কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৭১


আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের মিল-অমিল ও সম্পর্কের কথা ভাবতে বসে মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কি আদৌ এই প্রজন্মের চিন্তাভাবনা ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিজেদের কিছুটা হলেও সামঞ্জস্য রাখতে পারছি? অথবা আমাদের সঙ্গে তারা এবং তাদের সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হতে পেরেছি? প্রসঙ্গত আমাদের প্রজন্ম বলতে আমি একান্তই আমাদের জন্মের  সময় ধরে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে জন্মের কথা বলছি, অর্থাৎ আমরা যারা ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সত্তর দশকের প্রথম ও দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের যৌবনের দিনগুলি অতিবাহিত করেছি। বলা বাহুল্য, গত শতাব্দীর এই দুটি দশক বিভিন্ন কারণে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তা সে রাজনৈতিক কারণেই হোক  বা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে আমরা সেই সময় অনেক কিছু থেকেই হয়তো বঞ্চিত ছিলাম, বিশেষত তথ্য ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তো অবশ্যইকিন্তু সেই সময় আমরা  যেসব মতাদর্শগত চিন্তাভাবনার সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড় ভাবে সংশ্লিষ্ট হবার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছিলাম, তা থেকে বর্তমান প্রজন্ম নিতান্তই বঞ্চিত হয়ে আছে। এসব কথা মনে হচ্ছে, পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে। ৪৭ পরবর্তী ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা মুখোমুখি হয়েছি বিভিন্ন মূল্যবোধ ও মতাদর্শের, যার মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার পাশাপাশি ছিল নিজস্ব চিন্তা ভাবনা ও আদর্শের প্রতি ব্যক্তিগত সম্ভ্রমবোধ ও আস্থা। কোনো বিশ্বাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার সদিচ্ছা। সততার প্রতি আবেগ ও আগ্রহ। বিশেষত সত্তর দশকের রাজনৈতিক আন্দোলন সেই সময়কে যথার্থই আন্দোলিত ও উদ্বেলিত করেছিল। দিন বদলের স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়েছিল বিশাল ছাত্র ও যুবসমাজ এবং নির্যাতিত মানুষের একটা বৃহৎ অংশ। একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছিলেন অনেকেই। সেই সময়ে ছাত্র ও যুবসমাজ তাদের একাডেমিক শিক্ষাপর্ব শেষ করে ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গড়ার জন্য লালায়িত ছিলেন না বরং তাঁরা ছিলেন দেশের প্রতি ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, দেশের কাজ ও সমাজের কাজের জন্য নিষ্ঠাবান। আমরা অন্তত সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম এবং সেই যুগের জন্য গর্ববোধ করি। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই মূল্যবোধ, আদর্শ, দায়বদ্ধতা সেভাবে খুঁজে পাই না। সমষ্টিভাবনাকে ছাপিয়ে উঠেছে ব্যক্তিভাবনা। ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত রাখার জন্য সর্বদাই ব্যস্ত ও যত্নশীল। স্বাভাবিক কারণেই তাই দেশ ও সমাজের প্রতি আগ্রহ এবং সময় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আর এই সুযোগেরই দুর্ব্যবহার করে একশ্রেণীর ভন্ড ও লম্পট সমাজবিরোধী ও রাজনৈতিক নেতারা সারা দেশ ও সমাজকে লুটেপুটে খেতে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করে। গোষ্ঠিদ্বন্দ্ব, জাতিবিদ্বেষ, প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, চুরি, জোচ্চুরি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, গণপ্রহার, গণহত্যা নিত্য নৈমিত্তিক কর্মসূচি হয়ে দাঁড়ায়। আর আফসোস হয় এখানেই, আমাদের প্রজন্ম যেখানে দিন বদলের আকাঙ্ক্ষায় একটা উজ্জ্বল দিনের স্বপ্নে মশগুল ছিল, আজকের প্রজন্ম সেখানে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে অবক্ষয়িত নষ্ট সময়ে। তবু আমরা আশাবাদী, একদিন এই দুঃসময় যাবে কেটে। শিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর গানের কথায় উচ্চারণ করা যায় – “একদিন ঝড় থেমে যাবে / পৃথিবী আবার শান্ত হবে”।  

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India

<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




আমায় কেন নিজের ধর্ম আলাদা রে নিজের জন্যে তৈরি রে নিতে হবে?





(১)


‘আমরা যদি সৎ হই আর  বিজ্ঞানীদের তা হতেই হবেতবে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ধর্ম মিথ্যা কিছু উক্তির এক জগাখিচুড়ি। ঈশ্বরের ধারণাটাই মানবিক কল্পনার সৃষ্টি। এটা সুবোধ্যই যে আদিম মানুষরা, যাঁরা প্রকৃতির অদম্য শক্তিগুলির কাছে আজকে আমাদের থেকে অনেক বেশি উন্মুক্ত ছিলেন, তাঁরা ভয়তরাসে এঁদের ব্যক্তিসত্তামণ্ডিত মূর্তরূপ দেবেন। কিন্ত আমরা  যখন আজকাল এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলির এতগুলোকে বুঝি, তখন আমাদের আর এই সব সমাধানের প্রয়োজন নেই। আমি, আমার জীবনের শপথ, বুঝতে পারি না কীভাবে কোনো সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা আমাকে কোনোভাবে  সাহায্য করতে পারে। আমি যেটা দেখতে পাই সেটা হলো, এই অনুমানটি  অনেক অনুৎপাদনশীল প্রশ্নের জন্ম দেয়, যেমন ঈশ্বর কেন অনুমতি দেন এত দুঃখ ও অবিচারের, ধনীর দ্বারা গরিবের শোষণের, আরো কত ভয়ঙ্কর বস্তুর। তিনি তো নিবারণ করতে পারতেন এদের! ধর্ম যে এখনও শেখানো হচ্ছে তার  কারণ কিছুতেই এটা নয় যে এর ধারণাগুলি আমাদের কাছে প্রত্যয়জনক, বরং কেবল এজন্য যে আমাদের কেউ কেউ নিম্নতর শ্রেণিগুলিকে শান্ত রাখতে চাই। চেঁচামেচি করা অসন্তুষ্ট মানুষদের চেয়ে শান্ত মানুষদের শাসন করা সোজা। তাদের শোষণ করাও। ধর্ম এক ধরনের আফিম যা একটি জাতিকে অনুমতি দেয়  ইচ্ছাবিলাসী সুখস্বপ্নে ঘুমিয়ে পড়তে, আর এভাবে মানুষের বিরুদ্ধে সঙ্ঘটিত অবিচারগুলোকে ভুলে থাকতে। এই কারণেই রাষ্ট্র আর চার্চ এই দুই রাজনৈতিক শক্তির এত ঘনিষ্ট মৈত্রী। উভয়েরই প্রয়োজন এই বিভ্রমের যে এক দয়ালু ঈশ্বর    এই পৃথিবীতে না হ’লেও তাদের পুরস্কার দেন যারা অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে শান্তভাবে আর অনুযোগ না ক’রে তাদের কর্তব্য ক’রে যায়। এই কারণেই ঈশ্বর কেবল মানবিক কল্পনার সৃষ্টি এই সৎ উক্তিকে মানুষের সমস্ত পাপের মধ্যে সবচেয়ে হীন ধরা হয়’ (কোয়াণ্টাম তত্ত্বের আরেক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী Werner Heisenberg কর্তৃক Physics and Beyond: Encounters and Conversations(Allen and Unwin, 1971), পৃঃ ৮৫-৮৬তে উদ্ধৃত)

কথাগুলো নতুন নয়, কার্ল মার্ক্সের নয়, বলা হয়েছিল কোনো উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিদ্যার ক্লাসঘরে নয়, যুক্তিবাদের বা বামপন্থার সভায় নয়, পদার্থবিদ্যার Fifth Solvay International Conference (October 1927)-এ। বলেছিলেন মহাবিজ্ঞানী পদার্থবিদ Paul Dirac (1902-1984), যিনি ১৯৩৩ সালে Erwin Schrödinger-এর সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল প্রাইজ পান পারমাণবিক তত্ত্বের ‘new productive forms’ আবিষ্কার করার জন্য, কোয়াণ্টামতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা, আর যাঁর বিখ্যাত ‘Dirac equation’-টি fermion নামে একগুচ্ছ প্রাথমিক কণার আচরণ ব্যাখ্যা করা ছাড়াও প্রথম ‘antimatter’-এর অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করে। তাও কথাগুলো নিতাম না, যদি না ওই সভাতেই আরেক বিজ্ঞানী Wolfgang Pauli ঠাট্টা ক’রে বলতেন “Well, our friend Dirac, too, has a religion, and its guiding principle is God does not exist and Dirac is His prophet” আমি ডিরাক নই। তাঁর সুগতি ‘স্বপ্নেও কপালে নেই’। তবু কি নবী হতে পারি না, বলতেই হবে, ‘বর্তমানের কবি আমি নই, / ভবিষ্যতের নই নবী’?  সকলের জন্যে না হোক, নিজের জন্যে?

তাতেও আমার ধর্মের চিঁড়ে ভিজতো না, কারণ প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এর চেয়েও অনেক আর্তনাদে করেছেন অনেক বিখ্যাত মানুষ। ইয়োহান বয়ার, ১৯১৯ সালে, তাঁর এক মহৎ উপন্যাসে লিখে গিয়েছিলেন, যে আমাদের এই আধুনিক যুগের সব চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি এই যে, আমরা নিজেদের ঈশ্বরের অবধারণাকে ছাড়িয়ে উঠেছি (‘The tragedy of this age is that we have outgrown our own conception of the divine’) ইস্পাত আর আগুনের ক্রীতদাস, কিন্তু প্রমিথিউসের চেতনা থেকে চ্যুত এই মানুষ, নিরাশ্রয়, ঈশ্বরহীন এই মানুষ কি এখন নিজের ভিতরের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে? খুঁজে ফিরছে কোনো হারানো কিছু, কোনো স্তোত্র, ঈশ্বরের সঙ্গে সুস্বন, ঐকতান? কিন্তু ঈশ্বর? তিনি কই? আছে তো এক রক্ততৃষু জিহোবা, কিম্বা ক্রুশে কোনো যোগী। এঁরা কি আধুনিক মানুষের ঈশ্বর? ধর্ম নেই, আছে ধর্মের ইতিহাস (“God? They find a bloodthirsty Jehovah, and an ascetic on the cross. What gods are these for modern men? Religious history, not religion”, JohanBojer, The Great Hunger (1919), translated by W.J. Alexander Worster and C Archer (Calcutta: Rupa Paperback, 1962), pp. 157-58) নতুন ধর্মের তাই দরকার আছে।

কিন্তু মাথায় প্রশ্ন এলো, ডিরাক না করলেও, তাঁর বা বয়ারের অনেক আগে কিছু মানুষ নিজের জন্যে ধর্ম তৈরি করে গিয়েছিলেন কিনা। কারোর মাথায় আসতে পারে গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ / জ্যামিতিবিদ পিথাগোরাস (জন্মকাল অজানা, তবে খ্রীঃপূঃ ৫৩২ সালের কাছাকাছি স্যামোস দ্বীপে বিখ্যাত হচ্ছিলেন), যাঁর একটি থিওরেম বা উপপাদ্য আমাদের এখনও পড়তে হয়, একটি ধর্মও তৈরি ক’রে গিয়েছিলেন, যার মূল ভিত্তি দুটি আত্মার দেহান্তর গমন আর বিনস বা সীম খাওয়ার কুফল। আর একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাকি কিছু নিয়মও অবশ্য ছিল, যেমন ১) (মাটিতে)পড়ে যাওয়া জিনিস না তোলা; ২) সাদা মোরগ না ছোঁয়া; ৩) রুটি না ভাঙা; ৪) আড়াআড়ি রাখা কাঠের দণ্ড না  ডিঙনো; ৫)লোহা দিয়ে আগুন না উসকনো; ৬) পুরো পাঁউরুটি না খাওয়া; ৭) ফুলমালা হাতে না তোলা; ৮) পাঁইটের মাপের উপর না বসা; ৯) কলিজাটা না খাওয়া; ১০) রাজপথগুলিতে না হাঁটা; ১১) কারুর ছাদে সোয়ালো পাখিকে বসতে না দেওয়া; ১২) আগুন থেকে পাত্র তুলে নেওয়ার পর পাশে তার ছাপ পড়তে না দেওয়া, বরং তাদের একসঙ্গে নাড়া; ১৩) পাশে আলো রেখে আয়নার দিকে না তাকানো; ১৪) বিছানার পোশাক-আশাক ছেড়ে ওঠার পর, 
সেগুলোকে গুটিয়ে রাখা, যাতে তাতে শরীরের ছাপ না থেকে যায়। পিথাগোরাস নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতেই পারতেন, কারণ মতান্তরে তিনি ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। আর ‘Pythagoreansim … was a movement of reform in orphism, and orphism was a movement of reform in the worship of Dionysus’ কিন্তু  রাসেল এই ধর্মের নিয়মগুলোতে দেখছেন ‘primitive tabu conceptions’-এর প্রতিফলন তাই বুঝি খুব লুকোনো মজা করে বলছেন যে, তাঁর সম্প্রদায়ের  অনুগামীরা এখানে সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেও আর সন্তদের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও শীঘ্র বা ধীরে অপুনরুজ্জীবিতরা সিম খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে বিদ্রোহ ক’রে আর পিথাগোরিয়বাদের পতন হয় কেন গণিতবিদ / জ্যামিতিবিদ পিথাগোরাস নতুন ধর্মের পত্তন করেন সে প্রশ্ন অবান্তর নয়। ধর্মের সঙ্গে গণিতের যোগ সে যুগে ভালোই গভীর ছিল। রাসেল বলছেন, ‘Personal religion is derived from ecstasy, theology from mathematics; and both are to be found in Pythagoras’(Bertrand Russell,History of Western Philosophy  (First published George, Allen and Unwin, 1946, London and New York: Routledge, 1996), pp. 38-45) তবে পিথাগোরাসকে আমি হিসেবে রাখবো না, কারণ তিনি ধর্মের সংগঠনবিন্যাস বা religiousorder তৈরি করেছিলেন

নতুন ধর্ম তৈরি করেছিলেন সংশ্লেষবাদী বাদশাহ আকবর। তিনি যে খ্রীষ্টবাদ, জৈনবাদ সহ বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন একথা সবার জানা। ১৫৭৯-র সেপ্টেম্বরে দুই রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে পাঠানো তাঁর আমন্ত্রণ যায় গোয়ার জেসুইট মিশনের কাছে, খ্রীষ্টধর্মের প্রধান পুস্তক ও সুসমাচারগুলিসহ তাদের ব্যাখ্যাতা পাঠাতে। এক তিনজনের প্রতিনিধিদল গোয়া থেকে ফতেপুর সিক্রি আসেনও, ১৫৭৯-র ১৭ই নভেম্বর রওনা দিয়ে, ১৫৮০-র ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারিতেতাঁদের  গোপন সাধ ছিল তাঁকে দীক্ষিত করার। কিন্তু তাঁদের অনেক সমাদরে রাখলেও, জনসাধারণের কাছে প্রচার ও দীক্ষার অনুমতি দিলেও, রাজপুত্র মুরাদকে তাঁদের কাছে খ্রীষ্টবাদের একটু পাঠ নিতে, আর আবুল ফজলকে সুসমাচারের অনুবাদ করতে বললেও, আকবর কিন্তু খ্রীষ্টবাদে দীক্ষা নেন নি। যদিও ১৫৯০ সালে তিনি আরেকবার গোয়ার জেসুইট মিশনের কাছে আমন্ত্রণ পাঠান, আর তাঁরা আসেনও। পরন্তু বদায়ুনী তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন, খ্রীষ্টানদের ক্রশ  আর অন্যান্য খেলনা গ্রহণ করার জন্য, আর ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছিলেন, তিনি 

গোপনে দীক্ষা নিয়ে থাকতেও পারেন (S.R. Sharma, Mughal Empire in India: A Systematic Study Including Source Material, Volume 1 (New Delhi : Atlantic Publishers, 1999), pp. 246-52, 292-93)হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চিত নেন নি, কারণ সেই সময়েই, ১৫৭৯ সালে, ফতেপুর সিক্রির  ইবাদতখনায় আকবর নিজেকে দেশের চূড়ান্ত ধর্মীয় কর্তৃত্ব হিসেবে ঘোষণা ক’রে সুন্নী উলেমাদের ক্রোধ কুড়োন, আর ১৫৮২ সালে দীন-ই-ইলাহী নামের নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক শ্রীরাম শর্মা  অবশ্য ১৯৩৭ সালের দুটি প্রবন্ধে যুক্তি-তক্কো-সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিলেন, দীন-ই-ইলাহী কোনো ধর্ম নয়, একটি political order, যার সদস্যদের শপথ নিতে হতো সম্রাটকে ধর্মান্ধদের সকল রকমের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার (Arnulf Camps, Studies in Asian Mission History, 1956-1998 (Leiden; Boston : Brill, 2000), p. 56)

আকবরকে নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বলা যাবে না এর রাজকীয়তার জন্যে। সেটা করলে তো বৌদ্ধধর্মের সার বা অসার ছাঁকা সম্রাট অশোককেও তাঁর ‘ধম্ম’-র জন্যে হিসেবে রাখতে হবে। ডিরাক দেখিয়েছিলেন ধর্মের বন্ধু রাষ্ট্র আর চার্চ, এঁরা তো ‘Erastianaism’-এর মাধ্যমে চার্চকেই রাষ্ট্রর অধীনে এনে অন্তর্গত ক’রে দিয়েছেন।


[চলবে]



শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি - 



"-ঘর তখন ছোট্ট ছিলো, অনেকটা  ঠিক তোমার মতন
মলিন ছেঁড়া জামার মতন, দু-একটি পা নামার মতন
ছোট্ট ছিলো, এখন অনেক বদলে গেছে
কাঁঠালকাঠের চৌকি বদলে হয়েছে খাট
কুঁড়েঘরের দরজা সরে জোড়া কপাট
এখন অনেক বড়ো হয়েছে, -ঘর এখন বড়ো হয়েছে
এখন অনেক বুড়ো হয়েছে, অনেকটা ঠিক তোমার মতন..."

সদর বাজার থেকে যে রাস্তাটা বড়ি বাজারের দিকে গিয়েছে, তার বাঁদিকে স্টেডিয়ম রেখে ডানদিকে ঘুরলেই মাটির রাস্তা চলে গেছে সেনটোলা, সাহেববাঁধ  সেইপথের শুরুতেই একটা প্রায় খন্ডহরমার্কা বিশাল বাড়িতে থাকতো আমার বন্ধু কৌশিক দু'টো ঘর ভাড়া নিয়ে  কৌশিক ছিলো একটি টিপিক্যাল ক্যালকেশিয়ানউচ্চিংড়ে  পৃথিবীতে কিছুই তার অজানা নেই  মহানগরের লোকেরা জন্ম ইস্তক একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলে ; তারা কিছুতেই বিস্মিত হবেনা। ' আর নতুন কী?' সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া।  নেহাত ব্যাংকের চাকরি করতে এই অজ গ্রামে তাকে থাকতে হচ্ছে, নয়তো কা'কে সে চেনেনা ? অথবা কে তা'কে চেনেনা? কলকাতায় তার ঠিকানা ছিলো বাঙ্গুর  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নাকি ওদের প্রতিবেশী ছিলেন  ওর গপ্পোগুলো- ছিলো সেরকম। যেমন, বাঙ্গুরে বানভাসি হওয়ায়নীরেনদার কবিতা ' হ্যালো কলকাতা' প্রথম শ্রোতা নাকি সে নিজে  আমাদের কাছে গাঁট্টা-ফাঁট্টা খেয়ে বললো তার প্রভাব সে একদিন প্রমাণ করেই ছাড়বে।কিছুদিন পরে সে একটা বেশ পুরোনো মতন দেখতে বই নিয়ে আমার বাড়িতে এসে হাজির।  আমার সামনে সগৌরবে রেখে সে বলে, দ্যাখ এটা  আমি দেখি  বইটিনীরেনদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "নীরক্ত করবী' প্রথম সংস্করণ। আমার জন্মের ঢের আগে প্রকাশিত হয়েছিলো  খুঁজতে গিয়ে শুনেছিলুম, ছাপা নেই  তা সেই বই ওরকাছে? এখানেই শেষ নয়, সে প্রথম পাতা খুলে দেখায়, " কৌশিকের জন্য", নীরেনদার নিজের হাতে লেখা। ওঁর অপূর্ব হাতের লেখা আমি চিনি, একেবারে জেনুইন।মৌনতা ছাড়া আমার কোনও উত্তর নেই  তখন সে বলে, আমাদের কাছে সম্মান রাখতে নীরেনদার বাড়ি থেকে বইটা হাইজ্যাক করে নিয়ে এসেছে, ওঁর নিজেরসংগ্রহ থেকে। খুব উদারভাবে আমাকে বলে, তুই যতোদিন ইচ্ছে বইটা নিজের কাছে রাখতে পারিস, শুধু মেরে দিসনা।



সে হেন কৌশিক একদিন ভোর আটটায় আমার বাড়িতে এসে হাজির  বলে, আরে দ্যাখ সকাল সকাল পুরো কিচাইন। বলি, হলোটা কী?
-আরে বুড়ো এসে হাজির সক্কালবেলায়, সঙ্গে একটা চ্যালাও রয়েছে। টিট্লাগড়ে এসে ভোরবেলা চক্রধরপুরে নেমে খুঁজতে খুঁজতে চাইবাসায় সোজা আমার বাড়ি।রাতভর মাল না খেয়ে শরীর আনচান করছিলো দুজনের  তেষ্টা মিটিয়ে এখন ঘুমোতে গেছে।
বুঝতে পারি, 'বুড়ো'টি কে 
-তো, কী করবি, ছুটি নিবি আজ ?
-মাইরি আর কী, আজ আমাকে ক্যাশ রেমিট্যান্স নিয়ে যেতে হবে বাইরে...
-তবে..?
- জন্যই তো তোর কাছে এলাম, এসব কবি-টবিদের কেস। আজকের দিনটা সামলে দে বাবা...
-দ্যাখ, দু'জনকে সামলানো মুশকিল ; চ্যালাটা কে?
- আরে ওটা বেকার, ফুলটুশ টাইপ। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নাকি কী সব আত্মীয়তা আছে। বেশি ঝামেলা করলে দাবড়ে দিবি...



চিন্তায় পড়ে যাই। আমার স্বপ্নের কবি, কিন্তু সামলে রাখা একটা চ্যালেঞ্জ  তাঁর 'অভিনীত অপ্রকৃতিস্থতা' মর্ম বোঝা 'মুশকিল নহি, নামুমকিন হ্যাঁয়' চাইবাসারমতো একটা মধ্যযুগীয় গ্রামে চারদিকে জনতা হাবিলদার, জগতের চরিত্রপ্রহরী  ব্যাংকের ছেলেগুলো এমনিতেই সবসময় হাই স্ক্রুটিনিতে থাকে  তার উপরআমার প্রতি তারা আবার একটু বেশিই দয়াশীল  যাকগে দেখা যাবে...

বলি, ঠিক আছে, সাড়ে 'টার মধ্যে আমি চলে আসবো। একটা মহার্ঘ সি এল গেলো।
---------------------------------------
".... তুমি ছেঁড়া জামা দিয়েছো ফেলে
ভাঙা লন্ঠন, পুরোনো কাগজ, চিঠিপত্র, গাছের পাতা-
সবই কুড়িয়ে নেবার জন্য আছে কেউ
তোমাদের সেই হারানো দিনগুলি কুড়িয়ে পাবেনা তোমরা আর "
সুকান্ত আমার অনেকদিনের বন্ধু  সেই হাফপ্যান্টের আগে থেকেই  ডাকনাম সুকু  আমাদের মতো জামশেদপুরেই ওদেরও সব কিছু  ওর কাকা থাকতেনকদমায়। সুকুর সঙ্গে ছোটোবেলা থেকেই যাতায়াত ওঁদের বাড়ি  রিমা, মানে মধুরিমা সুকুর খুড়তুতো বোন  বছর তিনেকের ছোটো হবে আমাদের থেকে   ওকেযে দেখতে কেমন বা  যে একটা মেয়েএমন কোনও অনুভূতিই আলাদাভাবে গড়ে ওঠেনি কখনও। ছেলেরা বড়ো হই মাথায়মেয়েরা বড়ো হয় মনে। যখনকলেজে পড়ি , তখন মনে হতো রিমা বোধ হয় একটু অন্যভাবে কথা বলে আজকাল  খুব তাড়াতাড়বড়ো হয়ে যাচ্ছিলো সে পুজোর সময় তাকে যে অনেকেঘুরে দেখছেসেটা বোঝা যেতো  নিয়মিত দেখাশোনাতবু ব্যক্তিগতভাবে সে আমার ঘনিষ্ট বন্ধুর বোনআমার কাছে সেটাই ছিলো তার পরিচয়। কলেজ ছেড়েইপ্রায় সঙ্গে সঙ্গে চাকরিতে ঢুকে পড়া  জামশেদপুর ছেড়ে বাইরে চলে যাওয়া  নিত্য যোগাযোগ এভাবেই কম হয়ে যেতে থাকে  এর মধ্যে পর্ণা আসে মঞ্চে  আমিজামশেদপুরে ফিরে আসার পরেও বেশ কিছুদিন  রিমার সঙ্গে দেখা হয়নি। হঠাৎ একদিন বিষ্টুপুর বাজারে মেঘানির দোকানের সামনে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।চিনতে পারিকিন্তু তাকে এখন দেখতে হয়েছে যেন সোয়ানলেকের হংসপরী। আমি দেখছিলুম তাকে। আমার সেই বিস্মিত চাওয়া দেখে মৃদুস্বরে বলেছিলো,শিবাজিদাচিনতে পারছোনা নাকি?
-পারছি তোকিন্তু তুই তো দেখছি একেবারে হিরোয়িন হয়ে গেছিস....!!
-বাজে কথা রাখো  তুমি ফিরে এসেছো খবর পেয়েছিকিন্তু একবারও বাড়িতে আসোনি  মা জিগ্যেস করছিলো...
হ্যাঁরেএতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ... সত্যি...
-কাকে নিয়ে ব্যস্ত হলেপর্ণা....?
-আরে তুই এসব পাকা পাকা কথা শিখলি কবে ?
-অনেকদিন...
-তুই চিনিস ? পর্ণাকে...
-চিনি তোসাকচিতে থাকে  রবীন্দ্রভবনে গান শেখে...
-হমমঅনেক কিছুই জানিস দেখছি...দাঁড়া আসবে একটু পরে ... পরিচয় করিয়ে দেবো...
-থ্যাংক ইউপরিচয় করাতে হবেনাআমিই করে নেবো... আজ আসি। বাড়িতে এসো , কথা হবে...
-আয়....

 যেন এক অন্য রিমা  এতোদিন ধরে যাকে চিনিসে নয়...



সেদিন পর্ণা আর আসেনি। কামানি সেন্টারের সামনে থেকে দেখতে পেয়েছিলো রাস্তার ওপারে আমি আর মধুরিমা গপ্পো করছি  দেখা করার প্রয়োজন বোধকরেনি আরফিরে গিয়েছিলো উত্তপ্ত উষ্মায়।
(ক্রমশ)

(সৌজন্য-গুরুচণ্ডালি)