কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

শুভ্রনীল চক্রবর্তী




আল্ বিলেক্ : সময়-মানবের উপকথা





(২)

বিলেকের সবকিছু মনে পড়ার পর সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলো যে ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টে তার যোগদান সম্পর্কে সে পৃথিবীকে সব সত্য জানাবে। আসলে আল এবং এডের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে গেলে এই এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে আলোকপাত করা ভীষণ জরুরী। ১৯৪৩ সালে আমেরিকান নেভি দ্বারা পরিচালিত এই গোপন মিশনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন এড ক্যামেরন এবং তাঁর ভাই ডানকান ক্যামেরন।

১৯৫৫ সালে মরিস কে জেসাপ একটি বই পাবলিশ করেন ‘দ্যা কেস ফর দ্যা ইউ এফ ও’ এবং সেই বইয়ের ভিত্তিতে লেখক দুটি চিঠি পান কার্লোস মিগুয়েল  এলেন্ড বলে এক ব্যক্তির থেকে, যিনি নিজেকে গোপন ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টের মূর্ত দর্শক হিসেবে দাবী করেন। এলেন্ড জানান, ইউ.এস.এস এলড্রীজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ধ্বংসাত্মক এই যুদ্ধ জাহাজের উপর এই পরীক্ষাটি চলে এবং পরীক্ষাস্থল ছিল ফিলাডেলফিয়া নভল শিপ ইয়ার্ডে, পেনসিলভেনিয়া। গোপন পরীক্ষা বলে স্বভাবতই তখন বেশীরভাগ কর্মী ছুটিতে ছিলেন। এই এক্সপেরিমেন্ট এমনও গুজব শোনা গিয়েছে যে পরীক্ষাটি হয়েছিল নিকোলা টেসলার থিওরির উপর ভিত্তি করে, তার মৃত্যুর ঠিক কিছু মাস পর পরই।

কার্লোস চিঠিতে জেসাপকে জানান যে  পরীক্ষাটি চলাকালীন তিনি এল ড্রিজের ডেকের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল  এবং ঘটনার আগের মুহূর্তে সে স্পষ্ট ভাবে  বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা ভয়ানক জিনিস হতে চলেছে। তিনি এও জানান সেই সময় ডেকে অনেক উচ্চ পদস্থ মিলিটারি অফিসিয়ালরা উপস্থিত ছিলেন যেটা সাধারণত আগে তিনি কখনো প্রত্যক্ষ করেননি। যদিও কার্লোস বুঝতে পারেননি তারা আদতে কি যন্ত্র ব্যবহার করছেন, তবে হঠাৎ দেখতে পান চারদিক ঘন সবুজ কুয়াশায় ভরে উঠেছে এবং মনে হচ্ছে সেটা জাহাজটাকে গিলে খেতে আসছে। এবং আরও অদ্ভুত ভাবে হঠাৎ দু’এক সেকেন্ডের জন্য  একটা তীব্র নীল আলোর ছটা দেখা গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে এল ড্রিজ অদৃশ্য হয়ে গেলো।

পরবর্তী কালে গবেষণার মাধ্যমে উঠে আসে যে, আমেরিকানরা শত্রুর রাডার থেকে নিজেদের বাঁচাতে এক অদৃশ্য যুদ্ধ জাহাজ বানানোর পরিকল্পনার স্বার্থেই  এই পরীক্ষাটি করছিল। এই এক্সপেরিমেন্টের ফলস্বরূপ কার্লোস জানান সমগ্র জাহজটা সব লোকজন নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টেলিপর্টেড হয়ে পৌঁছে যায় ২০০ মাইল দূরে ভার্জিনিয়ার নরফ্লক শিপ ইয়ার্ডে এবং ঠিক আগের মত ভাবেই ঘন সবুজ কুয়াশা ও তীব্র নীল আলোর ছটায় জাহাজটি সব অফিসারদের নিয়েই ফিরে আসে ফিলাডেলফিয়াতে। কার্লোস জানান জাহাজে থাকা অসংখ্য লোকজন এতে মরে যায় অথবা অসুস্থ্ হয়ে পড়ে। যারা মোটামুটি ঠিক ছিলেন বা ঘটনাটাকে মেনে নিতে পেরেছিলেন তারা বাকী জীবনটা মেন্টাল এসাইলামে  বেশীরভাগ কাটিয়ে দেন।

শুনতে আশ্চর্য লাগতে পারে কিন্তু আল বিলেক তার প্রথম সাক্ষাৎকারে জানান যে তিনি ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টের সময় এল ড্রিজে উপস্থিত ছিলেন এবং সেই সময় তিনি আল ছিলেন না, ছিলেন এড ক্যামেরন এবং তার সাথে তার ভাই ডানকান ক্যামেরন ছিল। বিলেক জানান যখন ঘন সবুজ কুয়াশা তাদের ঘিরে ধরে তখন বাকীদের মত তারা দুই ভাই আর নরফ্লকে যায়নি গেছেন ১৯৮৩ সালে, দীর্ঘ ৪০ বছর ভবিষ্যতে। কার্লোসের মতই আল তথা এড জানান চারদিকে নাবিক এবং অন্যান্য নৌ কর্মীদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি – কেউ শ্বাস কষ্টে ভুগছে, কারুর গা হাত পা পুড়ে গেছে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, কেউ ভয়ে চিৎকার করছে। এসব দেখে তারা দু’ভাই একপ্রকার দিকবিদিক জ্ঞানহীন হয়ে সমুদ্রে  ঝাঁপ দিল এবং তারা ১৯৮৩ সালে পৌঁছয় ওয়ার্ম হোলের মাধ্যমে। কিন্তু তখন তারা সবকিছু মিলিটারিদের খুলে বলাতে মিলিটারিরা তাদের নির্দেশ দেয় ১৯৪৩ সালে ফিরে গিয়ে সব যন্ত্র ধ্বংস করে দিতে কারণ তাদের এই পরীক্ষার কারণে অনেক সময়ের গোলমাল হয়ে গেছে। আদেশ অনুযায়ী তারা তাই করলেন কিন্তু সবকিছুর শেষে একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে আবার ওয়ার্ম হোলে পড়ে যান।



আল জানালো মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য হয় তো তারা অজ্ঞান হয়ে গেছিল, যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেদের তারা আবিষ্কার করলো একটি হাসপাতালের পাশাপাশি বেডে, দুজনের শরীরের অনেক ভাগ পুড়ে গেছে এবং সারা শরীর জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা।

বিলেকের মতে, সেই পুড়ে যাওয়া ক্ষতগুলো সৃষ্টি হয়েছিল টাইম হাইপারস্পেসে রেডিয়েশন বার্নএর দরুণ। এই ঘটনা প্রসঙ্গে বিলেক তার মৃত্যুর আগে একটি ইন্টারভিউ তে জানান – “আমরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছে যাই ২১৩৭ সালে, আমাদের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে প্রায় একমাস আমাদের হাসপাতালে থাকতে হয়”। ধীরে ধীরে বিলেক ও তার ভাই ডানকান বুঝতে  থাকলো তারা সম্পূর্ণ এক অন্য সময়ে চলে এসেছে। আল জানান তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা একদমই অন্যরকম, বেশীর ভাগ চিকিৎসা হয় ভাইব্রেশন ও লাইট ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে, আজকের দিনের মত ডাক্তার ও নার্স নেই বললেই চলে, সবই যন্ত্রচালিত।

প্রায় ছয় সপ্তাহ ২১৩৭ সালে থাকার পর বিলেক ও ডানকান ঠিক করেন তারা ফিরে যাবেন, কিন্তু বিধি বাম, সেখান থেকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিলেক নিজেকে আবিষ্কার করেন ২৭৪৯ সালে। তিনি সেই সময় নিয়ে অদ্ভুত কিছু কথাও সংবাদ মাধ্যমকে জানান যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভাবা রূপকথার চেয়ে কম কিছু নয়।

তিনি দেখলেন, তখন পৃথিবীতে শহরগুলো সব ভাসমান, সেগুলো পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়াতে পারে, আজকের মত ভিসা বা সীমানা নেই কোনো। বিপরীত অভিকর্ষ নিয়ে গবেষণার ফসল - শহরগুলো মাটি থেকে প্রায় আড়াই মাইল উঁচুতে। কিন্তু তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা মাত্র ৩০০ মিলিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন ৫০ মিলিয়ন মানুষ, দু’বছর থাকেন তিনি সেখানে।


তবে মজার বিষয় এই যে বিলেক জানান তখন পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধ ছিল না, তবে রাশিয়ান ও চাইনিজ এবং আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে তখন মনোমালিন্য। যেহেতু মিলিটারি, নেভি বা এয়ারফোর্স বলতে পৃথিবীতে কিছুই তখন নেই, তাই যুদ্ধও অসম্ভব। তখন আসলে কোনো সরকারও নেই, সমগ্র দুনিয়া চলছে একটি সিন্থেটিক সিস্টেম দ্বারা এবং এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সারা পৃথিবী চালাচ্ছে নিখুঁতভাবে। আল জানান একে সৃষ্টি করা হয়েছে ২৬ শতকের গোড়ার দিকে। আল এও জানান তখন মানুষের কোনো কষ্ট নেই, মানে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা যা দেখি খাদ্য বাসস্থান সবই মানুষ পাচ্ছে নিজের  প্রয়োজন মত। তবে তখন সমুদ্র স্তরের উচ্চতা অনেক বেড়ে গেছে, বহু দেশ জলের তলায় চলে গেছে – যেমন তিনি জানান, ফ্লোরিডার ২/৩ অংশ তখন জলের তলায়। আসলে ২৭৪৯ সালে বিলেক দু’বছর কাটান এক ট্যুর-গাইড হিসেবে, তাই তার পক্ষে তখন এত বেশী জানা সম্ভব হয়েছিল।

অবশেষে বিলেক ফিরতে সক্ষম হন বিংশ শতকে, ১৯৮৩ সালে। বিলেকের কাহিনী শুনে মিলিটারিরা বুঝতে পারেন তাকে চুপ করাতে হবে। এবং এরপরই  ঘটে বিলেক তথা এড ক্যামেরনের জীবনে সবথেকে আশ্চর্য তথা অবিশ্বাস্য ঘটনা। মিলিটারিরা এডকে বয়স কমানোর প্রযুক্তি দিয়ে ছোট্ট শিশুর রূপদান করে এবং এরপর মন্টেক প্রজেক্ট পরিভ্রমণ কালে তাকে রেখে আসে বিলেক পরিবারের কাছে, ক্যামেরন পরিবার নয়। বিলেক পরিবার এক মৃত সন্তানের পরিবর্তে তাকে গ্রহণ করে, সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন আল বিলেক নামে, এড ক্যামেরন নয়। যদিও মনটেক প্রজেক্ট তার সমস্ত স্মৃতি কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা ছিল প্রখর। শিশু আলের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমরা প্রথমেই আলোচনা করেছি। আসলে মিলিটারিরা তার জৈবিক বয়স কমালেও তার মানসিক বিকাশ পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি এবং আমরা এর সম্মক উদাহরণ পাই বিলেকের প্রথম স্মৃতি ক্রিসমাসের দিনেই।

বিলেক আরও জানান সময় পরিভ্রমণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য। সময় পরিভ্রমণের প্রযুক্তি মানব জাতিকে উপহার দিয়েছে অরায়ন গ্যালাক্সি থেকে আগত এলিয়ন, যারা রেপটালিয়ান। পৃথিবীকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে থাকে সিরিয়স বা লুব্ধক নক্ষত্র থেকে আগতরা। মাইন্ড কন্ট্রোল প্রযুক্তিও মানবজাতির তাদের কাছ থেকেই শেখা।

এই রকম আরো অনেক অজানা তথ্য নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘দ্যা ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট’ গ্রন্থ এবং এছাড়াও অসংখ্য রেডিও প্রোগ্রামে তিনি  জানান তার অভিজ্ঞতার কথা। আলফ্রেড বিলেককে অনেকে নানাভাবে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার চেষ্টাও করেছেন, আবার তার অসংখ্য ভক্তকুল তার কথা বিশ্বাসও করেছেন। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, তিনি তার সমগ্র জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন সময় সংক্রান্ত গবেষণায়। আইনস্টাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড  থিওরি থেকে শুরু করে টেসলার থিওরি সব কিছুকেই বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন আল। ২০১১ সালে ১০ই অক্টোবর মেক্সিকোতে মারা যান বিংশ শতকের এই সময়মানব।



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন