কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

তুষ্টি ভট্টাচার্য




পদাবলি -





(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।
পদাপদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।
মাদাম তুভোঁআদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)

এদিকে শীত যে কোন ফাঁকে এল, আর চলেও গেল, কেউ কিচ্ছুটি টের পেল না। হঠাৎ করে হাইওয়ের ধারে লাগানো গাছগুলো রঙিন হতে শুরু করায়, আর দু চারটে কোকিলের থেকে থেকে ডুকরে ওঠায় লোকে টের পেল বসন্ত এসে গেছে! গায়ের চামড়ার টান একটু ঢিলে হতে শুরু করেছে অলরেডি। ঘামের বিন্দু গজিয়ে উঠছে নাকের ওপর। সেদিন যাচ্ছিলাম কোথায় যেনবর্ধমান লোকালে যেতে যেতে দেখলাম ছোট্ট ছোট্ট স্টেশন গুলোর পলাশ গাছগুলো দারুণ সেজে দাঁড়িয়ে আছে। এত লাল, এত লাল, যে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। চোখ ফেরালেও সেই লালের আভা চোখে আটকে থাকছে। বসন্তের রূপ এদিকে না এলে এভাবে বোঝাই যেত না। বেশ ভাব এসে গেছিল। নিজের মনেই বলে উঠলামভাই পলাশ, তোর ইস্টিশানে আর নামব না ঠিক করলাম তোর ইস্টিশানের ছবিতে এত লাইক, এত কমেন্ট, দেখলেই গা হিম হয়ে যাচ্ছে সেলিব্রিটিদের কাছে যেতে আমি ভয় পাই খুব তোর ইস্টিশানে বাহার থাকুক আমি বরং... কথা শেষ হওয়ার আগেই কে যেন বলে উঠল, 'হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই বরং ঘেঁটুফুলের ইস্টিশানে যা গিয়ে-' একথা পদা ছাড়া আর কেই বা বলতে পারে বলুন!
তা পদা যখন এসে গেছেই, তখন ওকেই জিজ্ঞেস করলাম,
-বইমেলার কেনা বইগুলো কবে পড়ব রে পদা?
-
যেদিন থেকে তুই চশমা পরাবি না, সেদিন থেকে
ভাবুন একবার! আমার পেশা তুলে কথা! যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! ওর আস্পদ্দা দিনেদিনে বেড়েই চলেছে। একেবারেই সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে ও। ওই জন্য ওকে ত্যাগ করতে মন চায়, অথচ হতচ্ছাড়া আমার পিছু ছাড়ে না। একেবারে মোক্ষম সময়ে এসে গা জ্বলানো ডায়লগ দিয়ে কেটে পড়ে।


দেখতে দেখতে গরম পড়ে গেল। কালবৈশাখীর বদলে মাঝেমাঝেই নিম্নচাপের বৃষ্টি এসে হাজির হচ্ছে। প্রথম গরমের প্রখরতা একটু বেশিই মনে হয় সকলের। ফলে যেই একটু বৃষ্টি পড়েছে ছুটিছাটা বা উইকএন্ডে লোকে দীঘা দৌড়চ্ছে। গ্রীষ্মের তাপে গায়ের পুড়ে যাওয়া আটকাতে সানস্ক্রিন আর রোদে পুড়ে ট্যানড্‌ চামড়াকে ফর্সা করতে ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনের জোয়ার এসেছে চারদিকে। এইরকম অবস্থায় পদাকে একদিন আপন মনে বকতে শুনলাম—একদিকে বাদামী মনুষ্যকূলে ফর্সা হওয়ার জন্য, ফর্সা দেখাবার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টার শেষ নেই আবার অন্যদিকে চুল সাদা হলে কালো করা চাইই চাই ওদিকে আবার দীঘায় গিয়ে কালো ঘোড়ায় চড়ার বীরত্বও তারা ছাড়তে পারল না ঘোড়াদেরও কলপ মেখে কালো হতে হচ্ছে মাসান্তে গুজরাটের গিররাজ দেখি এসবে আমল না দিয়ে দিব্যি পলাশ গাছে চড়ে লাল আগুনে পোজ দিচ্ছেন দেবেন নাই বা কেন বল? সে ছবি মহারাজ টুইট করেছেন মিত্রোঁগণের উদ্দেশ্যে ক্ষী জ্বালা গো মোক্ষদা মাসী! ফর্সা হবে না কালো? সাদা চুলে বাদামী চামড়ায় দিব্যি তো দেখাচ্ছে তা আবার কালো চুলে ফ্যাটফ্যাটে চামড়ার কম্বো আমি কোথা থেকে দিই বল দেখি তোমাকে! হ্যাঁ মোক্ষদা মাসিকে আপনাদের মনে আছে তো? সেই যে সেবার পদার বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। তিনি আবার এসেছেন ফিরিয়া। তবে এবারে কিঞ্চিৎ মৃয়মান। কারণ পদা বিয়ে করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাই মোক্ষদামাসির এখন ফেয়ারনেস ক্রিম মাখতে শখ হয়েছে। আর তাইই পদার এই লম্বা বিবৃতি। এরপর অবশ্য মোক্ষদামাসি আর ফর্সা হতে চাননি। পরের দিনই সোজা ভোর পাঁচটার বনগাঁ লোকাল ধরে নিজের গ্রামে রওনা হয়েছেন।
এভাবে বৈশাখ কেটে গেল। জষ্টিও চলে এল ধাঁ করে। জামাই বাবাজীবনদের আর দেখে কে এবার। এই গরমে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবে। বাবাজীবনরা! একটু বুঝেসুঝে চালিও গরম কমলেও ভ্যাপসানিতে হজম হতে সমস্যা হবে আমার কথা যেন শুনে উদ্ধার করবে ওরা! নিজেকেই গাল পারছি, এমন সময় দেখি, টিপটাপ পড়ছে আকাশ থেকে। জামাইদের ঠাণ্ডা করার জন্য বুঝি ওপরওলার দান এল!  কিন্তু তারপর? তারপর আর কী! এলো বখাটের মতো, চলে গেল লক্ষ্মীছেলের মতো। কে আবার? বৃষ্টির কথাই হচ্ছে। অবশ্য এতে বৃষ্টির কোন দোষ ছিল না। দু চার ফোঁটা পড়তে না পড়তেই যারা ছাতা খুলতে থাকে, তাদের ভয়েই যে বৃষ্টি আসে না, এ তো সকলেই জানে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই লোকগুলোকে কী করা উচিত?

পদা সেদিন যেই এসেছে, আমি উচ্ছসিত হয়ে ওকে বললাম-
ওরে পদা! 'মেঘ বালিকার হবু বর' আমাকে রিকু পাঠিয়েছে!! আমার মেঘবালিকা হতে ইচ্ছে করছেএএএএএএএএএ... হব? হয়েই যাই, কী বলিস?
ছোলা ভাজা চিবোতে চিবোতে নির্বিকার মুখে পদা বলল, 'নাটক করিস না তো! তোর তো এইসব ন্যাকামি রোগ ছিল না! প্রিবর্ষা শুরু হয়ে গ্যাছে এসব আর বাড়তে দিস না বরং ওই হবু বরকে দুই থাপ্পড়ে মেঘের ওপরে তুলে দে'
ভাবুন একবার! একে বৃষ্টির মরশুম শুরু হচ্ছে হচ্ছে প্রায়...আমার মনে ময়ূর নাচছে থেকে থেকে। কবিতা কবিতা করে পাগল হয়ে উঠছি। এমন সময়ে এই রকম বেরসিক মন্তব্য শুনলে কার মাথা ঠিক থাকে! এদিকে চিরকালীন এক মন্তব্য নিয়ে ফেসবুক উত্তাল হয়ে উঠেছে। কবি মাত্রেই যেন পুরুষ, আর নারীকূল কবিতা লিখলে মহিলা কবি! এই সব নিয়ে ক্যাচাল, উপরি ক্যাচাল, আছাড়ি ক্যাচাল, পিছাড়ি ক্যাচাল শুনতে শুনতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলামযে মেয়েরা কবিতা লেখে, তাদের বখাটে মেয়ে বলে তাদের ইহকাল, পরকাল রসাতলে গিয়াছে আর যে বখাটে ছেলেরা কবিতা লেখে, তারা ইহকালে দল ভারী করে, পরকালে করে দেশের মুখোজ্জ্বল
তো এভাবেই একদিন আমারও সুযোগ এসে গেল। সেদিন সবে ঘুম থেকে উঠেছি, দেখি মোক্ষদামাসী ফোন করেছে। হাঁফাতে হাঁফাতে আমাকে বলল, ‘সে ব্যাটাচ্ছেলে তো বিয়ে কত্তে ইনকার করে দেল আমাকে। ইদিকে শুনচি নাকি কোন আবাগীর বেটির কাচে ফেঁসেছে! প্রেম কচ্চে গো তোমার পদা!’ আমি প্রায় হাত ফসকে মোবাইলটা জলে ফেলে দিচ্ছিলাম আতঙ্কে! বলে কী মাসি! সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে হবে দেখছি। তড়িঘড়ি তলব করলাম তাকে আর আসা মাত্রই চেপে ধরলাম-
-হ্যাঁরে কীসব শুনছি! তুই নাকি প্রেমে পড়েছিস! সত্যি নাকি?
-
শোন তবে! এই প্রেম বা ফ্রেম যাই বল আর ফেসবুকই বল-এসব হচ্ছে কুঁচকির লুকনো দাদের মতো। সুযোগ পেলেই চুল্কে নিতে হয়। ভাবখানা এমন যেন কেউ দেখতে পাচ্ছে না! অথচ সব্বাই দেখে মুখ আড়াল করছে।
-
ছি ছি! তুই এমন জঘন্য উপমা দিতে পারলি!! প্রেমের 'অ্যায়সি কি ত্যায়সি" হয়ে গেল।
-
অলঙ্কার এখনো আছে। পিকচার আভি বাকি হ্যায় ইয়ার!
এরপর আর কী হতে পারে বলুন! প্রায় হাতাহাতি হবার উপক্রম। এমন সময়ে লাস্ট সিনে পুলিশ আসার মতো মাদাম তুভোঁ হাজির হলেন।


মাদাম অদ্য কিঞ্চিৎ উদাসীর ন্যয় আচরণ করিতেছেন। আসিয়া বসিলেন, তথাপি কোন বাণী আভিতক্‌ শ্রুত হইল না। আমাদিগের কলহ বৃত্তান্ত এইরূপ সিচুয়েশন দেখিয়া নিস্তেজ হইয়া আসিল। মাদাম ইহারও প্রায় দশ মিনিট পরে এক বিশালাকায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন। উহার ‘ফোঁস’ শব্দ কানে আসামাত্র বোধ হইল, যেন কত বেদনা, কত অশ্রু না জানি উহাতে স্টোর হইয়া রহিয়াছিল বিগত শতক ধরিয়া। আজ আমাদিগের কলহ শুনিয়া নির্গত হইলে পর, যেন ক্ষণিকের তরে শান্তি পাইল। মাদাম তাঁহার দূরগামী দুই চক্ষু জানলার বাহিরে স্থাপন করিলেন। আর তাঁহার কণ্ঠ যেন টাইম মেশিনে চাপিয়া ফিরিয়া আসিল এই ঘরে। ‘শোন বাছারা! প্রেমের মর্ম তোমরা কেউই বোঝনি, সে তোমাদের মূর্খের আচরণ দেখেই বুঝেছি। প্রেম করা যায় না কখনও আর প্রেমে কেউ ফেঁসেও যায় না। প্রেম হল দুই আত্মার মিলন। আত্মা বোঝ, আত্মা? শরীরের ভেতরে সে থাকে বটে, কিন্তু শরীরের পরোয়াও করে না খুব একটা। তোমরা তো শরীর চেন, মনও চেন না, এমন বলছি না। দুইই চেন হয়ত। কিন্তু শরীর বা মনের প্রেম, সম্পূর্ণতা পায় না। খাঁটি প্রেম হল আত্মপ্রেম বর্জিত  দুই আত্মার প্রেম।‘ প্রায় প্রত্যহই আমাদিগের মাদামের বাণী বুঝিতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু আজ সত্য সত্যই আমরা মূর্খের মতো হাঁ করিয়া রহিলাম। মাদাম নিঃশব্দে কখন প্রস্থান করিলেন, আমরা টেরও পাই নাই।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন