নিজের অনুভূতি নিজের ভেতরে
লুকিয়ে ফেলার কৌশল আয়ত্ব করে ফেললুম। আরথ্রাইটিসের জন্য লেখকীয় কষ্ট লাঘবের নানা উপায়
বাতলাতেন অনেকে, কিন্তু সেগুলো কোনোটাই গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলুম না। লেখক-কবি যাঁরা
আসতেন তাঁরা বলিয়ে-কইয়ে না হলে চুপচাপ বসে সময় কাটাতে হতো। কেউ-কেউ বলতেন, কাউকে সামনে
বসিয়ে ডিকটেশান দিন। সমস্যা ছিল যে আমি চাইতুমই না যে কেউ একজন আমার সামনে বসে থাকুক।
আরথ্রারাইটিসের কারণে আমাকে ফিজিওথেরাপির যোগব্যায়াম করতে হয়; সেই সূত্রে ডাক্তার পরামর্শ
দিয়েছিলেন যে আমি যেন মেডিটেশান করি। মেডিটেশান করতে বসে আমার মন একাগ্র হবার পরিবর্তে
আরও সন্ত্রস্ত একাকীত্ব চাপিয়ে দিল আমার মগজে। তা কিন্তু অনীহা নয়। আমি এমন-কিছু নই,
কিন্তু আমি যা আমি তা-ই, তো কীই বা করা যাবে!
স্মৃতিবাহিত তূষ্ণীভূত বোধের ভারে বোবা হয়ে থাকার অভ্যাস হয়ে গেল।
সামনাসামনি মুখোমুখি যোগাযোগের প্রতিকল্প হয়ে উঠেছে আমার লেখালিখি। বিষণ্ণ নিঃসঙ্গতার
সঙ্গে মিশে সন্ত্রস্ত একাকীত্ববোধ নিয়ে নিল নতুন রূপ। কলকাতা থেকে আবার ফিরে এসেছি
মুম্বাই। ইনটারনেটকে, ফেসবুককে, ব্যবহার করার চেষ্টা করি, একজন নির্মিত মলয় রায়চৌধুরীকে
উপস্হাপন করি, কিন্তু ব্যাস, যতক্ষণ কমপিউটারের সামনে বসি, ওই সময়টুকুই; তারপর যেমনকার
তেমন। আরথ্রাইটিস লেখালিখির অন্তরায় হয়ে উঠেছিল বলে বার্ধক্যে আমি কমপিউটার রপ্ত করতে
বাধ্য হয়েছি; এক আঙুলে টাইপ করে অদৃশ্য লেখক ও সম্পাদকের সঙ্গে অধিবাস্তব যোগাযোগ গড়ে
তোলার প্রয়াস করি। সে সম্পর্ক কাচের কমপিউটার-পর্দায় সীমিত। আমার এই স্হিতিকে ডিপ্রেশান
বলব না। লেখক উদয়ন ঘোষ, যিনি কলকাতায় আমার নাকতলার বাসার কাছে থাকতেন, তাঁকে দেখেছি
অসুস্হতার জন্য লিখতে পারছেন না বলে অনপনেয় ডিপ্রেশানে ভুগছেন, চিকিৎসার যন্ত্রপাতিতে
ঘেরা বিছানায় অদৃশ্য লিলিপুটদের দড়িতে বাঁধা গালিভার শুয়ে আছেন।
মুম্বাইতে দেখি গুজরাতি বুড়ো-বুড়িরা কোথাও একত্রিত হন, গল্প আর
হাসাহাসি করেন, মেলামেশা করেন। আমি তা পারি না। এই না-পারার উদ্বেগজনিত উৎকন্ঠায় নিজেই
নিজেকে কোণঠাসা করে ফেলেছি। বাজার যাই, অটোয় চাপি, ভিড়ের ভেতর হাঁটি, কিন্তু একা থাকতে
ভালোলাগার দরুণ আমার আত্মিক বিপন্নতা আরও চেপে ধরে। এ হল সদ্ভাবহীন ব্যথা, অপ্রীতিকর
পীড়া, আত্মিক শাস্তি-যন্ত্রণা, যার কোনো পেইনকিলার নেই। নিগূঢ় অনাসক্তিতে ভুগি। ভুগছি
যে, তা টের পাই। বুঝতে পারি যে নেগেটিভ ভাইব ঘিরে রেখেছে আমাকে যার উৎস আমি নিজে, তা
কাটিয়ে উঠতে পারি না। অথচ আমি মিস্যানথ্রপ নই। আমার হাঁপানি সারাতে যে বিশেষজ্ঞের কাছে
গিয়েছিলুম, তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ব্যাপারটা সম্ভবত জেনেটিকাল! ওনার বক্তব্য নির্ভরযোগ্য
মনে হয়নি, যদিও উনি আমার হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করেছেন, যা কলকাতার বিশেষজ্ঞরা
পারেননি। ঠাকুরমা আর মেজজ্যাঠার হাঁপানি ছিল।
আমি ডিপ্রেশনে ভুগি না; ডিপ্রেশন হল এমন মুড যা কাউকে সক্রিয় হতে
দেয় না। তা লোকটার চিন্তা, আচরণ, অনুভূতি, প্রণোদনাকে প্রভাবিত করে। তা দুঃখের কারণে, চিন্তা করার অসুবিধার কারণে, ঘুম না হবার
কারণে ঘটতে পারে। সে লোকটা আশাহীনতা, আত্মহত্যার ইচ্ছা, নিরাশা, মনোভঙ্গে ভোগে। আহ্লাদ
কাকে বলে টের পায় না। ডিপ্রেশনে মনোচিকিৎসা করাতে হয়।
মনে হয়, নিঃসঙ্গতাময় সর্বনাশের ভয়, যা মগজ থেকে তলপেট পর্যন্ত
ভেসে বেড়ায়, ভাসা-ভাসা এই অস্হিরতা-অনিশ্চয়তা-অব্যবস্হিতচিত্ততা থেকে উৎপন্ন আমার সন্ত্রস্ত-একাকীত্ববোধ
আরও নিদারুণ এবং দুর্বিসহ হয়ে গেছে। তা যেন আমার মগজের পোড়ো বাড়ির জবরদখলকারী বাসিন্দা।
বিষণ্ণ নিঃসঙ্গতার অনুবোধ থেকে যাতে বেরোতে
পারি, এই আশায় মাস ছয়েকের জন্য কলকাতায় গিয়েছিলুম
২০১৩ সালের বর্ষায়। তরুণ কবি-লেখক-সম্পাদকরা আসতেন; তাঁদের কাছে হয়তো আমি বোধাতীত রয়ে
গেলুম। নিঃসঙ্গতায় মোড়া একাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে
পারলুম না। চেতনায় ঘাপটি মেরে-থাকা অস্বচ্ছন্দ উপদ্রুতির নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাই
না, যাকে চিহ্ণিত করে এই আত্মপরিসর থেকে বেরিয়ে যেতে পারব। লেখালিখিকে উপায় মনে করে তাতে বেশিরভাগ সময় কাটাই,
তার ফলে আরও পাকিয়ে যেতে থাকি চেতনার ঘূর্ণিতে। আমি যা ইচ্ছা, যেমনভাবে ইচ্ছা লিখি,
কাঁটাতারের পাক খুলে বেরোবার উদ্দেশে, কে কী
বলল বা লিখল বড় একটা এসে যায় না তাই। সাহিত্য হচ্ছে কি হচ্ছে না সেসব গালগল্পকে মনে
হয় ফালতু চিন্তা।
অ্যামস্টারডমে ভ্যান গগের মিউজিয়ামে তাঁর আঁকা পেইনটিংগুলো দেখতে-দেখতে
বুঝতে পেরেছি, একাকীত্ববোধের সঙ্গে স্বাধীনতাবোধকে তিনি কেমনভাবে মিশিয়ে ফেলার প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ভ্যান গগের কোনো
ফোটো নেই। তিনি নিজেই নিজের একাধিক পোরট্রেট এঁকে না গেলে আমরা জানতে পারতুম না তাঁকে
কেমন দেখতে ছিল। নিজের স্বাধীনতাবোধকে তিনি অকাট্য, সিদ্ধ, বৈধ, পর্যাপ্ত হিসাবে বলবৎ
করে গেছেন। হাঁক পাড়ার আদিমতাকে দেখিয়ে গেছেন এঁকে। দেখিয়ে গেছেন, ব্যক্তিএকক তার নিজের
একাকীত্ববোধের দরুণ নিজেই নিজের মালিক।
আরথ্রাইটিস সত্ত্বেও, একটা ড্রইংখাতা আর ক্রেয়নবাক্স কিনেছি, যথেচ্ছ
আঁকব বলে, একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধকে ধরে রাখতে চাই। আঁকি শুনে একজন বিদেশিনী
চিত্রশিল্পী রঙতুলির এবং কাগজের পুরো সেট কিনে দিয়ে গেছেন।