কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৫ |
বাইশে শ্রাবণের পর
হঠাৎ কেন যে মনে পড়িল আমার উদ্যানের একটি রজনীগন্ধার
অকালমৃত্যু হইয়াছিল - সারি সারি ধ্বংসস্তূপের
অনিবার্য্যতা প্রায় যখন মানিয়া লইয়াছি, প্রায়ই যখন জমা-খরচের হিসাবনিকেশ লাট্টুর মত পাকের পর
পাক খাইয়া জাদুঘরের আওতার বাহিরেও পৌঁছাইয়া যাইতেছে, যে বাতাস,
যে কাঞ্চণবর্ণা ধূলিকণারও কোনোদিন হারাইয়া যাইবারও সদিচ্ছা ছিল না,
অথচ প্যালেট তোলপাড় করিয়া উপচাইয়া ঝড় হইয়া উড়িয়া ও উড়াইয়া দিয়া চলিয়া
গেল, ভাবিয়া দেখিলাম
জন্মের পূর্ব্বে ও মৃত্যুর অব্যবহিত পর সারি প্রশ্নগুলি নিঃশব্দে দন্ডায়মান থাকিলেও
থাকিতে পারে কিন্তু মৃত্যুর পর আমার রজনীগন্ধা কোনো প্রেক্ষিতেই “সেই ঘাসওয়ালা, টুকরো মেঘেদের ভর করে মরিয়া রহস্যে…,
অনেক জলাশয়কে ঘিরে…”
ইত্যাদি হইয়া উঠিতেছে না। ইত্যবসরে মস্তকোপরি শেষ সম্বল বোঁচকাটি লইয়াও
সাড়ে তিনমাসের বকেয়া ভাড়া মিটাইতে না পারিয়া পদব্রজে স্বগ্রামে প্রস্থান করত পূর্ব্বক
পরিযায়ীটি মনে ভাবিতেছিল, ‘রুটি নয়, একটু গরমভাত পেলে আজ কি ভালোই না
হতো’ (নগর পরিত্যাগ করিবার কালে উহার বামহস্তের স্ক্রু-প্লায়ারটি বামহস্তেই রহিয়া গিয়াছিল) নীরবতার পর নিঃশেষিত
নীরবতাও উহার দীর্ঘ প্রলম্বিত অবস্থান, রুটির লাইনে দাঁড়াইতেই
দৃশ্যমান হইল যে স্থলে পৃথিবী শেষ হইবার কথা এক্ষণে সে স্থান পঞ্চভূতে লীন হইয়া গিয়াছে। এবং রুটিজন্মের
পর উহার জীবনের ত্রিশকোটি বৎসর প্রায়ই অতিক্রান্ত, তথাপি আজ অবধি উহার কোনো বন্ধু হয় নাই। এবং আশ্চর্য্যের পর অধিকতর আশ্চর্য্য পিপাসা
নিবৃত্তি করিবার জন্য অতি সামান্য জল, এগারো নম্বর ওয়র্ডের কোয়ারান্টাইন
সেন্টারে উহাও কেমন অমিল হইয়া উঠিয়াছে। হায় এরূপ জল-জীবন অপেক্ষা চাতক-জীবন শ্রেষ্ঠ। এরূপ নগরজীবন অপেক্ষা
কলঙ্কপূর্ণচন্দ্রমাও অধিকতর সুষমিত।
মৃত রজনীগন্ধার শোকে আমি গভীর অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলাম। একে নিশুতি রাত্রি, তাহার উপর কয়দিন ধরিয়া অবিশ্রান্ত বর্ষণ। ঘন ঘন বজ্রপাত
ও ঝঞ্ঝাব্যতার উপদ্রবে বিশ্বচরাচর যেন লোপ পাইয়াছে। বিক্ষুব্ধ বাতাস কখন যে দীপ নিভাইয়া দিয়া সমস্ত
বাটীকে কালিমালিপ্ত করিয়া তুলিয়াছে টের পাই নাই।
অযূত যুগের
ব্যবধান, ক্ষণিক বিদ্যুৎ চমকে তবু দৃশ্যমান হইল,
স্কন্ধে কাহাকে মাদুরে জড়াইয়া চারিজন শববাহক নিঃশব্দে চলিতেছে,
গ্রামের কর্দমাক্ত পথ…
……………………………………………
প্রয়াত
কবি শম্ভু রক্ষিত স্মরণে-
“সেই ঘাসওয়ালা…” - কবি রচিত ‘প্রিয়
ধ্বনির জন্য কান্না’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত ও সংযোজিত
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন